লগইন করুন
৬ সূরাঃ আল-আন'আম | Al-An'am | سورة الأنعام - আয়াত নং - ১০৩ - মাক্কী
চক্ষুসমূহ তাকে আয়ত্ব করতে পারে না। আর তিনি চক্ষুসমূহকে আয়ত্ব করেন। আর তিনি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত। আল-বায়ান
দৃষ্টি তার নাগাল পায় না বরং তিনিই সকল দৃষ্টি নাগালে রাখেন, তিনি অতিশয় সূক্ষ্ণদর্শী, সব বিষয়ে ওয়াকিফহাল। তাইসিরুল
কোন মানব-দৃষ্টি তাঁকে দেখতে পারেনা, অথচ তিনি সকল কিছুই দেখতে পান এবং তিনি অতীব সূক্ষ্মদর্শী এবং সর্ব বিষয়ে ওয়াকিফহাল। মুজিবুর রহমান
Vision perceives Him not, but He perceives [all] vision; and He is the Subtle, the Acquainted. Sahih International
১০৩. দৃষ্টিসমূহ তাঁকে আয়ত্ব করতে পারে না(১), অথচ তিনি সকল দৃষ্টিকে আয়ত্ব করেন(২) এবং তিনি সূক্ষ্মদশী, সম্যক অবহিত।(৩)
(১) আলোচ্য আয়াতে أبصار শব্দটি بصر এর বহুবচন। এর অর্থ দৃষ্টি এবং দৃষ্টিশক্তি। إدراك শব্দের অর্থ পাওয়া, ধরা, বেষ্টন করা। [ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এস্থলে إدراك শব্দের অর্থ বেষ্টন করা বর্ণনা করেছেন। এতে আয়াতের অর্থ হয় এই যে, জীন, মানব, ফিরিশতা ও যাবতীয় জীব-জন্তুর দৃষ্টি একত্রিত হয়েও আল্লাহর সত্তাকে বেষ্টন করে দেখতে পারে না। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ তা'আলা সমগ্র সৃষ্টজীবের দৃষ্টিকে পূর্ণরূপে দেখেন এবং সবাইকে বেষ্টন করে দেখেন। এ সংক্ষিপ্ত আয়াতে আল্লাহ তা'আলার দুটি বিশেষ গুণ বর্ণিত হয়েছে। (এক) সমগ্র সৃষ্ট জগতে কারও দৃষ্টি বরং সবার দৃষ্টি একত্রিত হয়েও তাঁর সত্তাকে বেষ্টন করতে পারে না। (দুই) তার দৃষ্টি সমগ্র সৃষ্টিজগতকে পরিবেষ্টনকারী জগতের অণু-কণা পরিমাণ বস্তুও তার দৃষ্টির অন্তরালে নয়। সর্বাবস্থায় এ জ্ঞান এবং জ্ঞানগত পরিবেষ্টনও আল্লাহ তা'আলারই বৈশিষ্ট। তাকে ছাড়া কোন সৃষ্ট বস্তুর পক্ষে সমগ্র সৃষ্টজগত ও তার অণু-পরমাণুর এরূপ জ্ঞান লাভ কখনো হয়নি এবং হতে পারেও না। কেননা, এটা আল্লাহ্ তা'আলার বিশেষ গুণ।
(২) মানুষ আল্লাহ্ তা'আলাকে দেখতে পাবে কিনা। এ মাস’আলার দুটি দিক আছেঃ দুনিয়াতে তাঁকে কেউ দেখা সম্ভব কিনা? এ মাস’আলারও দুটি দিক রয়েছে, একঃ তাকে স্বপ্নে দেখা। এ ধরণের দেখা সম্ভব বলেই অনেকে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তারা তাদের মতের স্বপক্ষে দলীল হিসাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আল্লাহকে দেখার উপর বর্ণিত বিভিন্ন হাদীস উল্লেখ করেন। দুই. দুনিয়াতে সরাসরি চোখ দ্বারা আল্লাহকে দেখা। দুনিয়াতে এ ধরণের দেখা কখনই সম্ভব নয়। এর দলীল হলোঃ মুসা আলাইহিস সালাম আল্লাহকে দেখতে চেয়ে বলেছিলেনঃ (رَبِّ أَرِنِي) “হে রব! আমাকে দেখা দিন", তখন উত্তরে বলা হয়েছিলঃ (لَنْ تَرَانِي) আপনি আমাকে দেখতে পাবেন না। [সূরা আল-আরাফ: ১৪৩]
আল্লাহর নবী হয়েও যখন মূসা আলাইহিস সালাম এ উত্তর পেয়েছিলেন, তখন অন্য কোন জ্বিন ও মানুষের সাধ্য কি যে দুনিয়ার এ চোখ দিয়ে আল্লাহকে দেখবে! আখেরাতে ঈমানদারগণ আল্লাহ্ তা'আলাকে দেখতে পাবে। আখেরাতে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ তা'আলার সাক্ষাত ঘটবে- হাশরে অবস্থানকালেও এবং জান্নাতে পৌছার পরও। এটাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা ও বিশ্বাস। এর সপক্ষে দলীল প্রমাণাদি অনেক, নীচে তার কিছু উল্লেখ করা হলোঃ
কুরআন থেকেঃ
আল্লাহর বাণীঃ (وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ ٭ إِلَىٰ رَبِّهَا نَاظِرَةٌ) “সেদিন কিছু চেহারা হবে সজীব ও প্রফুল্ল। তারা স্বীয় রবকে দেখতে থাকবে। [সূরা আল-কিয়ামাহঃ ২২-২৩]
আল্লাহর বাণীঃ (لَهُمْ مَا يَشَاءُونَ فِيهَا وَلَدَيْنَا مَزِيدٌ) “তারা তাতে যা চাইবে তাই পাবে, আর আমাদের কাছে আছে আরো কিছু বাড়তি। [সূরা ক্বাফঃ ৩৫]। এ আয়াতের তাফসীরে আলী ও আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেনঃ বাড়তি বিষয় হলোঃ আল্লাহর চেহারার দিকে তাকানোর সৌভাগ্য’।
আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনের অন্যত্র বলেছেনঃ (كَلَّا إِنَّهُمْ عَنْ رَبِّهِمْ يَوْمَئِذٍ لَمَحْجُوبُونَ) “কাফেররা সেদিন স্বীয় রব-এর সাক্ষাত থেকে বঞ্চিত থাকবে। [সূরা আল-মুতাফফেফীনঃ ১৫]। এর দ্বারা কাফের ও অবিশ্বাসীরা সেদিনও সাজা হিসেবে আল্লাহকে দেখার গৌরব থেকে বঞ্চিত থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ আয়াতের দ্বারা এটা স্পষ্ট হলো যে, যারা ঈমানদার তাদের এ শাস্তি হবে না। অর্থাৎ তারা আল্লাহকে দেখতে পাবে।
আল্লাহর বাণীঃ (لِلَّذِينَ أَحْسَنُوا الْحُسْنَىٰ وَزِيَادَةٌ) “যারা সৎ কাজ করেছে তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত, তদুপরি তার উপর রয়েছে কিছু বাড়তি”। [সূরা ইউনুসঃ ২৬]। এ আয়াতের তাফসীরে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সরাসরি আল্লাহকে দেখা বলে সহীহভাবে বর্ণিত হয়েছে। যার আলোচনা পরবর্তী বর্ণনায় হাদীস থেকে আসছে।
সহীহ হাদীস থেকেঃ
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে ঈমানদারদের জন্য আল্লাহ্ তা'আলাকে দেখার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, সে সমস্ত হাদীস মুতাওয়াতির পর্যায়ে পৌছেছে। ইমাম দারকুতনী এ সংক্রান্ত বিশটির মত হাদীস বর্ণনা করেছেন। অনুরূপভাবে ইমাম আবুল কাসেম লালাকা’য়ী ত্রিশটির মত হাদীস বর্ণনা করেছেন। নীচে এর কয়েকটি উল্লেখ করা হলোঃ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, 'জান্নাতীরা জান্নাতে প্রবেশ করার পর আল্লাহ্ বলবেনঃ তোমরা যেসব নেয়ামত প্রাপ্ত হয়েছ, এগুলোর চাইতে বৃহৎ আরো কোন নেয়ামতের প্রয়োজন হলে বল, আমি তাও দেব। জান্নাতীরা নিবেদন করবেঃ ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন এবং জান্নাতে স্থান দিয়েছেন। এর বেশী আমরা আর কি চাইব। তখন মধ্যবর্তী পর্দা সরিয়ে নেয়া হবে এবং সবার সাথে আল্লাহর সাক্ষাত হবে। এটিই হবে জান্নাতের সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত'। [সহীহ মুসলিমঃ ১৮১] জান্নাতীদের জন্য আল্লাহর সাক্ষাতই হবে সর্ববৃহৎ নেয়ামত।
অন্য এক হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক চন্দ্রালোকিত রাতে সাহাবীদের সমভিব্যাহারে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি চাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেনঃ তোমরা স্বীয় রবকে এ চাঁদের ন্যায় চাক্ষুষ দেখতে পাবে’৷ [বুখারীঃ ৫৫৪, ৭৪৩৫, ৭৪৩৭] বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, ইবন আবিল ইয আল-হানাফী, শারহুল আকীদাতিত তাহাভীয়্যা।
(৩) আরবী অভিধানে لطيف শব্দটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়ঃ (এক) দয়ালু, (দুই) সূক্ষ্ম বস্তু যা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা বা জানা যায় না। خبير শব্দের অর্থ খবর রাখে। এখানে অর্থ হবে- তিনি খবর রাখেন। সমগ্র সৃষ্টিজগতের কণা পরিমাণ বস্তুও তার জ্ঞান ও খবরের বাইরে নয়। এখানে لطيف শব্দের অর্থ দয়ালু নেয়া হলে আলোচ্য বাক্যে এদিকে ইঙ্গিত হবে যে, তিনি যদিও আমাদের প্রত্যেক কথা ও কাজের খবর রাখেন এবং এজন্যে আমাদের গোনাহর কারণে আমাদেরকে পাকড়াও করতে পারেন, কিন্তু যেহেতু তিনি দয়ালুও, তাই সব গোনাহর কারণেই পাকড়াও করেন না। [সিফাতুল্লাহিল ওয়ারিদা ফিল কিতাবি ওয়াসসুন্নাতি]
তাফসীরে জাকারিয়া(১০৩) দৃষ্টিসমূহ তাঁকে আয়ত্ব করতে পারে না,[1] কিন্তু দৃষ্টিসমূহ তাঁর আয়ত্বে আছে এবং তিনিই সূক্ষ¹দর্শী; সম্যক পরিজ্ঞাত।
[1] أَبْصَارٌ হল بَصَرٌ (দৃষ্টি)এর বহুবচন। অর্থাৎ, মানুষ আল্লাহর প্রকৃতত্বের গভীরে পৌঁছতে পারে না। আর যদি এর অর্থ হয় চোখে দেখা, তাহলে এর সম্পর্ক হবে দুনিয়ার সাথে। অর্থাৎ, দুনিয়ার চোখে কেউ আল্লাহকে দেখতে পারবে না। তবে শুদ্ধ এবং বহুধা সূত্রে বর্ণিত বহু হাদীস দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে, কিয়ামতের দিন ঈমানদাররা মহান আল্লাহকে দেখবে এবং জান্নাতেও তাঁর দর্শনলাভে ধন্য হবে। কাজেই মু’তাযিলাদের এই আয়াতকে দলীল বানিয়ে এ কথা বলা সঠিক নয় যে, আল্লাহ তাআলাকে কেউ দেখতেই পাবে না; না দুনিয়াতে, আর না আখেরাতে। কেননা, এই (না দেখার) সম্পর্ক দুনিয়ার সাথে। এই জন্যই আয়েশা (রাঃ) এই আয়াতের ভিত্তিতেই বলতেন, যে ব্যক্তিই এ দাবী উত্থাপন করবে যে, নবী করীম (সাঃ) (মি’রাজ রজনীতে) আল্লাহকে দেখেছেন, সে ডাঁহা মিথ্যাবাদী। (বুখারী, তাফসীর সূরা আনআম) কারণ, এই আয়াতের ভিত্তিতে নবীরা সহ কেউই ইহলোকে আল্লাহকে দেখতে সক্ষম নয়। অবশ্য পারলৌকিক জীবনে এ দর্শন সম্ভব হবে। যেমন, অন্যত্রও কুরআন এ কথা সাব্যস্ত করেছে। {وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ نَاضِرَةٌ* إِلَى رَبِّهَا نَاظِرَةٌ} ‘‘সেদিন অনেক মুখমন্ডল উজ্জ্বল হবে। তারা তাদের পালনকর্তার দিকে তাকিয়ে থাকবে।’’ (সূরা ক্বিয়ামাহ ২২-২৩)
তাফসীরে আহসানুল বায়ান