পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - যে সব অপরাধের ক্ষতিপূরণ (জরিমানা) নেই
৩৫১০-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পশু-প্রাণীর আঘাতের কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। খনিতে ক্ষতিপূরণ নেই এবং কূপে (পড়ে গিয়ে মারা গেলেও) কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ مَا يُضْمَنُ مِنَ الْجِنَايَاتِ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْعَجْمَاءُ جَرْحُهَا جُبَارٌ وَالْمَعْدِنُ جُبَارٌ وَالْبِئْرُ جُبَارٌ»
ব্যাখ্যা: الْعَجْمَاءُ শব্দটি اعجم-এর স্ত্রীলিঙ্গ। এর অর্থ চতুস্পদ প্রাণী। নির্বাক হওয়ার কারণে একে عجماء বলে অভিহিত করা হয়। আর যে সমস্ত প্রাণী কথা বলতে পারে না তাকে اعجمى বলা হয়। সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার বলেন- মানুষ ব্যতিরেকে সব প্রাণীই হলো عجماء।
আর جُبَارٌ এর অর্থ নিস্ফল বা অকেজো যার কোনো মূল্য নেই। ইমাম তিরমিযী বলেন, الْعَجْمَاءُ বলা হয় এমন প্রাণীকে যা মালিকের নিকট থেকে ছুটে পালিয়ে যায়। আর جُبَارٌ বলা হয় এমন মূল্যহীন বস্তু যার জরিমানা দিতে হয় না। (ফাতহুল বারী ১২ খন্ড, হাঃ ৬৯১২)
* খত্ত্বাবী বলেনঃ চতুস্পদ জন্তুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত জিনিসের ক্ষতিপূরণ কারো ওপর বর্তায় না যখন তার সাথে কোনো চালক বা সওয়ারী না থাকে।
* ইমাম নববী বলেনঃ ‘আলিমগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, দিবাভাগে চতুস্পদ জন্তুর অপরাধের কারণে কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। তবে যদি তার সাথে কোনো আরোহী বা কোনো নিয়ন্ত্রণকারী থাকে তবে ‘আলিমগণের সর্বসম্মতিক্রমে তার ওপর ক্ষতির দায় বর্তাবে। আর যখন রাত্রিকালে এরূপ কোনো ক্ষতি সাধন করবে তখন তার মালিক ক্ষতির জন্য দায়ী হবে।
ইমাম শাফি‘ঈ ও তাঁর সাথীবর্গ বলেন- যদি মালিক জন্তুকে সংরক্ষণের ব্যাপারে অবহেলা বা শিথিলতা অবলম্বন করে তাহলে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অন্যথায় দিতে হবে না। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৭৪৫৮১)
সহীহ মুসলিম-এর ভাষ্যকার বলেন- জন্তুর মালিকের অবহেলা ছাড়া যখন প্রাণীটি দিনে বা রাতে কোনো অন্যায় করে বসে অথবা তার সাথে কোনো আরোহী বা নিয়ন্ত্রক না থাকে তাহলে তার ক্ষতির দণ্ড মাফ। তবে যখন তার সাথে চালক থাকে বা আরোহী যে নিয়ন্ত্রণ করে আর জন্তুটি হাত, পা বা মুখ অথবা কোনোভাবে ক্ষতি করে দিলে মালিককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। চাই সে মালিক হোক বা ভাড়ায় গ্রহণকারী হোক অথবা ধারকারী হোক, ছিনতাইকারী ও আমানত গ্রহণকারী হোক ও প্রতিনিধি হোক।
(جرح العجماء) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ধ্বংস সাধন করা বা নষ্ট করা। এটা আঘাত করার মাধ্যমে হতে পারে অথবা ক্ষতি করা হতে পারে। এই ক্ষতিটা জানের অথবা মালের হতে পারে। শাফি‘ঈ মতাবলম্বীগণ বলেন- যদি সে ক্ষতিটা إفسادً (তথা ক্ষতিসাধন করা) হিসেবে গণ্য করা হয় তবে সেক্ষেত্রে মালিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে। কেননা তার দায়িত্ব হলো সেটাকে বেঁধে রাখা।
ইমাম মালিক-এর মতে জন্তু রাত্রে অপরাধ করলে তার দায় বর্তাবে মালিকের ওপর। (শারহে মুসলিম ১১ খন্ড হাঃ ১৭১০)
بِئْرٌ শব্দটি একবচন, বহুবচন হলো اَبْؤُرٌ ও أَبَارٌ। এখানে بِئْرٌ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো প্রাচীন কোনো প্রাকৃতিক কূপ, যার মালিক অজ্ঞাত থাকে আর তা মরুভূমিতে থাকে। এতে কোনো মানুষ বা প্রাণী পড়ে গেলে এর জন্য কেউ দায়ী হবে না। অনুরূপভাবে যদি কেউ তার অধীনস্ত জায়গায় অথবা মরুপ্রান্তরে কূপ খনন করে আর তাতে মানুষ বা অন্য কিছু পড়ে ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে এতে কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। যখন এক্ষেত্রে ক্ষতি সাধন করার বা বিপদের সম্মুখীন করার উদ্দেশ্য না থাকে।
তেমনিভাবে কোনো লোক যদি কাউকে কূপ খননের জন্য মজুর হিসেবে গ্রহণ করে আর তার উপর কূপ ভেঙ্গে পড়ে তাহলে মালিককে এর দায় বহন করতে হবে না। আর যে ব্যক্তি মুসলিমের রাস্তায় অনুরূপভাবে বিনা অনুমতিতে অন্যের জায়গায় কূপ খনন করে এবং তাতে মানুষ ধ্বংস হয়ে যায় তবে এর দায় খননকারীর দিয়াত প্রদানকারীর ওপর ওয়াজিব এবং এর কাফফারা তার মালের মধ্যে রয়েছে। আর যদি মানুষ ব্যতীত অন্য কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে এর দায়পূরণ খননকারীর মাল থেকে আদায় করা ওয়াজিব। (ফাতহুল বারী ১২ খন্ড, হাঃ ৬৯১২)
উপরোক্ত মতের প্রতি সহীহ মুসলিম-এর ভাষ্যকারও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমর্থন করেন।
(الْمَعْدِنُ جُبَارٌ)-এর অর্থ হলো যদি কেউ তার জায়গায় কোনো খনি খনন করে অথবা প্রান্তরে খনন করে আর কোনো পথিক তাতে পড়ে মারা যায় অথবা সে কোনো মজুর গ্রহণ করে যে খনিতে কাজ করে অতঃপর তার উপর খনি ভেঙ্গে পড়ায় মৃত্যুবরণ করলে মালিককে এর মূল্য দিতে হবে না। যেমন কূপের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ লাগে না। (শারহে মুসলিম ১১ খন্ড, হাঃ ১৭১০)
* ফাতহুল বারীর ভাষ্যকার বলেনঃ সব ধরনের মজুর এই হুকুমের মধ্যে শামিল। যেমন কেউ যদি খেজুর গাছে খেজুর নামানোর জন্য কোনো শ্রমিককে গাছে উঠায়। আর সে গাছ থেকে পড়ে মারা গেলে তার রক্তপণ বৃথা যাবে। অর্থাৎ মালিককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। (ফাতহুল বারী ১২ খন্ড, হাঃ ৬৯১২)
ركاز তথা গুপ্তধন এক-পঞ্চমাংশত যাকাত প্রদান করতে হবে। ركاز বলা হয় دفين الجاهلية (জাহিলী যুগের প্রোথিত সম্পদকে)। ইমাম নববী বলেনঃ উপরোক্ত ব্যাখ্যাটি আমাদের, আহলে হিজাযের ও জুমহূর ‘উলামার মত।
* কিন্তু ইমাম আবূ হানীফাহ্ ও ইরাকের অধিবাসীগণ বলেনঃ معدن ও ركاز সমার্থবোধক শব্দ, সুতরাং গুপ্তধনের বিধান খনির বিধানের মতই। কিন্তু এই মতটি ঠিক নয়। কেননা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসটি তাদের মতকে খন্ডন করেছে। আর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দু’টি শব্দকে পৃথক পৃথকভাবে বর্ণনা করেছেন حرف عطف-এর মাধ্যমে। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ খন্ড, হাঃ ৪৫৮১)