গান-বাজনা শোনা হারাম। আর তা হারাম হওয়ার ব্যাপারে লেশমাত্র সন্দেহ নেই। সলফে সালেহীন; সাহাবা ও তাবেঈন কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে যে, গান অন্তরে মুনাফিকী (কপটতা) উদগত করে। উপরন্ত গান শোনা-অসার বাক্য শোনা এবং তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পর্যায়ভুক্ত। আর আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“মানুষের মধ্যে কেউ কেউ এমনও রয়েছে যারা অজ্ঞতায় লোকেদেরকে আল্লাহ্র পথ হতে বিচ্যুত করার জন্য অসাড় বাক্য বেছে নেয় এবং আল্লাহ্র প্রদর্শিত পথ নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। ওদেরই জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।” (সূরা লুকমান ৬ আয়াত)
ইবনে মাসঊদ (রাঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘সেই আল্লাহ্র কসম যিনি ছাড়া কেউ সত্য উপাস্য নেই! নিশ্চয় তা (অসার বাক্য) হচ্ছে গান।’ সাহাবাগণের ব্যাখ্যা (তফসীর) এক প্রকার দলীল। তফসীরের তৃতীয় পর্যায়ে এর মান রয়েছে। যেহেতু তফসীরের তিনটি পর্যায়; কুরআনের তাফসীর কুরআন দ্বারা, কুরআনের তাফসীর সুন্নাহ দ্বারা এবং কুরআনের তাফসীর সাহাবাগণের উক্তি দ্বারা। এমনকি কিছু উলামার সিদ্ধান্ত এই যে, সাহাবীর তাফসীর রাসূল ﷺ এর তফসীরের পর্যায়ভুক্ত। কিন্তু শুদ্ধ অভিমত এই যে, তা রাসুল ﷺ এর তাফসীরের পর্যায়ভুক্ত নয়। অবশ্য তা বিভিন্ন উক্তিসমূহের মধ্যে সঠিকতার অধিকতর নিকটবর্তী।
পক্ষান্তরে গান-বাজনা শ্রবণ করার অর্থই হল, সেই কর্মে আপতিত হওয়া, যা থেকে নবী ﷺ সাবধান করেছেন। বিতি বলেন, “নিশ্চয় আমার উম্মতের মধ্যে এমন কতক সম্প্রদায় হবে যারা ব্যাভিচার, রেশম বস্ত্র, মদ্য এবং বাদ্য-যন্ত্রকে হালাল মনে করবে।” (বুখারী) অর্থাৎ, তারা নারী-পুরুষের অবৈধ যৌন সম্পর্ক, মদপান এবং রেশমের কাপড় পরাকে হালাল ও বৈধ মনে করবে অথচ তারা পুরুষ, তাঁদের জন্য রেশম বস্ত্র পরিধান বৈধ নয়। অনুরূপ মিউজিক বা বাজনা শোনাকেও বৈধ ভাববে। আর বাদ্য-যন্ত্র, যার শব্দে মন উদাস হয়, এমন অসার যন্ত্রকে বলে। হাদিসটিকে ইমাম বুখারী আবু মালেক আল আশআরী অথবা আবু আমের আল আশআরী থেকে বর্ণিত করেছেন।
সুতরাং এই কথার উপর ভিত্তি করে আমি আমার মুসলিম ভ্রাতৃবৃন্দের প্রতি গান-বাদ্য শ্রবণ করা থেকে সাবধান হওয়ার জন্য এই উপদেশবানী প্রেরণ করছি। তারা যেন এমন আলেমদের কথায় ধোঁকা না খাঁয়, যারা বাদ্য যন্ত্রকে বৈধ বলে মত প্রকাশ করেছেন। যেহেতু এর অবৈধতার সপক্ষে সমস্ত দলীল ব্যক্ত ও সুস্পষ্ট।
আর টিভি সিরিজ যাতে মহিলা প্রদর্শিত হয় তা দেখাও হারাম। যেহেতু তা ফিতনা (বিঘ্ন) এবং (অবৈধ) নারীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার দিকে ধাবিত করে। পরন্ত সমস্ত সিরিজের অধিকাংশই ক্ষতিকারক। যদিও তাতে পুরুষ নারীকে এবং নারী পুরুষকে দর্শন না করে। যেহেতু এসবের পশ্চাতে সাধারণতঃ উদ্দেশ্য থাকে সমাজেকে তার আচরণ এবং চরিত্রে ক্ষতিগ্রস্ত করা। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি যে, তিনি যেন মুসলমানদেরকে এই অনিষ্ট থেকে বাঁচান। আর আল্লহই অধিক জানেন। (ইবনে উষাইমীন)
গজলও গানের মতোই। তা অসার ও অশ্লীল না হলে এবং শিরকে ও বিদআতমুক্ত থাকলে গাওয়া এবং শোনা বৈধ। কিন্তু তাতে বাজনা বা মিউজিক থাকলে তা যতই ভাল ও তাওহীদমূলক হোক, গাওয়া ও শোনা বৈধ নয়।
বিয়ে ও ঈদ ছাড়া অন্য কোন খুশীর উপলক্ষ্যে ‘দুফ’ বাজানো বৈধ নয়। একদা কোন যুদ্ধ থেকে মহানবী ﷺ বিজয়ী হয়ে ফিরে এলে একটি কৃশকায় দাসী এসে বলল, ‘(হে আল্লাহর রাসুল!) আমি নযর মেনেছিলাম যে, আপনি ভালভাবে ফিরে এলে আমি আপনার কাছে দুফ বাজাব।’ নবী ﷺ বললেন, “তুমি যদি নযর মেনে থাকো, তাহলে তা পুরা কর। আর না মেনে থাকলে তা করো না।” সুতরাং দাসীটি দুফ বাজাতে থাকল। ইতিমধ্যে আবু বাকর এসে প্রবেশ করলেন। তখনও সে বাজাতে থাকল। অন্য কেউ এসে উপস্থিত হলেও সে বাজাতে থাকল। অবশেষে উমার প্রবেশ করলে দুফটাকে সে নিজ পেছনে লুকিয়ে কাপড়ে মুখও লুকাতে লাগল। তা দেখে আল্লাহ্র রাসুল ﷺ উমারের উদ্দেশ্যে বললেন, “শয়তানও তোমাকে ভয় পায় হে উমার!” (আহমাদ, তিরমিযী, সিঃ সহীহাহ ১৬০৯ নং)
উক্ত হাদিস থেকেও বুঝা যায় যে, বিয়ে ও ঈদ ছাড়া অন্য উপলক্ষ্যে দুফ বাজানো বৈধ নয়। অবশ্য নযর পালন করা ও সে ব্যাপারে নবী ﷺ এর অনুমতি দেওয়া এ কথার দলীল যে, এ কেবল তার ফিরে আসার জন্য নির্দিষ্ট। যেহেতু তার নিরাপদে ফিরে আসার বিষয়টি ঈদ ও বিয়ের চাইতেও বেশি খুশীর বিষয়। (আলবানী)
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “সেই কাফেলার সঙ্গে (রহমতের) ফিরিশতা থাকেন না, যাতে কুকুর কিংবা ঘুঙুর থাকে।” (মুসলিম) তিনি আরও বলেছেন, “ঘণ্টা ও ঘুঙুর শয়তানের বাঁশি।” (বুখারী ও মুসলিম)
সুতরাং অপ্রয়োজনে তা ব্যবহার করা বৈধ নয়। তবে প্রয়োজনে হারিয়ে যাবার ভয়ে পশুর গলায়, টেলিফোনের বা মোবাইলের রিং-টোনে, এলার্ম ঘড়িতে, বাড়ীর কলিং বেল ইত্যাদিতে ব্যবহার করা দূষণীয় নয়। (ইবনে জিবরীন)
প্রকাশ থাকে যে, এ সব ক্ষেত্রে মিউজিক জাতীয় কিছু ব্যবহার করা বৈধ নয়। বৈধ হল সাধারণ রিং।
উলামাগন স্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, উভয় প্রকার খেলাই হারাম। আল্লাহ তাঁদের প্রতি করুনা করুন। যেমন আমাদের শাইখ ও ওস্তাদগণ তা উল্লেখ করেছেন। এই সিদ্ধান্তের কারণ এই যে, উভয় খেলাতে মানুষের মধ্যে ঔদাস্য এবং আল্লাহ সুবানাল্লাহু তাআলার যিকর ও স্মরনে বাঁধা সৃষ্টি হয়। আবার কখন কখন উভয় খেলাই খেলোয়ারদের মধ্যে শত্রুতা ও দ্বেষের কারণ হয়। পড়ন্ত অনেক ক্ষেত্রে ঐ সব খেলাতে অর্থের বাজিও রাখা হয়। আর এ কথা বিদিত যে, প্রতিযোগীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার উপর কোন পণ বা বাজি রাখা বৈধ নয়। তবে যে প্রতিযোগিতায় বাজি রাখায় শরীয়ত অনুমতি দিয়েছে তাতে রাখা চলে এবং তা মাত্র তিনটি প্রতিযোগিতা; তীর, উট ও ঘোড়া প্রতিযোগিতা। পক্ষান্তরে যে ব্যাক্তি তাস ও দাবা খেলার খেলোয়াড়দের অবস্থা চিন্তা করে, সে বুঝতে পারে যে, তারা তাতে কত বেশী সময় নষ্ট করে; যার সমস্তই আল্লাহ্র অনুগত্যের বাইরে এবং তাঁদের নিজস্ব কোন পার্থিব উপকার লাভ ছাড়াই তা অতিবাহিত করে ফেলে।
আবারও কিছু লোক বলে থাকে যে, তাস ও দাবা খেলায় নাকি ব্রেন খুলে এবং বুদ্ধি বাড়ে। কিন্তু বাস্তবে তাঁদের দাবীর বাইরে। বরং ঐ সব খেলা ব্রেনকে ভোতা করে এবং এই প্রকার বুদ্ধিতেই ব্রেনকে সীমাবদ্ধ করে রাখে। সুতরাং যদি কেউ তার চিন্তাশক্তিকে উক্ত পদ্ধতি ছাড়া অন্যভাবে (ভিন্ন বিষয়ে) ব্যবহার করে, তবে সে কিছু ফল লাভ করতে সক্ষম হবে না।
অতএব এই কথার উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, যে খেলা ব্রেন কে ভোতা করে এবং তাঁকে এক প্রকার বুদ্ধিতেই সীমাবদ্ধ করে রাখে সেই খেলা থেকে জ্ঞানি মানুষকে দূরে থাকা অবশ্যক। (ইবনে উষাইমীন)
তর্কের উপর পণ রাখা বহু লোকের নিকট বিদআত। তা এই রূপ হয় যে, দুই ব্যক্তি কোন বিষয়ে মতভেদ করে বলে, ‘আমি যা বলছি তা যদি সত্যি হয়, তাহলে তোমাকে এই এই লাগবে।’ এবং যা লাগবে তার নাম নেয়া।(অর্থাৎ এত মিষ্টি খাওয়াতে হবে অথবা এতো পয়সা দিতে হবে ইত্যাদি বলে)। ‘আর তুমি যা বলছ তা যদি সত্য বা সঠিক হয়, তাহলে আমি এই এই দেব।’ এবং যা দেবে তার নাম নেয়। এরূপ বাজি রাখা হারাম। কারণ এ কাজ জুয়ার পর্যায়ভুক্ত, যাকে আল্লাহ তাআলা মদের পাশাপাশি উল্লেখ করে বলেছেন,
“হে ইমানদারগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণয়ক শর ঘৃন্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর। এতে তোমরা সফলকাম হতে পারবে। শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহ্র স্মরণে ও নামাযে বাঁধা দিতে চায়। অতএব তোমরা কি নিবৃত হবে? (সূরা মাইদাহ ৯১-৯১ আয়াত)”
এই ভিত্তিতে উক্ত প্রকার জুয়াবাজি অবৈধ। কিছু লোকেরা তাঁকে বৈধ বলে আর নিকৃষ্টতাকে অধিক বৃদ্ধি করে। যেহেতু সে অন্যায়কে ন্যায় সাব্যস্ত করে এবং তার আসল নাম বর্জন করে ভিন্ন নামকরণ করে। আর তার উপর বৈধতার রঙ চড়িয়ে দেয়, ফলে সে যা দাবি করে তাতে মিথ্যুক প্রমাণিত হয় এবং যা ব্যক্ত করে, তাতে সে প্রতারক প্রতীয়মান হয়।
পুরষ্কার যদি প্রতিযোগী পক্ষ ছাড়া অন্য কোন পক্ষ দেয়, তাহলে তা গ্রহণ করায় দোষ নেই। দোষ হল প্রতিযোগীদের আপসে পুরষ্কার রেখে হার-জিতে লাভ-লোকসান হলে। যেহেতু তা জুয়ার পর্যায়ভুক্ত আর মহানবী ﷺ বলেছেন, “উট ঘোড়া অথবা তীর প্রতিযোগিতা ছাড়া অন্য প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার বৈধ নয়।” (আবূ দাউদ ২৫৭৪, তরমিজি ১৭০০)
যেহেতু এ তিনটি জিনিস জিহাদে কাজে লাগে, তাই তাতে সকল প্রকার পুরষ্কার বৈধ করা হয়েছে। (ইবনে উসাইমিন)
দ্বীনী ও আর্থিক নানা ক্ষতির কারণে এ খেলা বৈধ নয়। বৈধ নয় এ খেলার কোন যন্ত্র বিক্রয় ও তার দ্বারা ব্যবসা। (ইবনে জিবরিন, লাজনাহ দায়েমাহ, বিস্তারিত দ্রঃ ফাতাওয়া উলামাইল বালাদিল হারাম ১২৬২-১২৭০ পৃঃ)
সতর ঢাকার মত লেবাস পরে কুস্তি খেলা বৈধ। খোদ নবী ﷺ কুস্তি লড়ে প্রসিদ্ধ কুস্তিগীর রুকানাকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। (আবু দাউদ ৪০৭৮, তিরমিজি ১৭৮৫, বাইহাকি ১০/১৮, গায়াতুল মারাম ৩৭৮ নং) তবে ফ্রিস্টাইল কুস্তি বৈধ নয়। কারণ তাতে শরীর চর্চার চাইতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার ইচ্ছাই বেশী থাকে।
ষাঁড়ের সাথে এ খেলা বৈধ নয়। কারণ এতে বড় বিপদ ও প্রাণহানির আশঙ্কা আছে।