পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
ইমাম যুরক্বানী (রহঃ) বলেন, মদীনাহ্ বলা হয় বড় শহরকে। অতঃপর শব্দটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দারুল হিজরতকেই মদীনাহ্ নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে।
ইবনু হাজার ’ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেন, মদীনাহ্ একটি সুপরিচিত শহরের নাম যেখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করেছেন, (এবং মৃত্যুর পর) সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে। এর প্রাচীন নাম ছিল ইয়াসরিব। বর্তমান এ মদীনাহ্ শহরটির নাম ’’মদীনাহ্’’ এবং ’’ইয়াসরিব’’ উভয়টি পবিত্র কুরআনুল কারীমে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- মহান আল্লাহর বাণীঃ
(ক) يَقُوْلُوْنَ لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِيْنَةِ
’’তারা বলে- আমরা যদি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করি, তাহলে সম্মানীরা অবশ্য অবশ্যই হীনদেরকে সেখানে থেকে বহিষ্কার করবে।’’ (সূরা আল মুনা-ফিকূন ৬৩ : ৮)
(খ) وَإِذْ قَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ يَا أَهْلَ يَثْرِبَ
’’স্মরণ কর, যখন তাদের একদল বলেছিল- হে ইয়াসরিববাসী! তোমরা (শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে) দাঁড়াতে পারবে না, কাজেই তোমরা ফিরে যাও।’’ (সূরা আল আহযা-ব ৩৩ : ১৩)
ইয়াসরিব (বর্তমানের মদীনাহ্ শহরের) একটি স্থানের নাম। অতঃপর পুরো শহরটিকেই ইয়াসরিব নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, নূহ (আঃ) এর পুত্র শাম, তদীয় পুত্র ইরাম, তদীয় পুত্র ক্বনিয়াহ্, তদীয় পুত্র ইয়াসরিব-এর নামানুসারে এ শহরের নাম রাখা হয় ইয়াসরিব।
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম রাখেন ত্ববাহ্ ও ত্বইয়্যিবাহ্। এখানে ’আমলীক্ব’গণ বসবাস করত। অতঃপর বনী ইসরাঈলের একটি সম্প্রদায় এখানে উপনীত হন ও বসবাস শুরু করেন।
যুবায়র ইবনু বাকর ’’আখবারে মদীনাহ্’’ নামক গ্রন্থে একটি দুর্বল সনদে উল্লেখ করেছেন, এদের (ইসরাঈলদের) মূসা (আঃ) এখানে প্রেরণ করেছিলেন। এরপর আওস এবং খাযরাজ গোত্র এখানে আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) মদীনাহ্ শহরের পাঁচটি নামের উল্লেখ করেছেন। যথা- মদীনাহ্, ত্ববাহ্, ত্বইয়্যিবাহ্, আদ্দার ও ইয়াসরিব।
সহীহ মুসলিমে জাবির (রাঃ) থেকে মারফূ’ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- ’’নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলাই মদীনার নাম রেখেছেন ’’ত্ববাহ্’’ বা পবিত্র। ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, ত্ববাহ্ এবং ত্বইয়্যিবাহ্ নাম রাখা হয়েছে এজন্য যে, এ শহর শির্ক থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
গবেষকগণ মদীনাহ্ শহরের অনেকগুলো নাম বর্ণনা করেছেন, বিস্তারিত দেখতে চাইলে ’’ওয়াফাউল ওয়াফা’’ এবং ’’উম্দাতুল আখবার’’ নামক গ্রন্থ দেখুন।
জানা আবশ্যক যে, হানাফীদের নিকট মদীনার একটি মর্যাদা রয়েছে, তবে তা মক্কার মতো নয়। পক্ষান্তরে আয়িম্মায়ে সালাসা তথা তিন ইমাম এর বিরোধী তারা মনে করেন মদীনার হুরমত মক্কার মতই। এখানকার শিকার ধরা হারাম, বৃক্ষ কর্তন হারাম ইত্যাদি। (সামনে এর বিস্তারিত বিবরণ আসবে)
২৭২৮-[১] ’আলী হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কুরআন ও এ সহীফায় (পুস্তকে) যা আছে তা ছাড়া অন্য কোন কিছু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে আমরা লিখে রাখিনি। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মদীনাহ্ হারাম (অর্থাৎ- সম্মানিত বা পবিত্র) ’আয়র হতে সওর পর্যন্ত। যে ব্যক্তি এতে কোন বিদ্’আত (অসৎ প্রথা) চালু করবে অথবা বিদ্’আত চালুকারীকে আশ্রয় দেবে তার ওপর আল্লাহ ও মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) এবং সকল মানুষেরই অভিসম্পাত। তার ফরয বা নফল কিছুই কবূল (গ্রহণযোগ্য) হবে না। সকল মুসলিমের প্রতিশ্রুতি বা দায়িত্ব এক; তাদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিও তার চেষ্টা করতে পারে। যে কোন মুসলিমের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তার ওপর আল্লাহ ও মালায়িকাহ্ এবং সকল মানুষেরই অভিসম্পাত। তার ফরয ও নফল কোনটিই গৃহীত হবে না। আর যে নিজের মালিকের অনুমতি ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব (সম্পর্ক) স্থাপন করে তার ওপর আল্লাহর ও মালায়িকাহ্’র এবং সকল মানুষেরই অভিসম্পাত। তার ফরয বা নফল কোনটিই গৃহীত হবে না। (বুখারী, মুসলিম)
বুখারী ও মুসলিমের আর এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি নিজের পিতা ছাড়া অন্যকে পিতা বলে স্বীকার করেছে অথবা যে ক্রীতদাস নিজের মালিক ছাড়া অন্যকে মালিক বলে গ্রহণ করেছে তার ওপর আল্লাহর, মালায়িকাহ্’র এবং সকল মানুষেরই অভিসম্পাত। তার কোন ফরয বা নফল কোনটাই গৃহীত হবে না।[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: مَا كَتَبْنَا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَّا الْقُرْآنَ وَمَا فِي هَذِهِ الصَّحِيفَةِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «الْمَدِينَةُ حَرَامٌ مَا بَيْنَ عَيْرٍ إِلَى ثَوْرٍ فمنْ أحدَثَ فِيهَا حَدَثًا أَوْ آوَى مُحْدِثًا فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لَا يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلَا عَدْلٌ ذمَّةُ المسلمينَ واحدةٌ يَسْعَى بِهَا أَدْنَاهُمْ فَمَنْ أَخْفَرَ مُسْلِمًا فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لَا يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلَا عَدْلٌ وَمَنْ وَالَى قَوْمًا بِغَيْرِ إِذْنِ مَوَالِيهِ فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لَا يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلَا عدل»
وَفِي رِوَايَةٍ لَهُمَا: «مَنِ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ أَوْ تَوَلَّى غَيْرَ مَوَالِيهِ فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لَا يُقْبَلُ مِنْهُ صرف وَلَا عدل»
ব্যাখ্যা: ‘আলী (রাঃ)-এর উক্তি- ‘‘আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরআন ছাড়া কিছুই লিখি না, আর যা এ সহীফায় রয়েছে।’’ উল্লেখিত বাক্যে হাদীসটি ইমাম বুখারীর সহীহ গ্রন্থে সুফিয়ান-এর সূত্রে তিনি আ‘মাশ হতে, তিনি ইব্রাহীম আত্ তায়মী হতে, তিনি তার পিতা হতে, তিনি ‘আলী হতে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটি ইমাম মুসলিম আবূ মু‘আবিয়াহ্-এর সূত্রে তিনি আ‘মাশ থেকে, তিনি ইব্রাহীম থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি অর্থাৎ- ইয়াযীদ ইবনু শারীক আত্ তায়মী (ইব্রাহীম-এর পিতা) বলেছেন, ‘আলী ইবনু আবূ ত্বলিব আমাদের মাঝে খুৎবাহ্ দিতে গিয়ে বললেন, ‘‘যে ধারণা করে যে কুরআন ছাড়া এবং এ সহীফাহ্ ছাড়া আমাদের নিকট আরো কিছু আছে যা আমরা পাঠ করে থাকি সে মিথ্যা বলল।’’
ইমাম বুখারী আবূ জুহাফাহ্’র সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি ‘আলী -কে জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের নিকট কি কোন কিতাব আছে? তিনি বললেন, না, তবে আল্লাহর কিতাব (আল কুরআন) এবং ঐ বুঝ বা জ্ঞান যা একজন মুসলিম মুসলিমকে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) দেয়া হয়েছে আর এ সহীফায় যা রয়েছে।
হাফিয ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, প্রশ্নকারী ‘আলী (রাঃ)-কে বহুবচনে সম্বোধন করে প্রশ্ন করেছেন; এর দ্বারা হয়তো পুরো আহলে বায়ত উদ্দেশ্য অথবা তার সম্মান উদ্দেশ্য।
আবূ জুহায়ফাহ্ ‘আলী (রাঃ)-কে এ প্রশ্নের করার কারণ হলো শী‘আদের ধারণা- আহলে বাইত তথা নাবী পরিবার, বিশেষ করে ‘আলী (রাঃ)-এর নিকট ওয়াহীর এমন কতিপয় বিষয় ছিল যা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে খাসভাবে দান করেছিলেন, যে সম্পর্কে অন্যদের কোন অবহিত ছিল না।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেনঃ শী‘আ এবং রাফিযীরা বলে থাকে, ‘আলী (রাঃ)-এর প্রতি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকগুলো ওয়াসিয়্যাত করে গেছেন এবং শারী‘আতের গুপ্ত ভান্ডার, দীনের কাওয়ায়িদ এবং আসরারুল ‘ইলম বা ‘ইলমের গুপ্ত রহস্য বা তত্ত্বজ্ঞান তাকে দিয়ে গেছেন। তিনি আহলে বাইতদের এমন কিছু দিয়ে গেছেন যার সম্পর্কে অন্যদের কোন জ্ঞান-ই নেই। তাদের এ দাবী সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, মিথ্যা এবং বাতিল। ‘আলী (রাঃ)-এর নিজের কথাই তার ব্যাখ্যা প্রদান করেছে, যা অন্য বর্ণনায় এসেছে। আবূ জুহায়ফাহ্ ‘আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘‘আপনার এ সহীফায় কি আছে?’’ উত্তরে তিনি বলেছেন, বন্দীপণ, অর্থাৎ- বন্দীর মুক্তিপণ।
হাফিয ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, বুখারী এবং মুসলিমে ইয়াযীদ আত্ তায়মীর সূত্রে ‘আলী (রাঃ) থেকে এভাবে বর্ণনা এসেছে, তিনি বলেছেন,
ما عندنا شيء نقرؤه إلا كتاب الله وهذه الصحيفة، فإذا فيها الجراحات وأسنان الإبل والمدينة حرم.
আমাদের নিকট রক্ষিত আল্লাহর কিতাব ছাড়া আর কিছুই পাঠ করি না, আর এ সহীফায় যা রয়েছে। এতে রয়েছে, যখমের বিধান, উটের দাঁতের বিধান এবং মদীনার সম্মানের বিধান।
সহীহ মুসলিমে আবূ তুফায়ল-এর সূত্রে রয়েছে- ‘আলী (রাঃ) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বসাধারণের নিকট থেকে আমাদের কোন কিছুতেই বিশেষ কোন কিছু দ্বারা খাস করেননি। তবে এ তরবারির খাপে যা সংরক্ষিত। এরপর তিনি সেটা হতে লিখিত সংকলন বের করে দেখেন সেখানে লেখা আছে- لعن الله من ذبح لغير الله... الحديث। আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন ঐ ব্যক্তির ওপর যে আল্লাহর নাম ছাড়া অন্যের নামে পশু যাবাহ করে......। মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে- সেটাতে ফারায়িযুস্ সাদাকা লিখা ছিল। এ সকল বিভিন্ন রকম অর্থ সম্বলিত বর্ণনা সত্ত্বেও এ সহীফাহ্ ছিল একটি মাত্র এবং সকল বর্ণনার কথাগুলোই সেটাতে লিখা ছিল। যে যে বাক্য স্মরণ রেখেছেন সে সেটুকুই বর্ণনা করেছেন।
সহীহুল বুখারীতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনা ‘‘মদীনাহ্ সম্মানিত’’-এর মূলে ‘আরাবী حرام শব্দ ব্যবহার হয়েছে যার অর্থ নিষিদ্ধ।
আহমাদ, আবূ দাঊদ প্রভৃতি গ্রন্থেও অনুরূপ ‘আলিফ’সহ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু মুসলিমের বর্ণনায় المدينة حرم ‘আলিফ’ ছাড়া বর্ণিত হয়েছে। এমনকি বুখারী, আহমাদ, তিরমিযী, নাসায়ী প্রভৃতি গ্রন্থেও।
الحرام শব্দটি ‘আলিফ’ ছাড়া حَرَمٌ-এর অর্থ প্রদান করেছে। কেননা বিভিন্ন রকমের বর্ণনার একটি আরেকটির তাফসীর করে থাকে।
মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) বলেন, حرام-এর অর্থ محترم ممنوع مما يقتضي إهانة الموضع المكرم অর্থ ‘‘সম্মানিত’’, যে সম্মানিত স্থানের অবমাননা নিষিদ্ধ। ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) الحرام-এর অর্থ গ্রহণ করেছে الحرم নিষিদ্ধ ও সম্মানিত।
মদীনার এ নিষিদ্ধ এরিয়া হলো ‘আয়র এবং সাওর-এর মধ্যবর্তী স্থান। ‘আয়র হলো মদীনাহ্ থেকে কিবলার দিকে যুল্ হুলায়ফার (যা মদীনাবাসীদের মীকাত) সন্নিকটে প্রসিদ্ধ একটি পাহাড়। আর সাওর হলো উহুদ পাহাড়ের পিছনে ছোট্ট একটি পাহাড়, তাই বলে এটা মক্কার সে সাওর পাহাড় নয়।
(ثور) ‘সাওর’ শব্দটি ইমাম মুসলিমের একক বর্ণনা, বুখারীতে (إلى كذا) শব্দে বর্ণিত হয়েছে, যাতে ইব্হাম বা অস্পষ্টতা রয়েছে।
আবূ ‘উবায়দ আল কাসিম ইবনুস্ সালাম বলেন, (مَا بَيْنَ عَيْرِ إِلٰى ثَوْرٍ) এ শব্দ সম্বলিত বাক্যটি ইরাকবাসীদের বর্ণনা, মদীনাবাসীরা ‘সাওর’ নামক কোন পর্বত আছে বলে তারা জানে না। ‘সাওর’ হলো মক্কার পাহাড়ের নাম। আমরা মনে করি হাদীসের আসল কথা হলোঃ (مَا بَيْنَ عَيْرِ إِلٰى ثَوْرٍ)
হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, এটা ত্ববারানী এবং আহমাদ-এর বর্ণনা যা ‘আব্দুল্লাহ ইবনুস্ সালাম রিওয়ায়াত করেছেন, উভয় বর্ণনায় উহুদ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মদীনার সম্মানিত বা নিষিদ্ধ এরিয়া হলো পূর্বে কঙ্করময় টিলা এবং পশ্চিমেও কঙ্করময় টিলা আর উত্তর দক্ষিণে সাওর এবং ‘আয়র।
ইমাম শাফি‘ঈ, মালিক, আহমাদ তথা জমহূর আহলে ‘ইলম মনে করেন মক্কার মতই মদীনারও একটি নিষিদ্ধতা রয়েছে, এখানকার শিকার হত্যা করা যাবে না, বৃক্ষ কর্তন করা যাবে না। তবে ইমাম শাফি‘ঈ এবং মালিক (রহঃ)-এর একটি মত কেউ যদি কোন শিকার হত্যা করেই ফেলে অথবা কোন বৃক্ষ কর্তন করেই ফেলে তবে তার ওপর কোন জরিমানা ধার্য হবে না। কিন্তু ইবনু আবিয্ যি’ব এবং আবূ লায়লা প্রমুখ মনীষী বলেন, মক্কার মতই এদের ওপর শান্তির বিধান বর্তাবে। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বলেন, মদীনার নিষিদ্ধতা মূলত মক্কার নিষিদ্ধতার মত নয়। মদীনার শিকার হত্যা, বৃক্ষ কর্তনের নিষিদ্ধতা মুস্তাহাব অর্থে, হারাম অর্থে নয় এবং এটা মদীনার বিশেষ সম্মানার্থে বলা হয়েছে।
[এ মতামতগুলো বিভিন্ন ইমাম ও মুহাদ্দিসদের ব্যক্তিগত চিন্তার কথা অন্যথায় হাদীসে সেটাকে মুত্বলাক্বভাবেই হারাম বলা হয়েছে] -অনুবাদক
‘‘যে মদীনায় ইহদাস করল’’, এর অর্থ হলো যে মদীনাহ্ শহরে কোন মুনকার কাজ, বিদ্‘আত কাজ অর্থাৎ- যা কিতাব ও সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ সম্পাদন করবে অথবা এ জাতীয় কার্য সম্পাদনকারীকে আশ্রয়দান করবে তার প্রতি আল্লাহর লা‘নাত, তার মালায়িকাহ্’রও লা‘নাত এবং সমগ্র মানবমণ্ডলীর লা‘নাত বর্ষিত হবে। আল্লাহর লা‘নাত অর্থ আল্লাহর রহমাত থেকে দূরে থাকা এবং বঞ্চিত থাকা। আর মালায়িকাহ্’র লা‘নাত মানে তার জন্য আল্লাহর রহমাত থেকে দূরে থাকার (বদ্দু‘আ) করা।
হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, এ বাক্য দ্বারা বুঝা যায় যে, কোন গুনাহগারের প্রতি লা‘নাত করা বৈধ। এতে আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বিদ্‘আতকারী এবং বিদ্‘আতীকে আশ্রয়দানকারী উভয়েই সমান গুনাহগার।
কাযী ‘ইয়ায (রহঃ) বলেন, এ হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় যে, মদীনাহ্ শহরে কোন বিদ্‘আত কার্য বা কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থী কার্য সম্পাদন করা কাবীরাহ্ গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কেননা কাবীরাহ্ গুনাহ ছাড়া লা‘নাত করা প্রযোজ্য নয়। মালায়িকাহ্’র লা‘নাত এবং সমগ্র মানবমণ্ডলীর লা‘নাত দ্বারা আল্লাহর রহমাত থেকে দূরে বা বঞ্চিত থাকার কথা মুবালাগাতান বলা হয়েছে (অর্থাৎ- অতিরিক্ততা বা জোর দেয়া)। কেননা লা‘নাত শব্দের আভিধানিক অর্থ (اَلطَّرْدُ وَالإِبْعَادُ) বিতারিত করা, দূরে রাখা।
কেউ বলেছেন, লা‘নাত দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য হলো ঐ শাস্তি, যে শাস্তি তার গুনাহের কারণে প্রথমে ভোগ করে নিবে (পরে সে জান্নাতে যাবে)। কাফিরদের ঐ লা‘নাত উদ্দেশ্য নয় যা আল্লাহর রহমাত থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে ও বঞ্চিত করে রাখবে।
তাদের নিকট থেকে কোন বিনিময় অথবা দান গ্রহণ করা হবে না, এখানে عَدْلٌ এবং صَرْفٌ শব্দ দু’টি নিয়ে মনীষীগণ ইখতিলাফ করেছেন। জমহূরের মতে صَرْفٌ হলো ফরয দান এবং عَدْلٌ হলো নফল দান। ইমাম ইবনু খুযায়মাহ্ হাসান বাসরী (রহঃ)-এর সূত্রে ঠিক এর বিপরীত বর্ণনা করেছেন। ইমাম আসমা‘ঈ বলেন, الصرف অর্থ হলো التوبة, আর العدل হলো الفدية। এছাড়া আরো অনেকে অনেক কথা বলেছেন।
সমগ্র মু’মিন যেমন একটি দেহের ন্যায়, দেহের একটি অঙ্গ আক্রান্ত হলে সমস্ত দেহই তার ব্যথা অনুভব করে, ঠিক অনুরূপ সমগ্র মুসলিমের যিম্মাহ ও প্রতিশ্রুতি যা কেউই তা ভঙ্গ করতে পারবে না। হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, একজন মুসলিমও যদি কোন কাফিরকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয় তবে অন্য কোন মুসলিম তা ভঙ্গ করতে পারবে না।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, যে আপন পিতাকে বাদ দিয়ে অন্যকে পিতৃ-পরিচয় দিবে এবং যে কৃতদাস নিজ মনিবের পরিবর্তে অন্যকে মনিব পরিচয় দিবে তার প্রতিও লা‘নাত। অপরকে পিতৃ পরিচয় দেয়া বহু কারণেই হতে পারে তন্মধ্যে দু’টি কারণ প্রধান। যথা- (১) মীরাসী সম্পদ গ্রহণের জন্য এবং (২) বংশীয় মর্যাদা লাভের জন্য। যে কারণেই হোক এ কাজ সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭২৯-[২] সা’দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি মদীনার দু’ সীমানার মধ্যবর্তী জায়গাকে হারাম ঘোষণা করছি- এর বৃক্ষলতা কাটা যাবে না এবং এর শিকার করা যাবে না। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো বলেন, মদীনাহ্ ঐসব লোকের জন্য কল্যাণকর, যদি তারা বুঝতে পারে। যে ব্যক্তি অনাগ্রহী হয়ে মদীনাহ্ ত্যাগ করবে, তার বদলে আল্লাহ তা’আলা তার চেয়েও উত্তম ব্যক্তিকে সেখানে স্থান দেবেন। যে ব্যক্তি মদীনার অভাব-অনটন ও বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করে অটুট থাকবে, কিয়ামতের দিন আমি তার জন্য সাক্ষী ও সুপারিশকারী হবো। (মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ سَعْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنِّي أُحَرِّمُ مَا بَيْنَ لَابَتَيِ الْمَدِينَةِ: أَنْ يُقْطَعَ عِضَاهُهَا أَوْ يُقْتَلَ صَيْدُهَا وَقَالَ: «الْمَدِينَةُ خَيْرٌ لَهُمْ لَوْ كَانُوا يعلَمونَ لَا يَدَعُهَا أَحَدٌ رَغْبَةً عَنْهَا إِلَّا أَبْدَلَ اللَّهُ فِيهَا مَنْ هُوَ خَيْرٌ مِنْهُ وَلَا يَثْبُتُ أَحَدٌ عَلَى لَأْوَائِهَا وَجَهْدِهَا إِلَّا كُنْتُ لَهُ شَفِيعًا أَو شَهِيدا يَوْم الْقِيَامَة» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: মদীনার মর্যাদা ও সম্মানের কিছু কথা পূর্বের হাদীসে অতিবাহিত হয়েছে। এখানকার বৃক্ষাদি কর্তন করা যাবে না এবং কোন শিকার হত্যা করা যাবে না। এ নিষিদ্ধ এলাকার সীমাও বর্ণিত হয়েছে। অত্র হাদীসে ঐগুলো ছাড়া আরো বর্ণিত হয়েছে- ‘‘মদীনাহ্ তাদের জন্য কল্যাণ যদি তারা জানত’’।
মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) বলেন, এ ঘোষণা মদীনার মুসলিম অধিবাসীদের জন্য। আর এ কল্যাণ দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় জগতের জন্যই। অথবা খায়রিয়্যাত বা কল্যাণ দ্বারা উদ্দেশ্য দুনিয়ার জীবন-জিন্দেগীতে অধিক বারাকাত লাভ করা।
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় (মুসলিমের হাশিয়ায়) ‘আল্লামা সিনদী বলেন, এ হাদীস ঐ ব্যক্তিদের জন্য যারা মদীনাহ্ ত্যাগ করে সুখের আশায় অন্য শহরে চলে যায় তাদের জন্য সতর্কবাণী।
কেউ কেউ বলেছেন, মদীনার এ ফাযীলাতের ঘোষণা ‘আলিম ব্যক্তিদের জন্য। যেহেতু এটি একটি মর্যাদাসম্পন্ন শহর সুতরাং সেটার মর্যাদা কেবল মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই অনুভব করতে পারে। আর তার চাহিদা অনুপাতে নিজ নিজ ‘ইলমের দ্বারা সেটার দাবী মোতাবেক ‘আমল করতে পারে। পক্ষান্তরে যাদের ‘ইলম নেই তারা ঐ শহরের যথাযথ মর্যাদাও দিতে পারে না এবং সেটার ফাযীলাত ও কল্যাণও লাভ করতে পারে না। এ শহরের প্রতি আগ্রহহীন হয়ে (এ শহরে) বসবাস ত্যাগ করলে আল্লাহ তা‘আলা তার চেয়ে উত্তম ব্যক্তিকে সেখানে আবাসন দান করবেন। তবে যদি কেউ এ শহরের প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে নয় বরং অনিবার্য কারণে বা কোন ফিতনাহ্ থেকে বাঁচার জন্য তা ত্যাগ করে সে এ হুকুমের অন্তর্ভুক্ত হবে না।
আল্লামা বাজী (রহঃ) বলেন, আমি মনে করি যারা মদীনার আদীবাসী বা স্থায়ী বাসিন্দা তাদের জন্য এ হুকুম। কিন্তু যারা অন্য স্থানের বাসিন্দা পরবর্তীতে তারা মদীনায় ‘ইলম শিক্ষার জন্য অথবা মদীনার ফাযীলাত লাভের জন্য এসে বসবাস করছেন অথবা অত্যাবশ্যক প্রয়োজনেই এ শহর ত্যাগ করছেন তাদের জন্য এ হুকুম নয়।
এরপর প্রশ্ন হলো- ফাযীলাতের এ বিধান কতদিন পর্যন্ত? ইবনু ‘আবদিল বার এবং ‘আল্লামা যুরক্বানী সহ বহু মনীষী বলেন, এ ফাযীলাত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশাকাল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের পর হাজার হাজার সাহাবী মদীনাহ্ শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন এবং অন্যত্র বসতি স্থাপন করেছেন। যেমন- আবূ মূসা আল আশ্‘আরী, ইবনু মাস্‘ঊদ, মু‘আয, আবূ ‘উবায়দাহ্, ‘আলী, তলহা, যুবায়র, ‘আম্মার, হুযায়ফাহ্, ‘উবাদাহ্ ইবনুস্ সামিত, বিলাল, আবুদ্ দারদা, আবূ যার প্রমুখ সহাবা (রাঃ) স্ববিশেষ উল্লেখযোগ্য এ সকল মহান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সহাবা (রাঃ) মদীনাহ্ ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করেছেন এবং সেখানেই তারা ইন্তিকাল করেছেন।
সুতরাং বুঝা যায় মদীনার এ ফাযীলাত তার জীবিত থাকাকাল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
অন্য আরেকদলের মতে মদীনার ঐ ফাযীলাত সর্বকাল ব্যপ্ত। এখনও সেটাতে বসবাসে ঐ ফাযীলাত মিলবে। উপরে বর্ণিত সাহাবীগণ যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইন্তিকালের পর মদীনাহ্ ত্যাগ করে অন্য শহরে গিয়ে বসবাস করেছেন, তারা মদীনায় আর ফিরে আসেন নেই, বরং সেখানেই ইন্তিকাল করেছেন। তারা কেউ মদীনার প্রতি অনাসক্ত বা বিতশ্রদ্ধ হয়ে মদীনাহ্ ত্যাগ করেননি, বরং তারা দীনের যে কোন কল্যাণে যেমন- ‘ইলম কিংবা জিহাদের জন্য অথবা অন্য কোন অতীব প্রয়োজনীয় উম্মাতে মুসলিমার বৃহত্তর কল্যাণে মদীনাহ্ ত্যাগ করেছেন।
মদীনার অভাব-অনটন এবং দুঃখ-কষ্টে যে ধৈর্য ধারণ করে থাকবে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্বিয়ামাতের দিন তার জন্য সাক্ষ্যদানকারী শাফা‘আতকারী হবেন। এ দুঃখ-কষ্ট হলো- অভাব-অনটন বা ক্ষুধা, মদীনার প্রচন্ড ক্ষরা, এখানে বিদ্‘আতী অধিবাসীদের পক্ষ থেকে আগত অত্যাচার বা দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি।
‘আল্লামা জাওহারী দুঃখ-কষ্টের মূলে اللاواء শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যার অর্থ الشدة কষ্ট-কাঠিন্যতা, কিন্তু এখানে উদ্দেশ্য হলো জীবন-জিন্দেগীর সংকীর্ণতা এবং দুর্ভিক্ষ।
মানুষের অবস্থাভেদে কারো জন্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাক্ষী হবেন কারো জন্য সুপারিশকারী হবেন।
অত্র হাদীসে এদিকে ইশারা রয়েছে যে, জীবনের অবসান যেন সুন্দরভাবে হয়, অর্থাৎ- ঈমানের উপর হয়। আর মু’মিনের উচিত ধৈর্য ধারণ করা, বরং মদীনায় অবস্থানের সুযোগ পেয়ে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ হওয়া। অন্য শহরের চাকচিক্যময় সুখণ্ডসামগ্রীর প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করা উচিত নয়। কেননা আখিরাতের নি‘আমাতই হলো প্রকৃত নি‘আমাত বা সুখ-সামগ্রী।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৩০-[৩] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মাতের মধ্যে যে ব্যক্তি মদীনায় অভাব-অনটন ও বিপদাপদে ধৈর্যধারণ করবে আমি অবশ্যই কিয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশকারী হবো। (মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لَا يَصْبِرُ عَلَى لَأْوَاءِ الْمَدِينَةِ وَشِدَّتِهَا أَحَدٌ مِنْ أُمَّتِي إِلَّا كُنْتُ لَهُ شَفِيعًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ» . رَوَاهُ مُسْلِمٌ
ব্যাখ্যা: (لَا يَصْبِرُ عَلٰى لَأْوَاءِ الْمَدِيْنَةِ) অর্থাৎ- মদীনার প্রচন্ড দুর্ভিক্ষতা। (وَشِدَّتِهَا) এর দ্বারাও মদীনার অসহ্য পরিস্থিতির কথা বলা হয়েছে।
আবূ ‘উমার বলেনঃ মদীনাহ্ ও তার অবর্ণনীয় পরিস্থিতির কথা বলা হয়ছে। যেমন- দুর্ভিক্ষ, অনাবৃষ্টি, উপার্জনহীনতা ইত্যাদি।
ইমাম বাজী (রহঃ) বলেনঃ لَأْوَاءِ ‘‘লাওয়া’’ শব্দের অর্থ হলো দুর্ভিক্ষ, প্রচন্ড ক্ষুধা ও উপার্জনহীনতা। شِدَّتِهَا শব্দের উদ্দেশ্য ‘‘লাওয়া’’-ও হতে পারে এবং মদীনার সকল অধিবাসীর অবর্ণনীয় পরিস্থিতি হতে পারে।
ইমাম মাযিরী (রহঃ) বলেনঃ لَأْوَاءِ বলা হয় উপার্জনহীনতা। আর شِدَّتِهَا هَا ‘যমির’টি মদীনাহ্ ও لَأْوَاءِ ‘‘লাওয়া’’ উভয় শব্দের দিকে ফিরার সম্ভাবনা রাখে।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৩১-[৪] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, লোকেরা যখন গাছের প্রথম ফল দেখতো তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে হাযির করতো। যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এ ফল গ্রহণ করতেন, তখন বলতেন, আল্লাহ! আমাদের ফলে (শস্য-ফসলে) বারাকাত দান কর এবং আমাদের এ শহরে বারাকাত দান কর। আমাদের সা’-তে বারাকাত দান কর, আমাদের মুদ-এ (মাপার যন্ত্র বা পাত্রে) বারাকাত দান কর। হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই ইব্রাহীম (আঃ) তোমার বান্দা, তোমার বন্ধু ও তোমার নবী। আর আমিও তোমার বান্দা ও নবী। তিনি মক্কার জন্য তোমার কাছে দু’আ করেছেন, আর আমিও মদীনার জন্য তোমার কাছে দু’আ করছি, যেভাবে তিনি মক্কার জন্য তোমার কাছে দু’আ করেছেন। বর্ণনাকারী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] বলেন, অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সবচেয়ে ছোট শিশু সন্তানকে ডাকতেন এবং তাকে ঐ ফল (খেতে) দিতেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْهُ قَالَ: كَانَ النَّاسُ إِذَا رَأَوْا أَوَّلَ الثَّمَرَةِ جَاءُوا بِهِ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَإِذَا أَخَذَهُ قَالَ: «اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي ثَمَرِنَا وَبَارِكْ لَنَا فِي مَدِينَتِنَا وَبَارِكْ لَنَا فِي صَاعِنَا وَبَارِكْ لَنَا فِي مُدِّنَا اللَّهُمَّ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ عَبْدُكَ وَخَلِيلُكَ وَنَبِيُّكَ وَإِنِّي عَبْدُكَ وَنَبِيُّكَ وَإِنَّهُ دَعَاكَ لِمَكَّةَ وَأَنَا أدعوكَ للمدينةِ بمثلِ مَا دعَاكَ لمكةَ ومِثْلِهِ مَعَهُ» . ثُمَّ قَالَ: يَدْعُو أَصْغَرَ وَلِيدٍ لَهُ فيعطيهِ ذَلِك الثَّمر. رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: যে সমস্ত লোকেরা তাদের গাছের নতুন ফল নিয়ে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসতেন তারা হলেন সহাবায়ে কিরাম। তারা তাদের নতুন ফল বা প্রথম ফল নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে হাদিয়্যাহ্ বা উপঢৌকন পেশ করতেন। ‘উলামায়ে কিরাম বলেছেন, তারা এ কাজ এজন্য করেছেন যেন আল্লাহর নাবীর দু‘আ লাভ করতে পারেন। কেননা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট কোন ফল হাদিয়্যাহ্ পেশ করলেই তিনি ফলের জন্য দু‘আ করতেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাহ্ শহরের জন্য দু‘আ করতেন, মদীনার সা' এবং মুদ-এর জন্য দু‘আ করতেন।
[এ দু‘আর ফলে দু’ একজনের গাছে বছরে দু’বারও খেজুর ধরতে দেখা গেছে। -অনুবাদক]
কেউ কেউ বলেছেন, নিজেদের ওপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রাধান্য দেয়ার এবং তার প্রতি মুহাববাতের খাতিরেই তারা এ কাজ করেছেন।
‘আল্লামা যুরক্বানী (রহঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহান স্বকীয় সত্তার মর্যাদা ও মহাব্বাতের কারণেও এ হাদিয়্যাহ্ হতে পারে, আবার তার দু‘আ থেকে বারাকাত লাভের জন্যও হতে পারে।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে কোন ফল হাদিয়্যাহ্ পেশ করলেই দু‘আ করতেনঃ ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের ফলে বারাকাত দান করো।’’ অর্থাৎ- এতে ফলন ও প্রবৃদ্ধি দান করো, এর স্থায়িত্ব দান করো। কাযী ‘ইয়াযও এমনটিই ব্যাখ্যা করেছেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ মুহূর্তে মদীনাহ্ শহরের জন্য দু‘আ করতেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের মদীনাহ্ শহরকে বারাকাতমণ্ডিত করো। মদীনাহ্ শহরের বারাকাত হলো তার স্থানের, আবহাওয়ার এবং তার অধিবাসীদের সঠিক প্রশস্ততা। আল্লাহ তা‘আলা এ শহরের বাহ্যিক এবং আত্মিক উভয় বারাকাত দ্বারা সমৃদ্ধ করে রেখেছেন।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার পরিমাপের পাত্র বা মাধ্যম সা' এবং মুদ-এর জন্য দু‘আ করেছেন। ‘আল্লামা ইবনু ‘আবদিল বার (রহঃ) বলেন, এটা তার অলঙ্কারপূর্ণ বিজ্ঞচিত বাক্যবিশেষ, মূলত দু‘আ ছিল খাদ্যে বারাকাতের জন্য এবং পরিমাপ যন্ত্রে বা মাধ্যমে যা ধারণ করা হয় তার জন্যে, পরিমাপ যন্ত্রের জন্য দু‘আ নয়। তবে উভয়ের জন্যও হতে পারে যেমন- ‘আল্লামা নাবাবী (রহঃ) বলেছেন, ইব্রাহীম (আঃ) মক্কার জন্য দু‘আ করেছিলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার দু‘আ কবূল করেছেন ফলে মক্কার মানুষ বিশ্বের নানা ফলমূল দ্বারা রিযক্বপ্রাপ্ত হতে আছে। আমাদের নাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটা উল্লেখ করে মদীনার জন্য দু‘আ করেছেন, ফলে আল্লাহ তা‘আলা মদীনাহ্ শহরকেও অনুরূপ বারাকাতপূর্ণ করেছেন। দূর-দূরান্ত থেকে এখানেও এসে মানুষ আল্লাহ তা‘আলার নি‘আমাত ও মসজিদে নাবাবীর ফাযীলাত হাসিলে ধৈন্য হয়। বরং নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার চেয়ে দ্বিগুণ বারাকাত চেয়ে মদীনার জন্য দু‘আ করেছেন। এতদসংক্রান্ত বর্ণনা তৃতীয় পরিচ্ছেদে আসছে। উক্ত হাদীস দ্বারা কেউ কেউ মক্কার উপর মদীনার ফাযীলাত বর্ণনা করতে প্রয়াস পেয়েছেন।
‘আল্লামা বাজী (রহঃ) বলেন, ইব্রাহীম (আঃ) মক্কাবাসীদের জন্য দু‘আ করেছিলেন যা তা ছিল নিছক দুনিয়ার ফলমূল দ্বারা রিযক্ব দানের বিষয়ে, কিন্তু নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাবাসীদের জন্য যে দু‘আ করেছিলেন তা দুনিয়া বিষয়ক এবং তার সাথে অনুরূপ আরো। সম্ভবত সেটি ছিল আখিরাতের বিষয় যেমন- মক্কায় পুণ্যার্জন বহুগুণে লাভ করা যায় অনুরূপ মদীনার পুণ্যও যেন বহুগুণে পাওয়া যায়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট আগত নতুন ফল ছোট বাচ্চাদের ডেকে দিয়ে দিতেন। এটা ছিল তার শিশুদের প্রতি ভালবাসার সর্বোচ্চ নমুনা। শিশুদের আনন্দদান বড়দের আনন্দদানের চেয়ে অনেক বেশী ভাল। আবূ ‘উমার (রহঃ) বলেন, এটা উত্তম শিষ্টাচারের এবং সর্বোত্তম চরিত্রের নমুনা ঐ শিশু নিজ পরিবারের হোক অথবা পাড়া-প্রতিবেশীর হোক তাতে কোন ভেদাভেদ ছিল না।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৩২-[৫] আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ইব্রাহীম (আঃ) মক্কাকে সম্মানিত করেছেন এবং একে হারাম (পবিত্রতা) ঘোষণা করেছেন, আর আমি মদীনাকে এর দু’ সীমার মধ্যবর্তী স্থানকে যথাযথভাবে সম্মানে সম্মানিত করলাম। এতে রক্তপাত করা যাবে না, যুদ্ধের জন্য অস্ত্র গ্রহণ করা যাবে না, পশুর খাবার ছাড়া এতে কোন গাছপালার পাতা ঝরানো যাবে না। (মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِنَّ إِبْرَاهِيمَ حَرَّمَ مَكَّةَ فَجَعَلَهَا حَرَامًا وَإِنِّي حَرَّمْتُ الْمَدِينَةَ حَرَامًا مَا بَيْنَ مَأْزِمَيْهَا أَنْ لَا يُهْرَاقَ فِيهَا دَمٌ وَلَا يُحْمَلَ فِيهَا سلاحٌ لقتالٍ وَلَا تُخبَطَ فِيهَا شجرةٌ إِلَّا لعلف» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীঃ ‘‘ইব্রাহীম মক্কাকে হারাম করেছেন’’-এর অর্থ হলো তিনি এর হারাম হওয়ার বিষয়টি জনগণের নিকট প্রকাশ করে তা ঘোষণা করেছেন। সুতরাং পূর্বে বর্ণিত যে হাদীসে এ কথা এসেছে যে, ‘‘নিশ্চয় মক্কাকে আল্লাহ তা‘আলাই হারাম করেছেন, কোন মানুষ একে হারাম করেনি’’, এর সাথে কোন বিরোধ নেই। মূলত এটা আল্লাহ তা‘আলাই হারাম করেছেন, নাবী ইব্রাহীম তা ঘোষণা করেছেন মাত্র। তার দিকে হারামের নিসবাত বা সম্পর্ক ইস্তিআরাহ্ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ‘‘মক্কার সম্মান’’ পর্বে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ)-এর হাদীসে অতিবাহিত হয়েছে। ‘আরাবীতে শব্দ مَأْزِمَيْهَا -এর অর্থ দুই পাহাড়, উদ্দেশ্য দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানকে হারাম ঘোষণা করলাম। এখানে কোন মুসলিমের রক্ত প্রবাহ করবে না, এটা জঘন্য কাজ।
মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) বলেন, ‘‘এখানে রক্ত প্রবাহ নিষেধ’’-এর দ্বারা উদ্দেশ্য যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষেধ, যার দ্বারা রক্ত প্রবাহ হয়ে থাকে। যাদের রক্ত প্রবাহ এমনি সাধারণভাবে হারাম মক্কা মদীনার হারাম এরিয়ায় তাদের রক্ত প্রবাহ আরো কঠিনতরভাবে হারাম।
এখানে কোন প্রকার অস্ত্র বহনও হারাম, প্রয়োজন ব্যতিরেকে বৃক্ষ কর্তন, অর্থাৎ- পশুর খাদ্য সংগ্রহ ইত্যাদি ব্যতীত গাছের পাতা ছেড়া ও কর্তন করাও নিষেধ।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৩৩-[৬] ’আমির ইবনু সা’দ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, (আমার পিতা) সা’দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) সওয়ারীতে চড়ে তাঁর আক্বীক্বস্থ গৃহস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি দেখলেন একটি ক্রীতদাস (মদীনায়) একটি গাছ অথবা পাতা কাটছে বা ঝড়াচ্ছে। এতে তিনি কৃতদাসটির জামা-কাপড় ও অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিলেন। অতঃপর সা’দ মদীনায় ফিরে আসলে ক্রীতদাসের মালিকগণ তার নিকট এসে তাদের দাসের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া সমস্ত জিনিস ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ করলেন। তখন তিনি (সা’দ) বললেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে যা দান করেছেন তা আমি ফিরিয়ে দেয়া হতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আর তিনি তা ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করলেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ عَامِرِ بْنِ سَعْدٍ: أَنَّ سَعْدًا رَكِبَ إِلَى قَصْرِهِ بِالْعَقِيقِ فَوَجَدَ عَبْدًا يَقْطَعُ شَجَرًا أَوْ يَخْبِطُهُ فَسَلَبَهُ فَلَمَّا رَجَعَ سَعْدٌ جَاءَهُ أَهْلُ الْعَبْدِ فَكَلَّمُوهُ أَنْ يَرُدَّ عَلَى غُلَامِهِمْ أَوْ عَلَيْهِمْ مَا أَخَذَ مِنْ غُلَامِهِمْ فَقَالَ: مَعَاذَ اللَّهِ أَنْ أَرُدَّ شَيْئًا نَفَّلَنِيهِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَأَبِي أَنْ يرد عَلَيْهِم. رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: এ সা‘দ ছিলেন আশারায়ে মুবাশশারাহ্-এর অন্যতম ব্যক্তিত্ব। মদীনার অনতিদূরে ‘আক্বীক্ব নামক স্থানে তার একটি ভবন ছিল। হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেনঃ ‘আক্বীক্ব হলো যুল্ হুলায়ফার সন্নিকটে একটি স্থান। সেখানে একটি কৃতদাসকে দেখেন মদীনার নিষিদ্ধ স্থানে বৃক্ষ কর্তন করছে এবং তার পাতা ছিঁড়ছে। তাই তিনি তার অস্ত্র-শস্ত্র কেড়ে নিয়ে মদীনায় ফিরে আসলেন। অতঃপর কৃতদাসের মালিক যখন তার কাছে এসে কেড়ে আনা সামগ্রী ফেরত চাইলেন তখন তিনি আল্লাহর আশ্রয় চেয়ে বললেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা আমার জন্য নফল নির্ধারণ করেছেন। অর্থাৎ- যে মদীনার এ নিষিদ্ধ স্থানে শিকার ধরবে, বৃক্ষ কর্তন করবে তার মালামাল ক্রোক করে নিতে হবে। সুতরাং তার এ মালামাল ফেরত দেয়া হবে না।
‘আল্লামা নাবাবী (রহঃ) বলেনঃ এ হাদীস মদীনার নিষিদ্ধ স্থানে শিকার ধরা, বৃক্ষ কর্তন করা ইত্যাদি নিষেধ হওয়ার পক্ষে ইমাম শাফি‘ঈ, মালিক, আহমাদ এবং জমহূর ইমাম ও মুজতাহিদের পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ-দলীল। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) তার বিপক্ষে মত পোষণ করেন, ইতিপূর্বে এ বিষয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। ইমাম মুসলিম মদীনার ঐ নিষিদ্ধতার পোষকতায় ‘আলী, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস, আনাস ইবনু মালিক, জাবির ইবনু ‘আবদিল্লাহ, আবূ সা‘ঈদ (খুদরী), আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ), ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উবায়দ, রাফি‘ ইবনু খাদীজ, সাহল ইবনু হুনায়ফ প্রমুখ সহাবা থেকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মারফূ' হাদীস উল্লেখ করেছেন। অন্যেরাও আরো অন্যান্য সহাবা থেকেও হাদীস বর্ণনা করেছেন।
