১০ সূরাঃ ইউনুস | Yunus | سورة يونس - আয়াত নং - ৯৮ - মাক্কী
সুতরাং কেন হল না এমন এক জনপদ, যে ঈমান এনেছে এবং তার ঈমান তার উপকারে এসেছে? তবে ইউনুসের কওম ছাড়া যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমি তাদের থেকে দুনিয়ার জীবনের লাঞ্ছনাকর আযাব সরিয়ে দিলাম এবং আমি তাদেরকে একটি সময় পর্যন্ত ভোগ করতে দিলাম। আল-বায়ান
এমন কোন জনপদের দৃষ্টান্ত আছে কি যে তারা (শাস্তি দেখার পর) ঈমান আনল আর তাদের ঈমান উপকারে আসল- একমাত্র ইউনুসের সম্প্রদায় ছাড়া? তারা যখন ঈমান আনল, তখন আমি দুনিয়ার জীবনে তাদের থেকে হীনতাব্যঞ্জক ‘আযাব সরিয়ে দিলাম, আর একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত তাদেরকে জীবন উপভোগ করার সুযোগ দিলাম। তাইসিরুল
সুতরাং এমন কোন জনপদই ঈমান আনেনি যে, তাদের ঈমান আনা উপকারী হয়েছে, ইউনুসের কাওম ছাড়া। যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমি তাদের থেকে পার্থিব জীবনের অপমানজনক শাস্তি বিদূরিত করলাম এবং তাদেরকে সুখ স্বাচ্ছন্দে থাকতে দিলাম এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত। মুজিবুর রহমান
Then has there not been a [single] city that believed so its faith benefited it except the people of Jonah? When they believed, We removed from them the punishment of disgrace in worldly life and gave them enjoyment for a time. Sahih International
৯৮. অতঃপর কোন জনপদবাসী কেন এমন হল না যারা ঈমান আনত এবং তাদের ঈমান তাদের আসত? তবে ইউনুস(১) এর সম্প্রদায় ছাড়া, তারা যখন ঈমান আনল তখন আমরা তাদের থেকে দুনিয়ার জীবনের হীনতাজনক শাস্তি দূর করলাম এবং তাদেরকে কিছু কালের জন্য জীবনোপভোগ করতে দিলাম।(২)
(১) ইউনুস আলাইহিস সালামকে আসিরিয়ানদের হেদায়াতের জন্য ইরাকে পাঠানো হয়েছিল। এ কারণে আসিরীয়দেরকে এখানে ইউনুসের কওম বলা হয়েছে। সে সময় এ কওমের কেন্দ্র ছিল ইতিহাস খ্যাত নিনোভা নগরী। বিস্তৃত এলাকা জুড়ে এ নগরীর ধ্বংসাবশেষ আজো বিদ্যমান। দাজলা নদীর পূর্ব তীরে আজকের মুসেল শহরের ঠিক বিপরীত দিকে এ ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এ জাতির রাজধানী নগরী নিনোভা প্রায় ৬০ মাইল এলাকা জুড়ে অবস্থিত ছিল। এ থেকে এদের জাতীয় উন্নতির বিষয়টি অনুমান করা যেতে পারে।
(২) আয়াতের পরিষ্কার মর্ম এই যে, পৃথিবীর সাধারণ জনপদের অধিবাসীদের সম্পর্কে আফসোসের প্রকাশ হিসেবে বলা হয়েছে যে, তারা কেনই বা এমন হলো না যে, এমন সময়ে ঈমান নিয়ে আসত যে সময় পর্যন্ত ঈমান আনলে তা লাভজনক হতো! অর্থাৎ আযাব কিংবা মৃত্যুতে পতিত হবার আগে যদি ঈমান নিয়ে আসতো, তবে তাদের ঈমান কবুল হয়ে যেত। কিন্তু ইউনুস আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায় তা থেকে স্বতন্ত্র। কারণ তারা আযাবের লক্ষণাদি দেখে আযাবে পতিত হওয়ার পূর্বেই যখন ঈমান নিয়ে আসে, তখন তাদের ঈমান ও তাওবা কবুল হয়ে যায়। আয়াতের এই প্রকৃষ্ট মর্ম প্রতীয়মান করে যে, এখানে আল্লাহর চিরাচরিত নিয়মে কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি; বরং একান্তভাবে তার নিয়মানুযায়ীই তাদের ঈমান ও তাওবা কবুল করে নেয়া হয়েছে।
অধিকাংশ মুফাসসির এ আয়াতের এ মর্মই লিখেছেন যাতে প্রতীয়মান হয় যে, ইউনুস আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়ে তাওবা কবুল হওয়ার বিষয়টি আল্লাহর সাধারণ রীতির আওতায়ই হয়েছে। তাবারী প্রমূখ তাফসীরকারও এ ঘটনাকে ইউনুস আলাইহিস সালাম-এর সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেছেন। সে সম্প্রদায়ের বিশুদ্ধ মনে তাওবা করা ও আল্লাহর জ্ঞানে তার নিঃস্বার্থ হওয়া প্রভৃতিই আযাব না আসার কারণ। ঘটনা এই যে, ইউনুস আলাইহিস সালাম যখন আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তিন দিন পর আযাব আসার দুঃসংবাদ শুনিয়ে দেন। কিন্তু পরে প্রমাণিত হয় যে, আযাব আসেনি, তখন ইউনুস আলাইহিস্ সালাম-এর মনে এ ভাবনা চেপে বসলো যে, আমি সম্প্রদায়ের মধ্যে ফিরে গেলে তারা আমাকে মিথ্যুক বলে সাব্যস্ত করবে। অতএব, এ সময় এ দেশ থেকে হিজরত করে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু নবী-রাসূলগণের রীতি হলো এই যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন দিকে হিজরত করার নির্দেশ না আসা পর্যন্ত নিজের ইচ্ছামত তারা হিজরত করেন না।
ইউনুস আলাইহিস সালাম- আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুমোদন আসার পূর্বেই হিজরতের উদ্দেশ্যে নৌকায় আরোহণ করে বসেন। সূরা আস-সাফফাতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে (إِذْ أَبَقَ إِلَى الْفُلْكِ الْمَشْحُونِ) “স্মরণ করুন, যখন তিনি বোঝাই নৌযানের দিকে পালিয়ে গেলেন।” [আস-সাফফাতঃ ১৪০] এতে হিজরতের উদ্দেশ্যে নৌকায় আরোহণ করাকে أَبَقَ শব্দে বলা হয়েছে। এর অর্থ হলো স্বীয় মনিবের অনুমতি ব্যতীত কোন ক্রীতদাসের পালিয়ে যাওয়া। অন্য সূরায় এসেছে, “আর স্মরণ করুন, যুন-নূন-এর কথা, যখন তিনি ক্রোধ ভরে চলে গিয়েছিলেন এবং মনে করেছিলেন যে, আমরা তাকে পাকড়াও করব না।” [আল-আম্বিয়াঃ ৮৭]
এতে স্বভাবজাত ভীতির কারণে সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আত্মরক্ষা করে হিজরত করাকে ভর্ৎসনার সুরে ব্যক্ত করা হয়েছে। সুতরাং তার প্রতি ভর্ৎসনা আসার কারণ হলো, অনুমতির পূর্বে হিজরত করা। মোটকথা পূর্বের কোন নবী-রাসূলের জনপদের সবাই ঈমান আনেনি। এর ব্যতিক্রম ছিল ইউনুসের কাওম। তারা ছিল নিনোভার অধিবাসী। তাদের ঈমানের কারণ ছিল, তারা তাদের রাসূলের মুখে যে আযাব আসার কথা শুনেছিল সেটার বিভিন্ন উপসর্গ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আর তারা দেখল যে, তাদের রাসূলও তাদের কাছ থেকে চলে গিয়েছেন। তখন তারা আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইল, তার কাছে উদ্ধার কামনা করল, কান্নাকাটি করল এবং বিনয়ী হল। আর তারা তাদের শিশু-সন্তান, জন্তু-জানোয়ারদের পর্যন্ত উপস্থিত করেছিল এবং আল্লাহর কাছে তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নেয়ার আহবান জানিয়েছিল। আর তখনই আল্লাহ তাদের উপর রহমত করেন এবং তাদের আযাব উঠিয়ে নেন, তাদেরকে কিছু দিনের জন্য দুনিয়াকে উপভোগ করার সুযোগ প্রদান করেন [ইবন কাসীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৯৮) সুতরাং কোন জনপদ বিশ্বাস করল না কেন, যাদের বিশ্বাস উপকারী হত; ইউনুসের সম্প্রদায়ের ব্যাপারটি স্বতন্ত্র,[1] যখন তারা বিশ্বাস করল, তখন আমি তাদের থেকে পার্থিব জীবনে অপমানজনক শাস্তি বিদূরিত করে দিলাম এবং এক নির্ধারিত কাল পর্যন্ত তাদেরকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দান করলাম। [2]
[1] এখানে لَولاَ শব্দটি আফসোস প্রকাশের জন্য هَلاَّ এর অর্থে ব্যবহার হয়েছে, অর্থাৎ আমি যে জনপদগুলিকে ধ্বংস করেছি, তার মধ্য থেকে কোন একটি জনপদবাসীও কেনই বা এমন হলো না যে, এমন সময়ে ঈমান নিয়ে আসত, যে সময়ে ঈমান আনলে তাদের জন্য ফলপ্রসূ হত! তবে ইউনুস (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। যখন তারা ঈমান আনল,তখন আল্লাহ তাআলা তাদের উপর থেকে আযাব রহিত করে দিলেন। সংক্ষিপ্ত ঘটনা হল এই যে, যখন ইউনুস (আঃ) দেখলেন যে, তাঁর দাওয়াত ও তবলীগে তাঁর সম্প্রদায় প্রভাবিত হচ্ছে না, তখন তিনি নিজ সম্প্রদায়কে জানিয়ে দিলেন যে, অমুক দিন তোমাদের উপর আল্লাহর আযাব আসবে এবং তিনি নিজে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়লেন। যখন মেঘের মত তাদের উপর আযাবের লক্ষণাদি দেখা দিল, তখন তারা শিশু, নারী এমনকি জীবজন্তু সমেত এক মাঠে সমবেত হল এবং আল্লাহর দরবারে কাকুতি-মিনতির সাথে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে আরম্ভ করল। আল্লাহ তাআলা তাদের তওবা কবুল করে তাদের উপর থেকে আযাব রহিত করে দিলেন। ইউনুস (আঃ) পথচারী পথিকের নিকট থেকে নিজ সম্প্রদায়ের অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে থাকলেন। পরিশেষে তিনি যখন জানতে পারলেন যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর সম্প্রদায়ের উপর থেকে আযাব রহিত করে দিয়েছেন, তখন যেহেতু সেই সম্প্রদায় তাকে মিথ্যাজ্ঞান করেছিল, তাই তিনি সেই সম্প্রদায়ের নিকট ফিরে যাওয়া পছন্দ করলেন না। বরং তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি অন্য কোন দিকে চলে গেলেন। এই সফরে তাঁকে নৌকা থেকে ফেলে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। (এ ঘটনা যথাস্থানে দ্রষ্টব্য।) (ফাতহুল কাদীর) অবশ্য ইউনুস (আঃ)-এর সম্প্রদায় কখন ঈমান এনেছিল তা নিয়ে মুফাসসিরগণের মাঝে মতভেদ আছে। (কেউ কেউ বলেন যে,) তারা আযাব দেখার পর ঈমান এনেছিল, যে সময়ের ঈমান ফলপ্রসূ হয় না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তা নিজের উক্ত রীতি থেকে স্বতন্ত্রভাবে তাদের ঈমান কবুল করেছেন। অথবা এমন পর্যায় আসেনি যে, সেই সময় তাদের ঈমান ফলপ্রসূ হত না। কিন্তু কুরআন কারীম ইউনুস (আঃ)-এর সম্প্রদায়কে إلاَّ দ্বারা যেভাবে আলাদা করেছে, তা প্রথম ব্যাখ্যাকেই সমর্থন করে। আর আল্লাহই ভালো জানেন।
[2] কুরআন পার্থিব আযাব রহিত হওয়ার ব্যাপারে পরিষ্কার বর্ণনা দিয়েছে, আখেরাতের আযাব রহিত হওয়ার ব্যাপারে কোন বর্ণনা দেয়নি। ফলে কিছু তফসীরবিদের ধারণা যে, তাদের উপর থেকে আখেরাতের আযাব রহিত করা হয়নি। কিন্তু যখন কুরআন পরিষ্কারভাবে বর্ণনা দিয়েছে যে, পার্থিব আযাব ঈমান আনার কারণে রহিত করা হয়েছিল, তখন আর আখেরাতের আযাব সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়ার কোন প্রয়োজনই থাকে না। কারণ আখেরাতের আযাবের ফায়সালা তো ঈমান আনা ও না আনার উপর ভিত্তি করেই হবে। ঈমান আনার পর ইউনুস (আঃ)-এর সম্প্রদায় যদি আপন ঈমানের উপর অটল থাকে, তবে অবশ্যই তারা আখেরাতের আযাব থেকেও রক্ষা পাবে। তবে এর বিপরীত হলে শুধু পৃথিবীতেই আযাব থেকে রক্ষা পাবে। আর আল্লাহই ভালো জানেন।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান