পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ - মিরাজের বর্ণনা
৫৮৬৭-[৬] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে বলতে শুনেছেন, (মি’রাজের ব্যাপারে) কুরায়শরা যখন আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চেষ্টা করল, তখন আমি কাবাগৃহের হাত্বীমে দাঁড়ালাম। এমতাবস্থায় আল্লাহ তা’আলা বায়তুল মাক্বদিস মাসজিদখানা আমার সামনে প্রকাশ করে দিলেন। ফলে আমি তার দিকে তাকিয়ে তার চিহ্ন ও নিদর্শনগুলো তাদেরকে বলে দিতে থাকলাম। (বুখারী ও মুসলিম)
اَلْفصْلُ الثَّالِثُ (بَابٌ فِي الْمِعْرَاجِ)
عَن جَابِرٍ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «لَمَّا كَذَّبَنِي قُرَيْشٌ قُمْتُ فِي الْحِجْرِ فَجَلَّى اللَّهُ لِيَ بَيْتَ الْمَقْدِسِ فَطَفِقْتُ أُخْبِرُهُمْ عَنْ آيَاتِهِ وَأَنَا أَنْظُرُ إِلَيْهِ» . مُتَّفق عَلَيْهِ
متفق علیہ ، رواہ البخاری (3886) و مسلم (276 / 170)، (428) ۔
(مُتَّفق عَلَيْهِ)
ব্যাখ্যা: (لَمَّا كَذَّبَنِي قُرَيْشٌ) অর্থাৎ যখন কুরায়শরা আমাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। এ ব্যাপারে তুহফাতুল আহওয়াযীতে বলা হয়েছে, যখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে ইসরা সম্পর্কে বিভিন্ন কথাবার্তা বললেন, তখন তারা তাঁর কাছে এর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আলামতের দাবী করল।
(فَجَلَّى اللَّهُ لِيَ بَيْتَ الْمَقْدِسِ) অর্থাৎ তখন আমার জন্য বায়তুল মাকদিস প্রকাশ করে দেয়া হলো। এর ব্যাখ্যায় তুহফাতুল আহওয়াযীতে তিনটি উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে।
১) হাফিয (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, এর অর্থ হলো আমার মাঝে এবং বায়তুল মাকদিসের মাঝে এমনভাবে পর্দা উঠিয়ে দেয়া হলো যে, আমি তা দেখতে পাচ্ছিলাম।
২) সহীহ মুসলিমে এ ব্যাপারে হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তা থেকে বুঝা যায় বায়তুল মাক্বদিসকে নিয়ে এসে এমন স্থানে রাখা হয় যেখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) তা দেখতে পাচ্ছিলেন।
৩) হাসান সনদে বর্ণিত ইবনু আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, বায়তুল মাকদিসকে নিয়ে এসে ‘উকায়ল-এর বাড়ীর কাছে এমনভাবে রাখা হলো যে, আমি তা দেখতে পাচ্ছিলাম মোটকথা হলো বায়তুল মাকদিসকে এমন স্থানে উপস্থিত করা হয় যে, রাসূল (সা.) তা দেখতে পান। আর এটি আল্লাহর জন্য মোটেই কোন কঠিন বিষয় নয়।
আরো একটি বিষয় জেনে রাখা ভালো যে, ইমাম তিরমিযী (রহিমাহুল্লাহ)-এর এ হাদীসগুলো সূরাহ বানী ইসরাঈলের প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় নিয়ে এসেছেন। যে আয়াতে শুধু রাসূল (সা.) -এর ইসরা তথা মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করার কথা রয়েছে। কিন্তু রাসূল (সা.) -এর মাসজিদুল হারাম থেকে ঊর্ধ্ব ভ্রমণের কথা কোন আয়াতে বর্ণিত হয়নি তা কেবল বিভিন্ন সহীহ হাদীসেই বর্ণিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর মি'রাজ স্বশরীরে হয়েছিল, নাকি আত্মিকভাবে হয়েছিল। এ ব্যাপারে তুহফাতুল আহওয়াযীতে তিনটি মত উল্লেখ করা হয়েছে।
১) তাঁর মি'রাজ হয়েছে স্বশরীরে। ২) তাঁর মি'রাজ হয়েছে আত্মিকভাবে, স্বশরীরে নয়। ৩) কিছুটা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। আর তা হলো, তাঁর ইসরা তথা মক্কাহ থেকে বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত ভ্রমণ হয়েছে স্বশরীরে। আর সেখান থেকে ঊর্ধ্ব ভ্রমণ হয়েছে আত্মিকভাবে।
এখানে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত এবং বেশিরভাগ সালাফ ও খালাফদের কথা আর সহীহ হাদীসগুলোর বর্ণনানুসারে প্রথম মতটিই গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ তার মি'রাজ হয়েছে স্বশরীরে। (তুহফাতুল আহওয়াযী হা. ৩১৩৩)
রাসূলুল্লাহ (সা.) মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ করতে গিয়ে যা কিছু দেখেছেন সেগুলোর কিছু ফাতহুল বারীতে ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহিমাহুল্লাহ) নাসায়ীর বরাতে উল্লেখ করেছেন। যেমন- তিনি যখন মাসজিদুল হারাম থেকে ভ্রমণ শুরু করেন তখন এক স্থানে জিবরীল আলায়হিস সালাম তাকে বললেন, আপনি এখানে নেমে সালাত আদায় করুন। রাসূল (সা.) সেখানে তা-ই করেন। তারপর জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, আপনি কি জানেন কোন স্থানে সালাত আদায় করলেন? জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, এটি হলো উত্তম জায়গা। এখানেই হিজরত হবে। অর্থাৎ এটি হলো ইয়াসরিব।
তারপর আবার আরেক স্থানে জিবরীল আলায়হিস সালাম তাঁকে বললেন, আপনি নেমে সালাত আদায় করুন। তখন তিনি সেখানে নেমে সালাত আদায় করলেন। তারপর জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, আপনি সায়না পর্বতে সালাত আদায় করলেন। যেখানে আল্লাহ মূসা আলায়হিস সালাম-এর সাথে কথা বলেছিলেন।
