শিরক দু’প্রকার। বড় শিরক ও ছোট শিরক। বড় শিরক তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। মানুষকে এটি ইসলাম থেকে বের করে দেয়। বড় শিরকের অনেক প্রকার রয়েছে। কতিপয় বড় শিরকের আলোচনা ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। কবর ও সমাধির আশপাশে বড় শিরকের চর্চা করা হয়ে থাকে। এখানে আমরা আরো কয়েক প্রকার বড় শিরকের আলোচনা করবো।
আলেমগণ যেভাবে ভয়ের সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন, তা হলো সম্ভাব্য কিংবা নিশ্চিত কোনো লক্ষণ থেকে অপ্রিতিকর কিছু হওয়ার আশঙ্কা করাকে ভয় বলা হয়। ভয় তিন প্রকার।
প্রথম প্রকার ভয়: গোপন ভয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য জিনিস যেমন মূর্তি, তাগুত, মৃত ব্যক্তি, গায়েবী জগতের জিন কিংবা অনুপস্থিত মানুষের পক্ষ থেকে অপ্রিয় কিছু হওয়ার আশঙ্কা করার নাম ভয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা হুদ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেন যে, তারা হুদকে বলেছিল,
﴿إِن نَّقُولُ إِلَّا اعْتَرَاكَ بَعْضُ آلِهَتِنَا بِسُوءٍ قَالَ إِنِّي أُشْهِدُ اللَّهَ وَاشْهَدُوا أَنِّي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُون مِن دُونِهِ فَكِيدُونِي جَمِيعًا ثُمَّ لَا تُنظِرُونِ﴾
আমরা তো মনে করি তোমার উপর আমাদের কোনো দেবতার অভিশাপ পড়েছে। হুদ বললো, আমি আল্লাহকে সাক্ষী করছি এবং তোমরা সাক্ষী থাকো। তোমরা যে শিরক করছো, নিশ্চিতভাবে আমি তা থেকে মুক্ত। সুতরাং আল্লাহকে ছেড়ে তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করো। অতঃপর আমাকে সামান্য অবকাশও দিয়ো না। (সূরা হুদ: ৫৪-৫৫)
মক্কার মুশরিকরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের মূর্তিদের ভয় দেখিয়েছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِن دُونِهِ
‘‘এসব লোক তোমাকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদের ভয় দেখায়’’। (সূরা আয যুমার: ৩৬)
বর্তমান সময়ের কবর পূজারী এবং মূর্তিপূজকরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে এ ধরণের ভয় করে থাকে। তারা কবরকে ভয় করে। তাওহীদপন্থী যেসব লোক কবর পূজার প্রতিবাদ করে এবং ইখলাসের সাথে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার আদেশ দেয় তাদেরকেও কবর পূজারীরা কবর ও কবরে দাফনকৃত অলী-আওলীয়াদের ভয় দেখায়।
এ শ্রেণীর ভয় তথা গোপন ভয় গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এ শ্রেণীর ভয় একমাত্র আল্লাহকেই করা আবশ্যক।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾
‘‘এ হলো শয়তান, সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়। সুতরাং তোমরা যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে থাক তাহলে তাদেরকে ভয় করো না; বরং আমাকেই ভয় করো’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৭৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ﴾ কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো’’। (সূরা আল মায়িদা: ৩)
এ ভয় দীনের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম স্তরের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যকে এ শ্রেণীর ভয় করবে, আল্লাহর সাথে বড় শিরকে লিপ্ত হবে। আমরা এ থেকে আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
দ্বিতীয় প্রকার ভয়: ভয়ের আরেকটি প্রকার হলো মানুষের ভয়ে কিছু ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয়া। এটি হারাম ও ছোট শিরক। আল্লাহ তা‘আলার নিম্নের বাণীতে এ শ্রেণীর ভয়ের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ فَانقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَّمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾
‘‘যাদেরকে লোকেরা বলেছে যে, তোমাদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য লোকেরা বহু সাজ-সরঞ্জাম সমবেত করেছে। সুতরাং তাদের ভয় করো। তখন তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনিই সর্বোত্তম কর্ম সম্পাদনকারী। অবশেষে তারা ফিরে এলো আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহ সহকারে। তাদের কোনো রকম ক্ষতি হয়নি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর চলার সৌভাগ্যও তারা লাভ করলো। আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহকারী। এ হলো শয়তান, সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়। সুতরাং তোমরা যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে থাক তাহলে তাদেরকে ভয় করোনা; বরং আমাকেই ভয় করো’’। (সূরা আলে- ইমরান: ১৭৩-১৭৫)
ইবনে মাজাহ গ্রন্থে আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে এ ভয়ের কথাই এসেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَا يَحْقِرْ أَحَدُكُمْ نَفْسَهُ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، كَيْفَ يَحْقِرُ أَحَدُنَا نَفْسَهُ؟ قَالَ: يَرَى أَمْرًا، لِلَّهِ عَلَيْهِ فِيهِ مَقَالٌ، ثُمَّ لَا يَقُولُ فِيهِ، فَيَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: مَا مَنَعَكَ أَنْ تَقُولَ فِي كَذَا وَكَذَا؟ فَيَقُولُ: خَشْيَةُ النَّاسِ، فَيَقُولُ: فَإِيَّايَ كُنْتَ أَحَقَّ أَنْ تَخْشَى
‘‘তোমাদের কেউ যেন নিজেকে লাঞ্চিত না করে। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! কিভাবে আমাদের কেউ নিজেকে লাঞ্ছিত করতে পারে? তিনি বললেন, বান্দা কখনো এমন অন্যায় কাজ দেখে, যার প্রতিবাদ করা কেবল আল্লাহ তা‘আলার জন্যই তার উপর আবশ্যক। অথচ সে তার প্রতিবাদ করে না। আল্লাহ তা‘আলা তাকে কিয়ামতের দিন বলবেন, অমুক অমুক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কিসে তোমাকে বারণ করলো? বান্দা বলবে, মানুষের ভয়। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, কেবল আমাকেই ভয় করা তোমার উপর আবশ্যক ছিল’’।[1]
তৃতীয় প্রকার ভয়: আরেক প্রকার ভয় রয়েছে, যা সৃষ্টিগত ও স্বভাবগত ভয়। শত্রুর ভয়, হিংস্র জীব-জন্তুর ভয় এবং এ ধরণের অন্যান্য ভয়। এ জাতিয় ভয় দোষনীয় নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনাতে বলেন,
﴿فَخَرَجَ مِنْهَا خَائِفًا يَتَرَقَّبُ قَالَ رَبِّ نَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ﴾
‘‘এ খবর শুনতেই মূসা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে শহর থেকে বেরিয়ে পড়লো এবং সে বললো, হে আমার রব! আমাকে যালেমদের হাত থেকে বাঁচাও’’। (সূরা আল ক্বছাছ:২১)
উপরোক্ত তিন প্রকার ভয়ের মধ্যে প্রথমটি তথা গোপন ভয় সর্ববৃহৎ একটি ইবাদত। সুতরাং ইখলাসের সাথে এ শ্রেণীর ভয় কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করা আবশ্যক। এমনি দ্বিতীয় প্রকার ভয় ইবাদতের অন্যতম হক এবং সেটার পরিপূরক। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ﴾
‘‘এ হলো শয়তান, সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়। সূরা আলে ইমরান: ১৭৫ অর্থাৎ সে তার বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়।
﴿فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ﴾
‘‘সুতরাং তাদেরকে ভয় করো না; বরং আমাকেই ভয় করো।’’ সূরা আলে ইমরান: ১৭৫
আল্লাহ তা‘আলা এখানে মুমিনদেরকে তাকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করতে নিষেধ করেছেন এবং তাদের ভয়কে কেবল আল্লাহর সাথেই সীমিত রাখার আদেশ করেছেন। সুতরাং তারা যখন ইখলাসের সাথে আল্লাহকেই ভয় করবে এবং সকল প্রকার ইবাদত কেবল তার জন্যই সম্পন্ন করবে, তখন তিনি উদ্দেশ্য পূরণ করবেন এবং তাদেরকে ভয়-ভীতি হতে নিরাপত্তা দান করবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِن دُونِهِ﴾
‘‘আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? এসব লোক তোমাকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদের ভয় দেখায়’’। (সূরা আয যুমার: ৩৬)
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহর দুশমন ইবলীসের অন্যতম কৌশল হচ্ছে, সে মুমিন বান্দাদেরকে তার সৈনিক ও বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়। এভাবে ভয় দেখায়, তারা যেন তার দোসরদের বিরুদ্ধে জিহাদ না করে, তাদেরকে সুপথে আসার আদেশ না দেয় এবং অন্যায় কাজের প্রতিবাদ না করে। আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, এটি হচ্ছে শয়তানের কলাকৌশল। সে মুমিনদেরকে তার বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তার বন্ধুদেরকে ভয় করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং যখন বান্দার ঈমান শক্তিশালী হবে, তখন তার অন্তর থেকে শয়তানের বন্ধুদের ভয় দূর হয়ে যাবে। অপর দিকে যখনই তার ঈমান দুর্বল হবে, তখনই শয়তানের বন্ধুদের ভয় তার অন্তরে বৃদ্ধি পাবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ فَعَسَىٰ أُولَٰئِكَ أَن يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ﴾
‘‘তারাই হতে পারে আল্লাহর মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সেবক, যারা আল্লাহর প্রতি ও পরকালে প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না। তাদেরই ব্যাপারে আশা করা যেতে পারে যে, তারা সঠিক সোজা পথে চলবে’’। (সূরা তাওবা: ১৮)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহর ঘর মসজিদসমূহ কেবল তারাই আবাদ করবে, যারা অন্তর দিয়ে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি ঈমান আনয়নের সাথে সাথে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে আমল করে এবং ইখলাসের সাথে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই ভয় করে। মসজিদসমূহের তত্ত্বাবধানে মুশরিকদের অধিকার খর্ব করার পর আল্লাহ তা‘আলা সেটা মুমিনদের জন্য সাব্যস্ত করেছেন। কেননা মসজিদের তত্ত্বাবধান করার বিষয়টি এমন যে, আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করা ও সৎকাজে আত্মনিয়োগ করা ব্যতীত তা সম্পন্ন হয় না।
মুশরিকরা যদিও ভালো আমল করে, কিন্তু তাদের আমলগুলোর উপমা হলো পানিহীন মরু প্রান্তরের মরীচিকার মতো। তৃষ্ণার্ত পথিক তাকে পানি মনে করেছিল, কিন্তু ওখানে পৌঁছে সে কিছুই পেলো না অথবা তাদের আমলগুলো ঠিক ছাই এর মতো, যা ঝড়ের দিনে বাতাস প্রচ- বেগে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তারা নিজেদের কৃতকর্মের কোনই ফল লাভ করতে পারবে না।
যে আমলের অবস্থা ঠিক এ রকমই, সেটা থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। ইখলাসের উপর ভিত্তিশীল সৎআমল ও তাওহীদ ব্যতীত এবং শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার মুক্ত সহীহ আকীদা ব্যতীত মসজিদগুলোর সঠিক আবাদ হয় না। ইট, টালি ইত্যাদি দিয়ে জাঁকজমক ও সুসজ্জিত করে বড় আকারের মসজিদ বানালেই সেটা আবাদ হয়ে যায় না অথবা কবরের উপর মজবুতভাবে মসজিদ তৈরী করার মাধ্যমেই সেটা আবাদ হয় না। যারা এ কাজ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উপর লা’নত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ ‘‘আল্লাহ কে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না’’ সূরা আত তাওবা: ১৮
-ইবনে আতীয়া এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে তা’যীম, ইবাদত এবং আনুগত্যের ভয় উদ্দেশ্য। তবে মানুষ দুনিয়ার ক্ষয়-ক্ষতির যেসব আশঙ্কা করে তাতে কোনো দোষ নেই।
আমীর মুআবীয়া আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাছে একটি বার্তা লিখে তাতে কিছু উপদেশ প্রার্থনা করলেন। আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখলেন, তিনি যেন তার জন্য কিছু উপদেশ লিখে পাঠান এবং বেশী দীর্ঘ না করেন। সুতরাং তিনি এই চিঠি লিখলেন,
إِلَى مُعَاوِيَةَ سَلَامٌ عَلَيْكَ أَمَّا بَعْدُ فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ الْتَمَسَ رِضَا اللَّهِ بِسَخَطِ النَّاسِ كَفَاهُ اللَّهُ مُؤْنَةَ النَّاسِ وَمَنْ الْتَمَسَ رِضَا النَّاسِ بِسَخَطِ اللَّهِ وَكَلَهُ اللَّهُ إِلَى النَّاسِ وَالسَّلَامُ
‘‘মুআবীয়ার আমার এ পত্র। আপনার প্রতি সালাম। অতঃপর আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মানুষকে রাগান্বিত করে হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করে, তার জন্য মানুষের মুকাবেলায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ তাকে মানুষের কাছে সোপর্দ করে দেন। আপনার প্রতি সালাম’’। আবু নুআইম হিলইয়াতুল আওলীয়ায় এবং ইবনে হিববান তার সহীহ গ্রন্থে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তবে ইবনে হিববান ও আবু নুআইমের শব্দগুলো এ রকম,
مَنِ الْتَمَسَ رِضَا اللَّهِ بِسَخَطِ النَّاسِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ وَأَرْضَى عَنْهُ النَّاسَ وَمَنِ الْتَمَسَ رِضَا النَّاسِ بِسَخَطِ اللَّهِ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَسْخَطَ عَلَيْهِ النَّاسَ
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে নারাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহও অসন্তুষ্ট হন এবং মানুষকেও তার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দেন’’।[2]
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা মুআবীয়ার নিকট যে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন, তা মারফু হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। মারফু বর্ণনার শব্দগুলো ঠিক এ রকম,
مَنْ أَرْضَى اللَّهَ بِسَخَطِ النَّاس كَفَاهُ مَؤُنَةَ النَّاسَ ومَنْ أَرْضَى النَّاسَ بِسَخَطِ اللَّهِ لَمْ يَغْنُوا عَنْهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, তার জন্য মানুষের মুকাবেলায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করে মানুষেরা আল্লাহর মুকাবেলায় তার কোনো উপকারে আসবে না’’। আর মাউকুফ বর্ণনার শব্দগুলো হচ্ছে এ রকম,
من أرضى الله بسخط الناس رضي الله عنه وأرضى عنه الناس ومن أرضى الناس بسخط الله عاد حامده من الناس له ذاما
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, মানুষের মধ্য হতে তার প্রশংসাকারীরাই নিন্দুকে পরিণত হয়’’।
এটি দীনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে হলেও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবে, সে মুত্তাকী এবং আল্লাহর সৎ বান্দা হতে পারবে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন। বান্দার জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا (২) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ﴾
‘‘আর যে আল্লাহ্কে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক প্রদান করেন’’। (সূরা তালাক: ২-৩)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার উপর থেকে মানুষের কষ্ট দূর করবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর যারা আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে যায়, তাদের মনে রাখা উচিত যে সমস্ত মানুষ তার উপর সন্তুষ্ট নাও হতে পারে। তবে তারা যখন তার পক্ষ হতে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে, কোনো প্রকার অসুবিধা অনুভব করবে না এবং নিশ্চিতভাবে তার পক্ষ থেকে শুভ পরিণাম আশা করবে, তখন কেবল তারা সন্তুষ্ট থাকবে। এর ব্যতিক্রম ঘটলেই তারা অসন্তুষ্ট হবে ও বিদ্রোহ করবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী,
ومَنْ أَرْضَى النَّاسَ بِسَخَطِ اللَّهِ لَمْ يَغْنُوا عَنْهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, তার জন্য মানুষের মুকাবেলায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করে মানুষেরা আল্লাহর মুকাবেলায় তার কোনে উপকারে আসবে না’’।[3]
কিয়ামতের দিন যালেমরা রাগে-গোস্বায় তাদের হস্তদ্বয় কামড়াতে থাকবে। তারা বলবে, হায় আফসোস আমরা যদি রসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! হায় আফসোস! আমরা যদি অমুককে বন্ধু না বানাতাম!
যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, মানুষের মধ্য হতে তার প্রশংসাকারীরাই তার নিন্দুকে পরিণত হয়। এ রকমই হয়ে থাকে। কেননা যা আল্লাহর জন্য করা হয় সেটা স্থায়ী হয় আর যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য করা হয় তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্যই হয়ে থাকে। কিন্তু প্রথমেই সেটা তাদের মর্জি মোতাবেক অর্জিত হয় না। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার কথা এখানেই শেষ।
বিভিন্নভাবে বর্ণিত এ হাদীছে সুস্পষ্ট হয়ে গেল, যে ব্যক্তি তার কাজের মাধ্যমে মানুষকে অসন্তুষ্ট করে হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করবে সে দু’টি বড় ধরণের কল্যাণ অর্জন করবে। একটি হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি এবং অন্যটি মানুষের সন্তুষ্টি। বিপরীত পক্ষে যে ব্যক্তি তার কাজের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে নাখোশ করে মানুষের সন্তুষ্টি তালাশ করবে, সে দু’টি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং মানুষের অসন্তুষ্টি। এতে বুঝা গেল যে, আল্লাহ তা‘আলাকে সন্তুষ্টি করতে পারলেই সমস্ত কল্যাণ অর্জিত হয়। আল্লাহকে নাখোশ করে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে গেলেই সব ধরণের অকল্যাণ হয়। আমরা আল্লাহ তা‘আলার দয়া ও শান্তি কামনা করছি।
এখানে জেনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা‘আলার ভয়ের সাথে আশা-আকাঙ্খা ও ভালোবাসা মিশ্রিত হওয়া চাই। ভয় যেন এমন না হয়, বান্দা আল্লাহর রহমত থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হবে। মুমিন বান্দা ভয় ও আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আল্লাহর কাছে যাবে। সবসময় তার মনে আল্লাহর আযাবের ভয় এবং তার রহমতের আশা রাখবে। শুধু এমন ভয় নিয়ে আল্লাহর দিকে যাবে না যে, নিজেকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করবে। শুধু এমন আশা-আকাঙ্খা নিয়েও যাবে না যে, আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করবে। কেননা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া এবং তার পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করা তাওহীদের পরিপন্থী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَأَمِنُوا مَكْرَ اللَّهِ فَلَا يَأْمَنُ مَكْرَ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْخَاسِرُونَ﴾
তারা কি আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে? ক্ষতিগ্রস্থ সম্পদ্রায় ছাড়া আল্লাহর পাকড়াও থেকে কেউ নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবতে পারে না। (সূরা আল আরাফ: ৯৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَا تَيْأَسُوا مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ﴾
‘‘আল্লাহর রহমত থেকে তোমরা নিরাশ হয়ো না। তার রহমত থেকে তো একমাত্র কাফেররাই নিরাশ হয়’’। (সূরা ইউসুফ: ৮৭)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَمَنْ يَقْنَطُ مِنْ رَحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُّونَ﴾
‘‘একমাত্র পথভ্রষ্ট লোকেরা ব্যতীত স্বীয় রবের রহমত থেকে আর কে নিরাশ হতে পারে’’? (সূরা হিজর: ৫৬)
ইসমাঈল ইবনে রাফে রহিমাহুল্লাহ বলেন, বান্দা পাপ কাজের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকেও আল্লাহর ক্ষমার আশা করা তার পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করার আলামত। আলেমগণ বলেন, القنوط অর্থ হলো দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ দূর হওয়া অসম্ভব মনে করা। এটি আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করার বিপরীত। এই উভয় অবস্থাতেই বিরাট গুনাহ রয়েছে।
মুমিনদের জন্য শুধু ভয়ের উপর বিদ্যমান থাকা জায়েয নয়। এতে করে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনি শুধু আশা-আকাঙ্খার উপরও বিদ্যমান থাকা জায়েয নয়। এতে আল্লাহর আযাব হতে নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে। সুতরাং বান্দা একই সঙ্গে ভীত-সন্ত্রস্ত ও আশাবাদী থাকবে। আল্লাহর আযাবের ভয় করবে, তার আনুগত্য করবে এবং আল্লাহর রহমতের আশা করবে।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা আম্বীয়ার ৯০ নং আয়াতে বলেন,
﴿إِنَّهُمْ كَانُوا يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَيَدْعُونَنَا رَغَبًا وَرَهَبًا وَكَانُوا لَنَا خَاشِعِينَ﴾
‘‘তারা সৎকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তারা আশা-আকাঙ্খা ও ভয়-ভীতি সহকারে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত’’।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا﴾
‘‘এ সব লোকেরা যাদেরকে ডাকে তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় উসীলার অনুসন্ধান করে, তাদের মধ্য হতে কে সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী? তারা তার রহমতের আশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয় তোমার পালনকর্তার শাস্তি ভয়াবহ’’। (সূরা ইসরা: ৫৭)
সুতরাং ভয়-ভীতি ও আশা-আকাঙ্খা যখন একত্রিত হবে, তখন ভয় মিশ্রিত আশা বান্দাকে আমলের দিকে ধাবিত করে এবং উপকারী মাধ্যম গ্রহণ করার প্রতি উৎসাহ যোগায়। কেননা বান্দা আল্লাহর রহমত ও ছাওয়াবের আশা নিয়ে সৎকাজ সম্পন্ন করে এবং আল্লাহর আযাবের ভয়ের কারণেই বান্দা পাপাচার ও নাফরমানী ছেড়ে দেয়। কিন্তু বান্দা যখন আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবে, তখন সৎ আমল ছেড়ে দিবে আর যখন আল্লাহর আযাব ও শাস্তি থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে, তখন পাপাচারের দিকে ধাবিত হবে। কোনো কোনো আলেম বলেন, যে ব্যক্তি শুধু ভালোবাসা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে সুফী বলে গণ্য হবে। যে ব্যক্তি শুধু ভয় নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে খারেজী। যে শুধু আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে মুর্জীয়া। আর যে ভালোবাসা, ভয়-ভীতি, এবং আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সেই প্রকৃত মুমিন।
আল্লাহ তা‘আলা তার সর্বোত্তম বান্দাকে উপরোক্ত বিশেষণে বিশেষিত করেছেন,
﴿أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ﴾
‘‘এ সব লোক যাদেরকে ডাকে তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় উসীলার অনুসন্ধান করে, তাদের মধ্য হতে কে সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী? তারা তার রহমতের আশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে’’। (সূরা ইসরা: ৫৭)
যারা ভয়ের দিকটির প্রতি অবহেলা করে পাপাচারের দিকে ধাবিত হয় এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা এভাবে বিশেষিত করেছেন যে, তারাই ক্ষতিগ্রস্থ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَأَمِنَ أَهْلُ الْقُرَىٰ أَن يَأْتِيَهُم بَأْسُنَا بَيَاتًا وَهُمْ نَائِمُونَ أَوَأَمِنَ أَهْلُ الْقُرَىٰ أَن يَأْتِيَهُم بَأْسُنَا ضُحًى وَهُمْ يَلْعَبُونَ أَفَأَمِنُوا مَكْرَ اللَّهِ فَلَا يَأْمَنُ مَكْرَ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْخَاسِرُونَ﴾
‘‘জনপদের লোকেরা কি ভয় করে না যে, আমার শাস্তি তাদের উপর আসবে রাত্রিকালে যখন তারা থাকবে নিদ্রামগ্ন? অথবা জনপদবাসী কি নির্ভয় হয়ে গেছে যে, আমার শাস্তি তাদের উপর এসে পড়বে দিনের প্রথম ভাগে, যখন তারা খেলা ধুলায় মেতে থাকবে? তারা কি আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে? ক্ষতিগ্রস্থ সম্পদ্রায় ছাড়া আল্লাহর পাকড়াও থেকে কেউ নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবতে পারে না’’। (সূরা আরাফ: ৯৭-৯৯)
আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা হলো, আল্লাহ তা‘আলা রসূলদের প্রতি অবিশ্বাসী, কুফুরী ও পাপাচারে সীমালংঘনকারী জনপদবাসীদের অবস্থা বর্ণনা করার পর বলেছেন যে, আল্লাহর ধরপাকড় থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করা এবং তার শাস্তির ভয় না করাই তাদেরকে উপরোক্ত পাপাচারের দিকে ধাবিত করেছে। আল্লাহ তা‘আলার কৌশল হলো, বান্দা যখন তার অবাধ্য হয় ও তাকে ক্রোধান্বিত করে তিনি তখন বান্দাকে অনেক নিয়ামত দান করেন। বান্দা এতে মনে করে আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন। অথচ এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ হতে তাকে অবকাশ দেয়া মাত্র। কাফেররা যখন আল্লাহর নিয়ামত ও সুখ-শান্তি পেয়ে নিজেদেরকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ মনে করেছে এবং তাদের কাছে প্রেরিত রসূলদের অবাধ্য হয়েছে ও পাপাচারে সীমালংঘন করেছে তখন তিনি তাদেরকে ধ্বংস করেছেন।
তাদের পরে আগমনকারীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সতর্ক করেছেন। তারা যেন পূর্বেকার সীমালংঘনকারী জাতির মত অপরাধ করে তাদের মতো আযাবের কবলে না পড়ে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَوَلَمْ يَهْدِ لِلَّذِينَ يَرِثُونَ الْأَرْضَ مِن بَعْدِ أَهْلِهَا أَن لَّوْ نَشَاءُ أَصَبْنَاهُم بِذُنُوبِهِمْ وَنَطْبَعُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ﴾
‘‘পৃথিবীর কোনো অংশের অধিবাসীদের ধ্বংসের পর যারা তার উত্তরাধিকারী হয়েছে, তাদের নিকট এটা কি প্রতিয়মান হয়নি যে, আমি চাইলে তাদের অপরাধের কারণে তাদেরকে পাকড়াও করতে পারি এবং আমি তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিতে পারি। ফলে তারা কিছুই শুনবে না’’। (সূরা আরাফ: ১০০)
কতিপয় আলেম বলেন, নিম্নের বিষয়গুলো বান্দার অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে।
(১) অপরাধ ও সেটার কদর্যতা সম্পর্কে জানা।
(২) পাপাচারীদের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত শাস্তির প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং এটি অবগত হওয়া যে আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক পাপাচারের শাস্তি নির্ধারণ করেছেন।
(৩) বান্দার অন্তরে এ অনুভূতি জাগ্রত হওয়া যে, পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তির তাওবা করার সুযোগ নাও হতে পারে এবং পাপাচারে লিপ্ত হলে তার মাঝে ও তাওবার মাঝে আবরণ পড়ে যেতে পারে। পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে এ তিনটি বিষয় বান্দার অন্তরে ভয় ঢুকায়। আর পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার পর এ তিনটি বিষয় বান্দার অন্তরে আরো প্রবলভাবে ভয়ের সঞ্চার করে।
নবী-রসূলদের অবস্থা এমন ছিল যে, তারা কখনো আল্লাহর উপর আশা-ভরসা বর্জন করতেন না এবং কোনো অবস্থাতেই তারা তার রহমত ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হতেন না। বিপদাপদ যতই প্রকট আকার ধারণ করতো এবং উপায়-উপকরণ যতই দুর্বল হতো কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর প্রতি আশা-আকাঙ্খা ছেড়ে দিতেন না।
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হওয়া এবং তার স্ত্রী সন্তান প্রসবের বয়স পার হয়ে যাওয়ার পর তাকে যখন ফেরেশতারা সন্তানের সুখবর দিল তখন তিনি বলেছিলেন,
وَمَنْ يَقْنَطُ مِن رَّحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُّونَ
‘‘একমাত্র পথভ্রষ্ট লোকেরা ব্যতীত স্বীয় রবের রহমত থেকে আর কে নিরাশ হতে পারে?’’ (সূরা হিজর: ৫৬)
কেননা তিনি আল্লাহ তা‘আলার কুদরত ও রহমত সম্পর্কে অবগত ছিলেন, যা বৃদ্ধ বয়সে সন্তান দেয়ার চেয়ে অধিক পূর্ণাঙ্গ। তবে ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেন,
﴿أَبَشَّرْتُمُونِي عَلَىٰ أَن مَّسَّنِيَ الْكِبَرُ فَبِمَ تُبَشِّرُونَ﴾
‘‘তোমরা কি বৃদ্ধ অবস্থায় আমাকে সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছো? অতএব আমাকে তোমরা কিসের সুসংবাদ দিচ্ছো?। (সূরা হিজর: ৫৪)
বিস্ময় প্রকাশ করতে গিয়ে এবং আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা ও রহমতের বিশালতায় চিন্তামগ্ন হয়েই তিনি একথা বলেছিলেন।
আল্লাহর নবী ইয়াকুব আলাইহিস সালাম যখন দুঃখ-কষ্টে আক্রান্ত হলেন এবং পুত্রের বিচ্ছেদে যখন তার অবস্থা সঙ্কটময় হলো, তখনো তিনি আল্লাহর প্রতি বড় আশা পোষণ করতেন এবং রহমত পাওয়ার কামনা করতেন। তিনি তার নিকট পুত্রদেরকে এনে বললেন,
﴿يَا بَنِيَّ اذْهَبُوا فَتَحَسَّسُوا مِن يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلَا تَيْأَسُوا مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ﴾
‘‘হে আমার ছেলেরা! তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাও। আল্লাহর রহমত থেকে তোমরা নিরাশ হয়ো না। তার রহমত থেকে তো একমাত্র কাফেররাই নিরাশ হয়’’। (সূরা ইউসুফ: ৮৭)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَصَبْرٌ جَمِيلٌ عَسَى اللَّهُ أَن يَأْتِيَنِي بِهِمْ جَمِيعًا﴾
‘‘পূর্ণ সবরই শ্রেয়। হয়তো আল্লাহ ওদের সবাইকে আমার কাছে এনে দিবেন’’। (সূরা ইউসুফ: ৮৩)
আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে আল্লাহ আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا﴾
‘‘যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তাহলে মনে রেখো আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন, যখন তাকে কাফেররা বহিস্কার করেছিল। তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন: বিষন্ন হয়ো না আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (সূরা তাওবা: ৪০)
সুতরাং কঠিন বিপদের সময় তিনি আল্লাহর কাছেই আশা পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন,اعلم أن الفرج مع الكرب ‘‘জেনে রেখো, সংকীর্ণতার পরেই প্রশস্ততা’’।
আল্লাহ তা‘আলার যেসব বান্দা অনেক গুনাহ করেছে এবং যারা ভয়াবহ অপরাধ করেছে তিনি তাদেরকে নিষেধ করেছেন যে, তাদের গুনাহ ও অপরাধসমূহ যেন তাদেরকে আল্লাহর রহম থেকে নিরাশ না করে এবং তাওবা পরিত্যাগ করার প্ররোচনা না দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ ياَ عِباَدِيَ الَّذِيْنَ أسْرَفُوْا عَلىَ أنْفُسِهِمْ لاَتَقْنَطُوْا مِنْ رَحْمَةِ اللهِ إنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعاً إنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ وَأَنِيبُوا إِلَىٰ رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ﴾
‘‘হে নবী! বলে দাও, হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তোমরা ফিরে এসো তোমাদের রবের দিকে এবং তার অনুগত হয়ে যাও তোমাদের উপর আযাব আসার পূর্বেই। অতঃপর তা এসে গেলে তোমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবেনা’’। (সূরা আয যুমার: ৫৩-৫৪)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে নিষেধ করেছেন, তার গুনাহর বোঝা তাদেরকে যেন তাওবা পরিত্যাগ না করায় এবং আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্তির আশা থেকে নিরাশ না করে।
আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়াকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবীরা গুনাহর মধ্যে গণনা করেছেন। ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, কবীরা গুনাহ হচ্ছে,
الْكَبَائِرُ الشِّرْكُ بِاللَّهِ وَالْيَأْسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ وَالْقَنُوطُ مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ وَالأَمْنُ مِنْ مَكْرِ اللَّهِ
‘‘আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া এবং আল্লাহর দয়া থেকে নিজেকে দূরে মনে করা এবং তার পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করা’’।[4]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,
أَكْبَرُ الْكَبَائِرِ الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَالأَمْنُ لِمَكْرِ اللَّهِ وَالْقَنُوطُ مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ وَالْيَأْسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ
সবচেয় বড় কবীরাহ গুনাহ হচ্ছে, আল্লাহর শাস্তি হতে নিরাপদ মনে করা, আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হওয়া এবং আল্লাহর করুণা থেকে নিজেকে বঞ্চিত মনে করা।[5]
চলমান...
আলেম, দাঈ ও সাধারণ মুসলিমগণ যেভাবে দিন দিন সত্য বলা থেকে পিছিয়ে আসছে, হিকমতের দোহাই দিয়ে যেভাবে মুখ বন্ধ করে রাখা হচ্ছে, তাতে ইসলাম ও মুসিলমদের সুবিধা হওয়ার বদলে অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই হিকমতের দোহাই দিয়ে সকল ক্ষেত্রেই হক বলা বর্জন করলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। মানুষের ভয়ে কিংবা পার্থিব স্বার্থ ছুটে যাওয়ার ভয়ে সত্য বলা পরিত্যাগ করার ভয়াবহ পরিণতির বিষয়টি কুরআনের অনেক আয়াত ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক সহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴾ وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ﴿‘‘আহলে কিতাবদের সেই অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দাও, যা আল্লাহ তাদের থেকে নিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিল, তোমরা কিতাবের শিক্ষা মানুষের মধ্যে প্রচার করবে, তা গোপন করতো পারবে না’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৮৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
‘‘বনী ইসরাঈল জাতির মধ্য থেকে যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তাদের উপর দাউদ ও মারইয়াম পুত্র ঈসার মুখ দিয়ে অভিসম্পাত করা হয়েছে। কারণ তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং পাপাচারে সীমালংঘন করেছিল। তারা পরস্পরকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা পরিহার করেছিল, তাদের গৃহীত সেই কর্ম ছিল বড়ই জঘণ্য’’। (সূরা মায়িদা: ৭৯-৮০)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, لَا يَمْنَعَنَّ رَجُلًا هَيْبَةُ النَّاسِ أَنْ يَقُولَ بِحَقٍّ إِذَا عَلِمَهُ ‘‘কেউ যখন সত্য জানতে পারবে তখন মানুষের ভয় যেন তাকে সত্য বলতে বারণ না করে’’। তিরমযী, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহিমাহুল্লাহ আরো বাড়িয়ে বলেন যে, فإنه لا يُقرِّب من أَجَلٍ ذلك ولا يُبَاعد من رِزْقٍ ‘‘কেননা সত্য বলা মানুষকে মৃত্যুর নিকটবর্তী করে দেয় না এবং রিযিক থেকেও দূরে সরিয়ে দেয় না’’।
সুতরাং আমরা সুস্পষ্ট করে সত্য বলতে চাই। সাধ্যানুসারে ইসলামের পক্ষে কথা বলতে চাই। এ ব্যাপারে আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করি না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য যা নাযিল করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্য যে সুন্নাত রেখে গেছেন, আমরা মানুষের কাছে তা নির্ভয়ে বর্ণনা করতে চাই।
একই সময়ে আমরা ঐসব নব্য মূর্তিপূজা, নতুন নতুন শিরক ও সকল প্রকার অশ্লীলতা, বেহায়াপনা এবং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ বিধ্বংসী বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চাই, যা নাস্তিক ও মুশরিকদের অন্ধ অনুসরণ করে আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা কুরআনের পক্ষে কথা বলতে চাই। মুসলিমদের সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষা করতে চাই।
এ মুহূর্তে প্রত্যেক মুমিন নর-নারী, আলেম ও দাঈদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা উচিৎ। আমরা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবো না। সত্য বললেই জান মালের ক্ষতি হবে এবং পার্থিব স্বার্থ নষ্ট হবে, -এ ভয়ে আমরা সত্য বলা হতে মোটেই পিছপা হতে পারি না। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সবকিছুই আল্লাহর হাতে।
আলেমগণ বলেছেন, শারীরিক ও মানসিক সামান্য কষ্ট এবং পার্থিব ভোগবিলাস ও স্বার্থ ছুটে যাওয়ার সন্দেহ হলেই সত্য বলা পরিত্যাগ করা নিষিদ্ধ। হত্যার আশঙ্কার বিষয়টি ভিন্ন। তাও আবার সাধারণ মুসলিমদের ক্ষেত্রে। তবে যারা জাতীয় পর্যায়ের আলেম ও দাঈ তাদের জন্য কোনো অবস্থাতেই সত্য গোপন করা জায়েন নেই। আল্লাহর জন্য তারা যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করবেন। আমাদের সামনে চার মাযহাবের চারজন বিজ্ঞ ইমাম, ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ এবং ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবসহ আরো বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। তারা সত্য বলার ক্ষেত্রে জান-মালসহ কোনো কিছুরই ভয় করেননি। আল্লাহর রহমতে অতঃপর তাদের ত্যাগের কারণে ইসলাম আজ পর্যন্ত টিকে রয়েছে। আশা করি আমাদের আলেমগণ সালাফে সালেহীনদের পথেই চলবেন।
সুতরাং মুসলিম যুবক-যুবতীদের বিবেক-বুদ্ধি ও অন্তরকে শিরক, কুফরী এবং ইউরোপ-আমেরিকা ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের অপসংস্কৃতি, নোংরামি ও কুসংস্কার থেকে পবিত্র রেখে তাতে ইসলামের আলো জ্বালিয়ে রাখার গুরু দায়িত্ব পালন করতে আলেমদের অবহেলা, জান-মাল ও ইজ্জতের ভয়ে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলকে যখন হত্যা করার জন্য তারতুসে অবস্থানরত খলীফা মামুনের দরবারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ইমাম আহমাদের অন্যতম সাথী আবু জা’ফর আলআন্বারী ফুরাত নদী পার হয়ে ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন। ইমাম তাকে দেখে বললেন: হে আবু জা’ফর! এত কষ্ট করে আমার সাথে দেখা করতে আসার কী প্রয়োজন ছিল? জবাবে আবু জা’ফর বললেন: ওহে আহমাদ! শুন! তুমি আজ মানুষের নয়ন মনি, তুমি সকলের মাথা! মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা তোমার অনুসরণ করবে। আল্লাহর কসম! তুমি যদি কুরআকে মাখলুক বলো, তাহলে আল্লাহর বান্দারা তাই বলবে। আর তুমি যদি তা বলতে অস্বীকার করো, তাহলে অগণিত মানুষ কুরআনকে মাখলুক বলা হতে বিরত থাকবে। হে বন্ধু! ভাল করে শুন। খলীফা যদি তোমাকে এইবার হত্যা নাও করে, তাহলে তুমি একদিন মৃত্যু বরণ করবে। মরণ একদিন আসবেই। সুতরাং তুমি আল্লাহকে ভয় করো। খলীফার কথায় তুমি কুরআনকে সৃষ্টি বলতে যেয়ো না।
কথাগুলো শুনে ইমাম আহমাদ কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন: ما شاء الله আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তাই হবে। অতঃপর তিনি বললেন, হে আবু জা’ফর! কথাগুলো তুমি আরেকবার বলো। আবু জা’ফর কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন। এবারও ইমাম কাঁদলেন এবং বললেন, ما شاء الله।
আমরা আশা করি বিলম্বে হলেও সত্যের এ দুর্বল আওয়াজ প্রতিটি মুসলিমের কানে পৌঁছবে এবং তাদেরকে জাগ্রত করবে।
[2]. ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন: শারহুল আকীদা আল ওয়াসেতীয়াহ, হা/৩০৪।
[3]. সহীহ: সুনানে তিরমিযী হা/২৪১৪
[4]. আল মু‘জামুল কাবির, ত্ববারানী ৮৭৮৩।
[5]. হাদীছটি মাওকুফ সূত্রে সহীহ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে হাদীছটি একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। দেখুন: মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক (১০/৪৫৯), তাফসীরে তাবারী, হা/৬১৯১ এবং তাবরানী আল কাবীর হা/৮৭৮৩ এবং অন্যান্য।
আগের পাতার শেষ অংশ..
কেননা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হওয়া তার সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করা এবং তার রহমতের প্রশস্ততা ও তার ক্ষমার বিশালতা সম্পর্কে অজ্ঞতার অন্তুর্ভুক্ত। আর আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করা আল্লাহর ক্ষমতা সম্পর্কে বান্দার অজ্ঞতার প্রমাণ। সেই সঙ্গে তার নফসের উপর নির্ভর করা অহংকারের মধ্যে শামিল।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছগুলোর মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে যে, বান্দা সবসময় ভয় ও আশার মধ্যে থাকবে। সে যখন আল্লাহকে ভয় করবে, তখন তার ভয় যেন তাকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না করে এবং সে যেন হতাশাগ্রস্থ না হয়। বরং ভয় করার সাথে সাথে আল্লাহর রহমত কামনা করবে। আর যখন সে আল্লাহর রহমতের আশা করবে, তখন সে যেন তাতে এভাবে সীমা লংঘন না করে যে সে আল্লাহর শাস্তি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করে।
কোনো কোনো সালাফ সুস্থ ও সুখে থাকা অবস্থায় বান্দার মধ্যে ভয়ের দিকটা বেশি থাকা পছন্দ করতেন। আর অসুস্থ অবস্থায় এবং মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে আল্লাহর ক্ষমা ও রহমতের আশা-আকাঙ্খার দিকটাকে প্রাধান্য দেয়া মুস্তাহাব মনে করতেন।
সুতরাং অন্তরের মধ্যে ভয়-ভীতি ও আশা-আকাঙ্খার ভারসাম্য বজায় থাকা মানুষকে আমলের প্রতি উৎসাহিত করে, পাপাচার থেকে দূরে রাখে এবং তাওবার দিকে ধাবিত করে। আর যখন অন্তরের মধ্যে উপরোক্ত দু’টি বিষয়ের মধ্যকার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়, তখন অন্তর একদিকে ঝুকে পড়ে। আর এটি আমলের প্রতি অন্তরের আগ্রহকে অকেজো করে দেয়, তাওবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে এবং বান্দাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
পূর্ববর্তী যেসব জাতি তাদের অন্তর থেকে আল্লাহর ভয়-ভীতি মুছে ফেলার কারণে শাস্তির সম্মুখীন হয়েছিল, তাতে ঈমানদারদের জন্য সর্বোত্তম উপদেশ রয়েছে। আল্লাহ তাদের ঘটনাবলী কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করেছেন।
হুদ আলাইহিস সালামের জাতি হুদকে বলেছিল,
﴿سَوَاءٌ عَلَيْنَا أَوَعَظْتَ أَمْ لَمْ تَكُن مِّنَ الْوَاعِظِينَ إِنْ هَٰذَا إِلَّا خُلُقُ الْأَوَّلِينَ وَمَا نَحْنُ بِمُعَذَّبِينَ فَكَذَّبُوهُ فَأَهْلَكْنَاهُمْ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً وَمَا كَانَ أَكْثَرُهُم مُّؤْمِنِينَ﴾
তুমি উপদেশ দাও অথবা না দাও, উভয়ই আমাদের জন্য সমান। এ ব্যাপারগুলো তো পূর্বপুরুষদের রীতিনীতি মাত্র। আমরা আযাবের শিকার হবো না। শেষ পর্যন্ত তারা তাকে মিথ্যা জ্ঞান করলো এবং আমি তাদেরকে ধ্বংস করে দিলাম। নিশ্চয় এর মধ্যে আছে একটি নিদর্শন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাস করে না’’। (সূরা শুআরা: ১৩৬-১৪৯)
সুতরাং ভয়-ভীতি ও আশা-আকাঙ্খা ইবাদতের বিরাট একটি প্রকার। অতএব এ দু’টির মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার জন্য ইখলাস থাকা জরুরী। এতে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তাওহীদ ত্রুটিযুক্ত হবে এবং ইবাদত নষ্ট হয়ে যাবে।[6]
[6]. ইমাম আবু আলী রুযবারী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহর আযাবের ভয় করা এবং তার রহমতের আশা রাখা একটি পাখির দু’টি ডানার ন্যায়। যখন পাখা দু’টি এক সমান থাকে তখন পাখি আকাশে স্থির থাকে এবং পাখিটি সোজাভাবে চলতে পারে। একটি পাখা ত্রুটিযুক্ত হলে পাখির চলার মধ্যে ত্রুটি চলে আসে। আর যখন উভয় পাখাই চলে যায়, তখন পাখিটি মারা যায়। যারা আল্লাহর আযাবের ভয় করে এবং তার রহমতের আশা রাখে তাদের প্রশংসায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَمْ مَنْ هُوَ قَانِتٌ آَنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآَخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ﴾
‘‘যে ব্যক্তি রাত্রিকালে সিজদার মাধ্যমে অথবা দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, পরকালের ভয় করে এবং তার পালনকর্তার রহমত প্রত্যাশা করে, সে কি তার সমান, যে এরূপ করে না? (সূরা যুমার: ৯)
ইতিপূর্বে আমরা বলেছি যে, বান্দার মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার যে ভয়-ভীতি বিদ্যমান থাকে সেটার সাথে তার ভালোবাসা মিশ্রিত হওয়া চাই। কেননা শুধু ভয় নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করা খারেজীদের দীনের মূল বিষয়।
সুতরাং ভালোবাসা হলো ইসলামের মূল বিষয়। এটিই ইসলামের কেন্দ্র বিন্দু। অতএব আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালোবাসার পূর্ণতা অনুপাতেই তার দীন পরিপূর্ণ হয়ে থাকে এবং ভালোবাসার ঘাটতি অনুযায়ীই মানুষের তাওহীদ ত্রুটিযুক্ত হয়।
ভালোবাসা বলতে এখানে ইবাদতের ভালোবাসা উদ্দেশ্য, যা নত হওয়া, বিনয়ী হওয়া এবং পরিপূর্ণ আনুগত্যের দাবি করার সাথে সাথে স্বীয় প্রিয়পাত্রকে অন্যের উপর প্রাধান্য দেয়ারও দাবি জানায়। এ ভালোবাসাটি আল্লাহ তা‘আলার জন্য খালেস বা নির্দিষ্ট হওয়া চাই। এতে আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা জায়েয নয়। কেননা ভালোবাসা দু’প্রকার।
(ক) একক ও খাস ভালোবাসা: এটি হচ্ছে ইবাদতের ভালোবাসা, যা পরিপূর্ণরূপে নত হওয়া এবং পরিপূর্ণরূপে মাহবুবের অনুগত থাকার দাবি করে। এ শ্রেণীর ভালোবাসা কেবল আল্লাহ তা‘আলার জন্য নির্দিষ্ট।
(খ) সাধারণ ও যৌথ ভালোবাসা: এটি তিন প্রকার। প্রথমটি হচ্ছে স্বভাবগত ও সৃষ্টিগত ভালোবাসা। যেমন খাবারের প্রতি ক্ষুধার্ত লোকের ভালোবাসা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে মায়া-মমতার ভালোবাসা। যেমন সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা। তৃতীয়টি হচ্ছে, পরিচিতি ও সাহচর্যের ভালোবাসা। যেমন এক অংশীদার অন্য অংশীদারকে এবং এক বন্ধু অন্য বন্ধুকে ভালোবাসে।
এ তিন প্রকার ভালোবাসার মধ্যে সম্মান প্রদর্শন করা ও নত হওয়া আবশ্যক নয় এবং এর জন্য কাউকে পাকড়াও করা হবে না। তা ছাড়া এটি খাস ভালোবাসার সাথে সাংঘর্ষিকও নয়। সেগুলো কারো মধ্যে থাকলে শিরকও হয় না। কিন্তু খাস বা একক ভালোবাসাকে এগুলোর উপর অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। একক ও খাস ভালোবাসা দ্বারা ইবাদতের ভালোবাসা উদ্দেশ্য। এ ভালোবাসার কথা নিম্নের আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারার ১৬৫ নং আয়াতে বলেন,
﴿ وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ﴾
‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে আল্লাহর অংশীদার বা সমতুল্য হিসাবে গ্রহণ করে এবং তাদেরকে এমন ভালোবাসে যেমন আল্লাহকে ভালোবাসা উচিত। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা ওদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী। যালেমরা যখন কোনো শাস্তি প্রত্যক্ষ করে তখন যদি অনুধাবন করতো যে, সমস্ত ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর এবং শাস্তি দানে আল্লাহ অত্যন্ত কঠোর তাহলে কতই না ভালো হতো’’।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে আল্লাহর ভালোবাসার মতই ভালোবাসবে, সে ঐ ব্যক্তির মতো হবে, যে ভালোবাসা ও তা’যীমের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যদেরকে তার শরীক হিসাবে গ্রহণ করেছে।
ইমাম ইবনে কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে মুশরিকদের দুনিয়ার অবস্থা বর্ণনা করেছেন এবং আখিরাতে তাদের যে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি রয়েছে তাও উল্লেখ করেছেন। কেননা তারা আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করেছে। তারা তাদের সাথে ঐরূপ ভালোবাসা পোষণ করে, যেরূপ ভালোবাসা আল্লাহর সাথে হওয়া উচিত। অর্থাৎ তারা ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে তাদেরকে আল্লাহর সমান করে ফেলে।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ এর উপরোক্ত কথাকে সমর্থন করেছেন। ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে তারা যে তাদের মাবুদদেরকে আল্লাহর সমান করে ফেলতো, সে কথা আল্লাহ তা‘আলা তার নিম্নের বাণীতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,
﴿تَاللَّهِ إِن كُنَّا لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ إِذْ نُسَوِّيكُم بِرَبِّ الْعَالَمِينَ﴾
‘‘আল্লাহর কসম আমরা তো স্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে ছিলাম, যখন আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টিজগতের প্রতিপালকের সমকক্ষ গণ্য করতাম’’। (সূরা শুআরা: ৯৭-৯৮)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ثُمَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِرَبِّهِمْ يَعْدِلُونَ﴾
অতঃপর কাফেররা অন্যদেরকে তাদের রবের সমকক্ষ দাঁড় করাচ্ছে। সূরা আনআম:১
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ ‘‘যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা ওদের তুলনায় অধিক শক্তিশালী’’।
অর্থাৎ মুশরিকরা আল্লাহকে যে পরিমাণ ভালোবাসে, মুমিনগণ তাকে তাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। অথবা মুশরিকরা তাদের শরীকদেরকে যে পরিমাণ ভালোবাসে, মুমিনগণ আল্লাহ তা‘আলাকে তারচেয়ে বহুগুণ বেশি ভালোবাসে। সুতরাং আয়াতটি প্রমাণ করে, যে ব্যক্তি কোনো কিছুর প্রতি ঐরূপ ভালোবাসা পোষণ করে, যেরূপ ভালোবাসা আল্লাহর জন্য হওয়া বাঞ্চনীয় সে সেটাকে ভালোবাসা ও সম্মানের ক্ষেত্রে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করলো।
শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি কোনো শরীক গ্রহণ করলো এবং সেটাকে আল্লাহর ভালোবাসার সমান ভালোবাসলো, এ ক্ষেত্রে সে আল্লাহ সাথে বড় শির্কে লিপ্ত হলো।
আমাদের কথাও শাইখের কথার কাছাকাছি। আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ইবাদতের যে ভালোবাসা পোষণ করা আবশ্যক, তাকে ঐসব ভালোবাসার উপর প্রাধান্য দেয়া উচিত, যা ইবাদতের ভালোবাসা নয়। সেগুলো হচ্ছে সাধারণ ভালোবাসা যেমন পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার পারস্পরিক ভালোবাসা, ধন-সম্পদের ভালোবাসা ইত্যাদি। যারা এসব কিছুর ভালোবাসাকে আল্লাহর ভালোবাসার উপর প্রাধান্য দিবে, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কঠিন শাস্তির ধমক দিয়েছেন।
সূরা তাওবার ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ﴾
‘‘বলো, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা, যা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করো এবং তোমাদের বাসস্থান, যাকে তোমরা পছন্দ করো, এসব কিছু আল্লাহ, তার রসূল ও তার পথে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা করো আল্লাহর আদেশ আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না’’।
এ আটটি প্রিয় বস্ত্তকে যারা আল্লাহর ভালোবাসা, রসূলের ভালোবাসা এবং আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় আমলের উপর প্রাধান্য দিবে, তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা ভয়াবহ শাস্তির ধমক দিয়েছেন। এসব জিনিসকে গ্রহণ করার কারণেই তিনি ধমক দেননি। কেননা এগুলো এমন জিনিস, যার প্রতি ভালোবাসা দিয়েই মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এগুলো মানুষ স্বীয় ইচ্ছায় নির্বাচন করে না।
আল্লাহ তা‘আলা কেবল ঐসব লোককেই ধমক দিয়েছেন, যারা আল্লাহর ভালোবাসা, রসূলের ভালোবাসা এবং আল্লাহ ও তার রসূলের পছন্দনীয় আমলের উপর এগুলোর ভালোবাসাকে প্রাধান্য দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বান্দা থেকে যেসব আমল পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন সেটাকে বান্দার প্রিয় ও পছন্দনীয় জিনিষের উপর প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক।
(১) যে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসে সে অবশ্যই নিজের নফসের প্রবৃত্তি, চাহিদা, প্রিয় বস্ত্ত, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি এবং জন্মভূমির ভালোবাসার উপর আল্লাহ তা‘আলার পছন্দনীয় আমলকে প্রাধান্য দিবে।
(২) যে ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসে সে অবশ্যই তার রসূলের সুন্নাতের অনুসরণ করবে। রসূল যা আদেশ করেন, সে তা বাস্তবায়ন করবে এবং যা থেকে নিষেধ করেছেন, সেটা বর্জন করবে।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ﴾
‘‘বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাক তাহলে আমাকে অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। বলো, তোমরা আল্লাহ ও রসূলের অনুগত হও। কিন্তু তারা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে ভালোবাসেন না’’। (সূরা আলে-ইমরান: ৩১-৩২)
কতিপয় সালাফ থেকে বর্ণিত হয়েছে, একদল লোক দাবি করলো যে, তারা আল্লাহকে ভালোবাসে। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করলেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ قُلْ أَطِيعُوا اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ الْكَافِرِينَ﴾
‘‘বলো, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবেসে থাক তাহলে আমাকে অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’’। (সূরা আলে-ইমরান: ৩১)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসার দলীল-প্রমাণ, ফলাফল এবং উপকারিতা বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসার দলীল-প্রমাণ ও আলামত হলো রসূলের অনুসরণ করা এবং তার ফলাফল ও উপকারিতা হলো আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা ও তার ক্ষমা পাওয়া।
(৩) আল্লাহ তা‘আলার প্রতি বান্দার ভালোবাসা সত্য হওয়ার আলামত সম্পর্কে তিনি বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا مَن يَرْتَدَّ مِنكُمْ عَن دِينِهِ فَسَوْفَ يَأْتِي اللَّهُ بِقَوْمٍ يُحِبُّهُمْ وَيُحِبُّونَهُ أَذِلَّةٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ أَعِزَّةٍ عَلَى الْكَافِرِينَ يُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَخَافُونَ لَوْمَةَ لَائِمٍ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ وَاللَّهُ وَاسِعٌ عَلِيمٌ﴾
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি তার দীন থেকে ফিরে যায়, তাহলে আল্লাহ আরো এমন বহু লোক সৃষ্টি করবেন, যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালোবাসবে, যারা মুমিনদের ব্যাপারে কোমল ও কাফেরদের ব্যাপারে কঠোর হবে, যারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে এবং কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। এটি আল্লাহর অনুগ্রহ, যাকে ইচ্ছা তিনি সেটা দান করেন। বস্তুত আল্লাহ প্রাচুর্যময় এবং সর্ব বিষয়ে অবগত’’। (সূরা আল মায়িদা: ৫৪)
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ভালোবাসার চারটি আলামত উল্লেখ করেছেন।
প্রথম আলামত: যারা আল্লাহকে ভালোবাসে তারা মুমিনদের প্রতি কোমল ও দয়ালু হবে। তারা তাদের মুমিন ভাইদের প্রতি কোমল হবে, তাদের উপর দয়া করবে এবং তাদের প্রতি সহানুভুতি প্রদর্শন করবে। আতা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, পিতা যেমন পুত্রের প্রতি স্নেহশীল হয়, তারা মুমিনদের প্রতিও অনুরূপ হবে।
দ্বিতীয় আলামত: তারা কাফেরদের বিরুদ্ধে কঠোর হবে। অর্থাৎ তারা কাফেরদের প্রতি কঠোরতা প্রদর্শন করবে এবং তারা নিজেদেরকে কাফেরদের উর্ধ্বে মনে করবে। তারা কোনোভাবেই কাফেরদের প্রতি নতি স্বীকার করবে না এবং তাদের কাছে দুর্বলতাও দেখাবে না।
তৃতীয় আলামত: তারা জান-মাল, হাতের শক্তি ও জবান দিয়ে আল্লাহর পথে ও আল্লাহর দীনকে শক্তিশালী করা এবং শত্রুদের মূলোৎপাটন করার জন্য যে কোনো উপায়ে জিহাদ করবে।
চতুর্থ আলামত: তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করতে গিয়ে এবং সত্যের বিজয় আনতে গিয়ে জান-মাল খরচ করার পথে কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করবে না। সত্যের সাহায্যার্থে তারা নিজেদের জান-মাল খরচ করার সময় মানুষের তিরস্কার ও দোষারোপ তাদের উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। কেননা তারা যে দীনের উপর রয়েছে, তা সত্য হওয়ার ব্যাপারে তাদের পরিপূর্ণ প্রত্যয় রয়েছে এবং তাদের ঈমান ও ইয়াকীন খুবই শক্তিশালী। নিন্দুকের নিন্দার কারণে যদি ভালোবাসা পোষণকারীর ভালোবাসায় ভাটা পড়ে অতঃপর সে যদি তার হাবীবের সাহায্য করতে দুর্বলতা দেখায়, তাহলে সে প্রকৃতপক্ষে ভালোবাসা পোষণকারী নয়।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার দশটি কারণ উল্লেখ করেছেন।
(১) গভীর মনোযোগ সহকারে কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত করা এবং কুরআনের অর্থ ও উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করা।
(২) ফরয সালাত শেষে নফল সালাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য হাসিল করার চেষ্টা করা।
(৩) জবান, অন্তর ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রতঙ্গের মাধ্যমে সবসময় ও সকল অবস্থায় আল্লাহ তা‘আলার যিকির করা।
(৪) বান্দা যা ভালোবাসে এবং আল্লাহ যা ভালোবাসেন, -এ দু’টি ভালোবাসা সাংঘর্ষিক হলে আল্লাহর ভালোবাসাকেই প্রাধান্য দেয়া।
(৫) আল্লাহর অতি সুন্দর নামসমূহ, তার সুউচ্চ গুনাবলীসমূহ এবং সেটার কামালিয়াত, বড়ত্ব, মর্যাদা ও প্রশংসনীয় ফলাফল নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা।
(৬) আল্লাহ তা‘আলার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নিয়ামতগুলো নিয়ে চিন্তা-গবষেণা করা এবং বান্দাদের উপর তার দয়া, অনুগ্রহ ও নিয়ামতগুলো গভীর দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করা।
(৭) মন-প্রাণ উজাড় করে আল্লাহর সামনে কাকুতি-মিনতি করা এবং নিজের সকল প্রয়োজন আল্লাহর কাছে তুলে ধরা।
(৮) রাতের শেষ তৃতীয়াংশ বাকি থাকতে যখন দুনিয়ার আসমানে নুযুলে এলাহীর সময় হয় তখন নির্জনে আল্লাহ তা‘আলার নিকট কান্না-কাটি করা, দু‘আ করা এবং কুরআন তেলওয়াত করা। ক্ষমা প্রার্থনা ও তাওবার মাধ্যমে শেষ রাতের আমলের সমাপ্তি করা।
(৯) আল্লাহর প্রিয় বান্দা-সৎলোকদের সাথে উঠা-বসা করা এবং তাদের উপদেশ-নছীহত ও কথা-বার্তা থেকে উপকৃত হওয়া।
(১০) আল্লাহর মাঝে ও বান্দার অন্তরের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী প্রত্যেক জিনিস থেকে দূরে থাকা।
আল্লাহর ভালোবাসার অন্যতম দাবি হলো তার রসূলকে ভালোবাসা। ইমাম বুখারী ও মুসলিম আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
‘‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা ও সন্তান-সন্ততি এমনকি দুনিয়ার সকল মানুষ হতেও অধিক প্রিয় হই’’।[1]
অর্থাৎ যে ব্যক্তি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিজের নাফ্স এবং তার সর্বাধিক ঘনিষ্ট লোক থেকে বেশি ভালো না বাসবে ততক্ষণ কেউ প্রকৃত ও পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না।
রসূলের ভালোবাসা আল্লাহর ভালোবাসার অনুগামী এবং আল্লাহ তা‘আলাকে ভালোবাসার দাবিই হলো তার রসূলকে ভালোবাসা। আর যে ব্যক্তি রসূলকে ভালোবাসবে, সে অবশ্যই রসূলের অনুসরণ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভালোবাসার দাবি করবে, অথচ সে রসূলের আনীত দীন ও সুন্নাতের বিরোধীতা করবে এবং তাকে বাদ দিয়ে ভ্রান্ত, বিদআতী ও কুসংস্কারচ্ছন্ন লোকদের অনুসরণ করবে, সুন্নাত পরিহার করে বিদআতকে পুনরুজ্জীবিত করবে, সে তার দাবিতে মিথ্যুক। যদিও সে দাবি করে যে, সে রসূলকে ভালোবাসে। কেননা যে মানুষ কাউকে ভালোবাসে সে অবশ্যই তার মাহবুবের আনুগত্য করে।
যারা রসূলের সুন্নাত বিরোধী নতুন নতুন বিদআত তৈরী করে এবং তার জন্মদিবস উপলক্ষে মীলাদ মাহফিল উদ্যাপন করাসহ অন্যান্য বিদআত পুনরুজ্জীবিত করে অথবা নবীজির প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করে এবং আল্লাহ ব্যতীত তার নিকট দু‘আ করে, তার কাছে মদদ চায় এবং তার কাছে ফরিয়াদ করার পরও রসূলকে ভালোবাসার দাবি করে, তারা সবচেয়ে বড় মিথ্যুক। তারা আসলে ঐসব লোকের মতোই যাদের ব্যাপারে-
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَيَقُولُونَ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالرَّسُولِ وَأَطَعْنَا ثُمَّ يَتَوَلَّىٰ فَرِيقٌ مِّنْهُم مِّن بَعْدِ ذَٰلِكَ وَمَا أُولَٰئِكَ بِالْمُؤْمِنِينَ﴾
‘‘তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি এবং আমরা আনুগত্য স্বীকার করেছি কিন্তু এরপর তাদের মধ্য থেকে একটি দল মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ ধরনের লোকেরা কখনোই মুমিন নয়’’। (সূরা আন নূর: ৪৭)
কেননা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরোক্ত কাজগুলো থেকে নিষেধ করেছেন। তারা তার নিষেধের বিরোধীতা করেছে এবং তার অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়েছে। অথচ তারা দাবি করে যে, তারা রসূলকে ভালোবাসে। সুতরাং তারা মিথ্যা বলেছে। আমরা আল্লাহর কাছে এগুলো থেকে নিরাপত্তা কামনা করছি।
[1]. সহীহ বুখারী, হা/১৫।
التوكل শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, নির্ভর করা ও সোপর্দ করে দেয়া। এটি অন্তরের কাজ। যেমন বলা হয়ে থাকে, توكل في الأمر ‘‘সে কাজটি বুঝে নিল’’। এ কথা ঠিক ঐ সময় বলা হয়, যখন সে কাজটি করার দায়িত্ব বুঝে নেয়। আরো বলা হয়, ووكلت أمري إلى فلان ‘‘আমি আমার কাজটি অমুকের নিকট সোপর্দ করলাম। এ কথা ঠিক ঐ সময় বলা হয়, যখন সে কাজটি সম্পাদন করার ব্যাপারে তার উপর নির্ভর করে।
যেসব ইবাদত এখলাসের সাথে কেবল আল্লাহর জন্যই সম্পন্ন করা আবশ্যক, তার প্রকারসমূহের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করা বিরাট একটি ইবাদত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾
‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো’’। (সূরা মায়িদা: ২৩)
আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের উপর ভরসা করার প্রকারসমূহ
আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপর التوكل বা ভরসা করার প্রথম প্রকার হলো, যেসব বিষয়ের উপর আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ ক্ষমতা রাখে না ঐসব বিষয়ের উপর ভরসা করা। যেমন সাহায্য, বিপদাপদ থেকে নিরাপত্তা, রিযিক, শাফা‘আত ইত্যাদি উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মৃত ব্যক্তি, অনুপস্থিত অথবা তাগুতের উপর ভরসা করা বড় শিরক।
দ্বিতীয় প্রকার التوكل হলো, বাহ্যিক উপায়-উপকরণের উপর নির্ভর করা। যেমন কেউ রাজা-বাদশাহর উপর নির্ভর করলো অথবা শাসকদের উপর নির্ভর করলো অথবা অন্য কোনো জীবিত ক্ষমতাবান ব্যক্তির ঐসব ক্ষমতার উপর নির্ভর করলো, যা আল্লাহ তাকে দিয়েছেন যেমন দান করা কিংবা দুঃখ-কষ্ট দূর করা অথবা অনুরূপ অন্যান্য বিষয়ে বাহ্যিক উপকরণের উপর নির্ভর করলো। এ ধরণের নির্ভর করা ছোট শিরক। কেননা এতে আল্লাহর পরিবর্তে ব্যক্তি বিশেষের উপর ভরসা করা হয়।
তৃতীয় প্রকার التوكل হলো, যেমন মানুষ এমন কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করলো, যে তার কাজ-কর্মগুলো করে দিবে। যেমন ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদি। এটি জায়েয। তবে যে জন্য তাকে উকীল নিযুক্ত করা হলো, তা অর্জনের ব্যাপারে তার উপর ভরসা করা যাবে না। বরং আল্লাহর উপরই ভরসা করবে। তিনি যেন তার ঐসব কাজ সহজ করে দেন, যা তিনি নিজে অর্জন করতে চাচ্ছেন অথবা তার প্রতিনিধির মাধ্যমে অর্জন করতে চাচ্ছেন। কেননা বৈধ বিষয়াদি অর্জনের ক্ষেত্রে কাউকে উকীল বানানো উপায়-উপকরণ গ্রহণের অন্তর্ভুক্ত। উপায়-উপকরণের উপর নির্ভর করা যাবে না। বরং কেবল আল্লাহ তা‘আলার উপরই নির্ভর করতে হবে। তিনিই সকল উপায় উপকরণের স্রষ্টা, তিনি উপায়-উকরণ এবং সেটা গ্রহণ করার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলেরও স্রষ্ট।
অকল্যাণ প্রতিরোধ করা, রিযিক লাভ করা এবং যা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ দিতে পারে না, তা পাওয়ার জন্য কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করা বিরাট একটি ইবাদত। সুতরাং এসব বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্যের উপর নির্ভর করা বড় শিরক।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾
‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাক, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো’’। সূরা আল মায়িদা: ২৩।
আল্লাহ এখানে কেবল তার উপরই ভরসা করার আদেশ দিয়েছেন। কেননা বাক্যের মধ্যে معمول কে عامل এর পূর্বে উল্লেখ করা হলে সীমাবদ্ধতার অর্থ প্রদান করে। আর এখানে আল্লাহর উপর ভরসা করাকে ঈমান সহীহ হওয়ার শর্তারোপ করা হয়েছে। অনুরূপ আল্লাহ তা‘আলা কারো ইসলাম সহীহ হওয়ার জন্যও তার উপর ভরসা করার শর্তারোপ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَقَالَ مُوسَىٰ يَا قَوْمِ إِن كُنتُمْ آمَنتُم بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِن كُنتُم مُّسْلِمِينَ﴾
‘‘ মূসা তার কওমকে বলল, হে লোকেরা! যদি তোমরা সত্যিই আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে থাকো তাহলে কেবল তার উপর ভরসা করো, যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো’’। (সূরা ইউনুস: ৮৪)
উপরের আয়াত দু’টি প্রমাণ করে যে, যারা আল্লাহর উপর ভরসা করে না অথবা তাকে ছাড়া অন্যের উপর ভরসা করে তাদের ঈমান বা ইসলাম কোনোটিই সঠিক নয়। যেসব বিষয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোনো ক্ষমতা নেই তাতে কবরবাসী ও সমাধিস্থ ব্যক্তিগণ এবং মূর্তিদের উপর নির্ভর করা হলে ঈমান ও ইসলাম উভয়টি ভঙ্গ হয়ে যাবে।
সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসা করা ফরয। তাই এখলাসের সাথে তার উপর ভরসা করা আবশ্যক। একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর উপর ভরসা সমস্ত ইবাদতের মূল, তাওহীদের সর্বোচ্চ স্তর। কেননা এ থেকেই অন্যান্য সৎ আমলের উৎপত্তি হয়। কেননা বান্দা যখন তার দুনিয়া-আখিরাতের সমস্ত কাজে কেবল আল্লাহর উপর ভরসা করবে এবং তিনি ব্যতীত অন্যান্য জিনিষের উপর ভরসা করা বাদ দিবে, তখনই তার এখলাস বিশুদ্ধ হবে এবং আল্লাহর সাথে তার সম্পর্কও ঠিক হবে।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, যখন কেউ কোনো সৃষ্টির কাছে আশা-আকাঙ্খা করেছে এবং তার উপর ভরসা করেছে, তখন সেই সৃষ্টির ব্যাপারে তার ধারণা ব্যর্থ হয়েছে। শাইখুল ইসলামের উক্তি এখানেই শেষ।
সূরা ফাতিহার আয়াত ﴿إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ﴾ ‘‘আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি ও শুধু তোমার কাছেই সাহায্য চাই’’
এর সর্বোচ্চ স্তর হলো আল্লাহর উপর ভরসা করা। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার উপর পরিপূর্ণরূপে ভরসা করা ব্যতীত তাওহীদের তিনটি প্রকার কেউ পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করতে পারবে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿رَّبُّ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِيلًا﴾
‘‘তিনি পূর্ব ও পশ্চিমের মালিক। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ নেই। তাই তাকে নিজের উকীল হিসাবে গ্রহণ করো’’। সূরা আল মুয্যাম্মিল:৯।
আল্লাহর উপর ভরসা করার আদেশ সম্বলিত অনেক আয়াত রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ ﴾
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট। নিশ্চয় আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করবেনই’’। (সূরা তালাক: ৩)
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿وَعَلَى اللَّهِ فَتَوَكَّلُوا إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾
‘‘তোমরা যদি মুমিন হয়ে থাকো, তাহলে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করো’’ সূরা আল মায়িদা: ২৩।
-এর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, আল্লাহ এখানে ঈমানদার হওয়ার জন্য আল্লাহর উপর ভরসা করার শর্তারোপ করেছেন। এতে বুঝা গেলো আল্লাহর উপর ভরসা না থাকলে ঈমান থাকে না। বান্দার ঈমান যতই বৃদ্ধি পাবে, আল্লাহর উপর তার ভরসাও ততো মজবুত হবে। ঈমান যখন দুর্বল হবে, তখন ভরসাও দুর্বল হবে। আর আল্লাহর উপর ভরসার দুর্বলতা বান্দার ঈমান দুর্বল হওয়ার প্রমাণ। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবের অনেক জায়গায় তাওয়াক্কুল (ভরসা) ও ইবাদতকে একসাথে উল্লেখ করেছেন, কোথাও তাওয়াক্কুল ও ঈমানকে একসাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন, কোথাও তাওয়াক্কুল এবং তাকওয়াকে একসাথে মিলিয়ে, কোথাও তাওয়াক্কুল এবং ইসলামকে একসাথে মিলিয়ে আবার কোথাও তাওয়াক্কুল এবং হিদায়াতকে একসাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন। এতে বুঝা গেলো, ঈমানের সকল স্তরের মধ্যে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল হলো মূল আর ইহসান বা ইখলাস হলো ইসলামের সমস্ত আমলের মূল। আর ঈমানের মধ্যে তাওয়াক্কুলের মর্যাদা দেহের মধ্যে মাথার মর্যাদার মতোই। দেহ ছাড়া যেমন মাথার অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, ঠিক তেমনি তাওয়াক্কুলের ভিত্তি ছাড়া অন্য কিছুর উপর ঈমান, ঈমানের শাখাসমূহ ও ঈমানের আমলসমূহ ঠিক হয় না।
আল্লাহ তা‘আলা তার উপর ভরসা ও নির্ভর করাকে মুমিনদের সর্বাধিক সুস্পষ্ট বৈশিষ্ট হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা আনফালের ২ নং আয়াতে বলেন,
﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آَيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ﴾
‘‘মুমিন তো তারাই, যাদের অন্তরসমূহ আল্লাহর নাম নেয়া হলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়। আর যখন তার আয়াত তাদের সামনে পাঠ করা হয়, তখন সেটা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে। আর তারা তাদের প্রভুর উপর ভরসা রাখে’’।
অর্থাৎ তারা অন্তর-মন দিয়ে আল্লাহ তা‘আলার উপর নির্ভর করে। তাকে ছাড়া তারা অন্য কারো কাছে কিছুই কামনা করে না। উপরোক্ত আয়াতে প্রকৃত মুমিনদেরকে ইহসানের তিনটি গুণে বিশেষিত করেছেন।
(১) তারা আল্লাহকে ভয় করে।
(২) আল্লাহর আয়াত শুনে তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং
(৩) তারা একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে।
আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করা উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার চেষ্টা করার পরিপন্থী নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা তাক্বদীরে নির্ধারিত জিনিসগুলো উপায়-উপকরণের সাথে যুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি তার উপর ভরসা করার সাথে সাথে উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করার আদেশ দিয়েছেন।
সুতরাং উপায়-উপকরণ গ্রহণ করাও আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে গণ্য। কেননা তিনি তা গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন। উপায়-উপকরণ গ্রহণ করা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের মধ্যে গণ্য। আর আল্লাহর উপর ভরসা করা অন্তরের আমল। আর তা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি সুদৃঢ় বিশ্বাস রাখা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا خُذُوا حِذْرَكُمْ فَانفِرُوا ثُبَاتٍ أَوِ انفِرُوا جَمِيعًا﴾
‘‘হে ঈমানদারগণ! সতর্কতা অবলম্বন করো। অতঃপর পৃথক পৃথক বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে বের হয়ে পড়ো অথবা এক সাথে বের হয়ে পড়ো’’। (সূরা আন নিসা: ৭১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَأَعِدُّوا لَهُم مَّا اسْتَطَعْتُم مِّن قُوَّةٍ وَمِن رِّبَاطِ الْخَيْلِ تُرْهِبُونَ بِهِ عَدُوَّ اللَّهِ وَعَدُوَّكُمْ﴾
‘‘আর তোমরা তাদের যথাসাধ্য শক্তি ও সুসজ্জিত ঘোড়া যোগাড় করে রাখো। এর মাধ্যমে তোমরা ভয় দেখাবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদের শত্রুকে’’। (সূরা আনফাল: ৬০)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ اللَّهِ وَاذْكُرُوا اللَّهَ كَثِيرًا لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ﴾
‘‘অতঃপর যখন সালাত শেষ হয়ে যায় তখন ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং অধিক মাত্রায় আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো। যাতে তোমরা সফলকাম হও’’। (সূরা জুমআ: ১০)
কোনো কোনো সালাফ বলেছেন, যে ব্যক্তি চেষ্টা করা, পরিশ্রম করা, উপার্জন করা এবং উপায়-উপকরণ সংগ্রহ করা বর্জন করলো, সে রসূলের সুন্নাতের মধ্যে আঘাত করলো এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসা করা বর্জন করলো, সে তার ঈমান নষ্ট করে ফেললো।
ইমাম ইবনে রজব হান্বালী রহিমাহুল্লাহ বলেন, বান্দার আমল মোট তিন প্রকার।
(১) এমন আনুগত্যের আমল, যা আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে সম্পাদন করার আদেশ দিয়েছেন, সেটাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচার উপায়-উপকরণ ও জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যম বানিয়েছেন। আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং তার কাছে সাহায্য চাওয়ার সাথে সাথে এ আমলগুলো সম্পাদন করা জরুরী। কেননা আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকা সম্ভব নয় এবং তার শক্তি ব্যতীত ভালো কাজ সম্পন্ন করাও অসম্ভব। তিনি যা চান, তাই হয় এবং তিনি যা চান না, তা হয় না। সুতরাং যে ব্যক্তি এ কাজগুলো থেকে কোনো একটি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ত্রুটি করবে, সে তাক্বদীরের নির্ধারণ ও শরী‘আতের হুকুম অনুযায়ী দুনিয়া-আখেরাত উভয় জগতে শাস্তির হকদার হবে।
ইউসুফ ইবনে আসবাত রহিমাহুল্লাহ বলেন, বলা হয়ে থাকে যে, তুমি ঐ ব্যক্তির ন্যায় আমল করো, যাকে তার আমল ব্যতীত অন্য কিছু নাজাত দিবে না। আর ঐ ব্যক্তির ন্যায় ভরসা করো, যে তার ভাগ্যে নির্ধারিত জিনিস ব্যতীত অন্য কিছুই অর্জন করার আশা করে না।
(২) আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার সকল সৃষ্টির মধ্যে স্বভাব ও সৃষ্টিগত যেসব রীতিনীতি চালু করেছেন বান্দাদেরকে তা গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন। যেমন ক্ষুধা লাগলে খাবার গ্রহণ করা, পিপাসা লাগলে পান করা, রোদ্রের তাপ লাগলে ছায়া গ্রহণ করা, শীত লাগলে উত্তাপ গ্রহণ করা ইত্যাদির উপকরণ গ্রহণ করা বান্দার উপর ওয়াজিব। যার এগুলো ব্যবহার করার ক্ষমতা রয়েছে, সে যদি অবহেলা বশতঃ এগুলো ব্যবহার বর্জন করে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাহলে অবহেলা করার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হবে। তবে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের কাউকে পানাহার বর্জন কিংবা গরম-ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষেত্রে এত শক্তিশালী করেন, যতটা অন্যদেরকে করেন না। যে বান্দাকে খাস করে অন্যের তুলনায় অতিরিক্ত শক্তি দেয়া হয়েছে, সে যদি তার শক্তি অনুপাতে কাজ করে, তাহলে তার কোনো দোষ নেই। তাই তো নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লাগাতার একদিন বা দুই দিন পর্যন্ত না খেয়ে সিয়াম রাখতেন। অথচ তিনি তার সাহাবীদেরকে তা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলতেন, আমি তোমাদের মতো নই। আমাকে আল্লাহর পক্ষ হতে খাওয়ানো হয় ও পান করানো হয়। পানাহার বর্জনে সালাফদের অনেকেরই এমন শক্তি ছিল, যা অন্যদের ছিল না।
সুতরাং যার শক্তি আছে, সে যদি শক্তি অনুসারে পানাহার ছেড়ে দিয়েও আল্লাহর আনুগত্য করতে দুর্বল না হয়, তাহলে তার কোনো অপরাধ হবে না। আর যে নিজের নফস্কে কষ্ট দিতে গিয়ে ফরয ইবাদত করতে দুর্বল হয়ে যায়, তার কাজের প্রতিবাদ করা হবে।
(৩) আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার অধিকাংশ সৃষ্টির মধ্যে স্বভাবগত ও সৃষ্টিগত যেসব রীতিনীতি ও প্রথা চালু করেছেন বান্দাদেরকে তা গ্রহণ করার আদেশ করেছেন। তিনি তার বান্দাদের মধ্য থেকে যার জন্য ইচ্ছা করেন, তার ব্যাপারে উক্ত সাধারণ রীতিনীতির ব্যতিক্রম করেন। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لَوْ أَنَّكُمْ تَوَكَّلْتُمْ عَلَى اللَّهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرَزَقَكُمْ كَمَا يَرْزُقُ الطَّيْرَ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوحُ بِطَانًا
‘‘তোমরা যদি আল্লাহ তা‘আলার উপর পরিপূর্ণরূপে ভরসা করতে, তাহলে তিনি তোমাদেরকে সেভাবেই রিযিক দিতেন, যেভাবে তিনি পাখিদেরকে রিযিক দিয়ে থাকেন। পাখি খালি পেটে সকালে বাসা থেকে বের হয় আর বিকালে ভরা পেটে ফিরে’’।[1]
এতে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সামান্য তাওয়াক্কুলের কারণে এবং বাহ্যিক উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার কারণে রিযিক দিয়ে থাকেন। তারা যদি অন্তর দিয়ে আল্লাহর উপর পরিপূর্ণরূপে ভরসা করতো, তাহলে তাদেরকে সামান্য পরিশ্রমের মাধ্যমেই প্রচুর পরিমাণ রিযিক দিতেন। যেমন তিনি সকাল-বিকাল বাসা থেকে শুধু বের হওয়ার কারণেই পক্ষীকূলকে রিযিক দিয়ে থাকেন। এটিও এক প্রকার অন্বেষণ। তবে তা খুবই সামান্য। পরিশেষে ইবনে রজব রহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইয়ামানবাসীরা হজ্জে আসতো। কিন্তু পাথেয় সাথে আনতো না। তারা বলতো, আমরা আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভরকারী। সুতরাং তারা মক্কায় এসে হজ্জ করার সময় মানুষের কাছে হাত পাততো। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করলেন,
﴿وَتَزَوَّدُوا فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَىٰ وَاتَّقُونِ يَا أُولِي الْأَلْبَابِ﴾
‘‘আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ করো। তাকওয়াই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। হে জ্ঞানীগণ! তোমরা আমাকেই ভয় করো’’। (সূরা আল বাকারা: ১৯৭)
ইমাম আহমাদ ইবনে হান্বাল রহিমাহুল্লাহকে জিজ্ঞাসা করা হলো, যে ব্যক্তি বসে থাকে, জীবিকার জন্য চেষ্টা করে না এবং বলে আমি আল্লাহর উপর ভরসা করলাম, তার ব্যাপারে আপনার মত কী?
জবাবে তিনি বললেন, সমস্ত মানুষেরই আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত, একই সঙ্গে জীবিকা অর্জনের জন্য নিজেকে অভ্যস্ত করা উচিত। নবী-রসূলগণ অন্যদের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আবু বকর এবং উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মানুষের কাজ করে দিতেন। তারা বলেননি যে, আমরা বসে থাকবো। আল্লাহ আমাদেরকে বিনা পরিশ্রমেই রিযিক দিবেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَانتَشِرُوا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوا مِن فَضْلِ﴾
তোমরা ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো। (সূরা জুমু‘আ: ১০)
আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ বর্ণনা করেন যে, এক লোক নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলো,
يَا رَسُولَ اللَّهِ أَعْقِلُهَا وَأَتَوَكَّلُ أَوْ أُطْلِقُهَا وَأَتَوَكَّلُ قَالَ اعْقِلْهَا وَتَوَكَّلْ
‘‘ইয়া রসূলাল্লাহ! আমি কি উট বাঁধবো এবং আল্লাহর উপর ভরসা করবো? না কি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করবো? তিনি বললেন, বাধোঁ এবং ভরসা করো’’।[2]
উপরে যেসব আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করা হলো, তা প্রমাণ করে যে, আল্লাহর উপর ভরসা করা বৈধ উপায়-উপকরণ অন্বেষণ করার প্রতিবন্ধক নয়। বরং উভয়টি একসাথে গ্রহণ করাই উত্তম।উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ইয়ামানের একদল লোকের সাক্ষাৎ পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কোন গোত্রের লোক? তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপর ভরসাকারী। তিনি বললেন, তা নয়; বরং তোমরা লোভী এবং অন্যের খাবারে অংশগ্রহণকারী। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার উপর ভরসাকারী হলো ঐব্যক্তি, যে যমীনে বীজ বপন করে অতঃপর আল্লাহর উপর ভরসা করে।
[2]. তিরমযী, হাদীছ নং- ২৪৪১।
আল্লাহ আমাকে এবং আপনাদেরকে তাওফীক দিন! জানা আবশ্যক যে, আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা হালাল করার ক্ষেত্রে অথবা তিনি যা হালাল করেছেন, তা হারাম করার ক্ষেত্রে আলেম ও শাসকদের আনুগত্য করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُواْ إِلاَّ لِيَعْبُدُواْ إِلَـهاً وَاحِداً لاَّ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾
‘‘তারা আল্লাহকে পরিহার করে তাদের পন্ডিত ও পুরোহিতদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে এবং মারইয়ামের পুত্র মসীহকেও। অথচ তাদেরকে শুধু এ আদেশ করা হয়েছিল যে, তোমরা শুধু এক মাবুদের ইবাদত করবে। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই। তিনি তাদের অংশী স্থির করা থেকে পবিত্র’’। (সূরা আত তাওবা: ৩১)
সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, আদী ইবনে হাতিম আত-তায়ী যখন মুসলিম হয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আসলেন, তখন তিনি উপরোক্ত আয়াত পাঠ করেছিলেন। আদী ইবনে হাতিম তখন বললেন,
يارَسُولَ اللَّهِ إِنَّا لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ قَالَ: أَلَيْسَ يحلون لكم مَا حَرَّمَ اللَّهُ فَتَسْتَحِلُّونَه ويُحَرِّمُونَ مَا أَحَلَّ اللَّهُ فَتُحَرِّمُونَهُ قال: بَلَى قَالَ النبي صلى الله عليه وسلم: فَتِلْكَ عِبَادَتُهُم
‘‘হে আল্লাহর রসূল! আমরা তো তাদের ইবাদত করতাম না। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হ্যাঁ, তারা তাদের ইবাদতই করে। কেননা আহলে কিতাবদের আলেমরা যখন আল্লাহর হারাম করা বস্তুকে তোমাদের জন্য হালাল করতো, তখন তোমরা কি তা হালাল মনে করতেনা? এমনি তারা যখন আল্লাহর হারাম করা জিনিসকে তোমাদের জন্য হারাম করতো, তখন তোমরা কি আলেমদের অনুসরণ করে তাকে হারাম মনে করতে না? আদী বললেন, হ্যাঁ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটিই হচ্ছে তাদের ইবাদত’’। ইমাম তিরমিযী এবং অন্যান্য ইমামগণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[1]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হাদীছে ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের পন্ডিত ও পুরোহিতদেরকে আল্লাহর বদলে প্রভু হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এর অর্থ এ নয় যে, তারা তাদের পন্ডিত ও পুরোহিতদেরকে রুকু ও সিজদাহ করতো। বরং তারা কেবল হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম করার মাধ্যমে আল্লাহর হুকুম পরিবর্তন ও রদবদল করার ক্ষেত্রে তাদের পন্ডিতদের অনুসরণ করতো। আর এটিকেই আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ইবাদত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। কেননা তারা শরী‘আত প্রবর্তনের ব্যাপারে আল্লাহর স্থানে নিজেদেরকে বসিয়েছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে যারা তাদের অনুসরণ করবে, তারা শরী‘আত প্রবর্তন এবং হালাল ও হারাম করার ক্ষেত্রে তাদেরকে আল্লাহর শরীক হিসাবে গ্রহণ করলো। আর এটি বড় শিরকের পর্যায়ভুক্ত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا أُمِرُواْ إِلاَّ لِيَعْبُدُواْ إِلَـهاً وَاحِداً لاَّ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾
‘‘অথচ তাদেরকে শুধু এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তোমরা শুধু এক মাবুদের ইবাদত করবে। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই। তিনি তাদের অংশী স্থির করা থেকে পবিত্র’’। (সূরা আত তাওবা: ৩১)
অনুরূপ অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَأْكُلُوا مِمَّا لَمْ يُذْكَرِ اسْمُ اللَّهِ عَلَيْهِ وَإِنَّهُ لَفِسْقٌ وَإِنَّ الشَّيَاطِينَ لَيُوحُونَ إِلَىٰ أَوْلِيَائِهِمْ لِيُجَادِلُوكُمْ وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ﴾
‘‘যেসব জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় না, সেগুলো থেকে ভক্ষণ করো না; এগুলো ভক্ষণ করা গুনাহ্। আর নিশ্চয় শয়তানরা তাদের বন্ধুদেরকে তোমাদের সাথে বিবাদ করতে প্ররোচনা দেয়। কিন্তু যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো তাহলে অবশ্যই তোমরা মুশরিক হবে’’। (সূরা আল আনআম: ১২১)
শাসক ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ হারামকে হালাল করার ক্ষেত্রে শরী‘আতের হুকুম-আহকাম বিরোধী সমাজে প্রচলিত যেসব আইনের আশ্রয় নেয়, তাতে শাসকদের আনুগত্য করাও বড় শিরক। যেমন-
- সুদের বৈধতা দেয়া,
- যেনা-ব্যভিচারের অনুমোদন দেয়া,
- মদ্যপান অনুমোদন করা,
- উত্তরাধিকার সূত্রে নারী-পুরুষকে সমান করে দেয়া,
- নারীদেরকে বেপর্দা হওয়ার অনুমতি দেয়া,
- সহশিক্ষা চালু ও কর্মক্ষেত্রে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার পরিবেশ তৈরী করা,
- কিংবা হালালকে হারাম করা যেমন পুরুষের জন্য একাধিক বিবাহ হারাম করা অনুরূপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আল্লাহর হুকুমকে পরিবর্তন করা এবং শয়তানের প্রচলিত আইন-কানুন দ্বারা আল্লাহর হুকুমকে বদলানোর ক্ষেত্রে শাসকদের আনুগত্য করাও বড় শিরক।
সুতরাং যারা এসব ক্ষেত্রে শাসকদের আনুগত্য করবে, তাতে সন্তুষ্ট থাকবে এবং তাদের অনৈসলামিক কাজগুলোকে ভালো মনে করবে সে মুশরিক ও কাফির হিসাবে গণ্য হবে। আমরা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
এমনি ফিকাহ শাস্ত্রের আলিমদের যেসব কথা কুরআন ও হাদীছের সুস্পষ্ট দলীলের বিপরীত ঐসব কথাতে তাদের অনুসরণ করাও বড় শিরক। বিশেষ করে যখন জানা যাবে যে, কিছু লোকের প্রবৃত্তি ও মনোবাসনা পূরণ করতে গিয়েই আলিমগণ ঐসব কথা বলেছেন। বিভিন্ন বিষয়ে সুযোগের সন্ধানী অর্ধশিক্ষিত কতিপয় লোককে এমনই করতে দেখা যায়।
মোটকথা মুজতাহিদদের ঐসব কথাই গ্রহণ করা আবশ্যক, যার পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর দলীল রয়েছে। তাদের যেসব কথা দলীল বিরোধী তা পরিত্যাগ করা আবশ্যক।
ইমামগণ বলেছেন, كل يؤخذ من قوله ويرد إلا رسول الله صلى الله عليه وسلم ‘‘প্রত্যেকের কথা থেকে গ্রহণ করা হবে এবং কিছু বর্জনও করা হবে। একমাত্র রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সব কথাই গ্রহণ করা হবে। ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
إذا جاء الحديث عن رسول الله صلى الله عليه وسلم فعلى الرأس والعين وإذا جاء عن الصحابة رضي الله عنهم فعلى الرأس والعين وإذا جاء عن التابعين فهم رجال ونحن رجال
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে কোনো হাদীছ আসলে তা আমরা মাথা পেতে মেনে নিবো এবং চোখ বন্ধ করে সেটা কবুল করবো, সাহাবীদের থেকে কোনো হাদীছ আসলে তা আমরা মাথা পেতে মেনে নিবো এবং চোখ বন্ধ করে সেটা কবুল করবো। আর তাবেঈদের থেকে যখন কোনো হাদীছ আসবে, সে ব্যাপারে কথা হলো তারাও পুরুষ এবং আমরা পুরুষ। অর্থাৎ তা আমরা চোখ বন্ধ করে মানতে বাধ্য নই। তাদের কথা ভুলের উর্ধ্বে নয়। ইমাম আবু হানীফা রাহিমাহুল্লাহ তার কথা দ্বারা তার অনুরূপ অন্যান্য আলেম ও বড় ইমামদেরকে উদ্দেশ্য করেছেন।
ইমাম আবু হানীফার শেষোক্ত কথাটিকে কতিপয় আধা শিক্ষিত লোক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে নিজেদেরকে মুজতাহিদদের কাতারে দাঁড় করিয়েছে। অথচ তারা এখনো মূর্খই রয়ে গেছে। ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ তার কথা দ্বারা আলেমদেরকে জাহেলদের বরাবর করতে চান নি। ইমাম মালেক রহিমাহুল্লাহ বলেন,
كلنا راُّد ومردود عليه؛ إلا صاحب هذا القبر ... "؛ يعني: رسول الله صلى الله عليه وسلم.
‘‘এ কবরের অধিবাসী ব্যতীত আমাদের প্রত্যেকের কথাই কখনো গ্রহণযোগ্য হয় আবার কখনো অগ্রহযোগ্য হয়। কেবল এ কবরবাসী ব্যতীত। এ কথা বলে তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবরের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন,
إذا صح الحديث فهو مذهبي
সহীহ হাদীছই আমার মাযহাব। তিনি আরো বলেন,
إذا خالف قولي قول رسول الله صلى الله عليه وسلم فاضربوا بقولي عرض الحائط
আমরা কথা যখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার বিপরীত হবে, তখন আমার কথাকে দেয়ালে নিক্ষেপ করবে। ইমাম আহমাদ ইবনে হান্বাল রাহিমাহুল্লাহ বলেন,
عجب لقوم عرفوا الإسناد وصحته يذهبون إلى رأي سفيان
ঐসব লোকের জন্য আফসোস! যারা হাদীছের সনদ এবং সেটার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে জেনেও সুফিয়ান ছাওরীর মতামত গ্রহণ করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾
‘‘যারা রসূলের আদেশের বিরোধিতা করে, তাদের এ ভয় করা উচিত যে, তাদের উপর কোনো ফিতনা কিংবা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি এসে পড়তে পারে’’। (সূরা আন নূর: ৮৩)
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমার আশঙ্কা হয় যে, তোমাদের উপর আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষিত হবে। আমি বলছি, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আর তোমরা বলছো যে, আবু বকর বলেছেন এবং উমার বলেছেন।[2]
শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে হাসান রহিমাহুল্লাহ কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল মাজীদে বলেন, প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিমের উপর আবশ্যক হলো, তার কাছে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের দলীল পৌঁছার পর যখন সে সেটার অর্থ ভালোভাবে বুঝবে, তখন সেটাকেই যথেষ্ট মনে করবে ও সে অনুযায়ী আমল করবে। যদিও এতে বিরোধীরা তার বিরোধীতা করে। তিনি আরো বলেন, নিজের কল্যাণকামী কোনো লোক যখন আলেমদের কিতাব পড়বে, তাতে নযর দিবে এবং তাদের কথা বুঝতে পারবে তখন সে যেন আলেমদের কথাগুলোকে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের সাথে মিলিয়ে দেখে। কেননা প্রত্যেক মুজতাহিদ আলেম, তার অনুসারী এবং তার দিকে নিজেকে সম্বন্ধকারী মতভেদপূর্ণ মাস‘আলায় নিজেদের মতো ও তার পক্ষে দলীল উল্লেখ করে থাকে। আর উক্ত মাস‘আলাতে একজনের কথাই সত্য হয়। ইমামগণ তাদের ইজতেহাদের কারণে ছাওয়াবপ্রাপ্ত হবেন।
এ ক্ষেত্রে সঠিক পথ অবলম্বনকারী হবে ঐ ব্যক্তি, যিনি আলেমদের কথায় দৃষ্টি দেয়, তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করার মাধ্যমে বিভিন্ন মাসাআলা জানা ও মুখস্ত করার চেষ্টা করে এবং তারা যেসব দলীল উল্লেখ করেছেন, তার মাধ্যমে ভুল মাস‘আলা থেকে সঠিক মাসআলা আলাদা করে। এর মাধ্যমেই দলীলের ভিত্তিতে আলেমদের কথা থেকে বাছাই করে সঠিক কথাটির উপর আমল করে সৌভাগ্যবান হতে পারবে। শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে হাসান
আল্লাহ তা‘আলার এ বাণী,
﴿وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ﴾
‘‘কিন্তু যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো তাহলে অবশ্যই তোমরা মুশরিক হবে’’। সূরা আল আনআম: ১২১।
এর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, মুকালিস্নদ এবং যারা তাদের তাকলীদ করে, তাদের অনেকেই এ ফিতনায় পড়েছেন। মুকাল্লাদ বা যার তাকলীদ করা হয়, তিনি দলীলের বিপরীত করলেও মুকালিস্নদরা দলীলের মূল্যায়ন না করার কারণেই ফিতনায় পড়েছে। আর এটি বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত।
মুকালিস্নদদের কেউ কেউ তাকলীদ করতে গিয়ে এতে বাড়াবাড়ি করে এবং বিশ্বাস করে যে, এ অবস্থায় দলীলের অনুসরণ করতে যাওয়া মাকরুহ অথবা হারাম। মুকালিস্নদরা আরো বলে, আমাদের ইমামগণই দলীল সম্পর্কে অধিক অবগত রয়েছেন। এরা এক বিরাট ফিতনায় পড়েছে। শাইখ আব্দুর রাহমান ইবনে হাসানের কথা এখানেই শেষ।
আমাদের সম্মানিত শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব কিতাবুত তাওহীদের ৩৭ম অধ্যায়ের ৫নং মাসআলায় বলেছেন: অবস্থা এ পর্যন্ত গড়িয়েছে যে, অধিকাংশের নিকট পাদ্রী ও পীর-মাশায়েখদের ইবাদত করাই সর্বাধিক উত্তম আমলে পরিণত হয়েছে। লোকেরা এটিকে ‘বেলায়াত’ হিসাবে নামকরণ করছে। পাদ্রীদের ইবাদতই বর্তমানে ইলম ও ফিকাহ হিসাবে গণ্য হচ্ছে। পরবর্তীতে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে এবং খারাপ লোকদেরও ইবাদত শুরু হয়। অর্থাৎ জাহেল ও মূর্খদেরও ইবাদত শুরু হয়। শাইখ মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাব রাহিমাহুল্লাহুর কথা এখানেই শেষ।
গোমরাহ আলেমরা আল্লাহর দীনের মধ্যে যেসব বিদআত, কুসংস্কার এবং গোমরাহী উদ্ভাবন করেছে, তাতে তাদের আনুগত্য করা এবং ইয়াহূদী-খ্রিষ্টানদের দ্বারা তাদের পন্ডিত ও পুরোহিতদেরকে প্রভু বানিয়ে নেয়া একই কথা। যেমন মীলাদ অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করা, সুফী তরীকাসমূহ, মৃতদের মধ্যস্থতা দেয়া এবং আল্লাহ তা‘আলার বদলে তাদের কাছে দু‘আ করা ইত্যাদি। পরিস্থিতি এতদূর গিয়ে পৌঁছেছে যে, গোমরাহ আলেমগণ এমন এমন শরী‘আত তৈরি করেছে, যা আল্লাহ তা‘আলা অনুমোদন করেননি। সহজ-সরল মূর্খ লোকেরা তাদের তাকলীদ করে এগুলোকেই দীন মনে করছে। এখন সমস্যা হলো, যে এ শিরক-বিদআতগুলোর প্রতিবাদ করে এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করার আহবান জানায় তাকে ইসলামের বাইরে গণ্য করা হয় অথবা তার নামে অপবাদ দেয়া হয় যে, সে আলেম ও সৎ লোকদেরকে ঘৃণা করে। এতে ভালো কাজ খারাপ এবং খারাপ কাজ ভালো রূপ ধারণ করছে। সুন্নাতকে বিদআত এবং বিদআতকে সুন্নাত হিসাবে গ্রহণ করা হচ্ছে। এর উপরই শিশুরা যুবক হচ্ছে এবং যুবকরা বৃদ্ধ হচ্ছে। এঅবস্থা দীনের অনুসারী কম হওয়ার প্রমাণ এবং দীনকে সংস্কারকারী দাঈদের সংখ্যাও কম হওয়ার প্রমাণ। মহান আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য ব্যতীত অন্যায় থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই এবং তার শক্তি ও সাহায্য ব্যতীত সৎকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়।
মুজতাহিদ ইমামগণ যেসব ইজতেহাদী মাসআলায় ভুল করেছেন, তাদের ভুলগুলো মার্জণীয় এবং অনিচ্ছকৃত ভুলের কারণে তারা ছাওয়াবও পাবেন। তাদের ভুলগুলোর ক্ষেত্রে যদি তাদের অনুসরণ করা হারাম হয়, তাহলে কবর এবং অলী-আওলীয়ার পূজায় লিপ্ত গোমরাহ-মিথ্যুক দাজ্জালদের তাকলীদ কিভাবে বৈধ হতে পারে? এরা এমন মাসআলায় ভুল করেছে, যাতে ইজতেহাদ করা জায়েয নেই। আর এটি হলো আকীদার মাসআলা। কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের ভিত্তিতেই আকীদা সাব্যস্ত করতে হবে। তবে যাদের অন্তর অন্ধ তারা তো কুরআন ও সুন্নাহ থেকে আকীদা গ্রহণ করবে না। যেমন-আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدْ ضَرَبْنَا لِلنَّاسِ فِي هَٰذَا الْقُرْآنِ مِن كُلِّ مَثَلٍ وَلَئِن جِئْتَهُم بِآيَةٍ لَّيَقُولَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ أَنتُمْ إِلَّا مُبْطِلُونَ كَذَٰلِكَ يَطْبَعُ اللَّهُ عَلَىٰ قُلُوبِ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ فَاصْبِرْ إِنَّ وَعْدَ اللَّهِ حَقٌّ وَلَا يَسْتَخِفَّنَّكَ الَّذِينَ لَا يُوقِنُونَ﴾
‘‘আমি তো মানুষের জন্য এ কুরআনে সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত বর্ণনা করে দিয়েছি। তুমি যে কোনো নিদর্শনই আনো না কেন, অবিশ্বাসীরা এ কথাই বলবে, তোমরা মিথ্যাশ্রয়ী। এভাবে জ্ঞানহীনদের অন্তরে আল্লাহ মোহর মেরে দেন। কাজেই তুমি সবর করো, অবশ্যই আল্লাহর প্রতিশ্রম্নতি সত্য এবং যারা বিশ্বাস করে না তারা যেন কখনোই তোমাকে গুরুত্বহীন মনে না করে’’। (সূরা আর রূম: ৫৮-৬০)
এসব লোক দীনের মূলনীতি ও শাখা-প্রশাখাগুলোর ব্যাপারে তাদের শাইখদের অন্ধ তাকলীদে ডুবে রয়েছে। আরেক দল লোক তাদের সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা সবাইকে মুজতাহিদ মনে করে। যেসব মূর্খ নিজে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে না এবং ইলমের ক্ষেত্রে যাদের বেশি একটা দখল নেই। তারা ফিকহার কিতাবসমূহ পড়া হারাম মনে করে। তারা চায় মূর্খরাও মুজতাহিদ হয়ে যাক এবং ইজতেহাদ করে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে নিজেরাই হুকুম বের করুক। এটি খুবই ঘৃণ্য বাড়াবাড়ি। উম্মতের উপর এদের ক্ষতির আশঙ্কা বেশি না হলেও কোনো অংশেই প্রথমোক্ত দলের চেয়ে কম নয়।
দীনের ব্যাপারে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করাই সর্বাধিক নিরাপদ। আমরা ফকীহদের অন্ধ তাকলীদ করবো না। তবে তাদের ইলমকে কোনোভাবেই খাটো করে দেখবো না এবং কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের ভিত্তিতে তারা যেসব কথা বলেছেন, তা আমরা মোটেই বর্জন করবো না। বরং আমরা তাদের কথা দ্বারা উপকৃত হবো এবং কুরআন ও সুন্নাহ বুঝতে তাদের বক্তব্যগুলোর সাহায্য নিবো। কেননা দীন ইলমের ক্ষেত্রে এগুলো আমাদের জন্য বিরাট সম্পদ এবং ইলমে ফিকহার বিরাট এক ভান্ডার। এগুলো থেকে যা দলীল মোতাবেক হয়, তা আমরা গ্রহণ করবো এবং যা দলীল বিরোধী হয়, তা বর্জন করবো। সালাফে সালেহীনগণ তাই করতেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিক কালে ইলম অর্জনে যেখানে মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনায় ভাটা পড়েছে, মূর্খতা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তাই মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা জরুরী। কড়াকড়ি ও শৈথিল্য প্রদর্শন করা যাবে না এবং বাড়াবাড়ি ও ঢিলামি করা যাবে না। আমরা আল্লাহর কাছে দু‘আ করি তিনি যেন, পথভ্রষ্ট মুসলিমদেরকে সঠিক পথ দেখান, তাদের ইমাম ও নেতাদেরকে হকের উপর দৃঢ়পদ রাখুন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা ও বান্দার আহবানে সাড়া দানকারী।
হারামকে হালাল করার ক্ষেত্রে এবং হালালকে হারাম করার ক্ষেত্রে আলেমদের আনুগত্য করা যেমন জায়েয নেই, তেমনি ইসলামী শরী‘আত বর্জন করে অন্য কিছু দিয়ে যেসব আমীর-উমারা ও শাসকগোষ্ঠি মানুষকে শাসন করে তাদের আনুগত্য করাও বৈধ নয়। সকল দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, পারস্পরিক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে এমনকি মানব জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের স্মরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক। এটিই একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত ও তাওহীদের দাবি। কেননা হুকুম-আহকাম ও বিধি-বিধান দেয়া একমাত্র আল্লাহর অধিকার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ﴾
‘‘জেনে রাখো, সৃষ্টি তারই এবং নির্দেশও তার’’। সূরা আল আরাফ:৫৪
অর্থাৎ আল্লাহই হুকুমকারী এবং হুকুম করার একমাত্র অধিকার তারই। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَمَا اخْتَلَفْتُمْ فِيهِ مِنْ شَيْءٍ فَحُكْمُهُ إِلَى اللَّهِ﴾
‘‘তোমরা যে বিষয়ে মতবিরোধ করো, তার ফায়সালা আল্লাহর নিকটেই’’। (সূরা শুরা: ১০)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا﴾
‘‘তোমরা যদি কেনো বিষয়ে মতবিরোধ করো, তাহলে বিতর্কিত বিষয়টি আল্লাহ এবং রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং পরকালের প্রতি ঈমান এনে থাক। আর এটাই কল্যাণকর এবং পরিণতির দিক দিয়ে উত্তম’’। (সূরা আন নিসা: ৫৯)
সুতরাং শুধু ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই নয়; বরং আল্লাহর শরী‘আত দিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করা একদিক থেকে যেমন প্রথম শ্রেণীর ইবাদত, অন্যদিকে এটি আল্লাহ তা‘আলার অধিকার এবং ইসলামী আকীদারও অন্তর্ভুক্ত।
সুতরাং শাসন ও বিচারকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যারা আল্লাহর শরী‘আত বাদ দিয়ে অন্যান্য রীতি-নীতি এবং মানুষের তৈরী প্রচলিত প্রথা ও আইন-কানুনের স্মরণাপন্ন হয়, তারা উপরোক্ত প্রচলিত প্রথা-রীতি-নীতি ও তা দিয়ে শাসনকারীদেরকে শরী‘আত প্রবর্তন ও হুকুম-আহকাম প্রণয়নের ক্ষেত্রে আল্লাহর শরীক নির্ধারণ করলো।[3]
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَمْ لَهُمْ شُرَكَاءُ شَرَعُوا لَهُم مِّنَ الدِّينِ مَا لَمْ يَأْذَن بِهِ اللَّهُ﴾
‘‘এদের কি এমন কিছু শরীক রয়েছে, যারা এদের জন্য দীনের এমন বিধি-বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছে আল্লাহ যার অনুমতি দেন নি?’’ (সূরা শুরা: ২১)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَإِنْ أَطَعْتُمُوهُمْ إِنَّكُمْ لَمُشْرِكُونَ﴾
‘‘কিন্তু যদি তোমরা তাদের আনুগত্য করো তাহলে অবশ্যই তোমরা মুশরিক হবে’’। (সূরা আনআম: ১২১)
যারা আল্লাহর শরী‘আত বাদ দিয়ে অন্যান্য আইন-কানুনের কাছে বিচার-ফায়ছালা নিয়ে যায়, তাদের থেকে আল্লাহ তা‘আলা ঈমান নাকোচ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آمَنُوا بِمَا أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَاءُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا أُوْلَئِكَ الَّذِينَ يَعْلَمُ اللَّهُ مَا فِي قُلُوبِهِمْ فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ وَعِظْهُمْ وَقُلْ لَهُمْ فِي أَنفُسِهِمْ قَوْلًا بَلِيغًا وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ وَلَوْ أَنَّهُمْ إِذْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ جَاءُوكَ فَاسْتَغْفَرُوا اللَّهَ وَاسْتَغْفَرَ لَهُمْ الرَّسُولُ لَوَجَدُوا اللَّهَ تَوَّابًا رَحِيمًا فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا﴾
‘‘তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তারা সে সমস্ত বিষয়ের উপর ঈমান এনেছে। তারা বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো সমাধানের জন্য তাগুতের কাছে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা ওকে মান্য না করে। পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে পথভ্রষ্ট করে ফেলতে চায়। আর যখন তুমি তাদেরকে বলবে, তোমরা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান এবং তার রসূলের দিকে এসো তখন তুমি মুনাফেকদিগকে দেখবে, ওরা তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ আরোপিত হয়, তখন কেমন হবে? অতঃপর তারা আল্লাহর নামে কসম খেয়ে ফিরে আসবে যে, কল্যাণ ও সমঝোতা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল না। এরা হলো সে সমস্ত লোক, যাদের মনের গোপন বিষয় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা অবগত। অতএব, তুমি ওদেরকে উপেক্ষা করো এবং ওদেরকে সদোপদেশ দিয়ে এমন কথা বলো, যা তাদের জন্য কল্যাণকর। বস্তুত আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়। আর সেসব লোক যখন নিজেদের অনিষ্ট সাধন করেছিল, তখন যদি তারা তোমার কাছে আসত অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করত এবং রসূলও যদি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতো, অবশ্যই তারা আল্লাহকে ক্ষমাকারী ও মেহেরবান রূপে পেত। অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবেনা, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কেনো রকম সংকীর্ণতা পাবেনা এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নিবে’’। (সূরা আন নিসা: ৬০-৬৫)
সুতরাং যারা মানুষের তৈরী আইন-কানুনের দিকে আহবান জানায়, তারা আনুগত্য এবং শরী‘আত প্রবর্তনের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করলো। আর যে ব্যক্তি এই মনে করে আল্লাহর নাযিল করা শরী‘আত পরিত্যাগ করে অন্যান্য আইন-কানুন দিয়ে শাসন করে যে, আল্লাহ তা‘আলার নাযিল করা শরী‘আতের চেয়ে এগুলোই ভালো অথবা মানুষের তৈরী আইন-কানুন ও রীতিনীতি আল্লাহর শরী‘আতের সমমর্যাদা সম্পন্ন অথবা আল্লাহর শরী‘আত বাদ দিয়ে অন্য কিছু দিয়ে শাসন করা জায়েয আছে, তাহলে সে কাফের হিসাবে গণ্য হবে। যদিও সে নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করে।
কেননা যারা আল্লাহ তা‘আলার শরী‘আত বর্জন করে অন্যান্য আইন-কানুনের কাছে বিচার-ফায়ছালা নিয়ে যায় এবং নিজেদেরকে মুমিন বলে দাবি করে, আল্লাহ তা‘আলা ঈমানের দাবিতে তাদেরকে মিথ্যুক বলেছেন। আল্লাহ তা‘আলার বাণী, يزعمون তাদের ঈমান নাকোচ হওয়ার দাবি করে। কেননা এ শব্দটি ঐ ব্যক্তির দিকে সম্বন্ধ করে বলা হয়, যে কোনো জিনিস দাবি করে, অথচ সে সেটাতে মিথ্যাবাদী। আর প্রচলিত আইন-কানুন দ্বারা বিচার-ফায়ছালা ও শাসন করা এবং তাগুতের কাছে বিচার-ফায়ছালার জন্য যাওয়া একই কথা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ﴾
‘‘যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল, যা বিচ্ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা আল বাকারা: ২৫৬)[4]
সুতরাং যারা মানুষের প্রচলিত আইন-কানুন দিয়ে শাসন করবে আর যারা মন খুলে খুশি হয়ে উত্তম মনে করে তার প্রতি অনুগত থাকবে তাদের কেউই তাওহীদপন্থী নয়। কেননা তারা শরী‘আত প্রবর্তন ও আনুগত্যের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অংশীদার সাব্যস্ত করেছে এবং যে তাগুতকে অস্বীকার করতে বলা হয়েছে, তা বর্জন করেনি। বরং সে শয়তানের আনুগত্য করেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا﴾
‘‘পক্ষান্তরে শয়তান তাদেরকে প্রতারিত করে বহুদূরের গোমরাহীতে নিক্ষেপ করতে চায়’’। সূরা আন নিসা:৬০।
আল্লাহ তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, মুনাফিকদেরকে যখন আল্লাহ তা‘আলার শরী‘আতের কাছে বিচার-ফায়ছালা নিয়ে যাওয়ার জন্য আহবান করা হয়, তখন তারা এদিকে আসতে অস্বীকার করে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে। এমনি তাদের বিকৃত স্বভাব এবং অন্তর নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে তারা ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করাকেই সংস্কার হিসাবে দেখে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَٰكِن لَّا يَشْعُرُونَ﴾
‘‘তাদেরকে যখন বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে, মূলত আমরাই সংশোধনকারী। সাবধান! এরাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী, তবে তারা এ ব্যাপারে সচেতন নয়’’। (সূরা আল বাকারা: ১১)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের নিকট বিচার-ফায়ছালা নিয়ে যাওয়া মুনাফেকদের কাজ। এটি পৃথিবীতে বিপর্যয়ের অন্যতম বৃহৎ কারণ।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় অধিকাংশ মুফাস্সির বলেন, রসূল প্রেরণ, শরী‘আতের হুকুম-আহকাম বর্ণনা এবং আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে পৃথিবীকে পরিশুদ্ধ করার পর তোমরা পাপাচার, সীমালংঘন, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের আনুগত্যের দিকে মানুষকে আহবান করার মাধ্যমে সেটাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। কেননা আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের দিকে আহবান করা এবং তার সাথে শিরক করা পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ ফাসাদ সৃষ্টি করার নামান্তর। প্রকৃতপক্ষে শিরক এবং আল্লাহ তা‘আলার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করার কারণেই পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। সুতরাং আল্লাহর সাথে শিরক করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের দিকে দাওয়াত দেয়া, আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে মাবুদ হিসাবে দাঁড় করানো এবং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কাউকে আনুগত্য ও অনুসরণ করার জন্য নির্ধারণ করাই পৃথিবীতে ফাসাদ ও ফিতনা সৃষ্টি হওয়ার কারণ। আল্লাহ তা‘আলাকে যতক্ষণ না একমাত্র মাবুদ হিসাবে গ্রহণ করা হবে, তার দিকেই কেবল আহবান না করা হবে এবং আনুগত্য ও অনুসরণ যখন একমাত্র রসূলের জন্যই না হবে ততোক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবী এবং এর অধিবাসীগণ পরিশুদ্ধ হবে না।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্যদের আনুগত্য করা কেবল তখনই ওয়াজিব হবে, যখন তারা রসূলের আনুগত্যের আদেশ দিবে। আর যখন তারা রসূলের নাফরমানী করা এবং তার শরী‘আতের বিরোধীতা করার আদেশ দিবে তখন তাদের কথা শ্রবণ করা যাবে না এবং তাদের আনুগত্যও করা যাবে না।
যে ব্যক্তি পৃথিবীর অবস্থা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, সে দেখতে পাবে যে, আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ, তার ইবাদত এবং তার রসূলের ইবাদতের কারণেই তা সংশোধন হয়েছে। আর সৃষ্টিজগতে যত অকল্যাণ, ফিতনা, বালা- মুছীবত, অনাবৃষ্টি, শত্রুদের বাড়াবাড়ি যুলুম ইত্যাদি রয়েছে তা রসূলের বিরুদ্ধচারণ, আল্লাহ এবং তার রসূল ব্যতীত অন্যের দিকে আহবান করার কারণেই হয়ে থাকে।
যেসব হুকুম-আহকাম ও বিচার-ফায়ছালা আল্লাহ তা‘আলার হুকুমের পরিপন্থী ও বিরোধী তাকে তিনি জাহেলীয়াতের হুকুম বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ﴾
‘‘তারা কি জাহেলী যুগের ফায়ছালা কামনা করে? বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ অপেক্ষা উত্তম ফায়ছালাকারী আর কে আছে?’’ (সূরা আল মায়েদা: ৫০)
ইমাম ইবনে কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলার হুকুম ও বিধানের মধ্যেই রয়েছে সমস্ত কল্যাণ এবং তাতেই রয়েছে সমস্ত অকল্যাণ থেকে নিরাপত্তা। যারা আল্লাহ তা‘আলার এসব কল্যাণকর হুকুম-আহকাম ও বিধি-নিষেধ থেকে সরে এসে বিভিন্ন মত, প্রবৃত্তি এবং আল্লাহর শরী‘আতের দলীল ছাড়াই মানুষের তৈরী বিভিন্ন পরিভাষার অনুসরণ করে আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিন্দা করেছেন। জাহেলী যুগের লোকেরা এসব অন্ধকারাচ্ছন্ন ও ভ্রান্ত মতবাদগুলো দিয়েই বিচার-ফায়ছালা করতো।
তাতারীরা চেঙ্গিস খানের তৈরী যেসব রীতিনীতি ও আইন-কানুন দ্বারা মুসলিম জনগণকে শাসন করেছিল, তাও জাহেলী যুগের রীতিনীতির মতোই ছিল। চেঙ্গিস খান তাতারীদের জন্য ‘আল-ইয়াসিক’ নামক একটি সংবিধান রচনা করেন। এটি হুকুম-আহকাম ও আইন-কানুন সম্বলিত এমন একটি কিতাব, যা বিভিন্ন শরী‘আত যেমন ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন কিতাব থেকে কিছু কিছু বিষয় গ্রহণ করে প্রস্ত্তত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে চেঙ্গিস খান নিজের নিজস্ব চিন্তা-গবেষণা এবং প্রবৃত্তির উপর ভিত্তি করেও তাতে অনেক আইন-কানুন যুক্ত করেছে। এ কিতাবটি তার ছেলেরা শরী‘আত হিসাবে গ্রহণ করে এবং সেটাকে আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাতের উপর প্রাধান্য দেয়। যে ব্যক্তি চেঙ্গিস খানের মতো কাজ করবে, সে কাফের বলে গণ্য হবে। এমন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হবে। যতক্ষণ না সে আল্লাহ এবং তার রসূলের হুকুমের দিকে ফিরে আসে এবং কম-বেশি সকল ক্ষেত্রেই আল্লাহর কিতাব ও রসূলের সুন্নাত দ্বারা বিচার-ফায়ছালা ও শাসন কার্য পরিচলনা করে।[5] ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের উক্তি এখানেই শেষ।
চলমান...
