পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - কিয়ামতের পূর্বলক্ষণসমূহ এবং দাজ্জালের বর্ণনা
৫৪৭১-[৮] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: এমন কোন নবী গত হননি যিনি তাঁর উম্মাতকে কানা মিথ্যাবাদী (দাজ্জাল) সম্পর্কে সতর্ক করেননি। তোমরা জেনে রাখ! সে (দাজ্জাল) নিশ্চয় কানা হবে। আর তোমরা এটাও নিশ্চিতভাবে জেনে রাখ যে, তোমাদের প্রভু (আল্লাহ) কানা নন। তার (দাজ্জালের) চক্ষুদ্বয়ের মধ্যস্থলে লিখে থাকবে (ك ف ر) (অর্থাৎ কাফির)। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَابُ الْعَلَامَاتِ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ وَذِكْرِ الدَّجَّالِ)
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَا مِنْ نَبِيٍّ إِلَّا أَنْذَرَ أُمَّتَهُ الْأَعْوَرَ الْكَذَّابَ أَلَا إِنَّهُ أَعْوَرُ وَإِنَّ رَبَّكُمْ لَيْسَ بِأَعْوَرَ مَكْتُوبٌ بَيْنَ عَيْنَيْهِ: ك ف ر . مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ متفق علیہ ، رواہ البخاری (7131) و مسلم (101 / 2933)، (7363) ۔ (مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (مَا مِنْ نَبِيٍّ إِلَّا أَنْذَرَ أُمَّتَهُ الْأَعْوَرَ الْكَذَّابَ) প্রত্যেক নবীই তার উম্মাতকে মিথ্যাবাদী জ্যোতিহীন চোখ বিশিষ্ট (দাজ্জাল) সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করেছেন। হাফিয ইবনু হাজার (রহিমাহুল্লাহ) ফাতহুল বারী গ্রন্থে উল্লেখ করেন (لَمْ يَكُنْ نَبِيٌ بِعْد نُوح إلَّا وَقَدْ أَنْذَرَ قَوْمه الدَّجَّال) “নূহ আলায়হিস সালাম-এর পর এমন কোন নবী আসেননি যারা তার জাতিকে দাজ্জাল থেকে সতর্ক করেননি। অর্থাৎ সবাই দাজ্জাল সম্পর্কে জাতিকে সতর্ক করেছেন।” মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে, (لَقَدْ أَنْجَرَهُ نُوح أُمَّته وَالنَّبِيُّونَ مِنْ بَعْده) নূহ আলায়হিস সালাম তার জাতিকে (দাজ্জাল) থেকে সতর্ক করেছেন এবং তার পরবর্তী সকল নবীই।
অতএব এখানে প্রশ্ন হতে পারে, নূহ আলাইহিস সালাম কিভাবে তার জাতিকে দাজ্জাল সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করেছেন অথচ একাধিক হাদীস থেকে জানা যায় যে, সে কতিপয় নিদর্শনের পরে আবির্ভূত হবে এবং ঈসা আলায়হিস চতুর্থ আসমান থেকে অবতরণ করে তাকে হত্যা করবে এবং শারী'আতে মুহাম্মাদীয়া অনুযায়ী দেশ শাসন করবেন। এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে: নূহ আলাইহিস সালাম এবং তার পরবর্তী নবীগণের নিকট দাজ্জালের আবির্ভাবের সময় জানা ছিল না তথাপি তারা তাদের জাতিকে তার ফিতনাহ থেকে বাঁচার জন্য সতর্ক করেছেন, এর প্রমাণ হচ্ছে রসূল -এর বাণী যা একাধিক সনদে বর্ণিত হয়েছে: (إِنْ يَخْرُج وَأأنَافِيكُمْ فَأَنَا حَخِيجه) “যদি আমি তোমাদের নিকট বর্তমান থাকা অবস্থায় সে প্রকাশ পায় তাহলে আমি তাকে পরাজিত করব।" এ হাদীস থেকে জানা যায় তার এ কথাটি ছিল তখনকার জন্য প্রযোজ্য যখন দাজ্জালের আগমনের সময় এবং তার নিদর্শন তার নিকট অস্পষ্ট ছিল। ফলে সম্ভাবনা ছিল যে, সে তার জীবদ্দশাতেই আসতে পারে। পরবর্তীতে তিনি তার আগমনের সময় সম্পর্কে অবগত হতে পেরেছেন তাই তিনি এ ব্যাপারে সংবাদ দিয়েছেন। এভাবে সমস্ত হাদীসের মাঝে সমন্বয় হয়ে গেল। ('আওনুল মা'বুদ ৭/৪৩০৮)।
(أَلَا إِنَّهُ أَعْوَرُ وَإِنَّ رَبَّكُمْ لَيْسَ بِأَعْوَرَ) “সাবধান, নিশ্চয় সে ত্রুটিপূর্ণ চক্ষুবিশিষ্ট আর তোমাদের প্রতিপালক ত্রুটিপূর্ণ চক্ষুবিশিষ্ট নন।”
দাজ্জালের মধ্যে অনেকগুলো নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও শুধু এটিকে উল্লেখ করেই ক্ষ্যান্ত হয়েছে এর কারণ হলো এ বৈশিষ্ট্যটি জ্ঞানী এবং সাধারণ মানুষ সকলেই অনুভব করতে পারে। এমনকি যারা যুক্তি প্রমাণ বুঝে তারাও। যদি সে সৃষ্টিগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ইলাহ দাবী করে তাহলে বুঝতে হবে নিশ্চয় সে মিথ্যাবাদী। ('আওনুল মা'বূদ ৭/৪৩০৮)
মিরকাতুল মাফাতীহ গ্রন্থকার বলেন, (وَإِنَّ رَبَّكُمْ لَيْسَ بِأَعْوَرَ) তথা তোমাদের রব সত্তাগত ও গুণগত দিক থেকে ত্রুটিমুক্ত। নবী (সা.) এই কথাকে সাধারণ মানুষের বিবেক অনুযায়ী বোধগম্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। যেহেতু তিনি বলেছেন-(كَلِّمِ النَّاسَ عَلَى قَدْرِ عُقُولِهِمْ) অর্থাৎ তুমি মানুষের সাথে কথা বল তার বিবেক অনুপাতে। পবিত্র কুরআনে ও এ নীতি অবলম্বন করা হয়েছে,
(اِنَّ الَّذِیۡنَ تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ عِبَادٌ اَمۡثَالُکُمۡ فَادۡعُوۡهُمۡ فَلۡیَسۡتَجِیۡبُوۡا لَکُمۡ اِنۡ کُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ ﴿۱۹۴﴾ اَلَهُمۡ اَرۡجُلٌ یَّمۡشُوۡنَ بِهَاۤ ۫ اَمۡ لَهُمۡ اَیۡدٍ یَّبۡطِشُوۡنَ بِهَاۤ ۫ اَمۡ لَهُمۡ اَعۡیُنٌ یُّبۡصِرُوۡنَ بِهَاۤ ۫ اَمۡ لَهُمۡ اٰذَانٌ یَّسۡمَعُوۡنَ بِهَا ؕ قُلِ ادۡعُوۡا شُرَکَآءَکُمۡ ثُمَّ کِیۡدُوۡنِ فَلَا تُنۡظِرُوۡنِ ﴿۱۹۵﴾) “আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাক তারা তোমাদের মতোই বান্দা। (ঠিক আছে) তাদেরকে ডাকতে থাক, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাক তাহলে তারা তোমাদের ডাকে সাড়া দিক।
তাদের কি পা আছে যা দিয়ে তারা চলাফেরা করে? তাদের কি হাত আছে যা দিয়ে তারা ধরে? তাদের কি চোখ আছে যা দিয়ে তারা দেখে? তাদের কি কান আছে যা দিয়ে তারা শোনে? বল, তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরীক করছ তাদেরকে আহ্বান কর, আর আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কর এবং আমাকে অবকাশ দিও না।" (সূরা আল আ'রাফ ৭: ১৯৪-১৯৫)
এ এই আয়াতদ্বয় দ্বারা আল্লাহ বুঝতে চেয়েছেন কাফিরদের মূর্তিগুলো খুবই অসহায়; তাদের হাত, পা, চোখ, কান কিছুই নেই। অতএব কি করে এগুলো মা'বুদ হওয়ার যোগ্যতা রাখে? এর অর্থ এই নয় যে, যদি তাদের এই অঙ্গগুলো থাকত, তাহলে তারা মা'বুদ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করত। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৪৫৭১)
(مَكْتُوبٌ بَيْنَ عَيْنَيْهِ: ك ف ر) তার দুই চোখের মাঝে তথা কপালে লেখা থাকবে কাফির। এ থেকে বুঝা যায় যে, সে মানুষকে কুফরীর দিকে ডাকবে, হিদায়াতের দিকে নয়। অতএব পরিহার করা উচিত। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে এই উম্মতের জন্য একটি বিরাট নি'আমাত যে, তিনি তার দু’ চোখের মাঝে কাফির কথাটি লিখে দিয়েছেন।
ইমাম নববী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, দাজ্জাল একজন মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটা স্পষ্ট দলীল, যা দেখে প্রত্যেকে চিনে নিতে পারবে। শুধু দেহের বর্ণনা দিয়েই শেষ করা হয়নি, কেননা অনেক বিবেক তা দেখেও বুঝতে পারবে না। (মিরকাতুল মাফাতীহ ৪৫৭১)