আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَاءُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا
‘‘আপনি কি তাদেরকে দেখেন নি যারা আপনার উপর যে কিতাব নাযিল হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে বলে দাবী করে? তারা বিচার ফয়সালার জন্য তাগুত এর কাছে যায়, অথচ তা অস্বীকার করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর শয়তান তাদেরকে চরম গোমরাহীতে নিমজ্জিত করতে চায়। আর যখন তাদেরকে বলা হয় এসো সেই জিনিষের দিকে, যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন এবং এসো রাসূলের দিকে তখন তুমি মুনাফেকদেরকে দেখবে, ওরা তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি তাদের কৃতকর্মের দরুন বিপদ এসে যায়, অতঃপর তারা তোমার কাছে আল্লাহ্র নামে কসম করতে করতে ফিরে আসে এবং বলে, মঙ্গল ও সম্প্রীতি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিলনা’’। (সূরা নিসাঃ ৬০)
ব্যাখ্যাঃ হাফেয ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ উক্ত আয়াতগুলোতে ঐ ব্যক্তির দোষারোপ করা হয়েছে, যে কুরআন ও সুন্নাহ বাদ দিয়ে অন্যান্য বাতিল বিষয়ের ফয়সালা কবুল করে। এখানে তাগুত বলতে এটিই উদ্দেশ্য। যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্যের এবাদত করল, এবাদতের যে কোনো প্রকারের মাধ্যমেই তা হোক না কেন, যেমন আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে দুআ করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে মদদ চাওয়া ইত্যাদি, সেই মাবুদ যদি কোনো সৎ লোক হয়, তাহলে সেই এবাদত শয়তানের এবাদত বলেই গণ্য হবে। কেননা শয়তানই তাকে সেই সৎ লোকের এবাদত করার আদেশ করেছে এবং তা তার সামনে সুসজ্জিত করে পেশ করেছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَيَوْمَ يَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ يَقُولُ لِلْمَلَائِكَةِ أَهَؤُلَاءِ إِيَّاكُمْ كَانُوا يَعْبُدُونَ (40) قَالُوا سُبْحَانَكَ أَنْتَ وَلِيُّنَا مِنْ دُونِهِمْ بَلْ كَانُوا يَعْبُدُونَ الْجِنَّ أَكْثَرُهُمْ بِهِمْ مُؤْمِنُونَ
‘‘যেদিন তিনি তাদের সবাইকে একত্রিত করবেন এবং ফেরেশতাদেরকে বলবেন, এরা কি তোমাদেরই পূজা করত? ফেরেশতারা বলবে, আপনি পাক-পবিত্র, তারা ব্যতীত আপনিই আমাদের বন্ধু; বরং তারা জিনের এবাদত করত। তাদের অধিকাংশই ছিল তাদের প্রতি বিশ্বাসী’’। (সূরা সাবাঃ ৪০-৪১) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَيَوْمَ نَحْشُرُهُمْ جَمِيعًا ثُمَّ نَقُولُ لِلَّذِينَ أَشْرَكُوا مَكَانَكُمْ أَنْتُمْ وَشُرَكَاؤُكُمْ فَزَيَّلْنَا بَيْنَهُمْ وَقَالَ شُرَكَاؤُهُمْ مَا كُنْتُمْ إِيَّانَا تَعْبُدُونَ (28) فَكَفَى بِاللَّهِ شَهِيدًا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ إِنْ كُنَّا عَنْ عِبَادَتِكُمْ لَغَافِلِينَ
‘‘আর যেদিন আমি তাদের সবাইকে সমবেত করবো; আর যারা শির্ক করত তাদেরকে বলবোঃ তোমরা এবং তোমাদের শরীকরা নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে যাও। অতঃপর তাদেরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেব, তখন তাদের শরীকরা বলবে, তোমরা তো আমাদের উপাসনা করোনি। বস্তুত আল্লাহ্ আমাদের ও তোমাদের মাঝে সাক্ষী হিসাবে যথেষ্ট। আমরা তোমাদের বন্দেগী সম্পর্কে জানতাম না’’। (সূরা ইউনুসঃ ২৮-২৯)
আর সেই মাবুদ যদি এমন ব্যক্তি হয়, যে নিজেই নিজের এবাদত করার প্রতি আহবান জানায় কিংবা তাগুতের এবাদত করার প্রতি আহবান জানায় অথবা কোনো গাছ অথবা পাথর অথবা কবর হয় কিংবা লাত, উয্যা, মানাত এবং অনুরূপ অন্যান্য বস্ত্ত হয়, তাও তাগুত হিসাবে গণ্য হবে। যেসব বস্ত্তকে মুশরিকরা মাবুদ নির্ধারণ করেছিল যেমন সৎ লোক, ফেরেশতা বা অন্যান্য বস্ত্তর আকৃতিতে তারা নিজেদের মাবুদ বানিয়ে নিয়েছিল, উহা সেই তাগুতের অন্তর্ভূক্ত, যার প্রতি কুফরী করার জন্য এবং যার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে আদেশ দিয়েছেন। সেই সঙ্গে আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য সকল মাবুদের এবাদত থেকে বিরত থাকার আদেশও দিয়েছেন। সে যেই হোক না কেন।
সুতরাং জানা গেল যে, আল্লাহ ব্যতীত যেসব বস্ত্তর এবাদত করা হয়, ঐ রকম প্রত্যেক বস্ত্তর প্রতি কুফরী করা ওয়াজিব। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاء مِّمَّا تَعْبُدُونَ إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
‘‘আর যখন ইবরাহীম তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বললেনঃ তোমরা যাদের এবাদত করো, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে আমার সম্পর্ক তাঁর সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব, তিনিই আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করবেন। এ কথাকে তিনি অক্ষয় বাণী স্বরূপ তার সন্তানদের মধ্যে রেখে গেছেন, যাতে তারা এদিকেই ফিরে আসে’’। (সূরা যুখরুফঃ ২৬-২৮)
এখানে ইবরাহীম (আঃ) সকল মাবুদ থেকে কেবল ঐ মাবুদকেই আলাদা করেছেন, যিনি তাঁকে সৃষ্টি করেছেন। এটিই হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্এর অর্থ। যেমন ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সূরা মুমতাহানার ৪নং আয়াতে বলেনঃ
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ إِلَّا قَوْلَ إِبْرَاهِيمَ لِأَبِيهِ لَأَسْتَغْفِرَنَّ لَكَ وَمَا أَمْلِكُ لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ رَبَّنَا عَلَيْكَ تَوَكَّلْنَا وَإِلَيْكَ أَنَبْنَا وَإِلَيْكَ الْمَصِيرُ
‘‘তোমাদের জন্য ইবরাহীম ও তাঁর সংঙ্গীগণের মধ্যে চমৎকার নমুনা রয়েছে। যখন তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিলঃ তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহ্র পরিবর্তে যার এবাদত করো, তার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করছি। তোমরা এক আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করা পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে চির শত্রুতা ও বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ইবরাহীমের উক্তি তাঁর পিতার উদ্দেশ্যে এই আদর্শের ব্যতিক্রম। তিনি বলেছিলেনঃ আমি অবশ্যই তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব। তোমার উপকারের জন্যে আল্লাহ্র কাছে আমার আর কিছু করার নেই। হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা তোমারই উপর ভরসা করেছি, তোমারই দিকে মুখ করেছি এবং তোমারই নিকট আমাদের প্রত্যাবর্তন’’।
অনুরূপ যে বিচারক ও শাসক আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের হুকুমের বিরোধীতা করে এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান বাদ দিয়ে অন্য বিধান দ্বারা মানুষের মধ্যে ফয়সালা করে অথবা যে মূর্খতা বশতঃ মানুষের মধ্যে ফয়সালা করে অথবা যে ব্যক্তি লোকদের কাছে কামনা করে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরোধিতায় তার অনুসরণ করা হোক অথবা যে চায় এমন বিষয়ে তার অনুসরণ করা হোক, যে সম্পর্কে জানা যায়নি যে, উহা সত্য-সঠিক, এমন বিষয়ে যদি তার অনুসরণকারীরা হক-বাতিলের পরওয়া না করেই তার হুকুমের অনুসরণ করে, তাহলে এই ব্যক্তি বিনা সন্দেহে তাগুত। আল্লাহ তাআলা সূরা নিসার ৬০ নং আয়াতে বলেনঃ
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا
‘‘তুমি কি তাদেরকে দেখনি, যারা এই মর্মে দাবী করে চলেছে যে, তারা ঈমান এনেছে সেই বস্ত্তর উপর যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে এবং সেই সব কিতাবের প্রতি যেগুলো তোমার পূর্বে নাযিল করা হয়েছে। কিন্তু নিজেদের বিষয়সমূহ ফয়সালা করার জন্য তাগুতের দিকে নিয়ে যেতে চায়, অথচ তাদেরকে আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন তাগুতকে অস্বীকার করে। শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সরল সোজা পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিতে চায়’’। কেননা তাগুতকে অস্বীকার করা তাওহীদের অন্যতম রোকন। যেমন সূরা বাকারার ২৫৬ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
‘‘দ্বীনের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে হেদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ্র প্রতি ঈমান আনয়ন করে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল, যা কখনো বিচ্ছিন্ন হয়না। আর আল্লাহ্ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’’। সুতরাং এই রোকন যদি অর্জিত না হয় অর্থাৎ তাগুতকে যদি অস্বীকার না করে, তাহলে لاإله إلا الله যা অস্বীকার করেছে, তার অস্বীকার করা হবেনা।
وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا ‘‘শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সরল সোজা পথ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে নিতে চায়’’ঃ অর্থাৎ শয়তান তাদেরকে হেদায়াত থেকে সরিয়ে গোমরাহ করতে চায়। এই আয়াতে চারটি বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে।
১) মানুষকে গোমরাহ করার মধ্যে শয়তানেরও ইচ্ছা রয়েছে।
২) মানুষকে গোমরাহীতে লিপ্ত করাই শয়তানের কাজ।
৩) শয়তানের গোমরাহীকে মাসদারের (ক্রিয়ামূল উল্লেখের) মাধ্যমে তাগিদ করা হয়েছে।
৪) শয়তানের এই গোমরাহীকে হক ও হেদায়াত থেকে বহু দূরের গোমরাহী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সুবহানাল্লাহ! কত মহান এই কুরআন! যে ব্যক্তি এই কুরআনে গবেষণা করবে, তার জন্য কুরআন কতইনা উপকারী! কতই না উচ্চাঙ্গের! এটি একটি সুস্পষ্ট দলীল যে, তা রাববুল আলামীনের কালাম। তিনি অহীর মাধ্যমে তাঁর সম্মানিত রাসূলের উপর নাযিল করেছেন। তাঁর সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত বান্দা লোকদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তাঁর উপর, জিবরীলের উপর এবং সকল সাহাবীর উপর আল্লাহ তাআলার সালাত ও সাল্লাম বর্ষিত হোক।
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ ‘‘আর যখন তাদেরকে বলা হয় এসো সেই বিষয়ের দিকে, যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন এবং এসো রাসূলের দিকে তখন তুমি মুনাফেকদেরকে দেখবেঃ কেননা মুনাফেক সত্যকে এবং সত্যের অনুসারীকে ঘৃণা করে এবং সত্যের পরিপন্থী বাতিলকে পছন্দ করে। আহলে নিফাক তথা মুনাফেকদের অবস্থা এটিই।
আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ এই আয়াত থেকে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, কাউকে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের ফয়সালা মেনে নেয়ার আহবান জানানো হলে সে যদি তা কবুল করতে অস্বীকার করে, তাহলে সে মুনাফেক।
ব্যাখ্যাকার বলেনঃ এই ধরণের মুনাফেকের সংখ্যা অগণিত। আল্লাহ যেন তাদের সংখ্যা না বাড়ান!
উপরোক্ত আয়াতে يصدون ফেলে লাযেম। এখানে এটি يعرضون (মুখ ফিরিয়ে নেয়া) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা এর মাসদার হচ্ছে صدودا। এই স্বভাবের লোকের সংখ্যা প্রচুর। বিশেষ করে ইল্মের দাবীদারদের মধ্যে এদের সংখ্যা প্রচুর। এরা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত বিষয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এমন লোকদের কথার দিকে ধাবিত হয়, যাদের মধ্যে প্রচুর ভুল রয়েছে। বিশেষ করে যারা চার মাজহাবের কোনো একটি মাজহাবের অনুসারী বলে দাবী করে, তাদের মধ্যেই রয়েছে প্রচুর ভুল। এসব লোকেরা মাজহাব ওয়ালাদের এমন মাসআলায় তাকলীদ করে, যা কুরআন ও সুন্নাহর দলীল বিরোধী হওয়ার কারণে সেগুলোর তাকলীদ করা বৈধ নয়। এ সমস্ত মুকাল্লিদ লোকদের মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর সুন্নাতের অনুসারী গরীব অবস্থায় রয়েছে। এটি একটি বিরাট মসীবতে পরিণত হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ
‘‘তাদেরকে যখন বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা, তখন তারা বলে, মূলতঃ আমরাই সংশোধনকারী’’। (সূরা বাকারাঃ ১১)
ব্যাখ্যাঃ আবুল আলীয়া আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ তোমরা যমীনে আল্লাহর নাফরমানী করোনা। কেননা যে ব্যক্তি যমীনে আল্লাহর নাফরমানী করবে অথবা আল্লাহর নাফরমানীর আদেশ করবে, সে যমীনে ফাসাদ সৃষ্টিকারী বলে গণ্য হবে। আর আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের আনুগত্যের মধ্যেই আসমান ও যমীন সংশোধিত থাকে। অধ্যায়ের সাথে আয়াতের মিল এভাবে পাওয়া যায় যে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলকে বাদ দিয়ে অন্যের ফয়সালা গ্রহণ করা মুনাফেকদের কাজের অন্তর্ভূক্ত। আর এটি যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করাও বটে।
আয়াতে নফসের পূজারী ও বিদআতীদের কথা দ্বারা ধোঁকায় পতিত হওয়া থেকেও সতর্ক করা হয়েছে। যদিও তারা তাদের দাবীকে চাকচিক্যময় করে পেশ করে।
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেনঃ
وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا وَادْعُوهُ خَوْفًا وَطَمَعًا إِنَّ رَحْمَةَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِنَ الْمُحْسِنِينَ
‘‘পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার পর তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। অল্লাহকে আহবান করো ভয় ও আশা সহকারে। নিশ্চয়ই আল্লাহ্র রহমত সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী। (সূরা আরাফঃ ৫৬)
ব্যাখ্যাঃ আবু বকর বিন আয়াশ (রঃ) আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ আল্লাহ তাআলা পৃথিবীবাসীর নিকট মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন সময় পাঠিয়েছেন, যখন তারা বিপর্যয়ের মধ্যে ছিল। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাঁর মাধ্যমে সংশোধন করেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর আনীত দ্বীন বাদ দিয়ে অন্য দিকে আহবান করবে, সে পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ অধিকাংশ মুফাসসির বলেনঃ নবী-রাসূল পাঠিয়ে, শরীয়ত নাযিল করে এবং আল্লাহর আনুগত্যের প্রতি দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে পৃথিবীকে সংশোধন করার পর তাতে পাপ কাজের মাধ্যমে এবং আল্লাহর নাফরমানীর দিকে আহবানের মাধ্যমে তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। কেননা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের এবাদত করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে আহবান করা এবং আল্লাহর সাথে শির্ক করা যমীনে সর্ববৃহৎ ফাসাদ সৃষ্টি করার শামিল। প্রকৃত অর্থে আল্লাহ রাববুল আলামীনের সাথে শরীক স্থাপন করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে আহবান করা, আল্লাহ ছাড়া অন্য মাবুদ নির্ধারণ করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্যকে অনুসরণীয় বানানো ভূপৃষ্ঠে বিরাট ফাসাদ সৃষ্টি করার নামান্তর। পৃথিবী এবং পৃথিবীবাসী ততক্ষণ পর্যন্ত সংশোধন হবেনা যতক্ষণ না একমাত্র আল্লাহর এবাদত করা হবে এবং আল্লাহর দিকেই আহবান করা হবে; অন্যের দিকে নয়। সেই সঙ্গে আল্লাহর রাসূল ব্যতীত অন্য কারো আনুগত্য করা হবেনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্যের কথা তখনই মান্য করা হবে, যখন সে রাসূলের কথার আনুগত্য করার আদেশ দিবে। সুতরাং সে যখন রাসূলের সুন্নাত অমান্য করার আদেশ দিবে এবং তাঁর শরীয়তের খেলাফ করার হুকুম করবে, তখন তার কথা মান্য করা যাবেনা ও তার কথার আনুগত্যও করা যাবেনা।
যে ব্যক্তি পৃথিবীর অবস্থা নিয়ে চিন্তা করবে, সে দেখবে পৃথিবীর প্রতিটি সংস্কার ও সংশোধনের মূলেই রয়েছে আল্লাহর তাওহীদ, তাঁর এবাদত এবং আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য। আর প্রতিটি ফিতনা, মসীবত, অনাবৃষ্টি, শত্রুদের বিজয় এবং অন্যান্য অকল্যাণের মূলেই রয়েছে আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যতীত অন্যের দিকে আহবান করা।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
‘‘তারা কি জাহেলী যুগের ফয়সালা কামনা করে? বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ্ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালাকারী আর কে আছে?’’ (সূরা মায়েদাঃ ৫০)
ব্যাখ্যাঃ আল্লামা ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ তাআলা ঐ লোকের প্রতিবাদ করছেন, যে আল্লাহর হুকুম প্রত্যাখ্যান করে। অথচ আল্লাহর বিধান সকল প্রকার কল্যাণের প্রতি আহবান করে এবং সকল অকল্যাণ থেকে নিষেধ করে। তা বর্জন করে যে ব্যক্তি অন্যান্য মত, নিজস্ব প্রবৃত্তি এবং আল্লাহর শরীয়তের দলীল ছাড়াই মানুষের তৈরী বিভিন্ন পরিভাষার দিকে ঝুঁকে পড়ল, যেমন জাহেলী সমাজের লোকেরা তাদের গোমরাহী ও মূর্খতা দ্বারা ফয়সালা করত, যেমন তাতারগণ চেঙ্গিস খানের গৃহীত রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা রাষ্ট্র চালাত, চেঙ্গিসখান বিভিন্ন ধর্ম থেকে কতগুলো হুকুম-আহকাম একত্রিত করে একটি কিতাব রচনা করেছিল, তাতে তার নিজস্ব অনেক মতামতও ছিল, তার কিতাবটি পরবর্তীতে তার ছেলেদের জন্য এমন একটি শরীয়তে রূপ নেয়, যাকে তারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের হুকুমের উপর প্রাধান্য দিত, যে ব্যক্তি এরূপ করবে সে কাফের হয়ে যাবে, তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আবশ্যক। যাতে সে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের হুকুমের দিকে ফিরে আসে এবং ছোট-বড় সকল বিষয়েই ইসলামী শরীয়ত দ্বারা ফয়সালা করে।
বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ্ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালাকারী আর কে আছে? এখানে প্রশ্নটি অস্বীকারের অর্থবোধক। অর্থাৎ আল্লাহ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালাকারী আর কেউ নেই। এখানে اسم التفضيل এমন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, যাতে অপর পক্ষে তার কোনো শরীক নেই। (অর্থাৎ দু’টি বস্ত্ত একই গুণে গুণান্বিত হওয়ার সময় যে ইসম দ্বারা উক্ত দু’টি বস্ত্তর একটিকে অন্যটির তুলনায় অধিক গুণান্বিত করা হয়, তাকে ইসমে তাফযীল বলে। কিন্তু এখানে ইসমে তাফযীল মূল অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। কারণ আল্লাহর কোনো গুণের সাথে অন্যের তুলনাই চলেনা। সুতরাং যেখানে ইসমে তাফযীলের মাধ্যমে আল্লাহর গুণের আধিক্য বুঝানো হয়েছে, সেখানে তুলনামূলক উদ্দেশ্য নয়।
যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়তকে বুঝতে পেরেছে এবং বিশ্বাস ও ইয়াকীন রেখেছে যে আল্লাহই আহকামুল হাকিমীন বা সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক, মাতা যেমন তার সন্তানের প্রতি দয়াশীল আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি তার চেয়েও অধিক দয়াশীল, আল্লাহই তাঁর বান্দাদের স্বার্থ ও কল্যাণ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ও প্রত্যেক বস্ত্তর উপর ক্ষমতাবান, আল্লাহর সকল কথা, কাজ, শরীয়ত ও নির্ধারণ প্রজ্ঞাপূর্ণ- সে অবশ্যই বিশ্বাস করবে যে বিচার-ফয়সালায় আল্লাহর চেয়ে অধিক ইনসাফকারী অন্য কেউ হতেই পারেনা।
আব্দুল্লাহ বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
«لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ»
‘‘তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারবেনা, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত দ্বীনের অধীন হয়’’।[1] ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ হাদীছটি সহীহ। আমরা এটিকে কিতাবুল হুজ্জাতে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছি।
ব্যাখ্যাঃ শাইখ আবুল ফাতাহ নসর বিন ইবরাহীম আলমাকদেসী আশ্ শাফেয়ীঃالحجة على تارك المحجة নামক কিতাবে সহীহ সনদে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইমাম নববী থেকে যেই লেখক এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন তিনি এ কথা বলেছেন। ইমাম তাবারানী, আবু বকর ইবনে আবী আসেম, হাফেয আবু নুআইম স্বীয় কিতাব ‘আরবাঈন’এর মধ্যে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আবু নুআইম তার এই কিতাবে শর্ত করেছেন যে, তিনি তাতে কেবল সহীহ হাদীছই উল্লেখ করবেন।
তবে কুরআনে উপরে বর্ণিত হাদীছের সমর্থনে একাধিক আয়াত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً
‘‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবেনা, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নেবে’’। (সূরা নিসাঃ ৬৫) আল্লাহ তাআলা সূরা আহযাবের ৩৬ নং আয়াতে বলেনঃ
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
‘‘যখন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ে ফয়সালা করেন, তখন কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করার ক্ষমতা রাখেনা। যে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়’’। আল্লাহ তাআলা সূরা কাসাসের ৫০ নং আয়াতে আরো বলেনঃ
فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
‘‘অতঃপর তারা যদি আপনার কথায় সাড়া না দেয়, তবে জেনে রাখুন যে, তারা শুধু নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আল্লাহ্র হেদায়াতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? নিশ্চয়ই আল্লাহ্ যালেম সম্প্রদায়কে পথ দেখান না’’। এই অর্থে আরো অনেক আয়াত রয়েছে।
حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ ‘‘যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত আদর্শের অধীন হয়’’ঃ الهوى ‘হাওয়া’ শব্দটি আলিফে মাকসুরাযোগে পড়তে হবে। মানুষের মন যা চায়, মন যাকে ভালোবাসে এবং তার মন যেদিকে ঝুঁকে পড়ে তার নামই হাওয়া। সুতরাং মানুষ যা ভালবাসে, যার দিকে তার মন ঝুঁকে পড়ে এবং যে অনুযায়ী সে আমল করে তা যদি রাসূলের আনীত আদর্শের অনুগামী হয় ও তার বিরোধী না হয়, তাহলে এটি হচ্ছে পরিপূর্ণ ঈমানদারের বৈশিষ্ট। এই ঈমান তার জন্য জান্নাত আবশ্যক করবে এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত দিবে।
আর সে যদি এর খেলাফ করে এবং পাপ কাজে লিপ্ত হয় চাই কখনো কখনো লিপ্ত হোক বা অধিকাংশ সময়, তাহলে সে পরিপূর্ণ ঈমানদারদের তালিকায় থাকবেনা। গুনাহয় লিপ্ত হওয়ার কারণে তখন তাকে মুমিনে নাকেস তথা ত্রুটিপূর্ণ ঈমানদার বলা হবে। যেমন সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
«لاَ يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ ولاَ يَسْرِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَالتَّوْبَةُ مَعْرُوضَةٌ بَعْدُ»
‘‘যেনাকারী যখন যেনা করে তখন সে মুমিন থাকেনা, চোর যখন চুরি করে তখন সে মুমিন থাকেনা। একই অবস্থা মদ পানকারীর। সে মদ পান করা অবস্থায় মুমিন থাকেনা। এর পরও তার জন্যে তাওবার দরজা খোলা থাকে।[2]
সুতরাং গুনাহকারী গুনাহ করা অবস্থায় মুসলিম থাকে এবং তখন তার সাথে কেবল এতটুকু ঈমান থাকে, যা না থাকলে তাকে মুসলিম বলা ঠিক হয়না। আর এই পরিমাণ ঈমানকে ঐ তাওহীদ বলা হয়, যার সাথে কোনো শির্ক বা কুফরী মিশ্রিত হয়নি।
এটিই হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাজহাব। খারেজীরাও মুতাযেলাগণ এর বিরোধীতা করেছেন। পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে খারেজীগণ মানুষকে কাফের বলে থাকে। আর মুতাযেলাগণ তাকে মুমিন বলেনা, কাফেরও বলেনা। তবে তারা বলে পরকালে গুনাহকারী মুমিন জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে। এই দুই ফির্কাই দ্বীনের মধ্যে বিদআত তৈরী করেছে এবং কিতাব ও সুন্নাহর শিক্ষা বর্জন করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না। শির্ক ব্যতীত অন্যান্য গুনাহ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করেন’’। (সূরা নিসাঃ ৪৮) আল্লাহ তাআলা এখানে শির্ক ব্যতীত অন্যান্য গুণাহ ক্ষমা করার বিষয়টি স্বীয় ইচ্ছার সাথে শর্তযুক্ত করেছেন।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতের সমর্থনে অনেক সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারীতে আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
«يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ شَعِيرَةٍ مِنْ خَيْرٍ وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ بُرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ»
‘‘যে ব্যক্তি ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পাঠ করবে অথচ তার অন্তরে একটি যব পরিমাণ ঈমান রয়েছে সেও জাহান্নাম থেকে বের হবে। যে ব্যক্তি ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পাঠ করবে অথচ তার অন্তরে একটি গম পরিমাণ ঈমান রয়েছে সেও জাহান্নাম থেকে বের হবে। অনুরূপভাবে ঐ ব্যক্তিও জাহান্নাম থেকে বের হবে যে ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পাঠ করেছে অথচ তার অন্তরে একটি সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান রয়েছে’’।[3]
ইমাম শা’বী (রঃ) বলেনঃ একজন মুনাফিক এবং একজন ইহুদীর মধ্যে ঝগড়া চলছিল। ইহুদী বললঃ আমরা এর বিচার- ফয়সালার জন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে যাব। কেননা তার জানা ছিল যে, তিনি ঘুষ গ্রহণ করেন না। আর মুনাফিক বললঃ ফয়সালার জন্য আমরা ইহুদী বিচারকের কাছে যাবো। কেননা তার জানা ছিল যে, ইয়াহুদীরা বিচার-ফয়সালায় ঘুষ খায়। পরিশেষে তারা উভয়েই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, তারা এর বিচার ও ফয়সালার জন্য জুহাইনা গোত্রের এক গণকের কাছে যাবে। তখন সূরা নিসার এ আয়াত নাযিল হয়ঃ
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَاءُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا
‘‘তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যারা তোমার উপর যে কিতাব নাযিল হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে বলে দাবী করে? তারা বিচার ফয়সালার জন্য তাগুত এর কাছে যায়, অথচ তা অস্বীকার করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর শয়তান তাদেরকে চরম গোমরাহীতে নিমজ্জিত করতে চায়। আর যখন তাদেরকে বলা হয় এসো সেই জিনিষের দিকে, যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন এবং এসো রাসূলের দিকে তখন তুমি মুনাফেকদেরকে দেখবে, ওরা তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। তারপর যখন তাদের কৃতকর্মের দরুন? কোনো বিপদ এসে পড়ে, তখন তাদের অবস্থা কী হয়? তখন তারা তোমার কাছে আল্লাহ্র নামে কসম খেতে খেতে ফিরে আসে এবং বলতে থাকে যে, আল্লাহর কসম আমরা তো কেবল মঙ্গলই চেয়েছিলাম এবং উভয় পক্ষের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাক এটি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিলনা’’। (সূরা নিসাঃ ৬০-৬২)[4]
আরেকটি বর্ণনা মতে জানা যায়, ঝগড়া- বিবাদে লিপ্ত দু’জন লোকের ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। তাদের একজন বলেছিল, মীমাংসার জন্য আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে যাবো। অপরজন বলেছিলঃ কা’ব বিন আশরাফের কাছে যাবো। পরিশেষে তারা উভয়ে বিষয়টি মীমাংসার জন্য উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর কাছে সোপর্দ করল। তারপর তাদের একজন ঘটনাটি তাঁর কাছে উল্লেখ করল। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এ কথাও বলা হল যে, বিষয়টির নিস্পত্তির জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে যাওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল, কিন্তু আমাদের অমুক এতে রাজী হয়নি। অতঃপর যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিচার ফয়সালার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারেনি, তাকে লক্ষ্য করে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ঘটনাটি কি সত্যিই এ রকম? সে বললঃ হ্যা। তখন তিনি তলোয়ারের আঘাতে তার গর্দান উড়িয়ে দিলেন।[5]
ব্যাখ্যাঃ ইমাম শাবী হচ্ছেন আমের বিন শুরাহবীল আলকুফী। তার জীবনী ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে।
যেই মুনাফেক কাব বিন আশরাফের নিকট বিচার-ফয়সালার আবেদন করেছিল, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে হত্যা করে ফেললেন। এই ঘটনার মধ্যে দলীল রয়েছে যে, যার মধ্যে কুফুরী ও নিফাকী পাওয়া যাবে, তাকে হত্যা করা যাবে। এই কাব বিন আশরাফ ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ঘোর বিরোধী, সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিত এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে দুশমনী করত। এর মাধ্যমে কাবের সাথে কৃত চুক্তির অবসান হয়ে গিয়েছিল এবং তার রক্ত হালাল হয়ে গিয়েছিল। তাকে হত্যা করার ঘটনা হাদীছ, সীরাত এবং অন্যান্য বিষয়ের কিতাবসমূহে বিস্তারিত উল্লেখিত হয়েছে। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়।
১) সূরা নিসার ৬০ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল। এ থেকে তাগুতের মর্মার্থ বুঝার ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাওয়া যায়।
২) সূরা বাকারার ১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা জানা গেলো। সেখানে আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ
‘‘তাদেরকে যখন বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করোনা, তখন তারা বলে মূলতঃ আমরাই সংশোধনকারী’’। শির্ক ও বিদআতই পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির মূল কারণ।
৩) সূরা আরাফের ৫৬ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا
‘‘পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তোমরা উহাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা’’। অর্থাৎ তাওহীদের মাধ্যমে পৃথিবী সংশোধিত হওয়ার পর শির্ক ও বিদআত ছড়িয়ে তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা।
৪) সূরা মায়েদার ৫০ নং আয়াতের তাফসীরও জানা গেল। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
‘‘তারা কি জাহেলী যুগের ফয়সালা কামনা করে? বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ্ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালাকারী আর কে আছে?’’
৫) এ অধ্যায়ের প্রথম আয়াতের শানে নুযুল জানা গেল। এ ক্ষেত্রে ইমাম শাবীর বক্তব্যও জানা গেল।
৬) সত্যিকারের ঈমান এবং মিথ্যা ঈমানের ব্যাখ্যা জানা গেল।
৭) মুনাফিকের সাথে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর ব্যবহার সংক্রান্ত ঘটনা জানা গেল।
৮) মনুষ্য প্রবৃত্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর আনীত আদর্শের অনুগত না হওয়া পর্যন্ত কারো ঈমান পূর্ণাঙ্গ না হওয়ার বিষয় জানা গেল।
[2] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আশরিবাহ। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘‘যখন কোন হত্যাকারী কাউকে হত্যা করে, হত্যা করার সময় সে মুমিন থাকে না’’। অন্য বর্ণনায় আছে, ছিনতাইকারী যখন কোন মূল্যবান জিনিষ ছিনতাই করে নেয়, যার দিকে লোকেরা দৃষ্টি উঁচু করে দেখে তখন সে মুমিন থাকেনা’’।
[3] - বুখারী, অধ্যায়ঃ ঈমান কম বেশী হয়।
[4] - শাবীর বর্ণনাটি মুরসাল হওয়ার কারণে যঈফ। কারণ তিনি ছিলেন তাবেয়ী। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর যামানা পান নি বলে ঘটনায় উপস্থিত হওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ইমাম তাবারী স্বীয় তাফসীরে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন।
[5] - ঘটনাটি খুবই দুর্বলঃ ইমাম ছালাবী ইমাম বগবী নিজ নিজ তাফসীরে উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ ছালাবী (৩/৩৩৭), বগবী (১/৪৬৬)।
ইমাম ওয়াহেদী আসবাবে নুযুলে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। হাদীছের সনদে রয়েছে মিথ্যুক রাবী কালবী এবং যঈফ রাবী আবু সালেহ। দেখুনঃ কুর্রাতুল উয়ূন, পৃষ্ঠা নং- ৩২৭।