পরিচ্ছেদঃ ১১. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - কারো সম্পদে অন্যায় হস্তক্ষেপ, ঋণ ও ক্ষতিপূরণ
২৯৫৩-[১৬] হাসান বসরী (রহঃ) সামুরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ কোনো ব্যক্তি যখন কোনো পশুপালের কাছে (ক্ষুধার্ত অবস্থায়) পৌঁছে; তখন সেখানে যদি তাদের মালিক থাকে, তবে সে যেন তার নিকট হতে অনুমতি নেয়। আর যদি সেখানে মালিক না থাকে, সেক্ষেত্রে সে যেন তিনবার শব্দ করে। যদি কেউ তাতে সাড়া দেয়, তবে তার নিকট হতে যেন অনুমতি নেয়। আর যদি কেউ সাড়া না দেয়, সেক্ষেত্রে সে দুধ দোহন করে পান করবে, আর সাথে করে যেন নিয়ে না যায়। (আবূ দাঊদ)[1]
وَعَن الْحسن عَن سَمُرَة أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِذَا أَتَى أَحَدُكُمْ عَلَى مَاشِيَةٍ فَإِنْ كَانَ فِيهَا صَاحِبُهَا فَلْيَسْتَأْذِنْهُ وَإِنْ لَمْ يَكُنْ فِيهَا فَلْيُصَوِّتْ ثَلَاثًا فَإِنْ أَجَابَهُ أَحَدٌ فَلْيَسْتَأْذِنْهُ وَإِنْ لَمْ يُجِبْهُ أَحَدٌ فَلْيَحْتَلِبْ وَلْيَشْرَبْ وَلَا يَحْمِلْ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যা: খত্ত্বাবী বলেনঃ এ অনুমতি ঐ দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে খাদ্য পায় না। এমতাবস্থায় সে নিজের ব্যাপারে ধ্বংসের আশংকা করে, সুতরাং যখন এরূপ হবে তখন তার জন্য এরূপ কাজ করা বৈধা হবে। কতক হাদীসবিশারদ ঐ দিকে গিয়েছেন, এটা এমন বিষয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এর মালিক করে দিয়েছেন। সুতরাং তা তার জন্য বৈধ। এতে তার জন্য মূল্য আবশ্যক হবে না। অধিকাংশ ফিকহবিদগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, তার জন্য মূল্য আবশ্যক। যখন মূল্য পরিশোধ করতে সক্ষম হবে তখন তা মালিককে প্রদান করবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (لَا يَحِلّ مَالُ امْرِئٍ مُسْلِم إِلَّا بِطِيبَةٍ مِنْ نَفْسه) কোনো মুসলিম ব্যক্তির সম্পদ তার সন্তুষ্টি ছাড়া বৈধ হবে না।
হাফিয শামসুদ্দীন ইবনুল কইয়িম (রহঃ) বলেনঃ বায়হাক্বী ইয়াযীদ বিন হারূন-এর হাদীস হতে বর্ণনা করেন, তিনি সা‘ঈদ আল জারীরী থেকে, তিনি আবূ নাযরাহ্ হতে, তিনি আবূ সা‘ঈদ আল খুদরী হতে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
فَلْيَحْلُبْ وَلْيَشْرَبْ وَلَا يَحْمِلَنَّ وَإِذَا أَتٰى أَحَدكُمْ عَلٰى حَائِط فَلْيُنَادِ ثَلَاثًا يَا صَاحِب الْحَائِط فَإِنْ أَجَابَه وَإِلَّا فَلْيَأْكُلْ وَلَا يَحْمِلَنَّ وَهٰذَا الْإِسْنَاد عَلٰى شَرْط مُسْلِم
অর্থাৎ- তোমাদের কেউ যখন রাখালের কাছে আসবে তখন সে যেন আহবান করে, হে উটের রাখাল! তিনবার, অতঃপর রাখাল যদি তার ডাকে সাড়া দেয়, তাহলে তাকে যা বলার বলবে আর যদি সাড়া না দেয় তাহলে সে যেন উটের দুধ দোহন করে এবং পান করে, সঙ্গে যেন বহন না করে। আর তোমাদের কেউ যখন কোনো বাগানের কাছে আসবে তখন সে যেন আহবান করে, তিনবার- হে বাগানের মালিক! অতঃপর বাগানের মালিক যদি তার ডাকে সাড়া দেয় তাহলে তাকে যা বলার তা তাকে বলবে আর সাড়া না দিলে খাবে। এমতাবস্থায় সঙ্গে নিয়ে যাবে না। এ সূত্রটি মুসলিম-এর শর্তে। এর সানাদে সা‘ঈদ আল জারীরী একক হওয়ার কারণে কেবল বায়হাক্বী একে ত্রুটিযুক্ত সাব্যস্ত করেছেন, আর তার শেষ বয়সে ব্রেইনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, আর তার থেকে ইয়াযীদ বিন হারূন-এর শ্রবণ শেষ বয়সে। আর সামুরার হাদীসকে ত্রুটিযুক্ত সাব্যস্ত করেছেন সামুরাহ্ হতে হাসান-এর হাদীস শ্রবণে মতানৈক্যের কারণে। রাবীদ্বয়ের বিশুদ্ধতার পর এ দু’টি ত্রুটি হাদীসদ্বয়কে হাসান-এর স্তর হতে বের করে দিতে পারবে না। জুমহূরের নিকট হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে যে হাসানের মাধ্যমে দলীল গ্রহণ করা হয়। ইমাম আহমাদ-এর দু’ মতের মধ্যে এক মতানুযায়ী এ হাদীসদ্বয়ের উপর ‘আমল করার কথা বলেছেন।
ইমাম শাফি‘ঈ বলেনঃ নিঃসন্দেহে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি বাগানের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে সে যেন খায় এবং সাথে যেন নিয়ে না যায়। এ ক্ষেত্রে একটি হাদীস বর্ণনা করা হয়েছে, যদি আমাদের কাছে তা প্রমাণিত হয়, তাহলে তার বিরোধিতা করব না। কুরআন এবং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, অনুমতি ছাড়া কারো সম্পদ ভক্ষণ করা বৈধ না। আর যে হাদীসটির দিকে ইমাম শাফি‘ঈ ইঙ্গিত করেছেন তা হলো, ইমাম তিরমিযী ইয়াহ্ইয়া বিন সুলায়ম হতে বর্ণনা করেন, তিনি ‘উবায়দুল্লাহ বিন ‘উমার হতে, তিনি নাফি‘ হতে, তিনি ‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার হতে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ (مَنْ دَخَلَ حَائِطًا لِيَأْكُلغَيْر مُتَّخِذ خُبْنَة) অর্থাৎ- ‘‘যে ব্যক্তি বাগানে প্রবেশ করবে সে যেন খায় এবং সাথে যেন নিয়ে না যায়।’’ এ হাদীসটি গরীব, এ হাদীসটি আমি ইয়াহ্ইয়া বিন সুলায়ম-এর সানাদ ছাড়া অন্য কারো সানাদে জানি না। (‘আওনুল মা‘বূদ ৫ম খন্ড, হাঃ ২২৫৪)
ইয়াহ্ইয়া বিন সুলায়ম বলেন, কুতায়বাহ্ আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন, তিনি বলেন, লায়স আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন, তিনি ইবনু আযলান হতে, তিনি ‘আমর বিন শু‘আয়ব হতে, তিনি তার পিতা হতে, তিনি তার দাদা হতে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে ঝুলন্ত ফল সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো, জওয়াবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, অর্থাৎ- যে ব্যক্তি নিরুপায় হয়ে তা থেকে কিছু খায় এবং সাথে না নিয়ে যায়, তার ওপর কোনো অভিযোগ নেই। (তিরমিযী হাঃ ১২৮৯ : হাসান) অতঃপর তিনি বলেছেন, এটি একটি হাসান হাদীস, এ হাদীসগুলো গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিদ্বানগণ মতানৈক্য করেছেন।
একদল ঐ দিকে গিয়েছেন যে, এগুলোর হুকুম কার্যকর, প্রয়োজন এবং প্রয়োজন ছাড়া ফল খাওয়া এবং দুধ পান করা বৈধ হবে এবং এতে তার ওপর যিম্মাদারিত্ব থাকবে না, এটা ইমাম আহমাদ-এর প্রসিদ্ধ মত। একদল বলেন, এ হতে কোনো কিছুই তার জন্য বৈধ নয়, তবে প্রয়োজনে খেতে ও পান করতে পারবে কিন্তু তার মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এটা মালিক, শাফি‘ঈ ও আবূ হানীফাহ্ হতে বর্ণিত, এ মতের স্বপক্ষে তারা অনেক দলীল উপস্থাপন করেছেন সেগুলোর একটি হলো- মহান আল্লাহর বাণীঃ يٰاَيُّهَا الَّذِينَ اٰمَنُوا لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلَّا أَنْ تَكُونَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ অর্থাৎ- ‘‘হে মু’মিনগণ! যারা ঈমান এনেছো তোমরা অন্যায়ভাবে তোমাদের পরস্পরের মাঝে তোমাদের সম্পদসমূহ খেয়ে ফেলো না, তবে তোমাদের সন্তুষ্টচিত্তে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে’’- (সূরা আন্ নিসা ৪ : ২৯)। আর উপরে বর্ণিত পদ্ধতিতে পারস্পরিক সন্তুষ্টি অনুপস্থিত।
দ্বিতীয় : বাগান এবং চতুস্পদ জন্তু যদি কোনো ইয়াতীমের হয়ে থাকে, আর কোনো ব্যক্তি যদি তাত্থেকে খায়, তাহলে সে অন্যায়ভাবে ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ করল। সুতরাং সে শাস্তিযোগ্য বলে গণ্য হবে।
তৃতীয় : ইমাম বুখারী ও মুসলিম তাদের বিশুদ্ধ কিতাবদ্বয়ে আবূ বাকরাহ্ হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজে/হজ্জে তাঁর ভাষণে বলেছেনঃ (إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هٰذَا فِي شَهْرِكُمْ هٰذَا) অর্থাৎ- নিশ্চয় তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের সম্মান তোমাদের ওপর হারাম তোমাদের এ মাসে, তোমাদের এ শহরে, তোমাদের এ দিনের হারামের মতো এবং সহীহ মুসলিমে জাবির হতে অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। (শারহে মুসলিম- ইমাম নববী, হাঃ ১৪৫-[১২১৭])
চতুর্থ : যা সহীহাতে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত, নিশ্চয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ (كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُه وَمَا لُه وَعِرْضُه) অর্থাৎ- প্রত্যেক মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও তার সম্মান অপর মুসলিমের ওপর হারাম। (ফাতহুল বারী ১০ম খন্ড, হাঃ ৬০৪২)
পঞ্চম : বায়হাক্বী বিশুদ্ধ সানাদে ইবনু ‘আব্বাস থেকে যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, নিশ্চয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজে/হজ্জে ভাষণ দিলেন- আর তাতে আছে : ولا يحل لامرىء مِنْ مَالِ أَخِيهِ إِلَّا مَا أَعْطَاهُ عَنْ طِيب نَفْسٍ অর্থাৎ- কোনো ব্যক্তির জন্য তার ভাইয়ের সম্পদ হতে কিছুই বৈধ হবে না, তিনি তাকে সন্তুষ্টিচিত্তে যা দান করবেন তা ছাড়া।
ষষ্ঠ : মুসলিম যা তার সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, ‘আবদুল্লাহ বিন ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত, যা তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে বললেন, (لَا يَحْلُبَنَّ أَحَدٌ مَاشِيَةَ امْرِئٍ بِغَيْرِ إِذْنِه أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَنْ يُؤْتى مَشْرَبَتَهَ فَتَكْسَرَ خَزَانَتُه) অর্থাৎ- তোমাদের কেউ তার ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া তার ভাইয়ের চতুস্পদ জন্তুর দুধ দোহন না করে, তোমাদের কেউ কি তার পানপাত্রে এসে, অতঃপর তার সংরক্ষনাগারের দরজা ভেঙ্গে ফেলাকে পছন্দ করে?... আল হাদীস।
সপ্তম : নিশ্চয় এটা মুসলিম ব্যক্তির সম্পদ, সুতরাং তা তার সমস্ত সম্পদের মতো হারাম।
পূর্ববর্তীরা বলেন, তোমরা যা উল্লেখ করেছ তাতে এমন কিছু নেই যা বৈধতার হাদীসগুলোর বিরোধিতা করবে, তবে একমাত্র ইবনু ‘উমার-এর হাদীস যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে সামুরার হাদীসের বিরোধী। তবে এদের মাঝে সমন্বয় সাধনের সুযোগ আছে। আর মহান আল্লাহর لَا تَأْكُلُوا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ (সূরা আন্ নিসা ৪ : ২৯) এ বাণী বিরোধের স্থানকে শামিল করছে না, কেননা এটা শারী‘আত প্রণেতার বৈধতার মাধ্যমে খাওয়া। সুতরাং কিভাবে অবৈধ হবে? আর এটা কোনো বিষয়ে ‘আমকে খাসকরণের বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত না, বরং এ ধরণটি আয়াতের মাঝে প্রবেশ করেনি। যেমনিভাবে আয়াতের মাঝে সন্তানের সম্পদ পিতার খাওয়া নিষেধ করেনি। অধিকন্তু আল্লাহর এ বাণী কেবল অন্যায়ভাবে সম্পদ ভক্ষণের উপর প্রমাণ বহন করছে, যে সম্পদ ভক্ষণের ব্যাপারে শারী‘আত প্রণেতা ও সম্পদের মালিক অনুমতি দেয়নি। সুতরাং যখন শারী‘আত অনুমতি অথবা মালিকের তরফ হতে অনুমতি পাওয়া যাবে তখন বাতিল হবে না। আর জ্ঞাতব্য যে, শারী‘আতের অনুমতি সম্পদের মালিকের অনুমতি অপেক্ষা শক্তিশালী। সুতরাং যে সম্পদে মালিক অনুমতি দিবে সে সম্পদ অপেক্ষা ঐ সম্পদ অধিক হালাল হবে যে সম্পদে শারী‘আত অনুমতি দিবে। আর এ কারণেই গনীমাতের সম্পদ সর্বাধিক হালাল ও উত্তম, উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত এবং পিতার দিকে সম্বন্ধ করে সন্তানের সম্পদ সর্বাধিক উত্তম সম্পদের অন্তর্ভুক্ত। (‘আওনুল মা‘বূদ ৫ম খন্ড, হাঃ ২৬১৬)