বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ্ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালাকারী আর কে আছে? এখানে প্রশ্নটি অস্বীকারের অর্থবোধক। অর্থাৎ আল্লাহ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালাকারী আর কেউ নেই। এখানে اسم التفضيل এমন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, যাতে অপর পক্ষে তার কোনো শরীক নেই। (অর্থাৎ দু’টি বস্ত্ত একই গুণে গুণান্বিত হওয়ার সময় যে ইসম দ্বারা উক্ত দু’টি বস্ত্তর একটিকে অন্যটির তুলনায় অধিক গুণান্বিত করা হয়, তাকে ইসমে তাফযীল বলে। কিন্তু এখানে ইসমে তাফযীল মূল অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। কারণ আল্লাহর কোনো গুণের সাথে অন্যের তুলনাই চলেনা। সুতরাং যেখানে ইসমে তাফযীলের মাধ্যমে আল্লাহর গুণের আধিক্য বুঝানো হয়েছে, সেখানে তুলনামূলক উদ্দেশ্য নয়।
যে ব্যক্তি আল্লাহর শরীয়তকে বুঝতে পেরেছে এবং বিশ্বাস ও ইয়াকীন রেখেছে যে আল্লাহই আহকামুল হাকিমীন বা সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক, মাতা যেমন তার সন্তানের প্রতি দয়াশীল আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি তার চেয়েও অধিক দয়াশীল, আল্লাহই তাঁর বান্দাদের স্বার্থ ও কল্যাণ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত ও প্রত্যেক বস্ত্তর উপর ক্ষমতাবান, আল্লাহর সকল কথা, কাজ, শরীয়ত ও নির্ধারণ প্রজ্ঞাপূর্ণ- সে অবশ্যই বিশ্বাস করবে যে বিচার-ফয়সালায় আল্লাহর চেয়ে অধিক ইনসাফকারী অন্য কেউ হতেই পারেনা।
আব্দুল্লাহ বিন আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
«لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ»
‘‘তোমাদের কেউ ঈমানদার হতে পারবেনা, যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত দ্বীনের অধীন হয়’’।[1] ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ হাদীছটি সহীহ। আমরা এটিকে কিতাবুল হুজ্জাতে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছি।
ব্যাখ্যাঃ শাইখ আবুল ফাতাহ নসর বিন ইবরাহীম আলমাকদেসী আশ্ শাফেয়ীঃالحجة على تارك المحجة নামক কিতাবে সহীহ সনদে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইমাম নববী থেকে যেই লেখক এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন তিনি এ কথা বলেছেন। ইমাম তাবারানী, আবু বকর ইবনে আবী আসেম, হাফেয আবু নুআইম স্বীয় কিতাব ‘আরবাঈন’এর মধ্যে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আবু নুআইম তার এই কিতাবে শর্ত করেছেন যে, তিনি তাতে কেবল সহীহ হাদীছই উল্লেখ করবেন।
তবে কুরআনে উপরে বর্ণিত হাদীছের সমর্থনে একাধিক আয়াত রয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً
‘‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে লোক ঈমানদার হবেনা, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক বলে মনে না করে। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা পাবে না এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নেবে’’। (সূরা নিসাঃ ৬৫) আল্লাহ তাআলা সূরা আহযাবের ৩৬ নং আয়াতে বলেনঃ
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا
‘‘যখন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল কোনো বিষয়ে ফয়সালা করেন, তখন কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী সে বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করার ক্ষমতা রাখেনা। যে আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়’’। আল্লাহ তাআলা সূরা কাসাসের ৫০ নং আয়াতে আরো বলেনঃ
فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
‘‘অতঃপর তারা যদি আপনার কথায় সাড়া না দেয়, তবে জেনে রাখুন যে, তারা শুধু নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আল্লাহ্র হেদায়াতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? নিশ্চয়ই আল্লাহ্ যালেম সম্প্রদায়কে পথ দেখান না’’। এই অর্থে আরো অনেক আয়াত রয়েছে।
حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ ‘‘যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত আদর্শের অধীন হয়’’ঃ الهوى ‘হাওয়া’ শব্দটি আলিফে মাকসুরাযোগে পড়তে হবে। মানুষের মন যা চায়, মন যাকে ভালোবাসে এবং তার মন যেদিকে ঝুঁকে পড়ে তার নামই হাওয়া। সুতরাং মানুষ যা ভালবাসে, যার দিকে তার মন ঝুঁকে পড়ে এবং যে অনুযায়ী সে আমল করে তা যদি রাসূলের আনীত আদর্শের অনুগামী হয় ও তার বিরোধী না হয়, তাহলে এটি হচ্ছে পরিপূর্ণ ঈমানদারের বৈশিষ্ট। এই ঈমান তার জন্য জান্নাত আবশ্যক করবে এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত দিবে।
আর সে যদি এর খেলাফ করে এবং পাপ কাজে লিপ্ত হয় চাই কখনো কখনো লিপ্ত হোক বা অধিকাংশ সময়, তাহলে সে পরিপূর্ণ ঈমানদারদের তালিকায় থাকবেনা। গুনাহয় লিপ্ত হওয়ার কারণে তখন তাকে মুমিনে নাকেস তথা ত্রুটিপূর্ণ ঈমানদার বলা হবে। যেমন সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
«لاَ يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ ولاَ يَسْرِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَالتَّوْبَةُ مَعْرُوضَةٌ بَعْدُ»
‘‘যেনাকারী যখন যেনা করে তখন সে মুমিন থাকেনা, চোর যখন চুরি করে তখন সে মুমিন থাকেনা। একই অবস্থা মদ পানকারীর। সে মদ পান করা অবস্থায় মুমিন থাকেনা। এর পরও তার জন্যে তাওবার দরজা খোলা থাকে।[2]
সুতরাং গুনাহকারী গুনাহ করা অবস্থায় মুসলিম থাকে এবং তখন তার সাথে কেবল এতটুকু ঈমান থাকে, যা না থাকলে তাকে মুসলিম বলা ঠিক হয়না। আর এই পরিমাণ ঈমানকে ঐ তাওহীদ বলা হয়, যার সাথে কোনো শির্ক বা কুফরী মিশ্রিত হয়নি।
এটিই হচ্ছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাজহাব। খারেজীরাও মুতাযেলাগণ এর বিরোধীতা করেছেন। পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে খারেজীগণ মানুষকে কাফের বলে থাকে। আর মুতাযেলাগণ তাকে মুমিন বলেনা, কাফেরও বলেনা। তবে তারা বলে পরকালে গুনাহকারী মুমিন জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে। এই দুই ফির্কাই দ্বীনের মধ্যে বিদআত তৈরী করেছে এবং কিতাব ও সুন্নাহর শিক্ষা বর্জন করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করেন না। শির্ক ব্যতীত অন্যান্য গুনাহ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করেন’’। (সূরা নিসাঃ ৪৮) আল্লাহ তাআলা এখানে শির্ক ব্যতীত অন্যান্য গুণাহ ক্ষমা করার বিষয়টি স্বীয় ইচ্ছার সাথে শর্তযুক্ত করেছেন।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতের সমর্থনে অনেক সহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। সহীহ বুখারীতে আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
«يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ شَعِيرَةٍ مِنْ خَيْرٍ وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ بُرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ»
‘‘যে ব্যক্তি ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পাঠ করবে অথচ তার অন্তরে একটি যব পরিমাণ ঈমান রয়েছে সেও জাহান্নাম থেকে বের হবে। যে ব্যক্তি ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পাঠ করবে অথচ তার অন্তরে একটি গম পরিমাণ ঈমান রয়েছে সেও জাহান্নাম থেকে বের হবে। অনুরূপভাবে ঐ ব্যক্তিও জাহান্নাম থেকে বের হবে যে ‘‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ পাঠ করেছে অথচ তার অন্তরে একটি সরিষার দানা পরিমাণ ঈমান রয়েছে’’।[3]
ইমাম শা’বী (রঃ) বলেনঃ একজন মুনাফিক এবং একজন ইহুদীর মধ্যে ঝগড়া চলছিল। ইহুদী বললঃ আমরা এর বিচার- ফয়সালার জন্য মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে যাব। কেননা তার জানা ছিল যে, তিনি ঘুষ গ্রহণ করেন না। আর মুনাফিক বললঃ ফয়সালার জন্য আমরা ইহুদী বিচারকের কাছে যাবো। কেননা তার জানা ছিল যে, ইয়াহুদীরা বিচার-ফয়সালায় ঘুষ খায়। পরিশেষে তারা উভয়েই এ সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, তারা এর বিচার ও ফয়সালার জন্য জুহাইনা গোত্রের এক গণকের কাছে যাবে। তখন সূরা নিসার এ আয়াত নাযিল হয়ঃ
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يَزْعُمُونَ أَنَّهُمْ آَمَنُوا بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ يُرِيدُونَ أَنْ يَتَحَاكَمُوا إِلَى الطَّاغُوتِ وَقَدْ أُمِرُوا أَنْ يَكْفُرُوا بِهِ وَيُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُضِلَّهُمْ ضَلَالًا بَعِيدًا وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَى مَا أَنْزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ رَأَيْتَ الْمُنَافِقِينَ يَصُدُّونَ عَنْكَ صُدُودًا فَكَيْفَ إِذَا أَصَابَتْهُمْ مُصِيبَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ ثُمَّ جَاءُوكَ يَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنْ أَرَدْنَا إِلَّا إِحْسَانًا وَتَوْفِيقًا
‘‘তুমি কি তাদেরকে দেখোনি যারা তোমার উপর যে কিতাব নাযিল হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তার প্রতি ঈমান এনেছে বলে দাবী করে? তারা বিচার ফয়সালার জন্য তাগুত এর কাছে যায়, অথচ তা অস্বীকার করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আর শয়তান তাদেরকে চরম গোমরাহীতে নিমজ্জিত করতে চায়। আর যখন তাদেরকে বলা হয় এসো সেই জিনিষের দিকে, যা আল্লাহ্ নাযিল করেছেন এবং এসো রাসূলের দিকে তখন তুমি মুনাফেকদেরকে দেখবে, ওরা তোমার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে যাচ্ছে। তারপর যখন তাদের কৃতকর্মের দরুন? কোনো বিপদ এসে পড়ে, তখন তাদের অবস্থা কী হয়? তখন তারা তোমার কাছে আল্লাহ্র নামে কসম খেতে খেতে ফিরে আসে এবং বলতে থাকে যে, আল্লাহর কসম আমরা তো কেবল মঙ্গলই চেয়েছিলাম এবং উভয় পক্ষের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাক এটি ছাড়া আমাদের অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিলনা’’। (সূরা নিসাঃ ৬০-৬২)[4]
আরেকটি বর্ণনা মতে জানা যায়, ঝগড়া- বিবাদে লিপ্ত দু’জন লোকের ব্যাপারে এ আয়াত নাযিল হয়েছে। তাদের একজন বলেছিল, মীমাংসার জন্য আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে যাবো। অপরজন বলেছিলঃ কা’ব বিন আশরাফের কাছে যাবো। পরিশেষে তারা উভয়ে বিষয়টি মীমাংসার জন্য উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর কাছে সোপর্দ করল। তারপর তাদের একজন ঘটনাটি তাঁর কাছে উল্লেখ করল। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এ কথাও বলা হল যে, বিষয়টির নিস্পত্তির জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে যাওয়ার প্রস্তাব উঠেছিল, কিন্তু আমাদের অমুক এতে রাজী হয়নি। অতঃপর যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বিচার ফয়সালার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হতে পারেনি, তাকে লক্ষ্য করে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ঘটনাটি কি সত্যিই এ রকম? সে বললঃ হ্যা। তখন তিনি তলোয়ারের আঘাতে তার গর্দান উড়িয়ে দিলেন।[5]
ব্যাখ্যাঃ ইমাম শাবী হচ্ছেন আমের বিন শুরাহবীল আলকুফী। তার জীবনী ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে।
যেই মুনাফেক কাব বিন আশরাফের নিকট বিচার-ফয়সালার আবেদন করেছিল, উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু তাকে হত্যা করে ফেললেন। এই ঘটনার মধ্যে দলীল রয়েছে যে, যার মধ্যে কুফুরী ও নিফাকী পাওয়া যাবে, তাকে হত্যা করা যাবে। এই কাব বিন আশরাফ ছিল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর ঘোর বিরোধী, সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কষ্ট দিত এবং তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে দুশমনী করত। এর মাধ্যমে কাবের সাথে কৃত চুক্তির অবসান হয়ে গিয়েছিল এবং তার রক্ত হালাল হয়ে গিয়েছিল। তাকে হত্যা করার ঘটনা হাদীছ, সীরাত এবং অন্যান্য বিষয়ের কিতাবসমূহে বিস্তারিত উল্লেখিত হয়েছে। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়।
১) সূরা নিসার ৬০ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল। এ থেকে তাগুতের মর্মার্থ বুঝার ক্ষেত্রে সহযোগিতা পাওয়া যায়।
২) সূরা বাকারার ১১ নং আয়াতের ব্যাখ্যা জানা গেলো। সেখানে আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ
‘‘তাদেরকে যখন বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করোনা, তখন তারা বলে মূলতঃ আমরাই সংশোধনকারী’’। শির্ক ও বিদআতই পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির মূল কারণ।
৩) সূরা আরাফের ৫৬ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا
‘‘পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তোমরা উহাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা’’। অর্থাৎ তাওহীদের মাধ্যমে পৃথিবী সংশোধিত হওয়ার পর শির্ক ও বিদআত ছড়িয়ে তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা।
৪) সূরা মায়েদার ৫০ নং আয়াতের তাফসীরও জানা গেল। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
أَفَحُكْمَ الْجَاهِلِيَّةِ يَبْغُونَ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ حُكْمًا لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ
‘‘তারা কি জাহেলী যুগের ফয়সালা কামনা করে? বিশ্বাসীদের জন্য আল্লাহ্ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালাকারী আর কে আছে?’’
৫) এ অধ্যায়ের প্রথম আয়াতের শানে নুযুল জানা গেল। এ ক্ষেত্রে ইমাম শাবীর বক্তব্যও জানা গেল।
৬) সত্যিকারের ঈমান এবং মিথ্যা ঈমানের ব্যাখ্যা জানা গেল।
৭) মুনাফিকের সাথে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর ব্যবহার সংক্রান্ত ঘটনা জানা গেল।
৮) মনুষ্য প্রবৃত্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর আনীত আদর্শের অনুগত না হওয়া পর্যন্ত কারো ঈমান পূর্ণাঙ্গ না হওয়ার বিষয় জানা গেল।
[2] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আশরিবাহ। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘‘যখন কোন হত্যাকারী কাউকে হত্যা করে, হত্যা করার সময় সে মুমিন থাকে না’’। অন্য বর্ণনায় আছে, ছিনতাইকারী যখন কোন মূল্যবান জিনিষ ছিনতাই করে নেয়, যার দিকে লোকেরা দৃষ্টি উঁচু করে দেখে তখন সে মুমিন থাকেনা’’।
[3] - বুখারী, অধ্যায়ঃ ঈমান কম বেশী হয়।
[4] - শাবীর বর্ণনাটি মুরসাল হওয়ার কারণে যঈফ। কারণ তিনি ছিলেন তাবেয়ী। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর যামানা পান নি বলে ঘটনায় উপস্থিত হওয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া ইমাম তাবারী স্বীয় তাফসীরে ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন।
[5] - ঘটনাটি খুবই দুর্বলঃ ইমাম ছালাবী ইমাম বগবী নিজ নিজ তাফসীরে উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ ছালাবী (৩/৩৩৭), বগবী (১/৪৬৬)।
ইমাম ওয়াহেদী আসবাবে নুযুলে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। হাদীছের সনদে রয়েছে মিথ্যুক রাবী কালবী এবং যঈফ রাবী আবু সালেহ। দেখুনঃ কুর্রাতুল উয়ূন, পৃষ্ঠা নং- ৩২৭।