হাদীসের নামে জালিয়াতি যাকাত, সিয়াম ও হজ্জ ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
(গ) হজ্জ - ১. সাধ্য হলেও হজ্জ না করলে ইহূদী বা খৃস্টান হয়ে মরা

আমাদের সমাজে অতি পরিচিত একটি হাদীস, হজ্জ বিষয়ক যে কোনো ওয়ায, আলোচনা বা লেখালেখিতে যে হাদীসটি উল্লেখ করা হয়:

مَنْ مَلَكَ زَادًا وَرَاحِلَةً تُبَلِّغُهُ إِلَى بَيْتِ اللَّهِ وَلَمْ يَحُجَّ فَلا عَلَيْهِ أَنْ يَمُوتَ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا

‘‘যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহ পৌঁছার মত পাথেয় ও বাহনের মালিক হলো, অথচ হজ্জ করল না, সে ইহূদী অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে অথবা খৃস্টান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করলে তার কোনো অসুবিধা হবে না।’’

হাদীসটির প্রসিদ্ধির অন্যতম কারণ হলো, প্রসিদ্ধ ৬টি হাদীস গ্রন্থের অন্যতম গ্রন্থ সুনান তিরমিযীতে এ হাদীসটি সংকলিত। ইমাম তিরমিযী বলেন: আমাকে মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াহইয়া বলেন, আমাদেরকে মুসলিম ইবনু ইবরাহীম বলেছেন, আমাদেরকে হেলাল ইবনু আব্দুল্লাহ বলেছেন, আমাদেরকে আবূ ইসহাক হামদানী বলেছেন, হারিস থেকে, তিনি আলী থেকে, রাসূলুল্লাহ () বলেন....। হাদীসটি উদ্ধৃত করার পরে ইমাম তিরমিযী বলেন:

هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ لا نَعْرِفُهُ إِلا مِنْ هَذَا الْوَجْهِ وَفِي إِسْنَادِهِ مَقَالٌ وَهِلَالُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ مَجْهُولٌ وَالْحَارِثُ يُضَعَّفُ فِي الْحَدِيثِ

‘‘এটি একটি গরীব হাদীস। হাদীসটি একমাত্র এ সনদ ছাড়া অন্য কোনো সূত্রে আমার জানতে পারি নি। এর সনদে আপত্তি রয়েছে। হেলাল ইবনু আব্দুল্লাহ অজ্ঞাত পরিচয়। আর হারিস হাদীস বর্ণনায় দুর্বল’’[1]

হারিস নামক এ রাবীর পূর্ণ নাম ‘হারিস ইবনু আব্দুল্লাহ আল-আ‘ওয়ার আল-হামদানী। তিনি কূফার একজন কট্টরপন্থী শিয়া ছিলেন। তিনি আলী (রা) এর সহচর ছিলেন এবং ৬৫ হিজরীর দিকে ইন্তিকাল করেন। আলী (রা) ও আহলু বাইতদের বিষয়ে অনেক জঘন্য মিথ্যা কথা তিনি বলতেন। এজন্য সমসাময়িক মুহাদ্দিসগণ এবং পরবর্তী মুহাদ্দিসগণ প্রায় সকলেই তাকে মিথ্যাবাদী ও জাল হাদীস বর্ণনাকারী বলে উল্লেখ করেছেন।

আমির ইবনু শারাহীল শা’বী বলেন, হারিস আমাকে হাদীস বলেন এবং তিনি একজন বড় মিথ্যাবাদী ছিলেন। আবূ ইসহাক সুবাইয়ী বলেন, হারিস একজন বড় মিথ্যাবাদী ছিলেন। যে সকল মুহাদ্দিস হারিসকে মিথ্যবাদী বলে উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন: ইবরাহীম নাখয়ী, শু’বা ইবনুল হাজ্জাজ, আলী ইবনুল মাদীনী, ইবনু হিববান প্রমুখ। পক্ষান্তরে ইমাম নাসাঈ, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন প্রমুখ মুহাদ্দিস হারিসকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন।[2]

এছাড়াও এ হাদীসটির সনদে আরো দুটি কঠিন দুর্বলতা রয়েছে:

প্রথম, আবূ ইসহাক মুদাল্লিস ছিলেন। এখানে তিনি বলেন নি যে, হারিস তাকে হাদীসটি বলেছেন বা তিনি তার কাছ থেকে হাদীস শুনেছেন। তার বর্ণনাভঙ্গি থেকে বুঝা যায় তিনি সরাসরি হারিস থেকে শুনেন নি।

দ্বিতীয়, হাদীসের পরবর্তী বর্ণনাকারী হিলাল ইবনু আব্দুল্লাহ অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। হাদীসটি আদৌ আবূ ইসহাক বলেছেন, নাকি এ লোকটি বানিয়ে বলছে, তা কিছুই জানার উপায় নেই।

এখানে উল্লেখ্য যে, এ অর্থে আরো কয়েকটি সনদে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সে সকল সনদের অবস্থা এ সনদের চেয়েও খারাপ। এ সকল কারণে কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ হাদীসটিকে জাল ও বানোয়াট বলে গণ্য করেছেন। পক্ষান্তরে কেউ কেউ একে যয়ীফ বলে গণ্য করেছেন। আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী সকল সনদ আলোচনা করে বলেন, রাসূলুল্লাহ () থেকে এ কথাটি কোনো গ্রহণযোগ্য সনদে বর্ণিত হয় নি। সবগুলো সনদই অত্যন্ত দুর্বল বা বাতিল। তবে সহীহ সনদে তা উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) থেকে তাঁর নিজের বক্তব্য হিসাবে বর্ণিত হয়েছে।[3]

[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/১৭৬।

[2] ইবনু হাজার, তাহযীবুত তাহযীব ২/১২৬।

[3] ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ২/১২১-১২২; ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ২/২২২-২২৩; সুয়ূতী, আল-লাআলী ২/১১৮-১১৯; ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/১৬৭; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদ ১/১৩৭-১৩৮।