লগইন করুন
পরিচ্ছেদঃ ৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - গনীমাতের সম্পদ বণ্টন এবং তা আত্মসাৎ করা
৩৯৮৬-[২] আবূ কাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুনায়ন অভিযানে আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে অংশগ্রহণ করলাম। যখন আমরা শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিলাম, তখন (যুদ্ধের প্রথম দিকে) মুসলিমদের বিশৃঙ্খলার দরুন পরাজয়ের লক্ষণ দেখা দিল। এমন সময় আমি দেখলাম, এক মুশরিক জনৈক মুসলিম সৈন্যের উপর চড়ে বসেছে, তৎক্ষণাৎ আমি পিছন থেকে তার গর্দানে তরবারি মেরে তার লৌহবর্ম কেটে ফেললাম। তখন সে আমাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল, আমি যেন তা হতে মৃত্যুর গন্ধ পেলাম। ক্ষণিক পরেই সে আমাকে ছেড়ে দিল।
এরপর আমি ’উমার ইবনুল খত্ত্বাব (রাঃ)-এর সাক্ষাৎ পেলাম এবং তাকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকজনের (যুদ্ধের) অবস্থা কোন্ পর্যায়ে? তিনি বলেন, সবকিছু আল্লাহর হুকুম। অতঃপর মুসলিমগণ পুনরায় (বিজয় বেশে) ফিরে আসলেন। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জায়গায় বসে ঘোষণা করলেন, আজ তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কাফিরদের মধ্যে যাকে হত্যা করেছে এবং ঐ হত্যার সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে, সেই উক্ত নিহত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সবকিছু পাবে। আবূ কাতাদাহ(রাঃ) বলেন, আমি দাঁড়িয়ে বললাম, কেউ কি আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে? এ কথাটি বলে আমি বসে পড়লাম।
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্বের ন্যায় ঘোষণা করলেন, আর আমিও দাঁড়িয়ে বললাম, কেউ কি আমার পক্ষে সাক্ষ্য দিবে? এ কথা বলে আমি আবারও বসে পড়লাম। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবারও পূর্বের ন্যায় ঘোষণা করলেন, আর আমি এবারও পূর্বের ন্যায় একই কথার পুনরাবৃত্তি করলাম। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবূ কাতাদাহ! তোমার কি হয়েছে (বারবার উঠছ এবং কি যেন বলে বসছ কেন)? তখন আমি ঘটনার আদ্যোপান্ত খুলে বললাম, এমন সময় জনৈক ব্যক্তি বলে উঠল, আবূ কাতাদাহ সত্য কথাই বলেছেন এবং সেই নিহত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সমস্ত মালামাল আমার আয়ত্বেই আছে, আপনি তাকে অন্য কিছুর বিনিময়ে সন্তুষ্ট করে দিন (আর আমিই তা ভোগ করব)।
এ কথা শুনে আবূ বকর সিদ্দীক বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম! তা কক্ষনো হতে পারে না। আল্লাহর সিংহসমূহের একটি সিংহ যে আল্লাহ ও তার রসূলের পক্ষে যুদ্ধ করেছে, তাকে বঞ্চিত করে তার প্রাপ্য তথা নিহত ব্যক্তির পরিত্যক্ত মাল তোমাকে দেয়া হবে, এটা কক্ষনো হতে পারে না। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবূ বকর যথার্থই বলেছেন। তুমি ঐ নিহত ব্যক্তির পরিত্যক্ত মাল আবূ কাতাদাহ (রাঃ)-কে দিয়ে দাও। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে তখন সে সমুদয় মাল আমাকে দিয়ে দিল। আবূ কাতাদাহ বলেন, ঐ মাল বিক্রি করে আমি বানূ সালামার একটি খেজুরের বাগান ক্রয় করলাম। আর ইসলাম গ্রহণের পর এটাই আমার অর্জিত প্রথম সম্পত্তি। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ قِسْمَةِ الْغَنَائِمِ وَالْغُلُوْلِ فِيْهَا
وَعَن أبي قتادةَ قَالَ: خَرَجْنَا مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَامَ حُنَيْنٍ فَلَمَّا الْتَقَيْنَا كَانَتْ لِلْمُسْلِمِينَ جَوْلَةٌ فَرَأَيْتُ رَجُلًا مِنَ الْمُشْرِكِينَ قَدْ عَلَا رَجُلًا مِنَ الْمُسْلِمِينَ فَضَرَبْتُهُ مِنْ وَرَائِهِ عَلَى حَبْلِ عَاتِقِهِ بِالسَّيْفِ فَقَطَعْتُ الدِّرْعَ وَأَقْبَلَ عَلَيَّ فَضَمَّنِي ضَمَّةً وَجَدْتُ مِنْهَا رِيحَ الْمَوْتِ ثُمَّ أَدْرَكَهُ الْمَوْتُ فَأَرْسَلَنِي فَلَحِقْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ فَقُلْتُ: مَا بَالُ النَّاسِ؟ قَالَ: أَمْرُ اللَّهِ ثُمَّ رَجَعُوا وَجَلَسَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: «مَنْ قَتَلَ قَتِيلًا لَهُ عَلَيْهِ بَيِّنَةٌ فَلَهُ سَلَبُهُ» فَقُلْتُ: مَنْ يَشْهَدُ لِي؟ ثُمَّ جَلَسْتُ ثُمَّ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِثْلَهُ فَقُمْتُ فَقَالَ: «مَا لَكَ يَا أَبَا قَتَادَةَ؟» فَأَخْبَرْتُهُ فَقَالَ رَجُلٌ: صَدَقَ وَسَلَبُهُ عِنْدِي فَأَرْضِهِ مِنِّي فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ: لَا هَا اللَّهِ إِذاً لَا يعمدُ أَسَدٍ مِنْ أُسْدِ اللَّهِ يُقَاتِلُ عَنِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ فَيُعْطِيكَ سَلَبَهُ. فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «صَدَقَ فأعطه» فأعطانيه فاتبعت بِهِ مَخْرَفًا فِي بَنِي سَلِمَةَ فَإِنَّهُ لَأَوَّلُ مالٍ تأثَّلْتُه فِي الإِسلامِ
ব্যাখ্যা: হুনায়ন মক্কা ও ত্বায়িফের মাঝখানে একটি স্থান। ৮ম হিজরী সনে মক্কা বিজয়ের ১৯ দিন পরে ৬ই শাও্ওয়াল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনায়নের উদ্দেশে রওনা হন। এ যুদ্ধে মুসলিমদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ১২০০০। যুদ্ধের শুরুতে মুসলিমদের কিছুটা বিপর্যয় ঘটে, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটান।
جَوْلَةٌ শব্দের অর্থ هَزِيمَةٌ পরাজয় হওয়া। মুল্লা ‘আলী আল কারী (রহঃ) বলেনঃ الجَوْلَةٌ এর অর্থ হলো هَزِيمَةٌ قَلِيلَةٌ সামান্য পরাজয়, কিছুটা পরাজয়, পরাজয় পরাজয় ভাব হওয়া। الْجَوَلَانُ فِي الْحَرْبِ যুদ্ধের ময়দানে ঘূর্ণায়ন, যুদ্ধের ময়দানে নিজ অবস্থানস্থল থেকে সরে পড়া।
‘আল্লামা তূরিবিশতী (রহঃ) বলেনঃ এ যুদ্ধে প্রথম দিকে মুসলিমগণ ক্ষণিকের জন্য বিপর্যয়ের মুখে পড়েছিলেন, এ কথাটি সাহাবীগণ هَزِيمَة ‘পরাজয় বরণ’ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা অপছন্দ করেছেন, তাই তারা جَوْلَةٌ শব্দে তা প্রকাশ করেছেন। কেননা এ শব্দটির অর্থও পরাজয় তবে তা স্থায়ী এবং দীর্ঘ সময়ব্যাপী নয়। বর্ণনাকারী আবূ কাতাদাহ (রহঃ)-এর কথা : ‘আমি তার লৌহবর্ম কেটে ফেললাম, অতঃপর সে আমার দিকে ফিরে আসলো এবং আমাকে এমনভাবে চেপে ধরলো যে, আমি মৃত্যুর গন্ধ পেলাম।’ এটি একটি কিনায়া শব্দ দ্বারা اسْتِعَارَةٌ করা হয়েছে, এখানে শব্দের রূপক অর্থ বা পরোক্ষ অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে; সুতরাং তার কথার অর্থ হলো : আমি মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলাম, আমার প্রাণ বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল। এরপর আমার আঘাতের কারণে সে যখন নিসেত্মজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লো, তখন আমাকে ছেড়ে দিল।
যুদ্ধের বিধান হলো, যে কোনো কাফিরকে হত্যা করবে, সে প্রমাণসাপেক্ষে নিহত ব্যক্তির সঙ্গে থাকা অস্ত্র-শস্ত্র ও অন্যান্য যাবতীয় সামগ্রীর অধিকারী হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ কাতাদাহ-এর জন্য একাধিকবার সাক্ষ্য চান, একজন তার সাক্ষ্য প্রদান করে বলেন, হে আল্লাহর রসূল! আবূ কাতাদাহ তাকে হত্যা করেছে, আর ঐ নিহত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সামগ্রী আমার কাছেই রয়েছে। আপনি আমার পক্ষ থেকে তাকে বুঝিয়ে অথবা কিছু দিয়ে সন্তুষ্ট করে দিন, এ সম্পদ আমিই ভোগ করি। আবূ বাকর বললেন, না তা হবে না। সে আল্লাহর সিংহ, সে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষে যুদ্ধ করেছে। সুতরাং তার হাতে নিহত ব্যক্তির সম্পদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে দিতে পারেন না। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আবূ বাকর ঠিকই বলেছেন। এরপর তিনি ঐ সম্পদ ফেরত দিলেন।
ইমাম নববী (রহঃ) বলেনঃ এ হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম শাফি‘ঈ, লায়স প্রমুখ ইমাম ও ফাকীহ বলেন, নিহত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদ পেতে হলে তার পক্ষে সাক্ষীর প্রয়োজন, নিজে নিজে হত্যার দাবী করলেই যথেষ্ট হবে না। কিন্তু ইমাম মালিক (রহঃ) বলেন, হত্যাকারীর একক দাবীর ভিত্তিতেই তাকে পরিত্যক্ত সম্পদ দেয়া হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজনের কথার ভিত্তিতেই তাকে দিয়েছেন, তাকে শপথও করাননি। ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) আরো বলেন, নিহত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পদের হকদার হত্যাকারী, এ হাদীস তারও দলীল।
ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহঃ) বলেনঃ ইমাম যদি তাকে নফল হিসেবে প্রদান করেন তবেই সে হকদার হবে অন্যথায় নয়। ‘আল্লামা নববী (রহঃ) বলেন, এ ব্যাপারে ফাকীহগণ মতবিরোধ করেছেন; ইমাম মালিক, আহমাদ, আওযা‘ঈ, সাওরী প্রমুখসহ আরো কতিপয় ইমাম ও ফাকীহ বলেন, সেনাদলের আমীর যুদ্ধের পূর্বে বলুন অথবা না বলুন হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির সম্পদ পাবেন। তারা বলেন, এটা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শাশ্বত ফতোয়া এবং শারী‘আতের সুসাব্যস্ত বিধানের খবর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে কাউকে হত্যা করবে তার জন্যই নিহতের পরিত্যক্ত সম্পদ।’’ পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফাহ্ ও শাফি‘ঈ (রহঃ) বলেনঃ সেনাদলের আমীর বা ইমামের পূর্বানুমতি ছাড়া হত্যাকারী নিহত ব্যক্তির সম্পদ পাবে না। (মিরকাতুল মাফাতীহ; ফাতহুল বারী হাঃ ৪৩২১; তুহফাতুল আহওয়াযী ৪র্থ খন্ড, হাঃ ১৫৬২; ‘আওনুল মা‘বূদ ৫ম খন্ড, হাঃ ২৭১৪)
[বর্তমানে ইসলামী যুদ্ধ তেমন একটা নেই বললেই চলে; উপরোক্ত রাষ্ট্রের বেতনভোগী সৈন্যরা যুদ্ধ করে থাকে, তারা এই গনীমাতের অংশ পাবে কিনা, এ নিয়ে অনেক কথা। সুতরাং এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরিহার করা হলো।] -সম্পাদক