সুতরাং এ সকল সহীহ হাদীসের ভিত্তিতে প্রচলিত বা জারীকৃত ‘আমলের বিরোধীদের দিকে ভ্রুক্ষেপের কোনই প্রয়োজন নেই। মদীনার হারাম স্থানের মধ্য থেকে বৃক্ষ কর্তন বা শিকার ধরার কারণে তার সবকিছু ছিনিয়ে নেয়ার এ হাদীস হানাফীগণ মানসূখ বা রহিত অথবা বিশেষ ব্যাখ্যার দাবী করে থাকেন।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৩৪-[৭] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আসার পর আমার পিতা আবূ বকর ও (মুয়াযযিন) বিলাল (রাঃ) ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হলেন। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়ে তাঁকে তাদের অসুস্থতার খবর জানালে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের জন্য মদীনাকে প্রিয় কর যেভাবে মক্কা আমাদের নিকট প্রিয় অথবা তার চেয়েও বেশি। হে আল্লাহ! তুমি মদীনাকে আমাদের জন্য স্বাস্থ্যকর কর, আমাদের জন্য এর সা’ এবং মুদ-এ (পরিমাপ যন্ত্রে) বারাকাত দাও, এর জ্বরকে ’’জুহফাহ্’’য় (হাওযের কিনারাসমূহে) স্থানান্তরিত করে দাও। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: لَمَّا قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْمَدِينَةَ وُعِكَ أَبُو بَكْرٍ وَبِلَالٌ فَجِئْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَخْبَرْتُهُ فَقَالَ: «اللَّهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الْمَدِينَةَ كَحُبِّنَا مَكَّةَ أَوْ أَشَدَّ وَصَحِّحْهَا وَبَارِكْ لَنَا فِي صاعها ومدها وانقل حماها فاجعلها بِالْجُحْفَةِ»
ব্যাখ্যা: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মদীনায় আগমনের এ সময়টি নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। ‘আল্লামা যুরক্বানী (রহঃ) বলেনঃ এটি ছিল হিজরতের সময়কার ঘটনা, রবিউল আও্ওয়ালের ১২ দিন অবশিষ্ট থাকতে। বুখারীর বর্ণনা মতে বিদায় হজ্জের সফর থেকে ফিরে আসার সময়ের ঘটনা। এ সময় মদীনাহ্ ছিল মহামারী কবলিত এলাকা। এ মহামারী বিভিন্ন রোগের মাধ্যমেই হতে পারে, তবে জ্বরের ও প্লেগের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় পৌঁছলে আবূ বাকর ও বিলাল (রাঃ) জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এ খবর দেয়া হলে তিনি মদীনার জন্য এবং তার আবহাওয়ার জন্য দু‘আ করলেন। এছাড়াও তিনি মদীনার সা' এবং মুদ্-এ বারাকাতের জন্য দু‘আ করলেন। তিনি মদীনার জ্বরকে জুহ্ফায় স্থানান্তরের জন্যও দু‘আ করলেন।
ইমাম যুরক্বানী (রহঃ) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ দু‘আ কবূল করেন, ফলে মদীনাকে তার জন্য প্রিয় করে দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ দু‘আ ইতিপূর্বে মক্কাকে প্রিয় ভূমি হিসেবে বলার পরিপন্থী নয়। যেমন- মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের মুহূর্তে তিনি বলেছিলেনঃ
إنك أحب البلاد إليَّ وإنك أحب أرض الله إلى الله.
অন্য বর্ণনায়ঃ (لقد عرفت أنك أحب البلاد إلى الله)
অর্থাৎ- (হে মক্কা!) নিশ্চয় তুমি আমার প্রিয় ভূমি, তুমি আল্লাহর জমিনের মধ্য হতে আল্লাহর নিকটও প্রিয় জমিন।
ব্যাখ্যাকার ‘আল্লামা ‘উবায়দুল্লাহ মুবারাকপূরী (রহঃ) বলেন, এ মুহাব্বাতের কথা মুবালাগাহ্ হিসেবে বলা হয়েছে। অথবা আল্লাহ তা‘আলা যখন মুহাজিরগণকে মক্কার নিজ মাতৃভূমি, বসতবাড়ী ত্যাগ করে মদীনায় হিজরত করা আবশ্যক করেছিলেন তখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার কাছে দু‘আ করলেন তিনি যেন তাদের অন্তরে মদীনার মুহাববাত বাড়িয়ে দেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার জ্বরকে জুহফায় স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য দু‘আ করেছেন। জুহফার বিবরণ ইতিপূর্বে অতিবাহিত হয়েছে।
‘আল্লামা খাত্ত্বাবী বলেন, ঐ সময় জুহফায় ইসলাম ও মুসলিমদের চিরশত্রু ইয়াহূদীরা বসবাস করত। এ হাদীস থেকে অমুসলিমদের ওপর রোগ-ব্যাধি আপতিত হওয়ার এবং তাদের ধ্বংসের দু‘আ বৈধতা প্রমাণিত হয়। সাথে সাথে মুসলিমদের সুস্থতা কামনা তাদের শহরের জন্য বারাকাত কামনা এবং তাদের নিকট থেকে কষ্ট ও ক্ষতি দূরীভূত হওয়ার জন্য দু‘আ করা আবশ্যক প্রমাণিত হয়।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৩৫-[৮] ’আব্দুল্লাহ ইবনু ’উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি মদীনাহ্ সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্বপ্নের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ আমি দেখলাম একটি এলোমেলো চুলবিশিষ্টা কালো মহিলা মদীনাহ্ হতে বের হয়ে মাহ্ইয়া’আহ্ (নামক স্থানে) গিয়ে পৌঁছলো। তখন আমি এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলাম যে, মদীনার মহামারী মাহ্ইয়া’আহ্ স্থানান্তরিত হয়ে গেলো। বর্ণনাকারী বলেন, (মাহ্ইয়া’আহ্) হলো ’জুহফাহ্’। (বুখারী)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ فِي رُؤْيَا النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَدِينَةِ: رَأَيْتُ امْرَأَةً سَوْدَاءَ ثَائِرَةَ الرَّأْسِ خَرَجَتْ مِنَ الْمَدِينَةِ حَتَّى نَزَلَتْ مَهْيَعَةَ فَتَأَوَّلْتُهَا: أَنَّ وَبَاءَ الْمَدِينَةِ نُقِلَ إِلَى مَهْيَعَةَ وَهِيَ الْجُحْفَةُ . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দু‘আর কারণে মদীনার ‘‘ওয়াবা’’ অর্থাৎ- মহামারী জ্বর মাহ্ইয়া‘আহ্ বা জুহফায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। এ সময় সেটা এলোকেশী কালো মহিলার রূপ ধরে চলে যায়। ইমাম যুরক্বানী বলেন, প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করে কোন রোগের এ রকম রূপ অবয়ব ধারণ করা অসম্ভব কিছু নয়। এর পরিপূরকতায় একটি বর্ণনা রয়েছে- এক ব্যক্তি মক্কার পথ বেয়ে আসলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, পথে কি তোমার সাথে কারো সাক্ষাৎ হয়েছিল? লোকটি বলল না, তবে একটি কালো উলঙ্গ মহিলার সাক্ষাত হয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ওটাই মদীনার জ্বর, আজকের পর সে আর কখনো মদীনায় ফিরে আসবে না। অন্য বর্ণনায় আছে- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মদীনায় বর্তমান যে জ্বর আছে সেটি মহামারীময় বরং আমার রবের পক্ষ থেকে রহমাত।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৩৬-[৯] সুফিয়ান ইবনু আবূ যুহায়র (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ইয়ামান বিজিত হবে, সেখানে (মদীনার) কিছু লোক (স্থায়ীভাবে) চলে যাবে এবং তাদের সাথে তাদের পরিবার-পরিজন ও অনুসারীদেরও নিয়ে যাবে। অথচ মদীনাই তাদের জন্য উত্তম, যদি তারা বুঝতে পারতো। ঠিক এভাবেই শাম (সিরিয়া) দেশ বিজিত হবে, সেখানে কিছু লোক চলে যাবে তাদের পরিবার-পরিজন ও অনুসারীদেরকেও সাথে নিয়ে যাবে। অথচ মদীনাহ্ হচ্ছে তাদের জন্য উত্তম, যদি তারা বুঝতে পারতো। অনুরূপভাবে ’ইরাক বিজিত হবে, সেখানে কিছু লোক চলে যাবে তাদের সাথে তাদের পরিবার-পরিজন ও অনুসারীদেরকেও নিয়ে যাবে। অথচ মদীনাই হচ্ছে তাদের জন্য উত্তম, যদি তারা বুঝতে পারতো। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ سُفْيَانَ بْنِ أَبِي زُهَيْرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «يُفْتَحُ الْيَمَنُ فَيَأْتِي قومٌ يبُسُّونَ فيَتَحمَّلونَ بأهليهم وَمن أطاعهم وَالْمَدِينَةُ خَيْرٌ لَهُمْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ وَيُفْتَحُ الشَّامُ فَيَأْتِي قَوْمٌ يَبُسُّونَ فَيَتَحَمَّلُونَ بِأَهْلِيهِمْ وَمَنْ أَطَاعَهُمْ وَالْمَدِينَةُ خَيْرٌ لَهُمْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ وَيُفْتَحُ الْعِرَاقُ فَيَأْتِي قَوْمٌ يَبُسُّونَ فَيَتَحَمَّلُونَ بِأَهْلِيهِمْ وَمَنْ أَطَاعَهُمْ وَالْمَدِينَةُ خَيْرٌ لَهُمْ لَوْ كَانُوا يعلمُونَ»
ব্যাখ্যা: ইয়ামানকে ইয়ামান এজন্য বলা হয় যে, এটা কিবলার ডানদিকে অবস্থিত। ইয়ামান শব্দের অর্থ ডানদিকে, অথবা সূর্যের ডানদিকে হওয়ার কারণে একে ইয়ামান বলা হয়। অথবা ইয়ামান ইবনু ক্বহত্বান-এর নামানুসারে ওর নাম রাখা হয় ইয়ামান।
অত্র হাদীসে ইয়ামান বিজয়ের কথা বলা হয়েছে- এরপর শাম বা সিরিয়ার নাম, এরপর ইরাক্বের নাম উল্লেখ হয়েছে, কিন্তু সহীহ মুসলিমের এক বর্ণনায় আগে সিরিয়ার নাম দিয়ে শুরু করা হয়েছে, এরপর ইয়ামান, অতঃপর ‘ইরাক। ‘আল্লামা যুরক্বানী (রহঃ) বিভিন্ন দেশ বিজয়ের এ ভবিষ্যদ্বাণীকে নবূওয়াতের চিহ্ন বলে অভিহিত করেছেন। ইবনু ‘আবদুল বার (রহঃ) বলেছেনঃ ইয়ামান রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবূওয়াতকালেই বিজিত হয়। অতঃপর আবূ বাকর-এর খিলাফাতকালে শাম বা সিরিয়া, এরপর ইরাক।
এ হাদীসে উল্লেখিত শহরের ওপর মদীনার শ্রেষ্ঠত্ব ও ফাযীলাত সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত হয়েছে। (কিন্তু মক্কা-মদীনার উত্তমতা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে)। তথাপি লোকেরা মদীনাহ্ শহর ত্যাগ করে উক্ত শহরগুলোতে সুখের ও আরামের অন্বেষায় পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে চলবে। তারা যদি মদীনার সত্যিকার মর্যাদা বুঝত তাহলে কস্মিনকালেও তা ত্যাগ করত না।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৩৭-[১০] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি এমন এক জনপদে হিজরতের জন্য আদিষ্ট হলাম যে জনপদ অন্য জনপদসমূহকে গ্রাস করবে। লোকেরা একে ইয়াসরিব বলে, আর এটাই হলো মদীনাহ্। মদীনাহ্ মানুষকে খাঁটি করে। যেভাবে হাঁপর খাদ ঝেড়ে লোহাকে খাঁটি করে। (বুখারী , মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أُمِرْتُ بِقَرْيَةٍ تَأْكُلُ الْقُرَى. يَقُولُونَ: يَثْرِبَ وَهِيَ الْمَدِينَةُ تَنْفِي النَّاسَ كَمَا يَنْفِي الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ
ব্যাখ্যা: এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ‘আল্লামা ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীঃ ‘‘আমার প্রভু আমাকে (একটি গ্রামের দিকে) হিজরতের নির্দেশ করেছেন এবং সেখানে বসবাসেরও নির্দেশ করেছেন।’’ এ গ্রামটি হলো মদীনাহ্। কেউ কেউ এটাকে মক্কার কথাও বলেছেন, তবে মদীনার অর্থ নেয়া অধিক সামঞ্জস্যশীল।
এ গ্রামটি, অর্থাৎ- মদীনাহ্ শহর অন্যান্য গ্রামগুলোকে খেয়ে ফেলবে; এর ব্যাখ্যায় ‘আল্লামা তুরবিশতী (রহঃ) বলেন, এখানে খাওয়ার অর্থ হলো অন্যান্য শহরগুলো বিজিত হওয়া এবং তথাকার সম্পদ অর্জন করা বা নিয়ে নেয়া।
ইবনুল বাত্ত্বাল (রহঃ) বলেন, এর অর্থ হলো মদীনার লোকেরা অন্যান্য শহরগুলো বিজয় করবে এবং তাদের সম্পদ ভক্ষণ করবে। এটা ‘আরবদের একটি ফাসাহাত পূর্ণবাক্যের দৃষ্টান্ত। ‘আরবেরা যখন কোন রাজ্য জয় করে তখন বলে থাকে أكلنا بلد كذا আমরা অমুক দেশ খেয়েছি।
লোকেরা এ স্থানকে ইয়াসরিব বলে থাকে। এ নামকরণের কারণ ইতিপূর্বে কিঞ্চিৎ বলা হয়েছে। বর্তমানে সেটার নাম মদীনাহ্। কতিপয় ‘আলিম মদীনাকে ইয়াসরিব নামে ডাকা মাকরূহ মনে করেন, কারণ ইমাম আহমাদ বারা ইবনু ‘আযিব থেকে মারফূ' হাদীস বর্ণনা করেছেন, (নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ) যে ব্যক্তি মদীনাকে ইয়াসরিব বলবে সে যেন ইস্তিগফার করে, অর্থাৎ- আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নেয়, ওটা হলো ত্ব-বাহ্, ওটা ত্ব-বাহ্। অনুরূপ আরেকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নিশ্চয় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনাকে ইয়াসরিব বলতে নিষেধ করেছেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াসরিব শব্দ উচ্চারণ করেছেন তা জনগণকে অধিক পরিচিত নাম দিয়ে বুঝানোর জন্য অথবা এটা ছিল নিষেধাজ্ঞা জারী হওয়ার আগের ঘটনা।
‘আল্লামা ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, এ ঘটনাটি ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্বপ্নের ঘটনা এবং মদীনায় হিজরতের পূর্বের ঘটনা। সুতরাং তখন মদীনার ঐ নামই ছিল, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেখানে গিয়ে তার খারাপ নাম পরিবর্তন করে মদীনাহ্ নির্ধারণ করেন।
মদীনাকে কামারের হাফরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। ক্বামারের হাফর যেমন লৌহ বা অন্যান্য স্বর্ণ-চাঁদির ন্যায় ধাতব পদার্থের ময়লা দূরীভূত করে দিয়ে খাঁটি স্বর্ণ রৌপ্যে পরিণত করে দেয় ঠিক তেমনিভাবে মদীনাহ্ শহর তার অধিবাসীর অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষ, ক্লেশ ইত্যাদি সহ জ্বর, প্লেগ ও অন্যান্য মহামারী থেকে পবিত্র ও মুক্ত রাখে এবং খারাপ লোককে মদীনাহ্ থেকে বের করে দেয়। কাযী ‘ইয়ায বলেন, মদীনার এ ফাযীলাত নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশাকাল পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, এ ফাযীলাত ক্বিয়ামাত পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। সহীহ মুসলিমে এর প্রমাণে হাদীস রয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৩৮-[১১] জাবির ইবনু সামুরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা মদীনার নাম রেখেছেন ’ত্ব-বাহ্’ (পবিত্র)। (মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِنَّ الله سمى الْمَدِينَة طابة» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা নিজেই মদীনার নাম দিয়েছেন ‘ত্ব-বাহ্’। এ নাম তিনি লাওহে মাহফূযে লিখে রেখেছিলেন, অথবা তাওরাতে এ নাম উল্লেখ করেছিলেন। আর তিনি তার নাবীকে মুনাফিক্বদের দেয়া ইয়াস্রিব নাম পরিবর্তন করে ঐ নাম রাখতে নির্দেশ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনুল কারীমের কয়েক জায়গায় সেটাকে মদীনাহ্ নামে উল্লেখ করেছেন। সহীহ মুসলিমে যায়দ ইবনুস্ সাবিত-এর হাদীসে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটাকে ত্বইয়্যিবাহ্ বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও মদীনার আরো বেশ কয়েকটি নাম রয়েছে, যায়দ ইবনু আসলাম-এর বর্ণনায় এসেছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ‘‘মদীনার দশটি নাম রয়েছে.....।’’ আর তা হলোঃ আল মদীনাহ্, ত্ব-বাহ্, ত্বইয়্যিবাহ্, আল মুত্বাইয়্যিবাহ্ ইত্যাদি। মদীনাহ্ ছাড়া এ তিনটি, শব্দ ও অর্থগতভাবে একই অর্থ প্রদান করে। আর গঠনগতভাবে ভিন্নতা রয়েছে।
ইমাম সামহূদী (রহঃ) বলেনঃ এই নামে নামকরণ করা হয়েছে কয়েকটি কারণে-
১। মদীনার পবিত্রতার দিকে লক্ষ্য রেখে। মদীনাহ্ হলো পবিত্র শহর, যে সকল শির্কের অমানিষা থেকে পবিত্র করে। অথবা আল্লাহ তা‘আলার কথার সাথে সম্পর্কের কারণে; যেমন- আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ بِرِيْحِ طَيِّبَةٍ অথবা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অবতরণের স্থান বা যাত্রা বিরতির স্থান হওয়ার কারণে। অথবা মদীনাহ্ হল হাফরের ন্যায় যা ইসলামের সকল কলূষতা বা অন্যায়কে দূর করে। আর তাকে খাঁটি সুগন্ধিময় করে তুলে।
২। মদীনার নাম রাখার অন্য কারণ হলো যে, মদীনার সকল বিষয় ভালো অথবা মদীনাহ্ থেকে খাঁটি সুঘ্রাণ পাওয়া যায় এজন্য নামকরণ করা হয়েছে (طَابَةً) ত্ব-বাহ্ নামে।
ইবনু বাত্ত্বাল বলেনঃ যে এখানে বাস করে সে মদীনার মাটি ও পরিবেশ থেকে ভালো সুঘ্রাণ পায়।
ইমাম আসবিলী (রহঃ) বলেনঃ মদীনার মাটি উর্বর হওয়ার কারণে।
হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ শব্দ ভিন্ন হলেও অর্থ একই ভালো জিনিস থেকে উদগত হয়েছে।
কেউ বলেনঃ মাটি ভালো বা সুগন্ধিময় হওয়ার হওয়ার কারণে। আবার কেউ বলেনঃ বাতাস ভালোবা সুগন্ধি হওয়ার করণে। কিছু ‘আলিম বলেনঃ মদীনার বাতাস ও মাটি প্রমাণ করে এর নাম ‘ত্ব-বাহ্’ রাখা সঠিক হয়েছে। কেননা যে ব্যক্তি এখানে বসবাস করে সে এখানকার মাটি ও বাতাসা থেকে সুঘ্রাণ পায় যা অন্য কোন জায়গা থেকে পাওয়া যায় না।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৩৯-[১২] জাবির ইবনু ’আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক বেদুঈন এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাতে বায়’আত করলো। অতঃপর মদীনায় সে (বেদুঈন) জ্বরে পতিত হল। সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বললো, হে মুহাম্মাদ! আমার বায়’আত বাতিল করে দিন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্বীকার করলেন। আবারও সে এসে বললো, হে মুহাম্মাদ! আমার বায়’আত বাতিল করে দিন। এবারও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা করতে অস্বীকৃতি জানালেন। আবারও সে এসে বললো, আমার বায়’আত বাতিল করে দিন। এবারও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন জানালেন। এরপর বেদুঈন মদীনাহ্ ছেড়ে চলে গেলো। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ মদীনাহ্ হচ্ছে হাঁপরের মতো। যে এর খাদকে দূর করে দেয়, আর এর উত্তমটাকে খাঁটি করে। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ: أَنَّ أَعْرَابِيًّا بَايَعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَصَابَ الْأَعْرَابِيَّ وَعَكٌ بِالْمَدِينَةِ فَأَتَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ أَقِلْنِي بَيْعَتِي فَأَبَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ثُمَّ جَاءَهُ فَقَالَ: أَقِلْنِي بَيْعَتِي فَأَبَى ثُمَّ جَاءَهُ فَقَالَ: أَقِلْنِي بَيْعَتِي فَأَبَى فَخَرَجَ الْأَعْرَابِيُّ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنَّمَا الْمَدِينَةُ كَالْكِيرِ تَنْفِي خبثها وتنصع طيبها»
ব্যাখ্যা: যে গ্রাম্য লোকটি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে এসে বায়‘আত গ্রহণ করেছিলেন তার নাম উল্লেখ হয়নি। ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, আমি তার নামের ব্যাপারে কোন কিছু অবগত হতে পারিনি। ‘আল্লামা যামাখশারী বলেন, তার নাম হলো ক্বায়স ইবনু আবী হাযিম। তিনি একজন প্রসিদ্ধ তাবি‘ঈ ছিলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাতে রওয়ানা হয়েছিলেন, কিন্তু এসে শুনেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেছেন। কিন্তু অন্যদের বর্ণনায় তিনি ক্বায়স ইবনু আবী হাযিম সাহাবী ছিলেন। ‘আল্লামা মুবারাকপূরী (রহঃ) এ বর্ণনাটি সঠিক বলে মন্তব্য করেছেন।
তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার বায়‘আত গ্রহণ করেছিলেন। মদীনার প্রচন্ড তাপদাহে লোকটি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ল। ফলে সে মদীনাহ্ থেকে নিজ এলাকায় ফিরে যাওয়ার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে তার বায়‘আত প্রত্যাহার করে নেয়ার অনুরোধ জানালেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার এ আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন, এমনকি লোকটি বারবার (তিনবার) একই আবেদন জানালেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেকবারই তার আবেদন পূরণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অস্বীকৃতির কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে ‘আল্লামা নাবাবী ‘উলামায়ে কিরামের মতামত উল্লেখ করে বলেন, লোকটির বায়‘আত ছিল ইসলামের উপর, আর ইসলামের উপর থাকার বায়‘আত প্রত্যাহার করা বৈধ নয়। অনুরূপ যে ব্যক্তি হিজরত করে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট চলে এসেছেন সে হিজরত প্রত্যাহার বা ভঙ্গ করে স্বীয় কাফির এলাকায় বা দারুল কুফরে ফিরে যাওয়া বৈধ নয়।
প্রকাশ্য হাদীস থেকে জানা যায় যে, মদীনাহ্ শহর থেকে বের হওয়া নিন্দনীয় কাজ, কিন্তু সাহাবী এবং পরবর্তী অনেক নেক্কার ব্যক্তিদের মদীনাহ্ ত্যাগ করে অন্যত্র বসবাস ছিল ইসলামের কল্যাণে। ‘ইলম বিস্তার, রাজ্যর বিস্তার, বিজিত রাজ্যে প্রশাসন পরিচালনা ইত্যাদি কার্যে তারা অন্যত্র বসবাস করেছেন কিন্তু মদীনার ফাযীলাত এবং মুহাববাত তাদের অন্তরে পুরোদমে বিদ্যমান ছিল। সুতরাং এটা মোটেও হাদীসে বর্ণিত হুকুমের অন্তর্ভুক্ত নয়।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৪০-[১৩] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ ক্বিয়ামাত (কিয়ামত) অনুষ্ঠিত হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত মদীনাহ্ এর মন্দ লোকদেরকে দূর না করবে, যেমনিভাবে হাঁপর লোহার খাদকে দূর করে দেয়। (মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَنْفِيَ الْمَدِينَةُ شِرَارَهَا كَمَا يَنْفِي الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيد» . رَوَاهُ مُسلم
ব্যাখ্যা: মদীনাহ্ তার অভ্যন্তরের খারাপ মানুষগুলো বের করে না দেয়া পর্যন্ত ক্বিয়ামাত অনুষ্ঠিত হবে না। ‘আল্লামা ত্বীবী (রহঃ) বলেন, এটা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানাতেই সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবূওয়াতকালে মদীনার খারাপ লোকগুলোকে মদীনাহ্ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল, ফলে ঐ সময় মদীনাহ্ নিখাদ ও পবিত্র হয়ে গিয়েছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমন হলো ক্বিয়ামাতের আলামাতসমূহের একটি আলামাত। এ বিষয়ে ইতিপূর্বে আলোচনা হয়ে গেছে।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৪১-[১৪] উক্ত রাবী [আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ)] হতে এ হাদীসটিও বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মদীনার দরজাসমূহে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) পাহারায় রয়েছেন। তাই এতে (মদীনায়) মহামারী ও দাজ্জাল প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «عَلَى أَنْقَابِ الْمَدِينَةِ مَلَائِكَةٌ لَا يَدْخُلُهَا الطَّاعُونُ وَلَا الدَّجَّالُ»
ব্যাখ্যা: মদীনার প্রত্যেক প্রবেশদ্বারে প্রতিরক্ষী মালায়িক্বাহ্ পাহারায় নিযুক্ত রয়েছেন। এ শহরে প্লেগ-মহামারী প্রবেশ করতে পারে না। নিহায়াহ্ গ্রন্থকার বলেন, ‘‘ত্বা‘ঊন’’ প্লেগ এমন একটি ব্যাপক রোগ যার দ্বারা বাতাশও দূষিত হয়ে যায়।
ইবনুল ‘আরাবী বলেন, ত্বা‘ঊন বা প্লেগ এমন একটি মারাত্মক রোগ যা মানুষের মধ্যে প্রবেশ করলে তার আত্মাকে ধ্বংস করবেই।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) সহ কেউ কেউ বলেন, ত্বা‘ঊন হলো গ্রন্থি কেটে রক্ত গড়িয়ে পড়া রোগ। ইমাম নাবাবী অন্যত্র বলেন, ত্বা‘ঊন হলো বাউশী বা টিউমার জাতীয় অত্যন্ত বেদনাদায়ক ফোঁড়া বিশেষ যা কখনো লাল, কখনো সবুজ কখনো কালো রূপ ধারণ করে এবং সেটা থেকে কখনো রক্ত প্রবাহিত হয়; আর এর আশপাশ সেটার কারণেই আক্রান্ত হয়ে যায়।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অমর সম্রাট হাফিয আবূ ‘আলী ইবনু সীনা বলেন, ত্বা‘ঊন হলো- মৌলিক নামের ধ্বংসাত্মক রোগবিশেষ।
শরীরের যে কোন স্পর্শকাতর বা নরম অঙ্গ ফুলে সেটার আত্মপ্রকাশ ঘটে। অধিকাংশ সময় তা বগলে অথবা কানের পিছনে কিংবা নাসিকারন্ধে হয়ে থাকে। এ রোগের মূল কারণ হলো রক্ত দূষিত হওয়া। এ দূষিত রক্ত আশেপাশের জীবকোষকে সংক্রামিত করে, অবশেষে তার হৃদপিন্ডও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অথবা এটা জিনে্র খোঁচা বা স্পর্শ থেকে উৎপন্ন হয়। ‘‘ওয়াবা’’ বা মহামারী প্লেগ ছাড়া অন্য রোগও হতে পারে যেমন- কলেরা, বসন্ত ইত্যাদি। কেউ কেউ বলেছেন পেস্নগ মহামারী নয়। যারা প্রত্যেক মহামারীকেই ত্বা‘ঊন বা প্লেগ বলে অভিহিত করেছেন তা মাযায বা রূপক হিসেবে বলেছেন।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, মক্কা-মদীনায় প্লেগ রোগ প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু একদল গবেষক বলেছেন, ৭৪৫ হিঃ সনে মক্কায় প্লেগ রোগ দেখা দিয়েছিল, কিন্তু মদীনায় কখনো দেখা যায়নি। মদীনায় যে পেস্নগ রোগ প্রবেশ করতে পারবে না তার প্রমাণে বহু হাদীস রয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৪২-[১৫] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মক্কা মদীনাহ্ ছাড়া এমন কোন শহর নেই, যেখানে দাজ্জালের পদচারণা (বিপর্যয়) হবে না। মক্কা মদীনায় এমন কোন দরজা নেই যেখানে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) সারিবদ্ধ হয়ে পাহারা দিচ্ছে না। সুতরাং দাজ্জাল সাবিখাহ্’য় পৌঁছবে। তখন মদীনাহ্ ভূমিকম্পের মাধ্যমে তিনবার এর অধিবাসীদেরকে কাঁপিয়ে দিবে। আর এতে সকল কাফির মুনাফিক্ব মদীনাহ্ ছেড়ে দাজ্জালের দিকে রওনা হয়ে যাবে। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ أَنَسٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَيْسَ مِنْ بلدٍ إِلا سَيَطَؤهُ الدَّجَّالُ إِلَّا مَكَّةَ وَالْمَدِينَةَ لَيْسَ نَقْبٌ مِنْ أَنِقَابِهَا إِلَّا عَلَيْهِ الْمَلَائِكَةُ صَافِّينَ يَحْرُسُونَهَا فَيَنْزِلُ السَّبِخَةَ فَتَرْجُفُ الْمَدِينَةُ بِأَهْلِهَا ثَلَاثَ رَجَفَاتٍ فَيَخْرُجُ إِلَيْهِ كُلُّ كَافِرٍ وَمُنَافِقٍ»
ব্যাখ্যা: দাজ্জালের সকল শহরে গমন ও বিপর্যয় সৃষ্টি হয় স্বয়ং নিজের দ্বারা হবে আর না হয় তার অনুসারীদের দ্বারা হবে। জমহূরের মতে কথাটি ‘আম্ বা সাধারণভাবে বলা হয়েছে এর দ্বারা স্বয়ং দাজ্জালের নিজের উপস্থিতিই উদ্দেশ্য। ইবনু হাযম (রহঃ) এককভাবে ভিন্ন মত পোষণ করে বলেন, দাজ্জাল স্বয়ং নিজে সকল শহরে প্রবেশ করবে না। বরং সে তার বাহিনীকে প্রেরণ করবে। কেননা দাজ্জালের এ অল্প সময়কালের ভিতর সমস্ত পৃথিবীর শহরগুলোতে প্রবেশ অসম্ভব কথা।
‘আল্লামা মুবারকপূরী (রহঃ) এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, হাদীসে বর্ণিত অল্প সময়ের মধ্যে দাজ্জালের সমস্ত পৃথিবী পরিক্রম করা মোটেও অসম্ভব নয়, কেননা আমাদের বর্তমান যুগেই যে সকল দ্রুত গতিসম্পন্ন বিদ্যুৎ চালিত যান্ত্রিক বাহন বা আধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে যার ফলে জলে, স্থলে এবং আকাশ পথে নিমিষেই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছে যা ইতিপূর্বেকার মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি।
ইমাম হাকিম আবূ তুফায়ল-এর সূত্রে হাদীস বর্ণনা করেনঃ ‘‘দাজ্জাল যখন প্রকাশ পাবে তখন পৃথিবী সংকুচিত বা সংকীর্ণ হয়ে যাবে.....।’’ কিন্তু দাজ্জাল ও তার বাহিনী মক্কা-মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না। ইমাম যুরক্বানী (রহঃ) ইবনু ‘উমার (রাঃ)-এর সূত্রে ‘‘বায়তুল মুক্বাদ্দাস’’-এর কথাও উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ- দাজ্জাল বায়তুল মুক্বাদ্দাসেও প্রবেশ করতে পারবে না। ত্বহাবীর এক বর্ণনায় মসজিদে তূর-এর কথাও এসেছে। এ শহরগুলোর প্রতিটি প্রবেশদ্বারে মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তারা দাজ্জালকে দেখা মাত্র তাড়িয়ে দিবে। ব্যর্থ হয়ে দাজ্জাল মদীনার অনতিদূরে সাবখাহ্ নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করবে। এ সময় পর পর তিনটি ভূমিকম্প হবে ফলে মদীনার খারাপ লোকগুলো, অর্থাৎ- কাফির ও মুনাফিক্ব মদীনাহ্ ছেড়ে দাজ্জালের নিকট চলে যাবে।
হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, তিনটি কম্পনে মদীনার মুখলিস ঈমানদার ব্যতীত সকলেই বের হয়ে যাবে। মদীনায় শুধু খালেস ঈমানদারগণই অবশিষ্ট থাকবে, আর এদের ওপরে দাজ্জাল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। ‘আল্লামা ত্বীবী বলেন, সম্ভবত নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীঃ (تَرْجُفُ الْمَدِينَةُ بِأَهْلِهَا) বাক্যের ب হরফটি سبب বা কারণ অর্থে ব্যবহার হয়েছে তখন ঐ বাক্যের অর্থ দাঁড়ায়ঃ মদীনাহ্ প্রকম্পিত হবে তার অধিবাসীর (মুনাফিক্ব ও কাফিরদের) কারণে এবং তাদেরকে দাজ্জালের দিকে বের করে দেয়ার জন্য।
উপরে উল্লেখিত বর্ণনাটি আবূ বাক্রাহ্ বর্ণিত সহীহুল বুখারীতে বর্ণিত হাদীসের পরিপন্থী নয়, সে হাদীসে এসেছে- (لا يدخل المدينة رعب المسيح الدجال) অর্থাৎ- মাসীহে দাজ্জালের ভীতি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না। কেননা এ ভূমিকম্প শুধু মুনাফিক্ব ও কাফিরদের জন্যই ভীতিকর হবে মু’মিনদের জন্য নয়। অথবা এটা ঐ যামানার সাথে খাস, অর্থাৎ- সে নির্দিষ্ট যামানা বা কালে দাজ্জালের ভীতি মদীনায় প্রবেশ করতে পারবে না।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৪৩-[১৬] সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে কেউই মদীনাবাসীদের সাথে প্রতারণা করবে সে গলে যাবে, যেভাবে লবণ পানিতে গলে যায়। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ سَعْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَكِيدُ أَهْلَ الْمَدِينَةِ أَحَدٌ إِلَّا انْمَاعَ كَمَا يَنْمَاعُ الْملح فِي المَاء»
ব্যাখ্যা: মদীনাবাসীর সাথে প্রতারণা করা মানে তাদের বিরুদ্ধে কৌশল করা, ষড়যন্ত্র করা, নাহক খারাপ বা ক্ষতির চিন্তা করা ইত্যাদি।
মদীনাবাসীর প্রতি খারাপ আচরণকারী আল্লাহর ক্রোধে এভাবে নিঃশেষ হয়ে যাবে যেভাবে লবণ পানিতে গলে নিঃশেষ হয়ে যায়। সহীহ মুসলিমে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত আছে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে গলিয়ে ফেলবেন.....।
‘‘গলিয়ে ফেলবেন’’ এ বাক্যের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ‘আল্লামা মুবারাকপূরী (রহঃ) সহীহ মুসলিমে বর্ণিত ‘আমির ইবনু সা‘দ তার পিতা প্রমুখাৎ বর্ণিত হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে কেউই মদীনাবাসীর সাথে খারাপ আচরণের ইচ্ছা পোষণ করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামের আগুনে পুড়ে সীসার ন্যায় গলিয়ে ফেলবেন অথবা পানিতে লবণ গলানোর ন্যায় গলিয়ে ফেলবেন। কাযী ‘ইয়ায বলেন, এ ব্যাখ্যা (হাদীস) সকল প্রশ্ন নিঃশেষ করে দেয়। আরো প্রকাশ যে, এটা আখিরাতের শাস্তির ঘটনা।
কেউ কেউ বলেছেন, এও সম্ভব যে, যারা মদীনাবাসীর সাথে দুনিয়ায় আচরণের ইচ্ছা করবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের কোন অবকাশ দিবেন না এবং তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিবেন না বরং অনতিবিলম্বে তাদের কর্তৃত্ব হরণ করে নিবেন। যেমন- বানী ‘উমাইয়্যার খিলাফাতকালে যারা মদীনাবাসীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, অনুরূপ ইয়াযীদ ইবনু মু‘আবিয়াহ্-ও। এমনিভাবে যুগে যুগে কালে কালে যারাই মদীনার ওপর অন্যায়ভাবে চড়াও হয়েছে তারাই ধ্বংস হয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৪৪-[১৭] আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন সফর হতে আসার সময় মদীনার দেয়াল দেখতে পেতেন তখন নিজের আরোহীকে তাড়া করতেন। আর যদি তিনি ঘোড়া বা খচ্চরের পিঠে থাকতেন, তবে মদীনার ভালবাসার উচ্ছাসে ওকে নাড়া দিতেন। (বুখারী)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ أَنَسٍ: أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ إِذَا قَدِمَ مِنْ سَفَرٍ فَنَظَرَ إِلى جُدُراتِ الْمَدِينَةِ أَوْضَعَ رَاحِلَتَهُ وَإِنْ كَانَ عَلَى دَابَّةٍ حركها من حبها. رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন সফর শেষে মদীনায় ফেরার সময় মদীনার কোন দেয়াল দর্শনেই তার মুহাব্বাতে এত উদ্বেলিত হয়ে পড়তেন যে, কখন তিনি তাতে প্রবেশ করবেন? উটে থাকলে তাকে জোরে চালাতেন, ঘোড়া-গাধা-খচ্চর ইত্যাদিতে থাকলে তাকে দু’ পা দিয়ে নাড়া দিতেন।
‘আল্লামা কুস্তুলানী (রহঃ) বলেন, এটা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঐ দু‘আ কবূলের প্রমাণ; তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দু‘আ করেছিলেনঃ اَللّٰهُمَّ حَبِّبْ إِلَيْنَا الْمَدِيْنَةَ كَحُبِّنَا مَكَّةَ أَوْ أَشَدَّ অর্থাৎ- ‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রতি মক্কার মতই মদীনার মুহাববাত বৃদ্ধি করে দাও অথবা তার চেয়েও বেশী।’’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ ভালবাসা এবং ভালবাসার জন্য দু‘আ মদীনার মর্যাদারই প্রামাণ্য দলীল।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৪৫-[১৮] উক্ত রাবী [আনাস (রাঃ)] হতে এ হাদীসটিও বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উহুদ পাহাড় দৃষ্টিগোচর হলো। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তা দেখে বললেন, এ পাহাড় আমাদেরকে ভালবাসে, আর আমরাও এ পাহাড়কে ভালবাসি। হে আল্লাহ! ইব্রাহীম (আঃ) মক্কাকে সম্মানিত করেছেন, আর আমি মদীনার দু’ সীমানার মধ্যবর্তী স্থানকে সম্মানিত করলাম। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَلَعَ لَهُ أُحُدٌ فَقَالَ: «هَذَا جَبَلٌ يُحِبُّنَا وَنُحِبُّهُ اللَّهُمَّ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ حَرَّمَ مَكَّةَ وَإِنِّي أحرم مَا بَين لابتيها»
ব্যাখ্যা: উহুদ পাহাড়ের নামকরণের কারণ বলতে গিয়ে ‘আল্লামা সুহায়লী (রহঃ) বলেন, (أُحُدٌ) ‘‘উহুদ’’ শব্দটি (أَحَدٌ) ‘‘আহাদুন’’ থেকে, অর্থ একক, একাকী; এটা অন্যান্য পাহাড় থেকে একাকি বা এককভাবে দাঁড়িয়ে আছে, এজন্য তার নাম উহুদ রাখা হয়েছে।
অথবা তার উপরের আরোহীগণই কিংবা আহলে উহুদগণই তাওহীদের সাহায্য করেছে এবং তার জন্য যুদ্ধ করেছে, এ কারণে এর নাম রাখা হয়েছে উহুদ।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজ্জের সফর থেকে ফেরার সময় উহুদ পাহাড় দর্শন করে সেটার দিকে ইশারা করে বলেছিলেন, এ পাহাড়কে আমরা ভালবাসী সেও আমাদের ভালবাসে। সহীহুল বুখারীতে কিতাবুল জিহাদে আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসের মাধ্যমে জানাযায় যে, এটা খায়বার যুদ্ধ থেকে ফেরার সময়ের ঘটনা। সহীহুল বুখারীতে আবূ হুমায়দ-এর অন্য এক বর্ণনায় তাবূক যুদ্ধ থেকে ফেরার সময়ের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।
এ সকল বিভিন্ন সময়ের ঘটনার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, মূলত উপরে বর্ণিত প্রত্যেক সফর থেকে ফেরার সময়ই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথাটি পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।
উক্ত বাক্যটি নিয়ে ‘উলামাগণের মাঝে আরেক বক্তব্য রয়েছে, তা হলো একদলের মতে পাহাড়কে লক্ষ্য করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণীঃ ‘‘আমরা সেটাকে ভালোবাসী’’ এর মনে হলো আহলে উহুদকে ভালোবাসী, আর আহলে উহুদ হলো আনসারগণ, এরা ছিলেন উহুদের প্রতিবেশী। দ্বিতীয় আরেকদল ‘আলিম বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আনন্দের আতিশয্যে কথার কথায় বলে ফেলেছেন। ভালোবাসার ক্ষেত্রটা এরূপ হয়ে থাকে। তৃতীয় আরেকদলের মতে উহুদ পাহাড় যেহেতু জান্নাতের একটি পাহাড়, যেমন- হাদীসে এসেছে, সুতরাং তার প্রতি ভালোবাসার অভিব্যক্তি ব্যক্ত করা হয়েছে মানে জান্নাতের প্রতি ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে।
পাহাড় একটি জড়বস্ত্ত সে কিভাবে মানুষকে ভালোবাসতে পারে? এ ব্যাপারেও নানা জন নানা কথা বলেছেন। সবগুলো বক্তব্য তুলে ধরে ‘আল্লামা নাবাবী (রহঃ) বলেন, সবচেয়ে বিশুদ্ধ এবং পছন্দনীয় কথা হলো ‘‘উহুদ আমাদের ভালোবাসে’’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ কথার অর্থ প্রকৃত অর্থেই ভালোবাসা (কোন রূপক অর্থে নয়)। আল্লাহ তা‘আলা তার মধ্যে ভাল-মন্দ তামীয করার মতো একটি শক্তি ও যোগ্যতা দান করেছেন যার মাধ্যমে সে ভালোবাসে। যেমন- আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ ‘‘অনেক পাথরই আল্লাহর ভয়ে (পাহাড় থেকে) পড়ে যায়’’- (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ৭৪)। অনুরূপ শুকনো কাঠ (আল্লাহর নাবীর সামনে) ক্রন্দন করেছিল, কংকর তাসবীহ পাঠ করেছিল, অনুরূপ পাথর মূসা (আঃ)-এর কাপড় নিয়ে দৌড়িয়ে পালাচ্ছিল ইত্যাদি, এগুলো প্রকৃতির ব্যতিক্রম কিছু ঘটনার দৃষ্টান্ত যা আল্লাহ তা‘আলা ঐ বস্ত্তগুলোর দ্বারা সংঘটিত করিয়েছেন। ইব্রাহীম (আঃ)-এর মক্কাকে হারাম ঘোষণার ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে হয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
২৭৪৬-[১৯] সাহল ইবনু সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ উহুদ এমন একটি পাহাড়, যে পাহাড় আমাদেরকে ভালোবাসে আর আমরাও একে ভালোবাসি। (মুসলিম)[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
وَعَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أُحُدٌ جَبَلٌ يُحِبُّنَا ونحبُّه» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: উহুদ একটি জড় পদার্থ সে কিভাবে মানুষকে ভালোবাসতে পারে তার কিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে হয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো বহু পাহাড় থাকা সত্ত্বেও উহুদকে ভালোবাসার কথা বিশেষভাবে বলা হলো কেন? ‘আল্লামা মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) তার উত্তরে বলেন, যেহেতু সে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার তিনজন সাহাবীকে (আবূ বকর, ‘উমার এবং ‘উসমান (রাঃ)-কে) পেয়ে খুশীতে বা আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল, তাই তার কথা বিশেষভাবে বলা হয়েছে।