লগইন করুন
আলেমগণ যেভাবে ভয়ের সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন, তা হলো সম্ভাব্য কিংবা নিশ্চিত কোনো লক্ষণ থেকে অপ্রিতিকর কিছু হওয়ার আশঙ্কা করাকে ভয় বলা হয়। ভয় তিন প্রকার।
প্রথম প্রকার ভয়: গোপন ভয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য জিনিস যেমন মূর্তি, তাগুত, মৃত ব্যক্তি, গায়েবী জগতের জিন কিংবা অনুপস্থিত মানুষের পক্ষ থেকে অপ্রিয় কিছু হওয়ার আশঙ্কা করার নাম ভয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা হুদ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় সম্পর্কে বলেন যে, তারা হুদকে বলেছিল,
﴿إِن نَّقُولُ إِلَّا اعْتَرَاكَ بَعْضُ آلِهَتِنَا بِسُوءٍ قَالَ إِنِّي أُشْهِدُ اللَّهَ وَاشْهَدُوا أَنِّي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُون مِن دُونِهِ فَكِيدُونِي جَمِيعًا ثُمَّ لَا تُنظِرُونِ﴾
আমরা তো মনে করি তোমার উপর আমাদের কোনো দেবতার অভিশাপ পড়েছে। হুদ বললো, আমি আল্লাহকে সাক্ষী করছি এবং তোমরা সাক্ষী থাকো। তোমরা যে শিরক করছো, নিশ্চিতভাবে আমি তা থেকে মুক্ত। সুতরাং আল্লাহকে ছেড়ে তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করো। অতঃপর আমাকে সামান্য অবকাশও দিয়ো না। (সূরা হুদ: ৫৪-৫৫)
মক্কার মুশরিকরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তাদের মূর্তিদের ভয় দেখিয়েছিল। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِن دُونِهِ
‘‘এসব লোক তোমাকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদের ভয় দেখায়’’। (সূরা আয যুমার: ৩৬)
বর্তমান সময়ের কবর পূজারী এবং মূর্তিপূজকরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে এ ধরণের ভয় করে থাকে। তারা কবরকে ভয় করে। তাওহীদপন্থী যেসব লোক কবর পূজার প্রতিবাদ করে এবং ইখলাসের সাথে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করার আদেশ দেয় তাদেরকেও কবর পূজারীরা কবর ও কবরে দাফনকৃত অলী-আওলীয়াদের ভয় দেখায়।
এ শ্রেণীর ভয় তথা গোপন ভয় গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। এ শ্রেণীর ভয় একমাত্র আল্লাহকেই করা আবশ্যক।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾
‘‘এ হলো শয়তান, সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়। সুতরাং তোমরা যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে থাক তাহলে তাদেরকে ভয় করো না; বরং আমাকেই ভয় করো’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৭৫)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِ﴾ কাজেই তোমরা তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো’’। (সূরা আল মায়িদা: ৩)
এ ভয় দীনের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম স্তরের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যকে এ শ্রেণীর ভয় করবে, আল্লাহর সাথে বড় শিরকে লিপ্ত হবে। আমরা এ থেকে আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
দ্বিতীয় প্রকার ভয়: ভয়ের আরেকটি প্রকার হলো মানুষের ভয়ে কিছু ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয়া। এটি হারাম ও ছোট শিরক। আল্লাহ তা‘আলার নিম্নের বাণীতে এ শ্রেণীর ভয়ের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿الَّذِينَ قَالَ لَهُمُ النَّاسُ إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ فَزَادَهُمْ إِيمَانًا وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ فَانقَلَبُوا بِنِعْمَةٍ مِّنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ لَّمْ يَمْسَسْهُمْ سُوءٌ وَاتَّبَعُوا رِضْوَانَ اللَّهِ وَاللَّهُ ذُو فَضْلٍ عَظِيمٍ إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ﴾
‘‘যাদেরকে লোকেরা বলেছে যে, তোমাদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য লোকেরা বহু সাজ-সরঞ্জাম সমবেত করেছে। সুতরাং তাদের ভয় করো। তখন তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায় এবং তারা বলে, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট, তিনিই সর্বোত্তম কর্ম সম্পাদনকারী। অবশেষে তারা ফিরে এলো আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহ সহকারে। তাদের কোনো রকম ক্ষতি হয়নি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর চলার সৌভাগ্যও তারা লাভ করলো। আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহকারী। এ হলো শয়তান, সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়। সুতরাং তোমরা যদি প্রকৃত মুমিন হয়ে থাক তাহলে তাদেরকে ভয় করোনা; বরং আমাকেই ভয় করো’’। (সূরা আলে- ইমরান: ১৭৩-১৭৫)
ইবনে মাজাহ গ্রন্থে আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে এ ভয়ের কথাই এসেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
لَا يَحْقِرْ أَحَدُكُمْ نَفْسَهُ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، كَيْفَ يَحْقِرُ أَحَدُنَا نَفْسَهُ؟ قَالَ: يَرَى أَمْرًا، لِلَّهِ عَلَيْهِ فِيهِ مَقَالٌ، ثُمَّ لَا يَقُولُ فِيهِ، فَيَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ: مَا مَنَعَكَ أَنْ تَقُولَ فِي كَذَا وَكَذَا؟ فَيَقُولُ: خَشْيَةُ النَّاسِ، فَيَقُولُ: فَإِيَّايَ كُنْتَ أَحَقَّ أَنْ تَخْشَى
‘‘তোমাদের কেউ যেন নিজেকে লাঞ্চিত না করে। সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রসূলাল্লাহ! কিভাবে আমাদের কেউ নিজেকে লাঞ্ছিত করতে পারে? তিনি বললেন, বান্দা কখনো এমন অন্যায় কাজ দেখে, যার প্রতিবাদ করা কেবল আল্লাহ তা‘আলার জন্যই তার উপর আবশ্যক। অথচ সে তার প্রতিবাদ করে না। আল্লাহ তা‘আলা তাকে কিয়ামতের দিন বলবেন, অমুক অমুক অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে কিসে তোমাকে বারণ করলো? বান্দা বলবে, মানুষের ভয়। আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, কেবল আমাকেই ভয় করা তোমার উপর আবশ্যক ছিল’’।[1]
তৃতীয় প্রকার ভয়: আরেক প্রকার ভয় রয়েছে, যা সৃষ্টিগত ও স্বভাবগত ভয়। শত্রুর ভয়, হিংস্র জীব-জন্তুর ভয় এবং এ ধরণের অন্যান্য ভয়। এ জাতিয় ভয় দোষনীয় নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালামের ঘটনাতে বলেন,
﴿فَخَرَجَ مِنْهَا خَائِفًا يَتَرَقَّبُ قَالَ رَبِّ نَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ﴾
‘‘এ খবর শুনতেই মূসা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে শহর থেকে বেরিয়ে পড়লো এবং সে বললো, হে আমার রব! আমাকে যালেমদের হাত থেকে বাঁচাও’’। (সূরা আল ক্বছাছ:২১)
উপরোক্ত তিন প্রকার ভয়ের মধ্যে প্রথমটি তথা গোপন ভয় সর্ববৃহৎ একটি ইবাদত। সুতরাং ইখলাসের সাথে এ শ্রেণীর ভয় কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করা আবশ্যক। এমনি দ্বিতীয় প্রকার ভয় ইবাদতের অন্যতম হক এবং সেটার পরিপূরক। আল্লাহ তা‘আলার বাণী,
﴿إِنَّمَا ذَلِكُمُ الشَّيْطَانُ يُخَوِّفُ أَوْلِيَاءَهُ﴾
‘‘এ হলো শয়তান, সে তোমাদেরকে তার বন্ধুদের ভয় দেখায়। সূরা আলে ইমরান: ১৭৫ অর্থাৎ সে তার বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়।
﴿فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ﴾
‘‘সুতরাং তাদেরকে ভয় করো না; বরং আমাকেই ভয় করো।’’ সূরা আলে ইমরান: ১৭৫
আল্লাহ তা‘আলা এখানে মুমিনদেরকে তাকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করতে নিষেধ করেছেন এবং তাদের ভয়কে কেবল আল্লাহর সাথেই সীমিত রাখার আদেশ করেছেন। সুতরাং তারা যখন ইখলাসের সাথে আল্লাহকেই ভয় করবে এবং সকল প্রকার ইবাদত কেবল তার জন্যই সম্পন্ন করবে, তখন তিনি উদ্দেশ্য পূরণ করবেন এবং তাদেরকে ভয়-ভীতি হতে নিরাপত্তা দান করবেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِن دُونِهِ﴾
‘‘আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? এসব লোক তোমাকে আল্লাহর পরিবর্তে অন্যদের ভয় দেখায়’’। (সূরা আয যুমার: ৩৬)
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহর দুশমন ইবলীসের অন্যতম কৌশল হচ্ছে, সে মুমিন বান্দাদেরকে তার সৈনিক ও বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়। এভাবে ভয় দেখায়, তারা যেন তার দোসরদের বিরুদ্ধে জিহাদ না করে, তাদেরকে সুপথে আসার আদেশ না দেয় এবং অন্যায় কাজের প্রতিবাদ না করে। আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, এটি হচ্ছে শয়তানের কলাকৌশল। সে মুমিনদেরকে তার বন্ধুদের দ্বারা ভয় দেখায়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তার বন্ধুদেরকে ভয় করতে নিষেধ করেছেন। সুতরাং যখন বান্দার ঈমান শক্তিশালী হবে, তখন তার অন্তর থেকে শয়তানের বন্ধুদের ভয় দূর হয়ে যাবে। অপর দিকে যখনই তার ঈমান দুর্বল হবে, তখনই শয়তানের বন্ধুদের ভয় তার অন্তরে বৃদ্ধি পাবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّمَا يَعْمُرُ مَسَاجِدَ اللَّهِ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَأَقَامَ الصَّلَاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ فَعَسَىٰ أُولَٰئِكَ أَن يَكُونُوا مِنَ الْمُهْتَدِينَ﴾
‘‘তারাই হতে পারে আল্লাহর মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণকারী ও সেবক, যারা আল্লাহর প্রতি ও পরকালে প্রতি ঈমান আনে, সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না। তাদেরই ব্যাপারে আশা করা যেতে পারে যে, তারা সঠিক সোজা পথে চলবে’’। (সূরা তাওবা: ১৮)
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, আল্লাহর ঘর মসজিদসমূহ কেবল তারাই আবাদ করবে, যারা অন্তর দিয়ে আল্লাহর প্রতি ও পরকালের প্রতি ঈমান আনয়নের সাথে সাথে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে আমল করে এবং ইখলাসের সাথে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকেই ভয় করে। মসজিদসমূহের তত্ত্বাবধানে মুশরিকদের অধিকার খর্ব করার পর আল্লাহ তা‘আলা সেটা মুমিনদের জন্য সাব্যস্ত করেছেন। কেননা মসজিদের তত্ত্বাবধান করার বিষয়টি এমন যে, আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করা ও সৎকাজে আত্মনিয়োগ করা ব্যতীত তা সম্পন্ন হয় না।
মুশরিকরা যদিও ভালো আমল করে, কিন্তু তাদের আমলগুলোর উপমা হলো পানিহীন মরু প্রান্তরের মরীচিকার মতো। তৃষ্ণার্ত পথিক তাকে পানি মনে করেছিল, কিন্তু ওখানে পৌঁছে সে কিছুই পেলো না অথবা তাদের আমলগুলো ঠিক ছাই এর মতো, যা ঝড়ের দিনে বাতাস প্রচ- বেগে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তারা নিজেদের কৃতকর্মের কোনই ফল লাভ করতে পারবে না।
যে আমলের অবস্থা ঠিক এ রকমই, সেটা থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। ইখলাসের উপর ভিত্তিশীল সৎআমল ও তাওহীদ ব্যতীত এবং শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার মুক্ত সহীহ আকীদা ব্যতীত মসজিদগুলোর সঠিক আবাদ হয় না। ইট, টালি ইত্যাদি দিয়ে জাঁকজমক ও সুসজ্জিত করে বড় আকারের মসজিদ বানালেই সেটা আবাদ হয়ে যায় না অথবা কবরের উপর মজবুতভাবে মসজিদ তৈরী করার মাধ্যমেই সেটা আবাদ হয় না। যারা এ কাজ করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের উপর লা’নত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার বাণী, وَلَمْ يَخْشَ إِلَّا اللَّهَ ‘‘আল্লাহ কে ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না’’ সূরা আত তাওবা: ১৮
-ইবনে আতীয়া এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে তা’যীম, ইবাদত এবং আনুগত্যের ভয় উদ্দেশ্য। তবে মানুষ দুনিয়ার ক্ষয়-ক্ষতির যেসব আশঙ্কা করে তাতে কোনো দোষ নেই।
আমীর মুআবীয়া আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার কাছে একটি বার্তা লিখে তাতে কিছু উপদেশ প্রার্থনা করলেন। আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে উদ্দেশ্য করে তিনি লিখলেন, তিনি যেন তার জন্য কিছু উপদেশ লিখে পাঠান এবং বেশী দীর্ঘ না করেন। সুতরাং তিনি এই চিঠি লিখলেন,
إِلَى مُعَاوِيَةَ سَلَامٌ عَلَيْكَ أَمَّا بَعْدُ فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ الْتَمَسَ رِضَا اللَّهِ بِسَخَطِ النَّاسِ كَفَاهُ اللَّهُ مُؤْنَةَ النَّاسِ وَمَنْ الْتَمَسَ رِضَا النَّاسِ بِسَخَطِ اللَّهِ وَكَلَهُ اللَّهُ إِلَى النَّاسِ وَالسَّلَامُ
‘‘মুআবীয়ার আমার এ পত্র। আপনার প্রতি সালাম। অতঃপর আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি মানুষকে রাগান্বিত করে হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করে, তার জন্য মানুষের মুকাবেলায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে, আল্লাহ তাকে মানুষের কাছে সোপর্দ করে দেন। আপনার প্রতি সালাম’’। আবু নুআইম হিলইয়াতুল আওলীয়ায় এবং ইবনে হিববান তার সহীহ গ্রন্থে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তবে ইবনে হিববান ও আবু নুআইমের শব্দগুলো এ রকম,
مَنِ الْتَمَسَ رِضَا اللَّهِ بِسَخَطِ النَّاسِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ وَأَرْضَى عَنْهُ النَّاسَ وَمَنِ الْتَمَسَ رِضَا النَّاسِ بِسَخَطِ اللَّهِ سَخِطَ اللَّهُ عَلَيْهِ وَأَسْخَطَ عَلَيْهِ النَّاسَ
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে নারাজ করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করে দেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহও অসন্তুষ্ট হন এবং মানুষকেও তার প্রতি অসন্তুষ্ট করে দেন’’।[2]
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ বলেন, আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা মুআবীয়ার নিকট যে চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলেন, তা মারফু হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। মারফু বর্ণনার শব্দগুলো ঠিক এ রকম,
مَنْ أَرْضَى اللَّهَ بِسَخَطِ النَّاس كَفَاهُ مَؤُنَةَ النَّاسَ ومَنْ أَرْضَى النَّاسَ بِسَخَطِ اللَّهِ لَمْ يَغْنُوا عَنْهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, তার জন্য মানুষের মুকাবেলায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করে মানুষেরা আল্লাহর মুকাবেলায় তার কোনো উপকারে আসবে না’’। আর মাউকুফ বর্ণনার শব্দগুলো হচ্ছে এ রকম,
من أرضى الله بسخط الناس رضي الله عنه وأرضى عنه الناس ومن أرضى الناس بسخط الله عاد حامده من الناس له ذاما
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহর সন্তুষ্টি চায়, তার উপর আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন, আর মানুষকেও তার প্রতি সন্তুষ্ট করেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, মানুষের মধ্য হতে তার প্রশংসাকারীরাই নিন্দুকে পরিণত হয়’’।
এটি দীনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে হলেও আল্লাহকে সন্তুষ্ট করবে, সে মুত্তাকী এবং আল্লাহর সৎ বান্দা হতে পারবে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন। বান্দার জন্য আল্লাহ তা‘আলাই যথেষ্ট।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنْ يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَهُ مَخْرَجًا (২) وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لَا يَحْتَسِبُ﴾
‘‘আর যে আল্লাহ্কে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্যে নিষ্কৃতির পথ করে দেন এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক প্রদান করেন’’। (সূরা তালাক: ২-৩)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার উপর থেকে মানুষের কষ্ট দূর করবেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর যারা আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে যায়, তাদের মনে রাখা উচিত যে সমস্ত মানুষ তার উপর সন্তুষ্ট নাও হতে পারে। তবে তারা যখন তার পক্ষ হতে সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে, কোনো প্রকার অসুবিধা অনুভব করবে না এবং নিশ্চিতভাবে তার পক্ষ থেকে শুভ পরিণাম আশা করবে, তখন কেবল তারা সন্তুষ্ট থাকবে। এর ব্যতিক্রম ঘটলেই তারা অসন্তুষ্ট হবে ও বিদ্রোহ করবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী,
ومَنْ أَرْضَى النَّاسَ بِسَخَطِ اللَّهِ لَمْ يَغْنُوا عَنْهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে, তার জন্য মানুষের মুকাবেলায় আল্লাহই যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষকে সন্তুষ্ট করে মানুষেরা আল্লাহর মুকাবেলায় তার কোনে উপকারে আসবে না’’।[3]
কিয়ামতের দিন যালেমরা রাগে-গোস্বায় তাদের হস্তদ্বয় কামড়াতে থাকবে। তারা বলবে, হায় আফসোস আমরা যদি রসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! হায় আফসোস! আমরা যদি অমুককে বন্ধু না বানাতাম!
যে ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে মানুষের সন্তুষ্টি চায়, মানুষের মধ্য হতে তার প্রশংসাকারীরাই তার নিন্দুকে পরিণত হয়। এ রকমই হয়ে থাকে। কেননা যা আল্লাহর জন্য করা হয় সেটা স্থায়ী হয় আর যা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য করা হয় তা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্যই হয়ে থাকে। কিন্তু প্রথমেই সেটা তাদের মর্জি মোতাবেক অর্জিত হয় না। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়ার কথা এখানেই শেষ।
বিভিন্নভাবে বর্ণিত এ হাদীছে সুস্পষ্ট হয়ে গেল, যে ব্যক্তি তার কাজের মাধ্যমে মানুষকে অসন্তুষ্ট করে হলেও আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করবে সে দু’টি বড় ধরণের কল্যাণ অর্জন করবে। একটি হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি এবং অন্যটি মানুষের সন্তুষ্টি। বিপরীত পক্ষে যে ব্যক্তি তার কাজের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে নাখোশ করে মানুষের সন্তুষ্টি তালাশ করবে, সে দু’টি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। আল্লাহর অসন্তুষ্টি এবং মানুষের অসন্তুষ্টি। এতে বুঝা গেল যে, আল্লাহ তা‘আলাকে সন্তুষ্টি করতে পারলেই সমস্ত কল্যাণ অর্জিত হয়। আল্লাহকে নাখোশ করে মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন করতে গেলেই সব ধরণের অকল্যাণ হয়। আমরা আল্লাহ তা‘আলার দয়া ও শান্তি কামনা করছি।
এখানে জেনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা‘আলার ভয়ের সাথে আশা-আকাঙ্খা ও ভালোবাসা মিশ্রিত হওয়া চাই। ভয় যেন এমন না হয়, বান্দা আল্লাহর রহমত থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হবে। মুমিন বান্দা ভয় ও আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আল্লাহর কাছে যাবে। সবসময় তার মনে আল্লাহর আযাবের ভয় এবং তার রহমতের আশা রাখবে। শুধু এমন ভয় নিয়ে আল্লাহর দিকে যাবে না যে, নিজেকে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ করবে। শুধু এমন আশা-আকাঙ্খা নিয়েও যাবে না যে, আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ মনে করবে। কেননা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া এবং তার পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করা তাওহীদের পরিপন্থী।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَأَمِنُوا مَكْرَ اللَّهِ فَلَا يَأْمَنُ مَكْرَ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْخَاسِرُونَ﴾
তারা কি আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে? ক্ষতিগ্রস্থ সম্পদ্রায় ছাড়া আল্লাহর পাকড়াও থেকে কেউ নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবতে পারে না। (সূরা আল আরাফ: ৯৯)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَا تَيْأَسُوا مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ﴾
‘‘আল্লাহর রহমত থেকে তোমরা নিরাশ হয়ো না। তার রহমত থেকে তো একমাত্র কাফেররাই নিরাশ হয়’’। (সূরা ইউসুফ: ৮৭)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَمَنْ يَقْنَطُ مِنْ رَحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُّونَ﴾
‘‘একমাত্র পথভ্রষ্ট লোকেরা ব্যতীত স্বীয় রবের রহমত থেকে আর কে নিরাশ হতে পারে’’? (সূরা হিজর: ৫৬)
ইসমাঈল ইবনে রাফে রহিমাহুল্লাহ বলেন, বান্দা পাপ কাজের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকেও আল্লাহর ক্ষমার আশা করা তার পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করার আলামত। আলেমগণ বলেন, القنوط অর্থ হলো দুঃখ-কষ্ট ও বিপদাপদ দূর হওয়া অসম্ভব মনে করা। এটি আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করার বিপরীত। এই উভয় অবস্থাতেই বিরাট গুনাহ রয়েছে।
মুমিনদের জন্য শুধু ভয়ের উপর বিদ্যমান থাকা জায়েয নয়। এতে করে আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনি শুধু আশা-আকাঙ্খার উপরও বিদ্যমান থাকা জায়েয নয়। এতে আল্লাহর আযাব হতে নিজেকে নিরাপদ মনে করতে পারে। সুতরাং বান্দা একই সঙ্গে ভীত-সন্ত্রস্ত ও আশাবাদী থাকবে। আল্লাহর আযাবের ভয় করবে, তার আনুগত্য করবে এবং আল্লাহর রহমতের আশা করবে।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা আম্বীয়ার ৯০ নং আয়াতে বলেন,
﴿إِنَّهُمْ كَانُوا يُسَارِعُونَ فِي الْخَيْرَاتِ وَيَدْعُونَنَا رَغَبًا وَرَهَبًا وَكَانُوا لَنَا خَاشِعِينَ﴾
‘‘তারা সৎকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তারা আশা-আকাঙ্খা ও ভয়-ভীতি সহকারে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার কাছে বিনীত’’।
আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا﴾
‘‘এ সব লোকেরা যাদেরকে ডাকে তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় উসীলার অনুসন্ধান করে, তাদের মধ্য হতে কে সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী? তারা তার রহমতের আশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয় তোমার পালনকর্তার শাস্তি ভয়াবহ’’। (সূরা ইসরা: ৫৭)
সুতরাং ভয়-ভীতি ও আশা-আকাঙ্খা যখন একত্রিত হবে, তখন ভয় মিশ্রিত আশা বান্দাকে আমলের দিকে ধাবিত করে এবং উপকারী মাধ্যম গ্রহণ করার প্রতি উৎসাহ যোগায়। কেননা বান্দা আল্লাহর রহমত ও ছাওয়াবের আশা নিয়ে সৎকাজ সম্পন্ন করে এবং আল্লাহর আযাবের ভয়ের কারণেই বান্দা পাপাচার ও নাফরমানী ছেড়ে দেয়। কিন্তু বান্দা যখন আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হবে, তখন সৎ আমল ছেড়ে দিবে আর যখন আল্লাহর আযাব ও শাস্তি থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে, তখন পাপাচারের দিকে ধাবিত হবে। কোনো কোনো আলেম বলেন, যে ব্যক্তি শুধু ভালোবাসা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে সুফী বলে গণ্য হবে। যে ব্যক্তি শুধু ভয় নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে খারেজী। যে শুধু আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে মুর্জীয়া। আর যে ভালোবাসা, ভয়-ভীতি, এবং আশা-আকাঙ্খা নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করবে, সেই প্রকৃত মুমিন।
আল্লাহ তা‘আলা তার সর্বোত্তম বান্দাকে উপরোক্ত বিশেষণে বিশেষিত করেছেন,
﴿أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ﴾
‘‘এ সব লোক যাদেরকে ডাকে তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় উসীলার অনুসন্ধান করে, তাদের মধ্য হতে কে সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী? তারা তার রহমতের আশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে’’। (সূরা ইসরা: ৫৭)
যারা ভয়ের দিকটির প্রতি অবহেলা করে পাপাচারের দিকে ধাবিত হয় এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা এভাবে বিশেষিত করেছেন যে, তারাই ক্ষতিগ্রস্থ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَفَأَمِنَ أَهْلُ الْقُرَىٰ أَن يَأْتِيَهُم بَأْسُنَا بَيَاتًا وَهُمْ نَائِمُونَ أَوَأَمِنَ أَهْلُ الْقُرَىٰ أَن يَأْتِيَهُم بَأْسُنَا ضُحًى وَهُمْ يَلْعَبُونَ أَفَأَمِنُوا مَكْرَ اللَّهِ فَلَا يَأْمَنُ مَكْرَ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْخَاسِرُونَ﴾
‘‘জনপদের লোকেরা কি ভয় করে না যে, আমার শাস্তি তাদের উপর আসবে রাত্রিকালে যখন তারা থাকবে নিদ্রামগ্ন? অথবা জনপদবাসী কি নির্ভয় হয়ে গেছে যে, আমার শাস্তি তাদের উপর এসে পড়বে দিনের প্রথম ভাগে, যখন তারা খেলা ধুলায় মেতে থাকবে? তারা কি আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে? ক্ষতিগ্রস্থ সম্পদ্রায় ছাড়া আল্লাহর পাকড়াও থেকে কেউ নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবতে পারে না’’। (সূরা আরাফ: ৯৭-৯৯)
আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা হলো, আল্লাহ তা‘আলা রসূলদের প্রতি অবিশ্বাসী, কুফুরী ও পাপাচারে সীমালংঘনকারী জনপদবাসীদের অবস্থা বর্ণনা করার পর বলেছেন যে, আল্লাহর ধরপাকড় থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করা এবং তার শাস্তির ভয় না করাই তাদেরকে উপরোক্ত পাপাচারের দিকে ধাবিত করেছে। আল্লাহ তা‘আলার কৌশল হলো, বান্দা যখন তার অবাধ্য হয় ও তাকে ক্রোধান্বিত করে তিনি তখন বান্দাকে অনেক নিয়ামত দান করেন। বান্দা এতে মনে করে আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন। অথচ এটি ছিল আল্লাহর পক্ষ হতে তাকে অবকাশ দেয়া মাত্র। কাফেররা যখন আল্লাহর নিয়ামত ও সুখ-শান্তি পেয়ে নিজেদেরকে আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ মনে করেছে এবং তাদের কাছে প্রেরিত রসূলদের অবাধ্য হয়েছে ও পাপাচারে সীমালংঘন করেছে তখন তিনি তাদেরকে ধ্বংস করেছেন।
তাদের পরে আগমনকারীদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সতর্ক করেছেন। তারা যেন পূর্বেকার সীমালংঘনকারী জাতির মত অপরাধ করে তাদের মতো আযাবের কবলে না পড়ে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَوَلَمْ يَهْدِ لِلَّذِينَ يَرِثُونَ الْأَرْضَ مِن بَعْدِ أَهْلِهَا أَن لَّوْ نَشَاءُ أَصَبْنَاهُم بِذُنُوبِهِمْ وَنَطْبَعُ عَلَىٰ قُلُوبِهِمْ فَهُمْ لَا يَسْمَعُونَ﴾
‘‘পৃথিবীর কোনো অংশের অধিবাসীদের ধ্বংসের পর যারা তার উত্তরাধিকারী হয়েছে, তাদের নিকট এটা কি প্রতিয়মান হয়নি যে, আমি চাইলে তাদের অপরাধের কারণে তাদেরকে পাকড়াও করতে পারি এবং আমি তাদের অন্তরে মোহর মেরে দিতে পারি। ফলে তারা কিছুই শুনবে না’’। (সূরা আরাফ: ১০০)
