الأصل الرابع: الإيمان بالرسل - চতুর্থ মূলনীতি: রসূলগণের প্রতি ঈমান

রসূলগণের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ঈমানের অন্যতম রুকন। কেননা আসমানী বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে তারা আল্লাহ তা‘আলা ও মানুষের মাঝে মাধ্যম স্বরূপ এবং তাদের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির উপর দলীল-প্রমাণ কায়েম করেছেন।

রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নের অর্থ হলো তাদের রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং তাদের নবুওয়াতের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান করা। আরো বিশ্বাস করা যে, নবী-রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে যা কিছু বলেছেন, তাতে তারা সত্যবাদী। তারা তাদের রিসালাতের দায়-দায়িত্ব পৌঁছে দিয়েছেন এবং মানুষের জন্য যা অজ্ঞ থাকা মোটেই উচিত নয়, তা তারা বর্ণনা করেছেন।

নবী-রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক হওয়ার অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ﴾

‘‘তোমরা তোমাদের মুখমণ্ডল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে প্রত্যাবর্তিত করার মধ্যে কোনো ছাওয়াব নেই; বরং পূণ্য তার, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে’’। (সূরা বাকারা: ১৭৭)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ﴾

 ‘‘রসূল তার রবের পক্ষ থেকে তার উপর যে হিদায়াত নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে। আর যেসব লোক ঐ রসূলের প্রতি ঈমান এনেছে তারাও ঐ হিদায়াতকে মনে-প্রাণে স্বীকার করে নিয়েছে। তারা সবাই আল্লাহকে, তার ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবসমূহকে ও তার রসূলদেরকে বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ‘‘আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে অন্যজন থেকে আলাদা করিনা’’। (সূরা আল বাকারা: ২৮৫)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ الَّذِينَ يَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيُرِيدُونَ أَن يُفَرِّقُوا بَيْنَ اللَّهِ وَرُسُلِهِ وَيَقُولُونَ نُؤْمِنُ بِبَعْضٍ وَنَكْفُرُ بِبَعْضٍ وَيُرِيدُونَ أَن يَتَّخِذُوا بَيْنَ ذَٰلِكَ سَبِيلًا أُولَٰئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ حَقًّا﴾

‘‘যারা আল্লাহ ও তার রসূলদের সাথে কুফুরী করে, আল্লাহ ও তার রসূলদের মধ্যে পার্থক্য করতে চায় এবং বলে আমরা কারো প্রতি ঈমান আনয়ন করবো ও কারো প্রতি ঈমান আনয়ন করবোনা। আর তারা কুফর ও ঈমানের মাঝখানে একটি পথ বের করতে চায়, তারা সবাই প্রকৃত কাফের’’। (সূরা আন নিসা: ১৫০)

উপরোক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নকে তার প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি এবং কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনয়নের সাথে মিলিয়ে উল্লেখ করেছেন। সেই সঙ্গে যারা আল্লাহর প্রতি এবং রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নের মধ্যে পার্থক্য করবে এবং কারো প্রতি ঈমান আনবে ও কারো প্রতি কুফুরী করবে, তাদেরকে কাফের বলে উল্লেখ করেছেন।

মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে নবী-রসূল পাঠানো একটি বিরাট নিয়ামত। কেননা রসূলদের প্রতি মানুষের বিরাট প্রয়োজন রয়েছে। নবী-রসূলগণ ব্যতীত তাদের অবস্থা সুশৃঙ্খল ও সঠিক থাকা মোটেই সম্ভব নয়। রসূলদের প্রতি তাদের প্রয়োজন পানাহারের প্রয়োজনের চেয়েও অধিক। কেননা মানুষের সামনে আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় তুলে ধরা, তাদের জন্য উপকারী বিষয়গুলো বর্ণনা করা এবং ক্ষতিকর বিষয়গুলো থেকে সাবধান করার ক্ষেত্রে তার মাঝে এবং তার সৃষ্টির মাঝে নবী-রসূলগণই একমাত্র মাধ্যম। সেই সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলার শরী‘আত, হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ ও বৈধ বিষয়াদি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা এবং তিনি যা ভালোবাসেন ও যা ঘৃণা করেন, তা বর্ণনা করার মাধ্যম একমাত্র তারাই। সুতরাং রসূলদের মাধ্যম ছাড়া এগুলো জানার কোনো উপায় নেই। কেননা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি এগুলো বিস্তারিতভাবে জানতে ও সন্ধান পেতে সক্ষম নয়। যদিও তারা মোটামুটি সংক্ষিপ্তভাবে এগুলোর প্রয়োজন অনুভব করতে সক্ষম।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿كَانَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً فَبَعَثَ اللَّهُ النَّبِيِّينَ مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ وَأَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِيَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ فِيمَا اخْتَلَفُوا فِيهِ﴾

‘‘প্রথমে সব মানুষ একই পথের অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে যখন মতভেদ শুরু হলো তখন আল্লাহ নবীদেরকে পাঠালেন। তারা ছিলেন সত্য সঠিক পথের অনুসারীদের জন্য সুসংবাদদাতা এবং অসত্য পথ অবলম্বনের ব্যাপারে ভীতি প্রদর্শনকারী। আর তাদের সাথে সত্য কিতাব পাঠান, যাতে সত্য সম্পর্কে তাদের মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছিল তার মীমাংসা করা যায়’’। (সূরা আল বাকারা: ২১৩)       

রোগীর শরীর সুস্থ করার জন্য যেমন ডাক্তারের প্রয়োজন নবী-রসূলদের শিক্ষার প্রতি মানুষের প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি। কেননা ডাক্তার পাওয়া না গেলে রোগীর শরীর ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয় না। কিন্তু নবী-রসূলদের শিক্ষার অভাবে মানুষের অন্তর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অন্তরের ক্ষতি শরীরের ক্ষতির চেয়ে অধিক ভয়াবহ। ঐদিকে যমীনবাসীর মধ্যে যতদিন রিসালাতের প্রভাব বিদ্যমান থাকবে, পৃথিবী কেবল ততদিন বিদ্যমান থাকবে। যমীন থেকে নবী-রসূলদের রিসালাতের প্রভাব উঠে যাওয়ার সাথে সাথেই কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা যেসব রসূলের নাম উল্লেখ করেছেন, নির্দিষ্টভাবে তাদের প্রতি ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। তাদের সংখ্যা মোট ২৫জন। তাদের মধ্য থেকে ১৮ জনের নাম একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَتِلْكَ حُجَّتُنَا آتَيْنَاهَا إِبْرَاهِيمَ عَلَىٰ قَوْمِهِ نَرْفَعُ دَرَجَاتٍ مَّن نَّشَاءُ إِنَّ رَبَّكَ حَكِيمٌ عَلِيمٌ وَوَهَبْنَا لَهُ إِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ كُلًّا هَدَيْنَا وَنُوحًا هَدَيْنَا مِن قَبْلُ وَمِن ذُرِّيَّتِهِ دَاوُودَ وَسُلَيْمَانَ وَأَيُّوبَ وَيُوسُفَ وَمُوسَىٰ وَهَارُونَ وَكَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ وَزَكَرِيَّا وَيَحْيَىٰ وَعِيسَىٰ وَإِلْيَاسَ كُلٌّ مِّنَ الصَّالِحِينَ وَإِسْمَاعِيلَ وَالْيَسَعَ وَيُونُسَ وَلُوطًا وَكُلًّا فَضَّلْنَا عَلَى الْعَالَمِينَ﴾

‘‘ইবরাহীমকে তার জাতির মোকাবিলায় আমি এ যুক্তি-প্রমাণ প্রদান করেছিলাম। আমি যাকে চাই উন্নত মর্যাদা দান করি। তোমার রব প্রজ্ঞাময় ও মহাজ্ঞানী। তারপর আমি ইবরাহীমকে দান করেছি ইসহাক ও ইয়াকূবকে এবং সবাইকে সত্য পথ দেখিয়েছি, ইতিপূর্বে নূহকেও আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। আর তারই বংশধরদের থেকে দাউদ, সুলাইমান, আইউব, ইউসুফ, মূসা ও হারুণকে। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে বদলা দিয়ে থাকি। তার সন্তানদের থেকে যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা ও ইলিয়াসকেও সঠিক পথ দেখিয়েছি। তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন সৎকর্মশীল। ইসমাঈল, আল ইয়াসা, ইউনুস ও লূতকে আমি সৎপথ প্রদর্শন করেছি। তাদের মধ্য থেকে প্রত্যেককে আমি সমস্ত দুনিয়াবাসীর উপর মর্যাদাসম্পন্ন করেছি’’। (সূরা আন-আম: ৮৩-৮৬) বাকী সাতজনের কথা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে উল্লেখ করেছেন।

 আর যেসব নবীর নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয়নি, তাদের প্রতি সংক্ষিপ্তভাবে ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلًا مِنْ قَبْلِكَ مِنْهُمْ مَنْ قَصَصْنَا عَلَيْكَ وَمِنْهُمْ مَنْ لَمْ نَقْصُصْ عَلَيْكَ﴾

‘‘তোমার আগে আমি বহু রসূল পাঠিয়েছি। আমি তাদের অনেকের কাহিনী তোমাকে বলেছি আবার অনেকের কাহিনী তোমাকে বলিনি’’। (সূরা মুমিন: ৭৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَرُسُلًا قَدْ قَصَصْنَاهُمْ عَلَيْكَ مِنْ قَبْلُ وَرُسُلًا لَمْ نَقْصُصْهُمْ عَلَيْكَ وَكَلَّمَ اللَّهُ مُوسَى تَكْلِيمًا﴾  

‘‘এর পূর্বে যেসব নবীর কথা তোমাকে বলেছি তাদের কাছেও আমি অহী পাঠিয়েছি এবং যেসব নবীর কথা তোমাকে বলিনি তাদের কাছেও। আমি মূসার সাথে কথা বলেছি ঠিক যেমনভাবে কথা বলা হয়’’। (সূরা আন নিসা: ১৬৪)

এখানে একটি মাস‘আলা বর্ণনা করা আবশ্যক। তা হলো নবী ও রসূলের মধ্যে পার্থক্য কী? নবী ও রসূলের মধ্যে পার্থক্য আছে কি না এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ মতটি হলো, রসূল বলা হয় এমন পুরুষকে যার নিকট আল্লাহ তা‘আলা নতুন শরী‘আত পাঠিয়েছেন এবং তাকে সেটা প্রচার করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আর নবী হলেন এমন পুরুষ, যার নিকট অহী প্রেরণ করা হয়েছে, কিন্তু তাবলীগ করার আদেশ করা হয়নি। সুতরাং প্রত্যেক নবী ও রসূলের নিকটই অহী এসেছে। কিন্তু নবীকে পাঠানো হয়েছে মুমিন সম্প্রদায়ের প্রতি পূর্বের শরী‘আতসহ। যেমন বনী ইসরাঈলের নবীদের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তাদের সকলকেই তাওরাতের শরী‘আত দিয়ে বনী ইসরাঈলদেরকে পরিচালনা করার আদেশ দেয়া হয়েছে। তবে তাদের কারো কারো নিকট নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে খাস অহীও করা হয়েছে।

আর রসূলদেরকে পাঠানো হয়েছে কাফের সম্প্রদায়ের নিকট। তারা কাফেরদেরকে আল্লাহর তাওহীদের দিকে এবং তার ইবাদতের দিকে ডাকতেন। সুতরাং রসূলগণ প্রেরিত হতেন অবিশ্বাসী বিরুদ্বাচরণকারী কাফেরদের নিকট। কোনো কোনো কাফের সম্প্রদায় তাদেরকে মিথ্যুক বলতো। রসূলদের মর্যাদা নবীদের মর্যাদার চেয়ে অধিক। রসূলগণের মর্যাদার মধ্যেও তারতম্য রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ ۘ مِّنْهُم مَّن كَلَّمَ اللَّهُ وَرَفَعَ بَعْضَهُمْ دَرَجَاتٍ﴾      

‘‘এ রসূলদের একজনকে আরেকজনের উপর মর্যাদাশালী করেছি। তাদের কারোর সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন, কাউকে তিনি উন্নত মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন’’। (সূরা বাকারা: ২৫৩) রসূলদের মধ্যে সর্বোত্তম হলেন أولو العزم অর্থাৎ আল্লাহর দিকে দাওয়াত প্রচারে সুদৃঢ় ইচ্ছার অধিকারী রসূলগণ।[1]

তারা হলেন নূহ, ইবরাহীম, মূসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আল্লাহ তা‘আলা নিম্নের আয়াতে তাদের কথা উল্লেখ করেছেন,

  ﴿وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا﴾

‘‘হে নবী! ম্মরণ করো সেই অঙ্গীকারের কথা যা আমি নিয়েছি সকল নবীর কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে, নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মরিয়াম পুত্র ঈসার কাছ থেকে। সবার কাছ থেকে আমি নিয়েছি পাকাপোক্ত অঙ্গীকার’’। (সূরা আহযাব: ৭) আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে একসাথে উল্লেখ করে আরো বলেন,

﴿شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ﴾

‘‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের সেসব নিয়ম-কানুন নির্ধারণ করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং যা আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছি আমি ইবরাহীম, মূসা, ও ঈসা আলাইহিমুস সালামকে। এ আদেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা দীন কায়েম করো এবং তাতে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’’। (সূরা শূরা: ১৩)

উলুল আযম রসূলদের মধ্যে দুই খলীল তথা ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ আলাইহিমাস সালাম সর্বোত্তম। সম্মান ও মর্যাদার দিক দিয়ে তাদের পরে ছিলেন অন্যান্য রসূলগণ। অতঃপর নবীগণ। দুই খলীলের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন উত্তম।

নবী-রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়নের পর আমাদেরকে জানতে হবে যে, নবুওয়াত আল্লাহর পক্ষ হতে একটি অনুগ্রহ। আল্লাহ তা‘আলাই তার বান্দাদের মধ্য থেকে কাউকে নবী হিসাবে বাছাই করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ﴾

‘‘আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য থেকে বাণীবাহক বাছাই করেন এবং মানুষদের মধ্য থেকেও। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা হজ্জ: ৭৫)

নবুওয়াত এমন কোনো সম্মান জনক পদমর্যাদা নয়, যা বান্দা ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে পরিশ্রম করে অর্জন করতে পারে। নবুওয়াত এমন কোনো সম্পদ নয়, যা আনুগত্যের কাজে কঠোর পরিশ্রম, আত্মশুদ্ধির অভ্যাস, অন্তর পরিস্কার, চরিত্র সংশোধন এবং অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। যেমন দার্শনিকগণ বলে থাকে যে, পরিশ্রম করে নবুওয়াত অর্জন করা যায়। তাদের ধারণা হলো, আত্মশুদ্ধি ও অনুশীলনীর মাধ্যমে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন কামালিয়াত বা পূর্ণতা অর্জন করার পর নিয়মিত আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শনগুলোর প্রতি কেউ যখন গভীর অন্তর্দিষ্টি দিতে থাকবে, তখন তার হৃদয়ের আয়না প্রস্ফুটিত হবে, তার জ্ঞানের দৃষ্টি উন্মুক্ত হবে এবং তার জন্য এমন কিছু অর্জন করা সম্ভব হবে, যা অন্যদের জন্য হবে না।

দার্শনিকদের মতে নবুওয়াতের জন্য তিনটি শক্তি থাকা দরকার।

(১) এমন শক্তিশালী ইলম থাকা চাই, যাতে শিক্ষক ছাড়াই স্বীয় শক্তির মাধ্যমে ইলম অর্জন করতে সক্ষম হয়।

(২) এমন কল্পনাশক্তি থাকা আবশ্যক, যার মাধ্যমে মানুষ নিজের মধ্যে বিভিন্ন রকম এমন নূরানী চেহারা কল্পনা করতে পারে, যা তাকে সম্বোধন করে এবং সে উক্ত নূরানী চেহারার কথা শুনতে পায়।

(৩) মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক। এ শক্তিকে তারা সৃষ্টিজগতের মৌলিক বস্তুতে হস্তক্ষেপ ও কর্তৃত্বকারী শক্তি হিসাবে নামকরণ করে থাকে। দার্শনিকদের মতে এ ছিফাতগুলো অর্জন করা সম্ভব।

এমন বিভ্রান্তিকর বক্তব্যকে পুঁজি করে কতিপয় সুফী নবুওয়াত দাবি করেছে। তাদের মতে নবুওয়াত সাধারণ একটি পেশা মাত্র। এটি একটি সম্পূর্ণ বাতিল কথা। আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণী তাদের কথাকে প্রত্যাখ্যান করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা সূরা আনআমের ১২৪ নং আয়াতে বলেন,

      ﴿قَالُوا لَن نُّؤْمِنَ حَتَّىٰ نُؤْتَىٰ مِثْلَ مَا أُوتِيَ رُسُلُ اللَّهِ اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ﴾

‘‘তারা বলে, আল্লাহর রসূলদেরকে যা দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না তা আমাদের দেয়া হয় ততক্ষণ আমরা ঈমান আনয়ন করবো না। আল্লাহর নিজের রিসালাত কাকে দিবেন তা তিনিই সর্বাধিক অবগত আছেন’’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلَائِكَةِ رُسُلًا وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ﴾

আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য থেকেও বাণীবাহক বাছাই করেন এবং মানুষদের মধ্য থেকেও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা হজ্জ: ৭৫)

সুতরাং নবুওয়াত আল্লাহ তা‘আলার হিকমত অনুযায়ী এবং সেটার জন্য কে উপযুক্ত সে অনুপাতেই তার পক্ষ হতে নির্বাচিত হয়ে থাকে। বান্দা এটি উপার্জন করতে সক্ষম নয়।

তবে এ কথা সঠিক যে, নবীগণের এমন ফযীলত রয়েছে, যার মাধ্যমে তারা অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বৈশিষ্টের অধিকারী হয়েছেন। তবে বিভ্রান্ত দার্শনিকরা নবুওয়াতের যে ব্যাখ্যা দেয়, সেটা মোটেই সেরকম নয়।


[1]. তারা ছিলেন ঐ সমস্ত রাসূল, যারা রেসালাতের দায়িত্ব পালনে ছিলেন পর্বত সদৃশ সুদৃঢ় ইচ্ছা শক্তি সম্পন্ন এবং আল্লাহর তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করতে গিয়ে নিজ নিজ গোত্রের পক্ষ হতে যেসব যুলুম-নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন তাতে সীমাহীন ধৈর্যধারণকারী।

دلائل النبوة - নবুওয়াতের দলীল-প্রমাণসমূহ

দালায়েলুন নুবুওয়াত বলতে এমনসব দলীল-প্রমাণ উদ্দেশ্য, যার মাধ্যমে সত্য নবীর নবুওয়াত সম্পর্কে জানা যায় এবং নবুওয়াতের মিথ্যুক দাবিদারদের মিথ্যাবাদিতা জানা যায়। সে হিসাবে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নবুওয়াতের অনেক দলীল-প্রমাণ রয়েছে, যা গণনা করে শেষ করা যাবে না। নিম্নে কতিপয় দলীল বর্ণনা করা হলো।

(১) المعجزة মুজিযা অক্ষমকারী: القدرة (ক্ষমতা) এর বিপরীত অর্থবোধক শব্দ العجز (অক্ষমতা) থেকে المعجزة শব্দটি ইসমে ফায়েল হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অভিধান গ্রন্থে নবীর মুজিযা বলতে এমন জিনিস বুঝানো হয়েছে, যা দ্বারা তিনি চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় প্রতিপক্ষকে অক্ষম করে দিতে পারেন। المعجزة শব্দের মধ্যকার তা বর্ণটি আধিক্য বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

আর ইসলামের পরিভাষায় মুজিযা হলো সাধারণ অভ্যাসের বিপরীত এমন বিষয়, যা আল্লাহ তা‘আলা নবীর হাতে প্রকাশ করে থাকেন। উদ্দেশ্য হলো এর মাধ্যমে তিনি নবীর সত্যতা ও তার রিসালাতের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করেন।

নবী রসূলদের অনেক মুজিযা রয়েছে। যেমন সালেহ আলাইহিস সালামের উটনী। তার গোত্রের লোকদের উপর হুজ্জত কায়েম করার জন্য তিনি তাকে তা দান করেছিলেন। মূসা আলাইহিস সালামের নবুওয়াতের দলীল হিসাবে হাতের লাঠিকে আল্লাহ তা‘আলা সাপে পরিণত করেছিলেন। জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে ভালো করা এবং মৃতদেরকে জীবিত করা ছিল ঈসা আলাইহিস সালামের মুজিযা।

আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামেরও রয়েছে অনেক মুজিযা। তার মুজিযাসমূহের মধ্যে কুরআনুল কারীম হলো সবচেয়ে বড় মুজিযা। এ চিরন্তন মুজিযার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা জিন ও ইনসানকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। ইসরা ও মিরাজ, চন্দ্র দ্বিখ--ত করা, তার হাতের তালুতে পাথরের তাসবীহ পাঠ করা, খেজুর গাছের গুড়ির তার বিচ্ছেদে কান্নাকাটি করা এবং অতীত ও ভবিষ্যতের কিছু কিছু ঘটনা সম্পর্কে সংবাদ প্রদান করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম মুজিযা।

তর্কশাস্ত্রবিদরা বলে থাকে যে, নবুওয়াতের দলীল-প্রমাণ শুধু মুজিযার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সঠিক কথা হচ্ছে, তা কেবল মুজিযার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা অসংখ্য। তার মধ্যে রয়েছে,

(১) নবীগণ তাদের জাতির লোকদেরকে সুসংবাদ দিয়েছেন যে, তারা অচিরেই বিজয়ী হবেন, তাদের শত্রুরা ধ্বংস হবে এবং শুভ পরিণাম তাদেরই হবে। নবীগণ যে সংবাদ দিয়েছেন, তাই হয়েছে। তাদের একটি সংবাদও মিথ্যা হয়নি। যেমন হয়েছিল নূহ আলাইহিস সালাম, হুদ আলাইহিস সালাম, সালেহ আলাইহিস সালাম, শুআইব আলাইহিস সালাম, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম, লুত আলাইহিস সালাম, মূসা আলাইহিস সালাম এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংবাদগুলোর ক্ষেত্রে। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে এ সংবাদ দিয়েছেন।

(২) নবীগণ যে শরী‘আত ও সংবাদ নিয়ে এসেছেন, তা দৃঢ়তা, নিপুণতা, সত্যবাদিতা এবং সৃষ্টির জন্য সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করায় পূর্ণতম। বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে জানা যায় যে, সর্বাধিক জ্ঞানী ও সৎ লোক ছাড়া অন্য কারো মাধ্যমে এ রকম সুনিপুন কথা প্রকাশিত হওয়া সম্ভব নয়।

(৩) নবীদের আরেকটি মুজিযা হলো আল্লাহ তা‘আলা সবসময় তাদেরকে সাহায্য করেন। আল্লাহ তা‘আলার সুন্নাত (রীতি-নীতি) থেকে অবগত হওয়া গেছে যে, সত্যবাদীকে তিনি যেভাবে সাহায্য করেন মিথ্যাবাদীকে সেভাবে সাহায্য করেন না। বরং তিনি বিথ্যাবাদীকে লাঞ্ছিত করেন। তবে কখনো কখনো তাকে অবকাশ দেয়া হয়। অতঃপর ধ্বংস করেন।

(৪) আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও আনুগত্য করা এবং শেষ দিবসের প্রতি ঈমান আনয়ন করা, সমস্ত আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ও রসূলদের প্রতি ঈমান আনয়ন করার ব্যাপারে সমস্ত নবী-রসূলের তরীকা মাত্র একটি। তাদের এক ও অভিন্ন কাজের বিরোধিতা করা কারো জন্য বৈধ নয়। তাদের পরবর্তীগণ পূর্ববর্তীদেরকে সত্যায়ন করেন এবং পূর্ববর্তীগণ পরবর্তীদের আগমণের সুসংবাদ প্রদান করেন। যেমন ঈসা আলাইহিস সালাম মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমণের সুসংবাদ দিয়েছেন এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পূর্বের সমস্ত নবীকে সত্যায়ন করেছেন।

(৬) নবুওয়াতের আরেকটি দলীল হলো, আল্লাহ তা‘আলা নবীদেরকে সাহায্য করেন। আল্লাহ তা‘আলার চিরন্তন রীতি-নীতি সম্পর্কে অবগত হওয়া গেছে যে, তিনি সত্যাবাদীকে সাহায্য করার মত মিথ্যাবাদীকে সাহায্য করেন না। বরং মিথ্যুককে তিনি অপমানিত ও লাঞ্ছিত করেন, তাকে সাহায্য করেন না। বরং তাকে ধ্বংস করেন। তিনি যদি কোনো প্রভাবশালী যালেমকে কখনো সাহায্য করেন, তাহলে সে নবুওয়াত দাবি করে না এবং আল্লাহর নামে মিথ্যাও বলে না। বরং সে এমন যালেম হয়, যাকে আল্লাহ তা‘আলা তার মতই অন্য যালেমের উপর শক্তিশালী ও সক্ষম করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَكَذَلِكَ نُوَلِّي بَعْضَ الظَّالِمِينَ بَعْضًا بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ﴾

‘‘এভাবেই আমি কতক যালেমকে অন্যসব যালেমের উপর শক্তিশালী করে দেই তাদের কৃতকর্মের কারণে’’। (সূরা আল আনআম: ১২৯)

যারা বলে আল্লাহ তা‘আলা মিথ্যুক লোককে রসূল বানিয়ে পাঠিয়েছেন, তাদের কথা সত্যের বিপরীত। কেননা মিথ্যুকের জন্য আল্লাহ তা‘আলার সাহায্য-সহযোগিতা অব্যাহত থাকেনা। তবে তিনি কিছুকাল তাকে অবকাশ দেন। অতঃপর তাকে ধ্বংস করেন। আরেকটি কথা হলো নবুওয়াতের দাবি ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে সত্যবাদী মানুষ ও মিথ্যুক মানুষের মধ্যে পার্থক্য করার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। সুতরাং নবুওয়াতের সত্য দাবিদার এবং মিথ্যুক দাবিদারের মধ্যে পার্থক্য করার উপায় থাকবে না কেন?

এ কথা সকলের জেনে রাখা আবশ্যক যে, রিসালাতের দাবিদার হয়ত মানুষের মধ্যে সর্বাধিক শ্রেষ্ঠ হবে অথবা তাদের মধ্যে সর্বাধিক নিকৃষ্ট হবে। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ছাকীফ গোত্রে গেলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন তখন তাদের জনৈক নেতা তাকে বলেছিল, আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে একটি কথাও বলবোনা। তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তাহলে আমার দৃষ্টিতে তোমার কথার প্রতিবাদ করা অনর্থক। আর যদি তুমি মিথ্যুক হয়ে থাকো, তাহলে আমার দৃষ্টিতে তুমি এত নিকৃষ্ট যে, তোমার কথা প্রতিবাদের যোগ্য নয়।

নবুওয়াত সাধারণত সৃষ্টির সেরা ব্যক্তি এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তিই দাবি করে। সুতরাং সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তির বিষয়টি কিভাবে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি থেকে অস্পষ্ট হতে পারে! মিথ্যুকদের যে কেউ নবুওয়াত দাবি করেছে, তার মিথ্যাবাদিতা, মূর্খতা, পাপাচার এবং তার উপর শয়তান বিজয়ী হওয়ার বিষয়টি সামান্য বিবেক-বুদ্ধিমান লোকের নিকটও সুস্পষ্ট হয়েছে। আর নবুওয়াতের প্রত্যেক সত্য দাবিদার থেকে এমন জ্ঞান, সত্যবাদিতা, সৎ আমল এবং বিভিন্ন প্রকার কল্যাণ প্রকাশিত হয়েছে, যার মাধ্যমে সামান্যতম বিবেক-বুদ্ধিমান লোকের কাছেও তার সত্যবাদিতা সুস্পষ্ট হয়েছে। কেননা রসূলগণ অবশ্যই মানুষকে অনেক বিষয়ের সংবাদ দেন, অনেক কাজের আদেশ দেন এবং তারা অবশ্যই অনেক কাজ-কর্ম সম্পাদন করেন। মিথ্যুকরা যা বলে, যা আদেশ দেয়, যেসব বিষয়ের সংবাদ দেয় এবং তারা যেসব কাজ-কর্ম করে, তা থেকেই বিভিন্নভাবে তাদের মিথ্যাবাদিতা ধরা পরে। তাদের মিথ্যাবাদিতা সাব্যস্ত করতে বাইরের কোনো দলীলের প্রয়োজন হয় না।

কেউ কেউ প্রশ্ন করে, নবুওয়াতের দলীল-প্রমাণ এবং যাদুকর, গণক ও সাম্প্রতিক কালের বিস্ময়কর আবিষ্কারের মধ্যে পার্থক্য কী?

এ প্রশ্নের জবাব হলো, নবুওয়াতের দলীল-প্রমাণ এবং যাদুকর, গণক ও সাম্প্রতিক কালের বিস্ময়কর আবিস্কারের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।

(১) নবী-রসূলদের কথার মধ্যে কোনো খেলাপী কিংবা ভুল হয় না। কিন্তু গণক ও জ্যোতিষীর সংবাদ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাদের অধিকাংশ সংবাদ মিথ্যা হয়। তবে শয়তানদের চুরি করা কথা থেকে গণকরা যা শুনে তার মধ্য থেকে কিছু কিছু বিষয়ে তাদের কথা কখনো কখনো সত্য হয়।

(২) যাদুকর ও গণকের কাজ-কারবার এবং আধুনিক আবিস্কারের বিষয়গুলো মানুষের নিকট খুবই স্বাভাবিক ও পরিচিত। মানুষ এগুলো শিখতে পারে। এগুলো মানুষ ও জিনের ক্ষমতার বাইরে নয়। সমপর্যায়ের বিষয় দ্বারা এগুলোর মোকাবেলা করা সম্ভব। কিন্তু নবীদের নিদর্শন ও মুজিযার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এগুলোর মোকাবেলা করা কোনো জিন-ইনসানের পক্ষে সম্ভব নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا﴾

‘‘হে নবী! বলো, সমস্ত মানব ও জিন যদি এ কুরআনের অনুরূপ রচনা করার জন্য জড়ো হয় এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনো এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না’’। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮)

সুতরাং সৃষ্টির পক্ষে নবীদের নিদর্শনের অনুরূপ কিছু আনয়ন করা সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলাই নবীদের সত্যবাদিতার জন্য নিদর্শন ও আলামত নির্ধারণ করেন। যেমন চন্দ্র দ্বিখ--ত করা, হাতের লাঠিকে সাপে পরিণত করা, পাথরের তাসবীহ শ্রবণ করা, খেজুর কাঠের বিরহ-বিচ্ছেদের বেদনা মূলক ক্রন্দনের আওয়াজ শ্রবণ করা এবং সামান্য পরিমাণ পানি ও খাদ্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয় সংঘটিত করা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কারো ক্ষমতাধীন নয়।

(৩) নবীগণ ঈমানদার মুসলমান হয়ে থাকেন। তারা এক আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ইবাদত-বন্দেগী করেন। তারা সমস্ত নবীর আনীত দীনকে সত্যায়ন করেন। অপর পক্ষে যাদুকর, গণক এবং ভ- নবীরা কাফের, মুশরেক এবং আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ কিতাবের প্রতি কুফুরী করে।

(৪) সৃষ্টিগত স্বভাব এবং বিবেক-বুদ্ধি নবী-রসূলদের আনীতি দীনকে সমর্থন করে। ঐদিকে যাদুকর, গণক ও মিথ্যুক দাজ্জালদের কাজকর্ম শরী‘আতের দলীল এবং বিবেক-বুদ্ধি ও সৃষ্টিগত স্বভাবের পরিপন্থী।

(৫) নবী-রসূলগণ এসেছেন মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব ও বিবেক-বুদ্ধিকে পূর্ণতা প্রদান করার জন্য। বিপরীত পক্ষে যাদুকর, গণক ও মিথ্যুকরা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি ও সৃষ্টিগত পরিশুদ্ধ স্বভাবকে নষ্ট করে দেয়।

(৬) নবীদের মুজিযা তাদের নিজস্ব কাজের ফসল নয়। নবুওয়াতের আলামত ও নিদর্শন স্বরূপ এটি আল্লাহ তা‘আলাই তাদেরকে দান করেন। যেমন চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা, হাতের লাঠিকে সাপে পরিণত করা, কুরআন প্রদান করা এবং আল্লাহ তা‘আলার নিজস্ব ছিফাত ইলমুল গায়েবের খবর প্রদান করা। সুতরাং নিদর্শন প্রদান করার বিষয়টি সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহর হাতে। এতে সৃষ্টির কোনো হাত নেই। মুশরেকরা যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিদর্শন চাইলো, তখন আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে বললেন,

﴿قُلْ إِنَّمَا الْآيَاتُ عِندَ اللَّهِ وَإِنَّمَا أَنَا نَذِيرٌ مُّبِينٌ﴾

‘‘বলো, নিদর্শনাবলী তো রয়েছে আল্লাহর কাছে এবং আমি কেবলমাত্র সুস্পষ্ট সতর্ককারী’’। (সূরা আনকাবুত: ৫০) আর যাদুকর, গণক এবং শিল্প ও কারিগরি বিষয়ক আধুনিক আবিস্কার সম্পর্কে কথা হলো এগুলো সৃষ্টির কাজের অন্তর্ভুক্ত।

উপরোক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও নবীদের মুজিযা এবং যাদুকর ও গণকদের ভেলকিবাজির মধ্যে পার্থক্য করার অনেক উপায় রয়েছে। যে এ বিষয়ে অধিকতর জানতে চান, তিনি যেন শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহর النبوات নামক কিতাবটি অধ্যায়ন করে।

কুরআনুল কারীম আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সবচেয়ে বড় মুজিযা। প্রত্যেক নবীর গোত্রের অবস্থা অনুপাতেই তার মুজিযা হয়ে থাকে। এ জন্যই ফেরআউন সম্প্রদায়ের মধ্যে যখন যাদু বিদ্যা ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করলো, তখন মূসা আলাইহিস সালাম এমন একটি লাঠি নিয়ে আসলেন, যা যাদুকরেরা ব্যবহার করতো। কিন্তু মূসা আলাইহিস সালামের যাদুকরদের সাপ সদৃশ সব লাঠি গিলে ফেললো। এতে যাদুকররা হয়রান হয়ে গেলো এবং বিস্মিত হলো। তারা বিশ্বাস করে নিলো যে, মূসা আ. যা নিয়ে এসেছেন, তা সত্য-সঠিক; যাদু নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَأَلْقَىٰ مُوسَىٰ عَصَاهُ فَإِذَا هِيَ تَلْقَفُ مَا يَأْفِكُونَ فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سَاجِدِينَ قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ الْعَالَمِينَ رَبِّ مُوسَىٰ وَهَارُونَ﴾

‘‘তারপর মূসা নিজের লাঠিটি নিক্ষেপ করলেন। সে তাদের বানোয়াট কীর্তিগুলো গ্রাস করতে থাকলো। তখন সকল যাদুকর সিজদাবনত হয়ে পড়লো এবং বলে উঠলো, আমরা রাববুল আলামীনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। মূসা ও হারুনের রবের প্রতি’’। (সূরা শুআরা: ৪৬-৪৮)।

ঈসা আলাইহিস সালামের যুগে যখন ডাক্তারী বিদ্যা ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছিল, তখন তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন মুজিযা নিয়ে আসলেন, যা দেখে সে যুগের ডাক্তারগণ দিশেহারা হয়ে গেলেন। তিনি মৃতদেরকে জীবিত এবং জটিল ও কঠিন রোগ ভালো করতেন। যেমন জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করতেন এবং মাটি দিয়ে পাখির আকৃতি বানিয়ে তাতে ফুঁ দিলেই তা আল্লাহর অনুমতিতে পাখি হয়ে যেতো। এতে ডাক্তারদের বিবেক-বুদ্ধি হয়রান হয়ে গেলো এবং তারা স্বীকার করে নিলো যে, এগুলো আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতেই।

ঐদিকে আরবরা যখন ফাসাহাত ও বালাগাত তথা বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় বাগপটুতা ও উচ্চাঙ্গের সাহিত্যিক মান দিয়ে ভাষণ-বক্তৃতা দেয়ায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিল, তখন আল্লাহ তা‘আলা আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য এমন সাহিত্যিক মান সম্পন্ন কুরআনুল কারীম দান করলেন, যার ভাষাগত মান তাদের কথা-বার্তা ও ভাষণ-বক্তৃতায় ব্যবহৃত বাক্যসমূহের বহু উর্ধ্বে এবং যার সম্মুখ অথবা পশ্চাৎ হতে বাতিল প্রবেশ করতে পারে না। আর এ কুরআন হলো সর্বযুগের চিরন্তন মুজিযা।

আল্লাহ তা‘আলা সর্বযুগের সমস্ত মানুষের জন্য সর্বশেষ আসমানী রিসালাত হিসাবে কুরআনুল কারীমকে একটি উজ্জ্বল মুজিযা বানিয়েছেন। প্রত্যেক যামানার লোকেরা কুরআনের মুজিযা প্রত্যক্ষ করছে এবং সেটা তেলাওয়াত করছে। তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছে যে, কুরআন প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহর কালাম। এটি কোনো মানুষের কালাম নয়। আল্লাহ তা‘আলা মানুষ ও জিনকে কুরআনের অনুরূপ একটি কিতাব অথবা কুরআনের সূরার অনুরূপ দশটি সূরা কিংবা সেটার সূরার অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ করেছেন।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নবী হিসাবে প্রেরণ করার পর থেকে আজ পর্যন্ত কুরআনের চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ভবিষ্যতেও ইসলামের শত্রুরা কখনো কুরআনের অনুরূপ একটি কিতাব কিংবা কুরআনের সূরার ন্যায় একটি সূরা রচনা করে আনতে পারবেনা। যদিও ইতিহাসের প্রত্যেক যুগেই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও দীন ইসলামের শত্রুর সংখ্যা প্রচুর।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا وَلَن تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ﴾

‘‘আর যে কিতাবটি আমি আমার বান্দার উপর নাযিল করেছি তাতে যদি তোমরা সন্দেহ পোষণ করো তাহলে তার মতো একটি সূরা তৈরি করে আনো এবং নিজেদের সমস্ত সমর্থক গোষ্টীকে ডেকে আনো আল্লাহকে ছাড়া। তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো। কিন্তু তোমরা যদি এমনটি না করো আর নিঃসন্দেহে কখনই তোমরা এটা করতে পারবেনা, তাহলে ভয় করো সেই আগুনকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর যা তৈরি রাখা হয়েছে কাফেরদের জন্য’’। (সূরা আল বাকারা: ২৩-২৪)

সুতরাং কুরআনের চ্যালেঞ্জ এখনো বিদ্যমান রয়েছে। ইহা কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তোমরা যদি এখন এমনটি করতে না পারো, নিঃসন্দেহে কখনই তোমরা এটা করতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

  ﴿أَمْ يَقُولُونَ تَقَوَّلَهُ بَل لَّا يُؤْمِنُونَ فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ مِّثْلِهِ إِن كَانُوا صَادِقِينَ﴾

‘‘তারা কি বলে যে, এ ব্যক্তি নিজেই কুরআন রচনা করে নিয়েছে? প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে তারা ঈমান গ্রহণ করতে চায় না। তাদের এ কথার ব্যাপারে তারা যদি সত্যবাদী হয় তাহলে এ বাণীর মত একটি বাণী তৈরি করে আনুক’’। (সূরা তুর: ৩৩-৩৪)

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, এ চ্যালেঞ্জটি ছিল মক্কায়। কেননা সূরা হুদ, সূরা ইউনুস এবং সূরা তুর মক্কী সূরার অন্তর্ভুক্ত। মদীনায় হিজরত করার পর এ চ্যালেঞ্জের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। মাদানী সূরা বাকারায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

   ﴿وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا وَلَن تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ أُعِدَّتْ لِلْكَافِرِينَ﴾

‘‘আর যে কিতাবটি আমি আমার বান্দার উপর নাযিল করেছি তাতে যদি তোমরা সন্দেহ পোষণ করো তাহলে তার মতো একটি সূরা তৈরি করে আনো এবং নিজেদের সমস্ত সমর্থক গোষ্টীকে ডেকে আনো আল্লাহকে ছাড়া। তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো। কিন্তু তোমরা যদি এমনটি না করো আর নিসন্দেহে কখনই তোমরা এটা করতে পারবেনা, তাহলে ভয় করো সেই আগুনকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর যা তৈরি রাখা হয়েছে কাফেরদের জন্য’’। (সূরা আল বাকারা: ২৩-২৪) এখানে দু’টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে।

(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوا وَلَن تَفْعَلُوا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِي وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ﴾

‘‘কিন্তু তোমরা যদি এমনটি না করো আর নিঃসন্দেহে কখনই তোমরা এটা করতে পারবে না, তাহলে ভয় করো সেই আগুনকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর’’। তোমরা যখন এমনটি করতে পারবেনা, তখন জেনে নিবে যে, এটি সত্য। সুতরাং তোমরা তাকে মিথ্যায়ন করার ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। আর তা না করলে, তোমাদেরকে পরিবেষ্টন করবে সেই আযাব, যার ওয়াদা করা হয়েছে সত্য অস্বীকার কারীদের জন্য।

(২) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَن تَفْعَلُوا ‘‘আর নিঃসন্দেহে কখনই তোমরা এটা করতে পারবেনা’’। এখানে لن অব্যয় দ্বারা ভবিষ্যতে তাদের ক্ষমতা অর্জিত হওয়াকে নাকোচ করা হয়েছে। এতে সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, ভবিষ্যতেও তারা কুরআনের অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে আনয়ন করতে পারবেনা। কুরআন এভাবেই সংবাদ প্রদান করেছে।

কুরআনের সুস্পষ্ট বক্তব্য এবং মুতাওয়াতির হাদীছের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়েছে যে, সূরা বানী ইসরাঈল মাক্কী সূরা। ইসরা বা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নৈশ ভ্রমণের মাধ্যমে  এ সূরার সূচনা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا﴾

‘‘হে নবী তুমি বলো, সমস্ত মানব ও জিন যদি এ কুরআনের অনুরূপ রচনা করার জন্য জড়ো হয় এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনো এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না’’। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ তা‘আলা আদেশ করেছেন, তিনি যেন সমস্ত সৃষ্টিকে চ্যালেঞ্জ করে অকাট্যভাবে এ সংবাদ দিয়ে দেন যে, তারা সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা করলেও কুরআনের অনুরূপ কিতাব রচনা করতে পারবে না। যদিও তারা এ ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য-সহযোগিতা করে। সমগ্র সৃষ্টির জন্যই কুরআনের এ চ্যালেঞ্জ। যারা কুরআন শুনেছে, তাদের প্রত্যেকেই এ চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে অবগত আছে। কাছের কিংবা দূরের সকলেই এটি শুনেছে। সেই সঙ্গে এটি অবগত হওয়া গেছে যে, কাফেরদের কেউই কুরআনের মোকাবেলা করার সাহস পায়নি এবং কুরআনের অনুরূপ একটি সূরাও আনয়ন করতে পারেনি।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করার সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এ চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে আরবের সকলেই ছিল কাফের। তিনি যখন নবী হিসাবে প্রেরিত হলেন তখন অল্প সংখ্যক লোকই কেবল তার অনুসরণ করলো। কাফেররা নবী করীম সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথাকে বাতিল প্রমাণ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এবং সম্ভাব্য সকল পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। তারা কখনো কখনো আহলে কিতাবদের কাছে গিয়ে গায়েবী বিষয়ে প্রশ্ন শিখে নিতো। যাতে পরবর্তীতে তারা এ বিষয়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করতে পারে। যেমন তারা প্রশ্ন করেছিল ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা সম্পর্কে, আসহাফে কাহাফ সম্পর্কে এবং যুলকারনাইনের ঘটনা সম্পর্কে। সেই সঙ্গে তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে সম্মিলিতভাবে একটি মিথ্যা কথা বলার জন্য একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। তারা তার জন্য একাধিক উদাহরণ পেশ করতে লাগলো। অতঃপর তারা তাকে এমন ব্যক্তির সাথে সাদৃশ্য দিল, যার সাথে তার পার্থক্য সুস্পষ্ট। কখনো তারা তাকে পাগল বলেছে, কখনো যাদুকর বলেছে, কখনো গণক বলেছে এবং কখনো কবি বলেছে। তারা তার সম্পর্কে এমনসব কথা বলেছে, যা তারা নিজেরা এবং প্রত্যেক বিবেকবান লোক শুনে বুঝতে সক্ষম হতো যে সেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।

কুরআন যেহেতু তাদের দাবিকে বাতিল করে সেটার মোকাবেলা করার জন্য চ্যালেঞ্জের পর চ্যালেঞ্জ করেছে, তাই জানা গেলো যে, তারা যদি মোকাবেলা করতে পারতো, তাহলে অবশ্যই তারা তা করতো। সুতরাং চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করার যথেষ্ট প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও যদি তাদের মোকাবেলা করার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে অবশ্যই তারা কুরআনের অনুরূপ একটি কিতাব কিংবা সেটার অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে নিয়ে আসতো। সমগ্র যমীনবাসীর জন্যই কুরআনের এ চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। সুতরাং প্রত্যেকের কাছেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো যে, সমস্ত যমীনবাসী কৌশল কিংবা বিনা কৌশলে এই কুরআনের অনুরূপ একটি কুরআন আনয়ন করতে অক্ষম। কুরআনের মুজিযা ঐসব নিদর্শনের চেয়েও অধিক সু্স্পষ্ট ও পরিপূর্ণ যা কুরআনে বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন মৃতদেরকে জীবিত করার বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। কুরআনের অনুরূপ মুজিযা আর কোনো নবী আনয়ন করতে পারেনি।

ইসলামের প্রথম যুগে মক্কাতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসারীর সংখ্যা যখন একদম কমছিল তখন তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে একটি অকাট্য খবর দিয়েছেন যে, সমস্ত জিন এবং ইনসান যদি ঐক্যবদ্ধ হতো তবুও সে যুগে কুরআনের ন্যায় একটি কিতাব রচনা করে আনতে পারতো না। পরবর্তী যুগসমূহেও একই কথা। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে ও সুদৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে এ কথা বলেছেন। কিন্তু মনের মধ্যে সন্দেহ নিয়ে এ ধরণের কথা কেবল ঐ ব্যক্তিই বলতে পারে, যে নিজের মিথ্যাবাদিতা প্রকাশিত হওয়ার ভয় করে এবং অপদস্থ হওয়া ও মানুষ তার কথা সত্যায়ন না করার আশঙ্কা করে। আর যখন দৃঢ়চিত্তে ও পর্বত সদৃশ ঈমান নিয়ে বলবে, তখন আল্লাহর পক্ষ হতে নিশ্চিত সংবাদ নিয়েই বলবে। মানুষের পরিচিত ও স্বভাবগত যেসব ইলম রয়েছে, তার মধ্যে এমন কিছু আছে বলে মানুষ জানেনা, যা সমগ্র সৃষ্টি মিলে আনয়ন করতে অক্ষম। আলেমগণ কেবল ঐসব কালাম রচনা করতে অক্ষম, যা তাদের ক্ষমতার বাইরে। সুতরাং মানুষ যেহেতু কুরআনের অনুরূপ কালাম রচনা করে আনয়ন করতে পারে না, তখন এটি বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, কুরআন একটি চিরন্তন মুজিযা। বিভিন্ন পদ্ধতিতেই কুরআনুল কারীমের মুজিযা প্রমাণ করা যায়। কুরআনের শব্দমালা, গ্রন্থনা, অলঙ্কারপূর্ণ শব্দের মাধ্যমে বিষয়বস্তুর প্রতি নির্দেশনা প্রদান, তার আদেশ-নিষেধ, আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর সংবাদ প্রদান, তার ফেরেশতাদের খবরাদি, ভবিষ্যৎ ও অতীতের গায়েবী বিষয় সম্পর্কিত খবর, পুনরুত্থান দিবস সংক্রান্ত খবর, ঈমান ও ইয়াকীনের দলীল-প্রমাণাদি এবং অন্যান্য বিষয়েও কুরআন একটি চিরন্তন মুজিযা।

