প্রত্যেক মৃত ব্যক্তিকেই কবরের আযাব ও ফেরেশতাদ্বয়ের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। যদিও তাকে দাফন না করা হয়। কবরের আযাব ও নিয়ামত বলতে বারযাখী জীবনের আযাব বা নিয়ামত উদ্দেশ্য। আখিরাতের জীবন ও দুনিয়ার জীবনের মধ্যবর্তী সময়কে বারযাখী জিন্দেগী বলা হয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ ‘‘তাদের সামনে রয়েছে একটি পর্দা পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত’’। (সূরা মুমিনূন: ১০০)

অধিকাংশ অবস্থার বিবেচনায় কবরের আযাব কিংবা কবরের শাস্তির কথা বলা হয়। অন্যথায় যাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়, যে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়, যে পানিতে ডুবে মরে যায়, যাকে হিংস্ত্র জীব-জন্তু ও পশু-পাখি খেয়ে ফেলে সেও স্বীয় আমল অনুপাতে বারযাখী জীবনের আযাব কিংবা নিয়ামত ভোগ করবে। তবে কবরের আযাব ও নিয়ামতের কারণ ও আযাবের ধরণ-পদ্ধতিতে ভিন্নতা রয়েছে।

পূর্বকালের কেউ কেউ মনে করেছে, কারো শরীরকে যদি আগুনে পুড়ে ছাই বানিয়ে তার কিছু অংশ সাগরে ছিটিয়ে দেয়া হয় এবং বাকী অংশ প্রচ- বাতাসের সময় ডাঙ্গায় ছিটিয়ে দেয়া হয়, তাহলে কবরের আযাব থেকে সে রেহাই পেয়ে যাবে। জনৈক ব্যক্তি তার সন্তানদেরকে উপদেশ দিয়েছিলেন যে, তারা যেন মরার পর তার দেহকে আগুন দিয়ে পুড়ে ছাই বানিয়ে সাগরে ছিটিয়ে দেন। ছেলেরা তাই করলো। আল্লাহ তা‘আলা সাগরকে তার মধ্যে ছিটিয়ে দেয়া অংশগুলোকে একত্রিত করার আদেশ দিলেন এবং যমীনের মধ্যে ছিটিয়ে দেয়া অংশগুলোকেও একত্রিত করার হুকুম করলেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে বললেন, দাড়াও। দাঁড়ানোর আদেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কেন এমনটি করেছো? সে বললো, হে আমার প্রভু! তোমার ভয়ে এরূপ করেছি। আর এ বিষয়ে তুমিই আমার চেয়ে বেশি অবগত রয়েছো। তখন আল্লাহ তা‘আলা তার উপর রহম করলেন এবং তাকে ক্ষমা করে দিলেন। অতএব, দেহের এই ছিন্ন-ভিন্ন অংশগুলোও বারযাখী জীবনের নিয়ামত ও কিংবা আযাব থেকে রেহাই পেলো না।

শুধু তাই নয়; মৃত ব্যক্তিকে যদি গাছের মাথায় বাতাস প্রবাহিত হওয়ার স্থানে ঝুলিয়ে রাখা হয়, তাহলেও বারযাখের আযাবের অংশ তার দেহ ভোগ করবেই। একজন সৎ লোককে যদি আগুনের চুলার মধ্যে দাফন করা হয়, সেখানে তার দেহ এবং রূহ বারযাখী জীবনের নিয়ামত প্রাপ্ত হবে। আল্লাহ তা‘আলা তার উপর আগুনকে শান্তিময় ঠা-া করে দিবেন। ঐদিকে পাপিষ্ঠ কোনো লোককে গাছের উপর বাতাস প্রবাহের স্থানে ঝুলিয়ে রাখলেও সেখানকার বাতাস তার জন্য উত্তপ্ত আগুনে পরিণত হবে।

সৃষ্টিজগৎ তৈরি হওয়ার মূল উপদান এবং পদার্থসমূহ তার প্রভু ও স্রষ্টার প্রতি সদা অনুগত। তিনি এগুলোকে যেভাবে ইচ্ছা পরিচালিত করেন। আল্লাহ যা করার ইচ্ছা করেন, তা বাস্তবায়ন করা তার কাছে মোটেই কঠিন নয়। বরং সবকিছু তার আদেশ ও ইচ্ছার অনুগত এবং তার ক্ষমতার সামনে বশীভূত। সুতরাং ক্রশবিদ্ধ ব্যক্তি, পানিতে ডুবে মৃত্যুমুখে পতিত ব্যক্তি এবং অগ্নিদ ব্যক্তির রূহ তার দেহের মধ্যে ফিরিয়ে দেয়া আল্লাহ তা‘আলার পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। যদিও আমরা এটি অনুভব করতে পারি না। কেননা বারযাখী জীবনে রূহকে দেহের মধ্যে ফেরত দেয়ার ধরণ-পদ্ধতি আমাদের কাছে মোটেই পরিচিত নয়। আমরা দেখতে পাই যে, সংজ্ঞাহীন, নেশাগ্রস্থ এবং হতবুদ্ধি ব্যক্তিরা জীবিত থাকে এবং তাদের রূহসমূহ তাদের সাথেই থাকে। অথচ তারা তাদের জীবনী শক্তি অনুভব করতে পারে না। অতএব যার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষে রূহকে তার শরীরের অংশগুলোর সঙ্গে জোড়া দেয়া মোটেই অসম্ভব নয়। যদিও দেহের অংশগুলো ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে বহু দূরে অবস্থান করুক কিংবা কাছাকাছি অবস্থান করুক। ঐ অংশগুলোর এক প্রকার অনুভূতি ও চেতনা শক্তি থাকে, যার মাধ্যমে তা কষ্ট কিংবা আরাম অনুভব করতে সক্ষম হয়।

আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে দুনিয়ার এ জগতে কারো কারো দেহ থেকে রূহ বিচ্ছিন্ন করার পর তাতে পুনরায় ফেরত দেয়ার নমুনা দেখিয়েছেন। রূহ ফেরত পেয়ে কথা বলেছে, চলা ফেরা করেছে, পানাহার করেছে বিবাহ-সাদী করেছে এবং তাদের কারো কারো সন্তানও হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَهُمْ أُلُوفٌ حَذَرَ الْمَوْتِ فَقَالَ لَهُمُ اللَّهُ مُوتُوا ثُمَّ أَحْيَاهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَذُو فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَشْكُرُونَ﴾

‘‘তুমি কি তাদের দেখনি, যারা মৃত্যু ভয়ে হাজারে হাজারে আপন ঘর-বাড়ি পরিত্যাগ করেছিলো? অতঃপর আল্লাহ তাদেরকে বলেছিলেন, তোমাদের মৃত্যু হোক! এরপর তাদেরকে জীবিত করলেন। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা মানুষের প্রতি অনুগ্রহশীল। কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না’’। (সূরা বাকারা: ২৪৩)  

আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলের এক ব্যক্তির ঘটনা উল্লেখ করে বলেন,

﴿أَوْ كَالَّذِي مَرَّ عَلَى قَرْيَةٍ وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَى عُرُوشِهَا قَالَ أَنَّى يُحْيِي هَذِهِ اللَّهُ بَعْدَ مَوْتِهَا فَأَمَاتَهُ اللَّهُ مِئَةَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَهُ قَالَ كَمْ لَبِثْتَ قَالَ لَبِثْتُ يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالَ بَلْ لَبِثْتَ مِئَةَ عَامٍ فَانْظُرْ إِلَى طَعَامِكَ وَشَرَابِكَ لَمْ يَتَسَنَّهْ وَانْظُرْ إِلَى حِمَارِكَ وَلِنَجْعَلَكَ آَيَةً لِلنَّاسِ وَانْظُرْ إِلَى الْعِظَامِ كَيْفَ نُنْشِزُهَا ثُمَّ نَكْسُوهَا لَحْمًا فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ قَالَ أَعْلَمُ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾

‘‘অথবা পুনরুত্থানের দৃষ্টান্ত স্বরূপ সেই ব্যক্তির কথা স্মরণ করো, যে এমন একটি গ্রাম অতিক্রম করেছিল, যার গৃহের ছাদগুলো উপুড় হয়ে পড়েছিল। সে বললো, এই ধ্বংসপ্রাপ্ত জনবসতিকে আল্লাহ আবার কিভাবে জীবিত করবেন? এ কথায় আল্লাহ তার প্রাণ হরণ করলেন এবং সে একশ বছর পর্যন্ত মৃত অবস্থায় পড়ে রইলো। তারপর আল্লাহ পুনর্বার তাকে জীবন দান করলেন, এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কত বছর ঘুমিয়েছো? সে বললো, এই তো মাত্র একদিন বা তার চেয়েও কম সময় ঘুমিয়েছি। আল্লাহ বললেন, বরং তুমি একশ বছর ঘুমিয়েছো। এবার নিজের খাবার ও পানীয়ের উপর নজর বুলাও, দেখো তাতে সামান্য পরিবর্তনও আসেনি। অন্যদিকে তোমার গাধাটিকে দেখো। আর এটা আমি এ জন্য করেছি যে, মানুষের জন্য তোমাকে আমি একটি নিদর্শন হিসাবে দাঁড় করাতে চাই। তুমি গাধার অস্থিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখো। লক্ষ্য করো, আমি কিভাবে একে উঠিয়ে এর গায়ে মাংস ও চামড়া লাগিয়ে দেই। এভাবে সত্য যখন তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো, তখন সে বলে উঠলো, আমি অবগত আছি, নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিশালী’’। (সূরা বাকারা: ২৫৯)  

বনী ইসরাঈলের লোকেরা যখন মূসা আলাইহিস সালামকে বললো,

﴿ياَ مُوْسَى لَنْ نُؤْمِنَ لَكَ حَتَّى نَرَى اللَّهَ جَهْرَةً فَأَخَذَتْكُمُ الصَّاعِقَةُ وَأَنْتُمْ تَنْظُرُونَ (55) ثُمَّ بَعَثْنَاكُمْ مِنْ بَعْدِ مَوْتِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ﴾

 ‘‘হে মূসা! আমরা আল্লাহকে না দেখা পর্যন্ত কখনো তোমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবো না। তখন তোমরা বজ্রাহত হয়েছিলে এবং নিজেরা তা প্রত্যক্ষ করছিলে। মৃত্যুর পর আমি তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করলাম। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও’’। (সূরা বাকারা: ৫৫-৫৬)

আসহাফে কাহাফের ঘটনাও মৃতকে জীবিত করার একটি উজ্জ্বল নমুনা। ইবরাহীম আলাইহিস সালামের চারটি পাখির ঘটনাটিও এ ব্যাপারে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছিলেন,

﴿رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِي الْمَوْتَى قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِنْ قَالَ بَلَى وَلَكِنْ لِيَطْمَئِنَّ قَلْبِي قَالَ فَخُذْ أَرْبَعَةً مِنَ الطَّيْرِ فَصُرْهُنَّ إِلَيْكَ ثُمَّ اجْعَلْ عَلَى كُلِّ جَبَلٍ مِنْهُنَّ جُزْءًا ثُمَّ ادْعُهُنَّ يَأْتِينَكَ سَعْيًا وَاعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾

‘‘হে আমার প্রতিপালক, আমাকে দেখাও, কেমন করে তুমি মৃতকে জীবিত করবে। বললেন, তুমি কি বিশ্বাস করো না? ইবরাহীম বললো অবশ্যই বিশ্বাস করি, কিন্তু এজন্য দেখতে চাচ্ছি, যাতে আমার অন্তর প্রশান্তি লাভ করে। আল্লাহ বললেন, তাহলে চারটি পাখি ধরো। পরে সেগুলোকে নিজের পোষ মানিয়ে নাও, অতঃপর সেগুলো যবেহ করে দেহের একেকটি অংশ বিভিন্ন পাহাড়ের উপর ছিটিয়ে দাও। তারপর সেগুলোকে ডাকো; তোমার নিকট দৌড়ে চলে আসবে। আর জেনে রেখো, নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা বাকারা: ২৬০)

উপরোক্ত বিভিন্ন ঘটনায় দেহগুলো মৃত্যুর মাধ্যমে শীতল ও নিসেত্মজ হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তা‘আলা যখন তাতে পরিপূর্ণ হায়াত ফেরত দিলেন, তাহলে তার অসীম ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কিভাবে মৃত্যুর পর স্বীয় আদেশে মৃতদের দেহগুলোতে অস্থায়ীভাবে রূহগুলোকে ফেরত দেয়া, কথা বলানো, শাস্তি দেয়া কিংবা আমল অনুযায়ী নিয়ামত দান করা অসম্ভব হতে পারে? দেহের মধ্যে রূহ ফেরত দেয়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করা নিছক কুফুরী, অবাধ্যতা, অবিশ্বাস ছাড়া আর কিছুই নয়।