অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করেন যে, মানুষ ইবাদাত করতে করতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সে তখন দুনিয়ার প্রতিটি বস্ত্তর মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলাকে স্বয়ং দেখতে পায় অথবা দুনিয়ার প্রতিটি বস্ত্তকে আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্বের বিশেষ অংশ হিসেবে মনে করে। এ পর্যায়কে সূফীদের পরিভাষায় ‘‘ওয়াহদাতুল্ উজূদ্’’ বলা হয়।
এভাবে মানুষ আরো বেশি বেশি আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করতে থাকলে সে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তখন তার অস্তিতব আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। তখন আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর বান্দাহ্’র মাঝে আর কোন ব্যবধানই থাকে না। এ পর্যায়কে সূফীদের পরিভাষায় ‘‘ওয়াহদাতুশ্ শুহূদ্’’ বা ‘‘ফানা ফিল্লাহ্’’ বলা হয়।
এভাবে মানুষ আরো বেশি বেশি আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করতে থাকলে সে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, তখন আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্ব তার অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এ পর্যায়কে সূফীদের পরিভাষায় ‘‘হুলূল্’’ বলা হয়।
মূল কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, এ পরিভাষাগুলোর মাঝে কোন ফারাকই নেই। কারণ, সবগুলোর মূল কথা হচ্ছে, মানুষ তথা আল্লাহ্ তা’আলার সকল সৃষ্টি তাঁরই অংশ বিশেষ মাত্র। হিন্দুদের পরিভাষায় এ বিশ্বাসকে অবতার বলা হয়।
উক্ত বিশ্বাসের কারণেই ইহুদীরা উযাইর (আ.) কে এবং খ্রিস্টানরা ঈসা (আ.) কে আল্লাহ্ তা’আলার ছেলে বলে আখ্যায়িত করেছে। শিয়াদের মধ্যেও এ বিশ্বাস চালু রয়েছে এবং উক্ত কারণেই সূফী সম্রাট মনসূর হাল্লাজ নিজকে আল্লাহ্ তা’আলা তথা ‘‘আনাল্ হক্ব’’ বলে দাবি করেছিলেন। হযরত বায়যীদ বোস্তামীও বলেছিলেন: ‘‘সুব্হানী মা আ’যামা শা’নী’’ (আমি পবিত্র এবং আমি কতই না সুমহান!)। একদা জনৈক ব্যক্তি তাঁর ঘরের দরোজায় গিয়ে তাঁকে ডাক দিলে তিনি বলেন: কাকে চাও। সে বললো: আমি বায়যীদ বোস্তামীকে চাই। তখন তিনি লোকটিকে বললেন: ঘরে আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া আর কেউ নেই। পরবর্তীতে এ দাবির সমর্থন জানিয়েছেন সর্বজনাব ’আলী হাজুইরী, শাইখ আব্দুল কাদের জিলানী, খাজা নিজামুদ্দীন আউলিয়া, মাওলানা আশ্রাফ আলী থানুভী ও রশীদ আহমাদ গঙ্গূহী সাহেবগণ।
এ দিকে অনেক নতুন ও পুরাতন সূফী সাহেবগণ উক্ত বিশ্বাসকে সঠিক প্রমাণ করতে গিয়ে বড় বড় অনেক কিতাব ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তবে আমাদের প্রশ্ন হলো এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা এবং তাঁর বান্দাহ্ যদি একই হয়ে যায় তা হলে ইবাদাতই বা করবে কে এবং কার ইবাদাত করা হবে? সিজ্দাহ্ই বা করবে কে এবং কাকে সিজ্দাহ্ করা হবে? স্রষ্টাই বা কে এবং সৃষ্টি বলতে কোন বস্ত্তটিকে বুঝানো হবে? মুখাপেক্ষীই বা কে এবং সমস্যা দূর করবেন কে? মরবেই বা কে এবং মৃত্যু দিবেন কে? জীবিতই বা কে এবং জীবন দিচ্ছেন কে? গুনাহ্গারই বা কে এবং ক্ষমা করবেন কে? কিয়ামতের দিন হিসেব দিবেই বা কে এবং হিসেব নিবেন কে? জান্নাত ও জাহান্নামে যাবেই বা কে এবং পাঠাবেন কে?
