লগইন করুন
পরিচ্ছেদঃ
৩৩৯। হাদীস নং ২২২ দ্রষ্টব্য।
২২২। ইবনুল আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের মধ্য থেকে যে দুই স্ত্রী সম্পর্কে এ আয়াত নাযিল হয়েছে, “তোমরা উভয়ে আল্লাহর নিকট তাওবা করলে ভালো হয়, কেননা তোমাদের মন অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে,” (সূরা আত তাহরীমঃ ৪) সেই দুই মহিলা কে কে- এ কথা উমার ইবনুল খাত্তাবের নিকট জিজ্ঞাসা করার জন্য আমি উদগ্রীব ছিলাম। অবশেষে উমার হজ্জ করলেন, আর আমিও তার সাথে হজ্জ করলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর তিনি ভিন্ন পথ ধরলেন, আমিও তার সাথে পানির পাত্র হাতে ভিন্ন পথ ধরলাম। এরপর তিনি দৃশ্যপটে এলেন এবং আমার কাছে এলেন। তখন আমি তার হাতের ওপরে পানি ঢেলে দিলাম। তিনি ওযূ করলেন। তখন আমি বললাম, হে আমীরুল মুমিনীন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীদের মধ্য থেকে সেই দুই মহিলা কে কে, যাদের সম্পর্কে, আল্লাহ বলেছেন, “যদি তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবা কর, তবে খুবই ভাল হয়। কারণ তোমাদের মন অন্যয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল”।
উমার (রাঃ) বললেনঃ হে ইবনুল আব্বাস, তোমার জন্য অবাক হচ্ছি। (এই হাদীসের জনৈক বর্ণনাকারী আয যুহরী বলেন, তিনি প্রশ্নটাকে অপছন্দ করেছিলেন। তথাপি আল্লাহর কসম, তিনি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেননি এবং বিষয়টি তার কাছ থেকে গোপনও করেননি।) উমার (রাঃ) বললেনঃ তারা হলো, হাফসা ও আয়িশা। তারপর ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন।
তিনি বললেনঃ আমরা কুরাইশ বংশীয়রা নারীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতাম। যখন মদীনায় গেলাম, সেখানে এমন এক জনগোষ্ঠীকে পেলাম, যাদের ওপর তাদের নারীরা আধিপত্য বিস্তার করে। এ কারণে আমাদের মহিলারা তাদের মহিলাদের কাছ থেকে এটি শিখতে লাগলো। উমার (রাঃ) বলেনঃ আমি থাকতাম আওয়ালীতে বনু উমাইয়া বিন যায়িদের বাড়ীতে। একদিন আমি আমার স্ত্রীর ওপর রাগ করলাম। সেও আমার ওপর পাল্টা রাগ করলো। তার আমার ওপর পাল্টা রাগ করাটা আমি অপছন্দ করলাম। সে বললো, তোমার ওপর পাল্টা রাগ করাকে অপছন্দ করার হেতু কী? আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীরা তার ওপর পাল্টা রাগ করে থাকে। এমনকি তাদের কেউ কেউ তো দিন থেকে রাত পর্যন্ত তার সঙ্গ বর্জন করে।
উমার (রাঃ) বলেনঃ এরপর আমি চলে গেলাম এবং হাফসার কক্ষে প্রবেশ করলাম। তাকে বললাম, তুমি কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর পাল্টা রাগ কর? সে বললো, হ্যাঁ। আমি বললামঃ দিন থেকে রাত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গ বর্জনও কর? সে বললো, হ্যাঁ। আমি বললামঃ এটা যে করে সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তোমাদের মধ্য থেকে কেউ কি এতটা নিশ্চিন্ত যে, তার ওপর আল্লাহর রাসূলের রাগান্বিত হওয়ার কারণে স্বয়ং আল্লাহও রাগান্বিত হতে পারেন না? আল্লাহ রাগান্বিত হলে তো সে ধ্বংস হয়ে যাবে। খবরদার, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর কখনো রাগান্বিত হবে না এবং কখনো কিছু চাইবে না। তোমার কিছু প্রয়োজন হলে আমার কাছে চেয়ো। তোমার সতিন যদি তোমার চেয়ে বেশি সুন্দরী হয় এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বেশি প্রিয় হয় তবে সে জন্য ঈর্ষান্বিত হয়োনা। এ দ্বারা উমার (রাঃ) আয়িশার দিকে ইঙ্গিত করছিলেন।
উমার (রাঃ) বলেনঃ আমার একজন আনসার প্রতিবেশী ছিল। আমরা দুজনে পালাক্রমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে অতিথি হতাম। একদিন আমি যেতাম, একদিন সে যেত। আমি যেদিন যেতাম সেদিন তার কাছে ওহীর খবরাদি নিয়ে আসতাম, আর সে যেদিন যেত, সেদিন সে আমার কাছে ওহীর খবরাদি নিয়ে আসতো। আমরা বলাবলি করতাম যে, গাসসান গোত্র আমাদের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য ঘোড়াগুলোকে প্রস্তুত করছে। একদিন আমার এই প্রতিবেশী আমার কাছে এসে অতিথি হলো। সন্ধ্যার পর সে এসে দরজায় করাঘাত করলো। তারপর আমাকে ডাকলো। আমি বেরিয়ে তার সামনে এলাম। সে বললো, একটা ভয়ানক ঘটনা ঘটে গেছে। আমি বললামঃ সেটি কী? গাসসান এসে গেল নাকি? সে বললো, না, এর চেয়েও ভয়ঙ্কর ও দীর্ঘস্থায়ী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দিয়েছেন।
আমি বললামঃ হাফসা বিরাট ক্ষতি ও ব্যর্থতার শিকার হলো। আমিও ভাবছিলাম, এটা ঘটতে যাচ্ছে। অতঃপর ফজরের নামায পড়েই প্রস্তুত হয়ে নিলাম। তারপর গেলাম। হাফসার কক্ষে প্রবেশ করলাম। দেখলাম, সে কাঁদছে। আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তোমাদেরকে তালাক দিয়েছেন? সে বললো, জানি না। তিনি এই কাঠের কক্ষটাতে অবরোধবাসী হয়ে রয়েছেন। তখন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জনৈক হাবশী ভৃত্যের কাছে গেলাম। তাকে বললামঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে উমারের জন্য প্রবেশের অনুমতি এনে দাও। সে প্রবেশ করলো এবং পুনরায় আমার কাছে বেরিয়ে এল। বললো, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তোমার কথা বলেছি। কিন্তু তিনি নীরবতা অবলম্বন করলেন।
অতঃপর আমি সেখান থেকে চলে গেলাম এবং মিম্বারের নিকট উপস্থিত হলাম। দেখলাম, সেখানে একদল লোক বসে আছে। তাদের কেউ কেউ কাঁদছিল। আমি কিছুক্ষণ বসলাম। তারপর আমার ওপর অস্থিরতা প্রবল হয়ে উঠলো। আমি আবার সেই ভৃত্যের নিকট গেলাম, বললাম, উমারের জন্য একটু অনুমতি এনে দাও। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে প্রবেশ করলো এবং একটু পরেই বেরিয়ে এল। বললো, আমি তার কাছে আপনার কথা বলেছি। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। আমি বেরিয়ে এলাম এবং পুনরায় মিম্বারের নিকট গিয়ে বসলাম। অতঃপর আবারো আমার ওপর অস্থিরতা প্রবল হয়ে উঠলো। আমি পুনরায় সেই ভূত্যের নিকট গেলাম এবং বললাম, উমারের জন্য একটু অনুমতি এনে দাও। সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে প্রবেশ করলো এবং কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এল। বললো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট আপনার কথা বলেছি। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না।
অগত্যা আমি ফিরে চললাম। হঠাৎ দেখলাম, সেই ভৃত্যটি আমাকে ডাকছে। সে বললো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে অনুমতি দিয়েছেন। প্রবেশ করুন। আমি প্রবেশ করলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম করলাম। দেখলাম, তিনি বালুকাময় একটা পাটিতে কাত হয়ে শুয়ে আছেন, যার দরুন তার শরীরের এক পার্শ্বে দাগ হয়ে গেছে। আমি বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি কি আপনার স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়েছেন? তিনি মাথা তুলে আমার দিকে ফিরলেন এবং বললেনঃ না। আমি বললামঃ আল্লাহু আকবার। ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের কী অবস্থা হয়েছে তা যদি দেখতেন। আমরা কুরাইশরা নারীদের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতাম। পরে মদীনায় এসে এমন এক জনগোষ্ঠীর সংস্পর্শে এলাম, যাদের ওপর তাদের নারীরা আধিপত্য বিস্তার করে। ফলে আমাদের স্ত্রীরা তাদের স্ত্রীদের কাছ থেকে এই আচরণ শিখতে লাগলো।
একদিন আমি আমার স্ত্রীর ওপর রাগ করলাম। সেও আমার ওপর রাগ করলো। তার পাল্টা রাগ করাতে আমি অসন্তুষ্ট হলাম। সে বললো, আমি পাল্টা রাগ করাতে তুমি অসন্তুষ্ট হয়েছ কেন? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রীরা তো তার ওপর পাল্টা রাগ করে থাকে। এমনকি তাদের কেউ কেউ দিন থেকে রাত পর্যন্ত তার সাথে কথোপকথন ও সাহচর্য দান থেকে বিরত থাকে। আমি বললাম, তোমাদের মধ্য থেকে এ ধরনের আচরণ যে করে, সে ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্ত। এ ধরনের মহিলা কি নিশ্চিত যে, আল্লাহ তা’আলা তার রাসূলের ক্রোধের কারণে তার ওপর ক্রুদ্ধ হবে না? আল্লাহ ক্রুদ্ধ হলে তো তার সর্বনাশ অনিবার্য। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুচকি হাসলেন। আমি বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি এরপর হাফসার কাছে গিয়েছি। তাকে বলেছি, তোমার সতিন যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট তোমার চেয়েও সুন্দরী ও প্রিয় হয়, তবে তার ওপর তুমি ঈর্ষাকাতর হয়ো না। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুনরায় মুচকি হাসলেন।
এবার আমি বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি কি এখন নিশ্চিন্ত হতে পারি? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। তখন আমি ঘরের ভেতরে মাথা উঁচু করে তাকালাম। কিন্তু সেখানে চোখে পড়ার মত কিছু দেখলাম না। সেখানে তিন দিনের উপকরণ ছাড়া কিছুই ছিল না। এই দরিদ্রাবস্থার কারণেই স্ত্রীদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মনোমালিন্য হয়েছিল। তাই এ দুরবস্থা অবসানের লক্ষ্যে আমি বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর নিকট দু’আ করুন যেন আপনার উম্মাতকে সচ্ছলতা দান করেন। কেননা তিনি তো রোম ও পারস্যবাসীকে অনেক সচ্ছলতা দান করেছেন। অথচ তারা এক আল্লাহর ইবাদাত করে না।
এবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোজা হয়ে বসলেন। অতঃপর বললেনঃ হে খাত্তাবের ছেলে, তুমি কি কোন সংশয়ে লিপ্ত আছ? তারা এমন জনগোষ্ঠী, যাদের যাবতীয় সৎকর্মের ফল প্রদান দুনিয়াতেই ত্বরান্বিত করা হয়েছে। আমি বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার জন্য ক্ষমা চান। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার স্ত্রীদের ওপর এত বেশি রেগে গিয়েছিলেন যে, এক মাসের মধ্যে তাদের কারো কাছে যাবেন না বলে শপথ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা তাকে এজন্য ভৎসনা করেছিলেন।