অপ্রকাশ্য শির্ক বলতে এমন সব ব্যাপারকে বুঝানো হচ্ছে যা চোখে দেখা যায় না অথবা কানে শুনা যায়না অথবা অনুভব করা যায় না।
অপ্রকাশ্য শির্ক আবার তিন প্রকার। যা নিম্নরূপ:
১. নিয়্যাতের শির্ক:
নিয়্যাতের শির্ক বলতে কোন নেক আমল একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উদ্দেশ্যে না করে শুধুমাত্র দুনিয়া কামানোর উদ্দেশ্যে করাকে বুঝানো হয়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْـحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِيْنَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيْهِا وَهُمْ فِيْهَا لاَ يُبْخَسُوْنَ، أُوْلآئِكَ الَّذِيْنَ لَيْسَ لَـهُمْ فِي الآخِرَةِ إِلاَّ النَّارُ، وَحَبِطَ مَا صَنَعُوْا فِيْهَا وَبَاطِلٌ مَّا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ
‘‘যারা পার্থিব জীবন ও উহার সাজসজ্জা চায় আমি তাদের কৃতকর্মের ফল পূর্ণভাবে দুনিয়াতেই দিয়ে দেবো। এতটুকুও তাদেরকে কম দেয়া হবে না। এরা এমন যে, আখেরাতে তাদের জন্য জাহান্নাম ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। তাদের সকল আমল তখন অকেজো এবং নিষ্ফল বলে বিবেচিত হবে’’। (হূদ: ১৫, ১৬)
মানুষ যে নেক আমল একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার উদ্দেশ্যে না করে অন্য কোন উদ্দেশ্যে করে থাকে তা চার প্রকার:
১. কোন নেক আমল আল্লাহ্ তা’আলার জন্য করেছে ঠিকই। কিন্তু সে এর মাধ্যমে আখিরাতের কোন পুণ্য চায় না। বরং সে এর মাধ্যমে নিজ পরিবার ও পরিজনের হিফাজত অথবা ধন-সম্পদের উন্নতি ও রক্ষা এমনকি নিয়ামতের স্থায়িত্ব কামনা করে। এমন ব্যক্তির জন্য আখিরাতে কিছুই নেই। আল্লাহ্ চান তো দুনিয়াতে তার আশা পূর্ণ হবে মাত্র। এ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
২. কোন নেক আমল মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে করা। পরকালের পুণ্যের আশায় নয়। এর জন্যও আখিরাতে কিছুই থাকবে না।
৩. শুরু থেকেই কোন নেক আমল দুনিয়ার জন্য করা। আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য নয়। যেমন: সম্পদের জন্য হজ্জ বা জিহাদ করা।
৪. কোন নেক আমল আল্লাহ্ তা’আলার জন্য করেছে ঠিকই। কিন্তু সাথে সাথে সে এমন কাজও করে যাচ্ছে যা তাকে ইসলামের গন্ডী থেকে সম্পূর্ণরূপে বের করে দেয়। অথবা সে আদতেই কাফির। এ ব্যক্তি তার আমলগুলো একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার জন্য করে থাকলেও তা আল্লাহ্ তা’আলার জন্য হবে না। কারণ, সে কাফির এবং এ ব্যক্তির জন্য আখিরাতে কিছুই থাকবে না।
দুনিয়া কামানোর জন্য কোন নেক আমল করা হলে দুনিয়া যে নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যাবে তাও কিন্তু সঠিক নয়। বরং আল্লাহ্ তা’আলা যাকে যতটুকু দিতে চাবেন সে ততটুকুই পাবে। এর বেশি কিছু সে পাবে না। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
مَنْ كَانَ يُرِيْدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيْهَا مَا نَشَآءُ لِـمَنْ نُّرِيْدُ، ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ، يَصْلاَهَا مَذْمُوْمًا مَّدْحُوْرًا
‘‘কোন ব্যক্তি পার্থিব কোন সুখ-সম্ভোগ কামনা করলে আমি যাকে ইচ্ছা এবং যা ইচ্ছা অতিসত্বর দিয়ে থাকি। অতঃপর আমি তার জন্য নির্ধারিত করে রাখি জাহান্নাম। যাতে সে প্রবেশ করবে অপমানিত ও লাঞ্ছিতভাবে’’। (ইস্রা/বানী ইস্রাঈল : ১৮)
রাসূল (সা.) দুনিয়াকামী ব্যক্তিদেরকে দুনিয়ার গোলাম বলে আখ্যায়িত করেছেন। তারা কখনো আল্লাহ্ তা’আলার গোলাম হতে পারে না।
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী (সা.) ইরশাদ করেন:
تَعِسَ عَبْدُ الدِّيْنَارِ وَعَبْدُ الدِّرْهَمِ، وَعَبْدُ الْـخَمِيْصَةِ، إِنْ أُعْطِيَ رَضِيَ، وَإِنْ لَـمْ يُعْطَ سَخِطَ، تَعِسَ وَانْتَكَسَ، وَإِذَا شِيْكَ فَلاَ انْتَقَشَ، طُوْبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، أَشْعَثَ رَأْسُهُ، مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ، إِنْ كَانَ فِيْ الْـحِرَاسَةِ كَانَ فِيْ الْـحِرَاسَةِ، وَإِنْ كَانَ فِيْ السَّاقَةِ كَانَ فِيْ السَّاقَةِ، إِنِ اسْتَأْذَنَ لَـمْ يُؤْذَنْ لَهُ، وَإِنْ شَفَعَ لَـمْ يُشَفَّعْ
‘‘ধ্বংস হোক দীনার ও দিরহামের গোলাম! ধ্বংস হোক পোশাক-পরিচ্ছদের গোলাম! তাকে কিছু দিলে খুশি। না দিলে বেজার। ধ্বংস হোক! কখনো সে সফলকাম না হোক! সমস্যায় পড়লে সমস্যা থেকে উদ্ধার না হোক! (কাঁটা বিঁধলে না খুলুক)। জান্নাত ঐ ব্যক্তির জন্য যে সর্বদা আল্লাহ্’র রাস্তায় ঘোড়ার লাগাম ধরেই আছে। মাথার চুলগুলো তার এলোমেলো। পা যুগল ধূলিমলিন। সেনাবাহিনীর পাহারায় দিলেও রাজি। পশ্চাতে দিলেও রাজি। উপরস্থদের নিকট অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেয়া হয় না। কারোর জন্য সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গ্রহণ করা হয় না’’। (বুখারী, হাদীস ২৮৮৬, ২৮৮৭ বায়হাক্বী : ৯/১৫৯, ১০/২৪৫)
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
قَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! رَجُلٌ يُرِيْدُ الْـجِهَادَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، وَهُوَ يَبْتَغِيْ عَرَضًا مِنْ عَرَضِ الدُّنْيَا ؟ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: لاَ أَجْرَ لَهُ ، أَعَادَ عَلَيْهِ ثَلاَثًا وَالنَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَقُوْلُ: لاَ أَجْرَ لَهُ
‘‘জনৈক ব্যক্তি বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! জনৈক ব্যক্তি আল্লাহ্’র পথে জিহাদ করতে চায়। অথচ তার উদ্দেশ্য দুনিয়া কামানো। তখন রাসূল (সা.) বললেন: তার কোন সাওয়াব হবে না। লোকটি রাসূল (সা.) কে এ কথাটি তিন বার জিজ্ঞাসা করলো। আর রাসূল (সা.) প্রত্যেকবারই একই উত্তর দিলেন’’। (আবু দাউদ, হাদীস ২৫১৬ হাকিম : ২/৮৫ বায়হাক্বী : ৯/১৬৯ আহমাদ : ২/২৯০, ৩৬৬)
ক্বাতাদা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
مَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ وَنِيَّتَهُ وَطِلْبَتَهُ جَازَاهُ اللهُ بِحَسَنَاتِهِ فِيْ الدُّنْيَا ثُمَّ يُفْضِيْ إِلَى الآخِرَةِ وَلَيْسَ لَهُ حَسَنَةٌ، وَأَمَّا الْمُؤْمِنُ فَيُجَازَى بِحَسَنَاتِهِ فِيْ الدُّنْيَا وَيُثَابُ عَلَيْهَا فِيْ الآخِرَةِ
‘‘দুনিয়াই যার আশা, ভরসা, চাওয়া ও পাওয়া হবে আল্লাহ্ তা’আলা তার সকল নেক আমলের প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়ে দেবেন। আখেরাতের জন্য একটি নেক আমলও তার জন্য গচ্ছিত রাখা হবে না। তবে খাঁটি ঈমানদার তার নেক আমলের ফল দুনিয়াতেও পাবে আখেরাতেও’’।
কারোর সন্তুষ্টি কামনার শির্ক বলতে কোন নেক আমল একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য না করে অন্য কারোর সন্তুষ্টির জন্য করাকে বুঝানো হয়। যে কোন নেক আমল একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যই করতে হয়। অন্য কারোর জন্যে নয়। সুতরাং কোন নেক আমল একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কারোর সন্তুষ্টির জন্য করা হলে তা হবে মারাত্মক শির্ক।
কোর’আন মাজীদে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি কামনাকারীদেরকেই সফলকাম বলা হয়েছে। অন্য কাউকে নয়।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
فَاٰتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ وَالْمِسْكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلَ ذَلِكَ خَيْرٌ لِلَّذِيْنَ يُرِيْدُوْنَ وَجْـهَ اللهِ، وَأُوْلآئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ
‘‘অতএব আত্মীয়-স্বজন, অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকে তাদের প্রাপ্য দিয়ে দাও। এ কাজটি সর্বোত্তম ওদের জন্যে যারা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি কামনা করে এবং ওরাই সত্যিকার সফলকাম’’। (রূম : ৩৮)
আল্লাহ্ তা’আলা সাহাবাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:
يَبْتَغُوْنَ فَضْلًا مِّنَ اللهِ وَ رِضْوَانًا
‘‘তারা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ কামনা করে’’। (ফাত্হ : ২৯)
যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য দান-সাদাকা করে থাকে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে কোর’আন মাজীদের মধ্যে জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অন্যতম বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
وَسَيُجَنَّبُهَا الْأَتْقَى، الَّذِيْ يُؤْتِيْ مَالَهُ يَتَزَكَّى، وَمَا لِأَحَدٍ عِنْدَهُ مِنْ نِّعْمَةٍ تُجْزَى، إِلاَّ ابْتِغَآءَ وَجْهِ رَبِّهِ الْأَعْلَى، وَلَسَوْفَ يَرْضَى
‘‘তবে পরম মুত্তাকী ব্যক্তিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেয়া হবে। যিনি স্বীয় সম্পদ দান করে আরো কল্যাণ প্রাপ্তি তথা তা বৃদ্ধির আশায়। তার প্রতি কারোর অনুগ্রহের প্রতিদান হিসেবে নয়। শুধুমাত্র তার মহান প্রভুর একান্ত সন্তুষ্টি লাভের আশায়। সে জান্নাত পেয়ে অচিরেই সন্তুষ্ট হবে’’। (লাইল : ১৭-২১)
’আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি:
مَنِ الْتَمَسَ رِضَا اللهِ بِسَخَطِ النَّاسِ كَفَاهُ اللهُ مُؤْنَةَ النَّاسِ وَمَنِ الْتَمَسَ رِضَا النَّاسِ بِسَخَطِ اللهِ وَكَلَهُ اللهُ إِلَى النَّاسِ
‘‘যে ব্যক্তি মানুষকে অসন্তুষ্ট করে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টি কামনা করে মানুষের ব্যাপারে তার জন্য একমাত্র আল্লাহ্ই যথেষ্ট। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা’আলাকে অসন্তুষ্ট করে একমাত্র মানুষের সন্তুষ্টি কামনা করে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে মানুষের হাতে ছেড়ে দেন। তিনি তার কোন ধরনের সহযোগিতা করেন না’’। (তিরমিযী, হাদীস ২৪১৪)
আবু উমামা বাহিলী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا، وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা এমন আমলই গ্রহণ করে থাকেন যা হবে একেবারেই নিষ্কলুষ এবং যার মাধ্যমে শুধুমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি কামনা করা হয়’’। (নাসায়ী, হাদীস ৩১৪০ বায়হাক্বী, হাদীস ৪৩৪৮)
কাউকে দেখানো (রিয়া) বা শুনানো (সুম্’আহ্) এর শির্ক বলতে কোন নেক আমল করার সময় তা কাউকে দেখানো বা শুনানোর উদ্দেশ্যে করাকে বুঝানো হয়। যাতে মানুষের প্রশংসা কুড়ানো যায়।
কোন নেক আমল লুক্কায়িতভাবে করার পর পুনরায় তা কাউকে জানিয়ে দেয়াও এ শির্কের অন্তর্গত।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
قُلْ إِنَّمَآ أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوْحَى إِلَيَّ أَنَّمَآ إِلاَهُكُمْ إِلاَهٌ وَّاحِدٌ، فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْ لِقَآءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا، وَلاَ يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
‘‘আপনি বলে দিন: নিশ্চয়ই আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ। তবে আমার প্রতি এ প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের মা’বূদই একমাত্র মা’বূদ। সুতরাং যে ব্যক্তি তার প্রভুর সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদাতে কাউকে যেন শরীক না করে’’। (কাহ্ফ : ১১০)
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ্) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:
كَمَا أَنَّ اللهَ وَاحِدٌ، لاَ إِلاَهَ سِوَاهُ، فَكَذَلِكَ يَنْبَغِيْ أَنْ تَكُوْنَ الْعِبَادَةُ لَهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ، فَكَمَا تَفَرَّدَ بِالْإِلاَهِيَّةِ يَجِبُ أَنْ يُفْرَدَ بِالْعُبُوْدِيَّةِ، فَالْعَمَلُ الصَّالِحُ هُوَ الْـخَالِصُ مِنَ الرِّيَاءِ الْـمُقَيَّدُ بِالسُّنَّةِ
‘‘যখন আল্লাহ্ তা’আলা একক। তিনি ছাড়া কোন মা’বূদ নেই। তখন সকল ইবাদাত একমাত্র তাঁরই জন্য হতে হবে। অতএব নেক আমল বলতে রাসূল (সা.) এর আদর্শ সম্মত রিয়ামুক্ত ইবাদাতকেই বুঝানো হয়। মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্য থাকলে তা নেক আমল বলে গণ্য হবে না’’।
আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন মাজীদে রিয়াকে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন:
إِنَّ الْـمُنَافِقِيْنَ يُخَادِعُوْنَ اللهَ وَهُوَ خَادِعُهُمْ، وَإِذَا قَامُوْا إِلَى الصَّلاَةِ قَامُوْا كُسَالَى يُرَاؤُوْنَ النَّاسَ وَلاَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ إِلاَّ قَلِيْلًا
‘‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা আল্লাহ্ তা’আলার সাথে প্রতারণা করে। তিনি অচিরেই তাদের প্রতারণার শাস্তি দিবেন। যখন তারা নামাযের জন্য দাঁড়ায় তখন তারা লোকদেরকে দেখানোর জন্য আলস্যভাবেই দাঁড়ায় এবং তারা আল্লাহ্ তা’আলাকে খুব কমই স্মরণ করে থাকে’’। (নিসা’ : ১৪২)
উক্ত ব্যাধিটি কাফিরদের মধ্যেও প্রচলিত ছিলো। তারা যে কোন কাজ দাম্ভিকতার সঙ্গে লোকদেরকে দেখানোর জন্যই করতো।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
وَلاَ تَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ خَرَجُوْا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَّرِئَاءَ النَّاسِ، وَيَصُدُّوْنَ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ، وَاللهُ بِمَا يَعْمَلُوْنَ مُحِيْطٌ
‘‘তোমরা তাদের (কাফিরদের) ন্যায় আচরণ করোনা যারা নিজেদের ঘর হতে বের হয়েছে সদর্পে ও লোকদেরকে নিজেদের শক্তি দেখানোর জন্য। তারা মানুষকে আল্লাহ্’র পথ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের কর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত’’। (আন্ফাল্ : ৪৭)
কেউ কোন নেক আমল শুধু মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে করলে অথবা সাওয়াবের জন্য এবং মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে করলে তাতে কোন সাওয়াব হবে না। বরং তা বাতিল বলে গণ্য হবে।
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى: أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِيْ غَيْرِيْ، تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ
‘‘আমি শির্কের প্রতি সম্পূর্ণরূপে অমুখাপেক্ষী। যে ব্যক্তি কোন নেক আমলের মধ্যে আমি ছাড়া অন্য কাউকে আমার সাথে শরীক করলো আমি সে আমল ও সে শরীককে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করি’’। (মুসলিম, হাদীস ২৯৮৫ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪২৭৭)
আবু উমামা বাহিলী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
جَاءَ رَجُلٌ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم، فَقَالَ: يَا رَسُوْلَ اللهِ! أَرَأَيْتَ رَجُلًا غَزَا يَلْتَمِسُ الْأَجْرَ وَالذِّكْرَ، مَا لَهُ؟ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ: لاَ شَيْءَ لَهُ، فَأَعَادَهَا عَلَيْهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ، يَقُوْلُ لَهُ رَسُوْلُ اللهِصلى الله عليه وسلم : لاَ شَيْءَ لَهُ، ثُمَّ قَالَ: إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبَلُ مِنَ الْعَمَلِ إِلاَّ مَا كَانَ لَهُ خَالِصًا، وَابْتُغِيَ بِهِ وَجْهُهُ
‘‘জনৈক ব্যক্তি রাসূল (সা.) এর নিকট এসে বললো: হে আল্লাহ্’র রাসূল! জনৈক ব্যক্তি যুদ্ধ করছে সাওয়াব ও সুনামের জন্য। এমতাবস্থায় সে পুণ্য পাবে কি? রাসূল (সা.) বললেন: সে কিছুই পাবে না। লোকটি রাসূল (সা.) কে এ কথাটি তিন বার জিজ্ঞাসা করলো। আর রাসূল (সা.) প্রতিবারই তাকে বললেন: সে কিছুই পাবে না। অতঃপর রাসূল (সা.) বললেন: নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা এমন আমলই গ্রহণ করে থাকেন যা হবে একেবারেই নিষ্কলুষ এবং যা শুধু তাঁরই জন্য নিবেদিত’’। (নাসায়ী, হাদীস ৩১৪০ বায়হাক্বী, হাদীস ৪৩৪৮)
আবু হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি:
إِنَّ أَوَّلَ النَّاسِ يُقْضَى يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَلَيْهِ، رَجُلٌ اسْتُشْهِدَ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَـهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا؟ قَالَ: قَاتَلْتُ فِيْكَ حَتَّى اسْتُشْهِدْتُ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ قَاتَلْتَ لِأَنْ يُّقَالَ جَرِيْءٌ، فَقَدْ قِيْـلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِيْ النَّارِ، وَرَجُلٌ تَعَلَّمَ الْعِلْمَ وَعَلَّمَهُ وَقَرَأَ الْقُرْآنَ، فَأُتِيَ بِهِ، فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا؟ قَالَ: تَعَلَّمْتُ الْعِلْمَ وَعَلَّمْتُهُ وَقَرَأْتُ فِيْكَ الْقُرْآنَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ تَعَلَّمْتَ الْعِلْمَ لِيُقَالَ عَالِمٌ، وَقَرَأْتَ الْقُرْآنَ لِيُقَالَ هُوَ قَارِئٌ، فَقَدْ قِيْلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ حَتَّى أُلْقِيَ فِيْ النَّارِ، وَرَجُلٌ وَسَّعَ اللهُ عَلَيْهِ وَأَعْطَاهُ مِنْ أَصْنَافِ الْـمَالِ كُلِّهِ، فَأُتِيَ بِهِ فَعَرَّفَهُ نِعَمَهُ فَعَرَفَهَا، قَالَ: فَمَا عَمِلْتَ فِيْهَا؟ قَالَ: مَا تَرَكْتُ مِنْ سَبِيْلٍ تُحِبُّ أَنْ يُنْفَـقَ فِيْهَا إِلاَّ أَنْفَقْتُ فِيْهَا لَكَ، قَالَ: كَذَبْتَ، وَلَكِنَّكَ فَعَلْتَ لِيُقَالَ هُوَ جَوَادٌ، فَقَدْ قِيْلَ، ثُمَّ أُمِرَ بِهِ فَسُحِبَ عَلَى وَجْهِهِ، ثُمَّ أُلْقِيَ فِيْ النَّارِ
‘‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন সর্ব প্রথম যে ব্যক্তির হিসেব হবে সে একজন শহীদ। সুতরাং তাকে উপস্থিত করা হবে অতঃপর তাকে আল্লাহ্ তা’আলার সকল নিয়ামত বুঝিয়ে দেয়া হবে যা সে দুনিয়াতে ভোগ করেছে। অতএব সে সকল নিয়ামত বুঝে পাবে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বলবেন: এ গুলোর শুকরিয়া সরূপ তুমি কি আমল করেছিলে? তখন সে বলবে: আমি আপনার দ্বীন দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করে শহীদ হয়ে গিয়েছি। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন: তুমি মিথ্যা বলেছো। বরং তুমি যুদ্ধ করেছো এ জন্য যে, তোমাকে বলা হবে বীর সাহসী। আর তা বলা হয়েছে। অতএব তার ব্যাপারে আদেশ করা হবে এবং তাকে মুখের উপর টেনেহেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আরেক ব্যক্তি জ্ঞানার্জন করেছে এবং অন্যকেও শিখিয়েছে। তেমনিভাবে কোর’আন মাজীদও তিলাওয়াত করেছে। সুতরাং তাকে উপস্থিত করা হবে অতঃপর তাকে আল্লাহ্ তা’আলার সকল নিয়ামত বুঝিয়ে দেয়া হবে যা সে দুনিয়াতে ভোগ করেছে। অতএব সে সকল নিয়ামত বুঝে পাবে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বলবেন: এ গুলোর শুকরিয়া সরূপ তুমি কি আমল করেছিলে? তখন সে বলবে: আমি জ্ঞানার্জন করেছি এবং অন্যকেও শিখিয়েছি। তেমনিভাবে কোর’আন মাজীদও তিলাওয়াত করেছি। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলবেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছো। বরং তুমি জ্ঞানার্জন করেছো এ জন্য যে, তোমাকে আলিম বা জ্ঞানী বলা হবে এবং কোর’আন মাজীদ তিলাওয়াত করেছো এ জন্য যে, তোমাকে ক্বারী বা কোর’আন তিলাওয়াতকারী বলা হবে। আর তা বলা হয়েছে। অতএব তার ব্যাপারে আদেশ করা হবে এবং তাকে মুখের উপর টেনেহেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।
আরেক ব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা’আলা ধনী বানিয়েছেন এবং তাকে সর্ব ধরনের সম্পদ দিয়েছেন। সুতরাং তাকে উপস্থিত করা হবে অতঃপর তাকে আল্লাহ্ তা’আলার সকল নিয়ামত বুঝিয়ে দেয়া হবে যা সে দুনিয়াতে ভোগ করেছে। অতএব সে সকল নিয়ামত বুঝে পাবে। তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাকে বলবেন: এ গুলোর শুকরিয়া সরূপ তুমি কি আমল করেছিলে? তখন সে বলবে: আমি এমন কোন খাত বাকি রাখিনি যেখানে দান করা আপনার নিকট পছন্দনীয় অথচ আমি দান করিনি। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলবেন: তুমি মিথ্যা বলেছো। বরং তুমি দান করেছো এ জন্য যে, তোমাকে দানবীর বলা হবে। আর তা বলা হয়েছে। অতএব তার ব্যাপারে আদেশ করা হবে এবং তাকে মুখের উপর টেনেহেঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’’। (মুসলিম, হাদীস ১৯০৫)
জুন্দুব (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন:
مَنْ يُرَاءِ يُرَاءِ اللهُ بِهِ، وَمَنْ يُسَمِّعْ يُسَمِّعِ اللهُ بِهِ
‘‘যে ব্যক্তি কোন নেক আমল মানুষকে দেখানোর জন্য করবে আল্লাহ্ তা’আলা তা মানুষকে দেখিয়ে দিবেন। আখিরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না। আর যে ব্যক্তি কোন নেক আমল মানুষকে শুনানোর জন্য করবে আল্লাহ্ তা’আলা তা মানুষকে শুনিয়ে দিবেন। আখিরাতে তার জন্য কিছুই থাকবে না’’। (ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪২৮২)
আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم، وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ الْـمَسِيْحَ الدَّجَّالَ، فَقَالَ: أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِمَا هُوَ أَخْوَفُ عَلَيْكُمْ عِنْدِيْ مِنَ الْـمَسِيْحِ الدَّجَّالِ؟ قُلْنَا: بَلَى، قَالَ: الشِّـرْكُ الْـخَفِيُّ؛ أَنْ يَقُوْمَ الرَّجُلُ يُصَلِّيْ، فَيُزَيِّنُ صَلاَتَهُ لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ الرَّجُلِ
‘‘রাসূল (সা.) আমাদের নিকট আসলেন যখন আমরা দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন বস্ত্ত সম্পর্কে সংবাদ দেবো যা আমার জানা মতে তোমাদের জন্য দাজ্জাল চাইতেও অধিক ভয়ঙ্কর। আমরা বললাম: হাঁ, অবশ্যই বলুন। তিনি বললেন: লুক্কায়িত শির্ক। যেমন: কোন ব্যক্তি নামায পড়ছিলো অতঃপর কেউ তাকে দেখছে বলে সে নামাযকে খুব সুন্দর করে পড়তে শুরু করলো’’। (ইবনু মাজাহ্, হাদীস ৪২৭৯ আহমাদ : ৩/৩০ হা’কিম : ৪/৩২৯)
মাহমূদ বিন্ লাবীদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
خَرَجَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ! إِيَّاكُمْ وَشِرْكَ السَّرَائِرِ، قَالُوْا: يَا رَسُوْلَ الله! وَمَا شِرْكُ السَّرَائِرُ؟ قَالَ: يَقُوْمُ الرَّجُلُ فَيُصَلِّيْ، فَيُزَيِّنُ صَلاَتُهُ جَاهِدًا لِمَا يَرَى مِنْ نَظَرِ الرَّجُلِ إِلَيْهِ فَذَلِكَ شِرْكُ السَّرَائِرِ
‘‘নবী (সা.) নিজ হুজরা থেকে বের হয়ে বললেন: হে মানব সকল! তোমরা গুপ্ত শির্ক থেকে বেঁচে থাকো। সাহাবাগণ বললেন: হে আল্লাহ্’র রাসূল! গুপ্ত শির্ক কি? তিনি বললেন: যেমন: কোন ব্যক্তি নামায পড়ছে। এমতাবস্থায় কেউ তাকে দেখছে বলে সে অত্র নামাযটি খুব সুন্দরভাবে পড়তে শুরু করলো। এটিই হলো গুপ্ত শির্ক’’। (ইবনু খুজাইমাহ্, হাদীস ৯৩৭ বায়হাক্বী : ২/২৯০-২৯১)
তবে কোন ব্যক্তি যদি একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য কোন নেক আমল করে। অতঃপর মানুষ তা দেখে তার কোন প্রশংসা করে এবং সে আল্লাহ্ তা’আলা তাকে এ কাজের জন্য তাওফীক দিয়েছেন বলে তাঁর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে মনে মনে খুশি হয়। গর্বিত নয়। তাতে কোন অসুবিধে নেই। বরং তা হবে তার জন্য আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ হতে অগ্রিম পাওনা। আবু যর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
قِيْلَ لِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم: أَرَأَيْتَ الرَّجُلَ يَعْمَلُ الْعَمَلَ مِنَ الْـخَيْرِ، وَيَحْمَدُهُ النَّاسُ عَلَيْهِ؟ قَالَ: تِلْكَ عَاجِلُ بُشْرَى الْـمُؤْمِنِ
‘‘রাসূল (সা.) কে বলা হলো: আপনি এ ব্যাপারে কি বলেন? জনৈক ব্যক্তি কোন নেক আমল করছে। আর মানুষ এতে করে তার প্রশংসা করছে। রাসূল (সা.) বললেন: এটি হচ্ছে একজন মু’মিনের জন্য অগ্রিম সুসংবাদ’’। (মুসলিম, হাদীস ২৬৪২ আহমাদ : ৫/১৫৬)
وَصَلَّى اللهُ عَلَى نَبِيِّنَا مُحَمَّدٍ وَّعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ أَجْمَعِيْنَ
হে আল্লাহ্! আপনি আমাদের সকলকে শির্ক থেকে বাঁচার তাওফীক দান করুন। আ’মীন সুম্মা আ’মীন।