‘রূহ’ এবং নাফ্স কি দু’টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়? না কি একই জিনিসের দু’টি নাম? এ বিষয়েও আলেমগণ মতভেদ করেছেন। অধিকাংশ আলেমের মতে নাফ্স এবং রূহ একই বিষয়। কেউ কেউ বলেছেন, উভয়টি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। সঠিক কথা হচ্ছে অনেকগুলো বিষয় বুঝাতে রূহ এবং নাফস্ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। কখনো কখনো উভয়টির উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন হয়। আবার কখনো ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বুঝানোর জন্য রূহ এবং নাফ্স শব্দ দু’টি ব্যবহৃত হয়।
النفس শব্দটির অনেক অর্থ রয়েছে। তবে সাধারণত এটি ‘রূহ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন বলা হয়, خرجت نفسه তার প্রাণ বের হয়ে গেছে। অর্থাৎ ‘রূহ’ বের হয়ে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴾ ﴿أخْرِجُوا أَنْفُسَكُمْ ‘‘তোমরা তোমাদের রূহ বের করে আনো’’। (সূরা আনআম: ৯৩) রূহকে সত্তাও বলা হয়ে থাকে। যেমন বলা হয়, رأيت زيدا نفسه وعينه আমি যায়েদকে দেখেছি। এখানে যায়েদের ব্যক্তিসত্তা দেখা উদ্দেশ্য। এ অর্থে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿فَسَلِّمُوْا عَلى أَنْفُسِكُمْ﴾ ‘‘তোমরা তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম দিবে’’। (সূরা নূর: ৬১)
নাফ্সকে রক্তও বলা হয়। যেমন বলা হয়ে থাকে, سالت نفسه তার রক্ত প্রবাহিত হয়েছে। ফিকাহবিদগণ বলেছেন, ما له نفس سائلة وما ليس له نفس سائلة যে প্রাণীর রক্ত প্রবাহিত হয় এবং যে প্রাণীর রক্ত প্রবাহিত হয় না। হাদীছে এসেছে, যে প্রাণীর রক্ত প্রবাহিত হয় না, তা পানিতে পড়ে মারা গেলে পানি নাপাক হয় না।[1] এ জন্যই মহিলার হায়েয শুরু হলে বলা হয়, نفست المرأة মহিলাটির ঋতুস্রাবের রক্ত প্রবাহিত হওয়া শুরু হয়েছে। এমনি সন্তান প্রসবের রক্ত প্রবাহিত হওয়া শুরু হলেও বলা হয়, نفست।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, বনী আদমের তিনটি নাফ্স রয়েছে।
(১)النَّفْسُ الَأَمَّارَةُ بِالسُّوءِ নাফ্সে আম্মারা বা দুষ্ট আত্মা: পাপাচার ও গুনাহর কাজ করার প্রবণতা এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ এ নাফ্সের উপর সবসময় বিজয়ী থাকে।
(২) النَّفْسُ اللَّوَّامَةُ নাফ্সে লাওয়ামাহ বা তিরস্কারকারী আত্মা: এ নাফসটি পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং তাওবা করে। এতে কল্যাণ-অকল্যাণ দু'টোই রয়েছে। কিন্তু যখন এটি পাপাচারে লিপ্ত হয়, তখন তাওবা করে এবং আনুগত্যের দিকে ফিরে আসে। এ জন্যই এ নাফ্সকে দোষারোপকারী নাফ্স বলা হয়। কেননা এটি পাপাচারের কারণে মানুষকে দোষারোপ করে থাকে। কল্যাণ-অকল্যাণের মাঝে কখনো দোদুল্যমান থাকে না।
(৩) النَّفْسُ الْمُطْمَئِنَّةُ নাফ্সে মুতমাইন্নাহ বা শান্তিপ্রাপ্ত আত্মাঃ নাফ্সে মুতমাইন্নাহ সবসময় সৎ কাজ পছন্দ করে এবং মন্দকাজ অপছন্দ করে। ফলে ভালোকে পছন্দ করা ও ভালোবাসা এ নাফ্সের সাধারণ অভ্যাসে হয়েছে। এ হচ্ছে একই সত্তার তিনটি বৈশিষ্ট। কেননা প্রত্যেক মানুষের নাফ্স মাত্র একটি।
الروح শব্দটিও বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। (১) কুরআনকে ‘রূহ’ বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِّنْ أَمْرِنَا﴾
‘‘এভাবেই আমি আমার নির্দেশে তোমার কাছে এক ‘রূহ’কে অহী করেছি৷ তুমি আদৌ জানতে না কিতাব কী এবং ঈমান কী। (সূরা শুরা: ৫২)
(২) ‘রূহ’ দ্বারা জিবরীল আলাইহিস সালামকেও উদ্দেশ্য হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِنَّهُ لَتَنزِيلُ رَبِّ الْعَالَمِينَ نَزَلَ بِهِ الرُّوحُ الْأَمِينُ عَلَىٰ قَلْبِكَ لِتَكُونَ مِنَ الْمُنذِرِينَ بِلِسَانٍ عَرَبِيٍّ مُّبِينٍ﴾
‘‘এটি রববুল আলামীনের নাযিল করা কিতাব। একে নিয়ে আমানতদার ‘রূহ’ (জিবরীল) অবতরন করেছে তোমার হৃদয়ে, যাতে তুমি সতর্ককারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও, পরিস্কার আরবী ভাষায়’’। (সূরা শুআরা: ১৯৩)
(৩) আল্লাহ তা‘আলা তার নবী-রসূলদের প্রতি যে অহী পাঠান তাকেও রূহ বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يُلْقِي الرُّوحَ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَن يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ لِيُنذِرَ يَوْمَ التَّلَاقِ يَوْمَ هُم بَارِزُونَ لَا يَخْفَىٰ عَلَى اللَّهِ مِنْهُمْ شَيْءٌ ۚ لِّمَنِ الْمُلْكُ الْيَوْمَ لِلَّهِ الْوَاحِدِ الْقَهَّارِالْيَوْمَ تُجْزَىٰ كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ لَا ظُلْمَ الْيَوْمَ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ﴾
‘‘তার বান্দাদের মধ্য থেকে যার কাছে ইচ্ছা নিজের হুকুমে অহী নাযিল করেন। যাতে সে সাক্ষাতের দিন সম্পর্কে সাবধান করে দেয়’’। (সূরা মুমিন: ১৫)
নবীদের প্রতি প্রেরিত অহীকে রূহ বলার কারণ হলো এর মাধ্যমেই উপকারী জীবন লাভ করা যায়। অহীর আলো ব্যতীত জীবন দ্বারা কখনো কোনো মানুষ উপকৃত হয় না। ঐদিকে দেহের মধ্যকার রূহকে এ নামে নামকরণ করার কারণ হলো রূহএর মাধ্যমেই শরীর জীবিত থাকে।
(৪) শরীর থেকে যে প্রাণবায়ু নির্গত হয় এবং তাতে যে বাতাস প্রবেশ করে তাকেও রূহ বলা হয়। উপরোক্ত সবগুলো বিষয়কেই রূহ বলা হয়। এটি দেহ থেকে বের হয়ে গেলেই মানুষের মৃত্যু হয়। সে হিসাবে রূহ ও নাফস্ পরস্পর সমার্থবোধক এবং উভয় দ্বারা উদ্দেশ্য একটিই। তবে পার্থক্য হলো নাফ্স শব্দটি দেহ এবং রক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এভাবে রূহ শব্দটি উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয় না। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
[1]. এটি আসলে হাদীছ নয়। তবে এই অর্থে বায়হাকী শরীফে সালমান (রাঃ) হতে একটি হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। দেখুন: শরহুল আকীদা আত্ তাহাবীয়া, হাদীছ নং- ২৭৪।