পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) (مُعْجِزَاتِ)-এর পরিচয় সম্পর্কে বলেন, (مُعْجِزَاتِ) হলো নবীগণের সত্যতার প্রমাণ এবং রাসূলগণের বিভিন্ন নিদর্শন, যা অন্য কেউ দেখাতে অক্ষম। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
৫৮৬৮-[১] আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেছেন, (হিজরতের সময়) আমি আমাদের মাথার উপরে মুশরিকদের পা দেখতে পেলাম, যখন আমরা গুহায় ছিলাম। তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! যদি তাদের কেউ স্বীয় পায়ের দিকে তাকায়, তবে সে আমাদেরকে দেখে ফেলবে। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, হে আবূ বকর! তুমি এমন দুই লোক সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ কর, যাদের তৃতীয়জন হলেন স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّ أَبَا بَكْرٍ الصّديق رَضِي الله عَنهُ قا ل: نظرتُ إِلى أقدامِ المشركينَ على رؤوسنا وَنَحْنُ فِي الْغَارِ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ لَوْ أَنَّ أَحَدَهُمْ نَظَرَ إِلَى قَدَمِهِ أَبْصَرَنَا فَقَالَ: «يَا أَبَا بَكْرٍ مَا ظَنُّكَ بِاثْنَيْنِ اللَّهُ ثالثهما»
متفق علیہ ، رواہ البخاری (3653) ومسلم (1 / 2381)، (6169) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (وَنَحْنُ فِي الْغَارِ) অর্থাৎ আমরা সওর গুহায় ছিলাম। মিরক্বাত প্রণেতা বলেন, (غَارِ) (গর্ত) বলতে এখানে বুঝানো হয়েছে সাওর গুহাকে। হিজরত করার সময় যেখানে রাসূল (সা.) আবূ বাকর (রাঃ) কাফিরদের থেকে আত্মগোপন করেছিলেন।
ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (غَارِ) হলো মক্কা নগরীর মিনায় সাওর পাহাড়ের উপর অবস্থিত একটি গর্ত যা রাসূল (সা.) -এর বাসগৃহ থেকে একটু দূরেই অবস্থিত।
কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন, মুশরিকরা রাসূল (সা.) -কে খোঁজ করতে সাওর পাহাড়ের সেই গুহার উপর উঠে পড়ে। তখন আবূ বাকর (রাঃ) শঙ্কিত হয়ে বলেন, যদি তারা আজ আপনাকে পেয়ে যায় তাহলে আল্লাহর দীন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি তাদের কেউ নিজের পায়ের নিচে তাকায় তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে দেখে ফেলবে।
তখন রাসূল (সা.) আবূ বাকর (রাঃ)-কে বললেন, (مَا ظَنُّكَ بِاثْنَيْنِ اللَّهُ ثالثهما) অর্থাৎ এমন দু'জনের ব্যাপারে তোমার কি ধারণা? যাদের তৃতীয়জন হিসেবে আল্লাহ আছেন।
এ বিষয়টি পবিত্র কুরআন এভাবে তুলে ধরেছে,
(اِلَّا تَنۡصُرُوۡهُ فَقَدۡ نَصَرَهُ اللّٰهُ اِذۡ اَخۡرَجَهُ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا ثَانِیَ اثۡنَیۡنِ اِذۡ هُمَا فِی الۡغَارِ اِذۡ یَقُوۡلُ لِصَاحِبِهٖ لَا تَحۡزَنۡ اِنَّ اللّٰهَ مَعَنَا…) অর্থাৎ “যদি তোমরা তাকে সাহায্য না কর (তাতে কোন পরোয়া নেই) কারণ আল্লাহ তো তাকে সেই সময় সাহায্য করেছেন যখন কাফিররা তাকে বের করে দিয়েছিল, সে ছিল দু’জনের দ্বিতীয় জন। যখন তারা দু’জন গুহার মধ্যে ছিল। যখন সে তার সঙ্গীকে বলছিল, চিন্তা করো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন...।” (সূরাহ্ আত্ তাওবাহ্ ৯: ৪০)।
আরো বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা.) বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তাদের চক্ষু অন্ধ করে দিন। অতঃপর তারা সেই গর্তের আশপাশে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সাথে ঘুরতে লাগল আর তারা বুঝতেও পারলো না যে, আল্লাহ তাদের দৃষ্টি শক্তি সেখান থেকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন।
ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (اللَّهُ ثالثهما) এর অর্থ হলো আল্লাহ তাদের দুজনকে তিনজন বানিয়ে দিয়েছেন নিজেকে তাদের সাথে বিশেষভাবে যুক্ত করার মাধ্যমে। অতএব তারা বাহ্যিকভাবে দু’জন হলেও সাহায্যকারী হিসেবে আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৬৯-[২] বারা ইবনু ’আযিব (রাঃ) তাঁর পিতা হতে বর্ণনা করেন। একদিন (বারা ইবনু ’আযিব) আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) লক্ষ্য-কে বললেন, হে আবূ বকর! আমাকে বলুন তো, যে রাত্রে আপনি রাসূলুল্লাহ (সা.) - এর সাথে (হিজরতের উদ্দেশে) ভ্রমণ করেছিলেন, সে ভ্রমণে আপনারা কিরূপ করেছিলেন? আবূ বকর (রাঃ) বললেন, আমরা এক রাত্র এবং পরবর্তী দিন পথ চলতে থাকি। পরিশেষে যখন দ্বিপ্রহর হলো এবং পথঘাট এতটা শূন্য হয়ে পড়ল যে, একটি প্রাণীও তাতে যাতায়াত ও চলাফেরা করছে না। এমন সময় বিশাল একটি লম্বা পাথর আমাদের দৃষ্টিতে পড়ল। তার একপার্শ্বে ছিল ছায়া। সেখানে সূর্যের রোদ পড়ত না। তখন আমরা সেখানে অবতরণ করলাম এবং আমি নিজ হাতে নবী (সা.) -এর জন্য কিছুটা জায়গা সমান করলাম যাতে তিনি শয়ন করতে পারেন। অতঃপর আমি একখানা (চামড়ার) চাদর বিছিয়ে দিয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি আপনার (নিরাপত্তার) জন্য এদিক-ঐদিক বিশেষভাবে খেয়াল রাখব। তখন নবী (সা.) শুয়ে পড়লেন। আমি বের হয়ে চতুর্দিক হতে তাঁকে পাহারা দিতে লাগলাম। হঠাৎ আমি দেখতে পেলাম, একজন মেষচালক তার বকরির পাল নিয়ে পাথরটির দিকে আগাচ্ছে। আমি বললাম, তুমি কি তা (আমাদের জন্য) দোহন করবে? সে বলল, হ্যাঁ। অতঃপর সে একটি বকরি ধরে আনল। তারপর সে একটি পাত্রে দুধ দোহন করল। এদিকে আমার কাছেও একটি পাত্র ছিল, যা আমি নবী (সা.) -এর জন্য সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম, যেন তা দিয়ে তিনি তৃপ্তি সহকারে পানি পান এবং উযূ করতে পারেন। অতঃপর আমি (দুধের পেয়ালাটি হাতে করে) নবী (সা.) -এর কাছে আসালাম। কিন্তু তাকে ঘুম হতে জাগানো ভালো মনে করলাম না। কিছুক্ষণ পরে আমি তাকে জাগ্রত অবস্থায় পেলাম। ইতোমধ্যে আমি দুধের সাথে (তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা করার উদ্দেশে) কিছু পানি মিশ্রিত করলাম। তাতে দুধের নিম্নাংশ অবধি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। তারপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পান করুন। তিনি পান করলেন, এতে আমি খুবই খুশি হলাম। অতঃপর তিনি (সা.) বললেন, আমাদের রওয়ানা হওয়ার সময় কি এখনো হয়নি? আমি বললাম, হ্যাঁ, হয়েছে। আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) বলেন, আমরা সূর্য ঢলে যাওয়ার পর রওয়ানা হলাম। এদিকে সুরাকাহ্ ইবনু মালিক আমাদের অনুসরণ করেছিল। আমি (তাকে দেখতে পেয়ে) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! (শত্রু) আমাদের নিকট এসে পড়েছে।
তিনি (সা.) বললেন, চিন্তা করো না। মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদের সাথে আছেন। এরপর নবী (সা.) সুরাকার জন্য বদদু’আ করলেন। ফলে তার ঘোড়াটি তাকে নিয়ে পেট পর্যন্ত শক্ত মাটিতে গেড়ে গেল। তখন সুরাকাহ্ বলে উঠল, আমার বিশ্বাস তোমরা আমার প্রতি বদদু’আ করেছ। অতএব তোমরা আল্লাহর কাছে আমার জন্য দু’আ কর, আল্লাহই তোমাদের সাহায্যকারী। আমি তোমাদেরকে ওয়াদা দিচ্ছি যে, তোমাদের অন্বেষণকারীদের ফিরিয়ে দেব। নবী (সা.) তখন তার জন্য দু’আ করলেন। ফলে সে মুক্তি পেল। তারপর যার সাথেই তার দেখা হত তাকে সে বলত, তোমাদের কাজ আমি সেরে এসেছি। তারা সেদিকে নেই। এমনিভাবে যার সাথে তার সাক্ষাৎ হত, তাকেই সে ফিরিয়ে দিত। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنِ الْبَرَاءِ بْنِ عَازِبٍ عَنْ أَبِيهِ أَنَّهُ قَالَ لِأَبِي بَكْرٍ: يَا أَبَا بَكْرٍ حَدِّثْنِي كَيْفَ صَنَعْتُمَا حِينَ سَرَيْتَ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَسْرَيْنَا لَيْلَتَنَا وَمِنَ الْغَدِ حَتَّى قَامَ قَائِمُ الظَّهِيرَةِ وَخَلَا الطَّرِيقُ لَا يَمُرُّ فِيهِ أَحَدٌ فَرُفِعَتْ لَنَا صَخْرَةٌ طَوِيلَةٌ لَهَا ظِلٌّ لَمْ يَأْتِ عَلَيْهَا الشَّمْسُ فَنَزَلْنَا عِنْدَهَا وَسَوَّيْتُ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَكَانًا بِيَدَيَّ يَنَامُ عَلَيْهِ وَبَسَطْتُ عَلَيْهِ فَرْوَةً وَقُلْتُ نَمْ يَا رسولَ الله وَأَنَا أَنْفُضُ مَا حَوْلَكَ فَنَامَ وَخَرَجْتُ أَنْفُضُ مَا حَوْلَهُ فَإِذَا أَنَا بِرَاعٍ مُقْبِلٍ قُلْتُ: أَفِي غنمكَ لبنٌ؟ قَالَ: نعم قلتُ: أفتحلبُ؟ قَالَ: نَعَمْ. فَأَخَذَ شَاةً فَحَلَبَ فِي قَعْبٍ كُثْبَةً مِنْ لَبَنٍ وَمَعِي إِدَاوَةٌ حَمَلْتُهَا لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَرْتَوَى فِيهَا يَشْرَبُ وَيَتَوَضَّأُ فَأَتَيْتُ الْنَبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَكَرِهْتُ أَنْ أُوقِظَهُ فَوَافَقْتُهُ حَتَّى اسْتَيْقَظَ فَصَبَبْتُ مِنَ الْمَاءِ عَلَى اللَّبَنِ حَتَّى بَرَدَ أَسْفَلُهُ فَقُلْتُ: اشْرَبْ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَشَرِبَ حَتَّى رضيت ثمَّ قَالَ: «ألم يَأن الرحيل؟» قلتُ: بَلى قَالَ: فارتحلنا بعد مَا مَالَتِ الشَّمْسُ وَاتَّبَعَنَا سُرَاقَةُ بْنُ مَالِكٍ فَقُلْتُ: أُتِينَا يَا رَسُولَ اللَّهِ فَقَالَ: «لَا تَحْزَنْ إِنَّ اللَّهَ مَعَنَا» فَدَعَا عَلَيْهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَارْتَطَمَتْ بِهِ فَرَسُهُ إِلَى بَطْنِهَا فِي جَلَدٍ مِنَ الْأَرْضِ فَقَالَ: إِنِّي أَرَاكُمَا دَعَوْتُمَا عَلَيَّ فَادْعُوَا لِي فَاللَّهُ لَكُمَا أَنْ أَرُدَّ عَنْكُمَا الطَّلَبَ فَدَعَا لَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَنَجَا فَجَعَلَ لَا يلقى أحدا إِلا قَالَ كفيتم مَا هَهُنَا فَلَا يَلْقَى أَحَدًا إِلَّا رَدَّهُ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (3615) و مسلم (75 / 2009)، (5238) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (حَتَّى قَامَ قَائِمُ الظَّهِيرَةِ) অর্থাৎ দ্বিপ্রহর পর্যন্ত। মিরকাত প্রণেতা বলেন, দ্বিপ্রহর মানে হলো সূর্য যখন মধ্যাকাশে উঠে যায়। এখানে উক্ত বাক্য দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, সূর্য যখন মধ্যাকাশে পৌছে যায় তখন থেকে নিয়ে চলে যাওয়া পর্যন্ত তার ছায়া থেমে থাকে। তখন মানুষেরা তা দেখে মনে করে যে, সূর্য যেন একেবারে স্থির হয়ে গেছে। আর নড়াচড়া করছে না। অথচ তা চলমান রয়েছে। কিন্তু তার চলমানের দৃশ্যটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যেমন পরিলক্ষিত হত সে সময়ের আগে বা পরে। তাই এ বিষয়টি আরবরা এভাবে বলে থাকে (قَامَ قَائِمُ الظَّهِيرَةِ) অর্থাৎ দ্বিপ্রহর হলো।
(فَاللَّهُ لَكُمَا) অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের দুজনের জন্য রয়েছেন। মিরক্বাত প্রণেতা বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তোমাদের দুজনের জন্য রক্ষাকারী ও সাহায্যকারী হিসেবে থাকবেন যতক্ষণ না তোমরা নিরাপত্তার সাথে তোমাদের উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছবে।
অথবা এটিও উদ্দেশ্য হতে পারে যে, তোমরা দুজন আমার জন্য দু'আ করো, যেন আমি তোমাদের থেকে ফিরে যেতে পারি। আর অবশ্যই আল্লাহ তোমাদেরকে আমার থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়েছেন এবং তোমাদের কাছে পৌছা থেকে আমাকে আটকে দিয়েছেন।
ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তোমরা দুজন আমার জন্য দু'আ করো যেন আমি এই বিপদ থেকে মুক্তি পাই। কেননা যদি তোমরা তা করো তাহলে আল্লাহই দেখবেন যে, আমি তোমাদের থেকে অনুসন্ধানকারীদেরকে ফিরিয়ে দিবো।
(أَنْ أَرُدَّ عَنْكُمَا الطَّلَبَ) অর্থাৎ আমি তোমাদের থেকে অনুসন্ধান ফিরিয়ে দিবো। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, যে সকল কাফির তোমাদের দু'জনকে খুঁজতে আসবে আমি তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে চাইবো।
ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ হাদীসে বিভিন্নভাবে নবী (সা.) -এর জন্য রয়েছে প্রকাশ্য মু'জিযাহ্ আর আবূ বাকর (রাঃ) -এর জন্য রয়েছে উত্তম ফযীলত। এতে রয়েছে অনুসরণীয় ব্যক্তিকে অনুসারী ব্যক্তির পক্ষ থেকে উত্তমরূপে সেবা করার একটি মূল্যবান শিক্ষা। এতে আরো আছে যে, পবিত্রতা অর্জন করার জন্য এবং পান করার জন্য সফরে সাথে ছোট পাত্র রাখা ভালো। আর বিশেষ করে এ হাদীস থেকে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয়েছে তা হলো, আল্লাহর প্রতি ভরসা করার উত্তম ফযীলত ও কল্যাণকর পরিণতি। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭০-[৩] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ’আবদুল্লাহ ইবনু সালাম রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মদীনায় আগমনের সংবাদ শুনতে পেলেন। এ সময় তিনি নিজের এক বাগানে খেজুর পাড়ছিলেন। অতঃপর নবী (সা.) -এর কাছে এসে বললেন, আমি আপনাকে এমন তিনটি প্রশ্ন করব, যা নবী ছাড়া আর কেউই জানে না।
১. কিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামত কি?
২. জান্নাতবাসীদের সর্বপ্রথম খাদ্য কি?
৩. কিসের কারণে সন্তান (আকৃতিতে) কখনো তার পিতার মতো হয়, আবার কখনো তার মায়ের মতো হয়?
নবী (সা.) বললেন, এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জিবরীল আলায়হিস সালাম এইমাত্র আমাকে অবহিত করে গেলেন। কিয়ামতের সর্বপ্রথম আলামাত হলো একটি আগুন, যা লোকেদেরকে পূর্ব দিকে হতে পশ্চিম দিকে সমবেত করে নিয়ে যাবে। আর জান্নাতবাসীগণ সর্বপ্রথম যে খাদ্য খাবে, তা হলো মাছের কলিজার অতিরিক্ত টুকরা আর (সন্তানাদির বিষয়টি) যদি নারীর বীর্যের উপর পুরুষের বীর্যের প্রাধান্য ঘটে, তবে সন্তান বাপের মতো হয়। আর যদি নারীর বীর্যের প্রাধান্য ঘটে, তবে সন্তান মায়ের রূপ ধারণ করে। তখন ’আবদুল্লাহ ইবনু সালাম বলে উঠলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ তা’আলা ছাড়া ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য কেউ নেই এবং নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল।
(অতঃপর তিনি বললেন) হে আল্লাহর রাসূল! ইয়াহূদীরা এমন একটি জাতি, যারা অপবাদ আনবে। অতঃপর ইয়াহুদীগণ নবী (সা.) -এর কাছে আসলে তিনি তাদেরকে প্রশ্ন করলেন, তোমাদের মাঝে আবদুল্লাহ কে? তার উত্তরে বলেন, আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম লোক এবং সর্বোত্তম ব্যক্তির সন্তান। তিনি আমাদের নেতা এবং আমাদের নেতার সন্তান। তখন নবী (সা.) বললেন, আচ্ছা বল তো, আবদুল্লাহ ইবনু সালাম যদি ইসালাম গ্রহণ করে, তখন তারা বলে উঠল, আল্লাহ তা’আলা তাকে তা হতে রক্ষা করুন। এমন সময় ’আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (আড়াল হতে) বের হয়ে এসে কালিমাহ্ উচ্চারণ করে বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাসনার যোগ্য কেউ নেই এবং নিশ্চয় মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল। তখন তারা (ইয়াহূদীরা) বলতে লাগল, (এ লোকটি) আমাদের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তির সন্তান। অতঃপর তারা তাকে খুব তাচ্ছিল্যভাবে তুচ্ছ প্রতিপন্ন করল। তখন ’আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! (এদের ব্যাপারে) আমি এটাই আশঙ্কা করেছিলাম। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن أنس قا ل سَمِعَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَلَامٍ بِمَقْدَمِ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ فِي أَرْضٍ يَخْتَرِفُ فَأَتَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ إِنِّي سَائِلُكَ عَنْ ثَلَاثٍ لَا يَعْلَمُهُنَّ إِلَّا نَبِيٌّ: فَمَا أَوَّلُ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ وَمَا أَوَّلُ طَعَامِ أَهْلِ الْجَنَّةِ؟ وَمَا يَنْزِعُ الولدُ إِلَى أبيهِ أَو إِلَى أمه؟ قا ل: «أَخْبرنِي بهنَّ جِبْرِيلُ آنِفًا أَمَّا أَوَّلُ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ فَنَارٌ تَحْشُرُ النَّاسَ مِنَ الْمَشْرِقِ إِلَى الْمَغْرِبِ وَأَمَّا أَوَّلُ طَعَامٍ يَأْكُلُهُ أَهْلُ الْجَنَّةِ فَزِيَادَةُ كَبِدِ الْحُوت وَإِذَا سَبَقَ مَاءُ الرَّجُلِ مَاءَ الْمَرْأَةِ نَزْعَ الْوَلَدَ وَإِذَا سَبَقَ مَاءُ الْمَرْأَةِ نَزَعَتْ» . قَالَ: أشهد أَن لاإله إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّكَ رَسُولُ اللَّهِ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ الْيَهُودَ قَوْمٌ بُهْتٌ وَإِنَّهُمْ إِنْ يعلمُوا بِإِسْلَامِي من قبل أَن تَسْأَلهُمْ يبهتوني فَجَاءَتِ الْيَهُودُ فَقَالَ: «أَيُّ رَجُلٍ عَبْدُ اللَّهِ فِيكُمْ؟» قَالُوا: خَيْرُنَا وَابْنُ خَيْرِنَا وَسَيِّدُنَا وَابْنُ سيدِنا فَقَالَ: «أرأَيتم إِنْ أَسْلَمَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَلَامٍ؟» قَالُوا أَعَاذَهُ اللَّهُ مِنْ ذَلِكَ. فَخَرَجَ عَبْدُ اللَّهِ فَقَالَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ فَقَالُوا: شَرُّنَا وَابْنُ شَرِّنَا فَانْتَقَصُوهُ قَالَ: هَذَا الَّذِي كُنْتُ أَخَافُ يَا رسولَ الله رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (4480) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে আবদুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে এমন তিনটি বিষয় সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন, যার উত্তর কেবল একমাত্র কোন নবীই দিতে পারেন। প্রশ্ন করার পর যখন রাসূল (সা.) সেগুলো উত্তর দিলেন তখন ‘আবদুল্লাহ ইবনু সালাম বুঝতে পারলেন যে, তিনি একজন সত্য নবী এবং এ প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারাটা তার মু'জিযাহ্। তারপর তিনি ইসলাম গ্রহণ করলেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া শুরু করার আগে বললেন, (أَخْبرنِي بهنَّ جِبْرِيلُ آنِفًا) অর্থাৎ এইমাত্র জিবরীল আমাকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানিয়ে গেলেন। মিরকাত প্রণেতা বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর এ কথা বলার মাধ্যমে ‘আবদুল্লাহ ইবনু সালাম -এর এই ধারণা দূর করেছেন যে, সে মনে করতে পারে যে, রাসূল (সা.) প্রশ্নগুলোর উত্তর কোন আহলে কিতাবী জ্ঞানী ব্যক্তির থেকে শুনে থাকতে পারেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
(وَأَمَّا أَوَّلُ طَعَامٍ يَأْكُلُهُ أَهْلُ الْجَنَّةِ فَزِيَادَةُ كَبِدِ الْحُوت) অর্থাৎ জান্নাতীরা সর্বপ্রথম যে খাবার খাবে তা হলো মাছের কলিজার অতিরিক্ত অংশ।
ফাতহুল বারীতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, (زِيَادَةُ كَبِدِ الْحُوت) অর্থাৎ মাছের কলিজার অতিরিক্ত অংশ। এটি হলো মাছের কলিজার সাথে আলাদা একটি অংশ। যা অনেক অনেক সুস্বাদু। খেতে খুব তৃপ্তিদায়ক এবং অসাধারাণ মজাদার।
(وَإِذَا سَبَقَ مَاءُ الرَّجُلِ مَاءَ الْمَرْأَةِ نَزْعَ الْوَلَدَ وَإِذَا سَبَقَ) অর্থাৎ, যখন পুরুষের বীর্য স্ত্রীর বীর্যের উপরে প্রাধান্য পায় তখন ছেলে সন্তান হয়। আর যখন স্ত্রীর বীর্য প্রাধান্য পায় তখন মেয়ে সন্তান হয়।
সহীহ মুসলিম-এর একটি বর্ণনায় রয়েছে, যখন পুরুষের বীর্য স্ত্রীর বীর্যের উপর বিজয় লাভ করে তখন সন্তান তার চাচাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয় আর যখন স্ত্রীর বীর্য পুরুষের বীর্যের উপর বিজয় লাভ করে তখন সন্তান তার মামাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়।
বীর্যের প্রাধান্য পাওয়া এবং জয়লাভ করা সম্পর্কে ফাতহুল বারী গ্রন্থকার বলেন, “বীর্যের প্রাধান্য পাওয়া এবং জয় লাভ করা” দ্বারা সম্ভাব্য ছয়টি উদ্দেশ্যর যে কোনটি হতে পারে।
১) পুরুষের বীর্য অগ্রগামী হবে এবং পরিমাণে বেশি হবে। তখন সন্তান পুরুষ হবে এবং তার সাদৃশ্য পুরুষের সাথে হবে।
২) স্ত্রীর বীর্য অগ্রগামী হবে এবং পরিমাণে বেশি হবে। তখন সন্তান নারী হবে এবং স্ত্রীর সাথে সাদৃশ্য হবে।
৩) পুরুষের বীর্য অগ্রগামী হবে কিন্তু স্ত্রীর বীর্য পরিমাণে বেশি হবে। তখন সন্তান পুরুষ হবে কিন্তু তার সাদৃশ্য হবে স্ত্রীর সাথে।
৪) স্ত্রীর বীর্য অগ্রগামী হবে কিন্তু পুরুষের বীর্য পরিমাণে বেশি হবে। তখন সন্তান নারী হবে কিন্তু তার সাদৃশ্য হবে পুরুষের সাথে।
৫) পুরুষের বীর্য অগ্রগামী হবে কিন্তু পরিমাণে স্বামী-স্ত্রীর বীর্য সমান হবে। তখন সন্তান পুরুষ হবে। কিন্তু বিশেষভাবে কারো সাদৃশ্যপূর্ণ হবে না।
৬) স্ত্রীর বীর্য অগ্রগামী হবে কিন্তু পরিমাণে স্বামী-স্ত্রীর বীর্য সমান হবে। তখন সন্তান নারী হবে। কিন্তু বিশেষভাবে কারো সাদৃশ্যপূর্ণ হবে না।
ইবনু ইসহাক কিতাবুল মাগাযীতে হিজরতের প্রাথমিক বিষয়গুলো আলোচনা করতে গিয়ে উল্লেখ করেন। মদীনায় যে সকল ইয়াহুদী ছিল, আবদুল্লাহ ইবনু সালামও তাদের একজন। তিনি ছিলেন ইয়াহুদীদের একজন বিজ্ঞ আলিম। তার বংশ ছিল বানূ কায়নুকা। ইসলাম গ্রহণ করার আগে তার নাম ছিল হাসীন। কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করার পর আল্লাহর রাসূল (সা.) ও তার নাম রাখলেন ‘আবদুল্লাহ। (ফাতহুল বারী ৭/৩৯৩৮)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭১-[৪] উক্ত রাবী [আনাস (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমাদের নিকট (কুরায়শ নেতা) আবূ সুফইয়ান-এর প্রত্যাবর্তনের সংবাদ পৌছলে রাসূলুল্লাহ (সা.) পরামর্শ করলেন, তখন (আনসার নেতা) সা’দ ইবনু উবায়দাহ্ (রাঃ) উঠে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সে মহান সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ! আপনি যদি আমাদেরকে সওয়ারীসহ দরিয়াতে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ করেন, তবে আমরা ঝাপিয়ে পড়ব। আর যদি বারকুল গিমাদ’ পর্যন্তও আমাদের বাহনকে ছুটে যেতে আদেশ করেন, তা করতেও আমরা প্রস্তুত। বর্ণনাকারী [আনাস (রাঃ)] বলেন, এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) লোকেদেরকে যুদ্ধের জন্য তৈরি করে নিলেন। এরপর তারা রওয়ানা হয়ে বদর’ নামক স্থানে এসে অবতরণ করলেন। এখানে পৌছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এটা অমুক নিহত হওয়ার স্থান আর তা অমুকের আর তা অমুকের। এ সময় তিনি (সা.) (স্থান দেখিয়ে) স্বীয় হাত জমিনে রাখলেন। বর্ণনাকারী বলেন, (যুদ্ধ শেষে) দেখা গেল, রাসূলুল্লাহ (সা.) যার জন্য যে স্থানটি দেখিয়েছিলেন, তাদের একটিও এদিক-সেদিক সরে পড়েনি। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعنهُ قا ل: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَاوَرَ حِينَ بَلَغَنَا إِقْبَالُ أَبِي سُفْيَانَ وَقَامَ سَعْدُ بْنُ عُبَادَةَ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ أَمَرْتَنَا أَنْ نُخِيضَهَا الْبَحْرَ لَأَخَضْنَاهَا وَلَوْ أَمَرْتَنَا أَنْ نَضْرِبَ أَكْبَادَهَا إِلَى بَرْكِ الْغِمَادِ لَفَعَلْنَا. قَالَ: فَنَدَبَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ النَّاسُ فَانْطَلَقُوا حَتَّى نَزَلُوا بَدْرًا فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «هَذَا مَصْرَعُ فُلَانٍ» وَيَضَعُ يدَه على الأرضِ هَهُنَا وَهَهُنَا قا ل: فَمَا مَاطَ أَحَدُهُمْ عَنْ مَوْضِعِ يَدُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
رواہ مسلم (83 / 1779)، (4621) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: আবূ সুফইয়ান-এর কাফেলা যখন সিরিয়া থেকে মক্কার উদ্দেশে বের হলো এবং সাহাবীগণের কাছে সেই সংবাদ পৌছল তখন মদীনাবাসীদের পরীক্ষা করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদের সাথে পরামর্শ করলেন। সাহাবীদের মধ্য থেকে আবূ বাকর (রাঃ) কথা বললেন। কিন্তু রাসূল (সা.) তার থেকে অন্যদিকে মুখ ফিরালেন। তারপর ‘উমার (রাঃ) কথা বললেন। কিন্তু তার থেকেও তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন সা'দ ইবনু উবাদাহ দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদেরকেই চাচ্ছেন? অতঃপর সা'দ ইবনু 'উবাদাহ (রাঃ) আল্লাহর কসম করে বললেন, (وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ أَمَرْتَنَا أَنْ نُخِيضَهَا الْبَحْرَ) অর্থাৎ, এ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ। যদি আপনি আমাদেরকে ঘোড়া নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিতে আদেশ করেন, আমরা তাই করব।