العصمة শব্দের অর্থ সংরক্ষণ করা, বাঁচানো। সে হিসাবে العاصم অর্থ সংরক্ষণকারী, হেফাযতকারী। الاعتصام অর্থ কোনো জিনিসকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা। এখানে ইসমত শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো গুনাহ ও পাপাচার থেকে নবীদেরকে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সংরক্ষণ করা।

নবী-রসূলগণ গুনাহ ও পাপাচার থেকে পবিত্র কি না, এ মাসআলায় শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া আলেমদের মতভেদ বর্ণনা করার পর প্রাধান্যপ্রাপ্ত মতটি উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আলেমদের ঐক্যমতে নবীগণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সংবাদ দেয়া এবং রেসালাতের তাবলীগ করার ব্যাপারে মাসুম (দোষ-ত্রুটিমুক্ত)। তাই আল্লাহর পক্ষ হতে তারা যেসব সংবাদ প্রদান করেছেন, একবাক্যে তার প্রতি বিশ্বাস করা আবশ্যক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿قُولُوا آمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنزِلَ إِلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَىٰ وَعِيسَىٰ وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِن رَّبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِّنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ فَإِنْ آمَنُوا بِمِثْلِ مَا آمَنتُم بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوا وَّإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ﴾

‘‘তোমরা বলো, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর প্রতি, আমাদের জন্য যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি এবং যা ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব ও ইয়াকুবের সন্তানদের প্রতি যা নাযিল হয়েছিল তার প্রতি, মূসা, ঈসা এবং অন্যান্য নবীদেরকে তাদের রবের পক্ষ হতে যা দেয়া হয়েছে তার প্রতি। আমরা কারোর মধ্যে কোনো পার্থক্য করি না। আমরা সবাই আল্লাহর অনুগত মুসলিম। তোমরা যেরূপ ঈমান এনেছো তারাও যদি সেরূপ ঈমান আনে, তাহলে নিশ্চয় তারা সুপথ পাবে। আর যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বিরুদ্ধচারিতায় লিপ্ত। কাজেই তাদের মোকাবিলায় তোমাদের সহায়তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’’। (সূরা বাকারা: ১৩৬-১৩৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿لَيْسَ الْبِرَّ أَنْ تُوَلُّوا وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ﴾

‘‘তোমাদের মুখমণ্ডল পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফিরানোর মধ্যে কোনো ছাওয়াব নেই; বরং পূণ্য তার, যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাব ও নবীগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে’’। (সূরা বাকারা: ১৭৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿آَمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ كُلٌّ آَمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ لا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ وَقَالُوا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا غُفْرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ﴾

 ‘‘রসূল তার রবের পক্ষ থেকে তার উপর যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে। মুমিনগণও তার প্রতি ঈমান এনেছে। তারা সবাই আল্লাহকে, তার ফেরেশতাদেরকে, তার কিতাবসমূহকে ও তার রসূলদেরকে বিশ্বাস করেছে এবং তাদের বক্তব্য হচ্ছে, আমরা আল্লাহর রসূলদের একজনকে অন্যজন থেকে আলাদা করি না। আর তারা বলেন, আমরা নির্দেশ শুনেছি এবং অনুগত হয়েছি। হে আমাদের প্রভু! আমরা গুনাহ মাফের জন্য তোমার কাছে প্রার্থনা করছি। আমরা তোমারই দিকে ফিরে যাবো’’। (সূরা বাকারা: ২৮৫)

নবুওয়াত ও রিসালাতের উদ্দেশ্য এ প্রকার মাসুম হওয়ার মাধ্যমেই অর্জিত হয়। কেননা নবী হলেন আল্লাহর পক্ষ হতে সংবাদ প্রদানকারী। আর আল্লাহ তা‘আলা যাকে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন, তিনিই হলেন রসূল। সে হিসাবে প্রত্যেক রসূলই নবী, কিন্তু প্রত্যেক নবী রসূল নন। তারা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে যা পৌঁছিয়ে দেন সে বিষয়ে তাদের নির্দোষিতা সুসাব্যস্ত। মুসলিমদের ঐক্যমতে এ ব্যাপারে ভুল হওয়া সম্ভব নয়।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, রিসালাতের তাবলীগ সম্পর্কিত বিষয় ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে নবীগণ ভুল-ত্রুটি থেকে পবিত্র কি না, এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তাদের পবিত্র হওয়ার বিষয়টি কি বিবেক-বুদ্ধির দলীল দ্বারা সাব্যস্ত? না কি শরী‘আতের দলীল দ্বারা সাব্যস্ত? তারা আরো মতভেদ করেছেন যে, তারা কি কবীরা ও ছবগীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকে পবিত্র? না কি কতক গুনাহ থেকে পবিত্র? না কি গুনাহর উপর স্থির থাকা হতে পবিত্র? না কি মূলতই গুনাহ করা থেকে পবিত্র? না কি আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তারা যার তাবলীগ করেন সে ক্ষেত্রেই তারা ভুল-ভ্রান্তি থেকে পবিত্র? এমন কি নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বেও কুফুরী ও পাপাচার হতে তাদের পবিত্র হওয়া আবশ্যক কি না? -এ ব্যাপারেও আলেমগণ মতভেদ করেছেন।  

অধিকাংশ আলেমের মতে নবী-রসূলগণ সর্বপ্রকার গুনাহর উপর স্থির থাকা থেকে পবিত্র। আলেমগণ ঐসব লোকের প্রতিবাদ করেছেন, যাদের মতে গুনাহর উপর নবী-রসূলদের স্থির থাকা সম্ভব। গুনাহর উপর নবীগণ স্থির থাকেন না, এমতটিই সালাফদের উক্তিসমূহ দ্বারা সমর্থিত। নবীগণ গুনাহর উপর স্থির থাকা হতে পবিত্র মর্মে মত পোষণকারীদের দলীলগুলো একত্রিত করলে প্রমাণিত হয় যে, তাদের কথাই সঠিক। আর যারা বলেছে, তারা গুনাহ থেকে পবিত্র নন তাদের দলীলগুলো সাব্যস্ত করে না যে, নবী-রসূলগণ গুনাহর উপর স্থির থাকতে পারেন।

আর যাদের মতে নবীগণের দ্বারা গুনাহর কাজ হতেই পারে না, তাদের দলীল হলো নবীগণকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা জরুরী। তাদের  কাজ-কর্মগুলোকে গুনাহ হিসাবে সাব্যস্ত করা হলে তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ নয়।

আর এটি জানা কথা যে, নবীগণ যার উপর স্থির থাকেন এবং যা সাব্যস্ত করেন কেবল তাতেই তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ। যা থেকে তারা নিষেধ করেছেন কিংবা যা থেকে তারা ফিরে এসেছেন, তাতে তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ নয়। যেমন ঐসব আদেশ-নিষেধের ক্ষেত্রেই তাদের আনুগত্য করা আবশ্যক, যা রহিত করা হয়নি। সুতরাং যেসব আদেশ-নিষেধ রহিত করা হয়েছে, তার অনুসরণ করা তো দূরের কথা, সেগুলোকে পরবর্তীতে আদেশ বা নিষেধ হিসাবে গণ্য করা বৈধ নয়।

নবীগণের পক্ষ হতে গুনাহর কাজ হওয়া অসম্ভব হওয়ার পক্ষে মত প্রকাশকারীদের আরেকটি দলীল হলো, তারা বলেন নবীদের মধ্যে পূর্ণতার গুণাবলী থাকা আবশ্যক। আর পাপাচার পূর্ণতার পরিপন্থি অথবা যাকে নবুওয়াতের মত বিরাট নিয়ামত দেয়া হয়েছে, তার থেকে পাপাচার প্রকাশিত হওয়া খুবই জঘন্য ব্যাপার অথবা বলা যায় যে, পাপাচারের কারণে মানুষ নবীদের থেকে দূরে সরে যেতে পারে বিধায় তাদের থেকে পাপাচার হওয়া মোটেই বৈধ নয়। তারা এমনি আরো আকলী বিবেক-বুদ্ধি প্রসূত দলীল পেশ করেছেন।

আমরা তাদের জবাবে বলবো যে, গুনাহর উপর অটল থাকলে এবং তা থেকে ফিরে এসে তাওবা না করলে উপরোক্ত কথা ঠিক আছে। কিন্তু খাটি তাওবা করলে আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু তাওবা কবুল করেন, তাই তাওবাকারীর মর্যাদা আল্লাহ তা‘আলার আগের চেয়ে আরো বাড়িয়ে দেন। যেমন কোনো কোনো সালাফ বলেছেন, দাউদ আলাইহিস সালাম তাওবা করার পর গুনাহ করার পূর্বের চেয়ে ভালো হয়েছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন, তাওবা করা যদি আল্লাহ তা‘আলার কাছে সর্বাধিক প্রিয় না হতো, তাহলে আল্লাহ তা‘আলার সর্বাধিক সম্মানিত বান্দা নবী-রসূলগণকে গুনাহ করার ফিতনায় ফেলতেন না। তাওবার ব্যাপারে সহীহ হাদীছে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِهِ حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلَى رَاحِلَتِهِ بِأَرْضِ فَلَاةٍ فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُهُ وَشَرَابُهُ فَأَيِسَ مِنْهَا فَأَتَى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِي ظِلِّهَا قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِهِ فَبَيْنَا هُوَ كَذَلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَهُ فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ اللَّهُمَّ أَنْتَ عَبْدِي وَأَنَا رَبُّكَ أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ»

‘‘বান্দা যখন আল্লাহর কাছে তাওবা করে, তখন তিনি তোমাদের ঐ ব্যক্তির চেয়েও অধিক খুশি হন, যে  তার বাহনে আরোহন করে সফরে বের হলো। বাহনের উপরেই ছিল তার খাদ্য-পানীয় ও সফর সামগ্রী। মরুভূমির উপর দিয়ে সফর করার সময় বিশ্রামার্থে সে একটি বৃক্ষের নীচে অবতরণ করল। অতঃপর মাটিতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম থেকে জাগ্রত হয়ে দেখল তার বাহন কোথায় যেন চলে গেছে। সে নিরাশ হয়ে একটি গাছের ছায়ায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পেলো, তার হারানো বাহনটি সমুদয় খাদ্য-পানীয়সহ মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাহনটির লাগাম ধরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে উঠলো, হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার প্রভু। অতি আনন্দের কারণেই সে এত বড় ভুল করে বসেছে।[1]

শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, কুরআন, সহীহ হাদীছ এবং কুরআনের পূর্বে যেসব আসমানী কিতাব নাযিল করা হয়েছে, তাতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, নবীগণ কবীরা গুনাহ থেকে মাসুম। কিন্তু তাদের পক্ষ হতে সগীরা গুনাহ হওয়া সম্ভব। কুরআন, সুন্নাহ এবং পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে এ মতের সমর্থনে বর্ণিত দলীলসমূহ গণনা করে শেষ করা যাবে না।

আর যারা বলে যে, নবীগণ কবীরা ও সগীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ রূপে নিষ্পাপ তারা জাহমীয়া, কাদারীয়া এবং দাহরীয়া সম্প্রদায়ের ন্যায় আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নাম, সুউচ্চ গুনাবলী, তাক্বদীর এবং পুনরুত্থান দিবস সংক্রান্তবক্তব্যগুলোর তাবীল করেছে। এগুলো কারামেতা বাতেনী[2] সম্প্রদায়ের তাবীলের মতই, যা বিবেক-বুদ্ধির দলীল-প্রমাণ দ্বারা বাতিল প্রমাণিত হয় এবং এগুলো কুরআন-হাদীছের বক্তব্যকে নিজ স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার শামিল। এদের কেউ কেউ নবীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে তাদেরকে মিথ্যায়ন করে ফেলে এবং তাদের প্রতি ঈমান আনয়ন করতে গিয়ে তাদের প্রতি কুফুরীতে লিপ্ত হয়।

আমরা নবীদের ইসমতের কথা উপরে উল্লেখ করেছি, তা কেবল আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাবলীগ করার ক্ষেত্রেই। আর এটি শরী‘আতের দলীল, বিবেক-বুদ্ধির দলীল এবং ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত। নবীগণ যেসব বিষয়ের তাবলীগ করেছেন, তারা যদি তার স্বীকৃতি প্রদান না করে এবং সেটার উপর সন্তুষ্ট না থাকে, তাহলে নবীদের রেসালাত দ্বারা তারা মোটেই উপকৃত হবে না। কিন্তু তারা কেবল কুরআনের ঐসব বাক্য বুঝার চেষ্টা করে, যার অর্থ থেকে তারা মাহরুম হয়েছে অথবা তারা তাদের ঐসব মূর্খ লোকদের মতোই, যারা শুধু ধারণা ব্যতীত কিতাবের আর কোনো জ্ঞান রাখে না।

যারা দাবি করে যে নবীগণ কবীরা ও সগীরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকে পবিত্র, এ ক্ষেত্রে তাদের কথা যদি সঠিক হয়েও থাকে, তথাপিও তা দ্বারা উপকৃত হতে পারেনি। কেননা তাদের মতে নবীগণের রিসালাতের প্রতি তাদের কোনো প্রয়োজন নেই। রিসালাতের বিষয়টি যেহেতু তাদের ব্যতীত অন্যদের সাথে সম্পৃক্ত, তাই তাতে নাক গলানো তাদের উচিত নয়। মোটকথা তাদের কেউ আল্লাহর পক্ষ হতে বিনা দলীলেই নবীদের ব্যাপারে কথা বলে এবং নবীদের প্রতি সত্যায়ন ও তাদের আনুগত্য সম্পর্কিত ওয়াজিব বিষয়কে পরিহার করে। অথচ তাদের প্রতি ঈমান ও আনুগত্যই সৌভাগ্য অর্জনের মাধ্যম এবং এর বিপরীত করার মধ্যেই রয়েছে দুর্ভাগ্য।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴾ ﴿فَإِن تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُم مَّا حُمِّلْتُمْ ‘‘কিন্তু তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও। তাহলে জেনে রাখো যে, রসূলের উপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সে জন্য রসূল দায়ী এবং তোমাদের উপর যে দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সে জন্য তোমরাই দায়ী’’। (সূরা আন নূর: ৫৪)

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের যেখানেই কোনো নবী থেকে ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানেই তার পক্ষ হতে তাওবা-ইসেত্মগফারের কথাও উল্লেখ করেছেন। যেমন আদম ও তার স্ত্রী বলেছেন,

﴿رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾

‘‘হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের উপর যুলুম করেছি। তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো এবং আমাদের প্রতি রহম না করো, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যাবো’’। (সূরা আরাফ: ২৩) নূহ আলাইহিস সালাম ভুল করে বলেছিলেন,

  ﴿رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُن مِّنَ الْخَاسِرِينَ﴾

‘‘হে আমার রব! যে সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই তা তোমার কাছে চাইবো, এ থেকে আমি তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তুমি যদি আমাকে মাফ না করো এবং আমার প্রতি রহম না করো তাহলে আমি ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবো’’। (সূরা হুদ: ৪৭) ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম তার দু‘আয় বলেছেন,

﴿رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ﴾

‘‘হে আমাদের রব! যেদিন হিসাব কায়েম হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সমস্ত মুমিনদেরকে মাফ করে দিয়ো’’। (সূরা ইবরাহীম: ৪১)

আল্লাহ তা‘আলা তার সম্পর্কে আরো বলেন যে তিনি বলেছেন,

﴿وَالَّذِي أَطْمَعُ أَن يَغْفِرَ لِي خَطِيئَتِي يَوْمَ الدِّينِ﴾

‘‘আর তার কাছে আমি আশা করি, প্রতিদান দিবসে তিনি আমার অপরাধ ক্ষমা করবেন’’। (সূরা শুআরা: ৮২) মূসা আলাইহিস সালাম বলেছেন,

﴿أَنتَ وَلِيُّنَا فَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَا وَأَنتَ خَيْرُ الْغَافِرِينَ وَاكْتُبْ لَنَا فِي هَٰذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ إِنَّا هُدْنَا إِلَيْكَ﴾

‘‘তুমিই তো আমাদের অভিভাবক। কাজেই আমাদের মাফ করে দাও এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করো। ক্ষমাশীলদের মধ্যে তুমিই শ্রেষ্ঠ। আর আমাদের জন্য এ দুনিয়ায় কল্যাণ লিখে দাও এবং আখিরাতেও। আমরা তোমার দিকে ফিরেছি’’। (সূরা আরাফ: ১৫৫) মূসা আলাইহিস সালাম তার দু‘আয় বলেছেন,

﴿رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ﴾

‘‘হে আমার রব! আমি নিজের উপর যুলুম করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি ক্ষমাশীল মেহেরবান’’। (সূরা কাসাস: ১৬)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿فَلَمَّا أَفَاقَ قَالَ سُبْحَانَكَ تُبْتُ إِلَيْكَ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُؤْمِنِينَ﴾

‘‘অতঃপর যখন সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে মূসা বললো: আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আমি তোমার কাছে তাওবা করছি এবং আমিই সর্বপ্রথম মুমিন’’। (সূরা আরাফ: ১৪৩) দাউদ আলাইহিস সালামের তাওবা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَاسْتَغْفَرَ رَبَّهُ وَخَرَّ رَاكِعًا وَأَنَابَ فَغَفَرْنَا لَهُ ذَٰلِكَ وَإِنَّ لَهُ عِندَنَا لَزُلْفَىٰ وَحُسْنَ مَآبٍ﴾

‘‘অতঃপর সে নিজের রবের কাছে ক্ষমা চাইলো এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়লো এবং তার অভিমুখী হলো। তখন আমি তার ত্রুটি ক্ষমা করে দিলাম এবং নিশ্চয় আমার কাছে তার জন্য রয়েছে উচ্চ মর্যাদা ও শুভ পরিণাম’’। (সূরা সোয়াদ: ২৪-২৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿قَالَ رَبِّ اغْفِرْ لِي وَهَبْ لِي مُلْكًا لَّا يَنبَغِي لِأَحَدٍ مِّن بَعْدِي إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ﴾

‘‘সে বললো, হে আমার রব! আমাকে মাফ করে দাও এবং আমাকে এমন রাজত্ব দান করো যার অধিকারী আমার পরে অন্য কেউ হতে পারবেনা; নিশ্চয় তুমি মহাদাতা’’। (সূরা সোয়াদ: ৩৫)

ঐদিকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে ইউসুফ আলাইহিস সালামের কোনো গুনাহর কথা উল্লেখ করেন নি। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যাপারে গুনাহর জন্য উপযুক্ত কোনো তাওবার কথা উল্লেখ করেন নি। বরং শুধু এতটুকু বলেছেন যে,

﴿كَذَٰلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ﴾

‘‘মন্দকাজ ও অশ্লীলতা থেকে দূর রাখার জন্য এভাবে তাকে আমার নিদর্শন দেখিয়েছিলাম। তিনি ছিলেন আমার একনিষ্ঠ বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত’’। (সূরা ইউসুফ: ২৪)

 আল্লাহ তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি তার থেকে মন্দকাজ ও অশ্লীলতা প্রতিহত করেছেন। এ কথা প্রমাণ করে যে, তার থেকে কোনো পাপাচার ও অশ্লীলতা প্রকাশিত হয়নি।  আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلَا أَن رَّأَىٰ بُرْهَانَ رَبِّهِ﴾

‘‘মহিলাটি তার প্রতি আসক্ত হয়েছিল এবং ইউসুফও তার প্রতি আসক্ত হয়ে যেতো, যদি না তার রবের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করতো’’। (সূরা ইউসুফ: ২৪)

এখানে الهم শব্দটি এমন ইসমে জিনস বা শ্রেণীবাচক বিশেষ্য, যার অধীনে দু’টি প্রকার রয়েছে। যেমন ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেন, الهم দুই প্রকার। (১) মনের কল্পনা ও (২) সুদৃঢ় সংকল্প। সহীহ বুখারীতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন,

   «إن العبد إذا هَمَّ بِسَيِّئَةٍ لم تكتب عليه وإذا تركها كتبت له حسنة وإن عملها كتبت له سيئة واحدة وإن تركها من غير أن يتركها لله لم تكتب له حَسَنَةً ولا سَيِّئَةً» (بخارى:6491)

‘‘বান্দা পাপ কাজের ইচ্ছা করলেই গুনাহ লেখা হয় না। আর তা করার ইচ্ছা করার পর পরিত্যাগ করলে তাতে আল্লাহ তার জন্য একটি নেকী লিখে দেন। আর যদি সংকল্প করার পর তা বাস্তবে পরিণত করে, তাহলে মাত্র একটি গুনাহ লেখা হয়। আর যদি পাপ কাজটি ছেড়ে দেয় ঠিকই; কিন্তু আল্লাহর জন্য ছেড়ে দেয় না, তাতে তার জন্য নেকী লেখা হয় না, গুনাহও লেখা হয় না। ইউসুফ আলাইহিস সালাম মনে মনে এমন চিন্তা করেছিলেন, যা তিনি আল্লাহর জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা এখলাসের কারণে তার থেকে মন্দ কাজ ও অশ্লীলতা দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। এমনটি তখনই হয়ে থাকে, যখন গুনাহর প্রতি আহবানকারী খারাপ চিন্তা মনের মধ্যে জাগ্রত হয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে এবং আল্লাহর জন্য অন্তরের এখলাস সেটার প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায়। ইউসুফ আলাইহিস সালাম থেকে কেবল ছাওয়াব পাওয়ার যোগ্য সৎকর্মই সংঘটিত হয়েছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ﴾

‘‘যারা তাকওয়ার পথ অবলম্বন করে তাদেরকে শয়তান যখন কুমন্ত্রণা দেয়, তখনই সতর্ক হয়ে যায় এবং তৎক্ষণাৎ তাদের চক্ষু খুলে যায়’’। (সূরা আরাফ: ২০১)

শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে ঐসব লোকের সন্দেহের জবাব সুস্পষ্ট হলো, যারা বলে নবুওয়াতের পূর্বে গুনাহ থেকে পবিত্র না থাকলে আল্লাহ তা‘আলা কাউকে নবী বানিয়ে পাঠান না। রাফেযী এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ও অনুরূপ কথা বলে থাকে। সেই সঙ্গে ঐসব লোকের জবাব সুস্পষ্ট হয়েছে, যারা বলে যারা নবুওয়াতের পূর্বে ঈমানদার থাকে, আল্লাহ তা‘আলা কেবল তাদেরকেই নবী হিসাবে প্রেরণ করেন। এ শ্রেণীর লোকেরা ধারণা করে যে, গুনাহ থেকে তাওবা করলেও সেটা বান্দার মর্যাদা কমিয়ে ফেলে। এটি তাদের ভুল ধারণা। সুতরাং যারা মনে করবে যে, খাঁটি তাওবা করার পরও গুনাহকারীর অসম্পূর্ণতা থেকে যায়, তারা বিরাট ভুলের মধ্যে রয়েছে। গুনাহকারীদের ব্যাপারে যেসব শাস্তির কথা বলা হয়েছে, তাওবাকারীগণকে তা স্পর্শ করতে পারবে না। সে যদি দ্রুত তাওবা করে, তাহলে তার কোনো শাস্তি হবে না। কিন্তু তাওবা করতে দেরী করলে গুনাহ করার পর থেকে তাওবা করার পূর্ব পর্যন্ত তার অবস্থা অনুপাতে দোষারোপ ও শাস্তির সম্মুখীন হবে।

নবীগণ তাওবা করতে বিলম্ব করতেন না। বরং দ্রুত তাওবা করতেন, দেরী করতেন না এবং গুনাহর উপর স্থিরও থাকতেন না। তার গুনাহর উপর স্থির থাকা হতে সম্পূর্ণ পবিত্র। আর তাদের কেউ যদি তাওবা করতে সামান্য বিলম্ব করেন, তাহলে মুছীবতে নিপতিত করে তার গুনাহকে মোচন করে দেন। যেমন করা হয়েছিল ইউনুস আলাইহিস সালামের ক্ষেত্রে।

প্রসিদ্ধ মতে নবুওয়াত প্রাপ্তির পরই তাকে পানিতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। যারা বলে নবুওয়াত পাওয়ার পূর্বে তাকে পানিতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তারা এ আলোচনার প্রতি মুখাপেক্ষী নয়। কুফুরী ও পাপাচার থেকে তাওবাকারী কখনো ঐ ব্যক্তি থেকে উত্তম হতে পারে, যে কুফুরী ও পাপাচারে একদম লিপ্ত হয়নি। গুনাহকারী যেহেতু নিষ্পাপ ব্যক্তি থেকে কখনো উত্তম হয়, তাই উত্তম ব্যক্তি নবুওয়াতের জন্য তার চেয়ে অধিক যোগ্য, যে ফযীলতের ক্ষেত্রে তার সমান নয়। আল্লাহ তা‘আলা ইউসুফের ভাইদের গুনাহর কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। তারা ছিলেন নবীদের বংশের লোক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَآَمَنَ لَهُ لُوطٌ وَقَالَ إِنِّي مُهَاجِرٌ إِلَى رَبِّي إِنَّهُ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾

‘‘অতঃপর ইবরাহীমের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলেন লুত। ইবরাহীম বললেন, আমি আমার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করছি। নিশ্চয় তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা আনকাবুত: ২৬) লুত আলাইহিস সালাম প্রথমে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের প্রতি ঈমান আনয়ন করলেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাকে রসূল বানিয়ে তার জাতির নিকট প্রেরণ করলেন। শোআইব আলাইহিস সালামের ঘটনায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 ﴿قَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ اسْتَكْبَرُوا مِن قَوْمِهِ لَنُخْرِجَنَّكَ يَا شُعَيْبُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَكَ مِن قَرْيَتِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا قَالَ أَوَلَوْ كُنَّا كَارِهِينَ قَدِ افْتَرَيْنَا عَلَى اللَّهِ كَذِبًا إِنْ عُدْنَا فِي مِلَّتِكُم بَعْدَ إِذْ نَجَّانَا اللَّهُ مِنْهَا وَمَا يَكُونُ لَنَا أَن نَّعُودَ فِيهَا إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّنَا وَسِعَ رَبُّنَا كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا عَلَى اللَّهِ تَوَكَّلْنَا رَبَّنَا افْتَحْ بَيْنَنَا وَبَيْنَ قَوْمِنَا بِالْحَقِّ وَأَنتَ خَيْرُ الْفَاتِحِينَ﴾

‘‘তার সম্প্রদায়ের দাম্ভিক প্রধানরা তাকে বললো, হে শোআইব! আমাদের ধর্মে তোমাদের ফিরে আসতেই হবে। অন্যথায় তোমাকে ও তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাদেরকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেবো। শোআইব জবাব দিলো: আমরা রাজি না হলেও কি আমাদের জোর করে ফিরিয়ে আনা হবে? তোমাদের ধর্ম থেকে আল্লাহ আমাদের উদ্ধার করার পর আবার যদি আমরা তাতে ফিরে আসি তাহলে আমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যা আরোপকারী বিবেচিত হবো। আমাদের রব আল্লাহ যদি না চান, তাহলে আমাদের পক্ষে সে দিকে ফিরে যাওয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। আমাদের রবের জ্ঞান সমস্ত জিনিসকে ঘিরে আছে। আমরা তারই উপর নির্ভর করি। হে আমাদের রব! আমাদের ও আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে যথাযথভাবে ফায়সালা করে দাও এবং তুমি সর্বোত্তম ফায়সালাকারী’’। (সূরা আরাফ: ৮৮-৮৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِرُسُلِهِمْ لَنُخْرِجَنَّكُم مِّنْ أَرْضِنَا أَوْ لَتَعُودُنَّ فِي مِلَّتِنَا﴾

‘‘শেষে কাফেররা তাদের রসূলদের বলে দিলো, হয় তোমাদের ফিরে আসতে হবে আমাদের মিল্লাতে আর নয়তো আমরা তোমাদের বের করে দেবো আমাদের দেশ থেকে’’। (সূরা ইবরাহীম: ১৩)

সুতরাং জানা গেল যে, শেষে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হওয়াই মূল্যায়নযোগ্য; শুরুতে অপূর্ণতা মূল্যায়নের বিষয় নয়। প্রত্যেক বান্দারই তাওবা করা আবশ্যক। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্যই তাওবা করা আবশ্যক। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لِّيُعَذِّبَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْمُشْرِكِينَ وَالْمُشْرِكَاتِ وَيَتُوبَ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَكَانَ اللَّهُ غَفُورًا رَّحِيمًا﴾

‘‘পরিণামে আল্লাহ মুনাফেক পুরুষ, মুনাফেক নারী, মুশরেক পুরুষ ও মুশরেক নারীদেরকে শাস্তি দেবেন এবং মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের তাওবা কবুল করবেন। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়’’। (সূরা আহযাব: ৭৩)

আল্লাহ তা‘আলা আদম ও নূহ আলাইহিমাস সালামের তাওবা করা থেকে শুরু করে সর্বশেষ রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাম পর্যন্ত সমস্ত নবীর তাওবা করার কথা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর সর্বশেষ যা নাযিল হয়েছে, তা হলো,

﴿إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ (১) وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا (২) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا﴾

যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে। আর মানুষকে আল্লাহর দীনে দলে দলে প্রবেশ করতে দেখতে পাবে। তখন তুমি তোমার প্রতিপালকের প্রশংসার সাথে পবিত্রতা ঘোষণা করো এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাকারী (সূরা নাসর:১-৩)।

অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ অনেক আয়াত উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে কুরআনের আয়াতগুলো খুব সুস্পষ্ট। যেমন রয়েছে সাহাবী, তাবেঈ এবং মুসলিম উম্মাহর আলেমদের অনেক বক্তব্য। কিন্তু বিরোধীগণ জাহমীয়া ও বাতেনী সম্প্রদায়ের লোকদের ন্যায় এ বক্তব্যগুলোর অপব্যাখ্যা করে থাকে। এগুলোতে গভীরভাবে দৃষ্টি প্রদানকারী বুঝতে সক্ষম হবে যে, এগুলো একদম বাতিল। এগুলো কালামকে স্বীয় স্থান থেকে সরিয়ে ফেলার মতই। যেমন তারা আল্লাহ তা‘আলার এই বাণীর ব্যাপারে বলে থাকে যে,  ﴿ليغْفَرَ اللَّهُ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ﴾ ‘‘আল্লাহ যাতে তোমার আগের ও পরের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেন’’, এখানে তার আগের গুনাহ বলতে আদমের গুনাহ এবং পরের গুনাহ বলতে তার উম্মতের গুনাহ উদ্দেশ্য। এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ বাতিল।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেন, অধিকাংশ আলেম যেখানে বলেছেন, নবীদের দ্বারা সগীরা গুনাহ হতে পারে, তাদের কথার উদ্দেশ্য হলো নবীগণের দ্বারা সগীরা গুনাহ হলেও তারা তার উপর অটল ও স্থির থাকেন না; বরং তাওবা করেন। সুতরাং এতে তারা নবীদেরকে পূর্ণতার গুণাবলী ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা বিশেষিত করেন নি। কেননা সর্বশেষ আমলগুলোই ধর্তব্য। যারা বলে নবীগণ ছবগীরা কিংবা কবীরা, কোনো গুনাহই করতে পারে না, তাদের কথা থেকে আবশ্যক হয় যে, নবীগণ তাওবা করেন না.....। শাইখুল ইসলামের বক্তব্য থেকে যেটুকু নেওয়া উদ্দেশ্য ছিল, তা এখানেই শেষ।

নবী-রসূলগণ গুনাহ থেকে মাসুম কি না, এ ব্যাপারে সংক্ষিপ্ত কথা হলো, গুনাহ থেকে নবীগণের মাসুম বা পবিত্র হওয়ার বিষয়টি এ রকম যে, তাতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যাতে তারা ভুল-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত। তাতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকা জরুরী। তাতে আরো কিছু বিষয় রয়েছে, তাতে তারা মাসুম কি না এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অর্থাৎ শুরু থেকেই তারা তা থেকে পবিত্র থাকার ব্যাপারে মতভেদ থাকলেও পরিশেষে তারা তা থেকে মাসুম হয়ে যান।

(১) নবীগণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে যেসব বিষয়ের সংবাদ প্রদান করেন, তাতে এবং রিসালাতের তাবলীগ করার ক্ষেত্রে নবীগণ সম্পূর্ণরূপে মাসুম বা নিষ্পাপ। কেননা এ ক্ষেত্রে নিষ্পাপ না হলে নবুওয়াত ও রিসালাতের মাকুসদ পূর্ণ হবে না।

(২) গুনাহ থেকে তারা মাসুম কি না, এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কতিপয় আলেম বলেছেন, তারা কবীরা, ছবগীরা সমস্ত গুনাহ থেকেই মুক্ত। কেননা নবুওয়াতের পদমর্যাদা পাপাচারে লিপ্ত হওয়া এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানি করার অনেক উর্ধ্বে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাদের অনুসরণ করার আদেশ করেছেন। তাদের কাজ-কর্মে পাপাচার থাকলে তাদের অনুসরণ করা বৈধ নয়। তাদেরকে অনুসরণ করার আদেশ দেয়ার অর্থ হলো তাদের সমস্ত কাজই অনুসরণীয়। যেসব আয়াত ও হাদীছে নবীদের কিছু কিছু গুনাহর কথা এসেছে, তারা সেগুলোর ব্যাখ্যা করেছে। অধিকাংশ আলেমের কথা হলো নবীদের পক্ষ হতে ছবগীরা গুনাহ হওয়া সম্ভব। কুরআনুল কারীমে এ মর্মে অনেক দলীল রয়েছে। তবে তারা ছবগীরা গুনাহর উপর স্থির থাকেন না। তা থেকে তাওবা করেন এবং ফিরে আসেন। যেমন ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা অতিক্রান্ত হয়েছে। অতএব তারা ছবগীরা গুনাহর উপর স্থির থাকা থেকে পবিত্র। সুতরাং তাদের থেকে যেসব ছোট-খাটো গুনাহ হয়েছে, আমরা তাতে তাদের অনুসরণ করবো না; বরং তারা যে তাওবা করেছেন, তাতেই তারা আমাদের আদর্শ।


[1]. মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুত্ তাওবা।

[2] . কারামেতা সম্প্রদায়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয়: হামদান ইবনে আশআছ কুরমুতের প্রতি সম্বন্ধ করে এই ঈমান বিধ্বংসী বাতেনী সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়ে থাকে। সংক্ষিপ্তভাবে তাদের কতিপয় আকীদা হচ্ছে, (১) তারা সালাত সিয়ামসহ শরীয়াতের অন্যান্য যাবতীয় ফরয বিষয়গুলোকে বাতিল বলে থাকে। (২) তারা পুনরুত্থান দিবস, আখিরাতের শাস্তি, জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাতি সবকিছুই অস্বীকার করে। জান্নাত বলতে তাদের মতে দুনিয়ার নিয়ামত এবং আযাব বলতে রোযা, সালাত, হজ্জ, জিহাদ ইত্যাদি পালন করার কষ্ট উদ্দেশ্য। (৩) তাদের মতে সিয়াম বলতে গোপন তথ্য ফাঁস করা থেকে বিরত থাকা উদ্দেশ্য। (৪) পুনরুত্থান বলতে তাদের মাযহাব গ্রহণ করা উদ্দেশ্য। (৫) তাদের মতে যার উপর প্রথম মাবুদের তরফ থেকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন শক্তির ফয়েয (বরকত) নাযিল হয়েছে, তিনিই নবী। (৬) মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যে ফয়েয নাযিল হয়েছে এবং তিনি সেটার যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তাই কুরআন। (৭) তাদের মতে অবিনশ্বর মাবুদের সংখ্যা দুইজন। একজন প্রথম অন্যজন দ্বিতীয়। তাদের একজনের কারণেই দ্বিতীয়জন অস্তিত্ব লাভ করেছে। (৮) তাদের কুফুরী মতাদর্শগুলো গোপন রেখে আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শনের মুখোশ পরে তারা মুসলিমদের কাতারে ঢুকে পরে। তারা বলে যে, আহলে বাইতের উপর যুলুম করা হয়েছে। এ কথা বলে তারা মূর্খ লোকদেরকে ধোঁকা দিয়ে থাকে। এ সম্প্রদায় কাবার আঙ্গিনায় হাজীদেরকে হত্যা করে এবং তাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হাজারে আসওয়াদ চুরি করে তাদের অঞ্চলে নিয়ে গিয়েছিল। ২২ বছর পর্যন্ত মুসলিমগণ হাজারে আসওয়াদ ছাড়াই কাবা ঘরের তাওয়াফ করেছে। এটি ছিল ৩১৭ হিজরী সালের ঘটনা। তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য এই কিতাবগুলো পড়ার অনুরোধ রইলো,

(১) الموسوعة الميسرة في الأديان والمذاهب والأحزاب المعاصرة (২) كشف أسرار الباطنية وأخبار القرامطة (৩)الملل والنحل للشهرستاني

دين الأنبياء عليهم الصلاة والسلام واحد - সমস্ত নবী-রসূলের দীন এক ও অভিন্ন

নবী আলাইহিমুস সালামদের দীন একটিই। যদিও তাদের শরী‘আত বিভিন্ন রকম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ﴾

‘‘তিনি তোমাদের জন্য দীনের সেসব নিয়ম-কানুন নির্ধারিত করেছেন যার নির্দেশ তিনি নূহকে দিয়েছিলেন এবং যা আমি তোমার কাছে অহীর মাধ্যমে পাঠিয়েছি। আর যার আদেশ দিয়েছি আমি ইবরাহীম, মূসা, ও ঈসা আলাইহিমুস সালামকে। এই আদেশ দিয়েছিলাম যে, তোমরা দীন কায়েম করো এবং এ ব্যাপারে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’’। (সূরা শুরা: ১৩) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ وَإِنَّ هَٰذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ﴾

‘‘হে রসূলগণ! তোমরা পাক-পবিত্র জিনিস খাও এবং সৎকাজ করো। আর তোমরা সৎকর্ম করো। তোমরা যা কিছুই করো না কেন আমি তা জানি। আর তোমাদের এ উম্মত হচ্ছে একই উম্মত এবং আমি তোমাদের রব, কাজেই আমাকেই তোমরা ভয় করো’’। (সূরা মুমিনুন: ৫১-৫২)

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমরা নবীদের দল। আমাদের দীন মাত্র একটিই। আর নবীগণ পরস্পর সতালো ভাই। ইসলামই হলো নবীদের দীন। এ দীন ছাড়া আল্লাহ তা‘আলা অন্য কোনো দীন কবুল করবেন না। ইসলাম হলো তাওহীদ ও আনুগত্যের সাথে এক আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পন করা এবং শিরক ও মুশরিকদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ঘোষণা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ

‘‘আমি আদিষ্ট হয়েছি যেন আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত হই’’। (সূরা নামাল: ৯১)

আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,

﴿إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ﴾

‘‘যখন তার রব তাকে বললো, মুসলিম হয়ে যাও। তখন সে বলে উঠলো, আমি বিশ্ব-জাহানের প্রভুর জন্য মুসলিম হয়ে গেলাম’’। (সূরা বাকারা: ১৩১) আল্লাহ তা‘আলা মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলেন,

﴿وَقَالَ مُوسَىٰ يَا قَوْمِ إِن كُنتُمْ آمَنتُم بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِن كُنتُم مُّسْلِمِينَ﴾

‘‘ মূসা তার কওমকে বলল, হে লোকেরা! তোমরা যদি সত্যিই আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে থাকো তাহলে কেবল তার উপর ভরসা করো, যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো’’। (সূরা ইউনুস: ৮৪) ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذْ أَوْحَيْتُ إِلَى الْحَوَارِيِّينَ أَنْ آمِنُوا بِي وَبِرَسُولِي قَالُوا آمَنَّا وَاشْهَدْ بِأَنَّنَا مُسْلِمُونَ﴾

‘‘আর যখন আমি হাওয়ারীদেরকে ইঙ্গিত করেছিলাম, আমার ও আমার রসূলের প্রতি ঈমান আনো, তারা বলেছিল, আমরা ঈমান আনলাম এবং সাক্ষী থাকো আমরা মুসলিম’’। (সূরা মায়েদা: ১১১) পূর্ববর্তী যামানার নবীগণ এবং তাওরাত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّا أَنزَلْنَا التَّوْرَاةَ فِيهَا هُدًى وَنُورٌ ۚ يَحْكُمُ بِهَا النَّبِيُّونَ الَّذِينَ أَسْلَمُوا لِلَّذِينَ هَادُوا وَالرَّبَّانِيُّونَ وَالْأَحْبَارُ﴾

‘‘আমি তাওরাত নাযিল করেছি। তাতে ছিল হিদায়াত ও আলো। আল্লাহর অনুগত নবীগণ, আল্লাহ ওয়ালাগণ এবং প--তগণ ইয়াহূদীদেরকে তা দিয়ে যাবতীয় বিষয়ের ফায়সালা প্রদান করতো’’। (সূরা মায়েদা: ৪৪) সাবার রাণী বিলকীস বলেছিলেনঃ

﴿رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين﴾

‘‘হে আমার রব! আমি নিজের উপর বড় যুলুম করেছি এবং এখন আমি সুলাইমানের সাথে আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্য ইসলাম কবুল করে নিয়েছি’’। (নামাল: ৪৪)

সুতরাং সমস্ত নবী-রসূলের দীন হলো ইসলাম। একমাত্র আল্লাহর জন্য আত্মসমর্পন করাকে ইসলাম বলা হয়। যে ব্যক্তি একই সময় আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য আত্মসমর্পন করে সে মুশরেক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য আত্মসমর্পন করে না, সে অহঙ্কারী। যারা শিরক করে এবং যারা অহঙ্কার বশতঃ আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করা থেকে বিরত থাকে, তারা সবাই কাফের। আল্লাহ তা‘আলার জন্য আত্মসমর্পন, এককভাবে তার ইবাদত করা এবং একমাত্র তার অনুসরণ করাকে শামিল করে। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহ তা‘আলার যেসব আদেশ রয়েছে, যথাসময়ে তা সম্পন্ন করার মাধ্যমেই তার আনুগত্য করা সম্ভব। ইসলামের প্রথম যুগে বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে সালাত  পড়ার আদেশ ছিল, পরবর্তীতে তা রহিত করে কাবার দিকে মুখ ফিরানোর আদেশ করা হয়েছে। এ উভয়ই কাজের আদেশ যখন করা হয়েছিল, প্রত্যেকটি কাজই ইসলামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুতরাং দীন হলো আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্য করার নাম।

বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে ফিরে সালাত  আদায় করা এবং কাবার দিকে ফিরে সালাত  আদায় করা উভয়টিই আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত। তবে আমলটি আদায়ের পদ্ধতির ভিন্নতা মাত্র। আর তা হলো সালাত ীর মুখ ফিরানো। এমনি রসূলদের দীন মাত্র একটিই। যদিও তার হুকুম-আহকাম, পথ-পদ্ধতি এবং রীতি-নীতি ভিন্নতর হয়। এ ভিন্নতা দীন এক হওয়ার পরিপন্থী নয়। এমনি একই রসূলের শরী‘আত বিভিন্ন হওয়া দোষণীয় নয়। যেমন আমরা ইতিপূর্বে বাইতুল মাকদিসের দিকে সালাত পড়ার উদাহরণ দিয়েছি। অতঃপর দ্বিতীয় পর্যায়ে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শরী‘আতেই কাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে সালাত  পড়ার হুকুম করা হয়েছে।

সুতরাং নবীদের শরী‘আত বিভিন্ন রকম হলেও তাদের দীন মাত্র একটি। বিশেষ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা এক সময় একটি বিষয় শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত করেন, অন্য সময় বিশেষ উদ্দেশ্যে আরেকটি আদেশ করেন। রহিত হওয়ার পূর্বে রহিত বিষয়ের উপর আমল করা আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের অন্তর্ভুক্ত। রহিত হওয়ার পর রহিতকারী বিষয়ের উপর আমল করা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি রহিতকারী বিষয় পরিত্যাগ করে রহিত কৃত বিষয়ের উপরই থেকে যাবে, সে দীন ইসলামের উপর থাকতে পারবেনা। এমনকি সে কোনো নবীর অনুসরণকারী হিসাবেই গণ্য হবেনা। এ জন্যই ইয়াহূদী- খ্রিষ্টানদের কাফের হিসাবে গণ্য করা হবে। কেননা তারা পরিবর্তিত ও রহিত শরী‘আতকেই আঁকড়ে ধরেছে।

আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জাতির জন্য তাদের অবস্থা ও সময় অনুপাতে শরী‘আত নির্ধারণ করেন এবং তাদের কল্যাণার্থে সেটা সংশোধন করার দায়িত্ব নেন। অতঃপর সেসব শরী‘আতের মেয়াদ শেষে সেটা থেকে আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা রহিত করেন। পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলা তার সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যমীনবাসীর নিকট পাঠালেন। কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীতে আসবে, তাদের সকলের জন্য তিনিই নবী হিসাবে থাকবেন। তাকে এমন শরী‘আত দিয়ে পাঠানো হয়েছে, যা সর্বকালের সকল মানুষের জন্য উপযোগী। এ শরী‘আতের কোনো পরিবর্তন কিংবা রদবদল হবেনা। সমস্ত যমীনবাসীর জন্য তার অনুসরণ এবং তার প্রতি ঈমান আনয়ন করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ  إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا  ‘‘হে মুহাম্মাদ! বলে দাও, হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রসূল হিসাবে এসেছি’’। (সূরা আল আরাফ: ১৫৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾

‘‘আর আমি তো তোমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে পাঠিয়েছি। কিন্তু বেশীর ভাগ লোক জানে না’’। (সূরা সাবা: ২৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ﴾ ‘‘হে মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে সৃষ্টিজগতের জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি’’। (সূরা আন্বীয়া: ১০৭) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَٰكِن رَّسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا﴾

‘‘মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে কারোর পিতা নন। কিন্তু তিনি আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত’’। (সূরা আহযাব: ৪০)

আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যে আয়াতগুলো নাযিল করেছেন, তাতে সমস্ত জিন-ইনসানকে সম্বোধন করা হয়েছে এবং জাতিগত ভেদাভেদের উর্ধ্বে থেকে তাদের সকলকে এক দীনের বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়েছে। আরবদের জন্য কোনো খাস হুকুম নাযিল করা হয়নি। বরং কুরআনের হুকুম-আহকামগুলোর সম্বন্ধ করা হয়েছে কাফের, মুমিন, মুসলিম, মুনাফিক, পূণ্যবান, পাপিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ন, যালেম এবং কুরআন ও হাদীছে উল্লেখিত ইত্যাদি নামের প্রতি।  সুতরাং কুরআন ও হাদীছে আরবদেরকে খাস করে বিশেষ কোনো শরঈ হুকুম প্রদান করা হয়নি। বরং হুকুমগুলোকে ছিফাত বা বিশেষণের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে।  আল্লাহ তা‘আলা বান্দার যেসব কাজ-কর্ম ভালোবাসেন তা সম্পন্নকারীদেরকে উত্তম বিনিময় প্রদান করার ওয়াদা করা হয়েছে এবং তাদের যেসব খারাপ আমলকে অপছন্দ করেন, তার অধিকারীদেরকে শাস্তি প্রদানের ধমক দেয়া হয়েছে।

শুধু তাবলীগ করার জন্যই আরবী ভাষায় কুরআন নাযিল করা হয়েছে। প্রথমত তিনি তার সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে তাবলীগ করেছেন। অতঃপর তাদের মাধ্যমে সমগ্র জাতির নিকট সেটা প্রচার করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে প্রথমে স্বীয় গোত্রের কাছে তাবলীগ করার আদেশ করেছেন। অতঃপর তার নিকটতম লোকদেরকে পর্যায়ক্রমে সতর্ক করার আদেশ দিয়েছেন। এমনিভাবে প্রথমে পার্শ্ববর্তী কাফেরদের অতঃপর দূরবর্তী কাফেরদের বিরুদ্ধে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার হুকুম করা হয়েছে। এর মধ্যে তাদের বিশেষ কোনো বিশেষত্ব নেই। বরং তাবলীগ করার ক্ষেত্রে কেবল ধীরে ধীরে ও পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হওয়ার নীতি অবলম্বন করা হয়েছে।

মোটকথা নবীদের দীন মাত্র একটিই। আর তা হচ্ছে এখলাসের সাথে আল্লাহর ইবাদত করা এবং শিরক ও ফাসাদ থেকে বিরত থাকা। পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজন অনুপাতে যদিও তাদের শরী‘আত বিভিন্ন হয়েছে, কিন্তু তাদের দীনের মূল কথা একই। এভাবেই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত এসে নবী-রসূলদের ধারাবাহিকতা শেষ হয়েছে।[1]

সমগ্র সৃষ্টির জন্যই তার রিসালাত এবং তা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তা পরিবর্তন, রদবদল কিংবা রহিত হবেনা। এটি সকল যুগের সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্যই উপকারী এবং সর্বকাল ও সর্বস্থানের মানুষের জন্যই রক্ষাকবচ। তার পরে কিয়ামত পর্যন্ত আর কোনো নবী আসবেনা। তার পূর্বের নবী-রসূলগণকে ঈমান আনয়ন করাসহ শরী‘আতের হুকুম-আহকাম বাস্তবায়নের মাধ্যমে এখলাসের সাথে আল্লাহর ইবাদত করার যে আদেশ দেয়া হয়েছে, তাকেও সেই একই আদেশ প্রদান করা হয়েছে। তিনি ছিলেন তার পূর্বেকার নবীদেরকে সত্যায়নকারী। তার পূর্বের নবীগণ তার আগমণের সুখবর দিয়েছেন। বিশেষ করে সময়ের দিক থেকে তার নিকটতম নবী ঈসা ইবনে মারইয়াম আলাইহিস সালাম তার সম্প্রদায়কে বলেছেন,

﴿يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُم مُّصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيَّ مِنَ التَّوْرَاةِ وَمُبَشِّرًا بِرَسُولٍ يَأْتِي مِن بَعْدِي اسْمُهُ أَحْمَدُ﴾

 ‘‘হে বনী ইসরাঈল, আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর প্রেরিত রসূল। আমি তাওরাতের সত্যায়নকারী যা আমার পূর্বে এসেছে এবং একজন রসূলের সুসংবাদদাতা যিনি আমার পরে আসবেন, যার নাম আহমাদ’’। (সূরা সাফ: ৬)

পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহে আমাদের রসূলের এমন বৈশিষ্টের বিবরণ এসেছে, যা একদম সুস্পষ্ট। ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানদের মধ্য থেকে যারা তাকে রসূল হিসাবে বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেছে, তারা কেবল হিংসা ও অহংকারের বশবতী হয়েই করেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ﴾

‘‘যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা তাকে সেভাবেই চেনে যেমন নিজেদের সন্তানদেরকে চেনে। কিন্তু তাদের একদল লোক জেনেবুঝে সত্য গোপন করে থাকে’’। (সূরা আল-বাকারা: ১৪৬)

হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সামনে সত্যকে সত্য হিসাবে দেখাও এবং সেটার অনুসরণ করার তাওফীক দাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সামনে বাতিলকে বাতিল হিসাবে দেখাও এবং সেটা পরিত্যাগ করার তাওফীক দাও।


[1]. সহীহ হাদীছে এসেছে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন দালানের সর্বশেষ ইট।

ذكر خصائص الرسول محمد صلى الله عليه وسلم إجمالا - সংক্ষেপে রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কিছু বৈশিষ্ট্য

রসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এমন বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা দ্বারা তিনি অন্যান্য নবীদের চেয়ে বিশেষ ফযীলতের অধিকারী হয়েছেন। এমনি তার এমন আরো কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে, যা দ্বারা তিনি তার উম্মত থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য লাভ করেছেন।

অন্যান্য নবীদের তুলনায় তার কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য:

(১) তিনি হলেন সর্বশেষ নবী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿مَّا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِّن رِّجَالِكُمْ وَلَٰكِن رَّسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا﴾

‘‘মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে কারোর পিতা নন। কিন্তু তিনি আল্লাহর রসূল এবং শেষ নবী। আর আল্লাহ সর্ববিষয়ে সম্যক অবগত’’। (সূরা আহযাব: ৪০) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«وَإِنَّهُ سَيَكُونُ في أمتي بَعْدِي ثَلَاثُونََ كذَّابُونَ كُلُّهُمْ يَزعم أَنَّهُ نَبِيٌّ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لَا نَبِيَّ بَعْدِي»

‘‘আমার উম্মতের মধ্যে আমার পরে ত্রিশজন মিথ্যুকের আগমন ঘটবে। তারা সকলেই নবুওয়াতের দাবী করবে। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী। আমার পর কিয়ামতের পূর্বে আর কোনো নবী নেই’’।[1]

(২) তাকে মাকামে মাহমুদ প্রদান করা হয়েছে। আর এটিই হলো শাফা‘আতে উযমা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴾  ﴿عَسَى أَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُودًا‘‘তোমার প্রতিপালক তোমাকে অচিরেই একটি প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৭৯)

বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত শাফা‘আতের দীর্ঘ হাদীছে এসেছে, আল্লাহ তা‘আলা যখন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত বনী আদমকে একই যমীনে একত্রিত করবেন তখন তারা পরস্পর বলাবলি করবে, তোমরা কি দেখছো না, তোমরা কী অবস্থায় আছো? তোমরা কি দেখছো না তোমাদের কেমন কষ্ট হচ্ছে? তোমরা কি এমন কাউকে খুঁজবে না, যিনি তোমাদের জন্য তোমাদের প্রভুর নিকট সুপারিশ করবেন? অতঃপর তারা দ্রুত বিচার সম্পন্ন করতে আল্লাহর নিকট সুপারিশ করার জন্যে পর্যায়ক্রমে আদম, নুহ, ইবরাহীম, মূসা এবং ঈসা ইবনে মারইয়ামের কাছে গমণ করবে। সকলেই অক্ষমতা প্রকাশ করে বলবে, তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে অন্যের কাছে যাও। পরিশেষে তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসবে। তিনি বলবেন, আমি তা করবো। অতঃপর তিনি শাফা‘আত করার অনুমতি না দেয়া পর্যন্ত সিজদায় পড়ে থাকবেন’’।[2] উপরোক্ত হাদীছের মাধ্যমে সমগ্র সৃষ্টির উপর আমাদের নবীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় এবং সম্মানিত স্থান মাকামে মাহমুদে অধিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে তার বিশেষত্ব প্রমাণিত হয়।

(৩) তিনি সমস্ত জিন-ইনসানের নিকট প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ  إِنِّي رَسُولُ اللَّهِ إِلَيْكُمْ جَمِيعًا﴾  ‘‘হে মুহাম্মাদ! বলো, হে মানব সম্প্রদায়, আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রসূল হিসাবে এসেছি’’। (সূরা আরাফ: ১৫৮)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴾

‘‘আর আমি তো তোমাকে সমগ্র মানব জাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও ভীতি প্রদর্শনকারী রূপে পাঠিয়েছি। কিন্তু বেশীর ভাগ লোক জানেনা’’। (সূরা সাবা: ২৮) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَىٰ عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا﴾

‘‘বড়ই বরকত সম্পন্ন তিনি, যিনি তারঁ বান্দার উপর নাযিল করেছেন এ ফুরকান। যাতে সে সমগ্র সৃষ্টির জন্য সতর্ককারী হন’’। (সূরা ফুরকান: ১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, ﴿وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ﴾ ‘‘হে মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে সৃষ্টিজগতের জন্য আমার রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি’’। (সূরা আন্বীয়া: ১০৭) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذْ صَرَفْنَا إِلَيْكَ نَفَرًا مِّنَ الْجِنِّ يَسْتَمِعُونَ الْقُرْآنَ فَلَمَّا حَضَرُوهُ قَالُوا أَنصِتُوا فَلَمَّا قُضِيَ وَلَّوْا إِلَىٰ قَوْمِهِم مُّنذِرِينَ﴾

 ‘‘আর যখন আমি জিনদের একটি দলকে তোমার কাছে নিয়ে পাঠিয়েছিলাম, যাতে তারা কুরআন শোনে। যখন তারা সেখানে পৌঁছলো তখন পরস্পরকে বললো, চুপ করো। যখন তা পাঠ করা শেষ হলো তখন তারা সতর্ককারী হয়ে নিজ নিজ কওমের কাছে ফিরে গেল’’। (সূরা আহকাফ: ২৯)

সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমগ্র মানব ও জিন জাতির নিকট প্রেরিত হয়েছেন।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যেসব আয়াত নাযিল করা হয়েছে, তাতে জিন-ইনসান সকলকে সম্বোধন করা হয়েছে। কেননা তার রিসালাত তাদের সকলের জন্যই। যদিও আরবদের মধ্যে শিরক, অশ্লীলতা, পাপাচার, অন্যায়-অপকর্ম অনুপ্রবেশ করার কারণেই কেবল তার উপর কুরআন নাযিল হয়েছে। তবে মুসলিমদের ঐক্যমতে এটা সাব্যস্ত যে, কুরআনের যেসব আয়াত বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়েছে, সেগুলো উক্ত কারণের সাথেই খাস। কোনো মুসলিম বলেনি যে, তালাকের আয়াত, যিহারের আয়াত, লিআনের আয়াত, চোরের শাস্তি সংক্রান্ত আয়াত এবং সন্ত্রাসীদের শাস্তি সংক্রান্ত আয়াত ঐ ব্যক্তির সাথেই খাস, যাকে কেন্দ্র করে সেটা নাযিল হয়েছে।


[1]. আবু দাউদ, তিরমিযী, অধ্যায়: কিতাবুল ফিতান। ইমাম আলবানী সহীহ বলেছেন, মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীছ নং- ৫৪০৬।

[2]. বুখারী, অধ্যায়: কিতাবুর্ রিকাক, শারহুল আকীদা আত-তাহাবীয়াহ, পৃষ্ঠা নং- ২০৪।

মোটকথা কুরআনের কতক আয়াত আরবদের মধ্যে বিদ্যমান দোষ-ত্রুটিকে কেন্দ্র করে নাযিল হয়েছে, কিন্তু আয়াতগুলোর হুকুম ব্যাপক। শব্দগত ও অর্থগত উভয় দিক থেকেই যে কোনো শ্রেণীর মানুষের মধ্যে তা বিদ্যমান থাকবে, তাদের উপর আয়াতগুলো প্রয়োগ করা হবে। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া  সাল্লামের দাওয়াত জিন-ইনসান সকলের জন্যই। জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্যই তার দাওয়াত। সুতরাং কেউ যেন এটি মনে না করে যে, ইসলামের কোনো হুকুম শুধু আরবদের জন্যই খাস। বরং কুরআনে মুসলিম, কাফের, মুমিন, মুনাফেক, নেককার, বদকার, সৎকর্মশীল, যালেম এবং কুরআন-হাদীছে উল্লেখিত অন্যান্য বিভিন্ন নামের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা হুকুম উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীছে শরী‘আতের কোনো হুকুমই আরবদের জন্য খাস করে নাযিল হয়নি। তাতে কেবল আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রিয় আমল ও তার নিকট অপ্রিয় আমলের উপর আলাদা আলাদাভাবে হুকুম প্রয়োগ করা হয়েছে। তিনি যা ভালোবাসেন সাধ্যানুসারে তা করার হুকুম করেছেন। তিনি যা ঘৃণা করেন, তা থেকে নিষেধ করেছেন এবং সেটা থেকে বিরত থাকার আদেশ দিয়েছেন। আরবদের জন্য খাস করে শরী‘আতের কোনো হুকুমই প্রদান করা হয়নি। কেননা তার দাওয়াত ছিল সমস্ত সৃষ্টির জন্য। তবে আরবদের ভাষায় এবং কুরাইশদের ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে। যাতে করে তিনি আরবদের জন্য এর তাবলীগ করতে পারেন। তাই তিনি প্রথমে আরবদের মাঝে তাবলীগ করেছেন। অতঃপর আরবদের মাধ্যমে সমস্ত জাতির কাছে দীনের দাওয়াত পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার নবীকে সর্বপ্রথম তাবলীগ করার আদেশ দিয়েছেন এবং পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে পার্শ্ববর্তী লোকদের নিকট তাবলীগ করার আদেশ করেছেন। ইসলামের জন্য জিহাদ করার ক্ষেত্রেও তিনি প্রথমে পার্শ্ববর্তী কাফেরদেরকে অতঃপর অন্যান্য কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার আদেশ করেছেন।

তিনি যেমন প্রেরিত হয়েছিলেন মানব জাতির প্রতি তেমনি প্রেরিত হয়েছেন জিন জাতির প্রতি। জিনেরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কুরআন তেলাওয়াত শুনেছিল। অতঃপর তারা সতর্ককারী হয়ে নিজ কওমের কাছে ফিরে গিয়েছিল। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা এ মর্মে সংবাদ দিয়েছেন। মুসলিমদের ঐক্যমতে এটি সুসাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে জিন-ইনসানকে উল্লেখ করে যে সম্বোধন করেছেন, তা এই মূলনীতিকে সুস্পষ্ট করে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِّنكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي وَيُنذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَٰذَا﴾  

‘‘হে জিন ও মানব সম্প্রদায়! তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য থেকে রসূলগণ আসেনি, যারা তোমাদেরকে আমার আয়াত শোনাতো এবং এ দিনটির সাক্ষাৎ সম্পর্কে তোমাদেরকে সর্তক করতো?’’ (সূরা আনআম: ১৩০)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,﴿وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُونَ وَمِنَّا دُونَ ذَٰلِكَ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَدًا﴾  ‘‘আর আমাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আছে নেককার আর কিছু লোক আছে তার চেয়ে নীচু পর্যায়ের। এভাবে আমরা বিভিন্ন মতে বিভক্ত ছিলাম’’। (সূরা জিন: ১১) অর্থাৎ বিভিন্ন মাযহাবে বিভক্ত ছিলাম। মুসলিম, কাফের, আহলে সুন্নাত, আহলে বিদআত ইত্যাদি বিভিন্ন তরীকায় বিভক্ত ছিলাম। তারা আরো বলেছিল,

﴿وَأَنَّا مِنَّا الْمُسْلِمُونَ وَمِنَّا الْقَاسِطُونَ فَمَنْ أَسْلَمَ فَأُولَٰئِكَ تَحَرَّوْا رَشَدًا﴾

‘‘আর আমাদের মধ্যে আছে মুসলিম আর যালেম। তবে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছে তারা নিঃসন্দেহে সত্য পথ বেছে নিয়েছে’’। (সূরা জিন: ১৪) القاسط অর্থ হলো সত্য পথ থেকে বিচ্যুত। যখন কেউ যুলুম করে, তখন বলা হয়, قسط। আর যখন ন্যায়নীতি অবলম্বন করে, তখন বলা হয় أقسط।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ বলেন, মানুষের উপর জানা আবশ্যক যে, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সমস্ত জিন-ইনসানের জন্য রসূল হিসাবে পাঠিয়েছেন এবং তাদের উপর তার প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন তার আনুগত্য করা আবশ্যক করেছেন। সুতরাং তার উম্মতের উপর আবশ্যক হলো, আল্লাহ তা‘আলা যা হালাল করেছেন ও তার রসূল যা হালাল করেছেন তা হালাল মনে করবে, আল্লাহ তা‘আলা ও তার রসূল যা হারাম করেছেন, তা হারাম মনে করবে, আল্লাহ তা‘আলা এবং তার রসূল যা ভালোবাসেন, তার প্রতি ভালোবাসা রাখা এবং আল্লাহ তা‘আলা ও তার রসূল যা অপছন্দ করেন, তার প্রতি ঘৃণাবোধ রাখা আবশ্যক। জিন-ইনসানের মধ্য থেকে যাদের কাছে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের প্রমাণাদি আসার পর তারা যদি তার প্রতি ঈমান না আনয়ন করে, তাহলে তারা আল্লাহ তা‘আলার শাস্তির হকদার হবে। অনুরূপ যেসব কাফেরের নিকট রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করা হয়েছিল, তাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনয়ন করেনি, তারাও আযাবের হকদার হবে। এটি সাহাবী, তাবেঈ, উত্তমভাবে তাদের অনুসারী, মুসলিমদের ইমাম এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের সমস্ত ফির্কার ঐক্যমত দ্বারা সুসাব্যস্ত। আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকলের উপর সন্তুষ্ট হোন।

(৪) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তার উপর এমন কুরআন নাযিল হয়েছে, যার মুজিযার সামনে জিন-ইনসান নতি স্বীকার করেছে, যার মোকাবেলা করতে জিন-ইনসানের সমস্ত পক্ষই বিরত হয়েছে এবং সমস্ত ধর্মের ভাষাবিদগণ সেটার সর্বাধিক ছোট সূরার অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে আনয়ন করতে অপারগতা স্বীকার করেছে। ইতিপূর্বে এর বিস্তারিত বিবরণ অতিক্রান্ত হয়েছে।

(৫) সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত মিরাজের ঘটনা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট। এখানেই শেষ নয়; সেখান থেকে আরো উপরে উঠে এমন স্থানে পৌঁছে গেলেন, যেখান থেকে তিনি কলমের লেখার (খসখস) শব্দ শুনতে পেলেন। অতঃপর তাদের মাঝে মুখোমুখি দু’টি ধনুকের কিংবা তার চেয়ে কিছু কম ব্যবধান রাইলো।

আর উম্মতের অন্যান্য লোকের উপর তার ফযীলত ও শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে ইমাম কুরতুবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে শরী‘আতের ফরয, হারাম হালাল সম্পর্কিত এমন কিছু বিশেষ হুকুম প্রদান করেছেন, যাতে উম্মতের কেউ শরীক নয়। এগুলো আল্লাহ তা‘আলা তাকে দান করেছেন এবং এগুলো তার খাস মর্যাদা। তার উপর এমন কিছু জিনিস ফরয করা হয়েছে, যা অন্যদের উপর ফরয করা হয়নি এবং তার উপর এমন কিছু জিনিস হারাম করা হয়েছে, যা অন্যদের উপর হারাম করা হয়নি। তার জন্য এমন কিছু জিনিস হালাল করা হয়েছে, যা অন্যদের জন্য হালাল করা হয়নি। এগুলোর মধ্য থেকে কিছু কিছু বিষয় আলেমদের ঐক্যমতে তার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে আবার কিছু কিছু বিষয়ে আলেমদের মতবিরোধ রয়েছে। অতঃপর শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া রাহিমাহুল্লাহ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার খাস বৈশিষ্টগুলো উল্লেখ করেছেন।

তার মধ্য থেকে (১) রাতের বেলায় তার জন্য তাহাজ্জুদের সালাত  আদায় করা ফরয ছিল। বলা হয়ে থাকে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর মৃত্যু পর্যন্ত তাহাজ্জুদ সালাত  পড়া ফরয ছিল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ﴿يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ قُمِ اللَّيْلَ إِلَّا قَلِيلًا﴾ ‘‘হে বস্ত্র মুড়ি দিয়ে শয়নকারী রাতের বেলা নামাযে রত থাকো। তবে কিছু সময় ছাড়া’’। (সূরা মুযাম্মেল: ১-২) কুরআনের বক্তব্য দ্বারা সাব্যস্ত হচ্ছে যে, তাহাজ্জুদ সালাত  তার উপর ওয়াজিব ছিল। অতঃপর তা রহিত হয়ে গেছে।

(২) তিনি যখন কোনো আমল করতেন, তা সর্বদা চালু রাখতেন।

(৩) তার উপর এবং তার পরিবারের জন্য মানুষের যাকাত গ্রহণ নিষিদ্ধ ছিল।

(৩) তার জন্য সেহরী না খেয়ে কিংবা একটানা দু’দিন পর্যন্ত রাতের বেলা কিছু না খেয়ে সিয়াম পালন/রোযা রাখা বৈধ ছিল।

(৪) তার জন্য চারের অধিক বিবাহ করা বৈধ করা হয়েছে।

(৫) মক্কাতে তার জন্য যুদ্ধ করার অনুমতি ছিল।

(৬) তার সম্পদের কোনো ওয়ারিছ হবে না।

(৭) তার স্ত্রীগণ তার মৃত্যুর পরও স্ত্রী হিসাবেই থাকবেন। তিনি যখন তার কোনো স্ত্রীকে তালাক দিতেন, তখন সে স্ত্রীকে বিবাহ করা অন্য কারো জন্য বৈধ ছিল না। এ ছাড়াও তার আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

এখানে আমরা আমাদের নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্য থেকে তিনটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো, ইনশা-আল্লাহ।

(১) ইসরা ও মিরাজ,

(২) সর্বকালের সমগ্র জিন-ইনসানের জন্য তার রিসালাত এবং

(৩) তার মাধ্যমে নবুওয়াত খতম-শেষ করা হয়েছে।

أولا: الإسراء والمعراج - প্রথমত ইসরা ও মি’রাজ

আল্লাহ তা‘আলা মিরাজের ঘটনায় বলেন,

﴿سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾

‘‘পবিত্র তিনি যিনি নিয়ে গেছেন এক রাতের কিয়দাংশে নিজের বান্দাকে মাসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশকে আমি করেছি বরকতময়। যাতে আমি তাকে নিজের কিছু নিদর্শন দেখাই। তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১)

হাফেয ইমাম ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ এ আয়াতে কারীমার তাফসীরে বলেন, আল্লাহ তা‘আলা এখানে নিজের বড়ত্ব ও শান বর্ণনা করেছেন। কারণ তিনি এমন সব বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান, যার উপর তিনি ছাড়া অন্য কেউ ক্ষমতাবান নন। তিনি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং তিনি ছাড়া আমাদের কোনো রব নেই। তিনি তার বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাতের অন্ধকারে ভ্রমণ করিয়েছেন মাসজিদুল হারাম তথা মক্কার মাসজিদ থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত এটি জেরুযালেম শহরে অবস্থিত। ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম থেকে শুরু করে এ শহরটি নবীদের কেন্দ্রস্থল। এ জন্যই মুহম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য সমস্ত নবীকে মিরাজের রাতে সেখানে একত্রিত করা হয়েছে। তিনি তাদের শহরে এবং তাদের বাড়িতে গিয়ে সালাতে তাদের ইমামতি করেছেন। এতে বুঝা গেলো তিনিই হলেন ইমামে আযাম এবং তিনিই অগ্রনায়ক। আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত নবী-রসূলের উপর রহম করুন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, باركناحوله ‘‘আমি তার আশপাশকে বরকতময় করেছি’’। অর্থাৎ সেখানকার ফল ও ফসলে বরকত দান করেছি। যাতে তাকে আমার বড় বড় নিদর্শন দেখাতে পারি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لَقَدْ رَأَىٰ مِنْ آيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَىٰ﴾

‘‘তিনি তার রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ দেখেছেন’’ (সূরা নাযম:১৮)।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ﴾

‘‘তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’ (সূরা মু‘মিন:৫৬)।

অর্থাৎ তিনি তার বান্দাদের সমস্ত কথা শুনেন। মুমিন, কাফের, সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী সকলের কথাই শুনেন এবং তাদের সকলের অবস্থাই দেখেন। সুতরাং দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের উপযুক্ত বিনিময় প্রদান করবেন।

 المعراج শব্দটি مفعال এর ওজনে ব্যবহৃত হয়েছে। উপরে উঠার যন্ত্রকে المعراج বলা হয়। এটি সিড়ির মতোই। কিন্তু সেটা কেমন, তা জানা সম্ভব নয়। এর হুকুম অন্যান্য গায়েবী বিষয়ের হুকুম একই রকম। আমরা এগুলোর উপর ঈমান আনয়ন করি। কিন্তু এগুলোর কাইফিয়্যাত জানার চেষ্টা করি না।

 হাদীছের হাফেযগণ বলেন, নবুওয়াতের পর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কাতে থাকা কালে হিজরতের একবছর পূর্বে একবার মিরাজ হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, মিরাজ হয়েছিল হিজরতের একবছর দুই মাস পূর্বে। ইমাম ইবনে আব্দিল বার এরকমই উল্লেখ করেছেন।

صفة الإسراء والمعراج - কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসরা ও মিরাজের ধরণ

হাফেয ইবনে কাছীর রাহিমাহুল্লাহ তার তাফসীরে বলেন, সঠিক কথা হচ্ছে, তাকে জাগ্রত অবস্থায় রাতের বেলা মক্কা থেকে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত ভ্রমণ করানো হয়েছে; স্বপ্নযোগে নয়। তিনি বোরাকের উপর আরোহন করে ভ্রমণ করেছেন। তিনি যখন মাসজিদুল আকসার দরজা পর্যন্ত পৌঁছালেন, তখন দরজার নিকট বোরাক বেধে মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করলেন। অতঃপর মাসজিদের কিবলার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাহিয়াতুল মাসজিদ দুই রাক‘আত সালাত পড়লেন। অতঃপর তার জন্য সিড়ি আনয়ন করা হলো। এটি হচ্ছে বিভিন্ন স্তরবিশিষ্ট সিড়ি, যা দ্বারা উপরে উঠা হয়। সুতরাং এ সিড়ির মাধ্যমে তিনি প্রথমে দুনিয়ার আসমানে আরোহন করলেন। অতঃপর দ্বিতীয় আসমানে আরোহন করলেন। অতঃপর তিনি অন্যান্য আসমানে আরোহন করলেন। প্রত্যেক আকাশের নৈকট্যশীল ফেরেশতাগণ তাকে সংবর্ধনা জানালো। সমস্ত আসমানের নবীদের মর্যাদা ও সম্মান অনুযায়ী তাদেরকে সালাম দিলেন। ষষ্ঠ আসমানে মূসা কালীমুল্লাহ আলাইহিস সালামের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেছেন এবং সপ্তম আসমান ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। অতঃপর তিনি উভয়ের অবস্থানস্থল অতিক্রম করেছেন। আল্লাহ তার প্রতি, মূসা আলাইহিস সালামের প্রতি এবং সমস্ত নবীর প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। পরিশেষে তিনি এমন স্থানে পৌঁছে গেলেন, যেখান থেকে তিনি কলম দিয়ে লেখার আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন। অর্থাৎ যা কিছু হবে তাক্বদীর লেখার কলম দিয়ে তা লেখার আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি সিদরাতুল মুনতাহা দেখতে পেলেন। আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব, স্বর্ণের প্রজাপতি এবং বিভিন্ন রং তাকে আচ্ছাদিত রেখেছে ও তাকে ছায়া দিচ্ছে। সেই সঙ্গে ফেরেশতারা সেটাকে ঘিরে রেখেছে। সেখানে জিবরীল আলাইহিস সালামকে তার আসল আকৃতিতে দেখতে পেলেন। তার রয়েছে ছয়শত পাখা। সেখানে তিনি সবুজ রঙের রাফরাফ দেখলেন, যা দিগন্তকে বন্ধ করে রেখেছে। তিনি সেখানে বাইতুল মা’মুর দেখতে পেলেন। তিনি দেখলেন, পৃথিবীতে কাবা নির্মাণকারী ইবরাহীম আলাইহিস সালাম বাউতুল মামুরের সাথে হেলান দিয়ে বসে রয়েছেন। কেননা ইহাই হলো আসমানের কাবা। প্রতিদিন বাইতুল মামুরে ৭০ হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করে সেখানে ইবাদত করার জন্য। একবার যারা প্রবেশ করে কিয়ামত পর্যন্ত তারা দ্বিতীয়বার তাতে প্রবেশ করার সুযোগ পায় না।

ঐরাতে তিনি জান্নাত ও জাহান্নাম দেখেছেন। সেখানে তার উপর ৫০ ওয়াক্ত সালাত  ফরয করা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের প্রতি দয়া পরবশ হয়ে পাঁচ ওয়াক্তে পরিণত করেছেন। এখান থেকেই সালাতের মর্যাদা সম্পর্কে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। অতঃপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে নেমে আসলেন এবং তার সাথে নবীগণও নেমে আসলেন। সালাতের সময় হলে তিনি তাদেরকে নিয়ে সালাত পড়েছেন। এটি সম্ভবত সেদিনকার ফজরের সালাত  ছিল। কেউ কেউ মনে করে তিনি আসমানে তাদেরকে নিয়ে সালাত পড়েছেন এবং নামাযে তাদের ইমামতি করেছেন। তবে এ বিষয়ে বর্ণনাগুলো সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, তিনি বাইতুল মুকাদ্দাসে ইমামতি করেছেন। কিছু কিছু বর্ণনা প্রমাণ করে যে, প্রথমবার প্রবেশ করার সময় সালাত  পড়েছেন। তবে ফিরে আসার সময় সালাত পড়াই অধিক সুস্পষ্ট। কেননা তিনি যখন নবীদের পাশদিয়ে নিকট দিয়ে অতিক্রম করেছেন, তখন তাদের সম্পর্কে একজন একজন করে জিবরীলকে জিজ্ঞাসা করেছেন। জিবরীল তাকে বলে দিয়েছেন। এমতটিই যথার্থ। কারণ তাকে প্রথমে উর্ধ্বজগতে রবের সান্নিধ্যে ডেকে নেয়া হয়েছিল। যাতে করে আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা তার উম্মতের উপর ফরয করেন। যে জন্য তাকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তা শেষ হলে তিনি এবং অন্যান্য নবীগণ বাইতুল মুকাদ্দাসে একত্রিত হয়েছেন। ইমামতি করার জন্য তাকে আগে বাড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে তার সম্মান ও ফযীলত সাব্যস্ত হয়েছে। জিবরীল আলাইহিস সালামের ইঙ্গিতেই তিনি নামাযে নবীদের ইমামতি করেছেন। অতঃপর তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে বের হয়ে বোরাকে আরোহন করে অন্ধকার থাকতেই মক্কায় ফিরে আসলেন। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »