পরিচ্ছেদঃ ১৪. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - লি‘আন
৩৩২০-[১৭] ’আমর ইবনু শু’আয়ব তাঁর পিতার মাধ্যমে তাঁর দাদা হতে বর্ণনা করেন। জনৈক ব্যক্তি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট) দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রসূল! অমুক আমার সন্তান। জাহিলিয়্যাতের সময় (ইসলাম-পূর্ব যুগে) আমি তার মায়ের সাথে ব্যভিচার করেছিলাম। এটা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, জাহিলিয়্যাতের প্রথা বাতিল হয়ে গেছে, ইসলামের বিধানে পিতৃত্বের কোনো দাবি নেই, ইসলামী বিধান হলো- সন্তান হবে শয্যাশায়িনীর, আর ব্যভিচারীর জন্য পাথর (নিক্ষেপ)। (আবূ দাঊদ)[1]
عَنْ عَمْرِو بْنِ شُعَيْبٍ عَنْ أَبِيهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ: قَامَ رَجُلٌ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ فَلَانًا ابْنِي عَاهَرْتُ بِأُمِّهِ فِي الْجَاهِلِيَّةِ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا دِعْوَةَ فِي الْإِسْلَامِ ذَهَبَ أَمْرُ الْجَاهِلِيَّةِ الْوَلَدُ لِلْفِرَاشِ وَلِلْعَاهِرِ الْحَجَرُ» . رَوَاهُ أَبُو دَاوُد
ব্যাখ্যা: (إِنَّ فَلَانًا ابْنِىْ) অর্থাৎ অমুক আমার ছেলে। ছেলে দাবী করা দলীল হিসেবে পরবর্তী বাক্য (عاهرت بأمه في الجاهلية) নিয়ে আসা হয়েছে। অর্থাৎ আমি তার মায়ের সাথে জাহিলিয়্যাতের যুগে যিনা করেছি। মূর্খতার যুগে যিনার মাধ্যমে যে সন্তান হতো তাকেও যিনাকারী তার দিকে সম্পৃক্ত করত। ইসলাম এসে বংশের পবিত্রতা রক্ষা করে এবং বিবাহ ও বৈধ মালিকানাধীন দাসীর মাধ্যমে যে সন্তান হয় কেবল তাকেই নিজ বংশীয় সন্তান বলে স্বীকৃতি দিয়ে বাকী সব অবৈধ পন্থা নাকচ করে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণিত ব্যক্তির দাবীর উপর বলেন, (لَا دِعْوَةَ فِى الْإِسْلَامِ ذَهَبَ أَمْرُ الْجَاهِلِيَّةِ) অর্থাৎ দাবী করে সন্তানের মালিক হওয়ার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। জাহিলী যুগের বিধান ইসলামে কার্যকর নয়। ইসলাম এসে জাহিলী বিধানকে মিটিয়ে দিয়েছে। সন্তানের বংশ বৈবাহিক বা মালিকানার শয্যার মাধ্যমে প্রমাণিত হবে। যে যিনা করবে সে সন্তান পাবে না বরং পাথর পাবে। অর্থাৎ তাকে পাথর দিয়ে আঘাত করে মারা হবে। (মিরকাতুল মাফাতীহ; ‘আওনুল মা‘বূদ ৪র্থ খন্ড, হাঃ ২২৭১)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - লি‘আন
৩৩২১-[১৮] উক্ত রাবী (’আমর ইবনু শু’আয়ব) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ চার শ্রেণীর রমণীর সাথে স্বামীর লি’আন গৃহীত হয় না- ১. মুসলিম পুরুষের নাসারা (খ্রিষ্টান) স্ত্রী, ২. মুসলিম পুরুষের ইয়াহূদী স্ত্রী, ৩. গোলাম স্বামীর স্বাধীনা স্ত্রী এবং ৪. স্বাধীনা পুরুষের বাঁদী স্ত্রী। (ইবনু মাজাহ)[1]
وَعَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَرْبَعٌ مِنَ النِّسَاءِ لَا مُلَاعَنَةَ بَيْنَهُنَّ: النَّصْرَانِيَّةُ تَحْتَ الْمُسْلِمِ وَالْيَهُودِيَّةُ تَحْتَ الْمُسْلِمِ وَالْحُرَّةُ تَحْتَ الْمَمْلُوكِ وَالْمَمْلُوكَةُ تَحْتَ الْحُرِّ . رَوَاهُ ابْنُ مَاجَه
ব্যাখ্যা: (أَرْبَعٌ مِنَ النِّسَاءِ لَا مُلَاعَنَةَ بَيْنَهُنَّ) স্ত্রীর স্বামী যিনার অভিযোগ তুললে এবং স্ত্রী তা অস্বীকার করলে শারী‘আত লি‘আনের বিধান রেখেছে। অধ্যায়ের শুরুতে আমরা এ সংক্রান্ত হাদীস দেখে এসেছি। এই হাদীসে যাদের মাঝে লি‘আনের বিধান কার্যকর হবে না তাদের একটি বিবরণ দেয়া হয়েছে। হাদীসে চার ধরনের নারীর বিবরণ দেয়া হয়েছে যাদের সাথে লি‘আন কার্যকর হবে না। যেমনঃ স্বামী মুসলিম স্ত্রী খ্রীষ্টান, স্বামী মুসলিম স্ত্রী ইয়াহূদ, স্বামী দাস স্ত্রী স্বাধীনা, স্ত্রী দাসী স্বামী স্বাধীন। এই চার প্রকারের মাঝে লি‘আনের বিধান নেই।
এ হাদীসের উপর ক্বিয়াস করে ফুকাহায়ে কিরাম আরো যাদের মাঝে লি‘আনের বিধান কার্যকর হবে না বলে মনে করেন তা হলোঃ স্বামী যদি পূর্বে কাউকে অপবাদ দেয়ার কারণে দণ্ডে দণ্ডিত হয়ে থাকে তবে তার কথা গ্রহণ করে লি‘আন কার্যকর করা যাবে না। তদ্রূপ স্ত্রী যদি অপবাদের দণ্ডে দণ্ডিত হয়ে থাকে তবে লি‘আন হবে না। এভাবে স্ত্রী না-বালেগাহ, পাগল, ব্যভিচারিণী হলে লি‘আন কার্যকর হবে না। মূলত লি‘আন একটি গুরুত্বপূর্ণ কসমের বিধান যার মাঝে স্বামী স্ত্রীর একের উপর অন্যের অভিযুক্ত করা রয়েছে; তাই একজনের কথা অন্যের উপর গ্রহণ করতে হলে মৌলিক মর্যাদায় সমান থাকা বাঞ্ছনীয়। এ কারণে হয়ত শারী‘আত এই শর্ত আরোপ করেছে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - লি‘আন
৩৩২২-[১৯] ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বামী-স্ত্রী উভয়কে লি’আন করার সময় একব্যক্তিকে (পুরুষকে) নির্দেশ দিলেন- লি’আন চলাকালীন পঞ্চমবার যখন সে বলতে উদ্যত হবে তখন তার মুখের উপর হাত চেপে ধর। কারণ, পঞ্চমবারের উক্তি ’’আমি যদি মিথ্যাবাদী হই, তবে আল্লাহর লা’নাত (অভিসম্পাত) আমার ওপর হোক’’ তথা নিজের ওপর অবধারিত করে নেয়। (নাসায়ী)[1]
وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَ رَجُلًا حِينَ أَمَرَ الْمُتَلَاعِنَيْنِ أَنْ يَتَلَاعَنَا أَنْ يَضَعَ يَدَهُ عِنْدَ الْخَامِسَةِ عَلَى فِيهِ وَقَالَ: «إِنَّهَا مُوجِبَةٌ» . رَوَاهُ النَّسَائِيُّ
ব্যাখ্যা: (إِنَّهَا مُوجِبَةٌ) নিশ্চয় এটা কার্যকরকারী। অর্থাৎ এই পঞ্চমবার বললেই হুকুম কার্যকর হয়ে যাবে। হাদীসের বাহযত দৃষ্টিতে এই বাক্যটি ঐ ব্যক্তিকে শিখিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, সে যেন লি‘আনকারীর মুখে হাত রেখে এই বাক্যটি বলে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)
পরিচ্ছেদঃ ১৪. তৃতীয় অনুচ্ছেদ - লি‘আন
৩৩২৩-[২০] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘর হতে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। এতে আমার ব্যথাতুর মনে ক্ষোভের উদ্রেক করে। পরক্ষণেই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফিরে এসে আমাকে বিমর্ষ ভাব দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে ’আয়িশাহ্! কি হয়েছে তোমার? তুমি কি ঈর্ষান্বিত হয়েছ? আমি বললাম, আপনার মতো মানুষের প্রতি (সাহচর্য হতে বঞ্চিত হয়ে) আমার মতো নারী কি করে ঈর্ষান্বিত না হয়ে থাকতে পারে? এটা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাকে শায়ত্বন প্ররোচিত করেছে। আমি (বিস্ময়াভিভূত হয়ে) জিজ্ঞেস করলাম- হে আল্লাহর রসূল! আমার সাথেও কি শায়ত্বন থাকতে পারে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনার নিকটও শায়ত্বন আসতে পারে? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হ্যাঁ, তবে তার বিরুদ্ধে আল্লাহ আমাকে সাহায্য করায় আমি (তার ওয়াস্ওয়াসাহ্ হতে) নিরাপদপ্রাপ্ত হই। (মুসলিম)[1]
وَعَنْ عَائِشَةَ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ مِنْ عِنْدِهَا لَيْلًا قَالَتْ: فَغِرْتُ عَلَيْهِ فَجَاءَ فَرَأَى مَا أَصْنَعُ فَقَالَ: «مَا لَكِ يَا عَائِشَةُ أَغِرْتِ؟» فَقُلْتُ: وَمَا لِي؟ لَا يَغَارُ مِثْلِي عَلَى مِثْلِكَ؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَقَدْ جَاءَكِ شَيْطَانُكِ» قَالَتْ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَمْعِي شَيْطَانٌ؟ قَالَ: «نَعَمْ» قُلْتُ: وَمَعَكَ يَا رَسُولَ الله؟ قَالَ: «نعم وَلَكِن أعانني علَيهِ حَتَّى أسلَمَ» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: (لَقَدْ جَاءَكِ شَيْطَانُكِ) ‘‘নিশ্চয় তোমার কাছে তোমার শায়ত্বন এসেছে।’’ এ কথা বলার কারণ হলো, এখানে গাইরতের কোনো কারণ নেই। বৈধ কাজের উপর গাইরত বা আত্মমর্যাদা আল্লাহ তা‘আলার পছন্দ নয় বলে আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। এ কারণেই হয়ত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আয়িশাহ্ -কে এ কথা বলেছেন। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর মনে রসূলের ওপর সন্দেহ থেকে গাইরত সৃষ্টি হয়েছে এমন কল্পনার সুযোগ নেই। বরং রসূলের জন্য তার অতিরিক্ত ভালোবাসাই এই গাইরতের কারণ। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, (لَا يَغَارُ مِثْلِىْ عَلٰى مِثْلِكَ؟) অর্থাৎ আমার মতো মানুষ আপনার মতো ব্যক্তিত্বের ওপর গাইরত করবে না কেন? তথাপি যেহেতু এখানে গাইরত ভিত্তিহীন তাই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা বলেছেন।
(حَتّٰى أسلَمَ) সিগাটি মুযারে‘ মুতাকাল্লিম। حتى হরফের কারণে সিগার শেষের ‘মীম’ হরফে যবর হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার সাহায্যের কারণে আমি শায়ত্বনের ওয়াস্ওয়াসা বা কুমন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকি। অথবা সিগাটি মাযির এবং সর্বনাম শায়ত্বনের দিকে প্রত্যাবর্তিত। মাযির সিগা হিসেবে ‘উলামাগণ দু’টি অর্থ করে থাকেন। أسلم অর্থ استسلم অর্থাৎ সে আমার অনুগত হয়ে গেছে, ফলে আমাকে কুমন্ত্রণা দেয় না। কেউ কেউ বলেন, অর্থ হলো সে মুসলিম মু’মিন হয়ে গেছে। বাহ্যিক অর্থ এটাই। আল্লাহ অধিক ভালো জানেন।
কাযী ‘ইয়ায বলেনঃ জেনে রাখো, উম্মাত এ কথার উপর একমত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শায়ত্বনের সব ধরনের কুমন্ত্রণা থেকে সংরক্ষিত ও মুক্ত। শরীর, অন্তর, যবান কোথায়ও শায়ত্বন তাকে কুমন্ত্রণা দিতে পারে না। (শারহে মুসলিম ১৭/১৮ খন্ড, হাঃ ২৮১৫; মিরকাতুল মাফাতীহ)