বিদআত শব্দটি আরবী البدع শব্দ থেকে গৃহীত হয়েছে। এর অর্থ হল পূর্বের কোনো দৃষ্টান্ত ও নমুনা ছাড়াই কোনো কিছু সৃষ্টি করা ও উদ্ভাবন করা। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ﴾

‘‘পূর্বের কোনো নমুনা ব্যতীত আল্লাহ তা‘আলা আকাশ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন’’। (সূরা বাকারা: ১১৭) তিনি আরো বলেন,

﴿قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِنْ الرُّسُلِ﴾

‘‘হে নবী! আপনি বলে দিন, আমি প্রথম রসূল নই’’। (সূরা আহ্কাফ: ৯)

অর্থাৎ মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে আমিই প্রথম রিসালাতের দায়িত্ব নিয়ে আসিনি; বরং আমার পূর্বে আরও অনেক রসূল আগমন করেছেন। বলা হয়ে থাকে «ابتدعة فلان بدعة» অমুক ব্যক্তি বিদআত তৈরী করেছে। অর্থাৎ এমন পথ আবিস্কার করেছে, যা পূর্বে ছিল না। ইসলামের পরিভাষায় বিদআত বলা হয় দীনের মধ্যে এমন বিষয় তৈরী করাকে, যা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে ছিল না বরং পরবর্তীতে উদ্ভাবন করা হয়েছে।

বিদআত প্রথমত দু’প্রকার: (১) পার্থিব বিষয়ে বিদআত এবং (২) দীনের ক্ষেত্রে বিদআত। পার্থিব বিষয়ে বিদআতের অপর নাম নতুন আবিষ্কৃত বিষয়। এ প্রকার বিদআত বৈধ। কেননা দুনিয়াবী সকল বিষয়ের ব্যাপারে মূলনীতি হল তা বৈধ। তবে শর্ত হলো তাতে শরঈ কোন নিষেধ না থাকা। দীনের ক্ষেত্রে বিদআত তথা নতুন কিছু উদ্ভাবন করা হারাম। কারণ দীনের ব্যাপারে মূলনীতি হল তা অহীর উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ দীনের সমস্ত বিধান কুরআন ও সুন্নাহ থেকে গ্রহণ করতে হবে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ»

যে দীনের মধ্যে নতুন কিছু তৈরী করবে যা তার অমর্ত্মভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।[1]


তিনি আরও বলেন,

«مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ»

‘‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করবে, যে বিষয়ে আমার অনুমোদন নেই, তা আমলকারীর উপর প্রত্যাখ্যাত হবে’’।[2]

দীনের মধ্যে বিদআত দু’প্রকার। (ক) বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিদআত এবং (খ) আমলের ক্ষেত্রে বিদআত।

ক) আকীদার ভিতরে বিদআত, যেমন যাহমীয়া, মু‘তাযিলা, রাফেযী এবং অন্যান্য সকল বাতিল ফির্কার আকীদাসমূহ।

খ) ইবাদতের ক্ষেত্রে বিদআত, যেমন আল্লাহ আদেশ দেননি কিংবা রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশ করেননি, এমন বিষয়ের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা। এটি আবার কয়েক প্রকার হয়ে থাকে। যেমন

(১) নতুন কোনো ইবাদত আবিষ্কার করা। এমন নতুন ইবাদত আবিষ্কার করা, ইসলামী শরী‘আতে যার কোনো ভিত্তি নেই। যেমন নতুন কোনো সালাত, সিয়াম এবং ঈদে মীলাদুন্ নবী ও অন্যান্য নামে বিভিন্ন ঈদের প্রচলন করা।

(২) শরী‘আত সম্মত ইবাদতের মধ্যে কম-বেশি করা। শরী‘আত সম্মত ইবাদতের মধ্যে কিছু বৃদ্ধি করা অথবা হ্রাস করা। যেমন কোনো ব্যক্তি আসর কিংবা যোহরের সালাত  এক রাকাত বাড়িয়ে অথবা কমিয়ে আদায় করলো।

(৩) শরী‘আত সম্মত ইবাদত বিদআতী নিয়মে পালন করা। শরী‘আত সম্মত ইবাদত বিদআতী নিয়মে পালন করা। যেমন হাদীছে বর্ণিত যিকিরের বাক্যগুলি দলবদ্ধভাবে সংগীতাকারে উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করা কিংবা ইবাদত পালনে শরীরকে এমন কষ্ট দেয়া, যা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাতের বিরোধী।

(৪) শরী‘আত সম্মত ইবাদতকে সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করা, যা শরী‘আতে নির্ধারিত নয়। শরী‘আত সম্মত ইবাদতকে এমন সময়ের সাথে নির্দিষ্ট করে আদায় করা, যা শরী‘আত নির্ধারণ করেনি। যেমন অর্ধ শাবানের দিনের বেলা রোযা রাখা এবং রাতে নির্দিষ্ট সালাত  আদায় করা। মূলত রোযা ও সালাত শরী‘আত সম্মত ইবাদত। কিন্তু ইহাকে নির্দিষ্ট সময়ের সাথে খাছ করার কোনো দলীল নেই। রোজা নির্দিষ্ট মাস এবং সালাত নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সংশিস্নষ্ট। প্রতিটি ইবাদত তার নির্ধারিত সময়ে আদায় করতে হবে। কিন্তু অর্ধ শাবানের দিনের বেলা রোজা রাখা এবং দিবাগত সারা রাত নফল সালাত  আদায় করা নিশ্চিতভাবে বিদআত। কারণ এ সম্পর্কে কোন সহীহ দলীল নেই।


[1]. সহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭ ও সহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮, সুনানে আবূ দাউদ ৪৬০৬।

[2]. সহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮।

حكم البدعة في الدين - দীনের মধ্যে বিদআতের বিধান

দীনের ব্যাপারে সকল প্রকার বিদআতই হারাম ও গোমরাহী। কেননা রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَة»

‘‘তোমরা দীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতের পরিণাম গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা’’।[1] রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ»

‘‘যে ব্যক্তি আমাদের দীনের মধ্যে এমন নতুন বিষয় তৈরী করবে, যা তার অন্তর্গত নয়, তা প্রত্যাখ্যত হবে’’।[2] তিনি আরও বলেন,

«مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ»

‘‘যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করবে, যার মধ্যে আমাদের আদেশ নেই, তা আমলকারীর উপর প্রত্যাখ্যাত হবে’’।[3]

উপরের হাদীছগুলোর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয় যে, দীনের মধ্যে প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতই হারাম ও গোমরাহী। তবে এ হারাম বিদআতের প্রকারভেদ অনুযায়ী বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। বিদআতের কিছু কিছু প্রকার প্রকাশ্য কুফুরীর নামান্তর। যেমন কবরবাসীদের নৈকট্য হাসিলের উদ্দেশ্যে কবরের চতুর্দিকে কাবা ঘরের তাওয়াফের ন্যায় তাওয়াফ করা, কবরের উদ্দেশ্যে পশু যবাই করা, নযর-মান্নত পেশ করা, কবরবাসীর কাছে দু’আ করা, তাদের কাছে আশ্রয় চাওয়া ইত্যাদি। এমন কিছু বিদআতও রয়েছে, যা শিরক না হলেও মানুষকে শিরকের দিকে নিয়ে যায়। যেমন কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করা, কবর উঁচু করা, পাকা করা, কবরের উপর কিছু লেখা, কবরের কাছে সালাত  আদায় করা, দু’আ করা ইত্যাদি। এমন কিছু বিদআতও আছে, যা শিরক বা তার মাধ্যমও নয়, তবে সঠিক আকিদার পরিপন্থী ও বহির্ভুত। যেমন খারেজী, কাদরীয়া ও মুর্জিয়াদের আকিদাহ সমূহ। তা ছাড়া এমন কিছু বিদআত রয়েছে, যা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত যেমন বৈরাগী হয়ে সংসার ত্যাগ করা, সূর্য্যের উত্তাপে দাড়িয়ে রোজা পালন করা এবং যৌন উত্তেজনা দমন করার জন্য খাসী হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।


