পরিচ্ছেদঃ ৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - বসা, ঘুমানো ও চলাফেরা করা
৪৭০৭-[১] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পবিত্র কা’বাহ্ গৃহের চত্বরে দেখলাম যে, তিনি নিজের দু’ হাত উভয় পায়ের গোছা (হাঁটু খাড়া করে) পরিবেষ্টন করেছিলেন। (বুখারী)[1]
بَابُ الْجُلُوْسِ وَالنَّوْمِ وَالْمَشْىِ
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِفنَاء الْكَعْبَة مُحْتَبِيًا بيدَيْهِ. رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যাঃ আলোচ্য হাদীসে (فنَاء الْكَعْبَة) দ্বারা কি উদ্দেশ্য করা হয়েছে তা নিয়ে মুহাদ্দিসগণের নিকট মতবিরোধ রয়েছে। তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
১. ফাতহুল বারীর প্রণেতা ইবনু হাজার ‘আসকালানী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ কা‘বার সামনে দিককে বুঝানো হয়েছে। ২. মুল্লা ‘আলী কারী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, কা‘বার সম্মুখস্থ প্রশস্ত স্থান। ৩. মিরক্বাতুল মাফাতীহ প্রণেতার মতে, কা‘বার সামনে প্রশস্ত আঙ্গিনাকে বুঝানো হয়েছে। ৪. কারো কারো মতে কা‘বার চারদিকে প্রশস্ত স্থানকে বুঝানো হয়েছে।
(مُحْتَبِيًا بيدَيْهِ) দ্বারা উদ্দেশ্য : ইহতিবা বলা হয়, দু’ হাঁটু উপরে তুলে, উরুকে পেটের সাথে মিলিয়ে দু’ হাত দিয়ে নলা জড়িয়ে ধরে নিতম্বের ওপর বসা। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা এভাবে বসতেন না। এ হাদীস দ্বারা ইহতিবা বৈধতা প্রমাণিত হয়। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - বসা, ঘুমানো ও চলাফেরা করা
৪৭০৮-[২] ’আব্বাদ ইবনু তামীম (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর চাচা হতে বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মসজিদের মধ্যে চিৎ হয়ে এক পা অপর পায়ের উপর রেখে শায়িত অবস্থায় দেখেছি। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْجُلُوْسِ وَالنَّوْمِ وَالْمَشْىِ
وَعَن عبَّادِ بن تَمِيم عَنْ عَمِّهِ قَالَ: رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَسْجِدِ مُسْتَلْقِيًا وَاضِعًا إِحْدَى قدمَيه على الْأُخْرَى. مُتَّفق عَلَيْهِ
ব্যাখ্যাঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিৎ হয়ে শুয়ে এক পা অপর পায়ের উপর রেখে শায়িত ছিলেন। এর অর্থ হলো পা লম্বা করে এক পা অপর পায়ের মধ্যে প্রবেশ করা অবস্থায় অথবা একটির উপর অপরটি সোজাসুজিভাবে স্থাপন করে শুয়েছেন। এভাবে শয়ন করলে সতর খুলে যায় না। সুতরাং এরূপ শয়ন করা নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু পা খাড়া করে একটিকে অপরটির উপরে রাখা দ্বারা যেহেতু সতর খুলে যাওয়ার আশংকা রয়েছে, তাই তা নিষিদ্ধ। এভাবে শয়ন করা হলে :
১. পায়ের উপর পা রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে সতর খুলে যেতে পারে।
২. এতে বুকে পিঠে ব্যথা হতে পারে। ৩. এরূপ শয়ন দেখতে ভদ্রতার পরিপন্থী। এ সমস্ত কারণে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিৎ হয়ে পায়ের ওপর পা রেখে শয়ন করতে নিষেধ করেছেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - বসা, ঘুমানো ও চলাফেরা করা
৪৭০৯-[৩] জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন ব্যক্তিকে চিৎ হয়ে শুয়ে এক পা খাড়া করে অপর পা তার উপরে রাখতে নিষেধ করেছেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْجُلُوْسِ وَالنَّوْمِ وَالْمَشْىِ
وَعَنْ جَابِرٍ قَالَ: نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَرْفَعَ الرَّجُلُ إِحْدَى رِجْلَيْهِ عَلَى الْأُخْرَى وَهُوَ مُسْتَلْقٍ عَلَى ظَهْرِهِ. رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যাঃ দু’টি হাদীসের মাঝে দ্বন্দ্ব ও সমাধান: জাবির (রাঃ)-এর হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, চিৎ হয়ে এক পায়ের উপর অপর পা তুলে শয়ন করা নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে ‘আব্বাদ ইবনু তামীম (রাঃ) হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, স্বয়ং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে এরূপ শয়ন করেছেন। সুতরাং বাহ্যিকভাবে উভয় হাদীসে দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। মুহাদ্দিসগণ যেভাবে সমাধান দিয়েছেন তা নিম্নে বর্ণনা করা হলো :
ক. ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ সম্ভাবনা রয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে চিৎ হয়ে শয়ন করা পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন, যা হারাম বুঝায় না। বরং সাবধানতার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করেছেন।
খ. কাযী ‘ইয়ায (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ সম্ভবত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রয়োজনে এভাবে শয়ন করেছিলেন, তার ক্লান্তি দূর করা ক্ষণিকের জন্য ‘আব্বাদ ইবনু তামীম (রাঃ) যেভাবে দেখেছিলেন, সেভাবে শুয়েছিলেন।
গ. ইমাম খত্ত্বাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, জাবির (রাঃ)-এর হাদীস ‘আব্বাদ ইবনু তামীম (রাঃ)-এর হাদীস দ্বারা রহিত হয়ে গেছে।
ঘ. তাছাড়া আব্বাদ (রাঃ)-এর হাদীসটি ফে‘লী ও জাবির (রাঃ)-এর হাদীসটি কওলী- এ ধরনের হাদীসদ্বয়ের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে কওলী হাদীসকে প্রাধান্য দেয়া হয়।
ঙ. ‘আব্বাদ (রাঃ)-এর হাদীসটি হা-বোধক, আর জাবির (রাঃ)-এর হাদীসটি না-বোধক, এরূপ ক্ষেত্রে না-বোধক হাদীস প্রাধান্য লাভ করে থাকে।
চ. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক পা খাড়া করে তার উপর অপর পা রেখে শয়ন করেননি। হয়তো বা শয়ন করে থাকলেও সাথে সাথে উভয় পা সোজা করেছেন। বর্ণনাকারী যে অবস্থায় দেখেছেন তাই বর্ণনা করেছেন।
মন্তব্য: কাজেই বুঝা গেল চিৎ হয়ে শয়ন করলে সাবধান থাকা চাই। এটা হারাম নয় বরং অনুত্তম। সুতরাং হাদীস দু’টিতে কোন দ্বন্দ্ব নেই। (শারহুন নাবাবী ১৪শ খন্ড, হাঃ ৪০৯৯; মিরক্বাতুল মাফাতীহ ৪৭০৮ ও ৪৭০৯)
পরিচ্ছেদঃ ৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - বসা, ঘুমানো ও চলাফেরা করা
৪৭১০-[৪] উক্ত রাবী [জাবির (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমাদের কেউ কখনো এমনভাবে চিৎ হয়ে শয়ন করবে না যে, এক পা খাড়া করে অপর পা তার উপর থাকে। (মুসলিম)[1]
بَابُ الْجُلُوْسِ وَالنَّوْمِ وَالْمَشْىِ
وَعَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَا يستلقين أحدكُم ثمَّ يضع رجلَيْهِ على الْأُخْرَى» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যাঃ চিৎ হয়ে শোয়া বলতে বুঝায় পিঠ নিচে রেখে বুক উপরের দিকে দিয়ে শয়ন করাকে চিৎ হয়ে শয়ন করা বুঝায়। এটা আবার দু’ ধরনের হতে পারে। ক. দুই পা সোজাভাবে বিছিয়ে এক পায়ের উপর অপর পা রাখা। এ অবস্থায় সতর খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বিধায় এভাবে শয়ন করা জায়িয। খ. চিৎ হয়ে শয়ন করে এক পায়ের হাঁটু খাড়া করে অপর পা তার উপর রাখা এভাবে শয়ন করা সতর খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বিধায় এরূপ শয়ন করা নিষিদ্ধ। (মিনহাতুল মুসলিম ৭০/২০৯৯)
পরিচ্ছেদঃ ৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - বসা, ঘুমানো ও চলাফেরা করা
৪৭১১-[৫] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ একদিন জনৈক ব্যক্তি নকশা করা দু’টি চাদর গায়ে দিয়ে প্রবল অহমিকার সাথে চলছিল এবং এ অবস্থায় তার মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করছিল। ফলে এ ব্যক্তিকে জমিনে ধসিয়ে দেয়া হলো, আর এ অবস্থায় সে কিয়ামত পর্যন্ত মাটির গভীরে বিলীন হতে থাকবে। (বুখারী ও মুসলিম)[1]
بَابُ الْجُلُوْسِ وَالنَّوْمِ وَالْمَشْىِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «بَيْنَمَا رَجُلٌ يَتَبَخْتَرُ فِي بُرْدَيْنِ وَقد أعجبتْه نَفسه خسف بِهِ لأرض فَهُوَ بتجلجل فِيهَا إِلَى يَوْم الْقِيَامَة» . مُتَّفق عَلَيْهِ. لفصل الثَّانِي
ব্যাখ্যাঃ রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী (بَيْنَمَا رَجُلٌ) শব্দের অর্থ জনৈক ব্যক্তি। এ জনৈক ব্যক্তি দ্বারা কাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা নিয়ে ‘আলিমদের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ উল্লেখিত ব্যক্তি দ্বারা উম্মাতে মুহাম্মাদীর কোন এক ব্যক্তি উদ্দেশ্য হওয়া অসম্ভব নয়। কেউ কেউ বলেন, এ ব্যক্তি ছিল মূসা (আ.)-এর সময়কালের কারূন। সে প্রবল অহংকার করে চলত। আল্লাহ তা‘আলা তার অহংকার চূর্ণ করেছিলেন, কারূন-এর ধ্বংস হওয়া সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘অতঃপর আমি কারূনকে ও তার প্রাসাদকে ভূগর্ভে বিলীন করে দিলাম।’’ (সূরাহ্ আল কাসাস ২৮ : ৮১)
হাদীসের শিক্ষা : এ হাদীস ও কুরআনের আয়াত হতে প্রমাণিত হয় যে, অহংকার অহমিকা ও আত্মগৌরব ইত্যাদির পরিণাম ধ্বংস। সুতরাং সকলকে এটা হতে বাঁচতে হবে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)