উক্ত দর্শন মেনে নিলে মানুষ ও মানুষের সৃষ্টি এবং আখিরাত সবই অর্থহীন হতে বাধ্য। উক্ত দর্শন ঠিক হলে খ্রিস্টানদের দর্শনও ঠিক হতে বাধ্য। তারা তো শুধু এতটুকুই বলে যে, ঈসা (আ.) আল্লাহ্ তা’আলার সন্তান বা সরাসরি আল্লাহ্ তা’আলা। তাদের দর্শন ও উক্ত দর্শনের মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই; অথচ আল্লাহ্ তা’আলা কোর’আন মাজীদের মধ্যে তাদেরকে কাফির বলেছেন।
আল্লাহ্ তা’আলা বলেন:
«لَقَدْ كَفَرَ الَّذِيْنَ قَالُوْآ إِنَّ اللهَ هُوَ الْـمَسِيْحُ ابْنُ مَرْيَمَ، قُلْ فَمَنْ يَّمْلِكُ مِنَ اللهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ أَنْ يُّهْلِكَ الْـمَسِيْحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَنْ فِيْ الْأَرْضِ جَمِيْعًا، وَلِلهِ مُلْكُ السَّمٰوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا، يَخْلُقُ مَا يَشَآءُ، وَاللهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ»
‘‘তারা অবশ্যই কাফির যারা বলে: নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা হচ্ছেন স্বয়ং মার্ইয়াম এর ছেলে মাসীহ্ বা ঈসা (আ.)। হে নবী! আপনি তাদেরকে বলে দিন: আল্লাহ্ তা’আলা যদি মার্ইয়াম এর ছেলে মাসীহ্ বা ঈসা (আ.) কে এবং তাঁর মাকে ও দুনিয়ার সবাইকে ধ্বংস করে দিতে চান তখন তাদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার হাত থেকে রক্ষা করবেন কে? ভূমন্ডল-নভোমন্ডল এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে সবগুলোর কর্তৃত্ব একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই হাতে। তিনি যা চান তাই সৃষ্টি করেন। আর আল্লাহ্ তা’আলা সকল বস্ত্তর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান’’। (মা’য়িদাহ্ : ১৭)
আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেন:
«وَقَالُوْا اتَّخَذَ الرَّحْمَنْ وَلَدًا، لَقَدْ جِئْتُمْ شَيْئًا إِدًّا، تَكَادُ السَّمَاوَاتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ وَتَنْشَقُّ الْأَرْضُ وَتَخِرُّ الْـجِبَالُ هَدًّا، أَنْ دَعَوْا لِلرَّحْمَنِ وَلَدًا»
‘‘তারা বলে: দয়াময় আল্লাহ্ তা’আলা সন্তান গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন: মূলতঃ তোমরা এক মারাত্মক কথার অবতারণা করলে। যে কথার ভয়ঙ্করতায় আকাশ ফেটে যাবে। পৃথিবী খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাবে। চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পাহাড়ও ভেঙ্গে পড়বে। যেহেতু তারা দয়াময় আল্লাহ্ তা’আলার সন্তান আছে বলে দাবি করেছে’’। (মার্ইয়াম : ৮৮-৯১)
উক্ত ব্যাপারটি এতো মারাত্মক হওয়ার একমাত্র কারণ এই যে, যখন কেউ আল্লাহ্ তা’আলার সন্তান অথবা কারোর অস্তিত্বের মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে বলে মনে করা হবে তখন এটাও মনে করতে হবে যে, তার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার সকল বৈশিষ্ট্য এসে গিয়েছে। আর যখন তার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার সকল বৈশিষ্ট্য আছে বলে মনে করা হবে তখন স্বাভাবিকভাবেই তার সন্তুষ্টির জন্য সকল ধরনের ইবাদাত ব্যয় করা হবে। তা হলে বুঝা গেলো, আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্বে শির্ক করা এবং তাঁর গুণাবলী ও ইবাদাতে শির্ক করার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা উক্ত আয়াতে তাঁর অস্তিত্বের মধ্যে শির্ক করার ব্যাপারে এতো কঠিন মন্তব্য করেছেন।
উক্ত ঈমান বিধ্বংসী বিশ্বাসের কারণেই সূফীরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে কঠিন কঠিন ঈমান বিধ্বংসী মন্তব্য করতে এতটুকুও লজ্জা পায়নি। বিষয়গুলো নিম্নরূপ:
ক. রাসূল ও রিসালাত:
নবু’ওয়াত ও রিসালাত সম্পর্কে সূফীদের ঈমান বিধ্বংসী ধারণার কিয়দাংশ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
সূফীদের নিকট ‘‘বিলায়াত’’ তথা বুযুর্গী নবু’ওয়াত এবং রিসালাত চাইতেও উত্তম।
শাইখ মুহয়ুদ্দীন ইবনু ’আরাবী বলেন:
‘‘নবু’ওয়াতের অবস্থান মধ্যম পর্যায়ের। বিলায়াতের নীচে ও রিসালাতের উপরে’’। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১১৮)
বায়েযীদ বুস্তামী বলেন:
‘‘আমি (মা’রিফাতের) সাগরে ডুব দিয়েছি; অথচ নবীরা আশ্চর্য হয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে আছেন’’। তিনি আরো বলেন:
‘‘আমার পতাকা কিয়ামতের দিন মুহাম্মাদ (সা.) এর পতাকা চাইতেও অনেক উঁচু হবে’’। আমার পতাকা হবে নূরের। যার নিচে থাকবেন সকল নবী ও রাসূলগণ। সুতরাং আমাকে একবার দেখা আল্লাহ্ তা’আলাকে এক হাজার বার দেখার চাইতেও উত্তম।
সূফীদের কেউ কেউ ধারণা করেন: রাসূল (সা.) হচ্ছেন বিশ্বের কেন্দ্র স্থল। তিনিই হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ্। যিনি আর্শের উপর রয়েছেন। আকাশ ও জমিন, আর্শ এবং কুর্সী এমনকি বিশ্বের তাঁর নূর থেকেই তৈরি করা হয়েছে। তাঁর অস্তিত্বই সর্ব প্রথম। আল্লাহ্’র আর্শের উপর তিনিই সমাসীন। (সূফিয়্যাত, শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১২০)
নিযামুদ্দীন আউলিয়া বলেন: ‘‘পীরের কথা রাসূল (সা.) এর কথার সম পর্যায়ের’’। (সূফীবাদের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব, পৃষ্ঠা: ৬৯)
’হাফিয শীরাযী বলেন: ‘‘যদি তোমাকে তোমার পীর সাহেব নিজ জায়নামায মদে ডুবিয়ে দিতে বলে তাহলে তুমি তাই করবে। কারণ, বুযুর্গীর রাস্তায় চলন্ত ব্যক্তি সে রাস্তার আদব-কায়দা সম্পর্কে ভালোই জানেন’’। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৫২)
খ. কোর’আন ও হাদীস:
কোর’আন ও হাদীস সম্পর্কে সূফীদের ধারণা:
সূফী ’আফীফুদ্দীন তিলমাসানী বলেন:
‘‘কোর’আন মাজীদের মধ্যে তাওহীদ কোথায়? তা তো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শির্ক দিয়েই পরিপূর্ণ। যে ব্যক্তি সরাসরি কোর’আনকে অনুসরণ করবে সে কখনো তাওহীদের উচ্চ শিখরে পৌঁছুতে পারবে না’’। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৫২)
জনাব বায়েযীদ বোস্তামী বলেন: ‘‘তোমরা (শরীয়তপন্থীরা) নিজেদের জ্ঞান মৃত ব্যক্তিদের থেকে (মুহাদ্দিসীনদের থেকে) সংগ্রহ করে থাকো। আর আমরা নিজেদের জ্ঞান সরাসরি আল্লাহ্ তা’আলা থেকে সংগ্রহ করি যিনি চিরঞ্জীব। আমরা বলি: আমার অন্তর আমার প্রভু থেকে বর্ণনা করেছে। আর তোমরা বলো: অমুক বর্ণনাকারী আমার নিকট বর্ণনা করেছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, ওই বর্ণনাকারী কোথায়? উত্তর দেয়া হয়, সে মৃত্যু বরণ করেছে। যদি বলা হয়: সে বর্ণনাকারী কার থেকে বর্ণনা করেছে এবং সে কোথায়? বলা হবে: সেও মৃত্যু বরণ করেছে। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ১৫২)
গ. ইবলিস ও ফির’আউন:
অভিশপ্ত ইবলিস সম্পর্কে সূফীদের ধারণা হচ্ছে এই যে, সে আল্লাহ্ তা’আলার কামিল বান্দাহ্। সর্ব শ্রেষ্ঠ আল্লাহ্’র সৃষ্টি। খাঁটি তাওহীদ পন্থী। কারণ, সে একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া আর কাউকে সিজদাহ্ করেনি। আল্লাহ্ তা’আলা তার সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন।
ফির’আউন সম্পর্কে তাদের ধারণা হচ্ছে এই যে, সে একজন শ্রেষ্ঠ তাওহীদ পন্থী। কারণ, সে ঠিকই বলেছে: ‘‘আনা রাব্বুকুমুল-আ’লা’’ (আমিই তো তোমাদের সুমহান প্রভু)। মূলতঃ সেই তো হাক্বীক্বতে পৌঁছেছে। কারণ, সব কিছুই তো স্বয়ং আল্লাহ্। তাই সে খাঁটি ঈমানদার এবং জান্নাতী।
ঘ. ইবাদাত ও মুজাহাদাহ্:
সূফীদের পরিভাষায় নামায বলতে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে আন্তরিক সাক্ষাতকেই বুঝানো হয়। আবার কারো কারোর নিকট পীরের প্রতিচ্ছবি কাল্পনিকভাবে নামাযীর চোখের সামনে উপস্থিত না হলে সে নামায পরিপূর্ণই হয় না। রোযা বলতে হৃদয়ে গায়রুল্লাহ্’র চিন্তা (একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলা ছাড়া দুনিয়াতে অন্য কিছু আছে বলে মনে করা) না আসাকেই বুঝানো হয় এবং হজ্জ বলতে নিজ পীর সাহেবের সাথে বিশেষভাবে সাক্ষাৎ করাকেই বুঝানো হয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা প্রচলিত নামায, রোযা, হজ্জ ও যাকাতকে সাধারণ লোকের ইবাদাত বলে আখ্যায়িত করে। যা বিশেষ ও অতি বিশেষ লোকদের জন্য প্রযোজ্য নয়। বরং তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ যিকির, নিতান্ত একা জীবন যাপন, নির্দিষ্ট খাবার, নির্দিষ্ট পোষাক ও নির্দিষ্ট বৈঠক।
ইসলামে ইবাদাতের উদ্দেশ্য ব্যক্তি বা সমাজ শুদ্ধি হয়ে থাকলেও সূফীদের ইবাদাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার সাথে অন্তরের বিশেষ বন্ধন সৃষ্টি যার দরুন তাঁর থেকেই সরাসরি কিছু শিখা যায় এবং তাঁর মধ্যে বিলীন হওয়া যায়। তাঁর রাসূল থেকে গায়েবের জ্ঞান সংগ্রহ করা যায়। এমনকি আল্লাহ্ তা’আলার একান্ত চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্য মন্ডিত হওয়া যায়। তা হলে সূফী সাহেবও কোন কিছুকে হতে বললে তা হয়ে যাবে। মানুসের গুপ্ত রহস্যও তিনি বলতে পারবেন। এমনকি আকাশ ও জমিনের সব কিছুই তিনি সচক্ষে দেখতে পাবেন।
এ ছাড়াও সূফীরা ইবাদাত ও মুজাহাদাহ্’র ক্ষেত্রে এমন কিছু পন্থা আবিষ্কার করেছে যা কুর’আন ও হাদীসের সম্পূর্ণ বিরোধী। নিম্নে উহার কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো:
১. বলা হয়: আব্দুল কাদির জিলানী পনেরো বছর যাবৎ এক পায়ে দাঁড়িয়ে ’ইশা থেকে ফজর পর্যন্ত এক খতম কোর’আন মাজীদ তিলাওয়াত করেছেন। (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৯১)
একদা তিনি নিজেই বলেন: আমি পঁচিশ বছর যাবৎ ইরাকের জঙ্গলে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছি। এমনকি আমি এক বছর পর্যন্ত তো শুধু ঘাস ও মানুষের পরিত্যক্ত বস্ত্ত খেয়েই জীবন যাপন করেছি। পুরো বছর একটুও পানি পান করিনি। তবে এর পরের বছর পানিও পান করতাম। তৃতীয় বছর তো শুধু পানি পান করেই জীবন যাপন করেছি। চতুর্থ বছর না কিছু খেয়েছি না কিছু পান করেছি না শুয়েছি।
(গাউসুস্ সাক্বালাইন, পৃষ্ঠা: ৮৩ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৩১)
২. বায়েযীদ বোস্তামী তিন বছর যাবৎ সিরিয়ার জঙ্গলে রিয়াযাত (সূফীবাদের প্রশিক্ষণ) ও মুজাহাদাহ্ করেছেন। একদা তিনি হজ্জে রওয়ানা করলেন। যাত্রাপথে তিনি প্রতি কদমে কদমে দু’ রাক্’আত দু’ রাক্’আত নামায আদায় করেছেন। এতে করে তিনি বারো বছরে মক্কা পৌঁছেন। (সূফিয়ায়ে নক্বশেবন্দী, পৃষ্ঠা: ৮৯ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৩১)
৩. মু’ঈনুদ্দীন চিশতী আজমীরি বেশি বেশি মুজাহাদাহ্ করতেন। তিনি সত্তর বছর যাবৎ পুরো রাত এতটুকুও ঘুমাননি।
(তারীখে মাশায়েখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১৫৫ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৫৯১)
৪. ফরীদুদ্দীন গাঞ্জে শুক্র চল্লিশ দিন যাবৎ কুয়ায় বসে চিল্লা পালন করেছেন।
(তারীখে মাশায়েখে চিশ্ত, পৃষ্ঠা: ১৭৮ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৩৪০)
৫. জুনাইদ বাগ্দাদী ত্রিশ বছর যাবৎ ’ইশার নামায পড়ার পর এক পায়ে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেছেন।
(সূফিয়ায়ে নক্বশেবন্দী, পৃষ্ঠা: ৮৯ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৯১)
৬. খাজা মুহাম্মাদ্ চিশ্তী নিজ ঘরে এক গভীর কুয়া খনন করেছেন। তাতে তিনি উল্টোভাবে ঝুলে থেকে আল্লাহ্’র স্মরণে ব্যস্ত থাকতেন।
(সিয়ারুল আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ৪৬ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৪৩১)
৭. মোল্লা শাহ্ কাদেরী বলতেন: পুরো জীবনে আমার স্বপ্নদোষ বা সহবাসের গোসলের কোন প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কারণ, এগুলোর সম্পর্ক বিবাহ্ ও ঘুমের সঙ্গে। আর আমি না বিবাহ্ করেছি না কখনো ঘুমিয়েছি। (হাদীক্বাতুল আউলিয়া, পৃষ্ঠা: ৫৭ শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ২৭১)
রাসূল (সা.) এর আদর্শের সঙ্গে উক্ত আদর্শের কোন মিল নেই। বরং তা রাসূল (সা.) প্রদর্শিত আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:
دَخَلَ عَلَيَّ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: أَلَمْ أُخْبَرْ أَنَّكَ تَقُوْمُ اللَّيْلَ وَتَصُوْمُ النَّهَارَ؟ قُلْتُ: بَلَى، قَالَ: فَلاَ تَفْعَلْ، قُمْ وَنَمْ ، وَصُمْ وَأَفْطِرْ ، فَإِنَّ لِـجَسَـدِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَإِنَّ لِعَيْنِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَإِنَّ لِزَوْرِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَإِنَّ لِزَوْجِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَإِنَّكَ عَسَى أَنْ يَطُوْلَ بِكَ عُمُرٌ، وَإِنَّ مِنْ حَسْبِكَ أَنْ تَصُوْمَ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ، فَإِنَّ بِكُلِّ حَسَنَةٍ عَشْرَ أَمْثَالِهَا، فَذَلِكَ الدَّهْرُ كُلُّهُ، قَالَ: فَشَدَّدْتُ فَشُدِّدَ عَلَيَّ، فَقُلْتُ: فَإِنِّيْ أُطِيْقُ غَيْرَ ذَلِكَ، قَالَ: فَصُمْ مِنْ كُلِّ جُمُعَةٍ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ، قَالَ: فَشَدَّدْتُ فَشُدِّدَ عَلَيَّ، فَقُلْتُ: أُطِيْقُ غَيْرَ ذَلِكَ، قَالَ: فَصُمْ صَوْمَ نَبِيِّ اللهِ دَاوُدَ، قُلْتُ: وَمَا صَوْمُ نَبِيِّ اللهِ دَاوُدَ؟ قَالَ: نِصْفُ الدَّهْرِ، وَفِيْ رِوَايَةٍ: قُلْتُ: فَإِنِّيْ أُطِيْقُ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ، قَالَ: لاَ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ، قَالَ عَبْدُ اللهِ: لَأَنْ أَكُوْنَ قَبِلْتُ الثَّلاَثَةَ الْأَيَّامَ الَّتِيْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَهْلِيْ وَمَالِيْ
‘‘রাসূল (সা.) আমার নিকট এসে বললেন: আমাকে সংবাদ দেয়া হয়েছে তুমি পুরো রাত নামায পড়ো এবং প্রতিদিন রোযা রাখো। এ সংবাদ কি সঠিক নয়? আমি বললাম: অবশ্যই। তিনি বললেন: তাহলে তুমি আর এমন করোনা। তুমি রাত্রে নামাযও পড়বে এবং ঘুমুবে। রোযা রাখবে এবং কখনো কখনো আবার রাখবেনা। কারণ, তোমার উপর তোমার শরীরেরও অধিকার আছে। তেমনিভাবে চোখ, মেহমান এবং স্ত্রীরও। হয়তোবা তুমি বেশি দিন বেঁচে থাকবে। তাই তোমার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, তুমি প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখবে। কারণ, তুমি একটি নেকি করলে দশটি নেকির সাওয়াব পাবে। এ হিসেবে প্রতি মাসে তিনটি রোযা রাখলে পুরো বছর রোযা রাখার সাওয়াব পাবে। আব্দুল্লাহ্ বলেন: আমি কঠোরতা দেখিয়েছি। তাই আমার উপর কঠিন করা হয়েছে। আমি বললাম: আমি এর চাইতেও বেশি পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি সপ্তাহে তিনটি রোযা রাখবে। আব্দুল্লাহ্ বলেন: আমি কঠোরতা দেখিয়েছি। তাই আমার উপর কঠিন করা হয়েছে। আমি বললাম: আমি এর চাইতেও বেশি পারি। তিনি বললেন: তাহলে আল্লাহ্’র নবী দাঊদ (আ.) এর ন্যায় রোযা রাখবে। আমি বললাম: দাঊদ (আ.) এর রোযা কেমন? তিনি বললেন: অর্ধ বছর। অর্থাৎ একদিন পর একদিন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আমি এর চাইতেও ভালো পারি। তিনি বললেন: এর চাইতে আর ভালো হয় না। শেষ জীবনে আব্দুল্লাহ্ বলেন: এখন তিন দিন মেনে নেয়াই আমার নিকট বেশি পছন্দনীয় যা রাসূল (সা.) বলেছিলেন আমার পরিবার, ধন-সম্পদ চাইতেও। (বুখারী, হাদীস ৬১৩৪ মুসলিম, হাদীস ১১৫৯)
অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন: রাসূল (সা.) আমাকে বলেছেন:
وَاقْرَأِ الْقُرْآنَ فِيْ كُلِّ شَهْرٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللهِ! إِنِّيْ أُطِيْقُ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ، قَالَ: فَاقْرَأْهُ فِيْ كُلِّ عِشْرِيْنَ، قَالَ: قُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللهِ! إِنِّيْ أُطِيْقُ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ، قَالَ: فَاقْرَأْهُ فِيْ كُلِّ عَشْرٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا نَبِيَّ اللهِ! إِنِّيْ أُطِيْقُ أَفْضَلَ مِنْ ذَلِكَ، قَالَ: فَاقْرَأْهُ فِيْ كُلِّ سَبْعٍ وَلاَ تَزِدْ عَلَى ذَلِكَ وَفِيْ رِوَايَةٍ: قَالَ: إِنِّيْ أَقْوَى مِنْ ذَلِكَ، قَالَ: اقْرَأْهُ فِيْ ثَلاثٍ أَوْ قَالَ: لَمْ يَفْقَهْ مَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ فِيْ أَقَلَّ مِنْ ثَلاَثٍ
‘‘তুমি প্রতি মাসে কোর’আন মাজীদ এক খতম দিবে। আব্দুল্লাহ্ বলেন: আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র নবী! আমি আরো ভালো পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি বিশ দিনে এক খতম দিবে। আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র নবী! আমি আরো ভালো পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি দশ দিনে এক খতম দিবে। আমি বললাম: হে আল্লাহ্’র নবী! আমি আরো ভালো পারি। তিনি বললেন: তাহলে প্রতি সপ্তাহে এক খতম দিবে। কিন্তু এর চাইতে আর বেশি পড়বেনা। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’আমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) বলেন: আমি এর চাইতেও বেশি পড়তে সক্ষম। তখন রাসূল (সা.) বললেন: তাহলে তুমি তিন দিনে এক খতম দিবে। ওব্যক্তি কোর’আন কিছুই বুঝেনি যে তিন দিনের কমে কোর’আন খতম করেছে’’। (মুসলিম, হাদীস ১১৫৯ আবু দাউদ, হাদীস ১৩৯০, ১৩৯১, ১৩৯৪ তিরমিযী, হাদীস ২৯৪৯ ইবনু মাজাহ্, হাদীস ১৩৬৪)
একদা সাল্মান (রা.) তাঁর আন্সারী ভাই আবুদ্দারদা’ (রা.) এর সাক্ষাতে তাঁর বাড়ি গেলেন। দেখলেন, উম্মুদ্দারদা’ (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) ময়লা কাপড় পরিহিতা। তখন তিনি তাঁকে বললেন: তুমি এমন কাপড়ে কেন? তোমার তো স্বামী আছে। তিনি বললেন: তোমার ভাই আবূদ্দারদা’র দুনিয়ার ভোগ-বিলাসের প্রতি কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ইতিমধ্যে আবূদ্দারদা’ ঘরে ফিরে সাল্মান (রা.) এর জন্য খানা প্রস্ত্তত করে বললেন: তুমি খাও। আমি এখন খাবোনা। কারণ, আমি রোযাদার। সাল্মান (রা.) বললেন: আমি খাবোনা যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি না খাবে। অতএব আবূদ্দারদা’ (রা.) খানা খেলেন। যখন রাত্র হয়ে গেল তখন আবূদ্দারদা’ (রা.) নফল নামায পড়তে গেলেন। এমন সময় সাল্মান (রা.) বললেন: ঘুমাও। তখন আবূদ্দারদা’ (রা.) ঘুমিয়ে গেলেন। অতঃপর আবারো আবূদ্দারদা’ (রা.) নফল নামায পড়তে গেলেন। এমন সময় সাল্মান (রা.) বললেন: ঘুমাও। তবে রাত্রের শেষ ভাগে সাল্মান (রা.) আবূদ্দারদা’ (রা.) কে বললেন: এখন উঠতে পারো। অতএব উভয়ে উঠে নামায পড়লেন। অতঃপর সাল্মান (রা.) আবূদ্দারদা’ (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বললেন: নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার প্রভুর অধিকার আছে। তেমনিভাবে তোমার এবং তোমার পরিবারেরও। অতএব প্রত্যেক অধিকার পাওনাদারকে তার অধিকার অবশ্যই দিতে হবে। ভোর বেলায় আবুদ্দারদা’ (রা.) নবী (সা.) কে উক্ত ঘটনা জানালে তিনি বলেন:
صَدَقَ سَلْمَانُ
‘‘সালমান (রা.) সত্যই বলেছে’’। (বুখারী, হাদীস ৬১৩৯)
আনাস্ (রা.) বলেন: একদা তিন ব্যক্তি নবী (সা.) এর স্ত্রীদের নিকট এসে তাঁর ইবাদাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তাদেরকে সে সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া হলো। তারা তা সামান্য মনে করলো এবং বললো: নবী (সা.) এর সাথে আমাদের কোন তুলনাই হয়না। তাঁর আগ-পর সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে। অতঃপর তাদের এক জন বললো: আমি কিন্তু যত দিন বেঁচে থাকবো সর্বদা পুরো রাত নফল নামায আদায় করবো। দ্বিতীয় জন বললো: আমি কিন্তু পুরো জীবন রোযা রাখবো। কখনো রোযা ছাড়বোনা। তৃতীয় জন বললো: আমি আদৌ বিবাহ করবোনা এমনকি কখনো মহিলাদের সংস্পর্শেও যাবোনা। রাসূল (সা.) কে এ সম্পর্কে জানানো হলে তিনি বলেন:
أَنْتُمُ الَّذِيْنَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا؟ أَمَا وَاللهِ إِنِّيْ لَأَخْشَاكُمْ لِلهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّيْ أَصُوْمُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّيْ وَأَرْقُدُ، وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِيْ فَلَيْسَ مِنِّيْ
‘‘তোমরাই কি এমন এমন বলেছো? জেনে রাখো, আল্লাহ্’র কসম! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের চাইতেও অনেক অনেক বেশি আল্লাহ্ তা’আলাকে ভয় করি। তবুও আমি কখনো কখনো রোযা রাখি। আবার কখনো রাখিনা। রাত্রে নফল নামাযও পড়ি। আবার ঘুমও যাই। বিবাহও করি। অতএব যে ব্যক্তি আমার আদর্শ বিমুখ হলো সে আমার উম্মত নয়’’।
(বুখারী, হাদীস ৫০৬৩ মুসলিম, হাদীস ১৪০১)
ঙ. পুণ্য ও শাস্তি:
‘‘হুলূল’’ ও ‘‘ওয়াহ্দাতুল্ উজূদ্’’ এর দর্শন অনুযায়ী মানুষতো কিছুই নয়। বরং তার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলাই অবস্থান করছেন বলে (না’ঊযু বিল্লাহ্) সে যাই করুক না কেন তা একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইচ্ছায়ই করে থাকে। মানুষের না কোন ইচ্ছা আছে না অভিরুচি। যার দরুন সূফীবাদীদের নিকট ভালো-খারাপ, হালাল-হারাম, আনুগত্য-নাফরমানি, পুণ্য ও শাস্তি বলতে কিছুই নেই। তাই তো তাদের মধ্যে রয়েছে বহু যিন্দীক্ব ও প্রচুর সমকামী। বরং তাদের কেউ কেউ তো প্রকাশ্য দিবালোকে গাধার সাথেও সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছে। আবার কেউ কেউ তো মনে করেন, তাঁদের আর শরীয়ত মানতে হবে না। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁদের জন্য সব কিছুই হালাল করে দিয়েছেন। এ কারণেই অধিকাংশ সূফীগণ জান্নাত ও জাহান্নাম নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করেছেন। বরং তাঁরা জান্নাত কামনা করাকে একজন সূফীর জন্য মারাত্মক অপরাধ মনে করেন। তাঁদের চাওয়া-পাওয়া হচ্ছে, ফানা ফিল্লাহ্, গায়েব জানা ও বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ এবং এটাই তাঁদের বানানো জান্নাত। তেমনিভাবে জাহান্নামকে ভয় পাওয়াও একজন সূফীর জন্য মারাত্মক অপরাধ। কারণ, তা গোলামের অভ্যাস ; স্বাধীন লোকের নয়। বরং তাঁদের কেউ কেউ তো দাম্ভিকতা দেখিয়ে এমনো বলেছেন যে, আমি যদি চাই জাহান্নামের জ্বলন্ত আগুনকে মুখের সামান্য থুতু দিয়েই নিভিয়ে দিতে পারি। আরেক ক্বুতুব বলেনঃ আমি যদি আল্লাহ্ তা’আলাকে লজ্জা না করতাম তা হলে মুখের সামান্য থুতু দিয়েই জাহান্নামকে জান্নাত বানিয়ে দিতাম।
নিযামুদ্দীন আওলিয়া তাঁর সংকলিত বাণী ‘‘ফাওয়ায়িদুল্ ফুওয়াদ্’’ কিতাবে বলেন:
’’কিয়ামতের দিন মা’রূফ কার্খীকে জান্নাতে যাওয়ার জন্য আদেশ করা হবে। কিন্তু তিনি তখন বলবেনঃ আমি জান্নাতে যাবো না। আপনার জান্নাতের জন্য আমি ইবাদাত করিনি। অতএব ফিরিশ্তাদেরকে আদেশ করা হবে, একে নূরের শিকলে মজবুত করে বেঁধে টেনে হেঁচড়ে জান্নাতে নিয়ে যাও’’।
বায়েযীদ বোস্তামী বলেন: জান্নাত তো বাচ্চাদের খেলনা ছাড়া আর কিছুই নয়। পাপী আবার কারা ? কার অধিকার আছে মানুষকে জাহান্নামে ঢুকাবে? (শরীয়ত ও তরীক্বত, পৃষ্ঠা: ৫০০)
রাবে’আ বস্রী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি একদা ডান হাতে পানির পেয়ালা এবং বাম হাতে আগুনের জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে বলেন: আমার ডান হাতে জান্নাত এবং বাম হাতে জাহান্নাম। অতএব আমি জান্নাতকে জাহান্নামের উপর ঢেলে দিচ্ছি। যাতে করে জান্নাতও না থাকে এবং জাহান্নামও। তাহলে মানুষ একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদাত করবে।