তাদের পরে আসল এমন এক অসৎ বংশধর যারা সালাত বিনষ্ট করল এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করল। সুতরাং শীঘ্রই তারা জাহান্নামের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। আল-বায়ান
অতঃপর তাদের পর এল অপদার্থ পরবর্তীরা, তারা নামায হারালো, আর লালসার বশবর্তী হল। তারা অচিরেই ধ্বংসের সম্মুখীন হবে। তাইসিরুল
তাদের পরে এলো অপদার্থ পরবর্তীরা; তারা সালাত নষ্ট করল ও লালসা পরবশ হল; সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি প্রত্যক্ষ করবে। মুজিবুর রহমান
But there came after them successors who neglected prayer and pursued desires; so they are going to meet evil - Sahih International
৫৯. তাদের পরে আসল অযোগ্য উত্তরসূরীরা(১), তারা সালাত নষ্ট করল(২) এবং কুপ্রবৃত্তির(৩) অনুবর্তী হল। কাজেই অচিরেই তারা ক্ষতিগ্রস্ততার(৪) সম্মুখীন হবে।
(১) خلف শব্দে লামের সাকিন যোগে এ শব্দটির অর্থ মন্দ উত্তরসূরী, মন্দ সন্তান-সন্ততি এবং লামের যাবর যোগে এর অর্থ হয় উত্তম উত্তরসূরী এবং উত্তম সন্তান-সন্ততি। এখানে সাকিনযুক্ত হওয়ায় এর অর্থ হচ্ছে: খারাপ উত্তরসূরী। [ফাতহুল কাদীর] এদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ষাট বছরের পর থেকে খারাপ উত্তরসূরীদের আবির্ভাব হবে, যারা সালাত বিনষ্ট করবে, প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে, তারা অচিরেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জাহান্নামে নিপতিত হবে। তারপর এমন কিছু উত্তরসূরী আসবে যারা কুরআন পড়বে অথচ তা তাদের কণ্ঠনালীর নিম্নভাগে যাবে না। আর কুরআন পাঠকারীরা তিন শ্রেণীর হবে: মুমিন, মুনাফিক এবং পাপিষ্ঠ। বর্ণনাকারী বশীর বলেনঃ আমি ওয়ালিদকে এ তিন শ্রেণী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেনঃ কুরআন পাঠকারী হবে অথচ সে এর উপর কুফরকারী, পাপিষ্ঠ কুরআন পাঠ্যকারী হবে যে এর দ্বারা নিজের রুটি-রোজগারের ব্যবস্থা করবে। আর ঈমানদার কুরআন পাঠ্যকারী হবে যে এর উপর ঈমান আনবে। [মুসনাদে আহমাদ: ৩/৩৮, সহীহ ইবন হিব্বান: ৩/৩২, ৭৫৫]
(২) মুজাহিদ বলেনঃ কেয়ামতের নিকটবর্তী সময়ে যখন সৎকর্মপরায়ণ লোকদের অস্তিত্ব থাকবে না, তখন এরূপ ঘটনা ঘটবে। তখন সালাতের প্রতি কেউ ক্ৰক্ষেপ করবে না এবং প্রকাশ্যে পাপাচার অনুষ্ঠিত হবে। এ আয়াতে “সালাত নষ্ট করা” বলে বিশিষ্ট তফসীরবিদদের মতে, অসময়ে সালাত পড়া বোঝানো হয়েছে। কেউ কেউ বলেনঃ সময়সহ সালাতের আদব ও শর্তসমূহের মধ্যে কোনটিতে ত্রুটি করা সালাত নষ্ট করার শামিল, আবার কারও কারও মতে ‘সালাত নষ্ট করা’ বলে জামা'আত ছাড়া নিজে গৃহে সালাত পড়া বোঝানো হয়েছে। [ইবন কাসীর]
খলীফা ওমর ফারুক রাদিয়াল্লাহু আনহু সকল সরকারী কর্মচারীদের কাছে এই নির্দেশনামা লিখে প্রেরণ করেছিলেনঃ আমার কাছে তোমাদের সব কাজের মধ্যে সালাত সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অতএব যে ব্যক্তি সালাত নষ্ট করে সে দ্বীনের অন্যান্য বিধি-বিধান আরও বেশী নষ্ট করবে। [মুয়াত্তা মালেকঃ ৬]
তদ্রুপ হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে দেখলেন যে, সে সালাতের আদব ও রোকন ঠিকমত পালন করছে না। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কবে থেকে এভাবে সালাত আদায় করছ? লোকটি বললঃ চল্লিশ বছর ধরে। হুযায়ফা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেনঃ তুমি একটি সালাতও পড়নি। যদি এ ধরনের সালাত পড়েই তুমি মারা যাও, তবে মনে রেখো মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত আদর্শের বিপরীতে তোমার মৃত্যু হবে।” [নাসায়ীঃ ৩/৫৮, সহীহ ইবন হিব্বানঃ ১৮৯৪]
অনুরূপভাবে অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ ঐ ব্যক্তির সালাত হয় না, যে সালাতে ‘একামত’ করে না। অর্থাৎ যে ব্যক্তি রুকু ও সেজদায়, রুকু থেকে দাঁড়িয়ে অথবা দুই সেজদার মধ্যস্থলে সোজা দাঁড়ানো অথবা সোজা হয়ে বসাকে গুরুত্ব দেয় না, তার সালাত হয় না। [তিরমিযীঃ ২৬৫]
মোটকথাঃ সালাত আদায় ত্যাগ করা অথবা সালাত থেকে গাফেল ও বেপরোয়া হয়ে যাওয়া প্রত্যেক উম্মতের পতন ও ধ্বংসের প্রথম পদক্ষেপ। সালাত আল্লাহর সাথে মুমিনের প্রথম ও প্রধানতম জীবন্ত ও কার্যকর সম্পর্ক জুড়ে রাখে। এ সম্পর্ক তাকে আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের কেন্দ্রবিন্দু থেকে বিচ্যুত হতে দেয় না। এ বাঁধন ছিন্ন হবার সাথে সাথেই মানুষ আল্লাহ থেকে দূরে বহুদূরে চলে যায়। এমনকি কার্যকর সম্পর্ক খতম হয়ে গিয়ে মানসিক সম্পর্কেরও অবসান ঘটে। তাই আল্লাহ একটি সাধারণ নিয়ম হিসেবে এখানে একথাটি বর্ণনা করেছেন যে, পূর্ববর্তী সকল উম্মতের বিকৃতি শুরু হয়েছে সালাত নষ্ট করার পর। হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বান্দা ও শির্কের মধ্যে সীমারেখা হলো সালাত ছেড়ে দেয়া। [ মুসলিম: ৮২] আরও বলেছেনঃ “আমাদের এবং কাফেরদের মধ্যে একমাত্র সালাতই হচ্ছে পার্থক্যকারী বিষয়, (তাদের কাছ থেকে এরই অঙ্গীকার নিতে হবে) সুতরাং যে কেউ সালাত পরিত্যাগ করল সে কুফরী করল।” [তিরমিযী: ২৬২১]
(৩) ‘কুপ্রবৃত্তি’ বলতে বুঝায় এমন কাজ যা মানুষের মন চায়, মনের ইচ্ছানুরূপ হয় এবং যা থেকে সে তাকওয়া অবলম্বন করে না। যেমন হাদীসে এসেছে, “জান্নাত ঘিরে আছে অপছন্দনীয় বিষয়াদিতে, আর জাহান্নাম ঘিরে আছে কুপ্রবৃত্তির চাহিদায়” [মুসলিম: ২৮২২] অনুরূপভাবে এখানেও ‘কুপ্রবৃত্তি’ বলে দুনিয়ার সেসব আকর্ষণকে বোঝানো হয়েছে, যেগুলো মানুষকে আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে গাফেল করে দেয়। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ বিলাসবহুল গৃহ নির্মাণ, পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণকারী যানবাহনে আরোহণ এবং সাধারণ লোকদের থেকে স্বাতন্ত্র্যমূলক পোশাক আয়াতে উল্লেখিত কুপ্রবৃত্তির অন্তর্ভুক্ত। [কুরতুবী]
(৪) আরবী ভাষায় غي শব্দটি رشد এর বিপরীত। প্রত্যেক কল্যাণকর বিষয়কে رشد বলা হয়। অপরদিকে প্রত্যেক অকল্যাণকর ও ক্ষতিকর বিষয়কে غي বলা হয়। [ফাতহুল কাদীর] আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বলেনঃ ‘গাই’ জাহান্নামের এমন একটি গর্তের নাম যাতে সমগ্ৰ জাহান্নামের চাইতে অধিক আযাবের সমাবেশ রয়েছে। ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেনঃ ‘গাই’ জাহান্নামের এমন একটি গুহা জাহান্নামও এর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে। [দেখুন, কুরতুবী; ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৫৯) তাদের পর এল অপদার্থ পরবর্তিগণ, তারা নামায নষ্ট করল ও প্রবৃত্তিপরায়ণ হল; সুতরাং তারা অচিরেই অমঙ্গল প্রত্যক্ষ করবে। [1]
[1] আল্লাহর পুরস্কারপ্রাপ্ত বান্দাদের বর্ণনার পর ঐ সমস্ত লোকেদের কথা বর্ণনা করা হচ্ছে যারা এর বিপরীত আল্লাহর আদেশের অন্যথাচরণ করে ও বিমুখতা অবলম্বন করে। নামায বিনষ্ট করার অর্থ একেবারে নামায না পড়া; যা মূলতঃ কুফরী, অথবা নামাযের সময় বিনষ্ট করা; যার অর্থ সঠিক সময়ে নামায আদায় না করা, যখন ইচ্ছা পড়া বা বিনা ওযরে দুই বা ততোধিক নামাযকে একত্রে পড়া, অথবা কখনো দুই, কখনো চার, কখনো এক, কখনো পাঁচ অক্তের নামায পড়া। এ সমস্ত নামায বিনষ্ট করার অর্থে শামিল। এ রকম ব্যক্তি অত্যন্ত পাপী এবং আয়াতে বর্ণিত শাস্তির যোগ্য। غَي এর অর্থ ধ্বংস, অমঙ্গল, অশুভ পরিণাম বা জাহান্নামের একটি উপত্যকার নাম।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান