লগইন করুন
১৭ সূরাঃ আল-ইসরা (বনী-ইসরাঈল) | Al-Isra | سورة الإسراء - আয়াত নং - ১ - মাক্কী
পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন আল মাসজিদুল হারাম থেকে আল মাসজিদুল আকসা* পর্যন্ত, যার আশপাশে আমি বরকত দিয়েছি, যেন আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাতে পারি। তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। আল-বায়ান
পবিত্র ও মহীয়ান তিনি যিনি তাঁর বান্দাহকে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারপাশকে আমি কল্যাণময় করেছি। তাকে আমার নিদর্শনাবলী দেখানোর জন্য, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। তাইসিরুল
পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মাসজিদুল হারাম হতে মাসজিদুল আকসায়, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বারাকাতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। মুজিবুর রহমান
Exalted is He who took His Servant by night from al-Masjid al-Haram to al-Masjid al-Aqsa, whose surroundings We have blessed, to show him of Our signs. Indeed, He is the Hearing, the Seeing. Sahih International
* ফিলিস্তীনে অবস্থিত বাইতুল মাকদিস, যা মুসলমানদের প্রথম কিবলা ছিল।
১. পবিত্ৰ মহিমাময় তিনি(১), যিনি তাঁর বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করালেন (২) আল-মসজিদুল হারাম (৩) থেকে আল-মসজিদুল আকসা পর্যন্ত (৪) যার আশপাশে আমরা দিয়েছি বরকত, যেন আমরা তাকে আমাদের নিদর্শন দেখাতে পারি (৫); তিনিই সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা (৬)
(১) سبحان শব্দটি মূলধাতু। এর অর্থ, যাবতীয় ত্রুটি ও দোষ থেকে পবিত্র ও মুক্ত। আয়াতে এর ব্যবহারিক অর্থ হচ্ছে, আমি তাঁকে পবিত্র ও মুক্ত ঘোষণা করছি। [ফাতহুল কাদীর]
(২) মূলে أسرى শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যার আভিধানিক অর্থ রাত্রে নিয়ে যাওয়া। এরপর ليلاً শব্দটি স্পষ্টতঃ এ অর্থ ফুটিয়ে তুলেছে। ليلاً শব্দটি نكره ব্যবহার করে এদিকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, সমগ্র ঘটনায় সম্পূর্ণ রাত্রি নয়; বরং রাত্রির একটা অংশ ব্যয়িত হয়েছে। [ফাতহুল কাদীর] আয়াতে উল্লেখিত মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত সফরকে “ইসরা” বলা হয় এবং সেখান থেকে আসমান পর্যন্ত যে সফর হয়েছে, তার নাম মে'রাজ। ইসরা অকাট্য আয়াত দ্বারা প্ৰমাণিত হয়েছে। আর মে'রাজ সূরা নাজমে উল্লেখিত রয়েছে এবং অনেক মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মান ও গৌরবের স্তরে بعبده শব্দটি একটি বিশেষ ভালবাসার প্রতি ইঙ্গিত বহন করে। কেননা, আল্লাহ্ তাআলা স্বয়ং কাউকে ‘আমার বান্দা’ বললে এর চাইতে বড় সম্মান মানুষের জন্যে আর হতে পারে না। [ইবন তাইমিয়্যাহ, আল-উবুদিয়্যাহঃ ৪৭]
