আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী خاتمة في التحذير من البدع - বিদআত থেকে সতর্ক করণার্থে একটি পরিশিষ্ট শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
الفصل الثالث: الأسباب التي أدت إلى ظهور البدع - তৃতীয় পরিচ্ছেদ: মুসলিম সমাজে বিদআত প্রকাশের কারণসমূহ

নিঃশর্তভাবে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের অনুসরণই বিদআত ও সকল প্রকার গোমরাহী থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ﴾

‘‘এটিই আমার সঠিক পথ। সুতরাং তোমরা এই সঠিক পথের অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের দিকে গমণ করো না। তাহলে সে সব পথ তোমাদেরকে আল্লাহর সঠিক পথ হতে বিপথগামী করে দিবে’’। (সূরা আল আন‘আম: ১৫৩)

আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) এর বর্ণিত হাদীছে (সনদ হাসান: সুনানে দারেমী) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ আয়াতের অর্থকে অতি সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন,

«خَطَّ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمًا خَطًّا ثُمَّ قَالَ هَذَا سَبِيلُ اللَّهِ ثُمَّ خَطَّ خُطُوطًا عَنْ يَمِينِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ ثُمَّ قَالَ -هَذِهِ سُبُلٌ عَلَى كُلِّ سَبِيلٍ مِنْهَا شَيْطَانٌ يَدْعُو إِلَيْهِ ثُمَّ تَلَا ﴿وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ﴾

‘‘রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সামনে মাটিতে একটি রেখা টানলেন। সে রেখার উপর হাত রেখে বললেন, এটি হল আল্লাহর পথ। অতঃপর সে রেখার ডানে ও বামে আরো অনেকগুলো রেখা অঙ্কন করে বললেন, এ সবগুলোই পথ। তবে এ সব পথের মাথায় একটি করে শয়তান দাঁড়িয়ে আছে। সে সর্বদা মানুষকে ঐ পথের দিকে আহবান করছে। এ কথা বলার পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেন,

﴿وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ﴾

‘‘এটিই আমার সঠিক পথ। সুতরাং তোমরা এই সঠিক পথের অনুসরণ করো। অন্যান্য পথের অনুসরণ করোনা। তাহলে সে সব পথ তোমাদেরকে আল্লাহর সঠিক পথ হতে বিপদগামী করে দিবে’’। (সূরা আল আন‘আম: ১৫৩) সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাতের পথ থেকে বিমুখ হবে, বিদআতী ও ভ্রান্ত পথগুলো তাকে নিজের দিকে টেনে নিবে।

যে সমস্ত কারণে মুসলিম জাতির ভিতরে বিদআতের উৎপত্তি হয়েছে, সে কারণগুলো সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে আলোচনা করা হলো

১. দীনের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে অজ্ঞতা: সময় যতই অতিবাহিত হয়েছে এবং মানুষ যখনই নবুওয়াতের শিক্ষা থেকে দূরে অবস্থান করেছে, তখনই ইসলাম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের কমতি দেখা দিয়েছে এবং মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ»

‘‘আমার পরে তোমাদের মধ্য থেকে যারা জীবিত থাকবে, তারা অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা আমার সুন্নাত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়িয়ে ধরবে। তোমরা দীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতের পরিণাম ভ্রষ্টতা।[1] তিনি আরও বলেন,

«إِنَّ اللَّهَ لَا يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالًا فَسُئِلُوا فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا»

‘‘আল্লাহ মানুষের অন্তর থেকে ইলমকে টেনে বের করে নিবেন না। বরং আলেমদেরকে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নিবেন। শেষ পর্যন্ত যখন কোনো আলেম জীবিত থাকবে না, মানুষেরা তখন মূর্খদেরকে নিজেদের নেতা নির্বাচন করবে। তাদেরকে দীনের কোনো বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে বিনা ইলমেই তারা ফতোয়া দিবে। ফলে তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হওয়ার সাথে সাথে মানুষদেরকেও পথভ্রষ্ট করবে’’।[2]

দীনের সঠিক জ্ঞান ও জ্ঞানী লোক ব্যতীত বিদআতের মুকাবেলা করার মত কোনো শক্তি নেই। যখন জ্ঞান ও জ্ঞানীগণ উঠে যাবেন, তখন বিদআত ও বিদআতীদের পক্ষে সুযোগ সৃষ্টি হবে।

২. প্রবৃত্তির অনুসরণ: এটাই স্বাভাবিক যে, কোন লোক যখন আল্লাহর কিতাব ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাত থেকে বিমুখ হবে, তখন সে আপন প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنْ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾

‘‘অতঃপর তারা যদি আপনার কথায় সাড়া না দেয়, তবে জেনে নিন যে, তারা শুধু নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, আল্লাহর হেদায়াতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তারচেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে আছে? নিশ্চয় আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সঠিক পথ দেখান না’’। (সূরা ক্বছাছ: ৫০) আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,

﴿أَفَرَأَيْتَ مَنْ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللَّهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللَّهِ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ﴾

‘‘তুমি কি তার প্রতি লক্ষ্য করেছো? যে তার খেয়াল-খুশীকে স্বীয় উপাস্য স্থির করেছে? আল্লাহ জেনে শুনে তাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, তার কান ও অন্তরে মোহর এঁটে দিয়েছেন। আর তার চোখের উপর রেখেছেন পর্দা। অতএব আল্লাহর পর কে তাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করবে? অতএব তোমরা কি চিন্তা-ভাবনা করো না?’’ (সূরা আল-জাসিয়া: ২৩) সুতরাং খেয়াল-খুশির অনুসরণ বিদআতের পথকে উন্মুক্ত করে।

৩. আলেমদের অন্ধ অনুসরণ: আলেম ও পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ মানুষকে দলীল-প্রমাণের অনুসরণ এবং সত্য জানার আগ্রহ ও তা কবুল করার পথে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ﴾

‘‘যখন তাদেরকে বলা হয় আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তার অনুসরণ করো, তখন তারা বলে থাকে আমরা বরং আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে যে বিষয়ের উপর পেয়েছি, তারই অনুসরণ করবো। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জানতো না এবং সত্য পথ প্রাপ্তও ছিল না’’। (সূরা আল বাকারা: ১৭০)

বর্তমান যুগের কতক মাযহাবপন্থী, সূফী ও কবর পুজারীদের একই অবস্থা। তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাতের দিকে ডাকা হলে এবং কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আমলসমূহ বর্জন করতে বলা হলে তারা তাদের মাযহাব, মাশায়েখ এবং বাপ-দাদার দোহাই দেয়।

৪. কাফের-মুশরেকদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা: বিধর্মী কাফের-মুশরিকদের সাথে সাদৃশ্য রাখা নতুন নতুন বিদআত সৃষ্টির বিরাট একটি কারণ। আবু ওয়াকেদ আল-লাইছী (রা.) এর হাদীছে এ কথার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলেন, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে হুনাইন যুদ্ধের জন্য বের হলাম। আমরা ছিলাম নব মুসলিম। আমরা দেখলাম মুশরিকদের জন্য একটি বড়ই গাছ রয়েছে। তারা বরকত লাভের আশায় নিজেদের অস্ত্র ঐ গাছে ঝুলিয়ে রাখে। গাছটির নাম ছিল যাতু আনওয়াত অর্থাৎ বরকতময় বৃক্ষ। আমরা সে গাছটির নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় বললাম, হে আল্লাহর রসূল! তাদের যেমন বরকতময় বৃক্ষ রয়েছে, আমাদের জন্যও একটি বরকতময় বৃক্ষ নির্ধারণ করে দিন। যাতে আমরা যুদ্ধের অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখবো এবং বরকত হাসিল করবো।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কথা শুনে বললেন, ‘‘আল্লাহু আকবার’’ নিশ্চয়ই এটি একটি পথ। ঐ সত্তার শপথ, যার হাতে আমার জীবন, তোমরা এমন রীতি-নীতির কথা বললে যেমনটি বলেছিল বনী ইসরাইল সম্প্রদায় আল্লাহর নবী মূসা (আ.) কে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قَالُوا يَامُوسَى اجْعَل لَنَا إِلَهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ﴾

‘‘তারা বলেছিল, হে মূসা! তাদের জন্য যেমন মাবূদ রয়েছে, আমাদের জন্যও অনুরূপ একটি মাবূদ নির্ধারণ করে দিন। মূসা (আ.) বললেন, নিশ্চয় তোমরা একটি মূর্খ জাতি’’। (সূরা আল আরাফ: ১৩৮)

অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমরা তো দেখছি অবশ্যই অতীত জাতিসমূহের পথের অনুসরণ করবে।[3]

এই হাদীছের মাধ্যমে সুস্পষ্ট জানা যায় যে, কাফেরদের সাথে সাদৃশ্য করাই বনী ইসরাঈল ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কতিপয় সাথীদেরকে তাদের নবীর কাছে এরকম একটি জঘন্য আবদার করতে উৎসাহিত করেছিল। বনী ইসরাঈলের লোকেরা মূসা আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আবেদন করেছিল, তাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য একটি মাবূদ নির্ধারণ করে দেয়া হোক, তারা সে মাবূদের ইবাদত করবে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে তা থেকে বরকত হাসিল করবে।

বর্তমানেও একই অবস্থা লক্ষ করা যায়। অধিকাংশ মুসলিম বিদআত ও শিরকী কর্মসমূহে কাফের-মুশরেকদের অনুসরণ করে চলেছে। যেমন ঈদে মীলাদুন্ নবী, বিভিন্ন ঘটনা উপলক্ষে বিশেষ দিন ও সপ্তাহ পালন করা, ধর্মীয় বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠান পালন করা, নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিমূর্তি তৈরী করা, স্মৃতিচিহ্ন ও ভাষ্কর্য স্থাপন করা, মাতম করা, মৃত ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রকার বিদআতের প্রচলন করা, কবরের উপর গম্বুজ নির্মাণ করা ইত্যাদি।


[1]. সহীহ: আবু দাউদ, হা/ ৪৬০৭, মুসনাদে আহমাদ।

[2]. সহীহ বুখারী, হা/১০০।

[3]. সহীহ: সুনানে তিরমিযী, হা/২১৮০।