সে বলল, ‘বরং তাদের এ বড়টিই একাজ করেছে। তাই এদেরকেই জিজ্ঞাসা কর, যদি এরা কথা বলতে পারে’। আল-বায়ান
সে বলল, ‘না, তাদের এই বড়টাই এ সব করেছে, তারা যদি কথা বলতে পারে তবে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর।’ তাইসিরুল
সে বললঃ সে’ই তো এটা করেছে, এইতো এদের প্রধান। এদেরকে জিজ্ঞেস কর যদি এরা কথা বলতে পারে। মুজিবুর রহমান
He said, "Rather, this - the largest of them - did it, so ask them, if they should [be able to] speak." Sahih International
৬৩. তিনি বললেন, বরং এদের এ প্রধান-ই তো এটা করেছে(১), সুতরাং এদেরকে জিজ্ঞেস কর যদি এরা কথা বলতে পারে।
(১) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তিন জায়গা ব্যতীত কোন দিন মিথ্যা কথা বলেননি। তন্মধ্যে দুটি খাস আল্লাহর জন্যে বলা হয়েছে। একটি (بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ) (বরং তাদের প্রধানই তো এটা করেছে) বলা। দ্বিতীয়টি ঈদের দিনে সম্প্রদায়ের কাছে ওযর পেশ করে (إِنِّي سَقِيمٌ) (আমি অসুস্থ) বলা এবং তৃতীয়টি স্ত্রী সারাহ সহ সফরে এক জনপদের নিকট দিয়ে গমন করেছিলেন। জনপদের প্রধান ছিল যালেম ও ব্যভিচারী। কোন ব্যক্তির সাথে তার স্ত্রীকে দেখলে সে স্বামীকে হত্যা করত ও তার স্ত্রীকে পাকড়াও করত এবং তার সাথে ব্যভিচার করত। কিন্তু কোন কন্যা পিতার সাথে কিংবা ভগিনী ভাইয়ের সাথে থাকলে সেই এরূপ করত না।
ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্ত্রীসহ এই জনপদে পৌছার খবর কেউ এই যালেম ব্যভিচারীর কাছে পৌঁছে দিলে সে সারাহকে গ্রেফতার করিয়ে আনল। গ্রেফতারকারীরা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে জিজ্ঞেস করলঃ এই মহিলা সাথে তোমার আত্মীয়তার সম্পর্ক কি? ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যালেমের কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য বলে দিলেন: সে আমার ভগিনী। (এটা হাদীসে বর্ণিত তৃতীয় মিথ্যা)। [বুখারীঃ ৩১৭৯, ৪৪৩৫। মুসলিমঃ ২৩৭১]
এই হাদীসে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দিকে পরিষ্কারভাবে তিনটি মিথ্যার সম্বন্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোন কোন আলেমের ব্যাখ্যা হলো যে, তিনটির মধ্যে একটিও সত্যিকার অর্থে মিথ্যা ছিল না। বরং এটা ছিল অলংকার শাস্ত্রের পরিভাষায় “তাওরিয়া”। এর অর্থ দ্ব্যৰ্থবোধক ভাষা ব্যবহার করা এবং শ্ৰোতা কর্তৃক এক অর্থ বোঝা ও বক্তার নিয়তে অন্য অর্থ থাকা। যুলুম থেকে আত্মরক্ষার জন্যে ফিকাহবিদগণের সর্বসম্মত মতে এই কৌশল অবলম্বন করা জায়েয ও হালাল। এটা মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত নয়। উল্লেখিত হাদীসে এর প্রমাণ এই যে, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজেই সারাহকে বলেছিলেন আমি তোমাকে ভগিনী বলেছি। তোমাকে জিজ্ঞেস করা হলে তুমি ও আমাকে ভাই বলো। ভগিনী বলার কারণও তিনি বলে দিয়েছেন যে আমরা উভয় ইসলামী সম্পর্কের দিক দিয়ে ভ্রাতা-ভগিনী। বলাবাহুল্য এটাই “তাওরিয়া”।
হুবহু এমনি ধরনের কারণ প্রথমোক্ত দুই জায়গায় বলা যায় যে, অসুস্থ শব্দটি যেমন শারীরিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়, তেমনি মানসিক অসুস্থতা অর্থাৎ চিন্তান্বিত ও অবসাদগ্ৰস্ত হওয়ার অর্থেও ব্যবহৃত হয়। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম দ্বিতীয় অর্থেই “আমি অসুস্থ” বলেছিলেন, কিন্তু শ্রোতারা একে শারীরিক অসুস্থতার অর্থে বোঝেছিলেন। মূর্তি ভাঙ্গার কাজটিতে তিনি যে ভাঙ্গার কাজটি বড় মূর্তির দিকে সম্পর্কযুক্ত করেছিলেন এ ব্যাপারে আলেমগণ নানা সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন:
১. ইবরাহীম আলাইহিস সালামের এ উক্তি ধরে নেয়ার পর্যায়ে ছিল; অথাৎ তোমরা একথা ধরেই নাও না কেন যে, একাজ প্রধান মুর্তিই করে থাকবে। ধরে নেয়ার পর্যায়ে বাস্তববিরোধী কথা বলা মিথ্যার আওতায় পড়ে না। [ফাতহুল কাদীর]
২. কোন কোন মুফাসসিরের মতে, মূলতঃ প্রধান মূর্তিটি ইইবরাহীম আলাইহিস সালামকে একাজ করতে উদ্ধৃদ্ধ করেছিল। তার সম্প্রদায় এই মুর্তির প্রতি সর্বাধিক সম্মান প্রদর্শন করত। সম্ভবত এ কারণেই বিশেষভাবে এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর]
তবে এ ব্যাপারে আলেমগণ একমত যে, নবী-রাসূলগণ কখনো নবুওয়ত ও তাবলীগ বা প্রচার-প্রসার সংক্রান্ত ব্যাপারে মিথ্যার আশ্রয় নেননি। তারা জগতশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী লোক ছিলেন। [ইবন তাইমিয়্যাহ, আল-জাওয়াবুস সহীহ ১/৪৪৬]
তাফসীরে জাকারিয়া(৬৩) সে বলল, ‘বরং ওদের মধ্যে এই বড়টিই এরূপ করেছে। সুতরাং তোমরা ওদেরকেই জিজ্ঞেস কর; যদি ওরা কথা বলতে পারে।’ [1]
[1] সুতরাং ইবরাহীম (আঃ)-কে জনসমক্ষে আনা হল এবং জিজ্ঞাসা করা হল। ইবরাহীম (আঃ) উত্তর দিলেন যে, এ কাজ তো বড় মূর্তিটিই করেছে। যদি এই ভাঙ্গা মূর্তিগুলো কথা বলতে পারে, তাহলে এদেরকেই জিজ্ঞেস কর। তাদের জন্য এ বক্রোক্তি আভাসে তিরস্কারস্বরূপ ব্যবহার করেছিলেন, যাতে তারা জানতে পারে যে, যারা কথা বলার ক্ষমতা রাখে না, বা কোন জিনিস সম্পর্কে কোন খবর রাখে না, তারা মাবূদ হতে পারে না; তাদেরকে সঠিক অর্থে ‘উপাস্য’ বলাই সঠিক নয়।। একটি সহীহ হাদীসে ইবরাহীম (আঃ)-এর ‘বরং ওদের মধ্যে এই বড়টিই এরূপ করেছে’ উক্তিটিকে তাঁর মিথ্যা বলে বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি তিনটি মিথ্যা বলেছিলেন; দু’টি আল্লাহর জন্য এবং একটি নিজের জন্য। প্রথমঃ তাঁর কথা, আমি অসুস্থ। (অথচ তিনি অসুস্থ ছিলেন না।) দ্বিতীয়ঃ ‘বরং ওদের মধ্যে এই বড়টিই এরূপ করেছে।’ আর তৃতীয়ঃ আপন স্ত্রী সারাকে বোন বলা। (সহীহ বুখারী, আম্বিয়া অধ্যায়) সম্প্রতিকালের কিছু ব্যাখ্যাকারিগণ এই সহীহ হাদীসটিকে কুরআন-বিরোধী মনে করে অস্বীকার করেছেন এবং সহীহ মানার ব্যাপারে তাকীদ করলে তাঁরা সেটাকে অতিরঞ্জন ও বর্ণনার উপর অন্ধবিশ্বাস বলে মনে করেন। কিন্তু তাদের এ অভিমত সঠিক নয়।
নিঃসন্দেহে বাস্তবিকতার দিক দিয়ে এগুলিকে যেরূপ মিথ্যা বলা যায় না, ঠিক অনুরূপই বাহ্যিকভাবে এগুলিকে মিথ্যা থেকে খারিজ করাও যায় না। কারণ এগুলি আল্লাহর জন্যই বলা হয়েছিল। আর কোন পাপ কাজ আল্লাহর জন্য হতে পারে না। অবশ্য এটা তখনই সম্ভব যখন এগুলি বাহ্যিক দৃষ্টিতে মিথ্যা হলেও প্রকৃতপক্ষে মিথ্যা নয় বলে মেনে নেওয়া যায়। যেমন আদম (আঃ)-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, ‘আদম তার প্রতিপালকের অবাধ্য হল; ফলে সে পথভ্রষ্ট হয়ে গেল।’ অথচ তাঁর নিষিদ্ধ গাছ খাওয়ার কাজকে তাঁর ভুলে যাওয়া বা ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতার পরিণতিও বলা হয়েছে। যার পরিষ্কার অর্থ হল, প্রত্যেক কাজের দু’টি দিক থাকতে পারে; একদিক ভালো এবং অপরদিক মন্দ। ইবরাহীম (আঃ)-এর উক্ত কথাগুলি একদিক দিয়ে বাহ্যিকরূপে মিথ্যা ছিল। কারণ তা ছিল বাস্তব ও সত্যের বিপরীত। মূর্তিগুলি তিনি নিজেই ভেঙ্গেছিলেন, কিন্তু ভাঙ্গার সম্পর্ক বড় মূর্তিটির দিকে জুড়লেন। কিন্তু যেহেতু তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, (এই কাজের মাধ্যমে তাদেরকে জ্ঞান দেওয়া,) তাদেরকে তিরস্কার করা এবং তওহীদ সাব্যস্ত করা, সেহেতু বাস্তবতার দিক দিয়ে আমরা তা মিথ্যা না বলে, প্রমাণের পূর্ণতা দানের একটি কৌশল এবং মুশরিকদের মূর্খতা প্রতিপাদন ও প্রকাশ করার একটি যুক্তিময় পদ্ধতি বলব। এ ছাড়া হাদীসের মধ্যে এসব উক্তিকে মিথ্যা বলে আখ্যায়ন যে পরিস্থিতিতে করা হয়েছে তাও বিবেচ্য। আর তা হল হাশরের ময়দানে মহান আল্লাহর সামনে সুপারিশ করা হতে নিজেকে দূরে রাখা। যেহেতু পার্থিব জীবনে তিন জায়গায় তার ত্রুটি হয়ে গিয়েছিল। যদিও লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বাস্তবতার দিক দিয়ে তা মিথ্যা (ত্রুটি) নয়। কিন্তু তিনি আল্লাহর মাহাত্ম্য ও প্রতাপের জন্য এত ভীত হবেন যে, এ কথাগুলির মিথ্যার সাথে বাহ্যিক সাদৃশ্য থাকার কারণে পাকড়াও যোগ্য মনে করবেন। অতএব হাদীসের উদ্দেশ্য ইবরাহীম (আঃ)-কে মিথ্যা সাব্যস্ত করা কখনই নয়; বরং উদ্দেশ্য হল, ঐ অবস্থার বিবরণ, যা কিয়ামতের দিন আল্লাহর ভয়ে তাঁর ঘটবে।