(৩) আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলামঃ বিশ্বের সর্বপ্রথম মসজিদ কোনটি? তিনি বললেনঃ মসজিদে-হারাম। অতঃপর আমি আরয করলামঃ এরপর কোনটি? তিনি বললেনঃ মসজিদে আকসা। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ এতদুভয়ের নির্মাণের মধ্যে কতদিনের ব্যবধান রয়েছে? তিনি বললেনঃ চল্লিশ বছর। তিনি আরও বললেনঃ এ তো হচ্ছে মসজিদদ্বয়ের নির্মাণক্রম। কিন্তু আল্লাহ্ তাআলা আমাদের জন্য সমগ্ৰ ভূ-পৃষ্ঠকেই মসজিদ করে দিয়েছেন। যেখানে নামাযের সময় হয়, সেখানেই সালাত পড়ে নাও। [মুসলিমঃ ৫২০]
(৪) ইসরা ও মে'রাজের সমগ্র সফর যে শুধু আত্মিক ছিল না, বরং সাধারণ মানুষের সফরের মত দৈহিক ও আত্মিক ছিল, একথা কুরআনের বক্তব্য ও অনেক মুতাওয়াতির হাদীস দ্বারা প্ৰমাণিত। আলোচ্য আয়াতের প্রথম سبحان শব্দের মধ্যে এদিকেই ইঙ্গিত রয়েছে। কেননা, এ শব্দটি আশ্চর্যজনক ও বিরাট বিষয়ের জন্যে ব্যবহৃত হয়। [ইবন কাসীর; মাজুমা ফাতাওয়া: ১৬/১২৫] মে'রাজ যদি শুধু আত্মিক অর্থাৎ স্বপ্নজগতে সংঘটিত হত, তবে তাতে আশ্চর্যের বিষয় কি আছে? স্বপ্নে তো প্রত্যেক মুসলিম, বরং প্রত্যেক মানুষ দেখতে পারে যে, সে আকাশে উঠেছে, অবিশ্বাস্য বহু কাজ করেছে। عبد শব্দ দ্বারা এদিকেই দ্বিতীয় ইঙ্গিত করা হয়েছে। কারণ, শুধু আত্মাকে দাস বলে না; বরং আত্মা ও দেহ উভয়ের সমষ্টিকেই দাস বলা হয়। [ইবন কাসীর]
তারপর “এক রাতে নিজের বান্দাকে নিয়ে যান” এ শব্দাবলীও দৈহিক সফরের কথাই সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে। স্বপ্নযোগে সফরের জন্য নিয়ে যাওয়া শব্দাবলী কোনক্রমেই উপযোগী হতে পারে না। তাছাড়া আয়াতে দেখানোর কথা বলা হয়েছে সেটাও শরীর ছাড়া সম্ভব হয় না। অনুরূপভাবে বুরাকে উঠাও প্রমাণ করে যে, ইসরা ও মি'রাজ দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে সংঘটিত হয়েছিল। [দেখুন, ইবন কাসীর]।
এছাড়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মে'রাজের ঘটনা উন্মে হানী রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে বর্ণনা করলেন, তখন তিনি পরামর্শ দিলেন যে, আপনি কারও কাছে একথা প্ৰকাশ করবেন না; প্রকাশ করলে কাফেররা আপনার প্রতি আরও বেশী মিথ্যারোপ করবে। ব্যাপারটি যদি নিছক স্বপ্নই হত, তবে মিথ্যারোপ করার কি কারণ ছিল? তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ঘটনা প্রকাশ করলেন, তখন কাফেররা মিথ্যারোপ করল এবং ঠাট্টা বিদ্রুপ করল। এমনকি, অনেকের ঈমান টলায়মান হয়েছিল। ব্যাপারটি স্বপ্নের হলে এতসব তুলাকালাম কান্ড ঘটার সম্ভাবনা ছিল কি? সুতরাং আমাদের জন্য একথা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই যে, এটি নিছক একটি রূহানী তথা আধ্যাতিক অভিজ্ঞতা ছিল না। বরং এটি ছিল পুরোদস্তুর একটি দৈহিক সফর এবং চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ। আল্লাহ নিজেই তাঁর নবীকে এ সফর ও পর্যবেক্ষণ করান।
তাফসীর কুরতুবীতে আছে, ইসরার হাদীসসমূহ সব মুতাওয়াতির। নাক্কাশ এ সম্পর্কে বিশ জন সাহাবীর রেওয়ায়েত উদ্ধৃত করেছেন এবং কাযী ইয়াদ শেফা গ্রন্থে আরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। ইমাম ইবনে কাসীর তার তাফসীর গ্রন্থে এসব রেওয়ায়েত পূর্ণরূপে যাচাই-বাছাই করে বর্ণনা করেছেন এবং পঁচিশ জন সাহাবীর নাম উল্লেখ করেছেন, যাদের কাছ থেকে এসব রেওয়ায়েত বৰ্ণিত রয়েছে। যেমন, ওমর ইবনে খাত্তাব, আলী, ইবনে মাসউদ, আবু যর গিফারী, মালেক ইবনে ছ’ছা, আবু হুরায়রা, আবু সায়ীদ আল-খুদরী, ইবনে আব্বাস, শাদ্দাদ ইবনে আউস, উবাই ইবনে ক’ব, আবদুর রহমান ইবনে কুর্ত, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর, জাবের ইবনে আবদুল্লাহ, হুযায়ফা ইবনে ইয়ামান, বুরাইদাহ, আবু আইউব আল-আনসারী, আবু উমামাহ, সামুরা ইবনে জুনদুব, সোহাইব রুমী, উম্মে হানী, আয়েশা, আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুম। এরপর ইবনে-কাসীর বলেন, ইসরা সম্পর্কে সব মুসলমানের ঐকমত্য রয়েছে। শুধু দ্বীনদ্রোহী যিন্দীকরা একে মানেনি।
মে'রাজের তারিখ সম্পর্কে বিভিন্ন রেওয়ায়েত বর্ণিত রয়েছে। মুসা ইবনে ওকবার রেওয়ায়েত এই যে, ঘটনাটি হিজরতের ছয়মাস পূর্বে খাদীজা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার মৃত্যুর পর সংঘটিত হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ খাদীজা রাদিয়াল্লাহু আনহার ওফাত সালাত ফরয হওয়ার পূর্বেই হয়েছিল। ইমাম যুহরী বলেনঃ খাদীজার ওফাত নবুওয়াত প্ৰাপ্তির সাত বছর পরে হয়েছিল। কোন কোন রেওয়ায়েত রয়েছে, মে'রাজের ঘটনা নবুওয়ত প্ৰাপ্তির পাঁচ বছর পরে ঘটেছে। ইবনে ইসহাক বলেনঃ মে'রাজের ঘটনা তখন ঘটেছিল, যখন ইসলাম আরবের সাধারণ গোত্ৰসমূহে বিস্তৃতি লাভ করেছিল। এসব রেওয়ায়েতের সারমর্ম এই যে, মে'রাজের ঘটনাটি হিজরতের কয়েক বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেনঃ ইসরা ও মে'রাজের ঘটনা রবিউসসানী মাসের ২৭তম রাত্রিতে হিজরতের এক বছর পূর্বে ঘটেছে। আবার কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, নবুওয়ত প্ৰাপ্তির আঠার মাস পর এ ঘটনা ঘটেছে। কারও কারও মতে হিজরতের এক বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল। মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন রেওয়ায়েত উল্লেখ করার পরে কোন সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করেননি। [বিস্তারিত দেখুন, আশশাইখ সফিউর রহমান আল-মুবারকপূৱী: আর-রাহীকুল মাখতূম]
(৫) মে'রাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনাঃ ইমাম ইবনে কাসীর তার তাফসীর গ্রন্থে আলোচ্য আয়াতের তাফসীর এবং সংশ্লিষ্ট হাদীসসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করার পর বলেনঃ সত্য কথা এই যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসরা সফর জাগ্রত অবস্থায় করেন; স্বপ্নে নয়। মক্কা মোকাররমা থেকে বাইতুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত এ সফর বোরাকযোগে করেন। তারপরের সংক্ষিপ্ত ঘটনা হলো, বায়তুল-মোকাদ্দাসের দ্বারে উপনীত হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বোরাকটি অদূরে বেঁধে দেন এবং বায়তুল মোকাদ্দাসের মসজিদে প্রবেশ করেন এবং কেবলার দিকে মুখ করে দুরাকাআত সালাত আদায় করেন। অতঃপর সিঁড়ি আনা হয়, যাতে নীচ থেকে উপরে যাওয়ার জন্য ধাপ বানানো ছিল। তিনি সিঁড়ির সাহায্যে প্রথমে প্রথম আসমানে, তারপর অবশিষ্ট আসমানসমূহে গমন করেন।
এ সিঁড়িটি কি এবং কিরূপ ছিল, তার প্রকৃতস্বরূপ আল্লাহ্ তাআলাই জানেন। প্রত্যেক আসমানে সেখানকার ফেরেশতারা তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং প্রত্যেক আসমানে সে সমস্ত নবী-রাসূলদের সাথে সাক্ষাত হয়, যাদের অবস্থান কোন নির্দিষ্ট আসমানে রয়েছে। যেমন, ষষ্ঠ আসমানে মূসা আলাইহিস সালাম এবং সপ্তম আসমানে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তারপর তিনি পয়গম্বরগণের স্থানসমূহও অতিক্রম করে এবং এক ময়দানে পৌছেন, যেখানে তাকদীর লেখার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তিনি ‘সিদরাতুল-মুনতাহা’ দেখেন, যেখানে আল্লাহ্ তাআলার নির্দেশে স্বর্ণের প্রজাপতি এবং বিভিন্ন রঙ এর প্ৰজাপতি ইতস্ততঃ ছোটাছুটি করছিল। ফেরেশতারা স্থানটিকে ঘিরে রেখেছিল। এখানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীলকে তাঁর স্বরূপে দেখেন। তাঁর ছয়শত পাখা ছিল। তিনি বায়তুল-মামুরও দেখেন।
বায়তুল-মামুরের নিকটেই কা'বার প্রতিষ্ঠাতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম প্রাচীরের সাথে হেলান দিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। এই বায়তুল মামুরে দৈনিক সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রবেশ করে। কেয়ামত পর্যন্ত তাদের পুর্নবার প্রবেশ করার পালা আসবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বচক্ষে জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করেন। সে সময় তার উম্মতের জন্য প্রথমে পঞ্চাশ ওয়াক্তের সালাত ফরয হওয়ার নির্দেশ হয়। তারপর তা হ্রাস করে পাঁচ ওয়াক্ত করে দেয়া হয়। এ দ্বারা ইবাদতের মধ্যে সালাতের বিশেষ গুরুত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। এরপর তিনি বায়তুল-মোকাদ্দাসে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন আসমানে যেসব পয়গম্বরের সাথে সাক্ষাত হয়েছিল তারাও তাকে বিদায় সম্বর্ধনা জানাবার জন্য বায়তুল-মোকাদ্দাস পর্যন্ত আগমন করেন। তখন নামাযের সময় হয়ে যায় এবং তিনি পয়গম্বরগণের সাথে সালাত আদায় করেন।
সেটা সেদিনকার ফজরের সালাতও হতে পারে। ইবনে-কাসীর বলেনঃ নামাযে পয়গম্বরগণের ইমাম হওয়ার এ ঘটনাটি কারও মতে আসমানে যাওয়ার পূর্বে সংঘটিত হয়। কিন্তু বাহ্যতঃ এ ঘটনাটি প্রত্যাবর্তনের পর ঘটে। কেননা, আসমানে নবী-রাসূলগণের সাথে সাক্ষাতের ঘটনায় একথাও বর্ণিত রয়েছে যে, জিবরীল সব পয়গম্বরগণের সাথে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেন। ইমামতির ঘটনা প্ৰথমে হয়ে থাকলে এখানে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন ছিল না। এছাড়া সফরের আসল উদ্দেশ্য ছিল উর্ধ্ব জগতে গমন করা। কাজেই একাজটি প্রথমে সেরে নেয়াই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। আসল কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর সব পয়গম্বর বিদায় দানের জন্যে তার সাথে বায়তুল-মোকাদ্দাস পর্যন্ত আসেন এবং জিবরীলের ইঙ্গিতে তাকে সবাই ইমাম বানিয়ে কার্যতঃ তার নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দেয়া হয়। এরপর তিনি বায়তুল মোকাদ্দেস থেকে বিদায় নেন এবং বোরাক সওয়ার হয়ে অন্ধকার থাকতেই মক্কা মোকার্রমা পৌঁছে যান।
৬. জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন, মিরাজের ব্যাপারে কুরাইশরা যখন আমাকে মিথ্যা প্ৰতিপন্ন করতে চেষ্টা করল তখন আমি কাবার হিজর অংশে দাঁড়ালাম। আর আল্লাহ বাইতুল মাকদিসকে আমার সামনে উদ্ভাসিত করলেন। ফলে আমি তার দিকে তাকিয়ে তার চিহ্ন ও নিদর্শনগুলো তাদেরকে বলে দিতে থাকলাম। [বুখারীঃ ৩৮৮৬]
তাফসীরে জাকারিয়া(১) পবিত্র ও মহিমময় তিনি[1] যিনি তাঁর বান্দাকে রাতারাতি[2] ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম হতে (ফিলিস্তীনের) মাসজিদুল আকসায়,[3] যার পরিবেশকে আমি করেছি বরকতময়,[4] যাতে আমি তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখাই; [5] নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা ।
[1] سُبْحَانَ হল, سَبَّحَ يُسْبِّحُ এর মাসদার (ক্রিয়া বিশেষ্য)। অর্থ হল, أُنَزِّهُ اللهَ تَنْزِيْهًا অর্থাৎ, আমি প্রত্যেক দোষ-ত্রুটি থেকে আল্লাহর পবিত্র ও মুক্ত হওয়ার কথা ঘোষণা করছি। সাধারণতঃ এর ব্যবহার তখনই করা হয়, যখন অতীব গুরুতত্ত্বপূর্ণ কোন ঘটনার উল্লেখ হয়। উদ্দেশ্য এই হয় যে, বাহ্যিক উপায়-উপকরণের দিক দিয়ে মানুষের কাছে এ ঘটনা যতই অসম্ভব হোক না কেন, আল্লাহর নিকট তা কোন কঠিন ব্যাপার নয়। কেননা, তিনি উপকরণসমূহের মুখাপেক্ষী নন। তিনি তো كُنْ শব্দ দিয়ে নিমিষে যা ইচ্ছা তা-ই করতে পারেন। উপায়-উপকরণের প্রয়োজন তো মানুষের। মহান আল্লাহ এই সব প্রতিবন্ধকতা ও দুর্বলতা থেকে পাক ও পবিত্র।
[2] إِسْراءٌ শব্দের অর্থ হল, রাতে নিয়ে যাওয়া। পরে لَيْلًا উল্লেখ করে রাতের স্বল্পতার কথা পরিষ্কার করা হয়েছে। আর এরই জন্য لَيْلًا ‘নাকেরাহ’ (অনির্দিষ্ট) এসেছে। অর্থাৎ, রাতের এক অংশে অথবা সামান্য অংশে। অর্থাৎ, চল্লিশ রাতের এই সুদীর্ঘ সফর করতে সম্পূর্ণ রাত লাগেনি; বরং রাতের এক সামান্য অংশে তা সুসম্পন্ন হয়।
[3]أَقْصَى দূরত্বকে বলা হয়। ‘আল-বাইতুল মুকাদ্দাস’ বা ‘বাইতুল মাকদিস’ ফিলিস্তীন বা প্যালেষ্টাইনের কদস অথবা জেরুজালেম বা (পুরাতন নাম) ঈলীয়া শহরে অবস্থিত। মক্কা থেকে ক্বুদ্স চল্লিশ দিনের সফর। এই দিক দিয়ে মসজিদে হারামের তুলনায় বায়তুল মাকদিসকে ‘মাসজিদুল আকসা’ (দূরতম মসজিদ) বলা হয়েছে।
[4] এই অঞ্চল প্রাকৃতিক নদ-নদী, ফল-ফসলের প্রাচুর্য এবং নবীদের বাসস্থান ও কবরস্থান হওয়ার কারণে পৃথক বৈশিষ্ট্যের দাবী রাখে। আর এই কারণে একে বরকতময় আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
[5] এটাই হল এই সফরের উদ্দেশ্য। যাতে আমি আমার এই বান্দাকে বিস্ময়কর এবং বড় বড় কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। তার মধ্যে এই সফরও হল একটি নিদর্শন ও মু’জিযা। সুদীর্ঘ এই সফর রাতের সামান্য অংশে সুসম্পন্ন হয়ে যায়। এই রাতেই নবী (সাঃ)-এর মি’রাজ হয় অর্থাৎ, তাঁকে আসমানসমূহে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন আসমানে নবীদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। সপ্তাকাশের উপরে আরশের নীচে ‘সিদরাতুল মুন্তাহা’য় মহান আল্লাহ অহীর মাধ্যমে নামায এবং অন্যান্য কিছু শরীয়তের বিধি-বিধান তাঁকে দান করেন। এ ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা বহু সহীহ হাদীসে রয়েছে এবং সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীন থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত উম্মতের অধিকাংশ উলামা ও ফুকহা এই মত পোষণ করে আসছেন যে, এই মি’রাজ মহানবী (সাঃ)-এর সশরীরে এবং জাগ্রত অবস্থায় হয়েছে। এটা স্বপ্নযোগে অথবা আত্মিক সফর ও পরিদর্শন ছিল না, বরং তা ছিল দেহাত্মার সফর ও চাক্ষুষ দর্শন। (তা না হলে এ ঘটনাকে অস্বীকারকারীরা অস্বীকার করবে কেন?) বলা বাহুল্য, এ ঘটনা মহান আল্লাহ (অলৌকিকভাবে) তাঁর পূর্ণ কুদরত দ্বারা ঘটিয়েছেন। এই মি’রাজের দু’টি অংশ। প্রথম অংশকে ‘ইসরা’ বলা হয়; যার উল্লেখ এখানে করা হয়েছে। আর তা হল, মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত সফর করার নাম। এখানে পৌঁছে নবী (সাঃ) সমস্ত নবীদের ইমামতি করেন। বায়তুল মাকদিস থেকে তাঁকে আবার আসমানসমূহে নিয়ে যাওয়া হয়। আর এটা হল এই সফরের দ্বিতীয় অংশ। যাকে ‘মিরাজ’ বলা হয়েছে। এর কিঞ্চিৎ আলোচনা সূরা নাজমে করা হয়েছে এবং বাকী বিস্তারিত আলোচনা হাদীসসমূহে বর্ণিত রয়েছে। সাধারণভাবে সম্পূর্ণ এই সফরকে ‘মি’রাজ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। ‘মি’রাজ’ সিড়ি বা সোপানকে বলা হয়। আর এটা রসূল (সাঃ)-এর পবিত্র মুখ-নিঃসৃত শব্দ عُرِجَ بِي إِلَى السَّمَاءِ (আমাকে আসমানে নিয়ে যাওয়া হয় বা আরোহণ করানো হয়) হতে গৃহীত। কেননা, এই দ্বিতীয় অংশটা প্রথম অংশের চেয়েও বেশী গুরুতত্ত্বপূর্ণ ও মাহাত্ম্যপূর্ণ ব্যাপার। আর এই কারণেই ‘মিরাজ’ শব্দটাই বেশী প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। মি’রাজের সময়কাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে এ ব্যাপারে সকলে একমত যে, তা হিজরতের পূর্বে সংঘটিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এক বছর পূর্বে। আবার কেউ বলেছেন, কয়েক বছর পূর্বে এ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অনুরূপ মাস ও তার তারীখের ব্যাপারেও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, রবিউল আওয়াল মাসের ১৭ অথবা ২৭ তারীখে হয়েছে। কেউ বলেছেন, রজব মাসের ২৭ তারীখ এবং কেউ অন্য মাস ও অন্য তারীখের কথাও উল্লেখ করেছেন। (ফাতহুল কাদীর)
[মহানবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবা (রাঃ) গণের নিকট তারীখের কোন গুরুত্ত্ব অথবা এ দিনকে স্মরণ ও পালন করার প্রয়োজনীয়তা ছিল না বলেই, তা সংরক্ষিত হয়নি। -সম্পাদক]