কতিপয় আলেম বলেন, নিম্নের বিষয়গুলো বান্দার অন্তরে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করে।
(১) অপরাধ ও সেটার কদর্যতা সম্পর্কে জানা।
(২) পাপাচারীদের ব্যাপারে কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত শাস্তির প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং এটি অবগত হওয়া যে আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক পাপাচারের শাস্তি নির্ধারণ করেছেন।
(৩) বান্দার অন্তরে এ অনুভূতি জাগ্রত হওয়া যে, পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তির তাওবা করার সুযোগ নাও হতে পারে এবং পাপাচারে লিপ্ত হলে তার মাঝে ও তাওবার মাঝে আবরণ পড়ে যেতে পারে। পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে এ তিনটি বিষয় বান্দার অন্তরে ভয় ঢুকায়। আর পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার পর এ তিনটি বিষয় বান্দার অন্তরে আরো প্রবলভাবে ভয়ের সঞ্চার করে।
নবী-রসূলদের অবস্থা এমন ছিল যে, তারা কখনো আল্লাহর উপর আশা-ভরসা বর্জন করতেন না এবং কোনো অবস্থাতেই তারা তার রহমত ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হতেন না। বিপদাপদ যতই প্রকট আকার ধারণ করতো এবং উপায়-উপকরণ যতই দুর্বল হতো কোনো অবস্থাতেই আল্লাহর প্রতি আশা-আকাঙ্খা ছেড়ে দিতেন না।
ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হওয়া এবং তার স্ত্রী সন্তান প্রসবের বয়স পার হয়ে যাওয়ার পর তাকে যখন ফেরেশতারা সন্তানের সুখবর দিল তখন তিনি বলেছিলেন,
وَمَنْ يَقْنَطُ مِن رَّحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُّونَ
‘‘একমাত্র পথভ্রষ্ট লোকেরা ব্যতীত স্বীয় রবের রহমত থেকে আর কে নিরাশ হতে পারে?’’ (সূরা হিজর: ৫৬)
কেননা তিনি আল্লাহ তা‘আলার কুদরত ও রহমত সম্পর্কে অবগত ছিলেন, যা বৃদ্ধ বয়সে সন্তান দেয়ার চেয়ে অধিক পূর্ণাঙ্গ। তবে ফেরেশতাদেরকে বলেছিলেন,
﴿أَبَشَّرْتُمُونِي عَلَىٰ أَن مَّسَّنِيَ الْكِبَرُ فَبِمَ تُبَشِّرُونَ﴾
‘‘তোমরা কি বৃদ্ধ অবস্থায় আমাকে সন্তানের সুসংবাদ দিচ্ছো? অতএব আমাকে তোমরা কিসের সুসংবাদ দিচ্ছো?। (সূরা হিজর: ৫৪)
বিস্ময় প্রকাশ করতে গিয়ে এবং আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা ও রহমতের বিশালতায় চিন্তামগ্ন হয়েই তিনি একথা বলেছিলেন।
আল্লাহর নবী ইয়াকুব আলাইহিস সালাম যখন দুঃখ-কষ্টে আক্রান্ত হলেন এবং পুত্রের বিচ্ছেদে যখন তার অবস্থা সঙ্কটময় হলো, তখনো তিনি আল্লাহর প্রতি বড় আশা পোষণ করতেন এবং রহমত পাওয়ার কামনা করতেন। তিনি তার নিকট পুত্রদেরকে এনে বললেন,
﴿يَا بَنِيَّ اذْهَبُوا فَتَحَسَّسُوا مِن يُوسُفَ وَأَخِيهِ وَلَا تَيْأَسُوا مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لَا يَيْأَسُ مِن رَّوْحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْكَافِرُونَ﴾
‘‘হে আমার ছেলেরা! তোমরা যাও এবং ইউসুফ ও তার ভাইয়ের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাও। আল্লাহর রহমত থেকে তোমরা নিরাশ হয়ো না। তার রহমত থেকে তো একমাত্র কাফেররাই নিরাশ হয়’’। (সূরা ইউসুফ: ৮৭)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿فَصَبْرٌ جَمِيلٌ عَسَى اللَّهُ أَن يَأْتِيَنِي بِهِمْ جَمِيعًا﴾
‘‘পূর্ণ সবরই শ্রেয়। হয়তো আল্লাহ ওদের সবাইকে আমার কাছে এনে দিবেন’’। (সূরা ইউসুফ: ৮৩)
আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে আল্লাহ আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿إِلَّا تَنصُرُوهُ فَقَدْ نَصَرَهُ اللَّهُ إِذْ أَخْرَجَهُ الَّذِينَ كَفَرُوا ثَانِيَ اثْنَيْنِ إِذْ هُمَا فِي الْغَارِ إِذْ يَقُولُ لِصَاحِبِهِ لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا﴾
‘‘যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর, তাহলে মনে রেখো আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন, যখন তাকে কাফেররা বহিস্কার করেছিল। তিনি ছিলেন দু’জনের একজন, যখন তারা গুহার মধ্যে ছিলেন। তখন তিনি আপন সঙ্গীকে বললেন: বিষন্ন হয়ো না আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (সূরা তাওবা: ৪০)
সুতরাং কঠিন বিপদের সময় তিনি আল্লাহর কাছেই আশা পোষণ করেছেন। তিনি বলেছেন,اعلم أن الفرج مع الكرب ‘‘জেনে রেখো, সংকীর্ণতার পরেই প্রশস্ততা’’।
আল্লাহ তা‘আলার যেসব বান্দা অনেক গুনাহ করেছে এবং যারা ভয়াবহ অপরাধ করেছে তিনি তাদেরকে নিষেধ করেছেন যে, তাদের গুনাহ ও অপরাধসমূহ যেন তাদেরকে আল্লাহর রহম থেকে নিরাশ না করে এবং তাওবা পরিত্যাগ করার প্ররোচনা না দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ ياَ عِباَدِيَ الَّذِيْنَ أسْرَفُوْا عَلىَ أنْفُسِهِمْ لاَتَقْنَطُوْا مِنْ رَحْمَةِ اللهِ إنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعاً إنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ وَأَنِيبُوا إِلَىٰ رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ﴾
‘‘হে নবী! বলে দাও, হে আমার বান্দারা যারা নিজেদের উপর যুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিয় আল্লাহ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু। তোমরা ফিরে এসো তোমাদের রবের দিকে এবং তার অনুগত হয়ে যাও তোমাদের উপর আযাব আসার পূর্বেই। অতঃপর তা এসে গেলে তোমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবেনা’’। (সূরা আয যুমার: ৫৩-৫৪)
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে নিষেধ করেছেন, তার গুনাহর বোঝা তাদেরকে যেন তাওবা পরিত্যাগ না করায় এবং আল্লাহর ক্ষমা প্রাপ্তির আশা থেকে নিরাশ না করে।
আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়াকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবীরা গুনাহর মধ্যে গণনা করেছেন। ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, কবীরা গুনাহ হচ্ছে,
الْكَبَائِرُ الشِّرْكُ بِاللَّهِ وَالْيَأْسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ وَالْقَنُوطُ مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ وَالأَمْنُ مِنْ مَكْرِ اللَّهِ
‘‘আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া এবং আল্লাহর দয়া থেকে নিজেকে দূরে মনে করা এবং তার পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করা’’।[4]
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,
أَكْبَرُ الْكَبَائِرِ الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَالأَمْنُ لِمَكْرِ اللَّهِ وَالْقَنُوطُ مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ وَالْيَأْسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ
সবচেয় বড় কবীরাহ গুনাহ হচ্ছে, আল্লাহর শাস্তি হতে নিরাপদ মনে করা, আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হওয়া এবং আল্লাহর করুণা থেকে নিজেকে বঞ্চিত মনে করা।[5]
চলমান...
আলেম, দাঈ ও সাধারণ মুসলিমগণ যেভাবে দিন দিন সত্য বলা থেকে পিছিয়ে আসছে, হিকমতের দোহাই দিয়ে যেভাবে মুখ বন্ধ করে রাখা হচ্ছে, তাতে ইসলাম ও মুসিলমদের সুবিধা হওয়ার বদলে অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই হিকমতের দোহাই দিয়ে সকল ক্ষেত্রেই হক বলা বর্জন করলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতীয় জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। মানুষের ভয়ে কিংবা পার্থিব স্বার্থ ছুটে যাওয়ার ভয়ে সত্য বলা পরিত্যাগ করার ভয়াবহ পরিণতির বিষয়টি কুরআনের অনেক আয়াত ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একাধিক সহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴾ وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلَا تَكْتُمُونَهُ﴿‘‘আহলে কিতাবদের সেই অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দাও, যা আল্লাহ তাদের থেকে নিয়েছিলেন তাতে বলা হয়েছিল, তোমরা কিতাবের শিক্ষা মানুষের মধ্যে প্রচার করবে, তা গোপন করতো পারবে না’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৮৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَى لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَنْ مُنْكَرٍ فَعَلُوهُ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ
‘‘বনী ইসরাঈল জাতির মধ্য থেকে যারা কুফরীর পথ অবলম্বন করেছে তাদের উপর দাউদ ও মারইয়াম পুত্র ঈসার মুখ দিয়ে অভিসম্পাত করা হয়েছে। কারণ তারা বিদ্রোহী হয়ে গিয়েছিল এবং পাপাচারে সীমালংঘন করেছিল। তারা পরস্পরকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখা পরিহার করেছিল, তাদের গৃহীত সেই কর্ম ছিল বড়ই জঘণ্য’’। (সূরা মায়িদা: ৭৯-৮০)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, لَا يَمْنَعَنَّ رَجُلًا هَيْبَةُ النَّاسِ أَنْ يَقُولَ بِحَقٍّ إِذَا عَلِمَهُ ‘‘কেউ যখন সত্য জানতে পারবে তখন মানুষের ভয় যেন তাকে সত্য বলতে বারণ না করে’’। তিরমযী, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রহিমাহুল্লাহ আরো বাড়িয়ে বলেন যে, فإنه لا يُقرِّب من أَجَلٍ ذلك ولا يُبَاعد من رِزْقٍ ‘‘কেননা সত্য বলা মানুষকে মৃত্যুর নিকটবর্তী করে দেয় না এবং রিযিক থেকেও দূরে সরিয়ে দেয় না’’।
সুতরাং আমরা সুস্পষ্ট করে সত্য বলতে চাই। সাধ্যানুসারে ইসলামের পক্ষে কথা বলতে চাই। এ ব্যাপারে আমরা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করি না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য যা নাযিল করেছেন এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের জন্য যে সুন্নাত রেখে গেছেন, আমরা মানুষের কাছে তা নির্ভয়ে বর্ণনা করতে চাই।
একই সময়ে আমরা ঐসব নব্য মূর্তিপূজা, নতুন নতুন শিরক ও সকল প্রকার অশ্লীলতা, বেহায়াপনা এবং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও দেশ বিধ্বংসী বিজাতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চাই, যা নাস্তিক ও মুশরিকদের অন্ধ অনুসরণ করে আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা কুরআনের পক্ষে কথা বলতে চাই। মুসলিমদের সম্মান-সম্ভ্রম রক্ষা করতে চাই।
এ মুহূর্তে প্রত্যেক মুমিন নর-নারী, আলেম ও দাঈদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করা উচিৎ। আমরা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করবো না। সত্য বললেই জান মালের ক্ষতি হবে এবং পার্থিব স্বার্থ নষ্ট হবে, -এ ভয়ে আমরা সত্য বলা হতে মোটেই পিছপা হতে পারি না। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের সবকিছুই আল্লাহর হাতে।
আলেমগণ বলেছেন, শারীরিক ও মানসিক সামান্য কষ্ট এবং পার্থিব ভোগবিলাস ও স্বার্থ ছুটে যাওয়ার সন্দেহ হলেই সত্য বলা পরিত্যাগ করা নিষিদ্ধ। হত্যার আশঙ্কার বিষয়টি ভিন্ন। তাও আবার সাধারণ মুসলিমদের ক্ষেত্রে। তবে যারা জাতীয় পর্যায়ের আলেম ও দাঈ তাদের জন্য কোনো অবস্থাতেই সত্য গোপন করা জায়েন নেই। আল্লাহর জন্য তারা যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করবেন। আমাদের সামনে চার মাযহাবের চারজন বিজ্ঞ ইমাম, ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ এবং ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল ওয়াহাবসহ আরো বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। তারা সত্য বলার ক্ষেত্রে জান-মালসহ কোনো কিছুরই ভয় করেননি। আল্লাহর রহমতে অতঃপর তাদের ত্যাগের কারণে ইসলাম আজ পর্যন্ত টিকে রয়েছে। আশা করি আমাদের আলেমগণ সালাফে সালেহীনদের পথেই চলবেন।
সুতরাং মুসলিম যুবক-যুবতীদের বিবেক-বুদ্ধি ও অন্তরকে শিরক, কুফরী এবং ইউরোপ-আমেরিকা ও পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের অপসংস্কৃতি, নোংরামি ও কুসংস্কার থেকে পবিত্র রেখে তাতে ইসলামের আলো জ্বালিয়ে রাখার গুরু দায়িত্ব পালন করতে আলেমদের অবহেলা, জান-মাল ও ইজ্জতের ভয়ে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বর্ণিত হয়েছে যে, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলকে যখন হত্যা করার জন্য তারতুসে অবস্থানরত খলীফা মামুনের দরবারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ইমাম আহমাদের অন্যতম সাথী আবু জা’ফর আলআন্বারী ফুরাত নদী পার হয়ে ইমামের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসলেন। ইমাম তাকে দেখে বললেন: হে আবু জা’ফর! এত কষ্ট করে আমার সাথে দেখা করতে আসার কী প্রয়োজন ছিল? জবাবে আবু জা’ফর বললেন: ওহে আহমাদ! শুন! তুমি আজ মানুষের নয়ন মনি, তুমি সকলের মাথা! মানুষ তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। তারা তোমার অনুসরণ করবে। আল্লাহর কসম! তুমি যদি কুরআকে মাখলুক বলো, তাহলে আল্লাহর বান্দারা তাই বলবে। আর তুমি যদি তা বলতে অস্বীকার করো, তাহলে অগণিত মানুষ কুরআনকে মাখলুক বলা হতে বিরত থাকবে। হে বন্ধু! ভাল করে শুন। খলীফা যদি তোমাকে এইবার হত্যা নাও করে, তাহলে তুমি একদিন মৃত্যু বরণ করবে। মরণ একদিন আসবেই। সুতরাং তুমি আল্লাহকে ভয় করো। খলীফার কথায় তুমি কুরআনকে সৃষ্টি বলতে যেয়ো না।
কথাগুলো শুনে ইমাম আহমাদ কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন: ما شاء الله আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তাই হবে। অতঃপর তিনি বললেন, হে আবু জা’ফর! কথাগুলো তুমি আরেকবার বলো। আবু জা’ফর কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করলেন। এবারও ইমাম কাঁদলেন এবং বললেন, ما شاء الله।
আমরা আশা করি বিলম্বে হলেও সত্যের এ দুর্বল আওয়াজ প্রতিটি মুসলিমের কানে পৌঁছবে এবং তাদেরকে জাগ্রত করবে।
[2]. ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন: শারহুল আকীদা আল ওয়াসেতীয়াহ, হা/৩০৪।
[3]. সহীহ: সুনানে তিরমিযী হা/২৪১৪
[4]. আল মু‘জামুল কাবির, ত্ববারানী ৮৭৮৩।
[5]. হাদীছটি মাওকুফ সূত্রে সহীহ। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে হাদীছটি একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। দেখুন: মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক (১০/৪৫৯), তাফসীরে তাবারী, হা/৬১৯১ এবং তাবরানী আল কাবীর হা/৮৭৮৩ এবং অন্যান্য।