ব্যবসায়িক মালের যাকাত ফরয হওয়ার দলীল

আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদের জন্য হালাল বস্ত্তর ব্যবসা হালাল করেছেন এই শর্তে যে, তারা তাদের ব্যবসায় ইসলামী বিধি-বিধান লংঘন করবে না এবং আমানতদারী ও সততা সর্বতোভাবে রক্ষা করবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)। আল্লাহ তা‘আলার হালালকৃত ব্যবসায় যে সকল মাল ক্রয়-বিক্রয় করা হয় তাতে যাকাত ফরয।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ وَلاَ تَيَمَّمُوْا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ وَلَسْتُمْ بِآخِذِيْهِ إِلَّا أَنْ تُغْمِضُوْا فِيْهِ وَاعْلَمُوْا أَنَّ اللهَ غَنِيٌّ حَمِيْدٌ-

‘হে মুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন কর এবং আমি যা ভূমি হতে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় কর এবং তার নিকৃষ্ট বস্ত্ত ব্যয় করার সংকল্প কর না; অথচ তোমরা তা গ্রহণ করবে না, যদি না তোমরা চোখ বন্ধ করে থাক। আর জেনে রেখ যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত’ (বাক্বারাহ ২/২৬৭)

অত্র আয়াতে বর্ণিত مَا كَسَبْتُمْ অর্থাৎ ‘তোমরা যা উপার্জন কর’ দ্বারা ব্যবসায়িক মালকে বুঝানো হয়েছে। ইমাম বুখারী (রহঃ) باب صَدَقَةِ الْكَسْبِ وَالتِّجَارَةِ তথা ‘উপার্জিত ও ব্যবসায়িক মালের যাকাত’ শিরোনামে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন।

আল্লাহ অন্যত্র বলেন,

وَفِيْ أَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِلسَّائِلِ وَالْمَحْرُوْمِ-

‘আর তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক’ (যারিয়াত ৫১/১৯)

তিনি অন্যত্র বলেন,

خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا-

‘তাদের সম্পদ হতে ছাদাক্বাহ্ গ্রহণ করবে। এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশোধিত করবে’ (তওবা ৯/১০৩)

উল্লিখিত আয়াত সমূহে আল্লাহ তা‘আলা সম্পদের যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। ব্যবসায়িক মাল তা থেকে আলাদা নয়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামানে পাঠালেন এবং বললেন, তারা যদি দিন-রাত্রে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতকে মেনে নেয় তাহলে তাদেরকে জানিয়ে দাও যে,

أَنَّ اللهَ افْتَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً فِيْ أَمْوَالِهِمْ، تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ وَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ-

‘আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর তাদের সম্পদের মধ্য থেকে ছাদাক্বাহ্ (যাকাত) ফরয করেছেন। যেটা ধনীদের নিকট থেকে গৃহীত হবে আর দরিদ্রের মাঝে বণ্টন করা হবে’।[1] আর ব্যবসায়িক সম্পদ হাদীছে উল্লিখিত মাল থেকে আলাদা নয়। অতএব তার উপর যাকাত ফরয।

ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,

لَيْسَ فِيْ الْعُرُوْضِ زَكَاةٌ إِلاَّ مَا كَانَ لِلتِّجَارَةِ-

‘সম্পদের যাকাত নেই, কেবল ব্যবসায়িক সম্পদ ব্যতীত।[2]

ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ) তাঁর কর্মচারী রুযাইক ইবনু হুকাইমকে লিখে পাঠিয়েছিলেন যে,

أنِ انظُرْ مَنْ مَرَّ بِكَ مِنَ المُسْلِمِيْنَ فَخُذْ مِمَّا ظَهَرَ مِنْ أَمْوَالِهِمْ مِنْ التِّجَارَاتِ من كلِّ أربعيْنَ دِيْنَاراً دِيْنَاراً-

‘তোমার সামনে যে মুসলমানই আসবে তার ব্যবসায় ব্যবহৃত সব প্রকাশমান সম্পদ থেকে প্রতি চল্লিশ দ্বীনারে এক দ্বীনার যাকাত গ্রহণ কর’।[3]

[1]. বুখারী হা/১৩৯৫, ‘যাকাত’ অধ্যায়, ‘যাকাত ওয়াজিব হওয়া’ অনুচ্ছেদ, ঐ বঙ্গানুবাদ, ২/৭৫ পৃঃ; মুসলিম হা/১৯।

[2]. সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/৭৩৯৪; আলবানী সনদ ছহীহ।

[3]. মুওয়াত্তা মালেক, হা/৮৮০।
ব্যবসায়িক মালের যাকাত ফরয হওয়ার শর্ত

(ক) যাকাত ফরয এমন দ্রব্য না হওয়া : মূলগত দিক থেকে যে দ্রব্যের যাকাত ফরয এমন বস্ত্ত না হওয়া। কেননা একই দ্রব্যের উভয় দিক থেকে বা দু’বার যাকাত আদায় করা সম্ভব নয়। যেমন- স্বর্ণ, রৌপ্য, গবাদী পশু ইত্যাদি নিছাব পরিমাণ হলে তার মালিকের উপর যাকাত ফরয। সুতরাং উল্লিখিত সম্পদ ব্যবসায়িক মালের অন্তর্ভুক্ত হলেও তার যাকাত মূলের দিক থেকেই আদায় হবে। ব্যবসায়িক দ্রব্য হিসাবে নয়।

(খ) ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য নিছাব পরিমাণ হওয়া : ব্যবসায়িক পণ্য নিছাব পরিমাণ হতে হবে। আর তা হল, ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ অথবা ৫৯৫ গ্রাম রৌপ্যের মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া।

(গ) পূর্ণ এক বছর মালিকানায় থাকা : নিছাব পরিমাণ ব্যবসায়িক পণ্য পূর্ণ এক বছর মালিকানায় থাকলেই কেবল যাকাত ফরয। অন্যথা যাকাত ফরয নয়।

দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় ব্যবসায়িক পণ্য-সামগ্রীর যাকাত

মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী যা দোকানে গচ্ছিত রেখে প্রতিনিয়ত ক্রয়-বিক্রয় করা হয়, তার যাকাত আদায় করা ফরয। আর এ সকল পণ্যের যাকাত আদায় করার জন্য মালিক তার দোকানে গচ্ছিত পণ্যের বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করে শতকরা ২.৫০ টাকা হারে যাকাত দিবেন। উল্লেখ্য যে, বিক্রয় করা হবে না এমন কোন জিনিস দোকানে থাকলে তার যাকাত আদায় করতে হবে না। যেমন ফ্রিজ যা পণ্যকে ঠান্ডা রাখার জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। অনুরূপভাবে দোকানের আসবাবপত্র যা বিক্রয় করা হয় না, তার যাকাত আদায় করতে হবে না।[1]

[1]. ছহীহ ফিকহুস সুন্নাহ ২/৫৭ পৃঃ।

আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে যতগুলো সম্পদ দান করেছেন তার মধ্যে জমি অতি মূল্যবান একটি সম্পদ। এই মূল্যবান সম্পদের কখন ও কিভাবে যাকাত আদায় করতে হবে তা নিম্নে আলোচনা করা হল :

(ক) জমি যদি বসবাস অথবা চাষাবাদের কাজে ব্যবহৃত হয় তাহলে সেই জমির কোন যাকাত আদায় করতে হবে না। বরং উক্ত জমি থেকে যে শস্য উৎপাদিত হবে তা নিছাব পরিমাণ হলে তার ওশর বা যাকাত আদায় করতে হবে।

(খ) উক্ত জমি ভাড়ায় খাটানো হলে অথবা ভাড়া দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিল্ডিং তৈরী করা হলে সেই জমির কোন যাকাত আদায় করতে হবে না। বরং তা থেকে অর্জিত নিছাব পরিমাণ অর্থ এক বছর অতিক্রম করলে শতকরা ২.৫০ টাকা হারে যাকাত দিতে হবে।

(গ) ব্যবসার উদ্দেশ্যে জমি ক্রয় করলে (সরাসরি উক্ত জমি বিক্রয় করে লাভ করার উদ্দেশ্য থাকলে) এবং তা এক বছর অতিক্রম করলে সেই জমির বর্তমান বিক্রয়মূল্য হিসাব করে শতকরা ২.৫০ টাকা হারে যাকাত দিতে হবে। উল্লেখ্য যে, উক্ত জমির বছর হিসাব করা হবে ঐ সময় থেকে, যখন থেকে তার নিকট জমি ক্রয় করার টাকা গচ্ছিত হয়েছে। এ সময় থেকে এক বছর অতিক্রম করলে উক্ত জমির বর্তমান মূল্যের শতকরা ২.৫০ টাকা হারে যাকাত প্রদান করবে। আর এক বছর অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই জমি বিক্রয় করলে বিক্রয়লব্ধ টাকা নিছাব পরিমাণ হলে তা থেকে যাকাত আদায় করবে।

অতএব মূল কথা হল, ব্যবসার উদ্দেশ্যে জমি ক্রয়-বিক্রয় করলেই কেবল সেই জমির বর্তমান বিক্রয়মূল্য হিসাব করে শতকরা ২.৫০ টাকা হারে যাকাত দিতে হবে। আর ব্যবসার উদ্দেশ্য না থাকলে সেই জমির কোন যাকাত আদায় করতে হবে না। বরং তা থেকে অর্জিত অর্থ নিছাব পরিমাণ হলে তার শতকরা ২.৫০ টাকা হারে যাকাত দিতে হবে।[1]

[1]. শরহুল মুমতে‘ ৬/১৪২-১৪৩ পৃঃ।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৪ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে