লগইন করুন
ইতিপূর্বে আমরা কিয়ামতের বড় আলামতগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। এখন আমরা সেগুলো বিস্তারিত আলোচনা করবো। এগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম হলো মাহদীর আত্মপ্রকাশ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘‘ততদিন দুনিয়া ধ্বংস হবে না যতদিন না আমার পরিবারের একজন লোক আরবদের বাদশা হবেন। তার নাম হবে আমার নাম এবং তার পিতার নাম হবে আমার পিতার নাম’’।[1] অর্থাৎ তার নাম হবে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ। ইমাম আহমাদ, আবু দাউদ এবং তিরমিযী রাহিমাহুমুল্লাহ সহীহ সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছটি হাসান-সহীহ। এ বিষয়ে আলী, আবু সাঈদ, উম্মে সালামা এবং আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম থেকে হাদীছ রয়েছে।
আল্লামা সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মাহদীর ব্যাপারে অনেক হাদীছ ও আছার রয়েছে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যেসব হাদীছ দ্বারা মাহদীর আগমনের উপর দলীল গ্রহণ করা হয়, তা সহীহ। ইমাম আবু দাউদ, তিরমিযী, আহমাদ এবং অন্যান্য ইমামগণ এসব হাদীছ বর্ণনা করেছেন।
মাহদীর নাম হলো মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ। আখেরী যামানায় যখন পৃথিবী যুলুমে ভরপুর হয়ে যাবে, তখন তিনি হাসান আলী ইবনে আবু তালেবের বংশধর থেকে বের হবেন এবং ন্যায়-ইনসাফ দ্বারা পৃথিবী পরিপূর্ণ করে দিবেন।
আল্লামা সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, মাহদীর ব্যাপারে অনেক কথা বর্ণিত হয়েছে। এমন কি এ কথাও বলা হয়েছে যে, لامهدي إلا عيسى ‘‘ঈসা ব্যতীত আর কোনো মাহদী নেই’’। অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালাম আসবেন; মাহদী নন। তবে আহলে হকদের মতে, সঠিক কথা হলো মাহদী ঈসা নন। মাহদী আসবেন ঈসা আলাইহিস সালাম নামার আগে। মাহদী সম্পর্কে এত বেশি হাদীছ এসেছে যে, তা অর্থগত মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আহলে সুন্নাতের আলেমদের নিকট মাহদী সংক্রান্ত হাদীছগুলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট হওয়ার কারণে তা আকীদার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
আমি বলছি, মাহদীর ব্যাপারে দু’টি সম্প্রদায় পরস্পর বিপরীতমুখী কথা বলেছে এবং আরেকটি পক্ষ মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছে। কুরআন ও হাদীছের উক্তি এবং আলেম-উলামাদের বক্তব্য সম্পর্কে অনভিজ্ঞ সাম্প্রাতিক কালের কিছু লেখক মাহদীর আগমন সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে নিজেদের মতো ও বিবেক বুদ্ধির উপর নির্ভর করা ছাড়া তাদের কাছে আর কোনো দলীল নেই।
কিছু গোমরাহ সম্প্রদায় মাহদীর ব্যাপারে খুব বাড়াবাড়ি করেছে। এমনকি প্রত্যেক গোমরাহ সম্প্রদায় নিজেদের নেতাকে প্রতীক্ষিত মাহদী মনে করেছে। রাফেযীরা দাবি করে যে, তাদের প্রতীক্ষিত ইমামই মাহদী। তারা সামেরার গর্ত থেকে তাদের প্রতীক্ষিত ইমাম বের হবে বলে অপেক্ষা করছে। তারা তার নাম দিয়েছে মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আল-আসকারী। তাদের মতে তিনি পাঁচশত বছর পূর্বে শিশুকালে সামেরার গর্তে প্রবেশ করেছেন। তারা তাদের ইমাম বের হওয়ার অপেক্ষা করছে।
শিয়াদের ফাতেমীয় সম্প্রদায় দাবি করে যে, তাদের নেতাই হবেন মাহদী। এভাবে যে কেউ মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করা, বিজয়ী হওয়া এবং তাদেরকে ধোঁকা দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করেছে, সে নিজেকে প্রতীক্ষিত মাহদী বলে দাবি করেছে। অনুরূপ সুফীদের যে কেউ মিথ্যাচার ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে, সে নিজেকে আহলে বাইতের অন্তর্ভুক্ত সাইয়্যেদ বা আওলাদে রসূল বলে দাবি করেছে।
আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা মাহদীর ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন। তারা সহীহ হাদীছ মোতাবেক মাহদীর আগমন সাব্যস্ত করেন। সহীহ হাদীছে তার নাম, পিতার নাম, বংশ, গুণাবলী ও তার বের হওয়ার সময়ের ব্যাপারে যা বর্ণিত হয়েছে সে অনুপাতে তারা মাহদীর আগমনে বিশ্বাসী। তারা এ ব্যাপারে সহীহ হাদীছের সীমালংঘন করেন না। তার বের হওয়ার পূর্বে অনেক আলামত দেখা দিবে, যা আলেমগণ তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন।
আল্লামা সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, মাহদীর ব্যাপারে অনেক কথা বর্ণিত হয়েছে। এমন কি এ কথাও বলা হয়েছে যে, لامهدي إلا عيسى ‘‘ঈসা ব্যতীত আর কোনো মাহদী নেই’’। অর্থাৎ ঈসা আলাইহিস সালাম আসবেন; মাহদী নন। তবে আহলে হকদের মতে, সঠিক কথা হলো মাহদী ঈসা নন। মাহদী আসবেন ঈসা আলাইহিস সালাম নামার আগে। মাহদী সম্পর্কে এত বেশি হাদীছ এসেছে যে, তা অর্থগত মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আহলে সুন্নাতের আলেমদের নিকট মাহদী সংক্রান্ত হাদীছগুলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট হওয়ার কারণে তা আকীদার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সাহাবীদের নাম উল্লেখসহ এবং তাদের নাম উল্লেখ ছাড়া মাহদীর ব্যাপারে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে এবং সাহাবীদের পরে তাবেঈদের থেকেও অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, যা দ্বারা অকাট্য ইলম অর্জিত হয়। সুতরাং মাহদীর আগমনের উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। আলেমদের নিকট এটি একটি সুসাব্যস্ত বিষয় এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদার কিতাবগুলোতে এটি লিপিবদ্ধ রয়েছে।
অতঃপর ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ মাহদীর বৈশিষ্ট সম্পর্কে বলেন, আলেমগণ বলেছেন, তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত মোতাবেক আমল করবেন। এমনকি কোনো স্থান দিয়ে অতিক্রম করার সময় যদি ঘুমন্ত ও জাগ্রত উভয় শ্রেণীর লোক দেখতে পান, সে ক্ষেত্রেও তিনি সুন্নাতের অনুসরণ করবেন। অর্থাৎ জাগ্রতদেরকে সালাম দিয়ে চলে যাবেন, কিন্তু ঘুমন্তদেরকে জাগাবেন না। তিনি সুন্নাত প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করবেন, প্রতিটি সুন্নাত পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবেন এবং সমস্ত বিদআতের মূলোৎপাটন করবেন। আখেরী যামানায় তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ন্যায় দীন প্রতিষ্ঠা করবেন। খ্রিষ্টানদের ক্রুশ চিহ্ন ভেঙে ফেলবেন, শূকর হত্যা করবেন, মুসলিমদের পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন সুদৃঢ় করবেন এবং পৃথিবী যেভাবে যুলুম-নির্যাতনে ভরে গেছে, সেভাবেই ন্যায়-ইনসাফ দ্বারা ভরপুর করে দিবেন।
ইমাম সাফারায়েনী রাহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিবার থেকে সুপথ প্রাপ্ত একজন পুরুষ বের হবেন। তার চরিত্র হবে উত্তম। তিনি কন্স্টানটিনোপ্ল জয় করবেন। তিনি হবেন উম্মতে মুহাম্মাদীর সর্বশেষ আমীর। তার যামানাতেই দাজ্জাল বের হবে এবং ঈসা আলাইহিস সালাম অবতরণ করবেন।
তিনি আরো বলেন, আল্লামা শাইখ মারঈ রাহিমাহুল্লাহ তার فوائد الفكر নামক কিতাবে আবুল হাসান ইবনে মুহাম্মাদ আল-হাসান থেকে বর্ণনা করেছেন যে, মুহাম্মাদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে মাহদীর আগমন সম্পর্কে প্রচুর হাদীছ বর্ণিত হয়েছে এবং সেটার বর্ণনাকরীগণ খুব প্রসিদ্ধ। তিনি হবেন রসূলের পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। তিনি সাতবছর রাজত্ব করবেন এবং পৃথিবীকে ন্যায়-ইনসাফ দ্বারা ভরপুর করে দিবেন। তার জীবদ্দশাতেই ঈসা আলাইহিস সালাম আগমন করবেন এবং ফিলিসত্মীনের যমীনে লুদ্দের ফটকের সামনে দাজ্জালকে হত্যা করার কাজে তাকে সাহায্য করবেন। তিনি এ উম্মতের ইমামতি করবেন এবং ঈসা আলাইহিস সালাম তার পিছনেই মুক্তাদী হয়ে সালাত পড়বেন। অর্থাৎ মাত্র এক ওয়াক্ত সালাত পড়বেন। সেটি হলো ফজরের সালাত ।
তিনি হলেন মাহদী। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন, তার সুস্পষ্ট গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তার বের হওয়ার সময় বলে দিয়েছেন এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট সম্পর্কেও আলোকপাত করেছেন। মাহদী আসার আগেই একদল গোমরাহ লোক নিজেদেরকে মাহদী বলে দাবি করেছে। মাহদীর বিশেষণ তাদের মধ্যে মোটেই পাওয়া যায়নি। এর মাধ্যমে তারা সরল প্রাণ মানুষকে ধোঁকা দিয়েছে এবং মাহদীয়াতের দাবি করে নিজেদের লোভ-লালসা বাস্তবায়নের পায়তারা করেছে। আল্লাহ তা‘আলা এই মিথ্যুকদের মিথ্যাচারের মুখোশ উন্মুক্ত করেছেন এবং তাদের বাতিলকে মানুষের সামনে সুস্পষ্ট করে দেখিয়েছেন।
হে পাঠক সম্প্রদায়! আপনারা আশ্চর্যবোধ করবেন না! একদল লোক নবুওয়াত দাবি করেছে। তারা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا أَوْ قَالَ أُوحِيَ إِلَيَّ وَلَمْ يُوحَ إِلَيْهِ شَيْءٌ﴾
‘‘আর সে ব্যক্তির চেয়ে বড় যালেম আর কে হতে পারে যে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ রটায় অথবা বলে আমার কাছে অহী এসেছে অথচ তার উপর কোনো অহী নাযিল করা হয়নি’’। (সূরা আনআম: ৯৩)
আমরা আল্লাহর কাছে দু‘আ করি, তিনি যেন আমাদের সামনে সত্যকে সত্য হিসাবে উদ্ভাসিত করেন এবং সেটার অনুসরণ করার তাওফীক দান করেন। সেই সঙ্গে বাতিলকেও যেন আমাদের সামনে বাতিল হিসাবে সুস্পষ্ট রূপে প্রকাশ করেন এবং আমাদেরকে সেটা থেকে দূরে রাখেন। একই সঙ্গে আমাদেরকে যেন পথভ্রষ্ট ইমাম এবং প্রতারক-মিথ্যুকদের অনিষ্ট থেকে হেফাযত করেন। আমরা আল্লাহ পাক রাববুল আলামীনের প্রশংসা করছি।
[1]. মুসনাদে আহমাদ, সহীহুল জামে আস্সাগীর, হাদীছ নং- ৫১৮০।