[1]. তিরমিযী, মুসনাদে আহমাদ। ইমাম তিরমিযী, হাদীছটি বর্ণনা করার পর হাসান বলেছেন। ইমাম আলবানী (রহি.) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। ইমাম তাবারানীও বিভিন্ন সনদে এই হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। দেখুন: গায়াতুল মুরাম, হাদীছ নং- ৬।
[2] . ছহীহ ও যঈফ সনদে এবং বিভিন্ন শব্দে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাসের এ আছারটি আলেমদের নিকট খুবই প্রসিদ্ধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথার উপরে অন্য কারো কথাকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর আছারটি এ কথাকেই শক্তিশালী করছে। ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু লোকদেরকে তামাত্তো হজ্জকে উত্তম বলতেন। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জের বছর সাহাবীদেরকে জোর দিয়ে তা করতে বলেছেন। তাকে যখন সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, এটি কি আমাদের জন্য খাস? নাকি কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের জন্য? তিনি বললেন, বরং সকল মানুষের জন্য। সুতরাং ইবনে আব্বাস এ ফতোয়াই প্রদান করতেন। ঐ দিকে আবু বকর ও উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা চাইতেন যে, লোকেরা হজ্জ এবং উমরা আলাদাভাবে করুক। এতে করে আল্লাহর ঘর আবাদ হবে বেশি এবং সবসময়ই কাবা শরীফে লোকের ভিড় থাকবে। সবসময়ই আল্লাহর এবাদত হবে। আর একই সফরে হজ্জের মৌসুমে দু’টি একসাথে করে ফেললে কাবাঘর খালি থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ বিষয়ে আবু বকর ও উমারের খেলাফ করতেন এবং তাদের কথা গ্রহণ করতে লোকদেরকে নিষেধ করতেন। তিনি বলতেন হজ্জ ও উমরা একসাথে করাই উত্তম। লোকেরা তাকে বললো, আপনি লোকদেরকে এমন কাজের আদেশ দিচ্ছেন, যা থেকে আবু বকর ও উমার নিষেধ করছেন। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমার আশঙ্কা হয় যে, তোমাদের উপর আসমান থেকে প্রস্তর বর্ষিত হবে। আমি বলছি, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আর তোমরা বলছো, আবু বকর বলেছেন এবং উমার বলেছেন
এখানে জেনে রাখা আবশ্যক যে, এ উম্মতের কেউই জ্ঞান-বুদ্ধিতে আবু বকর ও উমারের সমান নয়। তারা হজ্জ ও উমরা একসাথে করতে লোকদেরকে কেন মানা করতেন, তা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, লোকেরা এক সাথে হজ্জ ও উমরা করে নিলে অন্য সময় কাবা ঘরে লোকদের ভিড় থাকবে না। তাই হজ্জের মাসসমূহে যদি শুধু হজ্জ করা হয় এবং বছরের অন্যান্য সময় উমরা করা হয় তাহলে সারা বছরই কাবা আবাদ হবে এবং তাতে সবসময় লোকদের ভিড় থাকবে। লোকদেরকে তামাত্তো হজ্জ করতে নিষেধ করার মাধ্যমে তা হারাম করেননি। বরং তারা কেবল উত্তম মনে করতেন এবং মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিতেন। এতেই ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আমার আশঙ্কা হয় তোমাদের উপর আল্লাহর তরফ থেকে পাথর বর্ষণ করা হবে। কেননা তোমরা এমন কথা বলছো এবং এমন কাজ করছো যাতে তোমরা আসমান থেকে পাথর বর্ষণের শাস্তির যোগ্য হয়েছো। আমি বলছি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জ ও উমরা একসাথে করার আদেশ দিয়েছেন, আর তোমরা আবু বকর ও উমারের কথা টেনে এনে আমার কথার বিরোধীতা করছো।
আব্দুল্লাহ ইবনে আববাসের এ কথা থেকে বুঝা গেলো যে, কোনো মানুষের কথাকে আল্লাহর কথা কিংবা রাসূলের কথার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো যাবে না। সে যত বড় আলেমই হোক না কেন। ইবনে আববাসের কথাই সঠিক। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সীরাত ও সুন্নাত প্রমাণ করে যে, কোনো মানুষের কথা মানতে গিয়ে আল্লাহ ও তার রাসূলের আদেশের বিরুদ্বাচরণ করা যাবে না।
[3]. তবে সাধারণ মুসলিমদের উপর জোর পূর্বক মানব রচিত আইন চাপিয়ে দেয়া হলে তারা যদি অন্তর দিয়ে সেটাকে অপছন্দ ও ঘৃণা করে, চাপের মুখে তা মানতে বাধ্য হয় এবং না মানলে যুলুম-নির্যাতন ও জান-মাল, মান-ইজ্জত ইত্যাদির ক্ষতির আশঙ্কা করে তাহলে ঘৃণাসহকারে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তা মেনে নিলে কাফের হবে না।
[4]. মোটকথা তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কারো ইসলাম পরিশুদ্ধ হবে না। কালেমায়ে তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর মর্মার্থ এটিই। সুতরাং لاإله এ কথার মাধ্যমে আল্লাহর পরিবর্তে প্রত্যেক তাগুতের এবাদত করাকে অস্বীকার করা হয়েছে। আর إلا الله কালেমার এ অংশের মাধ্যমে এবাদতের ক্ষেত্রে কেবল আল্লাহর তাওহীদকে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾ ‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর এবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। সুতরাং আল্লাহর এবাদতকে একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তাগুতের এবাদতকে অন্য একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং একজন মানুষ কেবল তখনই মুসলিম বলে গণ্য হবে, যখন সে আল্লাহর এবাদত করবে এবং একই সাথে তাগুত থেকে দূরে থাকবে।
আর طاغوت শব্দের উৎপত্তি হয়েছে الطغيان থেকে। তাগুত বলা হয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে, যে অন্যায় ও বিদ্রোহে সীমালংঘন করে। আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ﴾ اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى ﴿ ‘‘এখন তুমি যাও ফেরাউনের কাছে। কেননা সে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে’’। (সূরা তোহা: ২৪) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
إِنَّا لَمَّا طَغَى الْمَاءُ حَمَلْنَاكُمْ فِي الْجَارِيَةِ
‘‘যখন পানি সীমা অতিক্রম করলো তখন আমি তোমাদেরকে জাহাজে আরোহন করিয়েছিলাম’’। (সূরা আল-হাক্কাহ: ১১) অর্থাৎ পানি যখন অত্যন্ত বেড়ে গেল। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,﴾ فَأَمَّا ثَمُودُ فَأُهْلِكُوا بِالطَّاغِيَةِ ﴿ ‘‘তাই সামূদ জাতিকে একটি সীমাহীন বিপদ দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে’’। (সূরা আলহাক্কাহ: ৫) অর্থাৎ বিকট ও ভয়াবহ একটি চিৎকারের মাধ্যমে। সুতরাং যে ব্যক্তি বা বিষয় সীমা অতিক্রম করে, তাকেই তাগুত বলা হয়। শয়তানকে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণে ও সীমালংঘন করার কারণে তাগুত বলা হয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যেসব মাবুদের এবাদত করা হয়, সেসব মাবুদ যদি উক্ত এবাদতের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে ওগুলোকে তাগুত বলা হয়। যাদুকর এবং গণক উভয়ই তাগুত। এমনি আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য প্রত্যেক মাবুদই তাগুত।
[5]. আমরা বহুবার উল্লেখ করেছি যে, কুরআন-সুন্নাহ এবং ইসলামী বই-পুস্তকের যেখানে যুদ্ধ-জিহাদ পরিচলনা করা, মৃত্যুদ- ও বিভিন্ন শাস্তির কথা বলা হয়েছে তা কার্যকর করার দায়িত্ব সাধারণ জনগোষ্ঠী, ব্যক্তি বিশেষ অথবা কোনো সংগঠনকে প্রদান করা হয়নি। তা কেবল মুসলিম শাসক, প্রশাসন ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাজ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং পরবর্তীতে ইসলামের স্বর্ণ যুগসমূহে মুসলিমদের কোনো জামা‘আত বা সাধারণ নাগরিক নিজেদের শাসক শ্রেণীকে ডিঙ্গিয়ে নিজস্ব ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে উপরোক্ত কাজগুলো করেননি। কুরআন-সুন্নাহয় এর সমর্থনে কোনো দলীলও নেই। এরূপ করা হলে কী ধরণের ক্ষতি হতে পারে তাও আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। সুতরাং বিষয়টি ভালো করে বুঝা উচিৎ।
আগের চলমান পাতার শেষ অংশ...
বর্তমানে অনেক মুসলিম দেশই প্রচলিত মানব রচিত রীতিনীতি, বিধি-বিধান ও প্রথাকেই আইনের উৎস হিসাবে নির্ধারণ করেছে এবং তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শুধু পারিবারিক জীবনের সাথে সংশিস্নষ্ট কিছু বিধি-বিধান বাকী রেখে ইসলামী শরী‘আতের বাকি সব হুকুম-আহকাম বাতিল করে দিয়েছে। এদের কাজ-কর্ম তাতারীদের মতোই। কুরআনের অনেক আয়াত এদের কাজকে কুফুরী প্রমাণ করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأُوْلَئِكَ هُمْ الْكَافِرُونَ﴾
যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান দিয়ে বিচার করে না, তারা কাফের। (সূরা আল মায়েদা: ৪৪)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً﴾
‘‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম! সে লোক ঈমানদার হবে না, যতোক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মনে করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নেবে’’। (সূরা আন নিসা: ৬৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَفَتُؤْمِنُونَ بِبَعْضِ الْكِتَابِ وَتَكْفُرُونَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَاءُ مَن يَفْعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمْ إِلَّا خِزْيٌ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰ أَشَدِّ الْعَذَابِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ﴾
‘‘তাহলে কি তোমরা কিতাবের একটি অংশের উপর ঈমান আনছো এবং অন্য অংশের সাথে কুফরী করছো? তোমাদের মধ্য থেকে যারাই এমনটি করবে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছিত হবে এবং আখিরাতে তাদেরকে কঠিনতম শাস্তির দিকে ফিরিয়ে দেয়া হবে? তোমাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে আল্লাহ বেখবর নন’’। (সূরা আল বাকারা: ৮৫)
আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, আকীদা ও দীন হিসাবে ইসলামী শরী‘আতকেই কবুল করে নেয়া আবশ্যক। মানব সমাজে শুধু ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই নয়; বরং আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত মনে করেও কুরআন ও সুন্নাহর হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক।
সুতরাং বান্দার উপর আল্লাহর বিধান কবুল করে নেয়া অপরিহার্য। এটি তার পক্ষে যাক অথবা বিপক্ষে যাক। এতে তার প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ হোক বা না হোক।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لاَ يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً﴾
‘‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম! সে লোক ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক হিসাবে মেনে নিবে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোনো রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নেবে’’। সূরা আন নিসা: ৬৫।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمْ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا﴾
‘‘আল্লাহ এবং তার রসূল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার অধিকার নেই। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তার রসূলের বিরোধীতা করবে, সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে পতিত হবে’’। (সূরা আহযাব: ৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَإِن لَّمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾
‘‘এখন যদি তারা তোমার ডাকে সাড়া না দেয়, তাহলে জেনে রেখো, তারা আসলে নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হিদায়াত ছাড়াই নিছক নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তার চেয়ে বড় পথভ্রষ্ট আর কে হবে? আল্লাহ এ ধরনের যালেমদেরকে কখনো সঠিক পথ প্রদর্শন করেন না’’। (সূরা আল কাসাস: ৫০)
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ
‘‘তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত আদর্শের অধীন হয়’’।[6]
ইমাম ইবনে রজব রহিমাহুল্লাহ বলেন, হাদীছের অর্থ হলো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পক্ষ হতে যেসব আদেশ-নিষেধ এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে এসেছেন, তার প্রতি বান্দার পছন্দ ও ভালোবাসা অনুগত না হলে সে কখনো পরিপূর্ণ ঈমানদার হতে পারবে না।
সুতরাং বান্দার উপর আবশ্যক হলো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা করার আদেশ করেছেন, তাকে ভালোবাসবে এবং রসূল যে কাজ করতে নিষেধ করেছেন, তাকে অপছন্দ করবে। এ অর্থে কুরআনের অনেক আয়াত রয়েছে। সেখানে আল্লাহ তা‘আলা ঐসব লোকের নিন্দা করেছেন, যারা আল্লাহ তা‘আলার পছন্দনীয় বিষয়কে অপছন্দ করে এবং তার অপছন্দনীয় জিনিসগুলোকে পছন্দ করে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمُ اتَّبَعُوا مَا أَسْخَطَ اللَّهَ وَكَرِهُوا رِضْوَانَهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ﴾
‘‘এটি এ জন্য যে, যা আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে তারা তার অনুসরণ করেছে এবং তার সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করেছে। এ কারণে তিনি তাদের সব কাজ-কর্ম বরবাদ করে দিয়েছেন’’। (সূরা মুহাম্মাদ: ২৮)
ইবনে রজব রহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের একাধিক স্থানে মুশরিকদেরকে প্রবৃত্তির অনুসরণকারী হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَإِن لَّمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ﴾
‘‘এখন তারা যদি তোমার ডাকে সাড়া না দেয়, তাহলে জেনে রেখো, তারা আসলে নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হিদায়াত ছাড়াই নিছক নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে তার চেয়ে বড় পথভ্রষ্ট আর কে হবে? নিশ্চয় আল্লাহ যালেমদেরকে কখনো হিদায়াত করেন না’’। (সূরা কাসাস: ৫০)
শরী‘আতের উপর নিজস্ব প্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দেয়া থেকেই যেহেতু বিদআতের সূচনা হয়, তাই বিদআতীদেরকেও আহলুল আহওয়া তথা প্রবৃত্তির পূজারী বলা হয়। ঠিক এমনি আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা ও তিনি যা ভালোবাসেন তার উপর প্রবৃত্তির চাহিদাকে প্রাধান্য দেয়া থেকেও পাপাচারের উৎপত্তি হয়।
অতএব মানুষকে ভালোবাসার ক্ষেত্রেও খেয়াল রাখতে হবে, তা যেন রসূলের আনীত দীন ও সুন্নাতের অনুগামী হয়। সুতরাং মুমিনদের উপর আবশ্যক হলো, আল্লাহ তা‘আলা যাদেরকে ভালোবাসেন, তারা যেন তাদেরকে ভালোবাসে। তারা যেন ফেরেশতা, নবী-রসূল, সিদ্দীকীন, শহীদগণ এবং সকল সৎকর্মশীল ব্যক্তিদেরকে ভালোবাসে। ইবনে রজব রাহিমাহুল্লাহর কথা এখানেই শেষ।
[6]. ইমাম আলবানী (রহি.) হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। তবে তার মর্মার্থ সঠিক। দেখুন: শাইখের তাহকীকসহ ‘মিশকাতুল মাসাবীহ’, হা/১৬৭।