[1]. সহীহ: আবু দাউদ, হা/৪৬০৭।

[2]. সহীহ বুখারী, হা/২৬৯৭ ও সহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮, সুনানে আবূ দাউদ ৪৬০৬।

[3]. সহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮।

আমাদের দেশের কিছু কিছু আলেম বিদআতকে হাসানা এবং সাইয়্যেআ, এ দুই শ্রেণীতে ভাগ করে থাকে। বিদআতকে এভাবে ভাগ করা সম্পূর্ণ ভুল এবং রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীছের সম্পূর্ণ বিপরীত। রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা। আর এই শ্রেণীর আলেমগণ বলে থাকে, প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী নয়। বরং এমন কিছু বিদআত রয়েছে, যা হাসানা বা উত্তম বিদআত।

হাফেয ইবনে রজব (রহি.) বলেন, ‘‘প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী’’ এটি খুব সংক্ষিপ্ত একটি বাক্য হলেও তার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক ও পরিপূর্ণ। এখানে প্রতিটি বিদআতকেই গোমরাহী বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদআতের কোন প্রকারকেই হাসানা বলেননি। এই হাদীছটি দীনের অন্যতম মূলনীতির অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহর রসূলের বাণী ‘‘যে ব্যক্তি আমাদের দীনের মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করল, যা আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত। অতএব যে ব্যক্তি কোন নতুন বিধান রচনা করে দীনের মাঝে প্রবেশ করিয়ে দিবে, তা গোমরাহী বলে বিবেচিত হবে। তা থেকে দীন সম্পূর্ণ মুক্ত। চাই সে বিষয়টি বিশ্বাসগত বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হোক অথবা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য আমলগত বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত হোক। সুতরাং বিদআতে হাসানার পক্ষে মত প্রকাশকারীদের কোন দলীল নেই। কিছু লোক তারাবীর নামাযের ব্যাপারে উমার (রা.)এর উক্তি, এটি কত উত্তম বিদআত! এ কথাটিকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। তারা আরও বলেন, এমন অনেক বিদআত আবিষ্কৃত হয়েছে, যা সালাফে সালেহীনগণ সমর্থন করেছেন। যেমন গ্রন্থাকারে কুরআন একত্রিত করণ, হাদীছ সঙ্কলন করণ ইত্যাদি।

উপরোক্ত যুক্তির উত্তর এ যে, শরী‘আতের ভিতরে এ বিষয়গুলোর মূলভিত্তি রয়েছে। এ গুলো নতুন কোন বিষয় নয়। উমার (রা.) এর কথা, ‘‘এটি একটি উত্তম বিদআত’’ এর দ্বারা তিনি বিদআতের শাব্দিক অর্থ গ্রহণ করেছেন। ইসলামের পরিভাষায় যাকে বিদআত বলা হয়, সে অর্থ গ্রহণ করেননি। মৌলিকভাবে ইসলামী শরী‘আতে যে বিষয়ের অস্তিত্ব রয়েছে, তাকে বিদআত বলা হয়নি। এমন বিষয়কে যদি বিদআত বলা হয়, তার অর্থ দাড়ায় জিনিসটি শাব্দিক অর্থে বিদআত, পারিভাষিক অর্থে বিদআত নয়। সুতরাং শরী‘আতের পরিভাষায় এমন বিষয়কে বিদআত বলা হয়, যার পক্ষে কোনো দলীল-প্রমাণ নেই।

আর গ্রন্থাকারে কুরআন সংকলনের পক্ষে দলীল রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের আয়াতসমূহ লেখার আদেশ দিয়েছেন। তবে এই লেখাগুলো এক স্থানে একত্রিত অবস্থায় ছিল না। তা ছিল বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। সাহাবীগণ তা এক গ্রন্থে একত্রিত করেছেন। যাতে কুরআনের যথাযথ হেফাযত করা সম্ভব হয়।

তারাবীর নামাযের ব্যাপারে সঠিক কথা হল, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সাহাবীদেরকে নিয়ে জামা‘আত বদ্ধভাবে কয়েক রাত পর্যন্ত তারাবীর সালাত  আদায় করেছেন। ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় পরবর্তীতে তা ছেড়ে দিয়েছেন। আর সাহাবীগণের প্রত্যেকেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবিত থাকা কালে ও মৃত্যুর পর একাকী এ সালাত আদায় করেছেন। পরবর্তীতে উমার (রা.) সবাইকে এক ইমামের পিছনে একত্রিত করেছেন, যেমনিভাবে তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পিছনে তার ইমামতিতে এ সালাত  আদায় করতেন। তাই ইহা বিদআত নয়।

হাদীছ লিখিতভাবে সংরক্ষণের ব্যাপারেও দলীল রয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কতিপয় সাহাবীর জন্য তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাদীছ লিখে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন। বিদায় হজ্জের ভাষণ দেয়ার পর আবু শাহ নামক জনৈক সাহাবী রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে ভাষণটি লিখে দেয়ার আবেদন করলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, «اكتبوا لأبى شاه» অর্থাৎ আবু শাহের জন্য আমার আজকের ভাষণটি লিখে দাও। তবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর যুগে সুনির্দিষ্ট কারণে ব্যাপকভাবে হাদীছ লেখা নিষেধ ছিল। যাতে করে কুরআনের সাথে হাদীছ মিশ্রিত না হয়ে যায়। পরবর্তীতে যখন তিনি ইমেত্মকাল করলেন এবং কুরআনের সাথে হাদীছ মিশ্রিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দূরিভুত হলো, তখন মুসলমানগণ হাদীছ সংরক্ষণ করে রাখার জন্য তা লেখা র কাজে  আত্মনিয়োগ করেছেন। যারা এ মহান কাজে আঞ্জাম দিয়েছেন, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা উত্তম বিনিময় দান করুন। কারণ তারা আল্লাহর কিতাব এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতকে বিলুপ্তির আশঙ্কা থেকে হেফাজত করেছেন।

الفصل الثاني: ظهور البدع في حياة المسلمين - দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ: মুসলিম সমাজে বিদআত প্রকাশিত হওয়া

এতে দু’টি মাস‘আলা রয়েছে

(১) বিদআত প্রকাশের সময়: শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রহি.) বলেন, খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগের শেষের দিকে মুসলিম জাতির আকীদা ও আমলের ক্ষেত্রে অধিকাংশ বিদআতের প্রকাশ ঘটেছে। যার সংবাদ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আগেই আমাদেরকে প্রদান করেছেন এবং বিদআত থেকে মুসলিম জাতিকে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন,

«عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ»

‘‘আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা সে সময় আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরবে তোমরা দীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতের পরিণাম গোমরাহী’’।[1]

বিদআতী ফির্কাসমূহের মধ্যে কাদরীয়া, মুর্জিয়া, শিয়া এবং খারেজী সম্প্রদায়ের বিদআত সর্বপ্রথম হিজরী দ্বিতীয় শতকে প্রকাশ পায়। এ সময় সাহাবীদের অনেকেই জীবিত ছিলেন। তারা এ সমস্ত বিদআতের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। অতঃপর মু‘তাযিলা সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। যার ফলে মুসলমানদের মাঝে অসংখ্য ফিতনা-ফাসাদের সৃষ্টি হয়। মুসলিম জাতির বিরাট এক অংশ বিদআতী মতবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অতঃপর সম্মানিত সাহাবীদের যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর সূফীবাদ নামে আরেক নতুন মতবাদ দেখা দেয়। পর্যায়ক্রমে কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ, কবর পাকা করা ও কবর কেন্দ্রিক অসংখ্য বিদআতের প্রকাশ ঘটে। এভাবে সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বিদআতের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং বিভিন্ন আকার ধারণ করতে থাকে।

২) বিদআত প্রকাশের অঞ্চল সমূহ:

বিদআত প্রকাশের দিক দিয়ে ইসলামী অঞ্চলগুলো কয়েক ভাগে বিভক্ত। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবীগণ মোট পাঁচটি শহরে বসবাস করতেন। এ সমস্ত দেশ থেকে ঈমানের আলো বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। শহর পাঁচটি হলো মক্কা, মদীনা, বসরা, কুফা ও শাম (সিরিয়া)। এ সমস্ত দেশ থেকে কুরআন, হাদীছ, ফিক্হ ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা বিস্তার লাভ করেছে।