‘উলামাগণ বলেন, রাসূল (সা.) আনসারদেরকে পরীক্ষা করার ইচ্ছা করেছিলেন। কারণ তিনি যখন আনসারদের থেকে বায়'আত গ্রহণ করেছিলেন তখন তাদের এই অঙ্গীকার ছিল যে, তারা রাসূল (সা.) -কে শত্রুদের থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু এই অঙ্গীকার ছিল না যে, তারা তাঁর সাথে বের হয়ে শত্রুদের সাথে লড়াই করবে।
তাই যখন আবূ সুফইয়ান-এর কাফেলা আক্রমণের উদ্দেশে বের হওয়ার সময় আসলো তখন তিনি নিশ্চিতভাবে আনসারদের থেকে জানতে চাইলেন যে, তারা তাঁর সাথে একমত কিনা? তারপর তারা উত্তম জবাব দিল এবং রাসূল (সা.) -এর সাথে পরিপূর্ণ একাত্বতা ঘোষণা করল। (ফাতহুল বারী হা. ১২/১৭৭৯)
উক্ত হাদীসে সাথিদের সাথে এবং জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা হয়েছে।
ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, কুরায়শরা বড় একটি ব্যবসায়ী কাফেলা নিয়ে সিরিয়া থেকে মক্কার উদ্দেশে বের হয়। সেই কাফেলায় ছিল চল্লিশ জন আরোহী এবং তাতে ছিল অনেক সম্পদ। আর কাফেলার নেতা ছিল আবূ সুফিয়ান। মুসলিমগণ সেই কাফেলার সাথে সাক্ষাতের আগ্রহী ছিল। কারণ তাতে লোক ছিল কম আর সম্পদ ছিল অনেক বেশি। তারপর যখন মুসলিমগণ কাফেলা আক্রমণের উদ্দেশে বের হলো তখন এই সংবাদ মক্কায় পৌছে গেল। সংবাদ শুনে আবূ জাহল কা'বার উপর দাঁড়িয়ে ডাক দিয়ে বলল, হে মক্কাবাসী! তোমরা মুক্তির পথ খোজ। মুক্তির পথ খোজ। তারপর আবূ জাহল মক্কার অধিবাসীদের নিয়ে বের হলো। তখন আবূ জাহল-কে বলা হলো, ব্যবসায়ী কাফেলা তো সমুদ্র উপকূলীয় পথ ধরে চলতে শুরু করেছে এবং আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। কাজেই আপনি লোকেদেরকে নিয়ে মক্কায় ফিরে চলুন। তখন সে ফিরে যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহর নামে কসম করল এবং লোকেদেরকে নিয়ে বদরের প্রান্তরে উপস্থিত হলো। ইতোমধ্যে জিবরীল আলায়হিস সালাম এসে রাসূল (সা.) -কে জানিয়ে গেলেন যে, আল্লাহ দু’টি দলের কোন একটির সাথে মুখোমুখি করার ওয়াদা করেছেন। তখন রাসূল (সা.) বললেন, কাফেলা তো সমুদ্র উপকূলীয় পথ ধরে চলে গেছে। আর এগিয়ে আসছে আবূ জাহল। তখন আনসারদের পক্ষ থেকে সা'দ ইবনু ‘উবাদাহ্ (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহ রাসূল। ঐ সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! যদি আপনি আমাদেরকে ঘোড়া নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিতে আদেশ করেন আমরা তাই করব। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
(إِلَى بَرْكِ الْغِمَادِ) অর্থাৎ বারকুল গিমাদ পর্যন্ত। এ কথার মাধ্যমে দূরবর্তী স্থানের উপমা দেয়া হয়েছে। তবে (بَرْكِ الْغِمَادِ) -এর পরিচয় দিতে গিয়ে শারহুন নাবাবীর গ্রন্থকার কয়েকটি মত উল্লেখ করেছেন। যেমন কেউ কেউ বলেন, এটি হলো মক্কার পিছন দিকে একটি উপকূলীয় স্থান। যার দূরত্ব মক্কা থেকে পাঁচ দিনের পথ।
হাযিমী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এটি হলো দু’টি শহরের নাম। ক্বাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) এবং অন্যান্যরা বলেন, এটি হলো অনেক দূরবর্তী পরিত্যক্ত একটি স্থান।
ইবরাহীম আল হারিবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, (بَرْكِ الْغِمَادِ) এবং (سَعَفَاتُ) বলার মাধ্যমে দূরবর্তী স্থানের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়।
(وَرَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَائِمٌ يُصَلِّىْ فَلَمَّا رَأَي ذَلِكَ انْصَرَفَ) অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (সা.) দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। যখন তিনি তা দেখতে পান তখন সালাত শেষ করেন। হাদীসের এই বাক্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, সালাতরত অবস্থায় যদি কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঘটে যায় তাহলে সালাত হালকা করে আদায় করা মুস্তাহাব।
উক্ত হাদীসে রাসূল (সা.) -এর বিশেষভাবে দুটি মু'জিযাহ্ প্রকাশ পেয়েছে। আর সে দুটি হলো।
১) যুদ্ধের আগেই রাসূল (সা.) বলে দিয়েছিলেন যে, অমুক অমুক ব্যক্তি অমুক অমুক স্থানে মরে পড়ে থাকবে। আর যুদ্ধের পর দেখা যায় যে, ঠিক ঠিক জায়গায় তারা মরে পড়ে আছে। একটুও ব্যতিক্রম হয়নি।
২) বালকটি যখন আবূ সুফইয়ান-এর ব্যাপারে সত্য কথা বলছিল তখন তারা তাকে প্রহার করছিল। আর যখন সে তার ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলছিল তখন তারা তাকে ছেড়ে দিচ্ছিল। বালকটির সত্য-মিথ্যা বলার বিষয়টি আল্লাহর রাসূল (সা.) বলে দিয়েছেন। এটিও ছিল তাঁর বিশেষ মু'জিযা। (শারহুন নাবাবী ১২/১৭৭৯)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭২-[৫] ইবনু আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। বদর যুদ্ধের দিন একটি তাঁবুর মাঝে থাকাবস্থায় নবী (সা.) দু’আ করেন, “হে আল্লাহ! আমি তোমার ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! যদি তুমি চাও শত্রুদের হাতে এ মুসলিম দল ধ্বংস হয়ে যাক, তাহলে আজকের পর আর তোমার ’ইবাদত (এ পৃথিবীতে) হবে না।” এরপর আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) তাঁর হাত ধরে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আপনার প্রভুর কাছে খুব চেয়ে ফেলেছেন। অতঃপর তিনি (সা.) যুদ্ধবর্ম পরিহিত অবস্থায় দ্রুত বাইরে এসে এ আয়াতটি পড়লেন, “শত্রুদল অচিরেই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে”(সূরাহ্ আল কামার ৫৪ : ৪৫)। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ وَهُوَ فِي قُبَّةٍ يَوْمَ بَدْرٍ: «اللَّهُمَّ أَنْشُدُكَ عَهْدَكَ وَوَعْدَكَ اللَّهُمَّ إِنْ تَشَأْ لَا تُعْبَدْ بَعْدَ الْيَوْمِ» فَأَخَذَ أَبُو بَكْرٍ بيدِه فَقَالَ حَسْبُكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلْحَحْتَ عَلَى رَبِّكَ فَخَرَجَ وَهُوَ يَثِبُ فِي الدِّرْعِ وَهُوَ يقولُ: « [سيُهزَمُ الجمعُ ويُوَلُّونَ الدُّبُرَ] » . رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (4875) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: মুমিনদের সাহায্য করার ব্যাপারে আল্লাহর দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য আল্লাহর কাছে রাসূলুল্লাহ (সা.) বদর যুদ্ধের সময় অনেক দু'আ করেছেন যা এ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।
মিরকাত প্রণেতা এ হাদীসের ব্যাখ্যায় একটি সুপ্ত প্রশ্ন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। আর তা হলো, আল্লাহ তো মুমিনদেরকে সাহায্য করার ব্যাপারে ওয়াদাই করেছেন। তাহলে রাসূল (সা.) সাহায্যের জন্য আল্লাহর কাছে কেন এত দু'আ করলেন?
এই প্রশ্নের উত্তর মিরক্বাত প্রণেতা বিভিন্নভাবে দেয়ার চেষ্টা করেছেন। যেমন-
১) দুআ করাটা হলো মুস্তাহাব। এক্ষেত্রে দু'আকারী ব্যক্তি তার চাওয়া বিষয়টি অর্জিত হওয়ার ব্যাপারে অবগত থাকুক কিংবা না থাকুক। যেহেতু দু'আ করা মুস্তাহাব। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) দু'আ করেছেন।
২) আল্লাহর প্রতি যে জ্ঞান রাখে সে অবশ্যই আল্লাহকে ভয় করবে। আর এক্ষেত্রে নবীগণও ব্যতিক্রম নয়। বরং তারা আরো বেশি ভয় করেন। অতএব তাদেরকে যে উত্তম ফলাফলের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তা যেন নিজেদের কারণে কোনভাবেই এদিক-সেদিক হয়। সেজন্য তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করেছেন।
৩) তার কোন আশঙ্কা থাকতে পারে এই বিষয়ে যে, তাঁর অথবা তার পূর্বের জাতির কারণে সৃষ্ট কোন প্রতিবন্ধকতার। যেজন্য তাদের প্রতিশ্রুত সাহায্য আটকে যেতে পারে। এজন্যই রাসূল (সা.) এত দু'আ করেছেন।
৪) সম্ভবত এটিও হতে পারে যে, তাঁকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে কিন্তু সেই সাহায্যের জন্য সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। তাই তিনি আল্লাহর কাছে দু'আ করেছেন যেন তিনি তাঁকে সেদিনই সাহায্য করেন।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো যে উত্তরটি হতে পারে তা হলো, আল্লাহর প্রতি নবী (সা.) -এর পূর্ণ আস্থা ও দৃঢ় বিশ্বাস থাকার পরেও তিনি তার কাছে অনেক দু'আ করেছেন সাহাবীদেরকে উৎসাহিত করার জন্য এবং তাদের হৃদয়কে সুদৃঢ় করার জন্য। কারণ তারা জানত যে, নবী (সা.) -এর দু'আ অবশ্যই কবুল হবে। বিশেষ করে তিনি যখন আরো বেশি করে দু'আ করবেন।
উক্ত হাদীসে আরো একটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। তা হলো, যে ব্যক্তি যুদ্ধ করতে সক্ষম না। অথবা যাকে যুদ্ধের জন্য আদেশ করা হয়নি সে যেন তখন সাহায্যের জন্য দু'আ করে। যাতে সে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সাওয়াব অর্জন করতে পারে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুহায়ল বলেন, নবী (সা.) আল্লাহর কাছে অনেক বেশি দু'আ করেছেন। কারণ তিনি মালায়িকাকে (ফেরেশতাদেরকে) দেখেছেন যে, তারা যুদ্ধের মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন। আর আনসার সাহাবীরা মৃত্যুর মতো কষ্টের দিকে ঝাপিয়ে পড়ছে।
তাছাড়াও জিহাদ কখনো অস্ত্রের মাধ্যমে হয়। আবার কখনো দু'আর দ্বারাই জিহাদ হয়ে যায় ।
আর সুন্নাত হলো, ইমাম সেনাবাহিনীর পিছনে থাকবেন। তিনি তাদের সাথে যুদ্ধ করবেন না। যেন তিনি নিজেকে শান্ত রাখতে পারেন এবং আল্লাহর কাছে দু'আ করতে পারেন।
(اللَّهُمَّ إِنْ تَشَأْ لَا تُعْبَدْ) অর্থাৎ হে আল্লাহ! (আপনি যদি না) চান, তাহলে আর আপনার ‘ইবাদত করা হবে না। ‘উমার (রাঃ)-এর একটি হাদীসে রয়েছে, হে আল্লাহ! আপনি যদি এই ইসলামী দলকে ধ্বংস করে দেন। তাহলে জমিনে আর আপনার ইবাদত করা হবে না।
তিনি এ কথা বলেছিলেন, কারণ মুহাম্মাদ (সা.) হলেন সর্বশেষ নবী। অতএব যদি তিনি ও তাঁর সাথিরা ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে ইসলামের এখানেই সমাপ্তি ঘটবে। যেহেতু তার পরে আর কাউকে দাওয়াত দেয়ার জন্য আল্লাহ নবী হিসেবে পাঠাবেন না। আর তখন মুশরিকরা গায়রুল্লাহর ইবাদত করতেই থাকবে। তারপর এই পৃথিবীতে আর এই শারী'আত অনুযায়ী ‘ইবাদত করা হবে না।
খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এটি মনে করার কোনই কারণ নেই যে, বদর যুদ্ধের সময় রাসূল (সা.)-এর দু'আ করা অবস্থায় আল্লাহর প্রতি আবূ বাকর (রাঃ)-এর আস্থা ও বিশ্বাস রাসূল (সা.) -এর থেকে বেশি ছিল।
রাসূল (সা.) সেই সময় তাঁর সাহাবীদের প্রতি দরদ প্রকাশ করেছেন এবং তাদের হৃদয়কে সুদৃঢ় করেছেন। কারণ এটি ছিল তাদের সর্বপ্রথম সম্মুখ যুদ্ধ। তাই রাসূল (সা.) বেশি বেশি দু'আ করেছেন যেন তাদের অন্তর যুদ্ধের সময় স্থির থাকে।
তারপর আবূ বাকর (রাঃ) রাসূল (সা.) -কে যা বলার বললেন, তখন তিনি দু'আ করা থেকে বিরত হলেন এবং জানতে পারলেন যে, অবশ্যই তাঁর দু'আ কবুল করা হয়েছে। অতঃপর রাসূল (সা.) এই আয়াত (سَیُهۡزَمُ الۡجَمۡعُ وَ یُوَلُّوۡنَ الدُّبُرَ) “শত্রুদল অচিরেই পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে”- (সূরাহ্ আল কামার ৫৪ : ৪৫); পাঠ করতে করতে বের হলেন। যার অর্থ, অবশ্যই বাহিনী পরাজিত হবে এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পালিয়ে যাবে। (ফাতহুল বারী ৭/৩৯৫৩)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭৩-[৬] উক্ত রাবী [ইবনু আব্বাস (রাঃ)] হতে বর্ণিত। বদর যুদ্ধের দিন নবী (সা.) বললেন, এই তো জিবরীল আলায়হিস সালাম তার ঘোড়ার মাথা (লাগাম) ধরে আছেন। তিনি যুদ্ধাস্ত্রে সাজানো। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ يَوْمَ بَدْرٍ: «هَذَا جِبْرِيلُ آخِذٌ بِرَأْسِ فرسه عَلَيْهِ أَدَاة الْحَرْب» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (3995) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে বদর যুদ্ধের দিনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ হাদীসে উল্লেখিত (بَدْر) (বদর) শব্দের পরিচয়ের ক্ষেত্রে দুটি মত পাওয়া যায়। যথা -
১) ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, বদর হলো মক্কাহ ও মদীনার মাঝে একটি পরিচিত জলাশয়ের নাম যার দূরত্ব মদীনাহ থেকে চার মঞ্জীল তথা প্রায় ১৫০ কি.মি.।
২) ইবনু কুতায়বাহ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এটি হলো একটি কুপ। যা বদর নামক একজন ব্যক্তির ছিল। পরবর্তীতে সেই ব্যক্তির নাম অনুসারে উক্ত কূপকে বদর নামে নামকরণ করা হয়েছে। বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরী রমাযান মাসের ১৭ তারিখে জুমু'আর দিনে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
ফাতহুল বারীতে বদর যুদ্ধে ঘটে যাওয়া কিছু অলৌকিক বিষয় বিভিন্ন হাদীসের সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- ইবনু ইসহাক আবূ ওয়াক্বীদ আল লায়সী-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, বদর যুদ্ধের দিন আমি একজন মুশরিককে হত্যা করার জন্য তার পিছু নিলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো যে, তার কাছে আমার তরবারি পৌছার পূর্বেই তার গর্দান মাটিতে পড়ে গেল।
অন্য আরেকটি হাদীসে রয়েছে, ‘আলী (রা) বলেন, বদর যুদ্ধের দিন প্রচণ্ড বাতাস প্রবাহিত হলো। যে রকম বাতাস প্রবাহিত হলো, সে রকম বাতাস প্রবাহিত হতে আর কোন সময় দেখিনি। তারপর আবারও প্রচণ্ড বাতাস প্রবাহিত হলো। বর্ণনাকারী বলেন, আমার মনে হয় যে, তিনি তা তিনবার উল্লেখ করেছেন। এখানে প্রথমটি ছিলেন, জিবরীল আলায়হিস সালাম, দ্বিতীয়টি ছিলেন আলায়হিস সালাম এবং তৃতীয়টি ছিলেন ইসরাফীল আলায়হিস সালাম। মীকাঈল আলায়হিস সালাম ছিলেন নবী (সা.)-এর ডানপাশে আর সেখানে ছিলেন আবূ বাকর (রাঃ)। যেখানে ইসরাফীল আলায়হিস সালাম ছিলেন নবী (সা.) -এর বামপাশে আর সেখানে ছিলাম আমি।
শায়খ তাক্বীউদ্দীন আস্ সাবাকী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, মালায়িকাহ’র (ফেরেশতাদের) নবী (সা.) -এর সাথে থেকে লড়াই করার হিকমত সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো এভাবে যে, মালায়িকাহ্ কেন লড়াই করল? অথচ জিবরীল আলায়হিস সালাম তো একাই সক্ষম তার কোন এক ডানা দিয়ে কাফিরদেরকে প্রতিহত করতে। তখন উত্তরে আমি বললাম, এটি ঘটেছে এই উদ্দেশে, যেন যুদ্ধের কাজ নবী (সা.) সাহাবীদের মাধ্যমেই সংঘটিত হয় আর মালায়িকাহ যেন শুধু তাদেরকে সেনাবাহিনীর ভূমিকায় সাহায্য করেন। এ বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করে যে, মানুষ যেন উপকরণ গ্রহণ করতে পারে এবং আল্লাহর সেই পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারে যা তিনি তাঁর বান্দাদের মাঝে প্রচলিত করেছেন। (ফাতহুল বারী হা. ৩৯৯৫)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭৪-[৭] উক্ত রাবী [ইবনু আব্বাস (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সেদিন (বদর যুদ্ধের দিন) জনৈক মুসলিম তার সামনের একজন মুশরিকের পিছনে ধাওয়া করছিলেন, এমন সময় তিনি তার ওপর হতে একটি চাবুকের এবং এক অশ্বারোহীর আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি বলেছিলেন, “হে হায়যূম! (ফেরেশতার ঘোড়ার নাম) অগ্রসর হও।” এ সময় তিনি দেখতে পেলেন, সেই সম্মুখস্থ মুশরিক লোক চিত হয়ে পড়ে আছে। অতঃপর তার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তার নাকের উপর আঘাতের চিহ্ন এবং মুখ ফেটে রয়েছে। চাবুকের আঘাতের মতো সমস্ত স্থান নীল বর্ণ হয়ে রয়েছে। অতঃপর সে আনসারী রাসূলুল্লাহ (সা.) - এর কাছে এসে ঘটনাটি বর্ণনা করলে তিনি বললেন, তুমি সত্যই বলেছ। তিনি তৃতীয় আকাশের সাহায্যকারী মালায়িকার একজন ছিলেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, মুসলিমগণ সেদিন (বদরের দিন) সত্তরজন মুশরিককে হত্যা এবং সত্তরজনকে বন্দি করেছিলেন। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعنهُ قا ل: بَيْنَمَا رَجُلٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ يَوْمَئِذٍ يَشْتَدُّ فِي إِثْرِ رَجُلٍ مِنَ الْمُشْرِكِينَ أَمَامَهُ إِذْ سَمِعَ ضَرْبَةً بِالسَّوْطِ فَوْقَهُ وَصَوْتُ الْفَارِسِ يَقُولُ: أَقْدِمْ حَيْزُومُ. إِذْ نَظَرَ إِلَى الْمُشْرِكِ أَمَامَهُ خَرَّ مُسْتَلْقِيًا فَنَظَرَ إِلَيْهِ فَإِذَا هُوَ قَدْ خُطِمَ أَنْفُهُ وَشُقَّ وَجْهُهُ كَضَرْبَةِ السَّوْطِ فَاخْضَرَّ ذَلِكَ أَجْمَعُ فَجَاءَ الْأَنْصَارِيُّ فَحَدَّثَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: «صَدَقْتَ ذَلِكَ مِنْ مَدَدِ السَّمَاءِ الثَّالِثَةِ» فَقَتَلُوا يَوْمَئِذٍ سَبْعِينَ وَأَسَرُوا سبعين. رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (58 / 1763)، (4588) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: হাদীসের এক অংশে বলা হয়েছে, (فَجَاءَ الْأَنْصَارِيُّ فَحَدَّثَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: صَدَقْتَ ..) অর্থাৎ তারপর একজন আনসার সাহাবী এসে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর নিকট সেই ঘটনাটি বর্ণনা করলেন। তখন রাসূল (সা.) তা সত্যায়ন করলেন।
এখানে মিরক্বাত প্রণেতা উল্লেখ করেন যে, এ বিশেষ ঘটনাটি দেখতে পাওয়াটা সাহাবীর জন্য বিশেষ মর্যাদার বিষয়। বিশেষ করে তা ঘটেছে, রাসূল (সা.) -এর জীবদ্দশায় এবং তিনি সেই সাহাবীর বর্ণনাকে সত্যায়নও করেছেন। আর সকল সাহাবী হলেন ন্যায়পরায়ণ। তাই তাদের সংবাদও সঠিক। অতএব যুদ্ধের ময়দানে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাকে মু'জিযাহ্ হিসেবেই গণ্য হয়েছে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭৫-[৮] সা’দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, উহুদ যুদ্ধের দিন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর ডানে ও বামে সাদা পোশাক পরিহিত দু’জন লোককে দেখলাম, তারা [রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর] রক্ষার জন্য প্রচণ্ডভাবে লড়াই করছেন। ঐ দু’জনকে আমি পূর্বেও কোনদিন দেখিনি কিংবা পরেও, তারা দু’জন ছিলেন জিবরীল ও মীকাঈল আলায়হিস সালাম। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ سَعْدِ بْنِ أَبِي وَقَّاصٍ قَالَ: رَأَيْتُ عَنْ يَمِينُ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَنْ شِمَالِهِ يَوْمَ أُحُدٍ رَجُلَيْنِ عَلَيْهِمَا ثِيَابٌ بِيضٌ يُقَاتِلَانِ كَأَشَدِّ الْقِتَالِ مَا رأيتُهما قبلُ وَلَا بعد يَعْنِي جِبْرِيل وَمِيكَائِيل. مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4045) و مسلم (46 / 2306)، (6004) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে বর্ণনাকারী সাহাবী বলেছেন, (كَأَشَدِّ الْقِتَالِ) অর্থাৎ তারা দু’জন প্রচণ্ড লড়াই করছিল মিরকাত প্রণেতা বলেন, তারা দুজন এমনভাবে দৃঢ়তার সাথে লড়াই করছিল যেমন শক্তিশালী সাহসী বীর পুরুষ লড়াই করে থাকে।
উক্ত দুজনের পরিচয় দিতে গিয়ে বর্ণনাকারী বলেন, তাদের একজন হলেন জিবরীল আর অপরজন হলেন মীকাঈল আলায়হিস সালাম। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭৬-[৯] বারা’ (ইবনু ’আযিব) (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন নবী (সা.) একদল লোক (ইয়াহুদী নেতা) আবূ রাফি’-কে হত্যার জন্য পাঠালেন। সে দলের মধ্য হতে ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আতীক (রাঃ), এক রাত্রে তার (আবূ রাফি’-এর) গৃহে প্রবেশ করলেন, তখন সে (আবূ রাফি’) ঘুমিয়ে ছিল এবং সে অবস্থায় তাকে হত্যা করেন। এ প্রসঙ্গে ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আতীক (রাঃ) বলেন, আমি তরবারি তার পেটের উপর ধরলাম এবং তা পিঠ পর্যন্ত পৌছল। তখন আমি নিশ্চিত হলাম যে, তাকে হত্যা করেছি। অতঃপর আমি একটি একটি করে দরজা খুলে (ফিরে আসার পথে) সিড়িতে পৌছলাম। তা ছিল জোৎস্না রাত, তাই (দু’এক ধাপ থাকতেই সিড়ি শেষ হয়েছে ভেবে) নীচে পা রাখতেই আমি পড়ে গেলাম। ফলে আমার পায়ের গোড়ালির হাড় ভেঙ্গে গেল। তখন আমি পাগড়ি দিয়ে ভাঙ্গা পা’টি বেঁধে ফেললাম। তারপর আমি আমার সাথিদের কাছে আসলাম।
অবশেষে নবী (সা.) -এর কাছে পৌছে ঘটনাটি বর্ণনা করলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, তোমার পা’টি মেল। আমি পা মেলে ধরলাম। তিনি (সা.) সে পা’টির উপর হাত বুলালেন। এতে আমার পা এমনভাবে ব্যথামুক্ত হয়ে গেল যেন তাতে আমি কক্ষনো আঘাতই পাইনি। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن الْبَراء قَالَ بَعَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَهْطًا إِلَى أَبِي رَافِعٍ فَدَخَلَ عَلَيْهِ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَتِيكٍ بَيْتَهُ لَيْلًا وَهُوَ نَائِمٌ فَقَتَلَهُ فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ عَتِيكٍ: فَوَضَعْتُ السَّيْف فِي بَطْنه حَتَّى أَخذ فِي ظَهره فَعَرَفْتُ أَنِّي قَتَلْتُهُ فَجَعَلْتُ أَفْتَحُ الْأَبْوَابَ حَتَّى انْتَهَيْتُ إِلَى دَرَجَةٍ فَوَضَعْتُ رِجْلِي فَوَقَعْتُ فِي لَيْلَةٍ مُقْمِرَةٍ فَانْكَسَرَتْ سَاقِي فَعَصَبَتُهَا بِعِمَامَةٍ فَانْطَلَقْتُ إِلَى أَصْحَابِي فَانْتَهَيْتُ إِلَى النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَحَدَّثْتُهُ فَقَالَ: «ابْسُطْ رِجْلَكَ» . فَبَسَطْتُ رِجْلِي فَمَسَحَهَا فَكَأَنَّمَا لَمْ أَشْتَكِهَا قَطُّ. رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (3022) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: (بَعَثَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَهْطًا) অর্থাৎ রাসূল (সা.) একটি দল পাঠালেন। উক্ত হাদীসে উল্লেখিত শব্দ (رَهْط) সম্পর্কে মিরকাত প্রণেতা বলেন, (رَهْط) শব্দটি দশের কম সংখ্যক পুরুষ লোকের এমন একটি দলকে বুঝায় যে দলের মাঝে কোন স্ত্রীলোক থাকে না।
আর অভিধানে বলা হয়েছে যে, (رَهْط) তিন অথবা সাত থেকে দশের কম সংখ্যক পুরুষের এমন দলকে বুঝায় যাদের মাঝে কোন মহিলা লোক থাকবে না।
(فَوَضَعْتُ) অর্থাৎ তারপর আমি পড়ে গেলাম। ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) তার পরে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বলেন, চাঁদের আলো সিড়িতে এসে পড়ছিল। আর তিনি সিঁড়িতে প্রবেশ করে ধারণা করলেন যে, সিঁড়ি হলো জমিনের বরাবর। কিন্তু সেটি আসলে তেমন ছিল না। তাই তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
আবূ রাফি'-কে সাহাবীরা ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করেছে। পাশাপাশি নিশ্চিত হওয়ার জন্য তাকে ডাক দিয়েছে। যখন তার কথা শুনে সাহাবীরা নিশ্চিত হলো তখন তারা তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করল। এখানে থেকে বুঝা যায় যে, প্রয়োজনে মুশরিকদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করা বৈধ আছে। সাথে সাথে এটিও বুঝা যায় যে, মুশরিকদেরকে দাওয়াত দেয়া ছাড়াও হত্যা করা যাবে। যদি তাদের কাছে তারা পূর্বে দাওয়াত পৌঁছে থাকে। আর আবূ রাফি'-এর কাছে এর আগেই দা'ওয়াত পৌছেছে। তারপরে সে দা'ওয়াত তো গ্রহণ করেইনি। বরং রাসূল (সা.) -কে আরো বেশি কষ্ট দিয়েছে। তাই তিনি তাকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। (ফাতহুল বারী হা. ৩০২৩)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭৭-[১০] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, খন্দকের যুদ্ধের শুরুতে আমরা পরিখা খনন করছিলাম। এ সময় এক খণ্ড শক্ত পাথর দেখা দিল। তখন লোকেরা এসে নবী (সা.) -কে বলল, খাল খননকালে একটি শক্ত পাথর দেখা দিয়েছে (যা কোদাল কিংবা শাবল দ্বারা ভাঙা যাচ্ছে না)। তখন নবী (সা.) বললেন, আচ্ছা, আমি নিজেই গর্তে নামব। অতঃপর তিনি (সা.) দাঁড়ালেন, সে সময় তার পেটে পাথর বাধা ছিল। আর আমরাও তিনদিন যাবৎ কিছুই খেতে পাইনি। এমতাবস্থায় নবী (সা.) কোদাল হাতে নিয়ে পাথরটির উপর আঘাত করলে তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে বালুকণায় পরিণত হয়। জাবির (রাঃ) বলেন, [নবী (সা.)-কে ক্ষুধার্ত অবস্থায় পেয়ে] আমি আমার স্ত্রীর কাছে এসে বললাম, তোমার কাছে কি খাওয়ার মতো কিছু আছে? কেননা আমি নবী (সা.) -কে ভীষণ ক্ষুধার্ত দেখেছি। তখন সে একটি চামড়ার পাত্র হতে এক সা’ পরিমাণ যব বের করল আর আমাদের পোষা একটি বকরির ছানা ছিল। তখন আমি সেই ছানাটি যাবাহ করলাম এবং আমার স্ত্রীও যব পিষল। অবশেষে আমরা হাঁড়িতে মাংস চড়ালাম। অতঃপর নবী (সা.) -এর কাছে এসে তাকে চুপে চুপে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আমাদের ছোট একটি বকরির বাচ্চা যাবাহ করেছি। আর এক সা যব ছিল, আমার স্ত্রী তা পিষেছে। অতএব আপনি আরো কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে চলুন। (এ কথা শুনে) নবী (সা.) উচ্চৈঃস্বরে সকলকে ডেকে বললেন, হে খাল খননকারীগণ! আসো, তোমরা তাড়াতাড়ি চল, জাবির তোমাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করেছে।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, তুমি যাও, কিন্তু আমি না আসা পর্যন্ত মাংসের ডেকচি নামাবে না এবং খামিরগুলো নবী (সা.) -এর সামনে আগিয়ে দিলে তিনি তাতে মুখের লালা মিশালেন এবং বরকতের জন্য দু’আ করলেন। অতঃপর ডেকচির কাছে অগ্রসর হয়ে তাতেও লালা মিশিয়ে বরকতের জন্য দু’আ করলেন। এরপর তিনি (আমার স্ত্রীকে লক্ষ্য করে) বললেন, তুমি আরো রুটি প্রস্তুতকারিণীকে আহ্বান কর, যারা তোমাদের সাথে রুটি বানায় এবং চুলার উপর হতে ডেকচি না নামিয়ে তা হতে নিয়ে পরিবেশন কর। (জাবির রা. বলেন) সাহাবীদের সংখ্যা ছিল এক হাজার। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, সকলে তৃপ্তি সহকারে খেয়ে চলে যাওয়ার পরও তরকারি ভর্তি ডেচকি ফুটছিল এবং প্রথম অবস্থার মতো আটার খামির হতে রুটি প্রস্তুত হচ্ছিল। (বুখারী ও মুসলিম
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن جَابر قا ل إِنَّا يَوْمَ الْخَنْدَقِ نَحْفِرُ فَعَرَضَتْ كُدْيَةٌ شَدِيدَةٌ فجاؤوا الْنَبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالُوا: هَذِهِ كُدْيَةٌ عَرَضَتْ فِي الْخَنْدَقِ فَقَالَ: «أَنَا نَازِلٌ» ثُمَّ قَامَ وَبَطْنُهُ مَعْصُوبٌ بِحَجَرٍ وَلَبِثْنَا ثَلَاثَةَ أَيَّام لانذوق ذوقا فَأَخَذَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمِعْوَلَ فَضَرَبَ فَعَادَ كَثِيبًا أَهْيَلَ فَانْكَفَأْتُ إِلَى امْرَأَتِي فَقُلْتُ: هَلْ عِنْدَكِ شَيْءٌ؟ فَإِنِّي رَأَيْتُ بِالنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَمْصًا شَدِيدًا فَأَخْرَجَتْ جراباً فِيهِ صاعٌ من شعير وَلنَا بَهْمَةٌ دَاجِنٌ فَذَبَحْتُهَا وَطَحَنَتِ الشَّعِيرَ حَتَّى جَعَلْنَا اللَّحْمَ فِي الْبُرْمَةِ ثُمَّ جِئْتُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم فساررتُه فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ ذَبَحْنَا بُهَيْمَةً لَنَا وَطَحَنْتُ صَاعًا مِنْ شَعِيرٍ فَتَعَالَ أَنْتَ وَنَفَرٌ مَعَكَ فَصَاحَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يَا أهلَ الخَنْدَق إِن جَابِرا صَنَعَ سُوراً فَحَيَّ هَلًا بِكُمْ» فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تُنْزِلُنَّ بُرْمَتَكُمْ وَلَا تَخْبِزُنَّ عَجِينَكُمْ حَتَّى أَجِيءَ» . وَجَاءَ فَأَخْرَجْتُ لَهُ عَجِينًا فَبَصَقَ فِيهِ وَبَارَكَ ثُمَّ عَمَدَ إِلَى بُرمْتنا فبصقَ وَبَارك ثمَّ قَالَ «ادعِي خابزة فلتخبز معي وَاقْدَحِي مِنْ بُرْمَتِكُمْ وَلَا تُنْزِلُوهَا» وَهُمْ أَلْفٌ فَأَقْسَمَ بِاللَّهِ لَأَكَلُوا حَتَّى تَرَكُوهُ وَانْحَرَفُوا وَإِنَّ بُرْمَتَنَا لَتَغِطُّ كَمَا هِيَ وَإِنَّ عَجِينَنَا لَيُخْبَزُ كَمَا هُوَ. مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4101 ۔ 4102) و مسلم (141 / 2039)، (5315) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে মুহাম্মাদ (সা.)-এর বরকতময় একটি মুজিযাহ সম্পর্কে যেমন আলোচনা করা হয়েছে তেমনি তার সাথে তুলে ধরা হয়েছে তার পবিত্র জীবনের একটি কষ্টের কথা মুসলিমরা মুশরিক দলগুলো থেকে আত্মরক্ষা করার জন্য পরিখা খনন করেন। তাদের মাঝে রাসূল (সা.) নিজেও অংশগ্রহণ করে কাজ করেছেন। তখন অভাব এতটাই ছিল যে, তারা কয়েকদিন অনাহারে থেকে কাজ করেছেন। এমনকি রাসূল (সা.) নিজেও ক্ষুধার তাড়নায় পেটে পাথর বেঁধেছেন। ফাতহুল বারীর প্রণেতা রাসূল (সা.) -এর ক্ষুধার কারণে পেটে পাথর বাধার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। যেমন ক্ষুধার কারণে পেট সংকুচিত হয়ে যায় আর এতে পিঠ বেঁকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে যেন পিঠ বেঁকে না যায়। এজন্যই তিনি পেটে পাথর বেঁধেছেন। যাতে পিঠ সোজা থাকে।
কিরমানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, সম্ভবত পাথরের শীতলতার মাধ্যমে ক্ষুধার জ্বালা থেকে প্রশান্তি লাভ করার জন্য পাথর বেঁধেছেন। (ফাতহুল বারী হা. ৪১০১)
বর্ণনাকারী জাবির (রাঃ), হাদীসের একটি অংশে বলেন, (ثُمَّ جِئْتُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم فساررتُه) অর্থাৎ, তারপর আমি রাসূল (সা.) -কে কানে কানে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা ছোট একটি ছাগী যাবাহ করেছি। আর আমাদের এক সা যব আছে।
মিরক্বাত প্রণেতা তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন: এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রয়োজনে অনেক লোকের উপস্থিতিতে একজনের সাথে আলাদা করে কানে কানে বা চুপে চুপে কথা বলা বৈধ। আর অন্য হাদীসে কানে কানে কথা বলা থেকে নিষেধ করা হয়েছে। তবে তার ক্ষেত্র ভিন্ন। সেটি হলো যদি তিনজন ব্যক্তি উপস্থিত থাকে তাহলে একজনকে বাদ দিয়ে বাকী দু’জনে চুপে চুপে কথা বলা। কারণ এতে তৃতীয় ব্যক্তি কষ্ট পায়। উক্ত হাদীসে জাবির (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে চুপে চুপে দা'ওয়াতের কথা বলেছেন। কারণ খাবারের আয়োজন ছিল অল্প কিন্তু লোকজন ছিল অনেক বেশি, প্রায় হাজারের মতো। তাই জাবির (রাঃ) রাসূল (সা.) -কে চুপে চুপে বলেছেন, আপনি এবং আপনার কয়েকজন লোক নিয়ে আসুন। যেমন হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।
(وَإِنَّ عَجِينَنَا لَيُخْبَزُ كَمَا هُوَ) অর্থাৎ আমাদের খামীর দিয়ে রুটি বানানো হচ্ছিল। শেষে ঐ পরিমাণই রয়ে গেল যে পরিমাণ ছিল। মিরকাত প্রণেতা বলেন, যে পাত্রে খামির রেখে রুটি বানানো হচ্ছিল সে পাত্রে ঐ পরিমাণই থেকে গেল যে পরিমাণ দিয়ে রুটি বানানো শুরু করা হয়েছিল।
ইমাম নবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর বিশেষ মু'জিযার কারণে অল্প জিনিস বৃদ্ধি পাওয়া পানি বেশি হয়ে উথলিয়ে উঠা, খাবারের তাসবীহ পাঠ করা ইত্যাদি বিষয় সংক্রান্ত হাদীসগুলো সুপ্রসিদ্ধ যার ফলে হাদীসগুলো মুতাওয়াতীর পর্যায়ে পৌছে গেছে। অতএব এ বিষয়গুলো অকাট্যভাবে প্রমাণিত। অনেক ‘আলিমগণ নুবুওয়্যাতের প্রমাণে বিভিন্ন নিদর্শন তাদের কিতাবে একত্রিত করেছেন। যেমন আবূ আবদুল্লাহ আল হালিমী তাঁর (الْقَفَّالِ الشَّاشِي) নামক কিতাবে, আবূ বাকর আল বায়হাক্বী তার (كِتَابُ الْبَيْهَقِيِّ) -তে।
অতএব সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি বিভিন্ন মু'জিযার মাধ্যমে আমাদের নবী (সা.) -এর প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। এবং এসবের মাধ্যমে আমাদেরকে সম্মানিত করেছেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ফাতহুল বারীতে আরো কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে।
যেমন- হাসান সানাদে ইমাম আহমাদ ও নাসায়ী বারা ইবনু ‘আযিব থেকে বর্ণনা করেন। খন্দক যুদ্ধের সময় যখন রাসূল (সা.) আমাদেরকে পরিখা খনন করার আদেশ করলেন তখন খনন করা অবস্থায় একটি শক্ত পাথর বের হলো। যে পাথর কোদাল দিয়ে কাটা যাচ্ছিল না। তখন আমরা রাসূল (সা.) এ-কে এ বিষয়টি জানালাম। তারপর তিনি (সা.) এসে বিসমিল্লাহ বলে কোদাল নিয়ে আঘাত করলেন। এতে সেই পাথরের এক তৃতীয়াংশ ভেঙ্গে গেল। আর তখন রাসূল (সা.) বললেন, আল্লা-হু আকবার! আমাকে সিরিয়ার চাবিকাঠি দেয়া হয়েছে। আল্লাহর শপথ! অবশ্যই আমি এ সময়ে সিরিয়ার লাল প্রাসাদগুলো দেখতে পাচ্ছি।
তারপর দ্বিতীয়বার রাসূল (সা.) সেই পাথর আঘাত করলেন। ফলে পাথরের দুই-তৃতীয়াংশ কেটে গেল। তারপর তিনি (সা.) বললেন, আল্ল-হু আকবার! আমাকে পারস্যের চাবিকাঠি দেয়া হয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি মাদায়িনের সাদা প্রাসাদগুলো দেখতে পাচ্ছি। তারপর বিসমিল্লাহ বলে তৃতীয়বার উক্ত পাথরে আঘাত করলেন। তখন পাথরের অবশিষ্ট অংশও কেটে গেল। এ সময় রাসূল (সা.) বললেন, আল্ল-হু আকবার আমাকে ইয়ামানের চাবিকাঠি দেয়া হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমি এ মুহূর্তে এই জায়গায় থেকে সানার তোরণগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
ইমাম বায়হাক্কী (রহিমাহুল্লাহ) খন্দকের যুদ্ধ সম্পর্কে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে রয়েছে, রাসূল (সা.) এই প্রত্যেক দশজন ব্যক্তির জন্য দশ হাত করে জায়গা খনন করার দায়িত্ব দিলেন। সেই হাদীসে রয়েছে, খনন করতে করতে একটি সাদা পাথর আমাদের সামনে এসে পড়ল। তাতে আঘাত করার কারণে আমাদের কোদাল ভেঙ্গে গেল। আমরা পাথরটি সেখান থেকে সরাতে চাইলাম। তখন আমরা বললাম, আগে আমরা রাসূল (সা.) -এর সাথে পরামর্শ করে নেই। তাই আমরা তাঁর কাছে সালমান আল ফারসী-কে পাঠালাম।
সেই হাদীসে আরো উল্লেখ আছে আল্লাহর রাসূল (সা.) সেই পাথরটিতে আঘাত করলেন। ফলে তা চৌচির হয়ে গেল এবং তা চমকিয়ে উঠল। তখন রাসূল (সা.) তাকবীর দিলেন এবং মুসলিমেরাও তার সাথে তাকবীর দিয়ে উঠলো। উক্ত হাদীসে আরো উল্লেখ আছে, সাহাবীরা রাসূল (সা.) -কে বললেন, আমরা আপনাকে তাকবীর দিতে দেখেছি, তাই আমরাও আপনার সাথে তাকবীর দিয়েছি। তখন রাসূল (সা.) বললেন, প্রথম চমকানোটা সিরিয়ার প্রাসাদগুলোকে আলোকিত করে দিয়েছে। তারপর জিবরীল আলায়হিস সালাম আমাকে সংবাদ দিলেন যে, আপনার উম্মত তাদের ওপর বিজয় লাভ করবে। উক্ত হাদীসের শেষ অংশে রয়েছে, তারপর মুসলিমগণ খুশি হলো এবং সুসংবাদ গ্রহণ করল।
(قَالَتْ هَلْ سَأَلَكَ قَالَ نَعَمْ فَقَالَ ادْخُلُوا) অর্থাৎ জাবির (রাঃ)-এর স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করল, আল্লাহর রাসূল (সা.) তাকে কি জিজ্ঞেস করেছেন? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ। তারপর জাবির (রাঃ) বললেন, আপনারা প্রবেশ করুন।।
এখানে বিষয়টি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এর বিস্তারিত বিবরণ ইউনুস-এর একটি বর্ণনায় আছে। আর তা হলো, জাবির (রাঃ) বলেন, আমি সেদিন অনেক লজ্জার সম্মুখীন হয়েছি যা কেবল আল্লাহই জানেন। তাদের সবাইকে দেখে আমি মনে মনে বললাম। তারা সাবই চলে এসেছেন। অথচ আমার আছে মাত্র এক সা' যব আর একটি ছাগলের বাচ্চা। তারপর আমি আমার স্ত্রীর কাছে গিয়ে বললাম, আমি লজ্জায় পড়ে গেছি। আল্লাহর রাসূল (সা.) খন্দকের সবাইকে নিয়ে তোমার দাওয়াতে চলে এসেছেন। তখন তার স্ত্রী বলল, আল্লাহর রাসূল কি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছেন যে, তোমার কাছে কি পরিমাণ খাবার আছে? তখন আমি বললাম, হ্যাঁ, তারপর আমার স্ত্রী বলল, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। আমরা তো তাকে জানিয়েই দিয়েছি যে, আমাদের কাছে কি পরিমাণ খাবার আছে। তখন আমি সেই ভীষণ চিন্তা থেকে মুক্ত হলাম।
জাবির (রাঃ)-এর অন্য আরেকটি বর্ণনায় আছে যে, তার স্ত্রী তাকে বলল, আপনি আল্লাহর রাসূলএর কাছে আবার ফিরে গিয়ে বিষয়টি বর্ণনা করুন। তারপর আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল। আমাদের কাছে শুধু একটি ছাগলের বাচ্চা ও এক সা' যব আছে। তখন রাসূল (সা.) বললেন, তুমি ফিরে যাও কিন্তু আমি না আসা পর্যন্ত চুলা থেকে পাতিল নামাবে না এবং পাতিল থেকে কোন কিছু নাড়াবেও না। বরং তা চুলার উপরই আচ পেতে থাকবে।
এরপর অপর আরেকটি বর্ণনায় আছে, জাবির (রাঃ), বলেন: আমি আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে খামির বের করে দিলাম। তখন তিনি তাতে একটু থুথু দিলেন এবং বরকতের দু'আ করলেন। তারপর পাতিলের কাছে আসলেন এবং তাতে হালকা থুথু দিয়ে বরকতের দু'আ করলেন।
ইউনুস ইবনু বুকায়র-এর বর্ণনায় আছে। রুটি তৈরি করে লোকেদেরকে দেয়া হচ্ছিল আর তারা খাচ্ছিল। এক পর্যায়ে তারা সকলেই পরিতৃপ্ত হয়ে গেল। তারপরেও দেখা গেল যে, পাতিলে ঐ পরিমাণই খাবার রয়েছে যে, পরিমাণ আগে ছিল। অতএব, এসব ঘটনা থেকে বুঝা যায় যে, এটি ছিল মুহাম্মাদ (সা.) -এর বিশেষ মু'জিযার একটি। (ফাতহুল বারী ৭/৪১০১)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭৮-[১১] আবূ কতাদাহ্ (রহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত। ’আম্মার (রাঃ) যখন খন্দক যুদ্ধের খাল খনন করছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তার (ধুলাবালু ঝাড়ার উদ্দেশে) মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, হায়! সুমাইয়্যাহ্’র পুত্রের ওপর কত কঠিন সময় আগত, তোমাকে বিদ্রোহী দলটি হত্যা করবে। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ أَبِي قَتَادَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِعَمَّارٍ حِينَ يَحْفِرُ الْخَنْدَقَ فَجَعَلَ يَمْسَحُ رَأسه وَيَقُول: «بؤس بن سميَّة تقتلك الفئة الباغية» . رَوَاهُ مُسلم
رواہ مسلم (71 ، 70 / 2915)، (7320 و 7321) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে মুহাম্মাদ (সা.) বলে দিয়েছেন যে, ‘আম্মার (রাঃ)-কে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে। মিরক্বাত প্রণেতা বিদ্রোহী দলের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, “বিদ্রোহী দল হলো সে সময়ের খলীফার আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাওয়া দল।”
তৃীবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, “আম্মার (রাঃ) যে বিদ্রোহী দল কর্তৃক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে মারা গেছেন সেই বিদ্রোহী দল দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, মু'আবিয়াহ্ (রাঃ) এবং তার দল। কারণ ‘আম্মার (রাঃ)-কে সিফফীনের যুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে। আর সিফফীনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে ‘আলী (রাঃ) ও মু'আবিয়াহ্ (রাঃ) -এর দলের মাঝে। উক্ত যুদ্ধে ‘আম্মার (রাঃ) ‘আলী (রাঃ)-এর দলে ছিলেন।
ইবনু মালিক (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এটা জেনে রাখতে হবে যে, ‘আম্মার (রাঃ)-কে হত্যা করেছেন মু'আবিয়াহ (রাঃ)-ও তার দল। অতএব এ হাদীস অনুযায়ী তারাই হলেন বিদ্রোহী হল। কারণ আম্মার (রাঃ), ‘আলী (রাঃ)-এর দলে ছিলেন। আর প্রকৃতপক্ষে খলীফাহ হওয়ার হকদার ‘আলী (রাঃ)-ই ছিলেন। কিন্তু তারা ‘আলী (রাঃ)-এর কাছে বায়'আত করেনি।
তবে এছাড়াও মু'আবিয়াহ (রাঃ) সম্পর্কে আরো কিছু উভ্রান্তিমূলক বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন- তিনি নাকি উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, উসমান (রাঃ) -এর রক্তপণ আদায়ের দাবীকে কেন্দ্র করেই আমরা বিদ্রোহী হলাম।
এ ব্যাখ্যাটি একেবারেই বিভ্রান্তিকর এবং উসমান (রাঃ)-এর রক্তপণ আদায়ের দাবীটাও অমূলক। কারণ এ হাদীসে রাসূল (সা.) ‘আম্মার (রাঃ)-এর মর্যাদা বর্ণনা করেছেন। আর তার হত্যাকারীকে নিন্দা করেছেন। এখানে আর অন্য কোন বিষয়ের কথা তিনি উল্লেখ করেননি।
মু'আবিয়াহ্ (রাঃ)-এর সম্পর্কে আরো মারাত্মক বিভ্রান্তিকর কথা ছড়ানো হয়ে থাকে। যেমন তিনি নাকি বলেছেন, “আলী (রাঃ)-ই হলেন ‘আম্মার (রাঃ)-এর হত্যাকারী। কারণ তিনি ও তার দলই ‘আম্মার-কে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেছেন। অতএব, তারাই হলেন তার নিহত হওয়ার কারণ।
আর এ ব্যাখ্যাকে যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে মারাত্মক একটি ভুল কাজ হবে। তখন হামযাহ্ (রাঃ) -এর হত্যাকারী হবেন রাসূল (সা.)। যেহেতু তিনি তাকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেছেন। আর মুমিনদের হত্যাকারী হবেন আল্লাহ। নাউযুবিল্লা-হ কত জঘন্য কথা।
সারকথা হলো উক্ত হাদীস থেকে রাসূল (সা.) -এর তিনটি মু'জিযার বিষয় জানা যায়।
১) ‘আম্মার (রাঃ)-কে অবশ্যই হত্যা করা হবে- এ কথাটি তিনি আগেই জানিয়ে দিলেন।
২) তিনি মাযলুম হয়ে মারা যাবেন, তাও জানিয়ে দিলেন।
৩) তাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে, সেটিও জানিয়ে দিলেন। এসব কিছুই সত্য হয়েছে এবং যথার্থ সময়ে বাস্তবায়িত হয়েছে।
শায়খ আকমালুদ্দীন (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, আসল কথা হলো, মু'আবিয়াহ্ (রাঃ)-এর সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক বিভিন্ন ব্যাখ্যা ও বর্ণনা সবই তার প্রতি মিথ্যারোপ।
যেমন- এ ব্যাখ্যাটি। ‘আম্মার মা-কে তারাই হত্যা করেছে যারা তাকে লড়াইয়ের জন্য বের করেছে এবং লড়াইয়ের প্রতি উৎসাহিত করেছে।
উক্ত ব্যাখ্যা মিথ্যা হওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন- এই জাতীয় ব্যাখ্যা করাটা হলো হাদীসে বিকৃতি সাধন। তাছাড়াও ‘আম্মার (রাঃ)-কে কেউ বের করেননি। বরং তিনি নিজেই তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশে বের হয়েছিলেন। এসব কিছুই মুআবিয়াহ্ (রাঃ)-এর সম্পর্কে মিথ্যা ও বানোয়াট কথা। কারণ তিনি ছিলেন একজন সচেতন ব্যক্তি এবং সম্মানিত সাহাবী। অতএব ইতিহাস যাচাই-বাছাই করে সঠিক বিষয়টি জানা এবং সাহাবীদের বিশেষ সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখাই আমাদের কর্তব্য। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৭৯-[১২] সুলায়মান ইবনু সুরদ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (খন্দক যুদ্ধের সময় মদীনাহ্ আক্রমণের উদ্দেশে মক্কাহ্ হতে আগত) কাফিরদের সম্মিলিত বাহিনী যখন (অকৃতকার্য অবস্থায়) ফিরে যেতে বাধ্য হলো, তখন নবী (সা.) বললেন, এখন হতে আমরাই তাদের ওপর আক্রমণ করব। তারা আর আমাদের ওপর আক্রমণ করতে পারবে না, আমরাই তাদের দিকে অগ্রসর হব। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن سليمانَ بن صُرَد قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حِينَ أَجْلَى الْأَحْزَابَ عَنْهُ: «الْآنَ نَغْزُوهُمْ وَلَا يغزونا نَحن نسير إِلَيْهِم» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (4019 ۔ 4110) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: খন্দক যুদ্ধে কুফফার শক্তি যখন উচ্ছেদ হলো তখন রাসূল (সা.) বললেন, এরপর থেকে আমরাই তাদেরকে আক্রমণ করতে যাব। তারা আমাদের আক্রমণ করতে আসতে পারবে না। উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মিরকাত প্রণেতা আলোচনা করে বলেন, খন্দক যুদ্ধের সময় রাসূল (সা.) এর বিরুদ্ধে দশ হাজার কাফির সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী মদীনায় আক্রমণ করার লক্ষ্যে বের হয়। কেননা, গোত্র তিহামার অধিবাসী এবং কুরায়শদের লিডার ছিলেন আবূ সুফইয়ান। গাতফান গোত্র এক হাজার সৈন্য নিয়ে বের হয়েছিল। আর তাদের সাথে নাজুদের অধিবাসীরাও এসেছিল। তাদের নেতা ছিলেন ওয়াইনাহ্ ইবনু হাসীন এবং হাওয়াযিন-এর আমীর ইবনু তুফায়ল। সেই সময়ে মদীনার ইয়াহূদী গোত্র তথা কুরায়যাহ্ ও নাযীরের লোকেরাও মুসলিমদেরকে কষ্ট দিয়েছে।
আগত কাফির সৈন্যবাহিনী মদীনায় প্রবেশ করতে পারেনি তবে তারা পরিখার অন্যপাশে অবস্থান করেছে এবং তারা একে অপরকে তীর ও পাথর নিক্ষেপ করেছে। তাদের মাঝে এই অবস্থা চলেছে প্রায় এক মাসের মত। তারপর আল্লাহ প্রত্যুষের বাতাস পাঠানোর মাধ্যমে এবং অদৃশ্য বাহিনী তথা মালাক (ফেরেশতা) পাঠিয়ে মুসলিমদেরকে সাহায্য করেছেন, আর তাদের অন্তরে ভয়-ভীতি প্রবেশ করিয়ে দেন।
ত্বলহাহ্ ইবনু খুওয়াইলিদ আল আসাদী বলেন, ওহে তোমরা! মুক্তির পথ খোঁজ। তাড়াতাড়ি মুক্তির পথ খোজ। অতঃপর তারা লড়াই ছাড়াই ভেগে যেতে বাধ্য হয়।
তারা চলে যাওয়ার পর নবী (সা.) বললেন, এরপর থেকে আমরাই তাদেরকে আক্রমণ করতে যাব। তারা আমাদেরকে আক্রমণ করতে আসতে পারবে না। কেননা অন্যদের আক্রমণ প্রতিহত করাটা অনেক সমস্যার কাজ। এজন্য আমরাই তাদের দিকে গিয়ে আক্রমণ করব। আর পরবর্তীতে তথা হুদায়বিয়ার সন্ধির পর এটিই হয়েছে, কুফফার শক্তি আর তাদেরকে আক্রমণ করতে আসতে পারেনি। তারপর মুসলিমগণ এগিয়ে গিয়ে মক্কাহ্ বিজয় করেছে এবং আল্লাহর অনুগ্রহে তারা অনেক বিজয় লাভ করেছে।
(الْآنَ نَغْزُوهُمْ) অর্থাৎ এখন থেকে আমরাই যুদ্ধ করার জন্য যাব। ত্বীবী (রহিমাহুল্লাহ) এ সম্পর্কে বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর উক্ত বাণীর মাধ্যমে এই সংবাদ পাওয়া যায় যে, মুশরিকদের দাপট কমে এসেছে। তারপর তেমনই ঘটেছে। এটি ছিল রাসূল (সা.)-এর বিশেষ মু'জিযাহ্। (মিকাতুল মাফাতীহ)
ফাতহুল বারীতে উল্লেখ করা হয়েছে, (حِينَ أَجْلَى) অর্থাৎ যখন তাদেরকে উচ্ছেদ করা হলো। এ বাক্য থেকে এটাই বুঝা যায় যে, তারা তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে আর তা সম্ভব হয়েছে মহান আল্লাহর সাহায্যের কারণেই। এটি সংঘটিত হয়েছে যিলক'দাহ্ মাসের ২৩ তারিখে। তার পরের বছর নবী (সা.) ও তাঁর সাহাবীদের নিয়ে ‘উমরাহ করতে যান। কিন্তু তিনি কুরায়শ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হন এবং তাদের মধ্যে তখন সন্ধি স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে তারাই সেই সন্ধি ভঙ্গ করে। আর এটিই মুসলিমদের পক্ষে মক্কাহ বিজয়ের সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়। (ফাতহুল বারী হা. ৪১০৯)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮০-[১৩] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন খন্দকের যুদ্ধ হতে ফিরে আসলেন এবং যুদ্ধের হাতিয়ার রেখে গোসল করলেন, তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম মাথার ধুলা ঝাড়তে ঝাড়তে এসে উপস্থিত হয়ে বললেন, আপনি তো অস্ত্রশস্ত্র রেখে দিয়েছেন, কিন্তু আল্লাহর শপথ! আমি এখনো তা পরিত্যাগ করিনি। আপনি তাদের দিকে বের হয়ে পড়ুন। নবী (সা.) বললেন, কোথায়? তখন তিনি বানী কুরায়যার দিকে ইঙ্গিত করলেন। সে সময় নবী (সা.) তাদের উদ্দেশে (অভিযানে) বের হয়ে পড়লেন। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: لَمَّا رَجَعَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ الخَنْدَق وضع السِّلاحَ واغتسل أَتاه جِبْرِيل وَهُوَ يَنْفُضُ رَأْسَهُ مِنَ الْغُبَارِ فَقَالَ قَدْ وَضَعْتَ السِّلَاحَ وَاللَّهِ مَا وَضَعْتُهُ اخْرُجْ إِلَيْهِمْ قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَيْنَ فَأَشَارَ إِلَى بَنِي قُرَيْظَةَ فَخَرَجَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4117) و مسلم (65 / 1769)، (4598) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে উল্লেখিত ‘বানু কুরায়যাহ’র পরিচয় দিতে গিয়ে মিরক্বাত প্রণেতা বলেন, তারা হলো মদীনার পার্শ্ববর্তী একটি ইয়াহুদী গোত্র যারা মুসলিমদের সাথে তাদের কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিল এবং খন্দক যুদ্ধের কুফফার বাহিনী আল্লাহর বিশেষ সাহায্যের কারণে মুসলিমদের বিপক্ষে পরাজিত হয়েছিল। মুসলিমদেরকে আল্লাহর সাহায্য করা এবং সম্মিলিত কুফফার বাহিনীর পরাজয় বরণ করার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ বিভিন্ন সিরাত গ্রন্থে দেয়া হয়েছে। আর কিছু তাফসীর গ্রন্থেও সেসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সর্বোপরি কথা হলো এই বিশাল সম্মিলিত কাফির বাহিনীর বিপক্ষে অল্প সংখ্যক মুসলিমদের বিজয় লাভ করাটা ছিল রাসূল (সা.) -এর অন্যতম একটি মু'জিযাহ্। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮১-[১৪] বুখারীর অপর এক বর্ণনায় আছে, আনাস (রাঃ) বলেন: যে সময় জিবরীল আলায়হিস সালাম বানী কুরায়যার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে সামনে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম-এর বাহনের পদাঘাতে বানী গনম গোত্রের গলিতে উত্থিত ধুলাবালি যেন আমি এখনো দেখতে পাচ্ছি।
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَفِي رِوَايَةٍ لِلْبُخَارِيِّ قَالَ أَنَسٌ: كَأَنِّي أَنْظُرُ إِلَى الْغُبَارِ سَاطِعًا فِي زُقَاقِ بَنِيَ غَنْمٍ موكبَ جِبْرِيل عَلَيْهِ السَّلَامُ حِينَ سَارَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى بني قُرَيْظَة
رواہ البخاری (4118) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন বানূ কুরায়য়াহ্-কে আক্রমণ করার উদ্দেশে বের হলেন তখন আনাস (রাঃ) দেখলেন জনমানব শূন্য বন্ধ নামের অলি-গলিতে ধুলা উড়িয়ে এক অশ্বারোহী বাহিনী চলছে। মিরক্বাত প্রণেতা বলেন, এক প্রমাণ করে যে, তারা ছিলেন, মালাক (ফেরেশতা) বাহিনী। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)।
ফাতহুল বারীতে বলা হয়েছে, নবী (সা.) ও বানূ কুরায়যাহ’র মাঝে একটি চুক্তি ছিল। কিন্তু যখন সম্মিলিত কাফির বাহিনী এসে গেল তখন তারা রাসূল (সা.) -এর সাথে কৃত চুক্তি ভঙ্গ করে তাদেরকে সাহায্য করল। তারপর যখন সম্মিলিত বাহিনীকে আল্লাহ পরাজিত করলেন, তখন বানূ কুরায়যাহ্ গিয়ে নিজেদের দুর্গে আশ্রয় নিল। তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম এবং তার সাথে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতারা) এসে রাসূল (সা.) -কে বললেন, আপনি বানূ কুরায়যার দিকে চলুন। রাসূল (সা.) বললেন, এখন আমার অনেক সাহাবী তো আহত রয়েছে। জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, আপনি তাদের দিকে চলুন, আমি তাদের ভিতরকে দুর্বল করে দিচ্ছি। তারপর জিবরীল আলায়হিস সালাম ও তাঁর সাথে থাকা মালায়িকাহ্ চলে গেলেন। তাদের যাওয়ার সময় বানূ গনম নামক একটি আনসার গোত্রের অলি-গলিতে আনাস (রাঃ) ধুলা উড়তে দেখলেন। (ফাতহুল বারী হা, ৪১১৮)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮২-[১৫] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুদায়বিয়ার দিবসে লোক পিপাসার্ত হয়ে পড়ল। সে সময় একটি চমড়ার পাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সামনে ছিল। তিনি (সা.) তা হতে উযূ করলেন। অতঃপর লোক তাঁর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রসূল! আপনার চর্মপাত্রের পানি ছাড়া পান করার বা উযূ করার মত আমাদের কাছে কোন পানি নেই। তখন নবী (সা.) তাঁর হাত উক্ত পাত্রে রাখলেন। ফলে সাথে সাথেই তার আঙ্গুলগুলোর মধ্যবর্তী জায়গা হতে ঝরনাধারার মত পানি ফুটে বের হতে লাগল। জাবির (রাঃ) বলেন, আমরা সেই পানি (তৃপ্তি সহকারে) পান করলাম এবং তা দিয়ে আমরা উযূ করলাম। জাবির (রাঃ)-কে প্রশ্ন করা হল, সংখ্যায় আপনারা কতজন ছিলেন? তিনি বললেন, একলাখ হলেও সে পানিই আমাদের জন্য যথেষ্ট হত। তবে তখন আমাদের সংখ্যা ছিল পনের শত। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ عَطِشَ النَّاسُ يَوْمَ الْحُدَيْبِيَةِ وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بَيْنَ يَدَيْهِ رِكْوَةٌ فَتَوَضَّأَ مِنْهَا ثُمَّ أَقْبَلَ النَّاسُ نَحْوَهُ قَالُوا: لَيْسَ عَنْدَنَا مَاءٌ نَتَوَضَّأُ بِهِ وَنَشْرَبُ إِلَّا مَا فِي رِكْوَتِكَ فَوضَعَ النبيُّ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم يَدَه فِي الرِّكْوَةِ فَجَعَلَ الْمَاءُ يَفُورُ مِنْ بَيْنِ أَصَابِعِهِ كَأَمْثَالِ الْعُيُونِ قَالَ فَشَرِبْنَا وَتَوَضَّأْنَا قِيلَ لِجَابِرٍ كَمْ كُنْتُمْ قَالَ لَوْ كُنَّا مِائَةَ أَلْفٍ لَكَفَانَا كُنَّا خَمْسَ عَشْرَةَ مِائَةً. مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (4152) و مسلم (73 / 1856)، (4813) ۔
(مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা : উক্ত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর একটি বিশেষ মু'জিযার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যা হুদায়বিয়াতে ঘটেছিল। তখন সেখানে উপস্থিত সাহাবীদের সংখ্যা বিভিন্ন হাদীসে ১৪০০ এর কম-বেশি করে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম সুয়ূত্বী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, তখন হুদায়বিয়াতে সাহাবীদের সংখ্যা ছিল চৌদ্দশত এর কিছু বেশি। তবে অতিরিক্ত সংখ্যাটি এমন ছিল না যা শতকে পৌঁছে যায়।
অতএব যারা তাদের সংখ্যা চৌদ্দশত বলে উল্লেখ করেছেন, তারা সেই অতিরিক্ত সংখ্যাকে বাদ দিয়েছেন। আর যারা পনের শত বলে উল্লেখ করেছেন তারা সেই অতিরিক্ত সংখ্যাকে শতক ধরেই হিসাব করেছেন। আবার কেউ কেউ ষোল শত বা সতের শত বলে উল্লেখ করেছেন। তারা হয়ত উক্ত দলের সাথে আগত শিশুদের ও অন্যান্য লোকদেরকেও হিসাব করেছেন।
ইবনু মারদুওয়াইহি ইবনু আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন যে, তাদের সংখ্যা ছিল পনের শত পঁচিশ জন। তারপরেও প্রকৃত বিষয়ে আল্লাহই অধিক অবগত। (মিরকাতুল মাফাতীহ)।
ফাতহুল বারীতে বলা হয়েছে যে, নবী (সা.) তাঁর হাত পাত্রে রাখলেন। আর পানি তাঁর আঙ্গুল দিয়ে বের হতে শুরু করল। অন্য হাদীসে বলা হয়েছে যে, নবী (সা.) তার উযূর অতিরিক্ত পানি কুপে ঢেলে দিলেন। আর তখন কুপে পানি বেশি হতে লাগল।
এখানে বাহ্যিকভাবে উক্ত হাদীস দুটির মাঝে বৈপরীত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাই ইমাম ইবনু হিব্বান (রহ.) উক্ত হাদীস দুটির মাঝে বর্ণনা করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, হুদায়বিয়াতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনাটি দু'বার ঘটেছে- ১) তার আঙ্গুল দিয়ে পানি বের হয়ে তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২) তাঁর বরকতময় পানি কূপে ঢেলে দেয়ার কারণে তা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এটিও হতে পারে যে, তাঁর আঙ্গুল থেকে পানি বের হওয়ার সময় তার হাত পাত্রে ছিল আর তারা সকলেই সেখান থেকে পানি নিয়ে উযূ করেছিল এবং পান করেছিল। তারপর পাত্রে থাকা অবশিষ্ট পানি কুপে ঢেলে দিতে বললেন। তা ঢেলে দেয়ার পর কূপের পানি বৃদ্ধি পেলো। যেমন জাবির (রাঃ) নুবায়হি আল ‘আনাযী-এর সূত্রে বর্ণনা করেন। তাতে রয়েছে যে, এক ব্যক্তি একটি পাত্রে অল্প পানি নিয়ে আসলো। সেই পানিটুকু ছাড়া অন্য কোন লোকের কাছে একটুও পানি ছিল না। সেই পানি আল্লাহর রাসূল (সা.) একটি পেয়ালায় ঢাললেন।
তারপর সেখান থেকে পানি নিয়ে ভালোভাবে উযু করলেন এবং পাত্রটি সেখানে রেখে চলে গেলেন। অতঃপর লোকেরা উক্ত পাত্রটির কাছে ভিড় করল। তখন রাসূল (সা.) বললেন, তোমরা থাম। অতঃপর তিনি উক্ত পাত্রে হাত রাখলেন। তারপর বললেন, তোমরা পরিপূর্ণভাবে উযূ করো। উক্ত হাদীসের বর্ণনাকারী বলেন, সেদিন মানুষ দেখেছে যে, মানুষের আঙ্গুল দিয়ে ঝরনা প্রবাহিত হচ্ছে।
(دَلَائِلِ الْبَيْهَقِيِّ) (দালায়িলুল বায়হাক্কী) গ্রন্থে রয়েছে যে, নবী (সা.) কূপের গভীরে একটি তীর রাখতে আদেশ করলেন। তারপর যখন তা রাখলেন তখন কূপের পানি উথলিয়ে উঠল।
রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর জীবদ্দশায় কম পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা বিভিন্ন সময়ই ঘটেছে। এটি ছিল মুহাম্মাদ (সা.) -এর মু'জিযাহ্। (ফাতহুল বারী হা. ৪১৫২)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৩-[১৬] বারা’ ইবনু ’আযিব (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, হুদায়বিয়ার দিন রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে আমরা চৌদ্দশত ছিলাম। হুদায়বিয়াহ্ একটি কূপের নাম। উক্ত কূপ হতে পানি তুলতে তুলতে তার সবটুকু পানি আমরা নিঃশেষ করে ফেললাম। এমনকি আমরা তাতে এক ফোঁটা পানিও অবশিষ্ট রাখিনি। অতঃপর নবী (সা.) -এর কাছে এ সংবাদটি পৌছলে তিনি (সা.) উক্ত কূপের কাছে এসে বসলেন এবং এক পাত্র পানি চেয়ে এনে উযু করলেন ও কুলি করলেন। তারপর দু’আ করলেন। অতঃপর কূপের ভিতরে উক্ত পানি ঢেলে দিয়ে বললেন, কিছু সময়ের জন্য তোমরা এই কূপ হতে পানি তোলা বন্ধ রাখ। এরপর সকলে নিজে এবং আরোহণের জানোয়ারসমূহ এ স্থান ত্যাগ করা অবধি সে পানি তৃপ্তি সহকারে ব্যবহার করলেন। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن الْبَراء بن عَازِب قا ل: كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَرْبَعَ عَشْرَةَ مِائَةً يَوْمَ الْحُدَيْبِيَةِ وَالْحُدَيْبِيَةُ بِئْرٌ فَنَزَحْنَاهَا فَلَمْ نَتْرُكْ فِيهَا قَطْرَةً فَبَلَغَ النبيَّ صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فأتاهافجلس عَلَى شَفِيرِهَا ثُمَّ دَعَا بِإِنَاءٍ مِنْ مَاءٍ فَتَوَضَّأَ ثُمَّ مَضْمَضَ وَدَعَا ثُمَّ صَبَّهُ فِيهَا ثُمَّ قَالَ: دَعُوهَا سَاعَةً فَأَرْوَوْا أَنْفُسَهُمْ وَرِكَابَهُمْ حَتَّى ارتحلوا. رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (4150) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে বর্ণিত ঘটনা সম্পর্কে মিরকাত প্রণেতা বলেন যে, এ ঘটনাটির আগে জাবির (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত ঘটনাটি ঘটেছে। তার মানে বুঝা যায় যে, হুদায়বিয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর থেকে একাধিক বার মু'জিযাহ প্রকাশ পেয়েছে।
মানুষের কাছে এটি খুব আশ্চর্যের বিষয় যে, তারা এই কূপটিকে সংরক্ষণও করেনি এবং ব্যাপক কল্যাণের লক্ষ্যে তার ওপর বড় কোন প্রাচীরও নির্মাণ করে রাখেনি। অথচ তা মক্কার কাছেই জিদ্দা যাওয়ার পথে অবস্থিত ছিল। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৪-[১৭] ’আওফ (রহিমাহুল্লাহ) আবূ রজা’ (রহিমাহুল্লাহ) হতে এবং তিনি ’ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, একবার আমরা নবী (সা.) -এর সাথে এক ভ্রমণে ছিলাম। লোকেরা তাঁর কাছে পিপাসার অভিযোগ করল। তখন তিনি (সা.) অবতরণ করলেন এবং অমুককে ডাকলেন। আবূ রজা’ তার নাম বলেছিলেন কিন্তু আওফ ভুলে গেলেন, তাই ’আলী (রাঃ)-কে ডেকে বললেন, তোমরা দুজন যাও এবং পানির অনুসন্ধান কর। তারা উভয়ে রওয়ানা হলেন এবং পথিমধ্যে এমন একটি মহিলার সাক্ষাৎ পেলেন, যে একটি বাহনের (উটের পিঠে দুই দিকে পানির দু’টি মশক বা দু’টি থলে রেখে নিজে মাঝখানে বসে যাচ্ছে। তখন তারা মহিলাটিকে নবী (সা.) -এর কাছে নিয়ে আসলেন এবং লোকেরা মহিলাটিকে তার উটের পিঠ হতে নিচে নামতে বলল। অতঃপর নবী (সা.) একটি পাত্র আনালেন। তারপর মশক দুটির মুখ হতে এতে পানি ঢেলে নিলেন। আর লোকেদেরকে ডেকে বললেন, তোমরা নিজেরাও পান কর এবং পশুদেরকেও পান করাও। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা চল্লিশজন পিপাসার্ত লোক পূর্ণ তৃপ্তি সহকারে পানি পান করলাম এবং আমাদের সাথে যতগুলো মশক ও অন্যান্য পাত্র ছিল সেগুলোও প্রতিটি পানি দ্বারা পরিপূর্ণ করে নিলাম।
বর্ণনাকারী ’ইমরান বলেন, আল্লাহর শপথ! যখন আমাদেরকে পানির মশক হতে পৃথক করা হলো, (অর্থাৎ পানি নেয়া শেষ হলো,) তখন আমাদের এমন মনে হচ্ছিল যেন মশকটি প্রথম অবস্থার তুলনায় আরো অনেক বেশি পূর্ণ রয়েছে। (বুখারী ও মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَن عَوْف عَن أبي رَجَاء عَن عمر بن حُصَيْن قا ل: كُنَّا فِي سَفَرٍ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم فَاشْتَكَى إِلَيْهِ النَّاسُ مِنَ الْعَطَشِ فَنَزَلَ فَدَعَا فُلَانًا كَانَ يُسَمِّيهِ أَبُو رَجَاءٍ وَنَسِيَهُ عَوْفٌ وَدَعَا عَلِيًّا فَقَالَ: «اذْهَبَا فَابْتَغِيَا الْمَاءَ» . فَانْطَلَقَا فتلقيا امْرَأَة بَين مزادتين أَو سطحتين من مَاء فجاءا بهاإلى النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ وَسلم فاستنزلوهاعن بَعِيرِهَا وَدَعَا النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِإِنَاءٍ فَفَرَّغَ فِيهِ مِنْ أَفْوَاهِ الْمَزَادَتَيْنِ وَنُودِيَ فِي النَّاسِ: اسْقُوا فَاسْتَقَوْا قَالَ: فَشَرِبْنَا عِطَاشًا أَرْبَعِينَ رَجُلًا حَتَّى رَوِينَا فَمَلَأْنَا كُلَّ قِرْبَةٍ مَعَنَا وَإِدَاوَةٍ وَايْمُ اللَّهِ لَقَدْ أَقْلَعَ عَنْهَا وإنَّهُ ليُخيّل إِلينا أنّها أشدُّ ملئةً مِنْهَا حِين ابْتَدَأَ. مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (344) و مسلم (312 / 682)، (1563) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: এ হাদীসেও হুদায়বিয়াতে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর থেকে প্রকাশিত একটি মু'জিযার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। হাদীসের শেষ অংশে ‘ইমরান ইবনু হুসায়ন (রাঃ) বলেন, (وإنَّهُ ليُخيّل إِلينا أنّها أشدُّ ملئةً مِنْهَا حِين ابْتَدَأَ) অর্থাৎ আমার কাছে মনে হলো যে, পানি ব্যবহার করা শুরু করার আগে মশকে যে পরিমাণ পানি ছিল ব্যবহার করার পর দেখা গেল যে, তার থেকে বেশি পানি রয়েছে।
এ বিষয়ে মিরক্বাত প্রণেতা বলেন, তারা যখন উক্ত মশক থেকে পান করা শুরু করে তখন যে পরিমাণ পানি ছিল সেখান থেকে চল্লিশজন পান করার পরেও দেখা গেল যে, তার থেকে আরো বেশি পানি ভর্তি হয়ে আছে। এটিও রাসূল (সা.)-এর বিশেষ মু'জিযাহ্। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৫-[১৮] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে যাচ্ছিলাম। চলার পথে আমরা একটি বিস্তীর্ণ ময়দানে অবতরণ করলাম। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বীয় প্রয়োজন পূরণের জন্য গেলেন, কিন্তু আড়াল করার জন্য কিছুই পেলেন না। এ সময় হঠাৎ ময়দানের এক পার্শে দুটি গাছ দেখা গেল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন তার একটির কাছে গেলেন এবং তার একটি ডাল ধরে বললেন, আল্লাহর হুকুমে তুমি আমার অনুগত হও, গাছটি তৎক্ষণাৎ এমনভাবে তার অনুগত হলো, যেমন নাকে রশি লাগানো উট তার চালকের অনুগত হয়ে থাকে। এবার তিনি (সা.) দ্বিতীয় বৃক্ষটির কাছে যেয়ে তার একটি শাখা ধরে বললেন, আল্লাহর নির্দেশে তুমি আমার অনুগত হও। অতএব বৃক্ষটি সাথে সাথেই তার প্রতি অনুরূপ ঝুঁকে পড়ল। অবশেষে যখন তিনি (সা.) উভয় বৃক্ষের মধ্যখানে গিয়ে দাঁড়ালেন, তখন বললেন, আল্লাহর হুকুমে তোমরা উভয়ে আমার জন্য মিলিত হয়ে যাও। তখনই তারা মিলিত হয়ে গেল (তার আড়াল হয়ে হাজত পূরণ করলেন)। বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমি বসে এই বিস্ময়কর ঘটনার কথা মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম। এ অবস্থায় হঠাৎ আমি একদিকে তাকাতেই দেখি, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাশরীফ এনেছেন। আর বৃক্ষ দু’টিকেও দেখলাম তারা পুনরায় আলাদা হয়ে গেছে এবং প্রত্যেকটি আপন আপন জায়গায় গিয়ে যথারীতি দাঁড়িয়ে রয়েছে। (মুসলিম)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ: سِرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى نَزَلْنَا وَادِيًا أَفْيَحَ فَذَهَبَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقْضِي حَاجَتَهُ فَلَمْ يَرَ شَيْئًا يَسْتَتِرُ بِهِ وَإِذَا شَجَرَتَيْنِ بِشَاطِئِ الْوَادِي فَانْطَلَقَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَى إِحْدَاهُمَا فَأَخَذَ بِغُصْنٍ مِنْ أَغْصَانِهَا فَقَالَ انْقَادِي عَلَيَّ بِإِذْنِ اللَّهِ فَانْقَادَتْ مَعَهُ كَالْبَعِيرِ الْمَخْشُوشِ الَّذِي يُصَانِعُ قَائِدَهُ حَتَّى أَتَى الشَّجَرَةَ الْأُخْرَى فَأَخَذَ بِغُصْنٍ مِنْ أَغْصَانِهَا فَقَالَ انْقَادِي عَلَيَّ بِإِذْنِ اللَّهِ فَانْقَادَتْ مَعَهُ كَذَلِكَ حَتَّى إِذَا كَانَ بِالْمَنْصَفِ مِمَّا بَيْنَهُمَا قَالَ الْتَئِمَا عَلَيَّ بِإِذْنِ اللَّهِ فَالْتَأَمَتَا فَجَلَسْتُ أُحَدِّثُ نَفْسِي فَحَانَتْ مِنِّي لفتة فَإِذَا أَنَا بِرَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مُقْبِلًا وَإِذَا الشَّجَرَتَيْنِ قَدِ افْتَرَقَتَا فَقَامَتْ كُلُّ وَاحِدَةٍ مِنْهُمَا عَلَى سَاقٍ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
رواہ مسلم (74 / 3012)، (7518) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা : উক্ত হাদীসে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক প্রকাশিত মু'জিযাহ্ সেখানে উপস্থিত সকল সাহাবী অবলোকন করেছেন। এমনকি তিনি (সা.) তাঁর প্রাকৃতিক প্রয়োজন যখন পুরা করলেন তখন সেই গাছ দু'টি আবার চলে গেল। এ দৃশ্যটি সাহাবীগণ তাদের নিজ নিজ জায়গায় থেকে দেখেছেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৬-[১৯] ইয়াযীদ ইবনু আবূ ’উবায়দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি সালামাহ্ ইবনু আকওয়া’ (রাঃ)-এর পায়ের গোছায় আঘাতের চিহ্ন দেখে প্রশ্ন করলাম, হে আবূ মুসলিম! আঘাতটি কিসের? তিনি বললেন, এ আঘাত খায়বার যুদ্ধে লেগেছিল। তখন লোকেরা বলাবলি করছিল, সালামাহ্ মৃত্যুবরণ করেছেন। সালামাহ (রাঃ) বলেন, অতঃপর আমি নবী (সা.) -এর কাছে আসলাম। তিনি আমার জখমের উপর তিনবার ফুঁ দিলেন, ফলে সে সময় হতে অদ্যাবধি আর আমার কোন প্রকারের কষ্ট হয়নি। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
عَن يَزِيدَ بْنِ أَبِي عُبَيْدٍ قَالَ: رَأَيْتُ أَثَرَ ضَرْبَةٍ فِي سَاقِ سَلَمَةَ بْنِ الْأَكْوَعِ فَقُلْتُ يَا أَبَا مُسلم مَا هَذِه الضَّربةُ؟ فَقَالَ: هَذِه ضَرْبَةٌ أَصَابَتْنِي يَوْمَ خَيْبَرَ فَقَالَ النَّاسُ أُصِيبَ سَلَمَةُ فَأَتَيْتُ الْنَبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَنَفَثَ فِيهِ ثَلَاثَ نَفَثَاتٍ فَمَا اشْتَكَيْتُهَا حَتَّى السَّاعَة. رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (4206) ۔
(صَحِيح)
পরিচ্ছেদঃ প্রথম অনুচ্ছেদ - মু'জিযার বর্ণনা
৫৮৮৭-[২০] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যায়দ (ইবনু হারিসাহ্), জাফর (ইবনু আবূ তালিব) ও (আবদুল্লাহ) ইবনু রওয়াহাহ-এর মৃত্যু সংবাদ যুদ্ধের ময়দান হতে আসার আগেই নবী (সা.) লোকেদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। রণক্ষেত্রের বর্ণনা তিনি (সা.) এভাবে দিয়েছেন- যায়দ পতাকা হাতে নিয়েছে, সে শহীদ হয়েছে। তারপর জাফর পতাকা হাতে নিয়েছে, সেও শহীদ হয়েছে। অতঃপর ’আবদুল্লাহ ইবনু রওয়াহাহ্ পতাকা ধরেছে, সেও শহীদ হয়েছে। (বর্ণনাকারী বলেন,) এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর চক্ষুদ্বয় হতে অশ্রুধারা প্রবাহিত ছিল। এরপর তিনি (সা.) বললেন, আল্লাহর তরবারিসমূহের এক তরবারি [খালিদ ইবনু ওয়ালীদ (রাঃ)] পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তা’আলা কাফিরদের ওপর মুসলিমদের বিজয়ী করেছেন। (বুখারী)
الفصل الاول (بَاب فِي المعجزا)
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ نَعَى النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ زَيْدًا وَجَعْفَرًا وَابْنَ رَوَاحَةَ لِلنَّاسِ قَبْلَ أَن يَأْتِيهِ خَبَرُهُمْ فَقَالَ أَخْذَ الرَّايَةَ زِيدٌ فَأُصِيبَ ثُمَّ أَخَذَ جَعْفَرٌ فَأُصِيبَ ثُمَّ أَخَذَ ابْنُ رَوَاحَةَ فَأُصِيبَ وَعَيْنَاهُ تَذْرِفَانِ حَتَّى أَخَذَ الرَّايَةَ سَيْفٌ من سيوف الله حَتَّى فتح الله عَلَيْهِم. رَوَاهُ البُخَارِيّ
رواہ البخاری (4262) ۔
(صَحِيح)
ব্যাখ্যা : উক্ত হাদীসে মূতার যুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যে সকল সেনাপতি মূতার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন রাসূলুল্লাহ (সা.) মদীনায় থেকে তাদের সংবাদ দিয়েছেন। মিরকাত প্রণেতা বলেন, এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয় যে, কেউ মারা গেলে তার সংবাদ প্রচার করা বৈধ।
অষ্টম হিজরীতে তিন হাজার মুসলিম সৈন্য সিরিয়ার মূতা নামক এলাকায় তৎকালীন রোমের বাদশাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। প্রতিপক্ষের সৈন্য ছিল এক লক্ষ। সেই যুদ্ধে এক এক করে তিনজন মুসলিম সেনাপতি শহীদ হন। তখন রাসূল (সা.) মদীনায় বসে থেকে তাদের মৃত্যুর সংবাদ দিচ্ছিলেন। আর তার চক্ষু দিয়ে অঝরে অশ্রু বেয়ে পড়ছিল। তিনজন সেনাপতির শাহাদাতের পর দায়িত্ব নেন খালিদ ইবনু ওয়ালীদ। তিনি জীবন বাজি রেখে বীর বিক্রমে লড়াই করে যান। সেদিন তিনি একে একে আটটি তরবারি যুদ্ধ করে ভেঙ্গে ফেলেন এবং ছিনিয়ে আনেন মুসলিমদের বিজয়। তবে বিজয়টি কিভাবে হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে এই বিষয়ে যে, তারা কি বিজয়ী হয়ে মুশরিকদেরকে পরাজিত করে গনীমতের মাল নিয়ে ফিরেছিলেন নাকি শুধু কেবল বীরত্ব দেখিয়ে নিরাপদে মদীনায় ফিরে এসেছিলেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ)