এখানে একটি মাস‘আলা বর্ণনা করা আবশ্যক। তা হলো নবী ও রসূলের মধ্যে পার্থক্য কী? নবী ও রসূলের মধ্যে পার্থক্য আছে কি না এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ মতটি হলো, রসূল বলা হয় এমন পুরুষকে যার নিকট আল্লাহ তা‘আলা নতুন শরী‘আত পাঠিয়েছেন এবং তাকে সেটা প্রচার করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আর নবী হলেন এমন পুরুষ, যার নিকট অহী প্রেরণ করা হয়েছে, কিন্তু তাবলীগ করার আদেশ করা হয়নি। সুতরাং প্রত্যেক নবী ও রসূলের নিকটই অহী এসেছে। কিন্তু নবীকে পাঠানো হয়েছে মুমিন সম্প্রদায়ের প্রতি পূর্বের শরী‘আতসহ। যেমন বনী ইসরাঈলের নবীদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাদের সকলকেই তাওরাতের শরী‘আত দিয়ে বনী ইসরাঈলদেরকে পরিচালনা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তবে তাদের কারো কারো নিকট নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে খাস অহীও করা হয়েছে।

আর রসূলদেরকে পাঠানো হয়েছে কাফের সম্প্রদায়ের নিকট। তারা কাফেরদেরকে আল্লাহর তাওহীদের দিকে এবং তার ইবাদতের দিকে ডাকতেন। সুতরাং রসূলগণ প্রেরিত হতেন অবিশ্বাসী বিরুদ্বাচরণকারী কাফেরদের নিকট। কোনো কোনো কাফের সম্প্রদায় তাদেরকে মিথ্যুক বলতো। রসূলদের মর্যাদা নবীদের মর্যাদার চেয়ে অধিক। রসূলগণের মর্যাদার মধ্যেও তারতম্য রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۘ مِّنْهُم مَّن كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ﴾      

‘‘এ রসূলদের একজনকে আরেকজনের উপর মর্যাদাশালী করেছি। তাদের কারোর সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন, কাউকে তিনি উন্নত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন’’। (সূরা বাকারা: ২৫৩) রসূলদের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন أولو العزم অর্থাৎ আল্লাহর দিকে দাওয়াত প্রচারে সুদৃঢ় ইচ্ছার অধিকারী রসূলগণ।[1]

তারা হলেন নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াতে তাদের কথা উল্লেখ করেছেন,

  ﴿وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا﴾

‘‘হে নবী! ম্মরণ করো সেই অঙ্গীকারের কথা যা আমি নিয়েছি সকল নবীর কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে, নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মরিয়াম পুত্র ঈসার কাছ থেকে। সবার কাছ থেকে আমি নিয়েছি পাকাপোক্ত অঙ্গীকার’’। (সূরা আহযাব: ৭) আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে একসাথে উল্লেখ করে আরো বলেন,

﴿شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ﴾

‘‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের সেসব নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং যা আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছি আমি ইবরাহীম, মূসা, ও ঈসা আলাইহিমুস সালামকে। এ আদেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা দীন কায়েম করো এবং তাতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’’। (সূরা শূরা: ১৩)

উলুল আযম রসূলদের মধ্যে দুই খলীল তথা ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ আলাইহিমাস সালাম সর্বোত্তম। সম্মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে তাদের পরে ছিলেন অন্যান্য রসূলগণ। অতঃপর নবীগণ। দুই খলীলের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন উত্তম।

নবী-রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নের পর আমাদেরকে জানতে হবে যে, নবুওয়াত আল্লাহর পক্ষ হতে একটি অনুগ্রহ। আল্লাহ তা‘আলাই তার বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে নবী হিসাবে বাছাই করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ﴾

‘‘আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য থেকে বাণীবাহক বাছাই করেন এবং মানুষদের মধ্য থেকেও। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা হজ্জ: ৭৫)

নবুওয়াত এমন কোনো সম্মান জনক পদমর্যাদা নয়, যা বান্দা ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে পরিশ্রম করে অর্জন করতে পারে। নবুওয়াত এমন কোনো সম্পদ নয়, যা আনুগত্যের কাজে কঠোর পরিশ্রম, আত্মশুদ্ধির অভ্যাস, অন্তর পরিস্কার, চরিত্র সংশোধন এবং অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। যেমন দার্শনিকগণ বলে থাকে যে, পরিশ্রম করে নবুওয়াত অর্জন করা যায়। তাদের ধারণা হলো, আত্মশুদ্ধি ও অনুশীলনীর মাধ্যমে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন কামালিয়াত বা পূর্ণতা অর্জন করার পর নিয়মিত আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনগুলোর প্রতি কেউ যখন গভীর অন্তর্দিষ্টি দিতে থাকবে, তখন তার হৃদয়ের আয়না প্রস্ফুটিত হবে, তার জ্ঞানের দৃষ্টি উন্মুক্ত হবে এবং তার জন্য এমন কিছু অর্জন করা সম্ভব হবে, যা অন্যদের জন্য হবে না।

দার্শনিকদের মতে নবুওয়াতের জন্য তিনটি শক্তি থাকা দরকার।

(১) এমন শক্তিশালী ইলম থাকা চাই, যাতে শিক্ষক ছাড়াই স্বীয় শক্তির মাধ্যমে ইলম অর্জন করতে সক্ষম হয়।

(২) এমন কল্পনাশক্তি থাকা আবশ্যক, যার মাধ্যমে মানুষ নিজের মধ্যে বিভিন্ন রকম এমন নূরানী চেহারা কল্পনা করতে পারে, যা তাকে সম্বোধন করে এবং সে উক্ত নূরানী চেহারার কথা শুনতে পায়।

(৩) মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। এ শক্তিকে তারা সৃষ্টিজগতের মৌলিক বস্তুতে হস্তক্ষেপ ও কর্তৃত্বকারী শক্তি হিসাবে নামকরণ করে থাকে। দার্শনিকদের মতে এ ছিফাতগুলো অর্জন করা সম্ভব।

এমন বিভ্রান্তিকর বক্তব্যকে পুঁজি করে কতিপয় সুফী নবুওয়াত দাবি করেছে। তাদের মতে নবুওয়াত সাধারণ একটি পেশা মাত্র। এটি একটি সম্পূর্ণ বাতিল কথা। আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণী তাদের কথাকে প্রত্যাখ্যান করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা সূরা আনআমের ১২৪ নং আয়াতে বলেন,

      ﴿قَالُوا لَن نُّؤْمِنَ حَتَّىٰ نُؤْتَىٰ مِثْلَ مَا أُوتِيَ رُسُلُ اللَّهِ اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ﴾

‘‘তারা বলে, আল্লাহর রসূলদেরকে যা দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তা আমাদের দেয়া হয় ততক্ষণ আমরা ঈমান আনয়ন করবো না। আল্লাহর নিজের রিসালাত কাকে দিবেন তা তিনিই সর্বাধিক অবগত আছেন’’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ﴾

আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য থেকেও বাণীবাহক বাছাই করেন এবং মানুষদের মধ্য থেকেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা হজ্জ: ৭৫)

সুতরাং নবুওয়াত আল্লাহ তা‘আলার হিকমত অনুযায়ী এবং সেটার জন্য কে উপযুক্ত সে অনুপাতেই তার পক্ষ হতে নির্বাচিত হয়ে থাকে। বান্দা এটি উপার্জন করতে সক্ষম নয়।

তবে এ কথা সঠিক যে, নবীগণের এমন ফযীলত রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্টের অধিকারী হয়েছেন। তবে বিভ্রান্ত দার্শনিকরা নবুওয়াতের যে ব্যাখ্যা দেয়, সেটা মোটেই সেরকম নয়।


[1]. তারা ছিলেন ঐ সমস্ত রাসূল, যারা রেসালাতের দায়িত্ব পালনে ছিলেন পর্বত সদৃশ সুদৃঢ় ইচ্ছা শক্তি সম্পন্ন এবং আল্লাহর তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করতে গিয়ে নিজ নিজ গোত্রের পক্ষ হতে যেসব যুলুম-নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন তাতে সীমাহীন ধৈর্যধারণকারী।