পরবর্তীতে মক্কা মুকার্রামা ও মদীনা মুনাওয়ারা ব্যতীত বাকি স্থানগুলো থেকেই বড় বড় বিদআত বের হয়েছে। কুফা নগরী থেকে বের হয়েছে শিয়া ও মুর্জিয়াদের বিদআতী কথা ও মতবাদ। অতঃপর তা অন্যান্য অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বসরা শহর থেকে কাদরীয়া ও মু‘তাযিলাদের বিদআতসহ বিভিন্ন ভ্রান্ত ইবাদতের আবির্ভাব হয়ে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

সিরিয়া থেকে বের হয় আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের প্রতি ঘৃণা ও তাঁদের সম্মানে কালীমা লেপনকারীদের বিদআতী কথা-বার্তা। জাহ্মীয়াদের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে খোরাসানের সীমান্তবর্তী কোন এক অঞ্চলে। আর এটি হল সর্বনিকৃষ্ট বিদআত। যে দেশ রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মদীনা থেকে যত দূরে অবস্থিত, সেখানকার বিদআতও তত ভয়াবহ ও জঘন্য। উছমান (রা.) এর শাহাদাত বরণের পরপরই বের হয়েছে খারেজী সম্প্রদায় ও তাদের বিদআতসমূহ। তবে রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শহর মদীনা এ সমস্ত বিদআত থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিল। যদিও কোন কোন লোক মদীনাতে অবস্থান করেও গোপনে কিছু কিছু বিদআতী আকীদা পোষণ করতো। কিন্তু তারা অপমানিত অবস্থায় মদীনা বাসীদের সাথে বসবাস করতো। মদীনাতে তাদের সামাজিক কোন প্রভাব ও মূল্য ছিল না। একদল কাদরীয়া মতবাদের লোক মদীনাতে লাঞ্ছিত অবস্থায় বসবাস করতো। অপর দিকে কুফায় শীয়া ও মুর্জিয়া, বসরায় মু‘তাযিলা ও বিদআতী নিয়মে ইবাদতকারীদের দল এবং সিরিয়ায় নাসীবীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রকাশ্যে বিদআতের চর্চা করতো। সহীহ বুখারীতে রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত আছে, আখেরী যামানায় দাজ্জালের ফিতনা মদীনাতে প্রবেশ করতে পারবে না।

ইমাম মালেক (রহি.) এর সময়কাল পর্যন্ত মদীনাতে ইলম ও ঈমানের শিক্ষা বর্তমান ছিল। সম্মানিত তিন যুগে মদীনাতে বিদআতের নাম-নিশানা ছিল না। দীনের মৌলিক বিশ্বাসে আঘাতকারী কোন বিদআতও বের হয়নি। যেমনটি বের হয়েছে অন্যান্য শহর থেকে।  


[1]. আবু দাউদ হা/৪৬০৭, অধ্যায়: কিতাবুস্ সুন্নাহ, তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুল ইল্ম। ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীছটি হাসান সহীহ। মুসনাদে আহমাদ, (৪/১২৬), মাজমূ‘ ফাতাওয়া (১০/৩৫৪)।

الفصل الثالث: الأسباب التي أدت إلى ظهور البدع - তৃতীয় পরিচ্ছেদ: মুসলিম সমাজে বিদআত প্রকাশের কারণসমূহ

নিঃশর্তভাবে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের অনুসরণই বিদআত ও সকল প্রকার গোমরাহী থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ﴾

‘‘এটিই আমার সঠিক পথ। সুতরাং তোমরা এই সঠিক পথের অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের দিকে গমণ করো না। তাহলে সে সব পথ তোমাদেরকে আল্লাহর সঠিক পথ হতে বিপথগামী করে দিবে’’। (সূরা আল আন‘আম: ১৫৩)

আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) এর বর্ণিত হাদীছে (সনদ হাসান: সুনানে দারেমী) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতের অর্থকে অতি সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,

«خَطَّ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا خَطًّا ثُمَّ قَالَ هَذَا سَبِيلُ اللَّهِ ثُمَّ خَطَّ خُطُوطًا عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ ثُمَّ قَالَ -هَذِهِ سُبُلٌ عَلَى كُلِّ سَبِيلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ ثُمَّ تَلَا ﴿وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ﴾

‘‘রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সামনে মাটিতে একটি রেখা টানলেন। সে রেখার উপর হাত রেখে বললেন, এটি হল আল্লাহর পথ। অতঃপর সে রেখার ডানে ও বামে আরো অনেকগুলো রেখা অঙ্কন করে বললেন, এ সবগুলোই পথ। তবে এ সব পথের মাথায় একটি করে শয়তান দাঁড়িয়ে আছে। সে সর্বদা মানুষকে ঐ পথের দিকে আহবান করছে। এ কথা বলার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেন,

﴿وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ﴾

‘‘এটিই আমার সঠিক পথ। সুতরাং তোমরা এই সঠিক পথের অনুসরণ করো। অন্যান্য পথের অনুসরণ করোনা। তাহলে সে সব পথ তোমাদেরকে আল্লাহর সঠিক পথ হতে বিপদগামী করে দিবে’’। (সূরা আল আন‘আম: ১৫৩) সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাতের পথ থেকে বিমুখ হবে, বিদআতী ও ভ্রান্ত পথগুলো তাকে নিজের দিকে টেনে নিবে।

যে সমস্ত কারণে মুসলিম জাতির ভিতরে বিদআতের উৎপত্তি হয়েছে, সে কারণগুলো সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে আলোচনা করা হলো

১. দীনের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে অজ্ঞতা: সময় যতই অতিবাহিত হয়েছে এবং মানুষ যখনই নবুওয়াতের শিক্ষা থেকে দূরে অবস্থান করেছে, তখনই ইসলাম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের কমতি দেখা দিয়েছে এবং মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ»

‘‘আমার পরে তোমাদের মধ্য থেকে যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরবে। তোমরা দীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতের পরিণাম ভ্রষ্টতা।[1] তিনি আরও বলেন,

«إِنَّ اللَّهَ لَا يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا»

‘‘আল্লাহ মানুষের অন্তর থেকে ইলমকে টেনে বের করে নিবেন না। বরং আলেমদেরকে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নিবেন। শেষ পর্যন্ত যখন কোনো আলেম জীবিত থাকবে না, মানুষেরা তখন মূর্খদেরকে নিজেদের নেতা নির্বাচন করবে। তাদেরকে দীনের কোনো বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে বিনা ইলমেই তারা ফতোয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হওয়ার সাথে সাথে মানুষদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে’’।[2]

দীনের সঠিক জ্ঞান ও জ্ঞানী লোক ব্যতীত বিদআতের মুকাবেলা করার মত কোনো শক্তি নেই। যখন জ্ঞান ও জ্ঞানীগণ উঠে যাবেন, তখন বিদআত ও বিদআতীদের পক্ষে সুযোগ সৃষ্টি হবে।

২. প্রবৃত্তির অনুসরণ: এটাই স্বাভাবিক যে, কোন লোক যখন আল্লাহর কিতাব ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত থেকে বিমুখ হবে, তখন সে আপন প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنْ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

‘‘অতঃপর তারা যদি আপনার কথায় সাড়া না দেয়, তবে জেনে নিন যে, তারা শুধু নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, আল্লাহর হেদায়াতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তারচেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে আছে? নিশ্চয় আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সঠিক পথ দেখান না’’। (সূরা ক্বছাছ: ৫০) আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿أَفَرَأَيْتَ مَنْ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللَّهِ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ﴾

‘‘তুমি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছো? যে তার খেয়াল-খুশীকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে? আল্লাহ জেনে শুনে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মোহর এঁটে দিয়েছেন। আর তার চোখের উপর রেখেছেন পর্দা। অতএব আল্লাহর পর কে তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবে? অতএব তোমরা কি চিন্তা-ভাবনা করো না?’’ (সূরা আল-জাসিয়া: ২৩) সুতরাং খেয়াল-খুশির অনুসরণ বিদআতের পথকে উন্মুক্ত করে।

৩. আলেমদের অন্ধ অনুসরণ: আলেম ও পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ মানুষকে দলীল-প্রমাণের অনুসরণ এবং সত্য জানার আগ্রহ ও তা কবুল করার পথে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ﴾

‘‘যখন তাদেরকে বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার অনুসরণ করো, তখন তারা বলে থাকে আমরা বরং আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে যে বিষয়ের উপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করবো। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জানতো না এবং সত্য পথ প্রাপ্তও ছিল না’’। (সূরা আল বাকারা: ১৭০)

বর্তমান যুগের কতক মাযহাবপন্থী, সূফী ও কবর পুজারীদের একই অবস্থা। তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাতের দিকে ডাকা হলে এবং কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আমলসমূহ বর্জন করতে বলা হলে তারা তাদের মাযহাব, মাশায়েখ এবং বাপ-দাদার দোহাই দেয়।

৪. কাফের-মুশরেকদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা: বিধর্মী কাফের-মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্য রাখা নতুন নতুন বিদআত সৃষ্টির বিরাট একটি কারণ। আবু ওয়াকেদ আল-লাইছী (রা.) এর হাদীছে এ কথার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে হুনাইন যুদ্ধের জন্য বের হলাম। আমরা ছিলাম নব মুসলিম। আমরা দেখলাম মুশরিকদের জন্য একটি বড়ই গাছ রয়েছে। তারা বরকত লাভের আশায় নিজেদের অস্ত্র ঐ গাছে ঝুলিয়ে রাখে। গাছটির নাম ছিল যাতু আনওয়াত অর্থাৎ বরকতময় বৃক্ষ। আমরা সে গাছটির নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় বললাম, হে আল্লাহর রসূল! তাদের যেমন বরকতময় বৃক্ষ রয়েছে, আমাদের জন্যও একটি বরকতময় বৃক্ষ নির্ধারণ করে দিন। যাতে আমরা যুদ্ধের অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখবো এবং বরকত হাসিল করবো।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কথা শুনে বললেন, ‘‘আল্লাহু আকবার’’ নিশ্চয়ই এটি একটি পথ। ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন, তোমরা এমন রীতি-নীতির কথা বললে যেমনটি বলেছিল বনী ইসরাইল সম্প্রদায় আল্লাহর নবী মূসা (আ.) কে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قَالُوا يَامُوسَى اجْعَل لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ﴾

‘‘তারা বলেছিল, হে মূসা! তাদের জন্য যেমন মাবূদ রয়েছে, আমাদের জন্যও অনুরূপ একটি মাবূদ নির্ধারণ করে দিন। মূসা (আ.) বললেন, নিশ্চয় তোমরা একটি মূর্খ জাতি’’। (সূরা আল আরাফ: ১৩৮)

অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা তো দেখছি অবশ্যই অতীত জাতিসমূহের পথের অনুসরণ করবে।[3]

এই হাদীছের মাধ্যমে সুস্পষ্ট জানা যায় যে, কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য করাই বনী ইসরাঈল ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কতিপয় সাথীদেরকে তাদের নবীর কাছে এরকম একটি জঘন্য আবদার করতে উৎসাহিত করেছিল। বনী ইসরাঈলের লোকেরা মূসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন করেছিল, তাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য একটি মাবূদ নির্ধারণ করে দেয়া হোক, তারা সে মাবূদের ইবাদত করবে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তা থেকে বরকত হাসিল করবে।

বর্তমানেও একই অবস্থা লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ মুসলিম বিদআত ও শিরকী কর্মসমূহে কাফের-মুশরেকদের অনুসরণ করে চলেছে। যেমন ঈদে মীলাদুন্ নবী, বিভিন্ন ঘটনা উপলক্ষে বিশেষ দিন ও সপ্তাহ পালন করা, ধর্মীয় বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান পালন করা, নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিমূর্তি তৈরী করা, স্মৃতিচিহ্ন ও ভাষ্কর্য স্থাপন করা, মাতম করা, মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রকার বিদআতের প্রচলন করা, কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা ইত্যাদি।


[1]. সহীহ: আবু দাউদ, হা/ ৪৬০৭, মুসনাদে আহমাদ।

[2]. সহীহ বুখারী, হা/১০০।

[3]. সহীহ: সুনানে তিরমিযী, হা/২১৮০।

الفصل الرابع: موقف الأمة الإسلامية من المبتدعة - চতুর্থ পরিচ্ছেদ: বিদআতীদের ব্যাপারে মুসলিম মিল্লাতের আলেমদের অবস্থান

যুগে যুগে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ বিদআতীদের বিদআতী কার্য-কলাপের সামনে কখনই চুপ থাকেননি। বরং সব সময়ই তারা প্রতিবাদ করেছেন এবং তাদের কর্মকান্ডে বাঁধা দিয়ে এসেছেন। সাহাবীদের যুগ থেকেই বিদআতীদের প্রতিবাদের সূচনা হয়েছে। পাঠক সমীপে এসম্পর্কে কতিপয় দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো:

১. উম্মে দারদা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আবু দারদা রাগান্বিত অবস্থায় একদা আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। আমি বললাম, ব্যাপার কি? তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! জামা‘আতে সালাত আদায় করা ব্যতীত মুসলমানদের মধ্যে আমি নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।[1]

২. আমর ইবনে ইয়াহইয়া হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমার পিতাকে আমার দাদা হতে বর্ণনা করতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমরা একবার ফজরের সালাতের পূর্বে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) এর ঘরের দরজার সামনে বসা ছিলাম। উদ্দেশ্য হলো, তিনি যখন বের হবেন, আমরা তার সাথে পায়ে হেঁটে মসজিদের দিকে যাত্রা করবো। এমন সময় আমাদের কাছে আবু মূসা আশআরী (রা.) আগমন করে বললেন, আবু আব্দুর রাহমান (ইবনে মাসউদের উপনাম) কি বের হয়েছেন? আমরা বললাম, এখনও বের হননি। তিনিও আমাদের সাথে বসে গেলেন। তিনি যখন বের হলেন, আমরা সকলেই তার কাছে গেলাম। আবু মূসা আশআরী (রা.) বললেন, হে আবু আব্দুর রাহমান! আমি মসজিদে এখনই একটি নতুন বিষয় দেখে আসলাম। আলহামদুলিল্লাহ্‌, এতে খারাপ কিছু দেখিনি। ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন সেটি কী? আবু মূসা (রা.) বললেন, আপনার হায়াত দীর্ঘ হলে আপনিও তা দেখতে পাবেন। আবু মূসা আশআরী (রা.) বললেন, আমি দেখলাম, মসজিদে একদল লোক গোলাকারে বসে সালাতের অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক দলের মাঝখানে একজন লোক রয়েছে। আর সবার হাতে রয়েছে ছোট ছোট পাথর। মাঝখানের লোকটি বলছে, একশত বার আল্লাহু আকবার পাঠ করো। এতে সবাই একশতবার আল্লাহ আকবার পাঠ করছে। তারপর বলে, একশতবার আল-হাম্দুলিল্লাহ পাঠ করো। এ কথা শুনে সবাই একশতবার আল-হাম্দুলিল্লাহ পাঠ করছে। তারপর লোকটি বলে, এবার একশতবার সুবহানাল্লাহ্ পাঠ করো। সবাই একশতবার সুবহানাল্লাহ্ পাঠ করে। এ কথা শুনে ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তুমি তাদেরকে তাদের পাপের কাজগুলো গণনা করে রাখতে বললে না কেন? আর দায়িত্ব নিলে না কেন যে, তাদের নেকীর কাজগুলো থেকে একটি নেকীও নষ্ট হবে না। কাজেই এগুলো হিসাব করে রাখার কোন দরকার নেই।

অতঃপর ইবনে মাসউদ (রা.) চলতে থাকলেন। আমরাও তার সাথে চললাম এবং একটি হালাকার কাছে এসে উপস্থিত হলাম। তিনি তাদের কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, একি করছো তোমরা? তারা সকলেই বলল, পাথরের মাধ্যমে গণনা করে আমরা তাকবীর, তাসবীহ্ ইত্যাদি পাঠ করছি। ইবনে মাসউদ (রা.) বললেন, তাহলে তোমরা তোমাদের পাপের কাজগুলোর হিসাব করো। কারণ পাপের কাজগুলো হিসাব করে তা থেকে তাওবা করা দরকার। আমি এ ব্যাপারে জিম্মাদার হলাম যে তোমাদের ভালো কাজগুলোর একটিও নষ্ট হবে না। এ কথা বলার কারণ এই যে আল্লাহর কাছে কারও আমল বিনষ্ট হয় না। বরং একটি আমলের বিনিময়ে দশটি ছাওয়াব দেয়া হয় এবং দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়।[2]

তারপর তিনি বললেন, হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উম্মত! অমঙ্গল হোক তোমাদের! কিসে তোমাদেরকে এত তাড়াতাড়ি ধ্বংস করলো? এখনও নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অসংখ্য সাহাবী জীবিত আছেন। এই তো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাপড়-চোপড় এখনও পুরাতন হয়নি। তার ব্যবহৃত থালা-বাসনগুলো এখনও ভেঙ্গে যায়নি। ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা যে দীন তৈরী করেছ তা কি মুহাম্মাদের দীন হতে উত্তম? না কি তোমরা গোমরাহীর দ্বার উম্মুক্ত করেছো? তারা বলল, হে আবু আব্দুর রাহমান! আমরা এর মাধ্যমে কল্যাণ ছাড়া অন্য কোনো ইচ্ছা করিনি। তিনি বললেন অনেক কল্যাণকামী আছে, সে তার কল্যাণ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না।

আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন যে, একটি দল কুরআন তেলাওয়াত করবে, কিন্তু কুরআন তাদের গলদেশে প্রবেশ করবে না। আল্লাহর শপথ করে বলছি, মনে হয় তাদের অধিকাংশই তোমাদের মধ্য থেকে বের হবে। অতঃপর ইবনে মাসউদ (রা.) তাদেরকে ছেড়ে চলে আসলেন। আমর ইবনু সালামা (রা.) বলেন, আমরা তাদের অধিকাংশকেই দেখলাম, নাহ্রাওয়ানের যুদ্ধে খারেজীদের সাথে আমাদের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়েছে।[3]

৩. একজন লোক ইমাম মালেক (রহি.) এর নিকট আগমন করে বলল, আমি কোথা হতে ইহরাম বাঁধব? তিনি বললেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইহরাম বাঁধার জন্য যে সমস্ত স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেখান থেকে ইহরাম বাঁধো। লোকটি বলল, আমি যদি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্ধারিত স্থান থেকে আরেকটু দূর হতে ইহরাম বাঁধি, তাহলে কি বৈধ হবে না? ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ বললেন, আমি ইহাকে বৈধ মনে করি না। সে বলল, আপনি ইহার মধ্যে অপছন্দের কি দেখলেন? তিনি বললেন, আমি তোমার উপর ফিত্নার আশঙ্কা করছি। সে বলল, ভালো কাজ বেশি করে করার ভিতর ফিত্নার কি আছে? ইমাম মালেক লোকটির এ কথা শুনে বললেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

‘‘অতএব, যারা তার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিতনা তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে’’। (সূরা আন নূর: ৬৩)

এর চেয়ে বড় মুছীবত আর কি হতে পারে যে, তুমি এমন একটি ফযীলতের মাধ্যমে নিজেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করতে চাচ্ছ, যার মাধ্যমে স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেননি।[4]


[1]. সহীহ বুখারী, হা/৬৫০

[2]. অনুবাদক।

[3]. তিরমিযী।

[4]. ইমাম মালেক থেকে আরেকটি প্রসিদ্ধ কথা বর্ণিত: একদা এক বিদআতী লোক তার মজলিসে প্রবেশ করে বলল,

﴿الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى﴾

‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপর সমুন্নত’’। (সূরা ত্বহা: ৫) সে বললো আল্লাহ কিভাবে আরশে সমুন্নত হলেন? জবাবে ইমাম মালেক (রহি.) বললেন,

الاستواء معلوم والكيف مجهول والإيمان واجب والسوال عنه بدعة

অর্থাৎ ইস্তিওয়া তথা সমুন্নত হওয়া একটি জানা বিষয়, পদ্ধতি অজানা, এর উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব এবং এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদআত। প্রশ্নকারী এই জবাবে সন্তুষ্ট না হওয়ায় তাকে ইমাম মালেক (রহি.) এর মজলিস থেকে বের করে দেয়া হল।

বিদআতের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে সালাফদের থেকে এমনি আরো অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ কয়েকটি উদাহরণই পাঠক সমাজের জন্য পেশ করা হল। আশা করি এতেই যথেষ্ট হবে।

الفصل الخامس: منهج أهل السنة والجماعة في الرد على البدع - পঞ্চম পরিচ্ছেদ: বিদআতীদের প্রতিবাদে আলেমগণের পদ্ধতি

বিদআতীদের প্রতিবাদে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমদের পদ্ধতি হলো তারা এ ব্যাপারে আল্লাহর কিতাব ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের উপর নির্ভর করে থাকেন। আর এটিই হল সঠিক ও সন্তোষজনক পদ্ধতি। তারা বিদআতীদের কথাগুলো প্রথমে বর্ণনা করেন। তারপর একটি একটি করে সেগুলো খন্ডন করে থাকেন। সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা ওয়াজিব এবং বিদআত থেকে বিরত থাকা জরুরী, এবিষয়ে তারা কুরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণাদি উপস্থিত করে থাকেন।

বিদআতীদের প্রতিবাদে তারা অসংখ্য বই-পুস্তক রচনা করেছেন। ইসলামের আকীদার উপর লিখিত তাদের কিতাবগুলোতে তারা খারেজী, যাহমীয়া, মু‘তাযিলা এবং আশায়েরা সম্প্রদায়ের আকীদা বিষয়ক বিদআতী কথাগুলোর জবাব দিয়েছেন। এব্যাপারে তারা বিশেষ গ্রন্থও রচনা করেছেন। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রহি.) যাহমীয়াদের উত্তরে الرد على الجهمية নামক কিতাব লিখেছেন। অন্যান্য ইমামগণও বিভিন্ন ফির্কার লোকদের উত্তরে বিভিন্ন কিতাব রচনা করেছেন। তাদের মধ্যে উছমান ইবনে সাঈদ দারেমীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া, তার সুযোগ্য ছাত্র ইবনুল কাইয়িম, শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব এবং অন্যান্য আলেমগণ উপরোক্ত বাতিল ফির্কার লোকদের কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। তারা কবরপূঁজারী, সূফীদেরও প্রতিবাদ করেছেন।

বিদআতীদের প্রতিবাদে খাস করে যেসব কিতাব রচিত হয়েছে, তার সংখ্যা অনেক। নিম্মে উদাহরণ স্বরূপ কয়েকটি কিতাবের নাম উল্লেখ করা হলো,

পূরাতন লেখনীগুলোর মধ্যে রয়েছে।

(১) ইমাম শাতেবী রচিত আল-ইতেসাম।

(২) ইকতেজাউস্ সিরাতিল মুসতাকীম: কিতাবটি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়া (রহি.) রচিত। কিতাবের বিরাট অংশ জুড়ে তিনি বিদআতীদের প্রতিবাদ করেছেন।

(৩) ইনকারুল হাওয়াদেছ ওয়াল বিদাই, রচনায় ইবনে ওয়াজ্জাহ।

(৪) আল হাওয়াদেছ ওয়াল বিদাই: তারতুসী

(৫) আবু শামা কর্তৃক রচিত আল বা-ইছু আলা ইনকারিল বিদ্আহ্ ওয়াল হাওয়াদেছ।

(৬) মিনহাজুস্ সুন্নাহ আন্ নাববীয়াহ: শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ)। এতে তিনি রাফেযী এবং কাদরীয়া ফির্কার প্রতিবাদ করেছেন।

বর্তমান যুগে বিদআতীদের প্রতিবাদে যেসমস্ত কিতাব রচিত হয়েছে:

(১) শাইখ আলী মাহফুয কর্তৃক সংকলিত আল ইবদা’উ ফী মাযার্রিল ইবতিদা।

(২) শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ আশ্-শুকাইরী আল-হাওয়ামেদী কর্তৃক রচিত আস্ সুনানু ওয়াল মুবতাদাআহ ওয়াল মুতাআল্লাকাতু বিল আযকার ওয়াস্ সালাওয়াত

(৩) শাইখ ইবনে বায রাহিমাহুল্লাহ কর্তৃক রচিত আত্-তাহযীরু মিনাল বিদা। এ কিতাবটি বাংলাভাষায় অনুবাদ হয়েছে।

আলহামদুলিল্লাহ্‌! সর্বযুগের আলেমগণই লেখনী, ভাষণ, জুমআর খুৎবা, প্রচার মাধ্যম, পত্রিকা, রেডিও, সেমিনার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদআত ও বিদআতীদের প্রতিবাদ করে আস‎ছেন। এসব কর্ম তৎপরতা মুসলমানদের সজাগ করণে এবং বিদআতের মূলৎপাটনে যথেষ্ট ভূমিকা রেখে চলেছে।

الفصل السادس: بيان نماذج من البدع المعاصرة - ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ: সমকালীন বহুল প্রচলিত কতিপয় বিদআতের উদাহরণ

সময় অতিক্রম, দীনী ইলমের স্বল্পতা, বিদআতের দিকে আহবানকারীর সংখ্যাধিক্য, ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ এবং কাফেরদের আচার-আচরণের সাথে সাদৃশ্য করণ ইত্যাদি কারণে বর্তমানে বিদআতের সয়লাব বয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে রসূল সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণী বাস্তবায়িত হয়েছে, তিনি বলেছেন,

«لَتَتْبَعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ»

‘‘তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী জাতিসমূহের সুন্নাতের অনুসরণ করবে’’।[1]

সমকালীন বিদআত সমূহের মধ্যে থেকে নিম্নে আমরা কতিপয় বিদআতের আলোচনা করব।

  • নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম উপলক্ষে ঈদে মীলাদুন্ নবী পালন করা।
  • কবর, মাযার ও বিভিন্ন স্থান থেকে বরকত লাভ করা।
  • ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের ক্ষেত্রে নতুন নতুন ইবাদত তৈরী করা।

[1]. সহীহ বুখারী, হা/৭৩২০, ইবনে মাজাহ, হা/৩৯৯৪।

أولا: الاحتفال بمناسبة المولد النبي في ربيع الأول - ১. রবীউল আওয়াল মাসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম দিবস উপলক্ষে মীলা‏দ মাহফিল উদ্যাপন করা

অমুসলিম ইয়াহূদী-নাসারাদের অনুসরণ থেকেই এসেছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্মদিবস উপলক্ষে ঈদে মীলাদুন্ নবীর অনুষ্ঠান। অজ্ঞ মুসলমানেরা এবং একদল গোমরাহ আলেম প্রতি বছর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্ম উপলক্ষে রবিউল আওয়াল মাসে এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। কেউ কেউ মসজিদে এই অনুষ্ঠান করে থাকে। আবার কেউ ঘরে বা এর জন্য প্রস্তুতকৃত স্থানে এ অনুষ্ঠান করে থাকে। আর এতে অসংখ্য সাধারণ লোক উপস্থিত হয়। খ্রিষ্টানরা যেমন ঈসা আলাইহিস সালামের জন্মদিবস উদযাপন করে থাকে, তাদের অন্ধ অনুসরণ করেই মুসলিমগণ এ অনুষ্ঠান শুরু করেছে।

এ অনুষ্ঠানে বিদআত ও খ্রিস্টানদের সাথে সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে রয়েছে বিভিন্ন প্রকার শিরক ও পাপাচার। এতে এমন কিছু কবিতা আবৃতি করা হয়, যাতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যাপারে এমন বাড়াবাড়ি রয়েছে, যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দু‘আ করা এবং আশ্রয় প্রার্থনা করা পর্যন্ত নিয়ে যায়। অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেন,

«لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ»

‘‘ খ্রিস্টানরা যেমন মারইয়ামের পুত্র ঈসা (আ.) এর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা আমার ব্যাপারে সেরূপ বাড়াবাড়ি করো না। আমি কেবলমাত্র আল্লাহর একজন বান্দা। তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও রসূল বলো’’।[1]

প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করাকে الإطراء বলা হয়। খ্রিস্টানরা ঈসা (আ.) এর মর্যাদা বাড়াতে বাড়াতে আল্লাহর পুত্র হওয়ার আসনে বসিয়েছিল। আবার কেউ কেউ তাকে স্বয়ং আল্লাহ হিসাবে বিশ্বাস করে তার ইবাদত শুরু করেছে। কেউ বা তাকে তিন আল্লাহর এক আল্লাহ হিসাবে নির্ধারণ করে নিয়েছে। কিছু কিছু বিদআতী নবী প্রেমিক বিশ্বাস করে যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। তা ছাড়া এ সমস্ত মীলাদ মাহফিলে যে সব পাপ কাজের চর্চা করা হয়, তার মধ্যে রয়েছে দলবদ্ধভাবে গান গাওয়া, ঢোল বাজানো এবং সূফীদের বানানো বিদআতী নিয়মে বিভিন্ন যিকির-আযকার করা। কখনও কখনও নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে এ সমস্ত কাজে অংশ নিয়ে থাকে। যার কারণে অনেক সময় অশালীন কাজকর্ম সংঘটিত হওয়ার সংবাদও শুনা যায়। এমনকি যদি এ সমস্ত অনুষ্ঠান এধরণের অশ্লীল কাজ হতে মুক্ত হয় এবং শুধুমাত্র একত্রিত হয়ে খাওয়া-দাওয়া ও আনন্দ-ফুর্তির মাঝে সীমিত থাকে, তথাপিও তা বৈধ নয়। কারণ এটি নব আবিষ্কৃত অনুষ্ঠান। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দীনের ব্যাপারে প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রতিটি বিদআতই গোমরাহী। তা ছাড়া এতে অন্যান্য অনুষ্ঠানের মত অশ্লীল কাজ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

আমরা মীলাদ অনুষ্ঠানকে বিদআত বলি। যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন আপনারা বিদআত বলেন? উত্তর হলো, আল্লাহর কিতাব, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাত, সাহাবীদের আমল এবং সম্মানিত তিন যুগের কোনো যুগে এর কোন অস্তিত্ব ছিল না। তাই আমরা এটাকে বিদআত বলি। কারণ যে ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হবে, কুরআন বা সুন্নায় অবশ্যই তার পক্ষে দলীল থাকতে হবে। আর মীলাদ মাহফিলের পক্ষে এ রকম কোন দলীল নেই বলেই এটি এটি বিদআত, যা হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর পর তৈরী করা হয়েছে। মিশরের ফাতেমীয় শিয়া শাসকরা এটি সর্বপ্রথম ইসলামের নামে মুসলিমদের মাঝে চালু  করেছে। বিখ্যাত আলেমে দীন ইমাম আবু হাফস্ তাজুদ্দীন ফাকেহানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, একদল লোক আমাদের কাছে বারবার প্রশ্ন করছে যে, কিছু সংখ্যক মানুষ মীলাদের নামে রবীউল আওয়াল মাসে যে অনুষ্ঠান করে থাকে, শরী‘আতে কি এর কোনো ভিত্তি আছে?

প্রশ্নকারীগণ সুস্পষ্ট উত্তর চেয়েছিল। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে উত্তর দিলাম যে, আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতে এর পক্ষে কোনো দলীল পাইনি এবং যে সমস্ত আলেম মুসলিম জাতির জন্য দীনের ব্যাপারে আদর্শ স্বরূপ এবং পূর্ববর্তীদের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী তাদের কারও থেকে এ ধরণের আমলের প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং এই মীলাদ নামের ইবাদতটি একটি জঘণ্য বিদআত, যা দুর্বল ঈমানদার ও পেট পূজারী লোকদের আবিষ্কার মাত্র।

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রহি.) বলেন, এমনি আরও বিদআতের উদাহরণ হল, কিছু সংখ্যক মানুষ হয়ত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম দিবস পালনে খ্রিষ্টানদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে কিংবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান দেখানোর জন্য তার জন্ম দিবসকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সঠিক জন্ম তারীখ সম্পর্কে আলেমগণ যথেষ্ট মতবিরোধ করেছেন। সালাফগণ এ ধরণের অনুষ্ঠান করেননি। কাজটি যদি ভালো হত, তাহলে অবশ্যই তারা কাজটি করার দিকে আমাদের চেয়ে অনেক অগ্রগামী থাকতেন। তারা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমাদের চেয়ে অনেক বেশী ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন। তারা ছিলেন ভালো কাজে আমাদের চেয়ে অনেক আগ্রগামী। তবে তাদের ভালোবাসা ও সম্মান ছিল তার অনুসরণ, আনুগত্য, তার আদেশের বাস্তবায়ন এবং প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তার সুন্নাতকে বাস্তবায়ন করার মধ্যেই। তিনি যে দীন নিয়ে প্রেরিত হয়েছিলেন, তার প্রচার ও প্রসারের ভিতরে এবং অন্তর-মন, জবান এবং শক্তি দিয়ে সে পথে জিহাদের মাধ্যমে। এটিই ছিল উম্মতের প্রথম যুগের আনসার ও মুহাজির এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারীদের পথ। শাইখুল ইসলামের কথা এখানেই শেষ।

মীলাদ নামের এ বিদআতটির প্রতিবাদে ছোট-বড় অনেক কিতাব রচনা করা হয়েছে। এতে বিদআত ও নাসারাদের সাথে সাদৃশ্য থাকার সাথে সাথে অন্যান্য মীলাদ অনুষ্ঠানের দ্বার উম্মুক্ত করার আশঙ্কা রয়েছে। যেমন মাশায়েখ ও নেতাদের মীলাদ পালন করা, যাতে মন্দ কাজের আরো অনেক দরজা খোলার ভয় রয়েছে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। বর্তমানে এ মীলাদ মাহফিল শুধু রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্ম দিবসের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। এখন নেতা-নেত্রী, পীর-ফকীর, শায়েখ-মাশায়েখ এমনকি সাধারণ মানুষের জন্ম দিবসেও মীলাদ মাহফিল উদ্যাপন করা হয়ে থাকে।[2]


[1]. সহীহ বুখারী, হা/৩৪৪৫।

[2]. শাইখ আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে বায (রহি.) বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বা অন্য কারও জন্মোৎসব পালন করা জায়েয নয়, বরং তা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কারণ এটি দীনের মাঝে একটি নতুন প্রবর্তিত বিদআত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনও এ কাজ করেননি। তার নিজের বা তাঁর পূর্ববর্তী কোন নবী বা তাঁর কোন আত্মীয়, কন্যা, স্ত্রী অথবা কোন সাহাবীর জন্মদিন পালনের নির্দেশ দেননি। খোলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবায়ে কেরাম অথবা তাবেয়ীদের কেউ এ কাজ করেননি। এমন কি পূর্ব যুগের কোন আলেমও এমন কাজ করেন নি। তারা সুন্নাহ সম্পর্কে আমাদের চেয়ে অধিকতর জ্ঞান রাখতেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার শরীয়াত পালনকে সর্বাধিক ভালবাসতেন। যদি এ কাজটি ছাওয়াবের হত, তাহলে আমাদের আগেই তারা এটি পালন করতেন।

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ দীন। এ দীন পরিপূর্ণ বিধায় আমাদেরকে তার অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং বিদআত (নতুন কিছু সংযোজন করা) থেকে বিরত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘আমাদের এই দীনের মাঝে যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, তা প্রত্যাখ্যাত হবে। তিনি আরও বলেন, ‘‘তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত পালন করবে। আর তা দৃঢ়তার সাথে ধারণ করবে। সাবধান! তোমরা দীনের মধ্যে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রত্যেক নব প্রবর্তিত বিষয়ই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা’’। এ সমস্ত হাদীছে বিদআত প্রবর্তনের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ হয়েছে এবং উম্মতকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

‘‘অতএব, যারা তার নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিত্না (বিপর্যয়) তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে। (সূরা নূর: ৬৩) আল্লাহ তায়া’লা আরো বলেন:

﴿وَمَاَآتاَكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا﴾

‘‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর। এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা থেকে তোমরা বিরত থাক’’। (সূরা হাশর: ৭) আল্লাহ আরও বলেন,

﴿لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِى رَسُوْلِ اللَّهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الآخِرَ﴾

‘‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহকে বেশী স্মরণ করে, পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর জীবনীতে এক সর্বোত্তম আদর্শ রয়েছে। (সূরা আহযাব: ২১) আল্লাহ বলেন,

﴿الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمْ الْإِسْلَامَ دِينًا﴾

‘‘আজকের দিনে তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসাবে মনোনীত করলাম’’। (সূরা মায়েদা: ৩)

এই আয়াতের মাধ্যমে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য মনোনীত দীনকে আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওফাতের পূর্বেই পূর্ণ করে দিয়েছেন। তিনি এই বিষয়টি পরিস্কার করে বলে দিয়েছেন যে, তার ওফাতের পরে লোকেরা কথায় বা কাজে যে সব নতুন প্রথার উদ্ভাবন করে শরীয়াতের সাথে যুক্ত করবে, তা বিদআত হিসাবে প্রত্যাখ্যাত হবে। যদিও এগুলোর উদ্দেশ্য ভাল হয়। সাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেয়ীগণ বিদআত থেকে মুসলিম জনগণকে সতর্ক করেছেন ও ভয় প্রদর্শন করেছেন। কেননা এটা ধর্মের ভিতরে অতিরিক্ত সংযোজন, যার অনুমতি আল্লাহ তায়া’লা কোন মানুষকে প্রদান করেন নি। ইহা আল্লাহর দুশমন ইয়াহুদী-খ্রীষ্টান কর্তৃক তাদের ধর্মে নব নব প্রথা সংযোজনের সাথে সামঞ্জস্য স্বরূপ। সুতরাং এরূপ করার অর্থ এই যে, ইসলাম অসম্পূর্ণ ছিল। মীলাদপন্থীরা মীলাদের মাধ্যমে  তা পূর্ণ করে দিলেন। এটা যে কত বড় অপরাধ এবং আল্লাহর বাণীর বিরোধী, তা সর্বজন বিদিত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ﴾

‘‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম’’। (সূরা মায়েদা: ৩)

মীলাদ মাহফিল বা নবীর জন্মোৎসব পালন বা এ জাতীয় অন্যান্য উৎসবাদির প্রবর্তনের দ্বারা এ কথাই বুঝা যায় যে, আল্লাহ তায়া’লা এই উম্মতের জন্য ধর্মকে পূর্ণতা দান করেন নি এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উপর অর্পিত রেসালাতের দায়িত্ব পালন করেন নি। (নাউযুবিল্লাহ) পরবর্তীতে মীলাদপন্থীরা এসে তাকে পূর্ণ করে দিয়েছেন। এতে মারাত্মক ভয়ের কারণ রয়েছে এবং এ ধরণের ইবাদত তৈরী করার মাধ্যমে আল্লাহ তায়া’লা এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উপর আপত্তি উত্থাপনের শামিল। অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য দীনকে সার্বিকভাবে পূর্ণ করত তার নিয়ামত সম্পূর্ণ করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের সুস্পষ্ট বার্তা যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তিনি এমন কোন পথ, যা জান্নাতের দিকে নিয়ে যায় এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে উম্মতকে তা বলে দিতে কোন প্রকার ত্রুটি করেননি।

এ কথা সকলের জানা যে, আমাদের নবী সকল নবীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ। তিনি সবার চেয়ে অধিকতর পরিপূর্ণভাবে দীনের পয়গাম ও উপদেশ বার্তা পৌঁছিয়েছেন। যদি মীলাদ মাহফিল আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত দীনের অংশ হত, তাহলে তিনি অবশ্যই উম্মতের কাছে বর্ণনা করতেন বা তার সাহাবীগণ তা করতেন। যেহেতু এমন কিছু পাওয়া যায় না, তাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের সাথে এই মীলাদ মাহফিলের কোন সম্পর্ক নেই বরং এটা বিদআত, যা থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উম্মতকে সাবধান থাকতে বলেছেন।

যদি আমরা এই মীলাদ মাহফিলের বিষয়টি সম্পর্কে কুরআন মাযীদের দিকে ফিরে যাই, তাহলে দেখতে পাই আল্লাহ তায়া’লা তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যা আদেশ করেছেন বা যা থেকে নিষেধ করেছেন, তিনি আমাদেরকে তা অনুসরণ করার আদেশ দিয়েছেন এবং জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি এই দীনকে উম্মতের জন্য পূর্ণতা দান করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন তার মধ্যে মীলাদ মাহফিলের কোন ইঙ্গিত পর্যন্ত নেই। এভাবে যদি আমরা সুন্নাতের দিকে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাই যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একাজ করেন নি, এর আদেশও দেন নি। এমন কি তার সাহাবীগণও তা করেন নি। তাই আমরা বুঝতে পারি যে, এটা ধর্মীয় কাজ নয় বরং ইয়াহূদী-খ্রীষ্টানদের উৎসব সমূহের অন্ধ অনুকরণ মাত্র। যে ব্যক্তির সামান্যতম বিচক্ষণতা আছে এবং হক গ্রহণে ও তা বুঝার সামান্য আগ্রহ রাখে, তার বুঝতে কোন অসুবিধা হবে না যে, ধর্মের সাথে মীলাদ মাহফিল বা যাবতীয় জন্ম বার্ষিকী পালনের কোন সম্পর্ক নেই। বরং যে বিদআতসমূহ থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেছেন, এটি সেগুলোরই অন্তর্ভূক্ত।

বিভিন্ন স্থানে অধিক সংখ্যক লোক এই বিদআতী কাজে লিপ্ত দেখে কোন বুদ্ধিমান লোকের পক্ষে প্রবঞ্চিত হওয়া সংগত নয়। কেননা সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে সঠিক পথ জানা যায়না। বরং শরীয়াতের দলীলের মাধ্যমে তা অনুধাবন করা হয়।

এই মীলাদ মাহফিলসমূহ বিদআত হওয়ার সাথে সাথে অনেক এলাকায় অন্যান্য পাপের কাজ থেকেও মুক্ত নয়। যেমন নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা, গান-বাজনা ও মাদক দ্রব্যের ব্যবহার ইত্যাদি। সর্বোপরি এসব মাহফিলে শির্কে আকবার তথা বড় ধরণের শিরকও সংঘটিত হয়ে থাকে। আর তা হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও অন্যান্য আওলীয়ায়ে কেরামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা, তাদের কাছে দু’আ করা, সাহায্য ও বিপদে মুক্তির প্রার্থনা করা এবং এই বিশ্বাস পোষণ করা যে তারা গায়েবের খবর জানেন। এই সমস্ত কাজ করলে মানুষ কাফের হয়ে যায়।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অনেক লোক এ ধরণের বিদআতী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ক্ষেত্রে খুবই তৎপর ও সচেষ্ট এবং এর পিছনে যুক্তি-প্রমাণ দাঁড় করাতে প্রস্তুত। এ ধরণের অনুষ্ঠানের পিছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে তারা দ্বিধাবোধ করে না। অথচ তারা নামাযের জামা‘আত ও জুমআতে অনুপস্থিত থাকাতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠাবোধ করে না। যদিও আল্লাহ তা’আলা এ আমলগুলো পালন করা ওয়াজিব করেছেন। তারা এটাও উপলদ্ধি করে না যে, সালাতের মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত ছেড়ে দিয়ে তারা চরম অন্যায় করছে। নিঃসন্দেহে এটা দুর্বল ঈমান এবং পাপাচারের মাধ্যমে অন্তরকে কুলষিত করে নেয়ার পরিচয় বহন করে।

আরো বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, অনেকের ধারণা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মীলাদ মাহফিলে উপস্থিত হন। তাই তারা তাঁকে অভিনন্দন জানাতে দাঁড়িয়ে যায়। এটা বিরাট মূর্খতা ও অসত্য ছাড়া অন্য কিছু নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামত দিবসের পূর্বে আপন কবর থেকে বের হবেন না বা কারো সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করবেন না এবং কোন সমাবেশেও উপস্থিত হবেন না; বরং কিয়ামত পর্যন্ত অন্যান্য নবীদের মতই স্বীয় কবরে অবস্থান করবেন এবং তাঁর পবিত্র রূহ মোবারক প্রভুর নিকট উর্ধাকাশে ইলিস্নয়ীনের সম্মানজনক স্থানে সংরক্ষিত থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ثُمَّ اِنَّكُمْ بَعْدَ ذَلِكَ لَمَيِّتُوْنَ ثُمَّ اِنَّكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ تُبْعَثُوْنَ﴾

‘‘এরপর তোমাদেরকে অবশ্যই মরতে হবে। অতঃপর কিয়ামতের দিনে পুনরায় জীবিত করা হবে’’। (সূরা মুমিনুন: ১৬) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমার কবরই সর্বপ্রথম উন্মুক্ত করা হবে। আমিই প্রথম সুপারিশকারী এবং আমার সুপারিশ সবার আগে গৃহীত হবে।

   রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর দুরূদ পাঠ করা ও সালাম পাঠ করা নিঃসন্দেহে একটি ভাল আমল এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক উত্তম পন্থা। যেমন আল্লাহ তায়া’আলা বলেছেন,

﴿اِنَّ اللّهَ وَ مَلَائِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى النَّبِيِّ يَاَيُّهَا الَّذِيْنَ اَمَنُوْا صَلُّوْا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوْا تَسْلِيْمًا﴾

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দুরূদ পাঠান। হে মুমেনগণ! তোমরাও তার উপর দরূদ ও সালাম প্রেরণ করো’’। (সূরা আহযাব: ৫৬) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আমার উপর একবার দরূদ পাঠায়, আল্লাহ তার প্রতিদান স্বরূপ তার উপর দশবার রহমত নাযিল করেন।

সব সময়ই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উপর দুরূদ পড়ার বৈধতা রয়েছে। তবে সালাতের শেষে পড়ার জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে, বরং সালাতের মধ্যে শেষ তাশাহ্হুদে দুরূদ পাঠ করা ওয়াজিব। অনেক ক্ষেত্রে এই দুরূদ পড়া সুন্নাতে মুআক্কাদা। যেমন আযানের পরে, জুমু‘আর দিনে ও রাতে এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাম উল্লেখ হলে। এব্যাপারে অনেক হাদীছ রয়েছে।

এরূপ বিদআতী অনুষ্ঠান এমন সব মুসলমান দ্বারাও সংঘটিত হচ্ছে , যারা তাদের আকীদা ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ভালবাসার ব্যাপারে খুবই দৃঢ়তা রাখে। তাকে বলতে হবে, যদি তুমি সুন্নী ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসারী হওয়ার দাবী রাখ, তাহলে বল, তিনি স্বয়ং বা তার কোন সাহাবী বা তাদের সঠিক অনুসারী কোন তাবেয়ী কি এ কাজটি করেছেন? না এটা ইয়াহূদী-খ্রীষ্টান বা তাদের মত আল্লাহর অন্যান্য শত্রুদের অন্ধ অনুকরণ? এ ধরণের মীলাদ মাহফিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রতি ভালবাসা প্রতিফলিত হয় না। যা করলে ভালবাসা প্রতিফলিত হয়, তা হল তার নির্দেশের অনুসরণ করা, তিনি যা বলেছেন, তা বিশ্বাস করা, যা থেকে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করা। আল্লাহ যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, কেবল সেভাবেই তার উপাসনা করা।

কুরআন ও সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা এবং খোলাফায়ে রাশেদীন ও তাবেয়ীদের প্রদর্শিত পথে চলার ভিতরেই রয়েছে মুসলমানদের জন্য ইহ ও পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তি।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »