২৩৬৪

পরিচ্ছেদঃ ৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - আল্লাহ তা‘আলার রহমতের ব্যাপকতা

অত্র অধ্যায়ের অধিকাংশ হাদীস অবাধ্যতা থেকে তওবা্ করা, আশা করার পরিণাম এবং ক্ষমা থেকে নিরাশ না হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদানকারী দয়াময় আল্লাহর রহমতে সম্পর্কে। এটি কারীর উক্তি। ’উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, কতিপয় কপিতে (আল্লাহর রহমতের প্রশস্ততা সম্পর্কে অধ্যায়) এভাবে এসেছে এবং তাতে উল্লেখিত হাদীসের সাথে এর সামঞ্জস্যতা অস্পষ্ট নয়।


২৩৬৪-[১] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা মাখলূকাত (সৃষ্টিজগত) সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিলে একটি কিতাব লিখলেন, যা ’আরশের উপর সংরক্ষিত আছে। এতে আছে, আমার রহমত আমার রাগকে প্রশমিত করেছে। অন্য এক বর্ণনায় আছে, আমার রাগের উপর (রহমত) জয়ী হয়েছে। (বুখারী, মুসলিম)[1]

بَابُ سَعْةِ رَحْمَةِ اللهِ

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَمَّا قَضَى اللَّهُ الْخَلْقَ كَتَبَ كِتَابًا فَهُوَ عِنْدَهُ فَوْقَ عَرْشِهِ: إِنَّ رَحْمَتِي سَبَقَتْ غَضَبِي «. وَفِي رِوَايَةٍ» غَلَبَتْ غَضَبي

ব্যাখ্যা: (لَمَّا قَضَى اللّٰهُ الْخَلْقَ) অর্থাৎ- যখন তিনি সকল সৃষ্টিজীবকে সৃষ্টি করলেন। যেমন তার বাণী, فقضاهن سبع سماوات অর্থাৎ- তিনি এগুলোকে সৃষ্টি করলেন।

কারী বলেন, (لَمَّا قَضَى اللّٰهُ الْخَلْقَ) অর্থাৎ- যখন আল্লাহ সকল সৃষ্টিজীবের সৃষ্টিকে নির্ধারণ করলেন, অস্তিত্বসমূহের প্রকাশ সম্পর্কে ফায়সালা দিলেন অথবা যখন আল্লাহ অঙ্গীকার গ্রহণের দিন সৃষ্টিজীবকে সৃষ্টি করলেন অথবা তাদেরকে সৃষ্টি করতে শুরু করলেন।

‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, বুখারীর এক বর্ণনাতে তাওহীদ পর্বে আল্লাহর বাণী, وَيُحَذِّرُكُمُ اللّٰهُ نَفْسَهٗ (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ২৮) এ অধ্যায়ে এসেছে, (لما خلق الله الخلق) অর্থাৎ- আল্লাহ যখন সকল সৃষ্টিজীবকে সৃষ্টি করলেন। এভাবে আহমাদ এবং মুসলিমের এক বর্ণনাতে এবং তিরমিযীতে এসেছে, (ان الله حين خلق الخلق) অর্থাৎ- নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন সকল সৃষ্টিজীবকে সৃষ্টি করলেন। আর বুখারী ও মুসলিমের এক বর্ণনাতে আছে, (كتب فى كتاب) অর্থাৎ- লাওহে মাহফূযে মালায়িকাহকে (ফেরেশতাগণকে) অথবা কলমকে লিখতে নির্দেশ দেয়ার মাধ্যমে। আর একে সমর্থন করছে ‘উবায়দাহ্ বিন সামিত-এর (اول ما خلق الله القلم) অর্থাৎ- সর্বপ্রথম আল্লাহ যা সৃষ্টি করেছেন তা হল কলম। এ হাদীস, অর্থাৎ- ‘আরশ এবং পানি ছাড়া অন্য যা কিছু আছে তার দিকে সম্বন্ধ করে। এরপর আল্লাহ কলমকে বললেন, তুমি লিখ তখন কলম কিয়ামাত পর্যন্ত যা হবে তা লিখতে শুরু করল। আরো সমর্থন করছে (جف القلم بما هو كائن إلى يوم القيامة) অর্থাৎ- কিয়ামাত পর্যন্ত যা হবে সে সম্পর্কে অথবা লেখা সম্পর্কে কলম শুকিয়ে গেছে। এ হাদীস তিরমিযী এবং ইবনু মাজাহতে (كتب بيده على نفسه) এসেছে। অর্থাৎ- তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতির দাবী অনুযায়ী নিজের ওপর তা আবশ্যক করে নিয়েছেন। এখানে আল্লাহ যে কিতাব শব্দের উল্লেখ করেছেন তা মূলত তাঁর সাহায্যার্থে নয়। কারণ তিনি তা ভুলে যায় না, কেননা এ সব থেকে তিনি পবিত্র। তার নিকট কোন কিছু গোপন নয়। আর তা কেবল শারী‘আতের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে এমন সৃষ্টি দায়িত্বশীল মালায়িকাহর (ফেরেশতার) কারণে। অতঃপর যদি বলা হয়, কলম প্রতিটি জিনিসকে লিখে রেখেছে এ সত্ত্বেও আলোচনাতে এ বিষয়টি নির্দিষ্ট করার কারণ কি? ‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, আমি বলব, এতে যেই পূর্ণাঙ্গ আশা রয়েছে তা এবং নিশ্চয়ই তার রহমাতে প্রতিটি জিনিসকে পরিব্যাপৃত করে নিয়েছে তা প্রকাশ করার জন্য এ নির্দিষ্টতা। যা অন্যান্য বিষয়ের বিপরীত।

(فَهُوَ) অর্থাৎ- ঐ কিতাব যা লিখিত অর্থে ব্যবহৃত। একমতে বলা হয়েছে, তার বিদ্যা অথবা তার আলোচনা। (عِنْدَه) অর্থাৎ- সাধারণ অর্থ তার নিকটে। তবে এখানে এর অর্থ তাঁর নিকটে তথা স্থান উদ্দেশ্য নয় বরং তাঁর মর্যাদা উদ্দেশ্য, কেননা তিনি শুরু বা প্রারম্ভের লক্ষণ থেকে পবিত্র।

(فَوْقَ عَرْشِه) সকল সৃষ্টিজীব থেকে সুরক্ষিত, অনুভূতি থেকে দূরে। হাফেয বলেন, এখানে عند এর অর্থ ‘স্থান’ হবে না বরং তা সৃষ্টিজীব থেকে পূর্ণাঙ্গ গোপন হওয়ার দিকে ইঙ্গিত, তাদের অনুভূতিশক্তি থেকে দূরে। এতে বিষয়াবলীকে মর্যাদা দানের ব্যাপারে মহা সম্মানের ব্যাপারে সতর্কতা রয়েছে।

ইমাম খাত্ত্বাবী বলেন, الكتاب দ্বারা দু’টি বিষয়ের একটি উদ্দেশ্য আর তার একটি হল সম্পন্ন করা যা আল্লাহ সম্পন্ন করেছেন। যেমন তাঁর বাণী, كَتَبَ اللّٰهُ لَأَغْلِبَنَّ أَنَا وَرُسُلِيْ অর্থাৎ- ‘‘আল্লাহ সম্পন্ন করে দিয়েছেন বা রায় দিয়েছেন, অবশ্যই আমি এবং আমার রসূলগণ বিজয় লাভ করবে’’- (সূরা আল মুজাদালাহ্ ৫৮ : ২১)। অর্থাৎ- ঐ বিষয়টি সম্পন্ন করে তিনি বলেছেন। আর রসূলের উক্তি (فوق العرش) এর অর্থ হল তার নিকটে আছে তার জ্ঞান, তিনি তা ভুলেন না এবং পরিবর্তনও করেন না। যেমন আল্লাহর বাণী, ‘‘কিতাবে রয়েছে আমার প্রভু পথভ্রষ্ট হন না এবং ভুলেও যান না’’- (সূরা ত্ব-হা- ২০ : ৫২)। পক্ষান্তরে লাওহে মাহফূয, যাতে রয়েছে সৃষ্টির প্রকারসমূহের বর্ণনা, তাদের বিষয়াবলী, তাদের মৃত্যু নির্দিষ্ট সময়, তাদের রিযক ও তাদের অবস্থাসমূহের বর্ণনা। আর (فَهُوَ عِنْدَه فَوْقَ عَرْشِه) এর অর্থ হল, তাঁর জিকির ও তাঁর জ্ঞান এবং ব্যাখ্যা ক্ষেত্রে এ প্রত্যেকটি বৈধ। একমতে বলা হয়েছে, আল্লাহ এর ক্ষেত্রে (عند) এর সুপরিচিত ‘‘স্থান’’ অর্থ নেয়া অসম্ভব। সুতরাং আল্লাহর ক্ষেত্রে (عند) এর অর্থ ঠিক সেভাবে গ্রহণ করতে হবে যেভাবে তার সাথে মানানসই বা এর অর্থ তাঁরই দিকে সোপর্দ করতে হবে। ‘উবায়দল্লাহ মুবারকপূরী বলেন, এটা এমন এক বিষয় যে ব্যাপারে চুপ থাকা বাঞ্ছনীয়। সুতরাং এ খবর সম্পর্কে আমরা বলব, তবে এর ধরন বর্ণনা থেকে আমরা বিরত থাকব। কেননা তার মতো কোন কিছু নেই। সুতরাং উত্তম হল বরং সুনির্দিষ্ট হল, বিষয়টিকে তাঁর বাহ্যিকতার দিকে ঘুরিয়ে দেয়া এবং কোন ধরনের পরিবর্তন না করা।

(سَبَقَتْ غَضَبِىْ وَفِىْ رِوَايَةٍ غَلَبَتْ غَضَبِىْ) দ্বিতীয় বর্ণনাটি শুধু বুখারীর, তিনি এটা সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কিত অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন। মুসলিমের শব্দ (تغلب) এভাবে বুখারীতে আল্লাহর বাণী, (সূরা আ-লি ‘ইমরান ৩ : ২৮ আয়াত) وَيُحَذِّرُكُمُ اللهُ نَفْسَهٗ এ অধ্যায়ে এসেছে।

কারী বলেন, (غَلَبَتْ غَضَبِىْ) অর্থাৎ- আমার রহমাত আমার রাগের উপর বিজয় লাভ করেছে। এর উদ্দেশ্য হল, আমার রহমাতের প্রভাবসমূহ আমার রাগের প্রভাবসমূহের উপর বিজয় লাভ করেছে, এটি এর পূর্ববর্তী অংশের ব্যাখ্যা। উদ্দেশ্য হল, রহমাতের প্রশস্ততা, তার আধিক্যতা এবং তা সমস্ত সৃষ্টিকে শামিল করে নেয়া এমনকি যেন তা অগ্রগামী ও বিজয়ী যেমন একজন ব্যক্তির স্বভাব বৈশিষ্ট্যের মাঝে যখন দয়ার পরিমাণ অধিক হয় তখন সে ক্ষেত্রে (غلب على فلان الكرم) অর্থাৎ- অমুকের উপর দয়ার দিক প্রাধান্য পেয়েছে- এ কথা বলা হয়। অন্যথায় আল্লাহর (رحمة) অর্থাৎ- দয়া, এবং (غضب) অর্থাৎ- রাগ। দু’টি আলাদা বৈশিষ্ট্য যা আল্লাহর পুণ্যদান ও শাস্তিদান ইচ্ছার দিকে প্রত্যাবর্তনশীল। আর তাঁর গুণসমূহের ব্যাপারে তাদের একটিকে অপরটির উপর বিজয় লাভের বর্ণনা করা হয় না। তা কেবল আধিক্যতার পদ্ধতিতে রূপকতার জন্য ব্যবহার করা হয়।

আর (سَبَقَتْ رَحْمَتِىْ) এর অর্থ ক্রোধের উপর রহমাতের আধিক্যতার জন্য পণ করা। যেমন বলা হয়, (تسابقتا فسبقت احداهما على الأخرى) ঘোড়া দু’টি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হল, অতঃপর দু’টির একটি অপরটির উপর অগ্রগামী হল।

লাম্‘আত গ্রন্থকার বলেন, ওটা এজন্য যে, কেননা আল্লাহর রহমাতের প্রভাবসমূহ তাঁর উদারতা এবং অনুগ্রহ সকল সৃষ্টিজীবকে ব্যাপক করে নিয়েছে আর তা সীমাবদ্ধ নয় যা غضب তথা ক্রোধের প্রভাবের বিপরীত। কেননা তা কিছু কারণবশত কতিপয় আদম সন্তানের ওপর প্রকাশ পেয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, অর্থাৎ- ‘‘আর যদি তোমরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহ গণনা কর তোমরা তা পরিসংখ্যান করতে পারবে না’’- (সূরা আন্ নাহল ১৬ : ১৮)। তিনি আরো বলেন, অর্থাৎ- ‘‘আমার শাস্তি যাকে ইচ্ছা তাকে পৌঁছিয়ে থাকি, এবং আমার রহমাত প্রতিটি জিনিসকে পরিব্যাপৃত করে নিয়েছে’’- (সূরা আল আ‘রাফ ৭ : ১৫৬)। আল্লাহর বাণীঃ ‘‘আর আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের অন্যায়ের কারণে পাকড়াও করতেন তাহলে জমিনের উপর কোন প্রাণী ছেড়ে দিতেন না’’- (সূরা আন্ নাহল ১৬ : ৬১)। সুতরাং তিনি তাঁর রহমাতকে তাদের মাঝে অবশিষ্ট রাখবেন এবং বাহ্যিকভাবে তাদেরকে দান করবেন ও তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন, এজন্য তাদেরকে দুনিয়াতে পাকড়াও করবেন না। সুতরাং এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর রহমাত তাঁর عضب এর উপর অগ্রগামী।