শেষ দিবস উপস্থিত হওয়ার পূর্বে যেহেতু অনেক আলামত প্রকাশিত হয়ে তা নিকটবর্তী হওয়ার নির্দেশনা প্রদান করবে এবং সেগুলোকে যেহেতু কিয়ামতের আলামত হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে, তাই উক্ত আলামতসমূহ থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় আলামত এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। কেননা কিয়ামতের আলামতসমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। এ বিষয়টির সাথে আকীদার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿اقْتَرَبَتْ السَّاعَةُ وَانْشَقَّ الْقَمَرُ﴾ ‘‘কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে গেছে এবং চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছে’’। (সূরা কামার: ১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَهَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا السَّاعَةَ أَن تَأْتِيَهُم بَغْتَةً ۖ فَقَدْ جَاءَ أَشْرَاطُهَا ۚ فَأَنَّىٰ لَهُمْ إِذَا جَاءَتْهُمْ ذِكْرَاهُمْ﴾
‘‘তারা কি শুধু এ জন্য অপেক্ষা করছে যে, কিয়ামত তাদের নিকট হঠাৎ এসে পড়ুক? কিয়ামতের আলামতসমূহ তো এসেই পড়েছে। অতঃপর কিয়ামত এসে পড়লে উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে?’’। (সূরা মুহাম্মাদ: ১৮) أشراط অর্থ নিদর্শন ও লক্ষণসমূহ। এর একবচন হলো شرط. ‘রা’ বর্ণে যবর দিয়ে পড়লে অর্থ হবে আলামত বা নিদর্শন।
ইমাম বগবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করা কিয়ামতের অন্যতম আলামত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّ السَّاعَةَ قَرِيبٌ﴾ ‘‘তুমি জানো কি সম্ভবত কিয়ামত আসন্ন?’’ (সূরা শুরা: ১৭) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿هَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا السَّاعَةَ أَنْ تَأْتِيَهُمْ بَغْتَةً وَهُمْ لَا يَشْعُرُونَ﴾
‘‘তারা তো তাদের অজ্ঞাতসারে হঠাৎ কিয়ামত আসার অপেক্ষা করছে’’। (সূরা যুখরুফ: ৬৬) কিয়ামতের দিন যেহেতু অতি নিকটে এবং তা যেহেতু নিশ্চয়ই সংঘটিত হবে, তাই ঐদিনকে আল্লাহ তা‘আলা আগামীকাল বলে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلْتَنْظُرْ نَفْسٌ مَا قَدَّمَتْ لِغَدٍ﴾
‘‘প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক যে, আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে?’’। (সূরা হাশর: ১৮) আজকের দিনের পরের দিনকে غد আগামীকাল বলা হয়।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِنَّهُمْ يَرَوْنَهُ بَعِيدًا وَنَرَاهُ قَرِيبًا﴾
‘‘তারা সেটিকে অনেক দূরে মনে করছে। কিন্তু আমি দেখছি তা অতি নিকটে’’। (সূরা মা‘আরেজ: ৬-৭)। ইমাম তিরমিযী আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু হিসাবে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«بُعِثْتُ أَنَا وَالسَّاعَةُ كَهَاتَيْنِ وَأشار بالسَّبَّابَةَ وَالْوُسْطَى»
‘‘আমি এবং কিয়ামত এক সাথে প্রেরিত হয়েছি। একথা বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতের শাহাদাত আঙ্গুল এবং মধ্যমা আঙ্গুলকে একত্রিত করে দেখালেন’’।[1]
সহীহ বুখারী (৫৫৭) ও মুসলিমে ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّمَا بَقَاؤُكُمْ فِيمَن مضى قَبْلَكُمْ مِنَ الأُمَمِ من صَلاةِ الْعَصْرِ إِلَى غُرُوبِ الشَّمْسِ»
‘‘পূর্বের জাতিসমূহের তুলনায় দুনিয়াতে তোমাদের অবস্থানের মেয়াদ হল আসরের সালাতের সময় থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত’’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّمَا بَقَاؤُكُمْ فِيمَا سَلَفَ قَبْلَكُمْ مِنَ الأُمَمِ مَا بَيْنَ صَلاةِ الْعَصْرِ إِلَى غُرُوبِ الشَّمْسِ»
‘‘পূর্বের জাতিসমূহের তুলনায় দুনিয়াতে তোমাদের অবস্থানের মেয়াদ হল আসরের সালাতের সময় থেকে শুরু করে সূর্যাস্ত পর্যন্ত’’। উভয় বর্ণনার মধ্যে কেবল শব্দগত পার্থক্য রয়েছে।
কিয়ামতের বিষয়টি যেহেতু খুবই ভয়াবহ, তাই এ ব্যাপারে অন্যান্য বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ জন্যই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিয়ামতের আলামত এবং সেটার লক্ষণগুলো খুব বেশি বর্ণনা করেছেন। কিয়ামতের আগে যেসব ফিতনার আবির্ভাব হবে তিনি তাও বলেছেন। উম্মতকে তিনি এ বিষয়ে সতর্ক ও সাবধান করেছেন, যাতে তারা এর জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে।
তবে কিয়ামত আসার সময়কাল কেবল আল্লাহ তা‘আলাই জানেন। বান্দাদের কল্যাণার্থেই তিনি এর সময়কে তাদের থেকে গোপন রেখেছেন। কিয়ামত দিবসের ভয়াবহ বিপদ থেকে বাঁচার জন্য বান্দারা যেন সবসময় প্রস্ত্তত থাকে, তাই তিনি এর আগমনকাল গোপন রেখেছেন। অনুরূপ তিনি প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যুর সময়ও আড়াল করে রেখেছেন, যাতে করে সে সবসময় মৃত্যুর জন্য সর্বোচ্চ প্রস্ত্তত থাকে এবং ইহধামের মায়া-মমতা ছেড়ে পরপারের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে অধির আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে ও সেজন্য প্রয়োজনীয় আমলও করতে থাকে।
আল্লামা সাফারায়েনী রহিমাহুল্লাহ বলেন, জেনে রাখা আবশ্যক যে, কিয়ামতের আলামত ও লক্ষণসমূহ তিন প্রকার। এক প্রকার আলামত প্রকাশিত হওয়ার পর অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরেক শ্রেণীর আলামত প্রকাশিত হয়েছে; কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি; বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। আর তৃতীয় শ্রেণীর বড় আলামতগুলো বের হওয়ার পর কিয়ামত সংঘটিত হবে। পুতির মালার সুতা ছিড়ে গেলে যেমন সবগুলো পুতি একের পর এক পর্যায়ক্রমে পড়ে যায়, ঠিক তেমনি বড় আলামতসমূহ থেকে একটি বের হয়ে গেলে পর্যায়ক্রমে সবগুলোই প্রকাশিত হবে।
প্রথমত: কিয়ামতের যেসব আলামত প্রকাশিত হয়ে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তার মধ্যে রয়েছে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন, তার মৃত্যুবরণ, বাইতুল মুকাদ্দাস বিজয় এবং আমীরুল মুমিনীন উছমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকান্ড অন্যতম। হুযায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, উছমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হত্যার মাধ্যমেই ফিতনার সূচনা হয়েছে।
আল্লামা সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, উছমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হত্যার পর সংঘটিত যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিভিন্ন ফির্কা যেমন খারেজী, রাফেযী ইত্যাদি বাতিল ফির্কার আবির্ভাব হয়। অতঃপর শাইখ সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কিয়ামতের আরো যেসব আলামত রয়েছে, তার মধ্যে মিথ্যুক দাজ্জালদের আগমন। তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবি করবে। আরবদের রাজত্ব চলে যাওয়াও কিয়ামতের অন্যতম আলামত। ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ধন-সম্পদ বেড়ে যাওয়া কিয়ামতের আলামতসমূহের মধ্যে গণ্য। ইমাম বুখারী এবং অন্যান্য ইমামগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। কিয়ামতের আলামতসমূহের মধ্যে আরো রয়েছে যে, কিয়ামতের আগে অনেক ভূমিকম্প হবে, ভূমিধস হবে, চেহারা পরিবর্তনের শাস্তি হবে এবং উপরে উঠিয়ে নিক্ষেপ করার শাস্তিও হবে। এমনি আরো অনেক আলামত সম্পর্কে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন, যা প্রকাশিত হয়েছে এবং অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।
দ্বিতীয়ত: কিয়ামতের মধ্যম পর্যায়ের কিছু আলামত রয়েছে। এগুলো বের হয়েছে; কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। বরং এগুলো দিন দিন বেড়েই চলেছে। এগুলোর সংখ্যা প্রচুর।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَكُونَ أَسْعَدَ النَّاسِ بِالدُّنْيَا لُكَعُ ابْنُ لُكَعٍ»
‘‘নিকৃষ্ট লোকের নিকৃষ্ট সন্তানরা দুনিয়ার সম্পদ লাভে সর্বাধিক ধন্য না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা’’।[2]
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল, ইমাম তিরমিযী এবং যিয়া আল-মাকদেসী রাহিমাহুল্লাহ হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। لكع অর্থ হলো ক্রিতদাস, বোকা এবং নিকৃষ্ট লোক। হাদীছের অর্থ হলো নিকৃষ্ট, অভদ্র, বোকা এবং তাদের অনুরূপ লোকেরা মানুষের নেতা না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে না। কিয়ামতের আরো আলামত যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«يَأْتِي عَلَى النَّاسِ زَمَانٌ الصَّابِرُ فِيهِمْ عَلَى دِينِهِ كَالْقَابِضِ عَلَى الْجَمْرِ»
‘‘মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন জ্বলন্ত আগুনের স্ফুলিঙ্গ হাতের মুষ্ঠির মধ্যে রাখার মতই দীন নিয়ে টিকে থাকা কঠিন হবে’’।[3] ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَتَبَاهَى النَّاسُ فِي الْمَسَاجِدِ»
‘‘যতদিন লোকেরা মসজিদ নিয়ে গর্ব না করবে ততদিন কিয়ামত হবে না’’।[4] ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ, ইবনে হিববান এবং ইবনে মাজাহ আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন, আখেরী যামানায় মূর্খ আবেদ-ইবাদাতকারী এবং ফাসেকদের আবির্ভাব হবে’’। আবু নুআইম এবং হাকেম আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে, চাঁদ উঠার সময় বলা হবে, এটি দুই রাতের চাঁদ। চাঁদ খুব মোটা হয়ে উঠার কারণেই এমন কথা বলা হবে। এ অর্থে ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম তাবারানী একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার আলামত হচ্ছে, চন্দ্র মোটা হয়ে উদিত হবে’’।[5] মসজিদকে সচরাচর যাতায়াতের রাস্তা বানানোও কিয়ামতের একটি আলামত।
ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, সহীহ বুখারী এবং অন্যান্য কিতাবে আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, আমি তোমাদেরকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একটি হাদীছ শুনাবো। আমি ব্যতীত তোমাদেরকে অন্য কেউ তা শুনাবে না। আমি রসূল তাকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,
«إِنَّ مِنْ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ أَنْ يُرْفَعَ الْعِلْمُ وَيَكثر الْجَهْلُ ويكثر الزنى وَيكثر شْرب الْخَمْرُ ويقل الرجال ويكثر النساء حتى يكون لخمسين إمرأة القيم الواحد»
‘‘নিশ্চয় কিয়ামতের অন্যতম আলামত হচ্ছে জ্ঞান উঠিয়ে নেয়া হবে, অজ্ঞতা বিস্তার লাভ করবে, যেনা-ব্যভিচার বৃদ্ধি পাবে, মদ্যপান ছড়িয়ে পড়বে, পুরুষের সংখ্যা কমে যাবে, মহিলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এমনকি পঞ্চাশজন মহিলার দেখা-শুনা করার জন্য মাত্র একজন পুরুষ বিদ্যমান থাকবে’’।[6]
আবূ হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক মজলিসে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় একজন গ্রাম্য লোক এসে নবীজীকে এই বলে প্রশ্ন করলো যে, কিয়ামত কখন হবে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার কথা চালিয়ে যেতে থাকলেন। কিছু লোক মন্তব্য করলো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকটির প্রশ্নকে অপছন্দ করেছেন। আবার কিছু লোক বললো, তিনি তার কথা শুনতে পাননি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আলোচনা শেষে বললেন, প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে বললো, এ তো আমি। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,
«إِذَا ضُيِّعَتِ الْأَمَانَةُ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ قَالَ كَيْفَ إِضَاعَتُهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ إِذَا أُسْنِدَ الْأَمْرُ إِلَى غَيْرِ أَهْلِهِ فَانْتَظِرِ السَّاعَةَ»
‘‘যখন আমানতের খেয়ানত হবে তখন কিয়ামত নিকটবর্তী হয়ে গেছে বলে মনে করবে। লোকটি আবার প্রশ্ন করলো, কিভাবে আমানতের খেয়ানত করা হবে? নবীজী বললেন, যখন অযোগ্য লোকদেরকে দায়িত্ব দেয়া হবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করতে থাকো’’।[7]
তৃতীয়ত: কিয়ামতের বেশ কিছু বড় বড় আলামত রয়েছে। এসব বড় বড় আলামত প্রকাশিত হওয়ার পরপরই কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে। এগুলো হচ্ছে, মাহদীর আত্মপ্রকাশ, দাজ্জালের আগমন, ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালামের অবতরণ, ইয়াজুজ-মাজুজের আগমন, কাবাঘর ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া, বিশাল আকারের ধোঁয়ার আগমন, কুরআন উঠে যাওয়া, পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়া, যমীন থেকে দাববাতুল আরয নামক একটি অদ্ভুত প্রাণী বের হওয়া এবং আদনের গর্ত থেকে বিশাল আকারের আগুন বের হওয়া। অতঃপর শিঙ্গায় তিনবার ফুঁ দেয়া হবে। প্রথমবার ফুঁ দেয়ার সময় সমস্ত মানুষ ঘাবড়ে যাবে, দ্বিতীয়বার ফুঁ দেয়ার সময় মানুষ অচেতন ও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে যাবে এবং সকলেই ধ্বংস হয়ে যাবে, তৃতীয়বার ফুঁ দেয়ার সময় পুনরুত্থান ও হাশর-নাসর সংঘটিত হবে।
মোটকথা কিয়ামতের বিষয়টি অত্যন্ত ভয়াবহ। অথচ আমরা গাফেল হয়ে আছি। কিয়ামতের অনেক আলামত বের হয়ে গেছে। আমরা আল্লাহর কাছে দু‘আ করি, তিনি যেন আমাদেরকে দীনের উপর অটল রাখেন, ইসলামের উপর মৃত্যু দান করেন এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমস্ত ফিতনা থেকে হেফাযত করেন।
এ আলামতগুলো আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত ও রিসালাতের সত্যতা প্রমাণ করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাকে ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য যেসব বিষয়ের জ্ঞান দান করেছেন, তা তিনি যেভাবে সংবাদ দিয়েছেন, হুবহু সেভাবেই সংঘটিত হয়েছে। এগুলো বান্দার ঈমান মজবুত করে।
এসব আলামত সম্পর্কে সংবাদ দেয়া বান্দাদের জন্য রহমত স্বরূপ। যাতে তারা সতর্ক হয়, প্রস্ত্ততি গ্রহণ করে এবং তাদের দীনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণার উপর থাকতে পারে। সুতরাং সেই সম্মানিত নবীর প্রতি আল্লাহ তা‘আলার তরফ থেকে সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক, যিনি সুস্পষ্টভাবে মানুষের নিকট দীনের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন এবং পূর্ণভাবে তার বিবরণ দিয়েছেন। আমরা এ বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদানকারী।
এসব আলামতের মধ্যে সর্বপ্রথম আলামত হলো মাহদীর আত্মপ্রকাশ, অতঃপর দাজ্জালের আগমন অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন। অতঃপর বাকি বড় আলামতগুলো ধারাবাহিকভাবে একের পর এক প্রকাশিত হবে।
[1]. সহীহ মুসলিম ২৯৫১, অধ্যায়: কিয়ামতের আলামত, বুখারী ৪৯৩৬, ইবনে মাজাহ ৪৫।
[2]. সহীহ: তিরমিযী ২২০৯।
[3]. সহীহ: তিরমিযী ২২৬০।
[4]. মুসনাদে আহমাদ। ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, সহীহুল জামে, হাদীছ নং- ৭২৯৮।
[5]. তাবরানী। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, সহীহুল জামে আস্ সাগীর, হাদীছ নং- ৫৭৭৪।
[6]. সহীহ বুখারী ৫২৩১, অধ্যায়: কিতাবুল ইলম, মুসনাদে আহমাদ।
[7]. সহীহ বুখারী ৬৪৯৬, অধ্যায়: কিতাবুর রিকাক, মুসনাদে আহমাদ।
ইতিপূর্বে আমরা কিয়ামতের বড় আলামতগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। এখন আমরা সেগুলো বিস্তারিত আলোচনা করবো। এগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম হলো মাহদীর আত্মপ্রকাশ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘ততদিন দুনিয়া ধ্বংস হবে না যতদিন না আমার পরিবারের একজন লোক আরবদের বাদশা হবেন। তার নাম হবে আমার নাম এবং তার পিতার নাম হবে আমার পিতার নাম’’।[1] অর্থাৎ তার নাম হবে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ। ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ এবং তিরমিযী রাহিমাহুমুল্লাহ সহীহ সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছটি হাসান-সহীহ। এ বিষয়ে আলী, আবু সাঈদ, উম্মে সালামা এবং আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম থেকে হাদীছ রয়েছে।
আল্লামা সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মাহদীর ব্যাপারে অনেক হাদীছ ও আছার রয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যেসব হাদীছ দ্বারা মাহদীর আগমনের উপর দলীল গ্রহণ করা হয়, তা সহীহ। ইমাম আবু দাউদ, তিরমিযী, আহমাদ এবং অন্যান্য ইমামগণ এসব হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
মাহদীর নাম হলো মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ। আখেরী যামানায় যখন পৃথিবী যুলুমে ভরপুর হয়ে যাবে, তখন তিনি হাসান আলী ইবনে আবু তালেবের বংশধর থেকে বের হবেন এবং ন্যায়-ইনসাফ দ্বারা পৃথিবী পরিপূর্ণ করে দিবেন।
আল্লামা সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, মাহদীর ব্যাপারে অনেক কথা বর্ণিত হয়েছে। এমন কি এ কথাও বলা হয়েছে যে, لامهدي إلا عيسى ‘‘ঈসা ব্যতীত আর কোনো মাহদী নেই’’। অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালাম আসবেন; মাহদী নন। তবে আহলে হকদের মতে, সঠিক কথা হলো মাহদী ঈসা নন। মাহদী আসবেন ঈসা আলাইহিস সালাম নামার আগে। মাহদী সম্পর্কে এত বেশি হাদীছ এসেছে যে, তা অর্থগত মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আহলে সুন্নাতের আলেমদের নিকট মাহদী সংক্রান্ত হাদীছগুলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট হওয়ার কারণে তা আকীদার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
আমি বলছি, মাহদীর ব্যাপারে দু’টি সম্প্রদায় পরস্পর বিপরীতমুখী কথা বলেছে এবং আরেকটি পক্ষ মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে। কুরআন ও হাদীছের উক্তি এবং আলেম-উলামাদের বক্তব্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ সাম্প্রাতিক কালের কিছু লেখক মাহদীর আগমন সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে নিজেদের মতো ও বিবেক বুদ্ধির উপর নির্ভর করা ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো দলীল নেই।
কিছু গোমরাহ সম্প্রদায় মাহদীর ব্যাপারে খুব বাড়াবাড়ি করেছে। এমনকি প্রত্যেক গোমরাহ সম্প্রদায় নিজেদের নেতাকে প্রতীক্ষিত মাহদী মনে করেছে। রাফেযীরা দাবি করে যে, তাদের প্রতীক্ষিত ইমামই মাহদী। তারা সামেরার গর্ত থেকে তাদের প্রতীক্ষিত ইমাম বের হবে বলে অপেক্ষা করছে। তারা তার নাম দিয়েছে মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আল-আসকারী। তাদের মতে তিনি পাঁচশত বছর পূর্বে শিশুকালে সামেরার গর্তে প্রবেশ করেছেন। তারা তাদের ইমাম বের হওয়ার অপেক্ষা করছে।
শিয়াদের ফাতেমীয় সম্প্রদায় দাবি করে যে, তাদের নেতাই হবেন মাহদী। এভাবে যে কেউ মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করা, বিজয়ী হওয়া এবং তাদেরকে ধোঁকা দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে, সে নিজেকে প্রতীক্ষিত মাহদী বলে দাবি করেছে। অনুরূপ সুফীদের যে কেউ মিথ্যাচার ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে, সে নিজেকে আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত সাইয়্যেদ বা আওলাদে রসূল বলে দাবি করেছে।
আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা মাহদীর ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তারা সহীহ হাদীছ মোতাবেক মাহদীর আগমন সাব্যস্ত করেন। সহীহ হাদীছে তার নাম, পিতার নাম, বংশ, গুণাবলী ও তার বের হওয়ার সময়ের ব্যাপারে যা বর্ণিত হয়েছে সে অনুপাতে তারা মাহদীর আগমনে বিশ্বাসী। তারা এ ব্যাপারে সহীহ হাদীছের সীমালংঘন করেন না। তার বের হওয়ার পূর্বে অনেক আলামত দেখা দিবে, যা আলেমগণ তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন।
আল্লামা সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, মাহদীর ব্যাপারে অনেক কথা বর্ণিত হয়েছে। এমন কি এ কথাও বলা হয়েছে যে, لامهدي إلا عيسى ‘‘ঈসা ব্যতীত আর কোনো মাহদী নেই’’। অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালাম আসবেন; মাহদী নন। তবে আহলে হকদের মতে, সঠিক কথা হলো মাহদী ঈসা নন। মাহদী আসবেন ঈসা আলাইহিস সালাম নামার আগে। মাহদী সম্পর্কে এত বেশি হাদীছ এসেছে যে, তা অর্থগত মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আহলে সুন্নাতের আলেমদের নিকট মাহদী সংক্রান্ত হাদীছগুলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট হওয়ার কারণে তা আকীদার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সাহাবীদের নাম উল্লেখসহ এবং তাদের নাম উল্লেখ ছাড়া মাহদীর ব্যাপারে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে এবং সাহাবীদের পরে তাবেঈদের থেকেও অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, যা দ্বারা অকাট্য ইলম অর্জিত হয়। সুতরাং মাহদীর আগমনের উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। আলেমদের নিকট এটি একটি সুসাব্যস্ত বিষয় এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদার কিতাবগুলোতে এটি লিপিবদ্ধ রয়েছে।
অতঃপর ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ মাহদীর বৈশিষ্ট সম্পর্কে বলেন, আলেমগণ বলেছেন, তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত মোতাবেক আমল করবেন। এমনকি কোনো স্থান দিয়ে অতিক্রম করার সময় যদি ঘুমন্ত ও জাগ্রত উভয় শ্রেণীর লোক দেখতে পান, সে ক্ষেত্রেও তিনি সুন্নাতের অনুসরণ করবেন। অর্থাৎ জাগ্রতদেরকে সালাম দিয়ে চলে যাবেন, কিন্তু ঘুমন্তদেরকে জাগাবেন না। তিনি সুন্নাত প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করবেন, প্রতিটি সুন্নাত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন এবং সমস্ত বিদআতের মূলোৎপাটন করবেন। আখেরী যামানায় তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ন্যায় দীন প্রতিষ্ঠা করবেন। খ্রিষ্টানদের ক্রুশ চিহ্ন ভেঙে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন, মুসলিমদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন সুদৃঢ় করবেন এবং পৃথিবী যেভাবে যুলুম-নির্যাতনে ভরে গেছে, সেভাবেই ন্যায়-ইনসাফ দ্বারা ভরপুর করে দিবেন।
ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবার থেকে সুপথ প্রাপ্ত একজন পুরুষ বের হবেন। তার চরিত্র হবে উত্তম। তিনি কন্স্টানটিনোপ্ল জয় করবেন। তিনি হবেন উম্মতে মুহাম্মাদীর সর্বশেষ আমীর। তার যামানাতেই দাজ্জাল বের হবে এবং ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন।
তিনি আরো বলেন, আল্লামা শাইখ মারঈ রাহিমাহুল্লাহ তার فوائد الفكر নামক কিতাবে আবুল হাসান ইবনে মুহাম্মাদ আল-হাসান থেকে বর্ণনা করেছেন যে, মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মাহদীর আগমন সম্পর্কে প্রচুর হাদীছ বর্ণিত হয়েছে এবং সেটার বর্ণনাকরীগণ খুব প্রসিদ্ধ। তিনি হবেন রসূলের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তিনি সাতবছর রাজত্ব করবেন এবং পৃথিবীকে ন্যায়-ইনসাফ দ্বারা ভরপুর করে দিবেন। তার জীবদ্দশাতেই ঈসা আলাইহিস সালাম আগমন করবেন এবং ফিলিসত্মীনের যমীনে লুদ্দের ফটকের সামনে দাজ্জালকে হত্যা করার কাজে তাকে সাহায্য করবেন। তিনি এ উম্মতের ইমামতি করবেন এবং ঈসা আলাইহিস সালাম তার পিছনেই মুক্তাদী হয়ে সালাত পড়বেন। অর্থাৎ মাত্র এক ওয়াক্ত সালাত পড়বেন। সেটি হলো ফজরের সালাত ।
তিনি হলেন মাহদী। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন, তার সুস্পষ্ট গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তার বের হওয়ার সময় বলে দিয়েছেন এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন। মাহদী আসার আগেই একদল গোমরাহ লোক নিজেদেরকে মাহদী বলে দাবি করেছে। মাহদীর বিশেষণ তাদের মধ্যে মোটেই পাওয়া যায়নি। এর মাধ্যমে তারা সরল প্রাণ মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে এবং মাহদীয়াতের দাবি করে নিজেদের লোভ-লালসা বাস্তবায়নের পায়তারা করেছে। আল্লাহ তা‘আলা এই মিথ্যুকদের মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মুক্ত করেছেন এবং তাদের বাতিলকে মানুষের সামনে সুস্পষ্ট করে দেখিয়েছেন।
হে পাঠক সম্প্রদায়! আপনারা আশ্চর্যবোধ করবেন না! একদল লোক নবুওয়াত দাবি করেছে। তারা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ قَالَ أُوحِيَ إِلَيَّ وَلَمْ يُوحَ إِلَيْهِ شَيْءٌ﴾
‘‘আর সে ব্যক্তির চেয়ে বড় যালেম আর কে হতে পারে যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ রটায় অথবা বলে আমার কাছে অহী এসেছে অথচ তার উপর কোনো অহী নাযিল করা হয়নি’’। (সূরা আনআম: ৯৩)
আমরা আল্লাহর কাছে দু‘আ করি, তিনি যেন আমাদের সামনে সত্যকে সত্য হিসাবে উদ্ভাসিত করেন এবং সেটার অনুসরণ করার তাওফীক দান করেন। সেই সঙ্গে বাতিলকেও যেন আমাদের সামনে বাতিল হিসাবে সুস্পষ্ট রূপে প্রকাশ করেন এবং আমাদেরকে সেটা থেকে দূরে রাখেন। একই সঙ্গে আমাদেরকে যেন পথভ্রষ্ট ইমাম এবং প্রতারক-মিথ্যুকদের অনিষ্ট থেকে হেফাযত করেন। আমরা আল্লাহ পাক রাববুল আলামীনের প্রশংসা করছি।
[1]. মুসনাদে আহমাদ, সহীহুল জামে আস্সাগীর, হাদীছ নং- ৫১৮০।
সে হলো মাসীহ দাজ্জাল, ফিতনাবাজ, মিথ্যুক এবং গোমরাহ। আমরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার ফিতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। প্রত্যেক নবীই নিজ নিজ সম্প্রদায়কে দাজ্জালের ভয় দেখিয়েছেন, তার ফিতনা থেকে সতর্ক করেছেন এবং তার স্বভাব-চরিত্র বর্ণনা করেছেন। আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার থেকে সবচেয়ে বেশী সতর্ক করেছেন। তিনি তার উম্মতের জন্য দাজ্জালের বৈশিষ্টগুলো এত খোলাসা করে বর্ণনা করেছেন যে, বিবেকবান লোকদের কাছে তা মোটেই অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। তিরমিযী শরীফের হাদীছে আছে, সে খোরাসান থেকে বের হবে। সহীহ মুসলিমে আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু হিসাবে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘ইস্পাহানের সত্তর হাজার ইয়াহূদী দাজ্জালের অনুসরণ করবে। তাদের সবার পরনে থাকবে তায়ালেসা বা সেলাই বিহীন চাদর’’।[1]
দাজ্জালকে المسيح বলার কারণ হলো, তার এক চোখ অন্ধ থাকবে। কেউ কেউ বলেছেন, সে যেহেতু মক্কা ও মদীনা ব্যতীত সমগ্র ভূপৃষ্ঠে পরিভ্রমণ করবে, তাই তার নাম দেয়া হয়েছে মাসীহ বা ভূপৃষ্ঠে পরিভ্রমণকারী। আর الدجال শব্দটি الدجل থেকে নেয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো, الخلط বিভ্রান্তিতে নিপতিত করা, ধোঁকাবাজি করা। কেউ যখন বিভ্রান্তিতে ফেলে এবং ধোঁকাবাজি করে তখন বলা হয়, خَلَطَ وَمَوَّهَ বিভ্রান্তিতে ফেলেছে ও ধোঁকা দিয়েছে। دجال শব্দটি فَّعال এর ওজনে আধিক্য বাচক বিশেষ্য। তার থেকে যেহেতু প্রচুর পরিমাণ মিথ্যাচার ও ধোঁকাবাজি প্রকাশিত হবে, তাই তাকে দাজ্জাল বলা হয়। মাহদীর জীবদ্দশাতেই সে বের হবে।
হাফেয ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, অতঃপর আখেরী যামানায় দাজ্জালকে বের হওয়ার অনুমতি দেয়া হবে। প্রথমত সে প্রভাবশালী বাদশাহর বেশে প্রকাশিত হবে। অতঃপর সে নবুওয়াত দাবি করবে। অতঃপর রুবুবীয়াত দাবি করবে। বনী আদমের অজ্ঞ, মূর্খ এবং ইতর শ্রেণী ও সাধারণ লোকেরা তার অনুসরণ করবে। আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে হেদায়াতের পথে রাখবেন, তারা তার প্রতিবাদ করবেন। সে এক এক করে দেশ, ঘাটি, অঞ্চল ও গ্রাম দখল করতে থাকবে। সে তার অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীসহ মক্কা ও মদীনা ব্যতীত সবদেশেই প্রবেশ করবে।
সাহাবীগণ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছেন দাজ্জাল পৃথিবীতে কতদিন অবস্থান করবে? উত্তরে তিনি বলেছেন, সে চল্লিশ দিন অবস্থান করবে। প্রথম দিনটি হবে এক বছরের মতো লম্বা। দ্বিতীয় দিনটি হবে এক মাসের মতো। তৃতীয় দিনটি হবে এক সপ্তাহের মতো। আর বাকী দিনগুলো দুনিয়ার স্বাভাবিক দিনের মতই হবে। সে গড়ে একবছর আড়াই মাস অবস্থান করবে। আমরা বললাম, যে দিনটি এক বছরের মত দীর্ঘ হবে সে দিন কি এক দিনের সালাত ই যথেষ্ট হবে? উত্তরে তিনি বললেন, না; বরং তোমরা অনুমান করে সময় নির্ধারণ করে সালাত পড়বে।[2]
আল্লাহ তা‘আলা দাজ্জালের হাতে অনেক অস্বাভাবিক জিনিস সৃষ্টি করবেন। এর মাধ্যমে তিনি যাকে ইচ্ছা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করবেন। মুমিনগণ এগুলো দেখেও ঈমানের উপর অটল থাকবেন। তাদের ঈমানের সাথে আরো ঈমান বৃদ্ধি পাবে এবং হেদায়াতের সাথে আরো হিদায়াত বৃদ্ধি পাবে। হেদায়াতের প্রদীপ ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম এ গোমরাহ মিথ্যুক ধোঁকাবাজের জীবদ্দশাতেই বের হবেন। মুমিনগণ ঈসা ইবনে মারইয়ামের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হবেন। আল্লাহর মুত্তাকী বান্দারা তার সাথে যোগদান করবেন। তিনি তাদেরকে নিয়ে দাজ্জালের উদ্দেশ্যে বের হবেন। দাজ্জাল তখন বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে যেতে থাকবে। তাকে দেখে দাজ্জাল পালানোর চেষ্টা করবে। অতঃপর ঈসা আলাইহিস সালাম লুদ্দ শহরের ফটকের নিকট তার সাক্ষাত পাবেন। দাজ্জাল যখন লুদ্দ শহরে প্রবেশ করতে চাইবে তখন ঈসা আলাইহিস সালাম বর্শার আঘাতে তাকে হত্যা করবেন। তিনি তখন দাজ্জালকে লক্ষ্য করে বলবেন, আমি তোমাকে একটি আঘাত করবো, যা থেকে তুমি কখনো পালাতে পারবেনা। ঈসা আলাইহিস সালামের সামনে পড়ার সাথে সাথে সে পানিতে লবণ গলার মতই গলতে থাকবে। তারপরও তিনি অগ্রসর হয়ে লুদ্দ শহরের গেইটের নিকট যুদ্ধের বর্শা দিয়ে তাকে একটি আঘাতের মাধ্যমে হত্যা করবেন। সেখানেই সে মারা যাবে। এভাবেই দাজ্জালের পরিসমাপ্তির কথা একাধিক সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। তার উপর আল্লাহর লা’নত বর্ষিত হোক। সহীহ হাদীছের বর্ণনা মোতাবেক ইমাম ইবনে কাছীরের বর্ণনায় সংক্ষিপ্তভাবে এখানেই দাজ্জালের কাহিনী শেষ হলো। এ সংক্ষিপ্ত বর্ণনাটি খুবই উপকারী।
দাজ্জাল ও তার ফিতনা সম্পর্কিত হাদীছগুলো প্রমাণ করে যে, যারা দাজ্জালের আহবানে সাড়া দিবে, সে তাদের জন্য আসমানকে বৃষ্টি বর্ষণ করতে বলার সাথে আসমান বৃষ্টি বর্ষণ করবে, যমীনকে ফল ও ফসল উৎপন্ন করার আদেশ দেয়ার সাথে সাথে যমীন তা উৎপন্ন করবে। তা থেকে তারা ও তাদের পশু-পাখিগুলো আহার করবে। এতে করে তাদের পশুপাল মোটা-তাজা ও প্রচুর দুধ ওয়ালা হয়ে যাবে।
আর যারা তার আহবানে সাড়া দিবে না; বরং তার প্রতিবাদ করবে, তারা দুর্ভিক্ষ, ফসলহানি, অনাবৃষ্টি, ধন-সম্পদের কমতি, চতুষ্পদ জন্তুর প্রাণহানি, জান-মাল ও ফলফলাদির ঘাটতিসহ আরো অনেক বিপদাপদে নিপতিত হবে। আর দাজ্জালের পিছনে ভূগর্ভস্থ গুপ্তধন মৌমাছির ন্যায় ছুটে চলবে। সে একজন মুমিন যুবককে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করবে।[3] এসবগুলোই ফিতনা। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা আখেরী যামানায় তার মুমিন বান্দাদেরকে পরীক্ষা করবেন। এর মাধ্যমে অনেকেই বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হবে।
দাজ্জালের মাধ্যমে এত কিছু প্রকাশিত হওয়ার পরও সে হবে আল্লাহর নিকট খুব তুচ্ছ, সুস্পষ্ট ত্রুটিযুক্ত। তার থেকে পাপাচার ও যুলুম প্রকাশিত হবে। যদিও তার সাথে অনেক অস্বাভাবিক ও অসাধারণ জিনিস থাকবে। তার দুই চোখের মাঝখানে কাফের লেখা থাকবে। তার হাতে যা কিছু ঘটবে তা কেবল আল্লাহর পক্ষ হতে তার বান্দাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যই। এটি একটি বিরাট পরীক্ষা। ঈমানদার ও সুদৃঢ় বিশ্বাসের অধিকারীরাই এ থেকে রেহাই পাবে। তার ভয়ানক ক্ষতি ও ফিতনার কারণেই সমস্ত নবী নিজ নিজ উম্মতকে সতর্ক করেছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উম্মতকে সবচেয়ে বেশি সতর্ক করেছেন।
আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, নূহ আলাইহিস সালামের পরে যত নবী আগমন করেছেন, তাদের সকলেই নিজ নিজ সম্প্রদায়কে দাজ্জালের ফিতনা সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। আর আমিও তার থেকে তোমাদেরকে সতর্ক করছি। ইমাম আবু দাউদ, আহমাদ ও তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
প্রত্যেক সালাতের শেষাংশে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের ফিতনা থেকে আল্লাহ তা‘আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করার আদেশ দিয়েছেন। আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إِذَا فَرَغَ أَحَدُكُمْ مِنْ التَّشَهُّدِ الْآخِرِ فَلْيَتَعَوَّذْ بِاللَّهِ مِنْ أَرْبَعٍ مِنْ عَذَابِ جَهَنَّمَ وَمِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ وَمِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ وَمِنْ شَرِّ الْمَسِيحِ الدَّجَّالِ»
‘‘তোমাদের কেউ যখন সালাতের শেষ তাশাহুদ পাঠ শেষ করবে, তখন সে যেন আল্লাহর কাছে চারটি বিষয় থেকে আশ্রয় চায়। হে আল্লাহ! জাহান্নামের আযাব থেকে, কবরের আযাব থেকে, জীবন-মরণের ফিতনা থেকে এবং মিথ্যুক দাজ্জালের ফিতনা থেকে’’।[4] ইমাম আহমাদ ও মুসলিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
দাজ্জাল বের হওয়া, তার ফিতনা এবং তার ফিতনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনার ব্যাপারে বিভিন্ন সূত্রে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। আখেরী যামানায় তার বের হওয়ার উপর আলেমদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে। আকীদা সংক্রান্ত আলোচনার সাথেই তারা দাজ্জালের আলোচনা করেছেন। যে ব্যক্তি দাজ্জালের আগমন অস্বীকার করবে, সে মুতাওয়াতের সূত্রে বর্ণিত সহীহ হাদীছসমূহের বিরোধীতাকারী হিসাবে গণ্য হবে। সেই সঙ্গে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধীতাকারী বলে গণ্য হবে। খারেজী, জাহমীয়া, কতিপয় মু‘তাযিলা এবং সমসাময়িক কিছু লেখক ও স্বঘোষিত বুদ্ধিজীবি ছাড়া অন্য কেউ দাজ্জালের আগমন অস্বীকার করেনি। এ ব্যাপারে তাদের নিকট বিবেক-বুদ্ধি ও প্রবৃত্তির অনুসরণ ছাড়া আর কোনো দলীল নেই। এসব লোকের কথার কোনো মূল্য নেই।
আল্লাহ তা‘আলা ও তার রসূল থেকে সহীহ সূত্রে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, মুমিনদের উপর তা বিশ্বাস করা এবং আকীদা হিসাবে গ্রহণ করা আবশ্যক। তারা যেন ঐসব লোকের অন্তর্ভুক্ত না হন, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿بَلْ كَذَّبُوا بِمَا لَمْ يُحِيطُوا بِعِلْمِهِ وَلَمَّا يَأْتِهِمْ تَأْوِيلُهُ﴾
‘‘বরং তারা এমন বিষয়কে অস্বীকার করেছে, যা তারা জ্ঞান দ্বারা আয়ত্ত করতে পারেনি। তাদের কাছে এখনো সেটার পরিণাম ফল আগমন করেনি’’। (সূরা ইউনুস: ৩৯)
কেননা আল্লাহর প্রতি এবং তার রসূলের প্রতি ঈমান আনয়নের দাবি হলো আল্লাহ ও তার রসূলের নিকট থেকে যা কিছু এসেছে, তা সম্পূর্ণরূপে মেনে নেয়া এবং তার প্রতি পরিপূর্ণরূপে ঈমান আনয়ন করা। যে ব্যক্তি তা করবেনা, সে আল্লাহর হিদায়াত ছাড়াই স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণকারী হিসাবে গণ্য হবে। আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে সন্দেহ, শিরক, ফুফুরী, নিফাকী এবং মন্দ আখলাক-চরিত্র নিরাপত্তা কামনা করছি এবং আমরা আরো প্রার্থনা করছি, তিনি যেন সঠিক পথ দেখানোর পর আমাদের অন্তরসমূহকে বক্র না করে দেন। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্য।
[1]. মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ফিতান।
[2]. মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবুল ফিতান।
[3]. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দাজ্জাল বের হয়ে মদীনার দিকে অগ্রসর হবে। যেহেতু মদীনায় দাজ্জালের প্রবেশ নিষেধ তাই সে মদীনার নিকটবর্তী একটি স্থানে অবস্থান করবে। তার কাছে একজন মুমিন লোক গমন করবেন। তিনি হবেন ঐ যামানার সর্বোত্তম মু’মিন। দাজ্জালকে দেখে তিনি বলবেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি সে দাজ্জাল যার সম্পর্কে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সাবধান করেছেন। তখন দাজ্জাল উপস্থিত মানুষকে লক্ষ্য করে বলবে, আমি যদি একে হত্যা করে জীবিত করতে পারি তাহলে কি তোমরা আমার ব্যাপারে কোন সন্দেহ পোষণ করবে? লোকেরা বলবে, না। অতঃপর সে উক্ত মুমিনকে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করবে। এ পর্যায়ে যুবকটি বলবেঃ আল্লাহর শপথ! তুমি যে মিথ্যুক দাজ্জাল- এ সম্পর্কে আমার বিশ্বাস আগের তুলনায় আরো মজবুত হলো। দাজ্জাল তাকে দ্বিতীয়বার হত্যা করার চেষ্টা করবে। কিন্তু তাকে হত্যা করতে সক্ষম হবেনা।
মুসলিম শরীফের বর্ণনায় এসেছে উক্ত যুবক দাজ্জালকে দেখে বলবে, হে লোক সকল! এটি সে দাজ্জাল যা থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সাবধান করেছেন। অতঃপর দাজ্জাল তার অনুসারীদেরকে বলবে, একে ধর এবং প্রহার কর। তাকে মেরে-পিটিয়ে যখম করা হবে। অতঃপর দাজ্জাল তাকে জিজ্ঞাসা করবে এখনও কি আমার প্রতি ঈমান আনবেনা? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, উক্ত যুবক বলবেন, তুমি মিথ্যাবাদী দাজ্জাল। তারপর দাজ্জালের আদেশে তার মাথায় করাত লাগিয়ে দ্বিখন্ডিত করে ফেলবে। দাজ্জাল দু’খন্ডের মাঝ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করবে। অতঃপর বলবে: উঠে দাড়াও। তিনি উঠে দাড়াবেন। দাজ্জাল বলবে এখনও ঈমান আনবে না? তিনি বলবেন, তুমি মিথ্যুক দাজ্জাল হওয়ার ব্যাপারে এখন আমার বিশ্বাস আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। অতঃপর তিনি বলবেনঃ হে লোক সকল! আমার পরে আর কারো সাথে এরূপ করতে পারবে না। অতঃপর দাজ্জাল তাকে পাকড়াও করে আবার যবেহ করার চেষ্টা করবে। কিন্তু তার গলায় যবেহ করার স্থানটি তামায় পরিণত হয়ে যাবে। কাজেই সে যবেহ করতে ব্যর্থ হবে। অতঃপর তার হাতে-পায়ে ধরে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবে। লোকেরা মনে করবে তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছে। অথচ সে জান্নাতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘এই ব্যক্তি হবে পৃথিবীতে সেদিন সবচেয়ে মহা সত্যের সাক্ষ্য দানকারী’’।
[4]. সহীহ মুসলিম ৫৮৮, অধ্যায়: সালাতে যা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা চাই, আবূ দাউদ ৯৮৩, সহীহ।।
ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালামের অবতরণের বিষয়টি যেমন কুরআন দ্বারা প্রমাণিত, তেমনি সত্যবাদী ও সত্যবাদী হিসাবে সমর্থিত আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও তার আগমন সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন। তিনি তো নিজের পক্ষ হতে বানিয়ে কিছুই বলেন না। এ ব্যাপারে মুতাওয়াতের সূত্রে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এ বিষয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের সমস্ত আলেমের ইজমা সংঘটিত হয়েছে। ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণের প্রতি ঈমান আনয়ন করাকে ওয়াজিব হিসাবে গণ্য করেছেন।
ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণের বিষয়টি আল্লাহর কিতাব, রসূলের সুন্নাত ও উম্মতের ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِنْ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ إِلَّا لَيُؤْمِنَنَّ بِهِ قَبْلَ مَوْتِهِ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكُونُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا﴾
‘‘আহলে কিতাবদের প্রত্যেকেই তার মৃত্যুর পূর্বে তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে এবং কিয়ামত দিবসে তিনি তাদের উপর সাক্ষ্য প্রদান করবেন’’।[1]
অর্থাৎ ঈসার মৃত্যুর পূর্বে তার প্রতি ঈমান আনয়ন করবে। আর সেটি হবে আখেরী যামানায় তার অবতরণের পর। তখন মাত্র একটি দীন ব্যতীত অন্য কোনো দীন থাকবেনা। সেটি হবে একনিষ্ঠ মুসলিম ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দীন।
সুন্নাতের দলীল দ্বারাও তার অবতরণের বিষয়টি সাব্যস্ত। বুখারী, মুসলিম এবং অন্যান্য কিতাবে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَيُوشِكَنَّ أَنْ يَنْزِلَ فِيكُمُ ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَدْلًا فَيَكْسِرَ الصَّلِيبَ وَيَقْتُلَ الْخِنْزِيرَ وَيَضَعَ الْجِزْيَةَ»
‘‘ঐ আল্লাহর শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে। অচিরেই ন্যায় বিচারক শাসক হিসাবে ঈসা (আ.) তোমাদের মাঝে আগমন করবেন। তিনি ক্রুশচিহ্ন ভেঙ্গে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন এবং জিযিয়া কর প্রত্যাখ্যান করবেন’’।[2] সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«وَالَّله ليَنْزِلَن فِيكُمُ ابْنُ مَرْيَمَ حَكَمًا عَدْلًا فَيَكْسِرَ الصَّلِيبَ»
‘‘আল্লাহর শপথ! অচিরেই ন্যায় বিচারক শাসক হিসাবে ঈসা (আঃ) তোমাদের মাঝে আগমন করবেন। তিনি এসে খ্রিষ্টানদের ক্রুশচিহ্ন ভেঙ্গে ফেলবেন’’। ইমাম মুসলিম জাবের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেছেন যে, রসূল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي يُقَاتِلُونَ عَلَى الْحَقِّ ظَاهِرِينَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ قَالَ فَيَنْزِلُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ فَيَقُولُ أَمِيرُهُمْ تَعَالَ صَلِّ بنا فَيَقُولُ لَا إِنَّ بَعْضَكُمْ عَلَى بَعْضٍ أُمَرَاءُ تَكْرِمَةَ اللَّهِ هَذِهِ الْأُمَّةَ»
‘‘আমার উম্মতের একটি দল হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে কিয়ামত পর্যন্ত লড়াই করে বিজয়ী থাকবে। অতঃপর ঈসা (আ.) আগমন করবেন। সেদিন মুসলমানদের আমীর তাকে লক্ষ্য করে বলবেন, আসুন! আমাদের ইমামতি করুন। তিনি বলবেন, না; বরং তোমাদের একজন অন্যজনের আমীর। এ কারণে যে, আল্লাহ এ উম্মতকে সম্মানিত করেছেন’’।[3]
ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনের ব্যাপারে উম্মতের আলেমদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে। ইসলামী শরী‘আতের কোনো আলেম এই ইজমার বিরোধিতা করেছেন বলে জানা যায়নি। দার্শনিক, নাস্তিক অথবা যাদের কথার কোনো মূল্য নেই তারাই কেবল ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনকে অস্বীকার করেছে।
এই মর্মে আলেমদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে যে, ঈসা আলাইহিস সালাম আগমন করবেন এবং শরী‘আতে মুহাম্মাদীর মাধ্যমে হুকুম-ফায়ছালা করবেন। তিনি আসমান থেকে নামার সময় নতুন কোনো শরী‘আত নিয়ে আসবেন না। যদিও তিনি নবী হিসাবেই থাকবেন। তিনি নেমে মাহদীর নিকট থেকে দায়িত্ব বুঝে নিবেন। মাহদী নিজে এবং তার অন্যান্য সাথীগণও ঈসা আলাইহিস সালামের অনুসরণ করবেন। ইমাম সাফারায়েনীর কথা এখানেই শেষ।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ঈসা আলাইহিস সালাম আসমানে এখনো জীবিত আছেন। তিনি যখন আসমান থেকে নেমে আসবেন, তখন আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাত ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ফায়ছালা করবেন না। তখন আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের বিরোধিতা করার মতো কিছুই থাকবে না।
শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, ঈসা আলাইহিস সালাম জীবিত আছেন। সহীহ সূত্রে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন, তোমাদের মাঝে ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম ন্যায় বিচারক এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হিসাবে অবতরণ করবেন। তিনি এসে ক্রুশচিহ্ন ভেঙে ফেলবেন। তিনি শূকর হত্যা করবেন এবং জিযিয়া কর রহিত করবেন। তার থেকে সহীহ সূত্রে আরো বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, দামেস্ক নগরীর পূর্ব পার্শ্বের সাদা মিনারের উপর তিনি অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। আর যাদের রূহ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, আসমান থেকে তাদের দেহ অবতরণ করবে না। তাদেরকে যখন জীবিত করা হবে, তখন তারা তাদের কবর থেকে বের হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِذْ قَالَ اللَّهُ يَاعِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا﴾
‘‘যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে ওয়াফাত দান করবো। অতঃপর তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নিবো এবং আমি তোমাকে কাফেরদের থেকে পবিত্র করবো’’। (সূরা আলে-ইমরান: ৫৫)
এ আয়াতে ওয়াফাত দ্বারা মৃত্যু উদ্দেশ্য করা হয়নি। যদি মৃত্যু উদ্দেশ্য করা হতো, তাহলে তিনি এ বিষয়ে অন্যান্য সাধারণ মুমিনের মতই হতেন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের রূহ কবয করেন এবং তা আসমানে উঠানো হয়। এতে জানা গেলো যে, তার রূহ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পুনরায় তাতে ফেরত দেয়ার মধ্যে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট থাকেনা।
অনুরূপ আল্লাহ তা‘আলার বাণী:﴿وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا﴾ ‘‘এবং আমি তোমাকে কাফেরদের থেকে পবিত্র করবো’’। তাকে আসমানে উঠানোর সময় যদি তার রূহ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হতো, তাহলে তার দেহ অন্যান্য নবী কিংবা সাধারণ মুমিনদের দেহের মতোই যমীনে থাকতো। আল্লাহ তা‘আলা অন্য আয়াতে বলেন,
﴿وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَٰكِن شُبِّهَ لَهُمْ ۚ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِّنْهُ ۚ مَا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلَّا اتِّبَاعَ الظَّنِّ ۚ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا بَل رَّفَعَهُ اللَّهُ إِلَيْهِ ۚ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا﴾
‘‘প্রকৃতপক্ষে তারা তাকে হত্যা করেনি এবং শূলেও চড়ায়নি বরং ব্যাপারটিকে তাদের জন্য সন্দিহান করে দেয়া হয়েছে। আর যারা এ ব্যাপারে মতবিরোধ করেছে তারাও আসলে সন্দেহের মধ্যে অবস্থান করছে। তাদের কাছে এ সম্পর্কিত কোনো জ্ঞান নেই, আছে আন্দাজ-অনুমানের অন্ধ অনুস্মরণ মাত্র। নিঃসন্দেহে তারা ঈসা মসীহকে হত্যা করেনি; বরং আল্লাহ তাকে নিজের দিকে উঠিয়ে নিয়েছেন। আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা নিসা: ১৫৭-১৫৮)
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, তাকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, এর মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে যে, তাকে রূহ এবং দেহ সহকারে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। যেমন সহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত হয়েছে যে, তার দেহ এবং রূহ উভয়ই অবতরণ করবে। যদি তার মৃত্যু উদ্দেশ্য করা হতো, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা বলতেন, তারা তাকে হত্যা করতে পারেনি, ক্রুশবিদ্ধ করতে পারেনি; বরং তিনি স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছেন।
এ জন্যই কতক আলেম বলেছেন, ﴿إِنِّي مُتَوَفِّيكَ﴾ ‘‘নিশ্চয় আমি তোমাকে ওয়াফাত দান করবো’’। অর্থাৎ আমি তোমার দেহ ও রূহ গ্রহণ করে নিবো। যেমন বলা হয়, توفيت الحساب واستوفيته ‘‘আমি তার থেকে পরিপূর্ণ হিসাব গ্রহণ করেছি’’। التوفي শব্দটি দ্বারা দেহ ব্যতীত শুধু রূহ কবয করা বুঝায় এবং আলাদা কোনো আলামত ছাড়া উভয়টি একসাথে কবয করাও বুঝায় না। কখনো কখনো সেটা দ্বারা নিদ্রা উদ্দেশ্য হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿اللَّهُ يَتَوَفَّى الْأَنفُسَ حِينَ مَوْتِهَا وَالَّتِي لَمْ تَمُتْ فِي مَنَامِهَا ۖ فَيُمْسِكُ الَّتِي قَضَىٰ عَلَيْهَا الْمَوْتَ وَيُرْسِلُ الْأُخْرَىٰ إِلَىٰ أَجَلٍ مُّسَمًّى ۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَاتٍ لِّقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ﴾
‘‘মৃত্যুর সময় আল্লাহ রূহসমূহ কবয করেন আর যে এখনো মরেনি নিদ্রাবস্থায় তার রূহ কবয করেন। অতঃপর যার মৃত্যুর ফায়ছালা কার্যকরী হয় তাকে রেখে দেন এবং অন্যদের ‘রূহ’ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ফেরত পাঠান। যারা চিন্তা-গবেষণা করে তাদের জন্য এর মধ্যে বড় নিদর্শন রয়েছে’’। (সূরা যুমার: ৪২) এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, ‘রূহ’ কবয করা হয়, তাকে আটকিয়ে রাখা হয় আবার ছেড়েও দেয়া হয়। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُم بِاللَّيْلِ وَيَعْلَمُ مَا جَرَحْتُم بِالنَّهَارِ ثُمَّ يَبْعَثُكُمْ فِيهِ لِيُقْضَىٰ أَجَلٌ مُّسَمًّى ۖ ثُمَّ إِلَيْهِ مَرْجِعُكُمْ ثُمَّ يُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ﴾
‘‘তিনিই রাত্রিকালে তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং দিবসে তোমরা যা কিছু উপার্জন করো তা জানেন। পুনরায় তোমাদের সেই কর্মজগতে ফেরত পাঠান, যাতে জীবনের নির্ধারিত সময়-কাল পূর্ণ হয়। সবশেষে তারই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে। তখন তিনি জানিয়ে দেবেন তোমরা কি কাজে লিপ্ত ছিলে’’। (সূরা আনআম: ৬০) শাইখুল ইসলামের কথা এখানেই শেষ।
ইমাম কাযী ইয়ায রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতে ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন এবং দাজ্জালকে হত্যা করা সত্য ও সঠিক। কেননা এ মর্মে অনেক সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। বিবেক-বুদ্ধি প্রসূত দলীল ও শরী‘আতের দলীল এটিকে বাতিল করে না। সুতরাং ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন ও দাজ্জালের আগমন সাব্যস্ত করা আবশ্যক। তিনি দাজ্জালকে হত্যা করবেন, এটি সাব্যস্ত করাও আবশ্যক। কিছু কিছু মু‘তাযিলা ও জাহমীয়া দাজ্জালের আগমন ও ঈসা আলাইহিস সালামের আগমনকে অস্বীকার করেছে। তারা মনে করেছে ঈসা আলাইহিস সালামের আগমন সংক্রান্ত হাদীছগুলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী: «وخاتم النبيين» ‘‘তিনি সর্বশেষ নবী’’ এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী, «لانبي بعدي» ‘‘আমার পরে আর কোনো নবী নেই’’ দ্বারা রহিত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে মুসলিমদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে যে, আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবীর পরে আর কোনো নবী নেই। তার শরী‘আত কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে, তা কখনো রহিত হবে না।
এটি একটি ভ্রান্ত দলীল। কেননা ঈসা আলাইহিস সালামের আগমণের উদ্দেশ্য এ নয় যে, তিনি নবী হয়ে আগমন করবেন এবং নতুন শরী‘আত নিয়ে আসবেন ও আমাদের শরী‘আতকে রহিত করে দিবেন। উপরোক্ত হাদীছে কিংবা অন্যান্য হাদীছে এমন কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায় না। বরং এখানে আলোচিত একাধিক সহীহ হাদীছ এবং ঈমান অধ্যায়ে অতিক্রান্ত হাদীছগুলো প্রমাণ করে যে, তিনি একজন ন্যায়পরায়ন শাসক হয়ে আগমন করবেন ও আমাদেরকে শরী‘আত দ্বারা ফায়ছালা করবেন। সেই সঙ্গে মানুষ আমাদের শরী‘আতের যে বিষয়গুলো পরিত্যাগ করেছে, তিনি তা পুনরুজ্জীবিত করবেন। শাইখুল ইসলামের কথা এখানেই শেষ।
আল্লামা শাইখ সালেহ ফাওযান হাফিযাহুল্লাহ বলেন, আমি বলছি, বর্তমান সময়ে কিছু মূর্খ লেখক এবং অর্ধ শিক্ষিত লোক তাদের বিবেক-বুদ্ধির উপর নির্ভর করে ঈসা আলাইহিস সালামের অবতরণকে অস্বীকার করে। তারা এ বিষয়ে বর্ণিত সহীহ হাদীছগুলোকে অস্বীকার করে থাকে অথবা এগুলোর ভুল ব্যাখ্যা করে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন এবং আকীদার যেসব বিষয় তার থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, মুসলিমদের তা বিশ্বাস করা আবশ্যক। কেননা এগুলোতে বিশ্বাস করা ঐসব গায়েবী বিষয়ের প্রতি বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে অবগত করেছেন।
আল্লামা ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ঈসা আলাইহিস সালাম আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরী‘আতের স্বীকৃতি প্রদান করবেন। কেননা তিনি এ উম্মতের জন্য একজন দূত স্বরূপ। যেমনটি ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। তিনি দুনিয়াতে নামার আগেই আসমানে অবস্থানকালে আল্লাহ তা‘আলার আদেশে এ শরী‘আতের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে জেনে নিবেন।
ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, কতিপয় আলেম মনে করে ঈসা ইবনে মারইয়াম অবতরণ করার আগে ইসলামী শরী‘আতের হুকুম-আহকাম উঠে যাবে। একাধিক সহীহ হাদীছের বর্ণনা অনুপাতে এ ধারণা সম্পূর্ণ বাতিল। হাদীছগুলো প্রমাণ করে যে, তিনি এ শরী‘আতের হুকুম-আহকামের স্বীকৃতি প্রদান করবেন এবং সেটার সংস্কার সাধন করবেন। কেননা মুহাম্মাদী শরী‘আত হলো সর্বশেষ শরী‘আত এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ রসূল। বিনা আসমানী শরী‘আতে দুনিয়া কখনো টিকে থাকবে না। দুনিয়া টিকে থাকা আসমানী শরী‘আতের তাকলীফ বিদ্যমান থাকার উপর নির্ভরশীল। পৃথিবীতে যতদিন আল্লাহ আল্লাহ বলা হবে ততো দিন কিয়ামত হবে না। ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ তার ‘তাযকিরা’ নামক গ্রন্থে এ কথা উল্লেখ করেছেন।
তিনি আরো বলেন, ঈসা আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে কতদিন থাকবেন, এ বিষয়ে ইমাম তাবারানী এবং ইবনে আসাকির আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তিনি মানুষের মাঝে চল্লিশ বছর অবস্থান করবেন। ইমাম আহমাদ, ইবনে আবী শায়বা, আবু দাউদ, ইবনে জারীর এবং ইবনে হিববান প্রমুখ বর্ণনা করেছেন যে, তিনি চল্লিশ বছর অবস্থান করবেন। অতঃপর মৃত্যুবরণ করবেন। মুসলিমগণ তার জানাযা সালাত পড়বে। আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পাশেই তাকে দাফন করা হবে। ইমাম সাফারায়েনীর উক্তি এখানেই শেষ।
[1]. সহীহ বুখারী ৩৪৪৮, অধ্যায়: কিতাবু আহাদীছুল আম্বীয়া। মুসলিম, অধ্যায়: ঈসা (আ.)এর অবতরণ।
[2]. সহীহ বুখারী ৩৪৪৮, অধ্যায়: কিতাবু আহাদীছুল আম্বীয়া। মুসলিম, অধ্যায়: ঈসা (আ.)এর অবতরণ।
[3]. মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ঈমান।
আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের বিবরণ অনুযায়ী আমরা এখন ইয়াজুজ-মাজুজ সম্পর্কে আলোচনা করবো। কেননা মুসলিমদের উপর আবশ্যক হলো আকীদার অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় ইয়াজুজ-মা’জুজ বের হওয়ার প্রতি ঈমান আনয়ন করা। ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন, আল্লাহর কিতাব, রসূলের সুন্নাত এবং মুসলিমদের ইজমা দ্বারা ইয়াজুজ-মা’জুজ বের হওয়া সাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে বলেন,
﴿حَتَّى إِذَا فُتِحَتْ يَأْجُوجُ وَمَأْجُوجُ وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنسِلُونَ (৯৬) وَاقْتَرَبَ الْوَعْدُ الْحَقُّ فَإِذَا هِيَ شَاخِصَةٌ أَبْصَارُ الَّذِينَ كَفَرُوا يَاوَيْلَنَا قَدْ كُنَّا فِي غَفْلَةٍ مِنْ هَذَا بَلْ كُنَّا ظَالِمِين﴾
‘‘এমনকি যখন ইয়াজুজ ও মা’জুজকে মুক্ত করা হবে তখন তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে দলে দলে ছুটে আসবে। যখন সত্য প্রতিশ্রম্নতি নিকটবর্তী হবে তখন কাফেরদের চক্ষু স্থির হয়ে যাবে। তারা বলবে, হায় দুর্ভোগ আমাদের! আমরা তো ছিলাম এ বিষয়ে উদাসীন; বরং আমরা ছিলাম যালেম’’। (সূরা আম্বীয়া: ৯৬-৯৭) আল্লাহ তা‘আলা যুল কারনাইনের ঘটনায় বলেন,
﴿ثُمَّ أَتْبَعَ سَبَبًا (92) حَتَّى إِذَا بَلَغَ بَيْنَ السَّدَّيْنِ وَجَدَ مِنْ دُونِهِمَا قَوْمًا لَا يَكَادُونَ يَفْقَهُونَ قَوْلًا(93) قَالُوا يَاذَا الْقَرْنَيْنِ إِنَّ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ فَهَلْ نَجْعَلُ لَكَ خَرْجًا عَلَى أَنْ تَجْعَلَ بَيْنَنَا وَبَيْنَهُمْ سَدًّا (94) قَالَ مَا مَكَّنَنِي فِيهِ رَبِّي خَيْرٌ فَأَعِينُونِي بِقُوَّةٍ أَجْعَلْ بَيْنَكُمْ وَبَيْنَهُمْ رَدْمًا (95) آتُونِي زُبَرَ الْحَدِيدِ حَتَّى إِذَا سَاوَى بَيْنَ الصَّدَفَيْنِ قَالَ انفُخُوا حَتَّى إِذَا جَعَلَهُ نَارًا قَالَ آتُونِي أُفْرِغْ عَلَيْهِ قِطْرًا(96) فَمَا اسْتَطَاعُوا أَنْ يَظْهَرُوهُ وَمَا اسْتَطَاعُوا لَهُ نَقْبًا (97) قَالَ هَذَا رَحْمَةٌ مِنْ رَبِّي فَإِذَا جَاءَ وَعْدُ رَبِّي جَعَلَهُ دَكَّاءَ وَكَانَ وَعْدُ رَبِّي حَقًّا(98) وَتَرَكْنَا بَعْضَهُمْ يَوْمَئِذٍ يَمُوجُ فِي بَعْضٍ وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَجَمَعْنَاهُمْ جَمْعًا﴾
‘‘অতঃপর তিনি পথ অবলম্বন করলেন। চলতে চলতে তিনি যখন দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছলেন তখন তথায় এমন এক জাতির সন্ধান পেলেন যারা তার কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বললো হে যুল-কারনাইন! ইয়াজুয ও মা’জুয পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আমরা কি আপনাকে বিনিময় স্বরূপ কর প্রদান করবো এ শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি প্রাচীর নির্মাণ করে দিবেন? যুল-কারনাইন বললেন, আমার প্রভু আমাকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন তাই যথেষ্ট। তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য করো। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝখানে একটি মজবুত প্রাচীর তৈরী করে দিবো। তোমরা লোহার পাত নিয়ে আসো। অতঃপর যখন দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকাস্থান পূর্ণ হয়ে লৌহ স্ত্তপ দুই পর্বতের সমান হলো তখন যুল-কারনাইন বললেন, তোমরা ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালাও। যখন ওটা আগুনে পরিণত হলো তখন তিনি বললেন, তোমরা গলিত তামা আনয়ন করো, ওটা আগুনের উপরে ঢেলে দেই। এভাবে প্রাচীর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর ইয়াজুজ ও মা’জুজ তা অতিক্রম করতে পারলোনা এবং তা ছিদ্র করতেও সক্ষম হলো না। যুল-কারনাইন বললেন, এটা আমার প্রভুর অনুগ্রহ। যখন আমার প্রভুর ওয়াদা পূরণের সময় নিকটবর্তী হবে তখন তিনি প্রাচীরকে ভেঙ্গে চুরমার করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিবেন। আমার প্রতিপালকের ওয়াদা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। সেদিন আমি তাদেরকে ছেড়ে দেবো দলের পর দলে সাগরের ঢেউয়ের আকারে। এবং শিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে। অতঃপর আমি তাদের সকলকেই একত্রিত করবো’’। (সূরা কাহাফ: ৯২-৯৯)
দুই পাহাড়ের মাঝখানে নির্মিত এটি একটি লোহার প্রাচীর। যুলকারনাইন বাদশাহ এটি নির্মাণ করেছেন। ফলে তা এমন একটি মজবুত প্রাচীরে পরিণত হয়েছে, যা ভূপৃষ্ঠে ফাসাদ সৃষ্টিকারী এবং মানুষকে কষ্টদানকারী ইয়াজুজ-মা’জুজ সম্প্রদায়ের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতঃপর যখন এ প্রাচীর ধ্বংসের সময় উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা এটিকে মাটির সমান করে দিবেন। এটি এমন ওয়াদা, যা বাস্তবায়ন হবেই। প্রাচীর ধ্বংস হয়ে গেলে তারা প্রত্যেক টিলা থেকে দ্রুতগতিতে দলে দলে মানব সমাজে বের হয়ে আসবে। এর কিছুদিন পরেই শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে।
হাদীছ থেকে ইয়াজুজ-মা’জুজের দল বের হওয়ার দলীল হলো, সহীহ মুসলিমে নাওয়াস ইবনে সামআন থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা ঈসা আলাইহিস সালামকে জানাবেন যে, আমি এমন একটি জাতি বের করেছি, যাদের সাথে মোকাবেলা করার ক্ষমতা কারো নেই। কাজেই তুমি আমার বান্দাদেরকে নিয়ে তুর পাহাড়ে উঠে যাও। এ সময় আল্লাহ তা‘আলা ইয়াজুজ-মা’জুজের বাহিনী প্রেরণ করবেন। তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে বের হয়ে আসবে। তাদের প্রথম দলটি ফিলিসত্মীনের তাবারীয়া জলাশয়ের সমস্ত পানি পান করে ফেলবে। তাদের শেষ দলটি সেখানে এসে কোনো পানি না পেয়ে বলবে, এক সময় এখানে পানি ছিল। তারা আল্লাহর নবী ঈসা ও তার সাথীদেরকে অবরোধ করে রাখবে। ঈসা আলাইহিস সালাম ও তার সাথীগণ এ সময় প্রচ- খাদ্যাভাবে পড়বেন। এমনকি বর্তমানে তোমাদের কাছে একশত স্বর্ণ মুদ্রার চেয়ে তাদের কাছে একটি গরুর মাথা তখন বেশি প্রিয় হবে। আল্লাহর নবী ঈসা ও তার সাথীগণ এ ফিতনা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে দু’আ করবেন। আল্লাহ তাদের দু’আ কবূল করে ইয়াজুজ-মা’জুজের ঘাড়ে ‘নাগাফ’ নামক এক শ্রেণীর পোঁকা প্রেরণ করবেন। এতে একই সময়ে একটি প্রাণী মৃত্যু বরণ করার মতো তারা সবাই মারা যাবে। অতঃপর আল্লাহর নবী ঈসা ও তার সাথীগণ যমীনে নেমে এসে দেখবেন ইয়াজুজ-মাজুযের মরা-পচা লাশ ও তাদের শরীরের চর্বিতে সমগ্র যমীন ভরপূর হয়ে গেছে। কোথাও অর্ধহাত জায়গাও খালি নেই। আল্লাহর নবী ঈসা ও তার সাথীগণ আল্লাহর কাছে আবার দু’আ করবেন। আল্লাহ তাদের দু’আ কবুল করে উটের গর্দানের মত লম্বা লম্বা একদল পাখি পাঠাবেন। আল্লাহর আদেশে পাখিগুলো তাদেরকে অন্যত্র নিক্ষেপ করে পৃথিবীকে পরিস্কার করবে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। এতে পৃথিবী একেবারে আয়নার মতো পরিস্কার হয়ে যাবে।[1]
ইমাম তাবারানী হুযায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে মক্কা, মদীনা ও বাইতুল মাকদিসে প্রবেশ করা থেকে বাধা প্রদান করবেন। ইমাম নববী বলেছেন, অধিকাংশ আলেমের মতে তারা আদম সন্তানের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম ইবনে আব্দিল বার বলেছেন, আলেমদের ঐক্যমতে তারা ইয়াফিছ ইবনে নূহ আলাইহিস সালামের বংশধর।
আল্লামা সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেছেন যে, ইয়াজুজ-মা’জুজ আদমের সন্তানদের মধ্য থেকে তুর্কী বংশোদ্ভত দু’টি সম্প্রদায়। তিনি আরো বাড়িয়ে বলেছেন যে, তারা হলো নূহ আলাইহিস সালামের সন্তান তুর্কীদের পূর্ব পুরুষ ইয়াফিসের বংশধর।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইয়াজুজ-মা’জুজ বের হওয়ার সময় নিকটবর্তী হওয়ার সংবাদ দিয়েছেন এবং তাদের থেকে সতর্ক করেছেন। সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে এসেছে, তিনি বলেছেন, আজ ইযাজুজ-মা’জুজের প্রাচীর এ পরিমাণ খুলে দেয়া হয়েছে। এ কথা বলে তিনি হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ও শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে বৃত্ত তৈরী করে দেখিয়েছেন।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে যায়নাব বিনতে জাহ্শ (রা.) হতে বর্ণিত আছে,
«أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نام عندهَا ثم استيقظ محمرا وجهه وهو يَقُولُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَيْلٌ لِلْعَرَبِ مِنْ شَرٍّ قَدِ اقْتَرَبَ فُتِحَ الْيَوْمَ مِنْ رَدْمِ يَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ مِثْلُ هَذِهِ وَحَلَّقَ بِين إِصْبَعِهِ الْإِبْهَامِ وَالَّتِي تَلِيهَا قَالَتْ زَيْنَبُ بِنْتُ جَحْشٍ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَنَهْلِكُ وَفِينَا الصَّالِحُونَ قَالَ نَعَمْ إِذَا كَثُرَ الْخَبَثُ»
‘‘একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নিকট নিদ্রা গেলেন। অতঃপর তিনি জাগ্রত হলেন। তখন তার চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করেছিল। তিনি তখন বলছিলেন, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আরবদের জন্য ধ্বংস! একটি অকল্যাণ তাদের অতি নিকটবর্তী হয়ে গেছে। ইয়াজুজ-মা’জুজের প্রাচীর আজ এ পরিমাণ খুলে দেয়া হয়েছে। এ কথা বলে তিনি হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ও তার পার্শ্বের আঙ্গুল দিয়ে বৃত্ত তৈরী করে দেখালেন। যায়নাব বিনতে জাহ্শ (রাঃ) বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রসূল! আমাদের মাঝে সৎ লোক থাকতেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, যখন পাপাচার বেড়ে যাবে’’।[2]
[1]. মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুল ফিতান।
[2]. বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুল আম্বীয়া।
তাদের দৈহিক গঠন ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তারা তাদের অনারব স্বজাতীয় তুর্কী মোগল সন্তানদের মতই কঠিন প্রকৃতির হবে। তাদের চোখ হবে ছোট, নাক হবে খাটো এবং মাথার চুল হবে লাল। তাদের আকৃতি ও রং হবে তুর্কীদের মতোই। যারা মনে করে ইয়াজুজ-মা’জুজের কতক লোক লম্বা খেজুর গাজের মতো অথবা তার চেয়ে বেশি লম্বা, যারা মনে করে তাদের কেউ কেউ নিকৃষ্ট আকৃতির একদম খাটো এবং যারা মনে করে তাদের কারো কারো রয়েছে বৃহদাকার দু’টি কান, একটি দিয়ে গা ঢেকে রাখে ও অন্যটিকে বালিশ হিসাবে ব্যবহার করে, তারা কেবল বিনা ইলম ও বিনা দলীলে বানিয়ে কথা বলে।
পৃথিবীতে তাদের কারণে মানুষ যে কষ্ট পাবে, তারা যে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করবে এবং যেভাবে তাদের শেষ পরিণতি হবে সে ব্যাপারে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ইয়াজুজ-মা’জুজ মানব সমাজে বের হবে।
যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَهُمْ مِنْ كُلِّ حَدَبٍ يَنسِلُونَ﴾ ‘‘তারা প্রত্যেক উঁচু ভূমি থেকে দলে দলে ছুটে আসবে’’। (সূরা আন্বীয়া: ৯৬)
তারা মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়বে। তাদের ভয়ে লোকেরা পশুপাল নিয়ে শহর ও দুর্গে আশ্রয় নিবে। তারা যমীনের সমস্ত পানি পান করে শেষ করে ফেলবে। তাদের কেউ কেউ নদীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় সেটার সমস্ত পানি পান করে একদম শুকিয়ে ফেলবে। পরবর্তীরা তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলবে, এ নদীতে তো এক সময় পানি ছিল। তারা যখন পৃথিবীর সব মানুষ হত্যা করে শেষ করে ফেলবে এবং কোনো কোনো দুর্গে কিংবা শহরে পালিয়ে মাত্র দু’একজন মানুষ অবশিষ্ট থাকবে, তখন তাদের কেউ বলবে, যমীন বাসীকে হত্যা করে শেষ করে ফেলেছি। এখন কেবল আসমানের বাসিন্দারাই বাকি আছে। অতঃপর তাদের একজন বর্শা নাড়া দিয়ে আসমানের দিকে সেটা নিক্ষেপ করবে। বর্শাটি ফিতনা স্বরূপ তাদের নিকট রক্তাক্ত অবস্থায় ফেরত আসবে।
তখন আল্লাহ তা‘আলা ইয়াজুয-মা’জুজের ঘাড়ে উটের নাকের পোকার মতো ছোট ছোট এক ধরণের পোঁকা প্রেরণ করবেন। পোঁকাগুলোর আক্রমণে এ বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে। এরপর তাদের আর কোনো আওয়াজ পাওয়া যাবে না। মুসলিমরা তখন বলবে, এমন কেউ আছে কি যে তার নিজেকে আমাদের জন্য উৎসর্গ করবে এবং দেখার চেষ্টা করবে এ দুশমনদের কী অবস্থা হয়েছে? এতে তাদের একজন ছাওয়াবের আশায় অগ্রসর হবে। সে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও দুর্গ হতে বের হবে। সে তাদের একজনের উপর অন্যজনকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখবে। সে এই বলে আহবান করবে যে, হে মুসলিমগণ! তোমরা সুখবর গ্রহণ করো, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের শত্রুকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। এ কথা শুনে তারা তাদের দুর্গ ও শহর থেকে বের হয়ে আসবে। তারা তাদের পশুপাল ছাড়বে। পশুপালের জন্য ইয়াজুজ-মা’জুজের মরা দেহ ছাড়া আর কোনো খাবার থাকবে না। ঘাস ও তৃণলতা খেয়ে পশুগুলো যত মোটা-তাজা হয়নি, তার চেয়ে বেশি মোটা-তাজা হবে ইয়াজুজ-মা’জুজের মতৃদেহ ভক্ষণ করে।
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইউনুস ইবনে বুকাইর মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক থেকে এভাবেই বর্ণনা করেছেন। এ সনদটি ভালো। বর্তমান কালের কিছু লেখক ইয়াজু-মা’জুজ বিদ্যমান থাকা এবং তাদের প্রাচীর থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, শিল্পোন্নত কাফের রাষ্ট্রসমূহের নাগরিকরাই ইয়াজুজ-মা’জুজ। নিঃসন্দেহে এটি কুরআনের আয়াতকে অস্বীকার করা কিংবা এর আসল অর্থ বাদ দিয়ে অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করার শামিল। যে ব্যক্তি কুরআনের কোনো বিষয় অথবা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত কোনো বিষয়কে অস্বীকার করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। তবে যে ব্যক্তি কুরআন ও হাদীছের কোনো বিষয়কে অসম্ভাব্য কোনো অর্থে ব্যাখ্যা করবে, সে গোমরাহ বলে বিবেচিত হবে এবং তার কুফুরীতে নিপতিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যারা ইয়াজুজ-মা’জুজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তাদের কাছে এ ছাড়া অন্য কোনো দলীল নেই যে, তারা বলে থাকে, পৃথিবীতে যত শুকনো জায়গা আছে তা সবই আবিস্কৃত হয়েছে; কিন্তু কোথাও ইয়াজুজ-মা’জুজ কিংবা তাদের প্রাচীর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
উপরোক্ত কথার জবাব হলো, আবিষ্কারকরা অনুসন্ধান করে ইয়াজুজ-মা’জুজ ও তাদের প্রাচীর না পাওয়া তাদের অস্তিত্বহীনতার কথা প্রমাণ করে না। বরং আল্লাহ তা‘আলার রাজত্ব সম্পর্কে পুরোপুরি জ্ঞান অর্জন করতে মানুষের অক্ষমতা প্রমাণিত হয়। সম্ভবত আল্লাহ তা‘আলা তাদের দৃষ্টিকে ইয়াজুজ-মা’জুজ ও তাদের প্রাচীর থেকে ফিরিয়ে রেখেছেন অথবা এমন কিছু জিনিসকে প্রতিবন্ধক করে দিয়েছেন, যার কারণে তারা তাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জিনিসের উপর ক্ষমতাবান এবং প্রত্যেক জিনিষের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكَذَّبَ بِهِ قَوْمُكَ وَهُوَ الْحَقُّ ۚ قُل لَّسْتُ عَلَيْكُم بِوَكِيلٍ لِّكُلِّ نَبَإٍ مُّسْتَقَرٌّ ۚ وَسَوْفَ تَعْلَمُونَ﴾
‘‘তোমার জাতি তো ওটাকে মিথ্যা বলেছে। অথচ তা সত্য। বলো, আমি তোমাদের কার্যনির্বাহক নই। প্রত্যেক খবর প্রকাশিত হবার একটি নির্দিষ্ট সময় রয়েছে এবং শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে’’। (সূরা আনআম: ৬৬-৬৭)
বর্তমান সময়ের গবেষকগণ পেট্রোলসহ অন্যান্য যেসব খণিজ সম্পদ আবিষ্কার করেছে প্রথম যুগের মুসলিমগণ তা খুঁজে না পাওয়া এবং তা আবিষ্কার করতে না পারার কারণ হলো, আল্লাহ তা‘আলা তা বের হওয়ার জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করে রেখেছেন। নির্ধারিত সময় না হওয়ায় সাহাবী, তাবেঈ কিংবা তাদের কাছাকাছি যুগে তা বের হয়নি।
দাববাতুল আর্য বের হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذَا وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ أَخْرَجْنَا لَهُمْ دَابَّةً مِنْ الْأَرْضِ تُكَلِّمُهُمْ أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآيَاتِنَا لَا يُوقِنُونَ﴾
‘‘যখন প্রতিশ্রম্নতি (কিয়ামত) নিকটবর্তী হবে তখন আমি তাদের সামনে ভূগর্ভ থেকে একটি প্রাণী নির্গত করবো। সে মানুষের সাথে কথা বলবে, এ বিষয়ে যে, মানুষ আমার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করতোনা’’। (সূরা আন নামল: ৮২)
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ নিহায়া গ্রন্থে বলেন, ইবনে আব্বাস, হাসান ও কাতাদাহ বলেছেন, প্রাণীটি মানুষকে সম্বোধন করে সরাসরি কথা বলবে। ইমাম ইবনে জারীর বলেন, আয়াতে উল্লেখিত কুরআনের বাণীটিই হবে তার কথা: ﴿أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآيَاتِنَا لَا يُوقِنُونَ﴾ এ বাক্যটি সে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে শুনাবে। মানুষ আল্লাহর আয়াত ও নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করতো না। ইবনে জারীর আলী ও আতা থেকে এ কথা বর্ণনা করেছেন। তবে ইমাম ইবনে কাছীর বলেন, এতে মতভেদ রয়েছে। অতঃপর ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করে বলেন যে, এখানে تكلمهم দ্বারা উদ্দেশ্য হলো تجرحهم অর্থাৎ দাগ লাগাবে। সে কাফেরের কপালে ‘কাফের’ লিখে দিবে এবং মুমিনের কপালে ‘মুমিন’ লিখে দিবে। ইবনে আব্বাস থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, কথা বলবে এবং দাগ লাগাবে। এ কথাটি উভয় মতকে একত্রিত করে দেয়। এটি সুন্দর ও শক্তিশালী মত। এতে উভয় মতের মধ্যে সমন্বয় করা হয়েছে।
তিনি তার তাফসীরে আরো বলেন, আখেরী যামানায় মানুষ নষ্ট হয়ে যাওয়া, আল্লাহ তা‘আলার আদেশ-নিষেধ বর্জন করা এবং সত্য দীন পরিবর্তন করার সময় আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য যমীন থেকে এ প্রাণীটি বের করবেন। বলা হয়েছে যে, সে মক্কা থেকে বের হবে। কেউ কেউ বলেছেন, অন্যস্থান থেকে বের হবে এবং মানুষের সাথে কথা বলবে।
ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ স্বীয় তাফসীরে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: ﴿وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِم﴾ْ এবং الدابة এর অর্থ সম্পর্কে আলেমগণ মতবেদ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, وقع الغضب عليهم তাদের উপর ক্রোধ আবশ্যক হয়েছে। ইমাম কাতাদাহ এ কথা বলেছেন। মুজাহিদ বলেছেন, حق القول عليهم بأنهم لايؤمنون তাদের ব্যাপারে এ কথা সত্য হয়েছে যে, তারা ঈমান আনয়ন করবে না। ইবনে উমার এবং আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, মানুষ যখন সৎকাজের আদেশ করবে না এবং অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করবে না, তখন তাদের উপর আল্লাহর ক্রোধ আবশ্যক হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আলেমদের উঠে যাওয়া, ইলম চলে যাওয়া এবং কুরআনুল কারীম উঠিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি সত্য হবে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ আরো বলেন, কুরআন উঠিয়ে নেয়ার আগেই তোমরা বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করো। সাহাবীগণ বললেন, কুরআনের কপিসমূহ উঠিয়ে নেয়া হলে মানুষের বক্ষদেশে সংরক্ষিত কুরআনের কী অবস্থা হবে? ইবনে মাসউদ বললেন, এমন একটি রাত আসবে, যখন তারা অন্তরে কুরআন খুঁজে পাবে না এবং তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ভুলে যাবে। এরপর তারা জাহেলী যুগের কথা-বার্তা এবং তাদের কবিতাগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তখনই তাদের জন্য প্রতিশ্রম্নতি বাস্তবায়ন হবে।
অতঃপর ইমাম কুরতুবী,﴾ ﴿وَقَعَ الْقَوْلُ عَلَيْهِمْ এর ব্যাখ্যায় অন্যান্য কথা বলেছেন। পরিশেষে বলেছেন, তবে গবেষণা করলে বুঝা যায় যে, সবগুলোর কথার অর্থ একটিই। আয়াতের শেষাংষেই এর দলীল রয়েছে, ﴿أَنَّ النَّاسَ كَانُوا بِآيَاتِنَا لَا يُوقِنُونَ﴾ এ বাক্যটি সে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে শুনাবে। মানুষ আল্লাহর নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস করতো না।
সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তিনটি জিনিস যখন বের হবে, তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোনো উপকারে আসবে না যে ইতিপূর্বে ঈমান আনয়ন করেনি কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সৎকাজ করেনি। পশ্চিমাকাশে সূর্যোদয়, দাজ্জাল এবং দাববাতুল আরয্।
এ প্রাণীটি নির্দিষ্ট করণ, তার গুণাবলী এবং তা বের হওয়ার স্থান সম্পর্কে আলেমদের অনেক মতভেদ বর্ণিত হয়েছে। التذكرة নামক কিতাবে আমরা এগুলো বর্ণনা করেছি। হুযায়ফা ইবনে উসাইদ আল-গিফারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন,
«اطَّلَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَيْنَا وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ فَقَالَ مَا تَذَاكَرُونَ قَالُوا نَذْكُرُ السَّاعَةَ قَالَ إِنَّهَا لَنْ تَقُومَ حَتَّى تَرَوْنَ قَبْلَهَا عَشْرَ آيَاتٍ فَذَكَرَ الدُّخَانَ وَالدَّجَّالَ وَالدَّابَّةَ وَطُلُوعَ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنُزُولَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَيَأَجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَثَلَاثَةَ خُسُوفٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ بِجَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَآخِرُ ذَلِكَ نَارٌ تَخْرُجُ مِنَ الْيَمَنِ تَطْرُدُ النَّاسَ إِلَى مَحْشَرِهِمْ»
‘‘একদা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিকট আগমন করলেন। আমরা তখন কিয়ামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন, যতদিন তোমরা দশটি আলামত না দেখবে ততোদিন কিয়ামত হবে না। (১) ধোঁয়া (২) দাজ্জালের আগমন (৩) দাববাতুল আরদ্ (৪) পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় (৫) ঈসা ইবনে মারইয়ামের অবতরণ (৬) ইয়াজুয-মা’জুজ (৭) তিনটি ভূমিধস। একটি পশ্চিমে, আরেকটি পূর্বে এবং তৃতীয়টি হবে আরব উপদীপে (৮) সর্বশেষে ইয়ামান থেকে একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে সিরিয়ার দিকে হাঁকিয়ে নিবে’’।[1] ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ, আত্-তায়ালেসী, ইমাম মুসলিম এবং সুনান গ্রন্থকারগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছটি হাসান সহীহ।
আলা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তার পিতা থেকে, তার পিতা আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ছয়টি জিনিস বের হওয়ার আগেই তোমরা আমল করো। পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয়, দাজ্জাল, দাববাতুল আরয্.......। মুসলিম শরীফে কাতাদাহ হাসান থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি যিয়াদ ইবনে রাবাহ থেকে, তিনি বর্ণনা করেন আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তোমরা ছয়টি জিনিস বের হওয়ার আগেই আমল করো। দাজ্জাল, ধোঁয়া, দাববাতুল আরয্........।
ইমাম মুসলিম আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একটি হাদীছ মুখস্ত করে রেখেছি, যা আমি কখনো ভুলিনি। আমি তাকে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের সর্বপ্রথম যে নিদর্শনটি প্রকাশিত হবে, তা হলো পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় হওয়ার দিন সকাল বেলাতেই মানুষের সামনে দাববাতুল আরয্ বের হবে। এ দু’টি থেকে যেটি আগে প্রকাশিত হবে, অন্যটি তার পিছে পিছেই প্রকাশিত হবে’’।
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত হাদীছে কিয়ামতের সর্বপ্রথম যে দু’টি আলামত প্রকাশিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা দ্বারা ঐসব আলামত উদ্দেশ্য, যা সাধারণত মানুষের কাছে পরিচিত নয়। যদিও এর আগে দাজ্জাল বের হবে এবং আসমান থেকে ঈসা আলাইহিস সালাম নেমে আসবেন। ইয়াজুজ-মা’জুজ বের হওয়ার বিষয়টিও অনুরূপ। তবে এগুলো সাধারণ রীতিনীতি ও চিরাচরিত অভ্যাসের পরিপন্থী নয়। কেননা তারা সকলেই হবে মানুষ। তারা এবং অন্যান্য মানুষেরা পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ।
কিন্তু অস্বাভাবিক ও অসাধারণ আকৃতিতে দাববাতুল আরয্ বের হওয়া, মানুষের সাথে কথা বলা এবং তাদের কপালে ঈমান কিংবা কুফুরীর চিহ্ন লাগিয়ে দেয়া অভ্যাস বহির্ভূত একটি অভিনব বিষয়। এটি যমীন থেকে নির্গত অভ্যাস বহির্ভূত সর্বপ্রথম নিদর্শন। অনুরূপ সাধারণ অভ্যাস বহির্ভূত নিয়মে পশ্চিম আকাশে সূর্যোদয় হওয়া আসমানে প্রকাশিত সর্বপ্রথম নিদর্শন।
সহীহ হাদীছের বর্ণনা মোতাবেক এ প্রাণীটির কাজ হবে সে মুমিন-কাফের সমস্ত মানুষকে নির্দিষ্ট আলামতের মাধ্যমে চিহ্নিত করবে। মুমিনের কপালে যখন দাগ দেয়া হবে, তখন তার চেহারা আকাশে উদীয়মান তারকার মতো দেখা যাবে। তার দুই চোখের মাঝখানে مؤمن লেখা হবে। আর কাফেরের কপালে দুই চোখের মাঝখানে কালো দাগ লাগানো হবে এবং كافر লেখা হবে।
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত হাদীছে কিয়ামতের সর্বপ্রথম যে দু’টি আলামত প্রকাশিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা দ্বারা ঐসব আয়াত উদ্দেশ্য যা সাধারণত মানুষের কাছে পরিচিত নয়। যদিও এর আগে দাজ্জাল বের হবে এবং আসমান থেকে ঈসা আলাইহিস সালাম নামবেন।
অন্য বর্ণনায় আছে, সে মুমিনের সাথে সাক্ষাত করে তার কপালে সাদা দাগ লাগিয়ে চেহারাকে উজ্জ্বল করে দিবে এবং কাফেরের সাথে সাক্ষাত করে তার কপালে কালো দাগ লাগিয়ে তার চেহারাকে কালো করে দিবে। তখনো তারা মিলেমিশে ক্রয়বিক্রয় করবে, একই শহরে বসবাস করবে এবং মুমিন কাফেরকে এবং কাফের মুমিনকে চিনতে পাবে। এমনকি মুমিন কাফেরকে বলবে, হে কাফের! আমার হক ফেরত দাও।
তার স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে নাসের ইবনে সা’দী স্বীয় তাফসীরে বলেন, আখেরী যামানায় যে সুপ্রসিদ্ধ প্রাণীটি বের হবে, তা কিয়ামতের বড় আলামতগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূল প্রাণীটির ধরণ বর্ণনা করেন নি। তার কাজ-কর্ম থেকে যেটুকু বর্ণনা করা উদ্দেশ্য, কেবল সেটুকুই বর্ণনা করা হয়েছে। সে বিরাট একটি নিদর্শন এবং সাধারণ অভ্যাস বহির্ভুত নিয়মে মানুষের সাথে কথা বলবে। মানুষের নিকট যখন প্রতিশ্রম্নতি দিবস চলে আসবে এবং তারা আল্লাহর নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে সন্দেহে নিপতিত হবে, তখন সে বের হবে। এটি মুমিনদের জন্য একটি সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং সীমালংঘন কারীদের বিরুদ্ধে বিরাট দলীল।
সাম্প্রতিক কালের কিছু কিছু গবেষক এ প্রাণীটি বের হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে এবং বের হওয়া অসম্ভব মনে করেছে। তাদের কেউ কেউ এর এমন ব্যাখ্যা করে থাকে, যা সম্পূর্ণ নিরর্থক। তাদের বিবেক-বুদ্ধি এটি বুঝতে অক্ষম, -এ ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো দলীল নেই।
মুমিনদের উপর আবশ্যক হলো, আল্লাহ তা‘আলা ও তার রসূলের নিকট থেকে যে সংবাদ এসেছে, তা সত্য বলে বিশ্বাস করা। দাববাতুল আরয্ এর প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঐসব গায়েবী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের কারণে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের প্রশংসা করেছেন। আমরা আল্লাহর কাছে হিদায়াত চাই এবং সত্য জানা ও সেটা মানার তাওফীক চাই।
[1], সহীহ মুসলিম ২৯০১।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿هَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا أَنْ تَأْتِيَهُمْ الْمَلَائِكَةُ أَوْ يَأْتِيَ رَبُّكَ أَوْ يَأْتِيَ بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا قُلْ انتَظِرُوا إِنَّا مُنتَظِرُونَ﴾
‘‘তারা শুধু এ বিষয়ের দিকে চেয়ে আছে যে, তাদের কাছে ফেরেশতা আগমন করবে কিংবা তোমার পালনকর্তা আগমন করবেন। অথবা তোমার পালনকর্তার কোনো নিদর্শন আসবে। যেদিন তোমার পালনকর্তার কোনো নিদর্শন এসে যাবে তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোনো উপকারে আসবেনা ইতিপূর্বে ঈমান আনয়ন করেনি কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সৎকাজ করেনি। হে নবী! তুমি বলো তোমরা অপেক্ষা করতে থাকো। আমরাও অপেক্ষা করতে থাকলাম’’। (সূরা আনআম: ১৫৮)
হাফেয ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ নেহায়া গ্রন্থে বলেন, ইমাম বুখারী এ আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে বলেন, আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত হবেনা। যখন সূর্য পশ্চিম আকাশে উঠবে, তখন তারা সবাই ঈমান আনয়ন করবে। কিন্তু ইতিপূর্বে যারা ঈমান আনয়ন করেনি, তাদের ঈমান কোনো উপকারে আসবেনা। ইমাম তিরমিযী ব্যতীত সুনান গ্রন্থের অন্যান্য ইমামগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইবনে কাছীরের কথা এখানেই শেষ।
ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আলেমগণ বলেন পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়া সহীহ সুন্নাহ ও সুস্পষ্ট খবর দ্বারা সাব্যস্ত। শুধু তাই নয়; বরং রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর অবতীর্ণ কিতাবের দলীল দ্বারাও সাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا﴾
‘‘যেদিন তোমার পালনকর্তার কোনো নিদর্শন এসে যাবে তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোনো উপকারে আসবে না যে ইতিপূর্বে ঈমান আনয়ন করেনি কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সৎকাজ করেনি’’ (সূরা আন‘আম:১৫৮)।
মুফাস্সিরদের ঐক্যমতে অথবা অধিকাংশ মুফাস্সিরের মতে এখানে নিদর্শন বলতে পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়া উদ্দেশ্য। উপরোক্ত আয়াতের উদ্দেশ্য হলো, পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়ার সময় যদি কারো ঈমান না থাকে, সূর্য উদিত হওয়ার পর ঈমান নবায়ন করে এবং বিভিন্ন প্রকার সৎকর্ম করে তাতে কোনো লাভ হবে না। কেননা তারা আমলসমূহ গ্রহণযোগ্য হওয়ার মূল শর্ত ঈমান হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং সূর্য উদিত হওয়ার সময় নতুন করে ঈমান আনয়ন করে কোনো লাভ হবে না। যেহেতু ইতিপূর্বে তার ঈমান ছিল না, তাই ঈমানের পূর্বে তার সৎকর্ম, আত্মীয়তার বন্ধন ঠিক রাখা, দাসমুক্ত করা, মেহমানদারী করা, উত্তম আচরণ করা এবং অন্যান্য আমলের কোনো মূল্যায়ন হবে না। কেননা তার আমলগুলো মূলনীতির উপর ভিত্তি করে সম্পন্ন হয়নি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَّثَلُ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ ۖ أَعْمَالُهُمْ كَرَمَادٍ اشْتَدَّتْ بِهِ الرِّيحُ فِي يَوْمٍ عَاصِفٍ﴾
‘‘যারা তাদের রবের সাথে কুফুরী করে তাদের উপমা এই যে, তাদের কর্মগুলো ছাইয়ের মতো, যা ঝড়ের দিনে বাতাস প্রচ- বেগে উড়িয়ে নিয়ে যায়’’। (সূরা ইবরাহীম: ১৮)
সুতরাং পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়ার সময়ে ঈমান আনয়ন গ্রহণযোগ্য নয়।
ইমাম বুখারী, মুসলিম এবং অন্যান্য ইমামগণ আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«لَا تَقُوْمُ السَّاعَةُ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا فَإِذَا طَلَعَتْ وَرَآهَا النَّاسُ آمَنُوا أَجْمَعُونَ فَذَلِكَ حِينَ لَا يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا»
‘‘যতদিন পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হবে না ততোদিন কিয়ামত হবে না। যখন পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হবে এবং মানুষ তা দেখবে তখন সবাই ঈমান আনবে। তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোনো উপকারে আসবে না যে ইতিপূর্বে বিশ্বাস স্থাপন করে স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সৎকাজ করেনি’’।[1]
ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইমাম আহমাদ ও তিরমিযী যে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন, যাকে ইমাম নাসাঈ সহীহ বলেছেন এবং ইমাম ইবনে মাজাহ যাকে আসেম ইবনে আবু নাজুদের সনদে যার ইবনে হুবাইশ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বর্ণনা করেছেন সাফওয়ান ইবনে আস্সাল থেকে। সাফওয়ান বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা পশ্চিম আকাশে তাওবার এমন একটি দরজা খুলে রেখেছেন যার প্রশস্ততা ৭০ অথবা ৪০ বছরের পথ। পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়ার পূর্বে বন্ধ করা হবে না।
উপরোক্ত হাদীছগুলো এবং কুরআনের উপরোক্ত আয়াতটি প্রমাণ করে যে, যারা পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হতে দেখে ঈমান আনবে ও তাওবা করবে তাদের কাছ থেকে সেটা কবুল করা হবেনা। সে সময় ঈমান ও তাওবা কবুল না হওয়ার কারণ হলো পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়া ঐসব আলামতের অন্তর্ভুক্ত, যা কিয়ামত অত্যন্ত নিকটবর্তী হওয়ার প্রমাণ বহন করে। সুতরাং ঐ সময়ের অবস্থা কিয়ামতের দিনের অবস্থার অনুরূপ। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿هَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا أَنْ تَأْتِيَهُمْ الْمَلَائِكَةُ أَوْ يَأْتِيَ رَبُّكَ أَوْ يَأْتِيَ بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا قُلْ انتَظِرُوا إِنَّا مُنتَظِرُونَ﴾
‘‘তারা শুধু এ বিষয়ের দিকে চেয়ে আছে যে, তাদের কাছে ফেরেশতা আগমন করবে কিংবা তোমার পালনকর্তা আগমন করবেন অথবা তোমার পালনকর্তার কোনো নিদর্শন আসবে। যেদিন তোমার পালনকর্তার কিছু নিদর্শন এসে যাবে তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোনো উপকারে আসবে না যে পূর্ব থেকে ঈমান আনয়ন করেনি কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সৎকাজ করেনি। হে নবী! তুমি বলো, তোমরা অপেক্ষা করতে থাকো। আমরাও অপেক্ষা করতে থাকলাম’’। (সূরা আনআম: ১৫৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَلَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا قَالُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَحْدَهُ وَكَفَرْنَا بِمَا كُنَّا بِهِ مُشْرِكِينَ فَلَمْ يَكُ يَنفَعُهُمْ إِيمَانُهُمْ لَمَّا رَأَوْا بَأْسَنَا ۖ سُنَّتَ اللَّهِ الَّتِي قَدْ خَلَتْ فِي عِبَادِهِ ۖ وَخَسِرَ هُنَالِكَ الْكَافِرُونَ﴾
‘‘অতঃপর তারা যখন আমার আযাব দেখতে পেলো তখন বললো, আমরা এক আল্লাহতেই বিশ্বাস করলাম এবং আমরা তার সঙ্গে যাদেরকে শরীক করতাম তাদেরকে অস্বীকার করলাম। কিন্তু তারা যখন আমার আযাব প্রত্যক্ষ করলো তখন তাদের বিশ্বাস তাদের কোনো উপকারে এলো না। আল্লাহর এ বিধান তার বান্দাদের মধ্যে অনুসৃত হয়ে আসছে। আর তখন অবিশ্বাসীরা ক্ষতিগ্রস্থ হলো’’। (সূরা মুমিন: ৮৪-৮৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَهَلْ يَنظُرُونَ إِلَّا السَّاعَةَ أَن تَأْتِيَهُم بَغْتَةً ۖ فَقَدْ جَاءَ أَشْرَاطُهَا ۚ فَأَنَّىٰ لَهُمْ إِذَا جَاءَتْهُمْ ذِكْرَاهُمْ﴾
‘‘তারা কি শুধু এ জন্য অপেক্ষা করছে যে, কিয়ামত তাদের নিকট হঠাৎ এসে পড়ুক? কিয়ামতের নিদর্শনসমূহ তো এসেই পড়েছে। অতঃপর কিয়ামত এসে পড়লে তারা উপদেশ গ্রহণ করবে কেমন করে?’’ (সূরা মুহাম্মাদ: ১৮)
ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ,﴿لاَ يَنْفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ﴾ ‘‘তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোনো উপকারে আসবেনা যে পূর্ব থেকে ঈমান আনয়ন করেনি’’এর ব্যাখ্যায় বলেন, সেদিন যখন কাফের ঈমান আনয়ন করবে, তখন তার ঈমান গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে সেদিনের পূর্বে যারা ঈমানদার থাকবে এবং পরিশুদ্ধ আমলকারী হবে, সে বিরাট কল্যাণের মধ্যে থাকবে। আর যদি পরিশুদ্ধ আমলকারী না হয়ে থাকে; কিন্তু তখন যদি তাওবা করে, তাহলে তার তাওবা কবুল করা হবে না। এ মর্মে অনেক হাদীছ রয়েছে। এটিই ﴿أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا﴾ ‘‘কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কোনো সৎকাজ করেনি’’ এর অর্থ। অর্থাৎ পশ্চিম আকাশে সূর্য উঠার আগে আমলকারী না হলে সেটা উদিত হওয়ার পর সৎআমল করলে, তা কবুল হবে না। ইমাম ইবনে কাছীরের কথা এখানেই শেষ। ইমাম বগবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
﴿يَوْمَ يَأْتِي بَعْضُ آيَاتِ رَبِّكَ لَا يَنفَعُ نَفْسًا إِيمَانُهَا لَمْ تَكُنْ آمَنَتْ مِنْ قَبْلُ﴾
‘‘যেদিন তোমার পালনকর্তার কিছু নিদর্শন এসে যাবে তখন এমন ব্যক্তির ঈমান কোনো উপকারে আসবে না যে পূর্ব থেকে ঈমান আনয়ন করেনি’’। (সূরা আনআম: ১৫৮) অর্থাৎ যেসব নির্দশন প্রকাশিত হলে তারা ঈমান আনতে বাধ্য হবে, তা বের হওয়ার সময় ঈমান তাদের কোনো উপকার করবে না। আর﴿أَوْ كَسَبَتْ فِي إِيمَانِهَا خَيْرًا﴾ ‘‘কিংবা স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী সৎকাজ করেনি’’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তখন কাফেরের ঈমান ও ফাসেকের তাওবা গ্রহণযোগ্য হবে না।
ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ স্বীয় তাফসীরে আরো বলেন, আলেমগণ বলেছেন, পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হওয়ার সময় ঈমান আনলে কারো ঈমান উপকারে আসবেনা। কেননা তখন তাদের অন্তরে এমন ভয় ঢুকে যাবে যে, নফ্সের চাহিদা পূরণ করার ইচ্ছা একদম নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং শরীরের শক্তি একদম শেষ হয়ে যাবে। কিয়ামত নিকটে দেখে তখন সমস্ত মানুষ ঠিক ঐরকম হয়ে যাবে যেমন মৃত্যু শয্যায় শায়িত ব্যক্তিদের থেকে পাপাচারের আগ্রহ সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায় এবং তাদের শরীরে পাপাচার ও নাফরমানির ইচ্ছা একদম বাতিল হয়ে যায়। সুতরাং কিয়ামত নিকটবর্তী দেখে কেউ তাওবা করলে তার তাওবা কবুল হবে না। যেমন মৃত্যু উপস্থিত দেখে কেউ তাওবা করলে তার তাওবা কবুল হবেনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,
«إِنَّ اللَّهَ يَقْبَلُ تَوْبَةَ الْعَبْدِ مَا لَمْ يُغَرْغِرْ»
‘‘আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তাওবা ততোক্ষণ পর্যন্ত কবুল করেন, যতক্ষণ না তার মৃত্যুর গড়গড়ানী শুরু হয়’’।[2]
অর্থাৎ কণ্ঠনালীর মাথায় রূহ না আসা পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা বান্দার তাওবা কবুল করেন। এটি ঐ সময়ের অবস্থা যখন মানুষ জান্নাত কিংবা জাহান্নামে নিজের ঠিকানা দেখতে পায়। যারা পশ্চিম আকাশে সূর্য উদিত হতে দেখবে, তাদের অবস্থাও অনুরূপ।
মোটকথা, এটি একটি বিরাট ঘটনা। তখন ভয়াবহ অবস্থা হবে, যাতে সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়বে এবং কিয়ামত নিকটবর্তী হবে। এতে আল্লাহ তা‘আলার মহা শক্তির দলীল রয়েছে। এ বিশাল সৃষ্টি সূর্য আল্লাহ তা‘আলার নিয়ন্ত্রণাধীন। আল্লাহর ইচ্ছায় এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে।
আমরা আল্লাহর কাছে দু‘আ করি তিনি যেন আমাদেরকে বিশুদ্ধ ঈমান এবং এমন উপকারী ইয়াকীন দান করেন, যা সৎ আমলের দিকে ধাবিত করে। আমরা আরো দু‘আ করি, সময় ও বয়স ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই পুনরুত্থান দিবসের জন্য উপকারী পাথেয় সংগ্রহ করার তাওফীক দেন। সমগ্র সৃষ্টিজগতের প্রভু আল্লাহ তা‘আলার জন্য সমস্ত প্রশংসা।
[1]. বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুর রিকাক।
[2]. হাসান: তিরমিযী ৩৫৩৭, অধ্যায়: কিতাবুত্ তাওবা। ইমাম তিরমিযী বলেন, হাসান গরীব। হাকেম তার মুস্তাদরাকে হাদীছটি বর্ণনা করে সহীহ বলেছেন এবং ইমাম যাহাবী তার সাথে একমত পোষণ করেছেন। দেখুন: মুস্তাদরাক হাকেম, (৪/২৫৭)।
ইমাম ইবনে কাছীর নেহায়া গ্রন্থে বলেন, সহীহ বুখারী ও মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«يُحْشَرُ النَّاسُ عَلَى ثَلَاثِ طَرَائِقَ رَاغِبِينَ رَاهِبِينَ وَاثْنَانِ عَلَى بَعِيرٍ وَثَلَاثَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَأَرْبَعَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَعَشَرَةٌ عَلَى بَعِيرٍ وَيَحْشُرُ بَقِيَّتَهُمُ النَّارُ تَقِيلُ مَعَهُمْ حَيْثُ قَالُوا وَتَبِيتُ مَعَهُمْ حَيْثُ بَاتُوا وَتُصْبِحُ مَعَهُمْ حَيْثُ أَصْبَحُوا وَتُمْسِي مَعَهُمْ حَيْثُ أَمْسَوْا»
‘‘মানুষকে তিনভাবে একত্রিত করা হবে। (১) একদল লোককে আশা ও ভয় মিশ্রিত অবস্থায় হাঁকিয়ে নেয়া হবে। (২) দু’জনকে একটি উটের উপর, তিনজনকে একটি উটের উপর, চারজনকে একটি উটের উপর এবং দশজনকে একটি উটের উপর আরোহিত অবস্থায় হাশরের দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হবে। (৩) বাকি সব মানুষকে আগুন হাঁকিয়ে নিবে। মানুষ যেখানে দুপুরের বিশ্রাম নেয়ার জন্যে অবস্থান করবে আগুনও সেখানে থেমে যাবে। মানুষ যে স্থানে রাত অতিবাহিত করার জন্য অবস্থান করবে আগুনও সেখানে থেমে যাবে। এরপর আবার তাদেরকে নিয়ে চলবে। তারা যেখানে সকাল করবে আগুনও সেখানে থেমে যাবে। তারা যেস্থানে বিকালে অবস্থান করবে আগুনও সেস্থানে অবস্থান করবে। এরপর আবার তাদেরকে হাঁকিয়ে নিবে।[1]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আদনের গর্ত হতে একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে বেষ্টন করে নিবে। চতুর্দিক থেকে তাদেরকে হাশরের মাঠের দিকে হাঁকিয়ে যাবে। যে পিছিয়ে থাকবে আগুন তাকে জ্বালিয়ে ফেলবে।[2]
অতঃপর ইমাম ইবনে কাছীর এ অর্থে আরো অনেক হাদীছ বর্ণনা করেছেন। পরিশেষে বলেছেন, হাদীছগুলোর বর্ণনা প্রসঙ্গ প্রমাণ করে যে, এটি হবে আখেরী যামানায় দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমস্ত মানুষকে সিরিয়ার একটি স্থানে সমবেত করণ। তারা তিনভাগে বিভক্ত হবে। এক শ্রেণীর লোক তখন পানাহার করবে, কাপড়চোপড় পরিধান করবে এবং আরোহন করবে। আরেক শ্রেণীর লোক কখনো পায়ে হেঁটে চলবে আবার কখনো আরোহন করবে। তারা পালাক্রমে মাত্র একটি উটের উপর আরোহন করবে। যেমন সহীহ বুখারী ও মুসলিমের হাদীছ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। দু’জন মিলে একটি উটের উপর আরোহন করবে....তিনজন মিলে একটি উটের উপর আরোহন করবে.....দশজন একটি উটের উপর আরোহন করবে। বাহন কম থাকার কারণে এভাবেই তারা একই বাহনের উপর পালাক্রমে আরোহন করবে। যেমন ইতিপূর্বে হাদীছে অতিক্রান্ত হয়েছে এবং হাদীছের শেষাংশে এসেছে যে, বাকীদেরকে আগুন হাঁকিয়ে নিবে। এ আগুনটি ইয়ামানের আদানের গর্ত থেকে বের হয়ে সমস্ত মানুষকে ঘেরাও করবে এবং প্রত্যেক দিক থেকে হাশরের যমীনের দিকে হাঁকিয়ে নিবে। যে কেউ পিছিয়ে থাকবে আগুন তাকে জ্বালিয়ে ফেলবে।
এমনটি হবে আখেরী যামানায়। তখন পানাহার, ক্রয়-বিক্রি ও বাহনের উপর আরোহন করা এবং অন্যান্য কাজ-কর্ম বাকী থাকবে। যারা আগুনের তাড়া খেয়েও পিছিয়ে থাকবে, আগুন তাদেরকে ধ্বংস করবে। এটি যদি সিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার পরের ঘটনা হতো, তাহলে মাওত, যানবাহন ক্রয়-বিক্রয়, পানাহার ইত্যাদি অবশিষ্ট থাকার কথা নয়।
আখেরী যামানায় আদনের গর্ত থেকে আগুন বের হয়ে সিরিয়ার যমীনে মানুষকে হাঁকিয়ে নেয়ার ব্যাপারে অনেক হাদীছ রয়েছে। এগুলো থেকে একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন ইমাম মুসলিম, আহমাদ ও সুনান গ্রন্থকারগণ। আদনের গর্ত থেকে একটি আগুন বের হবে এবং মানুষকে হাঁকিয়ে নিবে। মানুষ যেখানে রাত্রি যাপন করবে, আগুনও সেখানে থেমে যাবে এবং মানুষ যেখানে বিশ্রাম নিবে আগুনও সেখানে থেমে যাবে। এ মর্মে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«سَتَخْرُجُ نَارٌ مِنْ حَضْرَمَوْتَ أَوْ مِنْ نَحْوِ بَحْرِ حَضْرَمَوْتَ قَبْلَ يَوْمِ الْقِيَامَةِ تَحْشُرُ النَّاسَ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ فَمَا تَأْمُرُنَا قَالَ عَلَيْكُمْ بِالشَّامِ»
‘‘অচিরেই কিয়ামত দিবসের পূর্বে হাযারামাউত শহর বা হাযারামাওতের দিক থেকে একটি আগুন বের হবে এবং মানুষকে হাঁকিয়ে নিবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! আপনি আমাদেরকে কিসের আদেশ দিচ্ছেন? তিনি বললেন, তোমরা সিরিয়াতে বসবাস করো।[3] আহমাদ, তিরমিযী এবং ইবনে হিববান তার সহীহ গ্রন্থে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছটি হাসান সহীহ গরীব।
ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকের হাশর বা মানুষকে হাঁকিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। এটি কি কিয়ামতের দিন হবে? না কি কিয়ামতের পূর্বে পৃথিবীতেই হবে?
ইমাম কুরতুবী, খাত্তাবী বলেন, এ হাশর হবে কিয়ামত দিবসের পূর্বে দুনিয়াতেই। কাযী ইয়ায এ মতকে সঠিক বলেছেন। আর কবর থেকে উঠিয়ে হাশরের মাঠে একত্রিত করার কথা ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মারফু হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। যেমন ইবনে আব্বাস থেকে সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«إِنَّكُمْ مَحْشُورُونَ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًا ثُمَّ قَرَأَ كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيدُهُ وَعْدًا عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلِينَ وَأَوَّلُ مَنْ يُكْسَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِبْرَاهِيمُ»
‘‘নিশ্চয় তোমাদেরকে একত্রিত করা হবে নগ্নপদ, বস্ত্রহীন এবং খাতনা বিহীন অবস্থায়। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করলেন,
﴿كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيدُهُ وَعْدًا عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلِينَ﴾
‘‘যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করবো। আমার ওয়াদা নিশ্চিত, আমাকে পূর্ণ করতেই হবে। (সূরা আম্বীয়া: ১০৪) কিয়ামতের দিন ইবরাহীম (আঃ) কে সর্বপ্রথম কাপড় পরিধান করানো হবে।[4]
ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কাযী ইয়ায রাহিমাহুল্লাহ খাত্তাবী ও কুরতুবীর কথা সমর্থন করতে গিয়ে বলেন, আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছে এসেছে, তারা যেখানে বিশ্রাম নিবে, আগুন সেখানে থেমে যাবে, তারা যেখানে রাত্রি যাপন করবে, আগুনও সেখানে থেমে যাবে, তারা যেখানে সকাল কাটাবে আগুন সেখানে থেমে থাকবে এবং তারা যেখানে বিকাল কাটাবে আগুন সেখানে থেমে যাবে.....এসব কথার মধ্যে দলীল পাওয়া যায় যে, এ হাশর হবে দুনিয়াতে সিরিয়ার যমীনে। কেননা এগুলো পার্থিব জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়।
ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ তার তাযকিরা নামক গ্রন্থে আরো বলেন, হাশর মোট চারটি। দু’টি হাশর দুনিয়ার এবং অন্য দু’টি আখিরাতের। দুনিয়ার হাশর দু’টির কথা সূরা হাশরে উল্লেখিত হয়েছে। একটি হচ্ছে ইয়াহূদীদেরকে সিরিয়াতে একত্রিত করার হাশর। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বলেছিলেন, তোমরা বের হয়ে যাও। তারা বলেছিল, আমরা কোথায় যাবো? তিনি বলেছিলেন, হাশরের যমীনে চলে যাও। অতঃপর উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বাকীদেরকে আরব উপদীপ থেকে সিরিয়ায় নির্বাসন দিয়েছিলেন।
দুনিয়ার দ্বিতীয় হাশরটি হবে কিয়ামতের আলামত হিসাবে। যেমন আনাস ও আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন,
نَارٌ تَحْشُرُ النَّاسَ مِنْ الْمَشْرِقِ إِلَى الْمَغْرِبِ
‘‘একটি আগুন সমস্ত মানুষকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে তাড়িয়ে নিবে’’।[5]
আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত মারফু হাদীছে এসেছে, পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দাদের প্রতি একটি আগুন প্রেরণ করা হবে, যা তাদেরকে পশ্চিম দিকে একত্রিত করবে। তারা যেখানে রাত্রি যাপন করবে, আগুন সেখানে থেমে যাবে। তারা যেখানে বিশ্রাম নেবে, আগুন সেখানে থেমে যাবে এবং যারা পিছিয়ে থাকবে, আগুন তাদেরকে জ্বালিয়ে দিবে। মূলত আগুনটি তাদেরকে উট তাড়িয়ে নেয়ার মতো তাড়িয়ে নিবে।
হাফেয ইবনে হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আদনের গর্ত থেকে আগুনটি বের হওয়ার অর্থ এ নয় যে, সেটা তাদেরকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে হাঁকিয়ে নিবে না। কারণ এটি প্রথমত বের হবে আদন থেকে। বের হওয়ার পর সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। মূলত এখানে পশ্চিম বা পূর্ব উদ্দেশ্য নয়; উদ্দেশ্য হলো তখন পৃথিবীতে জীবিত সমস্ত মানুষকে একত্রিত করা হবে। অথবা এটি প্রথমে পূর্ব দিক থেকে বের হয়ে পরবর্তীতে সমস্ত যমীনে ছড়িয়ে পড়বে।
ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আখিরাতের হাশর দু’টি হলো মৃত্যুর পর কবর থেকে সমস্ত মানুষকে উঠিয়ে একটি মাত্র মাঠে একত্রিত করার নাম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿وَحَشَرْنَاهُمْ فَلَمْ نُغَادِرْ مِنْهُمْ أَحَدًا﴾ ‘‘সেদিন আমি মানুষকে একত্রিত করবো এবং তাদের কাউকে ছাড়বো না’’। (সূরা কাহাফ: ৪৭) আর অন্য হাশরটি হলো তাদেরকে জান্নাত কিংবা জাহান্নামে একত্রিত করার নাম। দুনিয়ার হাশর সম্পর্কে কবি বলেন, وآخر الأيات حشر النار كما أتى في محمكم الأخبار কিয়ামতের আলামতগুলোর মধ্যে সর্বশেষ হলো একটি আগুন, যা মানুষকে একত্রিত করবে। যেমন এসেছে সহীহ হাদীছসমূহে। এখানে আলামতগুলো বলতে বড় বড় নিদর্শনসমূহ উদ্দেশ্য। ভয়াবহ একটি আগুন লোকদেরকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে এবং ইয়ামান থেকে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের হিজরতের যমীন সিরিয়াতে একত্রিত করবে। সহীহ হাদীছসমূহে সুস্পষ্টভাবে এ কথা উল্লেখ আছে। অতঃপর হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ ইয়ামান থেকে আগুনটি বের হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। আদানের গর্ত থেকে আগুনটি বের হওয়ার কথাও সুস্পষ্ট। সেই সঙ্গে পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিকে মানুষকে তাড়িয়ে নেয়ার কথা এবং সিরিয়ার যমীনে একত্রিত করার কথাও বর্ণিত হয়েছে। উভয় বর্ণনার মধ্যে সমন্বয় এভাবে করা যেতে পারে যে, দু’টি আগুন বের হবে। একটি পূর্ব দিক থেকে বের হয়ে পশ্চিম দিকে মানুষকে ধাওয়া করবে এবং অন্যটি ইয়ামান থেকে বের হয়ে মানুষকে সিরিয়ার যমীনে নিয়ে যাবে।
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, আগুন একটি হলেও হাদীছগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, «تَخْرُجُ نَارٌ مِنْ حَضْرَمَوْتَ فَتَسُوقُ النَّاسَ ‘‘হাযারা মাওত থেকে একটি আগুন বের হবে অতঃপর মানুষকে হাঁকিয়ে নিবে’’। অন্য বর্ণনা এসেছে, আদানের গর্ত থেকে আগুন বের হবে এবং মানুষকে হাশরের দিকে তাড়িয়ে নিবে।
অন্য হাদীছে আছে,«نَارٌ تَحْشُرُ النَّاسَ مِنْ الْمَشْرِقِ إِلَى الْمَغْرِبِ ‘‘একটি আগুন মানুষকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে জড়ো করবে’’। উক্ত হাদীছগুলোর মধ্যে এভাবে সমন্বয় করা সম্ভব যে, সিরিয়া হলো একত্রিত করার স্থান এবং এটি পূর্বের দেশগুলোর তুলনায় পশ্চিমে। অতএব ইয়ামানের আদানের গর্ত থেকে সর্বপ্রথম বের হবে। সেখান থেকে বের হয়ে পূর্ব দিকে ছড়িয়ে পড়বে। অতঃপর পূর্বের বাসিন্দাদেরকে পশ্চিমে তথা সিরিয়াতে একত্রিত করবে। সুতরাং সিরিয়া হবে দুনিয়ার হাশরের যমীন; আখিরাতের হাশরের যমীন নয়। যেমনটি মনে করে থাকেন এক শ্রেণীর আলেম।
[1]. সহীহ বুখারী ৬৫২২, অধ্যায়: কিতাবুর্ রিকাক, মুসলিম ২৮৬১।
[2]. নিহায়া, অধ্যায়: ফিতান ওয়া মালাহিম।
[3]. সহীহ: তিরমিযী ২২১৭।
[4]. সহীহ বুখারী ৩৩৪৯, অধ্যায়: কিতাবুর্ রিকাক।
[5]. সহীহ বুখারী ৭১১৮ নং হাদীছের অধ্যায়ে: আগুন বের হওয়া।
কুরআনুল কারীমে সিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার আলোচনা অনেকবার এসেছে। সিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার সময় যা কিছু ঘটবে সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, কুরআনে তিনটি ফুঁ দেয়ার কথা উল্লেখ আছে। ভয়-ভীতি ও আতঙ্কের ফুৎকার। সূরা নামালে এ ফুৎকারের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَيَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ فَفَزِعَ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلاَّ مَنْ شَاءَ اللَّهُ﴾
‘‘আর সেদিন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। ফলে আকাশ ও যমীনে যারা আছে সকলেই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, সে ব্যতীত’’। (সূরা আন নামল: ৮৭)
(২) সংজ্ঞাহীন হওয়া ও (৩) দাঁড়ানোর ফুৎকার সম্পর্কে সূরা আয্ যুমারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ﴾
‘‘এবং শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। ফলে আকাশ ও যমীনে যারা আছে সকলেই বেহুশ হয়ে যাবে। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, সে ব্যতীত। অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। তৎক্ষনাৎ তারা দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে’’। (সূরা যুমার: ৬৮)
এখানে যারা ভীত-আতঙ্কিত হবেনা বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তারা হলেন জান্নাতের হুরগণ। কেননা জান্নাতে কোনো মৃত্যু নেই। অনেকেই তা থেকে রেহাই পাবে। তবে কারা কারা ভয়-ভীতি ও আতঙ্কগ্রস্থ হওয়া থেকে রেহাই পাবে, তাদের প্রত্যেককে দৃঢ়তার সাথে সনাক্ত করা সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে বিষয়টিকে সাধারণ রেখেছেন। সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«لَا تُفَضِّلُونِي عَلَى مُوسَى فَإِنَّ النَّاسَ يُصْعَقُونَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَأَكُونُ أَوَّلَ مَنْ يُفِيقُ، فَأَجِدُ مُوسَى بَاطِشًا بِسَاقِ الْعَرْشِ، فَلَا أَدْرِي هَلْ أَفَاقَ قَبْلِي، أَوْ كَانَ مِمَّنِ اسْتَثْنَاه اللَّهُ؟»
‘‘তোমরা আমাকে মূসার উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করো না। কেননা কিয়ামতের দিন সমস্ত মানুষ অজ্ঞান হয়ে যাবে। আমিই সর্বপ্রথম জ্ঞান ফিরে পাবো। জ্ঞান ফিরে পেয়ে আমি দেখতে পাবো, মূসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর আরশের খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানিনা, তিনি কি আমার পূর্বে জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন? না কি আল্লাহ তা‘আলা তাকে ঐসব সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত করেছেন, যারা সংজ্ঞাহীন হবে না?’’[1] এ সংজ্ঞাহীন হওয়ার ব্যাপারে কেউ কেউ বলেছেন, এটি চতুর্থবার ফুঁ দেয়ার কারণে। কেউ কেউ বলেছেন, এটি কুরআনে উল্লেখিত ফুৎকার সমূহেরই অন্তর্ভুক্ত। শাইখুল ইসলামের উক্তি এখানেই শেষ। ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, জেনে রাখুন যে, শিঙ্গায় তিনবার ফুঁ দেয়া হবে। (১) ভীত-সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত হওয়ার ফুৎকার। এর মাধ্যমে সৃষ্টিজগতের শৃঙ্খলা পরিবর্তন হবে এবং সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। এ দিকে ইশারা করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَمَا يَنْظُرُ هَؤُلَاءِ إِلَّا صَيْحَةً وَاحِدَةً مَا لَهَا مِنْ فَوَاقٍ﴾
এরা তো কেবল অপেক্ষা করছে এক মহাগর্জনের, যাতে কোনো বিরতি থাকবে না। (সূরা সোয়াদ: ১৫) অর্থাৎ কোনো পুনরাবৃত্তি হবে না। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَيَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ فَفَزِعَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ﴾
‘‘এবং শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে সবাই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে যাবে। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, সে ব্যতীত। অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। তখন তারা দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে’’। (সূরা আয যুমার: ৮৭)
ইমাম যামাখশারী রাহিমাহুল্লাহ তার কাশ্শাফে এ আয়াতে শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার সময় ভয়-ভীতি থেকে যেসব ফেরেশতাদেরকে মুক্ত রাখবেন, তারা হলেন জিবরীল, মীকাঈল, ইসরাফীল ও মালাকুল মাওত। কেউ কেউ অন্য কথাও বলেছেন। শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার সময় যে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে, তার কারণেই তারা ভীত-আতঙ্কিত হয়ে যাবে।
(২) ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, দ্বিতীয় ফুৎকারটি হবে সংজ্ঞাহীন হওয়ার জন্য। এতে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ﴾
‘‘এবং শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। ফলে আকাশ ও যমীনে যারা আছে সকলেই সংজ্ঞাহীন হয়ে যাবে। তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, সে ব্যতীত’’। (সূরা যুমার: ৬৮) সংজ্ঞাহীন হওয়াকে মৃত্যু বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
শিঙ্গাটি হবে নূরের। সমস্ত সৃষ্টির রূহকে সেটার মধ্যে ঢুকানো হবে। মুজাহিদ বলেন, এটি হবে হর্ন বা বিউগলের মতো। ইমাম বুখারী রাহিমাহুল্লাহ এ কথা উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, জনৈক গ্রাম্য লোক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বললো, শিঙ্গা কী? জবাবে তিনি বললেন, এটি হলো একটি শিঙ্গা, যাতে ফুঁ দেয়া হবে। ইমাম তিরমিযী বলেন, হাদীছটি হাসান।
(৩) তৃতীয় ফুৎকারটি হবে পুনরুত্থান ও হিসাব-নিকাশের। পবিত্র কুরআনের বহু আয়াত এবং অনেক হাদীছ শিঙ্গায় পুনরুত্থানের ফুঁ দেয়ার কথা প্রমাণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُم مِّنَ الْأَجْدَاثِ إِلَىٰ رَبِّهِمْ يَنسِلُونَ﴾
‘‘তারপর শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে এবং সহসা তারা নিজেদের রবের সামনে হাযির হবার জন্য নিজেদের কবর থেকে বের হবে’’। (সূরা ইয়াসীন: ৫১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَى فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنْظُرُونَ﴾
‘‘অতঃপর আবার শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। তখন তারা দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে’’। (সূরা যুমার: ৬৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَإِذَا نُقِرَ فِي النَّاقُورِ (8) فَذَلِكَ يَوْمَئِذٍ يَوْمٌ عَسِيرٌ (9) عَلَى الْكَافِرِينَ غَيْرُ يَسِيرٍ﴾
‘‘যেদিন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। সেদিন হবে এক সঙ্কটের দিন। যা কাফেরদের জন্য সহজ নয়। (সূরা আল-মুদ্দাছছির: ৮-১০) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَاسْتَمِعْ يَوْمَ يُنَادِ الْمُنَادِ مِنْ مَكَانٍ قَرِيبٍ (41) يَوْمَ يَسْمَعُونَ الصَّيْحَةَ بِالْحَقِّ ذَلِكَ يَوْمُ الْخُرُوجِ﴾
‘‘মন দিয়ে শোন! যেদিন এক ঘোষক ঘোষণা করবে নিকটবর্তী স্থান হতে আহবান করবে। সেদিন মানুষ অবশ্যই শ্রবণ করবে এক বিরাট আওয়াজ। সেদিনই বের হওয়ার দিন’’। (সূরা কাফ: ৪০-৪১)
মুফাসসিরগণ বলেন, আহবায়ক হলেন ইসরাফীল আলাইহিস সালাম। তিনি শিঙ্গায় ফুঁ দিবেন এবং আহবান করবেন, হে পুরাতন হাড্ডীসমূহ! হে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন পেশী ও মাংসসমূহ এবং বিক্ষিপ্ত চুলসমূহ! আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে একত্রিত হওয়ার আদেশ দিচ্ছেন। যাতে তিনি বান্দাদের মাঝে বিচার-ফায়ছালা করতে পারেন।
কেউ কেউ বলেছেন, ইসরাফীল ফুঁ দিবেন এবং জিবরীল ডাক দিবেন। নিকটবর্তী স্থান বলতে বাইতুল মুকাদ্দাসের একটি পাথর উদ্দেশ্য। আরেকদল মুফাস্সির বলেছেন, উভয় ফুৎকারের মাঝের ব্যবধান হবে চল্লিশ বছর। কতিপয় আলেম বলেছেন, সমস্ত বর্ণনা একথারই প্রমাণ বহন করে। সহীহ মুসলিমে আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে মারফু হিসাবে বর্ণিত হয়েছে যে, উভয় ফুৎকারের মধ্যে চল্লিশের ব্যবধান হবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, হে আবু হুরায়রা! চল্লিশ দিন? আবু হুরায়রা বলেন, আমি তা বলতে অস্বীকার করলাম। সাহাবীগণ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, চল্লিশ মাস? তিনি বলেন, আমি তা বলতেও অস্বীকার করলাম। তারা বললেন, চল্লিশ বছর? তিনি বলেন, আমি তাও অস্বীকার করলাম.....।
আবু হুরায়রার উক্তি, আমি অস্বীকার করলাম, এ কথার তিনটি ব্যাখ্যা রয়েছে। (১) প্রথম ব্যাখ্যা হলো, আমি তোমাদের জন্য সেটা বলা থেকে বিরত থাকলাম। (২) কেউ কেউ বলেছেন, আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কথার অর্থ হলো আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ইহা জিজ্ঞাসা করা থেকে বিরত রয়েছি। (৩) কেউ কেউ বলেছেন, আমি জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গিয়েছিলাম। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি তা খুলে বলা থেকে বিরত থাকার কারণ হলো, এ বিষয়ে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ অবগত নয়। কেননা এটি মহান আল্লাহর রুবুবীয়াতের বৈশিষ্ট।
আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইবনে জারীর, তাবারী, আবু ইয়ালা স্বীয় মুসনাদে, বায়হাকী পুনরুত্থান অধ্যায়ে, আবু মুসা আল-মাদীনি এবং অন্যরা যে দীর্ঘ হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তাতে তিনি বলেছেন যে, আমাদের কাছে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা যখন আসমান-যমীন সৃষ্টি করে শেষ করলেন তখন শিঙ্গা সৃষ্টি করলেন এবং সেটা ইসরাফীলকে দিলেন। তিনি সেটাকে তার মুখে রেখে আরশের দিকে মাথা উঠিয়ে অপেক্ষা করছেন, কখন তাকে সেটাতে ফুঁ দেয়ার আদেশ দেয়া হবে। আবু হুরায়রা বলেন, আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ! শিঙ্গা কী? তিনি বললেন, সেটা হলো হর্ন বা বিউগল। আবু হুরায়রা বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কী দিয়ে সেটা সৃষ্টি করা হয়েছে? তিনি বললেন, সেটা একটি বিরাট শিঙ্গা। সেটার একটি আংটা আসমান-যমীনের চেয়ে বড়। তাতে তিনি তিনবার ফুঁ দিবেন। প্রথমটি হবে ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়ার ফুৎকার, দ্বিতীয়টি হবে সংজ্ঞাহীন হওয়ার ফুৎকার ও তৃতীয়টি হবে সৃষ্টিজগতের প্রভুর সামনে দন্ডায়মান হওয়ার ফুৎকার।
আল্লাহ তা‘আলা ইসরাফীলকে প্রথমবার ফুঁ দেয়ার আদেশ দিবেন। তুমি ভয়-ভীতি ও আতঙ্কগ্রস্থ হওয়ার ফুঁ প্রদান করো। তিনি ফুঁ দিবেন। এতে আসমান-যমীনের সবাই ভীত-সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত হবে। তবে আল্লাহ তা‘আলা যাকে এর বাইরে রাখবেন, তার কথা ভিন্ন। আল্লাহ তাকে ফুঁ দেয়ার আদেশ দিবেন। তিনি দীর্ঘ ফুৎকার প্রদান করবেন এবং কোনো প্রকার ক্লান্তিবোধ করবেন না। এ সম্পর্কেই আল্লাহ তা‘আলা বলছেন,
﴿وَمَا يَنْظُرُ هَؤُلَاءِ إِلَّا صَيْحَةً وَاحِدَةً مَا لَهَا مِنْ فَوَاقٍ﴾
‘‘এরা তো কেবল অপেক্ষা করছে এক মহাগর্জনের, যাতে কোনো বিরতি থাকবে না’’। (সূরা সোয়াদ: ১৫)
অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা পাহাড়গুলো চালিত করবেন। এতে মেঘমালা চলার মতো তা চলতে থাকবে। অতঃপর সেটা মরীচিকার মতো হয়ে যাবে। যমীন তার সমস্ত বাসিন্দা সহকারে প্রকম্পিত হবে। সেটা সমুদ্রে ভাসমান মাল বোঝাই করা নৌকার মতো হবে, যাকে আঘাত করছে ঢেউয়ের পর ঢেউ এবং তা ঝুলতে থাকবে ঐ ফানুসের মতো, যা লটকানো আছে আরশের সাথে এবং সেটাতে আশ্রয় নিচ্ছে মুমিনদের রূহসমূহ। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন,
﴿يَوْمَ تَرْجُفُ الرَّاجِفَةُ (6) تَتْبَعُهَا الرَّادِفَةُ﴾
‘‘সেদিন প্রকম্পিত করবে মহাপ্রলয়ের প্রথম শিঙ্গাধ্বনি। তার অনুগামী হবে পরবর্তী শিঙ্গাধ্বনি’’। (সূরা আন্-নাযিআত: ৬-৭)
এতে যমীন কাত হয়ে যাবে মানুষের পিঠের উপরে। স্তন্য দানকারীনী মহিলারা কোলের দুপোষ্য শিশুকে ভুলে যাবে, শিশুরা বৃদ্ধে পরিণত হবে এবং ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে শয়তান উড়ে পালানোর চেষ্টা করবে। এমনকি সে দিগমেত্মর দিকে চলে যাবে। কিন্তু ফেরেশতারা তাকে পাকড়াও করবে এবং তার চেহারায় আঘাত করবে। অতঃপর সে আঘাত খেয়ে ফিরে আসবে। মানুষেরা পরস্পরকে ডকাডাকি করতে করতে পালাতে চেষ্টা করবে। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন,
﴿يَوْمَ تُوَلُّونَ مُدْبِرِينَ مَا لَكُمْ مِنَ اللَّهِ مِنْ عَاصِمٍ﴾
‘‘সেদিন তোমরা পশ্চাতে ফিরে পলায়ন করতে চাইবে। আল্লাহর শাস্তি থেকে তোমাদের রক্ষাকারী কেউ থাকবে না’’।
এমতাবস্থায় যমীন ফেটে যাবে এবং বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হবে। তখন তারা এক ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখতে পাবে। তারা আসমানের দিকে তাকাবে। সেটাকে তারা ফুটন্ত তেলের গাদের মতো দেখতে পাবে। অতঃপর আসমান ফেটে যাবে এবং সেটার নক্ষত্রসমূহ ছিটকে পড়বে। আসমানের সূর্য ও চন্দ্র আলো বিহীন হয়ে যাবে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, কবরে দাফন কৃত মৃতরা এ ভয়াবহ অবস্থার কিছুই জানতে পারবে না। বর্ণনাকারী বলেন, আমি বললাম, ইয়া রসূলাল্লাহ!
إِلَّا مَنْ شَاءَ اللَّهُ﴾ ﴿
‘‘তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন, সে ব্যতীত’’ এর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে আলাদা করেছেন, তারা কারা? তিনি বললেন, তারা হলো শহীদগণ। জীবিত লোকেরা ভীত-আতঙ্কিত হবে। আর শহীদগণ তাদের রবের নিকট জীবিত অবস্থায় রিযিকপ্রাপ্ত হতে থাকবেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সেদিনের ভয়-ভীতি ও আতঙ্ক থেকে হেফাযত করবেন ও নিরাপত্তা প্রদান করবেন। আর এ ভয়-ভীতি হবে আল্লাহর পক্ষ হতে নিকৃষ্ট লোকদের জন্য শাস্তি স্বরূপ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَاأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمْ إِنَّ زَلْزَلَةَ السَّاعَةِ شَيْءٌ عَظِيمٌ يَوْمَ تَرَوْنَهَا تَذْهَلُ كُلُّ مُرْضِعَةٍ عَمَّا أَرْضَعَتْ وَتَضَعُ كُلُّ ذَاتِ حَمْلٍ حَمْلَهَا وَتَرَى النَّاسَ سُكَارَى وَمَا هُمْ بِسُكَارَى وَلَكِنَّ عَذَابَ اللَّهِ شَدِيدٌ﴾
‘‘হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো। নিশ্চয়ই কিয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সেদিন তোমরা দেখতে পাবে প্রত্যেক স্তন্যদায়ী তার দুধের শিশুকে ভুলে গেছে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলা তার গর্ভের সন্তান প্রসব করে দিবে আর তুমি মানুষকে মাতাল অবস্থায় দেখতে পাবে। অথচ তারা মাতাল নয়। বস্তুত আল্লাহর আযাব খুবই কঠিন’’। (সূরা হজ্জ: ১-২)
অতঃপর যতক্ষণ আল্লাহ চাইবেন, ততোক্ষণ তারা উক্ত ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে অবস্থান করতে থাকবে।
আমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে সীরাতুল মুস্তাকীম প্রার্থনা করছি এবং আমরা প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদেরকে ঐসব লোকের মধ্যে গণ্য করেন, যাদেরকে ভয়াবহ আতঙ্ক কোনো প্রকার চিন্তিত করবে না এবং যাদেরকে ফেরেশতাগণ নিরাপত্তা দিয়ে বলবেন, এটি হলো সেই দিন, যার ওয়াদা তোমাদের সাথে করা হয়েছে।
[1]. সহীহ বুখারী ২৪১১, সহীহ মুসলিম ২৩৭৩।