জিবরীল আলায়হিস সালাম আবার তাঁকে এক স্থানে বললেন, আপনি নেমে সালাত আদায় করুন। তখন তিনি সেখানে নেমে সালাত আদায় করলেন। তারপর জিবরীল আলায়হিস সালাম তাঁকে বললেন, আপনি বাইতে লাহমে সালাত আদায় করলেন। যেখানে ‘ঈসা আলায়হিস সালাম জন্মগ্রহণ করেছেন। শাদ্দাদ-এর আরেকটি বর্ণনায় আছে যে, রাসূল (সা.) একটি সাদা ভূমির উপর দিয়ে অতিক্রম করলেন। তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম তাঁকে বললেন, আপনি নেমে সালাত আদায় করুন। রাসূল (সা.) সেখানে নেমে সালাত আদায় করলেন। তারপর জিবরীল আলায়হিস সালাম তাঁকে বললেন, আপনি মাদায়িনে সালাত আদায় করলেন। শাদ্দাদ-এর বর্ণনায় আছে, যে পথে রাসূল (সা.) কুরায়শদের একটি কাফেলাকে সালাম দিয়েছিলেন তখন তাদের কেউ কেউ বলল, এটি মুহাম্মাদ-এর আওয়াজ। সেই বর্ণনায় আরো আছে যে, তিনি মিরাজ থেকে ফিরে এসে মক্কার লোকেদেরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের কাফেলা অমুক দিন এসে উপস্থিত হবে।
ইমাম বায়হাক্কী (রহিমাহুল্লাহ) ‘দালায়িল’ গ্রন্থে আনাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সা.) এমন কিছুর পাশ দিয়ে অতিক্রমকালে তাঁকে রাস্তা থেকে সরে যেতে ডাকছিল। তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম তাঁকে বললেন, আপনি চলুন। তারপর তিনি আরেকটি বৃদ্ধার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম তাঁকে বললেন, আপনি চলুন। তারপর তিনি কিছু লোকেদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। আর তারা তাঁকে সালাম দিলেন। তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, আপনি সালামের উত্তর দিন।
তারপর তিনি তাদের সালামের উত্তর দিলেন। শেষে জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, যে আপনাকে ডেকেছে সে হলো ইবলীস এবং বৃদ্ধা হলো দুনিয়া আর যারা আপনাকে সালাম দিয়েছেন তারা হলেন ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা আলায়হিস সালাম। তবারানী এবং বাযযার-এর নিকট আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে আরো কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যা রাসূল (সা.) ইসরা ও মি'রাজের ভ্রমণে দেখেছেন। যেমন- রাসূল (সা.) কিছু লোকেদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যারা ফসল বুনছে আর কাটছে। যখনই তারা ফসল কাটছে তখনই তা আবার পূর্বের মতোই ফসলে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, এরা হলো মুজাহিদগণ।
তারপর রাসূল (সা.) আরো কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যাদের মাথা পাথর দিয়ে থেতলে দেয়া হচ্ছে। যখনই থেতলে দেয়া হচ্ছে তখনই তা আবার পূর্বের মতো ঠিক হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই তাদেরকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে। জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, তারা হলো ঐ সকল লোক যাদের মাথা সালাতের প্রতি অবহেলা করত।
তারপর আরো কিছু লোকেদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যাদের শরীর পশুর মতো সূচ দিয়ে আঁচড়ানো হচ্ছে। তখন জিবরীল আলায়হিস সালাম রাসূল (সা.) -কে বললেন, এরা হলো ঐ সকল ব্যক্তি যারা যাকাত আদায় করত না।
তারপর তিনি আরো কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যারা দুর্গন্ধযুক্ত পঁচা গোশত ভক্ষণ করছে। (অথচ তাদেরকে ভালো সুস্বাদু গোশতের দিকে ডাকা হচ্ছে, কিন্তু তারা সেখানে যেতে পারছে না।) জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, এরা হলো যিনাকারী।
তারপর তিনি এক লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যে লাকড়ীর বোঝা জমা করছে। কিন্তু সে তা বহন করতে পারছে না। তারপরেও সে তা জমা করেই যাচ্ছে। জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, এ হলো ঐ ব্যক্তি যার কাছে আমানাত রাখা হত। কিন্তু সে তা আদায় করত না। তারপরেও সে অন্য আমানত খোঁজ করত।
তারপর তিনি আরো কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন, যাদের ঠোট ও জিহ্বা কাটা হচ্ছে। যখনই কাটা হচ্ছে তখনই আবার তা ঠিক হয়ে যাচ্ছে। জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, এরা হলো ফিতনাবাজ বক্তাগণ।
তবারানীর হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো কিছু লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন। যাদের পেট ছিল ঘরের মতো বড়। যখন তারা দাঁড়াতে ইচ্ছা করত তখনই তারা পড়ে যেত। জিবরীল আলায়হিস সালাম বললেন, এরা হলো সুদখোর ব্যক্তি। এ জাতীয় কিছু বিষয়ও রাসূল (সা.) তাঁর ইসরা ও মি'রাজের ভ্রমণে দেখতে পেয়েছেন। (ফাতহুল বারী ৭/৩৮৮৬)