পরিচ্ছেদঃ ২৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইমামের দায়িত্ব
এ অধ্যায়টি ইমামের ওপর মুক্তাদীদের অধিকারসমূহের বর্ণনা সম্পর্কে। এ অধিকারসমূহের মাঝে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মুক্তাদীদের অবস্থা, অসুস্থ, প্রয়োজনমুখী ইত্যাদির দিকে লক্ষ্য রেখে সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) হালকা করা, দীর্ঘ না করা যা মানুষকে জামা’আতে উপস্থিত হওয়া থেকে দূরে রাখতে পারে। ক্বারী বলেন, ইমামের ওপর মুক্তাদীদের যে বিষয় লক্ষ্য রাখা দরকার তা হল সালাত হালকা করা। ’’লুম্’আত’’-এ তিনি বলেন, জানা উচিত সালাত হালকা করা ও দীর্ঘতাকে বর্জন করা দ্বারা সুন্নাত ক্বিরাআত (কিরআত) ও তাসবীহ ছেড়ে দেয়া এবং সেগুলো আদায়ের ব্যাপারে অলস তা করা উদ্দেশ্য না বরং এ ব্যাপারে যথার্থ পরিমাণের উপর সীমাবদ্ধ থাকা। যেমন সালাতের ক্ষেত্রে মুফাসসাল ক্বিরাআত (কিরআত) থেকে যা নির্ধারণ করা হয়েছে সে অনুপাতে সকল প্রকার মুফাসসাল ক্বিরাআতের উপর সীমাবদ্ধ থাকা।
তিনবার তাসবীহ আদায়ের উপর যথেষ্ট মনে করা। যেমনিভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত বৈঠক ও দন্ডায়মানের প্রতি। হাদীসসমূহে বর্ণিত সালাত হালকা করা দ্বারা অধিকাংশ সময় যা উদ্দেশ্য তা হল ক্বিরাআত (কিরআত) হালকা করা। অচিরেই অধ্যায়ের হাদীসসমূহের ব্যাখ্যাতে এ ব্যাপারে অতিরিক্ত বর্ণনা আসছে। ইমামের ক্ষেত্রে উদ্দেশিত নির্দেশিত হালকা এর অর্থে যা প্রাধান্য পাবে তাও আসছে।
১১২৯-[১] আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চেয়ে আর কোন ইমামের পেছনে এত হালকা ও পরিপূর্ণ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করিনি। তিনি যদি (সালাতের সময়) কোন শিশুর কান্নার শব্দ পেতেন, মা চিন্তিত হয়ে পড়বে মনে করে সালাত হালকা করে ফেলতেন। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ مَا عَلَى الإِمَامِ
عَنْ أَنَسٍ قَالَ: مَا صَلَّيْتُ وَرَاءَ إِمَامٍ قَطُّ أَخَفَّ صَلَاةً وَلَا أَتَمَّ صَلَاةً مِنَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَإِنْ كَانَ لَيَسْمَعُ بُكَاءَ الصَّبِيِّ فَيُخَفِّفُ مَخَافَةَ أَنْ تُفْتَنَ أمه
ব্যাখ্যা : ইমাম মুসলিম আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্ণাঙ্গ সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে সর্বাধিক হালকা পন্থা অবলম্বনকারী। বুখারী ও মুসলিমে আনাস (রাঃ) থেকেই অন্য বর্ণনাতে আছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে সংক্ষিপ্ততার পন্থা অবলম্বন করতেন এবং পূর্ণাঙ্গ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করতেন। একমতে বলা হয়েছে তিনি যখন সাহাবীদের সালাত দীর্ঘ করার ক্ষেত্রে উৎসাহী ও আগ্রহী দেখতেন তখন সালাত দীর্ঘ করতেন এবং সালাত হালকা করা ও দীর্ঘতাকে বর্জন করার দিকে আহবান করে এমন কোন কারণ যা আপত্তি দেখলে সালাত হালকা করতেন। তবে প্রথম অর্থটিই স্পষ্ট।
একমতে বলা হয়েছে সালাত হালকা বলতে ক্বিরাআতের ব্যাপারে হাদীসসমূহে যা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং যা বর্ণিত হয়েছে তার উপর ক্বিরাআত (কিরআত)কে দীর্ঘ না করা এবং বসা হালকা করা। সালাতের পূর্ণতা হলো সকল রুকন, ওয়াজিব ও সুন্নাত আদায় করা এবং রুকূ' ও সিজদা্ (সিজদা/সেজদা) পূর্ণ করা। ইমাম নাসায়ী আনাস (রাঃ) সূত্রে যায়দ বিন আরক্বাম-এর মাধ্যমে বর্ণনা করেন। আনাস (রাঃ) বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাতের সাথে সর্বাধিক সাদৃশ্য রাখে এমন কোন সালাত আমি তোমাদের এ ইমাম অপেক্ষা কারো পেছনে আদায় করিনি। (‘উমার বিন ‘আবদুল ‘আযীয) যায়দ বলেন, ‘উমার বিন ‘আবদুল ‘আযীয রুকূ‘ ও সিজদা্ (সিজদা/সেজদা) পূর্ণাঙ্গভাবে করতেন এবং ক্বিয়াম (কিয়াম) ও বৈঠক হালকা করতেন।
আবূ দাঊদ ও নাসায়ী আনাস (রাঃ)-এর হাদীস কর্তৃকই বর্ণনা করেন। আনাস (রাঃ) বলেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ এ যুবক অপেক্ষা কারো পেছনে সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করিনি। অর্থাৎ ‘উমার বিন ‘আবদুল ‘আযীয। অতঃপর আমরা তার রুকূ‘র অনুমান করেছি দশ তাসবীহ। তার সাজদার অনুমান করেছি দশ তাসবীহ। এ হাদীস দু’টি থেকে জানা গেল, সালাত হালকা করা দ্বারা উদ্দেশ্য হল বৈঠক ও দাঁড়ানোকে হালকা করা এবং রুকূ' ও সাজদাকে পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করা।
আরও জানা গেল যে, যে ব্যক্তি রুকূ‘ ও সাজদাতে দশ তাসবীহ পাঠ করবে তার কাজ আনাস (রাঃ) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাত পূর্ণাঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও হালকা হত বলে যে বর্ণনা দিয়েছেন তার বিরোধী হবে না। বলা হয়েছে সালাত হালকা বলতে (أمر نسي) বা তুলনামূলক নির্দেশ। সুতরাং কতক দীর্ঘতা এমন যে, তা তার অপেক্ষা দীর্ঘতার দিক থেকে খাটো মনে করা হয় আবার অনেক খাটো এমন আছে যাকে তার অপেক্ষা খাটোর দিকে লক্ষ্য করে দীর্ঘ মনে করা হয়।
সুতরাং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাত হালকা ছিল তবে হালকা হওয়া সত্ত্বেও তা পূর্ণাঙ্গ ছিল। আর এতে কোন জটিলতা নেই। একমতে বলা হয়েছে অন্যান্যদের সালাতের দিকে লক্ষ্য করে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ক্বিরাআতের মতো ক্বিরাআত (কিরআত) অন্য কেউ পাঠ করলে তা দীর্ঘ মনে করা হত, অন্যের পাঠ বিরক্ত সৃষ্টি করত। অথচ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠ করলে তার বিপরীত মনে করা হত।
কেননা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উত্তম স্বর, উত্তমভাবে ক্বিরাআতের হক আদায়, জ্যোতির বিকাশ ও তাৎপর্যের প্রকাশের কারণে তাঁর কুরআন পাঠ স্বাদ, প্রাণ চঞ্চলতা ও মনোযোগ সৃষ্টি করত। তদুপরি তাঁর কুরআন পাঠে দ্রুতগামীতা, সময় ও জবানের ভাঁজ ছিল; স্পষ্টভাবে, তারতীল সহকারে উত্তম পদ্ধতিতে অতি অল্প সময়ে অনেক কুরআন পড়তে পারতেন ও পূর্ণ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করতে পারতেন। ইবনুল ক্বইয়্যিম কিতাবুস্ সালাতে অধ্যায়ের হাদীস এবং বুখারীতে ‘‘রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতকে সংক্ষেপ করতেন এবং পূর্ণ পড়তেন’’ এ শব্দে উল্লেখিত আনাস (রাঃ)-এর হাদীস উল্লেখের পর বলেন, যার শব্দ হলঃ অতঃপর আনাস (রাঃ) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাত সংক্ষেপ ও পূর্ণাঙ্গ হওয়ার ব্যাপারে বর্ণনা দিয়েছেন। সংক্ষেপ বলতে তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা করতেন।
সংক্ষেপ বলতে ঐ ব্যক্তির ধারণা উদ্দেশ্য নয়, যে ব্যক্তি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাতের পরিমাণ সম্পর্কে অবহিত না। কেননা সংক্ষেপ কথাটি একটি সম্বন্ধীয় নির্দেশ; সুন্নাতের দিকে প্রত্যাবর্তনশীল। ইমাম এবং তাঁর পেছনে যারা আছে তাদের প্রবৃত্তির দিকে না। সুতরাং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাজরের (ফজরের) সালাতে ষাট থেকে একশত আয়াত পাঠ করতেন। অতএব ৬০/১০০ আয়াত হাজার আয়াতের দিকে সম্বন্ধ করে সংক্ষেপ। মাগরিবের সালাতে সূরাহ্ আল আ‘রাফ পড়েছেন অতএব তা সূরাহ্ আল বাক্বারাহ্ এর দিকে সম্বন্ধ করে সংক্ষেপ।
এর উপর আরও প্রমাণ বহন করে ইমাম আবূ দাঊদ ও নাসায়ী বর্ণিত ঐ হাদীস যে হাদীসে স্বয়ং আনাস (রাঃ) বলেনঃ আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর তাঁর সালাতের সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) এ যুবক অপেক্ষা আর কারো পেছনে আদায় করিনি। এ যুবক বলতে ‘উমার বিন ‘আবদুল ‘আযীয। অতঃপর আমরা তার রুকূ‘র ক্ষেত্রে দশ তাসবীহ অনুমান করেছি..... শেষ পর্যন্ত।
বুখারী ও মুসলিমের এক হাদীসে স্বয়ং আনাস (রাঃ) বলেনঃ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে যেভাবে সালাত আদায় করতেন তোমাদের নিয়ে আমি সেভাবে সালাত আদায় করতে অবহেলা করব না। সাবিত বলেন, আনাস (রাঃ) এমন কিছু করতেন তোমাদের যা করতে দেখছি না। তিনি যখন রুকূ' থেকে তাঁর মাথা উঠাতেন তখন সোজা হয়ে এতক্ষণ পর্যন্ত দাঁড়াতেন যে, উক্তিকারী বলত তিনি ভুলে গেছেন।
আর তিনি যখন সিজদা্ (সিজদা/সেজদা) থেকে তার মাথা উঠাতেন এতক্ষণ পর্যন্ত বিলম্ব করতেন যে, উক্তিকারী বলত তিনি ভুলে গেছেন। আর আনাস (রাঃ) নিজেই এর উক্তিকারী; তিনি বলেনঃ আমি কোন ইমামের পেছনে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা অধিক হালকা ও অধিক পূর্ণ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করিনি। আর আনাস (রাঃ)-এর হাদীসের কতক কতককে মিথ্যা সাব্যস্ত করবে না।
(لَيَسْمَعُ بُكَاءَ الصَّبِيِّ) উল্লেখিত অংশ ছোট বাচ্চাদের মসজিদে প্রবেশ করানো বৈধ এ ব্যাপারে প্রমাণ রয়েছে। যদিও মসজিদে যাদের হাদাস (অপবিত্র) হওয়া থেকে নিরাপদ থাকা যায় না তাদের থেকে মাসজিদকে নিরাপদে রাখা উত্তম। এটা মূলত ঐ হাদীসের কারণে যাতে আছে ‘‘তোমরা আমাদের মাসজিদগুলোকে তোমাদের বাচ্চাদের থেকে আলাদা করে রাখ..... শেষ পর্যন্ত’’ এ হাদীসটিকে ইবনু মাজাহ অত্যন্ত দুর্বল সানাদে বর্ণনা করেছেন।
ইবনু হাজার বলেনঃ ছোট বাচ্চাদের মসজিদে প্রবেশ করানো বৈধ হওয়ার ব্যাপারে অধ্যায়ের হাদীসটি দ্বারা প্রমাণ গ্রহণ করতে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। আর তা মূলত এ সম্ভাবনা থাকার কারণে যে, বাচ্চাটি মসজিদের নিকটবর্তী কোন বাড়িতে ছিল ফলে মাসজিদ থেকে বাচ্চার কান্না শোনা যেত।
(فَيُخَفِّفُ) মুসলিম আনাস (রাঃ) কর্তৃক সাবিত-এর এক বর্ণনাতে সালাত হালকা করা সম্পর্কে বলেন, (তিনি খাটো সূরাহ্ পড়তেন) ইবনু আবী শায়বাহ্ ‘আবদুর রহমান বিন সাবিত-এর সানাদে সূরার পরিমাণ সম্পর্কে বলেন, প্রথম রাক্‘আতে তিনি লম্বা সূরাহ্ পড়তেন, অতঃপর বাচ্চার কান্না শুনলে দ্বিতীয় রাক্‘আতে তিন আয়াত পড়েছেন। এটি মুরসাল। ফাতহুল বারীতে এভাবে আছে। ‘আয়নী ইবনু সাবিত-এর হাদীস (রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনি প্রথম রাক্‘আতে ষাট আয়াতের মতো পাঠ করলে বাচ্চার কান্না শুনতে পান) এ শব্দে উল্লেখ করেছেন।
(مَخَافَةَ أَنْ تُفْتَنَ) ‘আবদুর রাযযাক্ব ‘আত্বা এর মুরসাল বর্ণনাতে একটু বাড়িয়ে বলেছেন ‘‘মা বাচ্চাকে ছেড়ে রাখবে অতঃপর বাচ্চা (সালাত) নষ্ট করে দিবে’’ বুখারী কর্তৃক আবূ যার-এর এক কপিতে এসেছে (বাচ্চা ফিৎনাতে ফেলে দিবে) অর্থাৎ যাকে ফিৎনাতে ফেলে দিবে।
জাযারী জামি‘উল উসূল-এর ৬ষ্ঠ খন্ডে ৩৭৪ পৃষ্ঠাতে ‘‘তার মা ফেৎনায় পতিত হওয়ার আশঙ্কাতে’’ এ শব্দে উল্লেখ করেছেন। হাদীসটিতে সাহাবীদের প্রতি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্নেহ, সাহাবীদের সাথে বয়োবৃদ্ধ ও ছোটদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখা কোন কিছু সংঘটিত হলে সালাতকে হালকা করা শারী‘আত সম্মত হওয়ার ব্যাপারে প্রমাণ রয়েছে। সিনদী বলেনঃ কখনো এ হাদীস থেকে এ মাসআলাও গ্রহণ করা যেতে পারে যে, ইমামের জন্য জায়িয আছে মসজিদে প্রবেশকারীর প্রতি লক্ষ রেখে সালাত দীর্ঘ করা যাতে ব্যক্তি রাক্‘আত পেতে পারে আর এটি ঠিক অনুরূপ যেমন মুসল্লীদের প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদের জন্য সালাত হালকা করা বৈধ রয়েছে। তবে এ ধরনের করাকে লোক দেখানো আমল বলা যাবে না। বরং এটি কল্যাণকর কাজের ব্যাপারে সহযোগিতা ও অকল্যাণকর কাজ থেকে নিষ্কৃতি লাভ করার মাধ্যম।
খাত্ত্বাবী মা‘আলিম গ্রন্থের ১ম খন্ডে ২০১ পৃষ্ঠাতে বলেন, এ হাদীসে ঐ ব্যাপারে প্রমাণ রয়েছে যে, ইমাম যখন রুকূ‘ অবস্থায় থাকবে তখন যদি তিনি অনুভব করেন যে, কোন ব্যক্তি তাঁর সাথে সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায়ের উদ্দেশ্য করছে তাহলে এমতাবস্থায় ইমামের পক্ষে ঐ মুসল্লীর জন্য রুকূ‘ অবস্থায় অপেক্ষা করা বৈধ রয়েছে যাতে মুসল্লী জামা‘আতের সাথে রাক্‘আতের মর্যাদা লাভ করতে পারে। কেননা তার পক্ষে যখন দুনিয়াবী কতিপয় বিষয়ে মানুষের প্রয়োজনার্থে সালাতের দীর্ঘতাকে বিলুপ্ত করা বৈধ হয়েছে তখন আল্লাহর ‘ইবাদাতের লক্ষ্যেও এ সালাতে প্রয়োজন মুহূর্তে কিছু সময় বৃদ্ধি করা বৈধ রয়েছে। বরং সময় বৃদ্ধি করাটাই বেশি হক ও উত্তম।
তবে কুরতুবী এর সমালোচনা করেছেন যে, এখানে সময় দীর্ঘ করা সালাতে অতিরিক্ত কাজ; যা সালাত হালকা করার বিপরীত ও উদ্দেশ্যহীন পক্ষান্তরে সালাতে দীর্ঘতাকে বিলুপ্ত করা উদ্দেশিত কাজ। ইবনু বাত্তাল বলেনঃ যারা এ ধরনের দীর্ঘ করাকে জায়িয বলেছেন তাদের মাঝে রয়েছে শা‘বী, হাসান ও ‘আবদুর রহমান বিন আবী লায়লা। অন্যরা বলেনঃ যতক্ষণ মুক্তাদীর ওপর জটিল না হবে ততক্ষণ ইমাম অপেক্ষা করবে। এটি মূলত আহমাদ, ইসহাক ও আবূ সাওর-এর উক্তি।
মালিক বলেনঃ অপেক্ষা করা যাবে না, কেননা তা পেছনের মুসল্লীদের ক্ষতি সাধন করবে এটি আওযা‘ঈ, আবূ হানীফা ও শাফি‘ঈর কথা। ‘আয়নী এটি উল্লেখ করেন। হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ এ মাসআলার ক্ষেত্রে শাফি‘ঈ মতাবলম্বীদের নিকট বিরূপ মন্তব্য ও বিশদ বিবরণ রয়েছে। ইমাম নাবাবী এটিকে তার নতুন মতানুযায়ী এটিকে মাকরূহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ব্যাপারে উক্তি করেছেন আওযা‘ঈ, মালিক, আবূ হানীফাহ্ ও আবূ ইউসুফ। মুহাম্মাদ বিন হাসান বলেনঃ আমি এটিকে শির্ক হয়ে যাওয়ার আশংকা করছি।
‘উবায়দুল্লাহ (রাঃ) মুবারকপূরী বলেনঃ আমি বলবঃ ইমাম সালাতে কোন মুসল্লীর জন্য অপেক্ষা করা বিষয়টিকে যারা সালাতে অতিরিক্ত করা ও শির্কী সংশয় সৃষ্টি হওয়ার দিকে চাপিয়ে দিয়ে এমন কাজকে মাকরূহ বলেছেন তাদের এ ধরনের উক্তিতে বিশাল উদাসীনতা, দীনের মাঝে বিচ্ছিন্নতা এবং শারী‘আতে এমন গভীরতায় পৌঁছা যা আল্লাহভীরু ব্যক্তিদের জন্য বিশুদ্ধ হবে না। দীন সহজ আর আল্লাহ আমাদের সাধ্যের উপর আমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেননি। কোন মুসলিমের প্রতি দয়ার নিয়্যাত করা এক ধরনের ভাল সুনদর নিয়্যাত। এর উপর ভিত্তি করে এর কর্তাকে সাওয়াব দেয়া হবে।
আর তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে হওয়ার কারণে। কোন সন্দেহ নেই যে, মুসল্লী জামা‘আত শুরু হওয়ার পর মসজিদে প্রবেশ করবে ইমামের তার প্রতি লক্ষ্য রেখে রাক্‘আত দীর্ঘ করা এই উদ্দেশ্যে যে, যাতে পেছনের মুক্তাদীদের কোন রকম জটিলতা হওয়া ছাড়াই সেও রাক্‘আতটি পায়; রুকূ' দীর্ঘ করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিয়্যাতে তাকে আনুগত্যের ব্যাপারে সাহায্য করার নামান্তর। এতে শির্ক ও লোক দেখানো ‘আমলের সংস্পর্শতা নেই। কেনই বা থাকবে? অথচ আহমাদ, আবূ দাঊদ ‘আবদুল্লাহ বিন আবী আওফা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন ‘‘নিশ্চয়ই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুুহরের প্রথম রাক্‘আতে ক্বিয়াম (কিয়াম) করতেন যতক্ষণ না বসে পড়ার কথা শুনতেন’’- আবূ দাঊদ, মুনযিরী এ ব্যাপারে চুপ থেকেছেন। এতে একজন অপরিচিত বর্ণনাকারী আছেন।
মুনযিরী আরও বর্ণনা করেন, নিশ্চয়ই আবূ ক্বাতাদাহ্ বলেনঃ (অর্থাৎ প্রথম রাক্‘আত দীর্ঘ করার কৌশল বর্ণনা সম্পর্কে) আমরা ধারণা করেছি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম রাক্‘আত লম্বা করার দ্বারা মানুষ প্রথম রাক্‘আত পেয়ে যাওয়ার ইচ্ছা করতেন। আমাদের কাছে সর্বাধিক সমতাপূর্ণ উক্তি হল আহমাদ, ইসহাক ও আবূ সাওর যেদিকে গিয়েছেন। আর আল্লাহই সর্বাধিক ভাল জানেন। হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম ঐকমত্যে বর্ণনা করেছেন কথাটিতে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে, কেননা মুসলিম শুধু প্রথম অংশটি সংকলন করেছেন আর ইমাম বুখারী দ্বিতীয় অংশটি এককভাবে বর্ণনা করেছেন। ইসমা‘ঈলী বর্ণনায় এ হাদীসকে দীর্ঘ করে পূর্ণাঙ্গতার সাথে বর্ণনা করেছেন।
পরিচ্ছেদঃ ২৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইমামের দায়িত্ব
১১৩০-[২] আবূ ক্বাতাদাহ্ (রাঃ)থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ আমি সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আরম্ভ করলে তা লম্বা করার ইচ্ছা করি। কিন্তু যখনই (পেছন থেকে) শিশুদের কান্নার শব্দ শুনি, তখন আমার সালাতকে আমি সংক্ষেপ করি। কারণ তার কান্নায় তার মায়ের মনের উদ্বিগ্নতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। (বুখারী)[1]
بَابُ مَا عَلَى الإِمَامِ
وَعَنْ أَبِي قَتَادَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «إِنِّي لَأَدْخُلُ فِي الصَّلَاةِ وَأَنَا أُرِيدُ إِطَالَتَهَا فَأَسْمَعُ بُكَاءَ الصَّبِيِّ فَأَتَجَوَّزُ فِي صَلَاتِي مِمَّا أَعْلَمُ مِنْ شِدَّةِ وجد أمه من بكائه» . رَوَاهُ البُخَارِيّ
ব্যাখ্যা: নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে মহিলাগণ মসজিদে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে দলীল রয়েছে। ইমাম বুখারী হাদীসটিকে সঠিক আবূ ক্বাতাদাহ্ থেকে বর্ণনা করেছেন। কথাটিতে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। কেননা লেখক যে বাচনভঙ্গিতে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন তা আনাস (রাঃ)-এর হাদীস পূর্বে আমরা অতিবাহিত করেছি; আবূ ক্বাতাদাহ্-এর না। আবূ ক্বাতাদার হাদীস ইমাম বুখারী সহীহুল বুখারীর দু’ স্থানে উল্লেখ করেছেন।
প্রথমতঃ তিনি একে ‘‘ছোট বাচ্চার ক্রন্দনের মুহূর্তে অতি হালকা সালাত’’ অধ্যায়ে ‘‘নিশ্চয়ই সালাতে দাঁড়াই, সালাতে দীর্ঘ করার ইচ্ছা করি, অতঃপর বাচ্চার কান্না শুনতে পেয়ে মার উপর বিষয়টি কষ্টকর হওয়াকে অপছন্দ করে সালাতে হালকা করে থাকি’’- এ শব্দে বর্ণনা করেছেন। অতঃপর তিনি একে জুমু‘আর পর্বের কিছু আগে মহিলাদের মসজিদে গমন অধ্যায়ে ‘‘নিশ্চয়ই আমি সালাতে দাঁড়াই অতঃপর তাতে দীর্ঘ করার ইচ্ছা করি’’- এ শব্দে উলেলখ করেছেন। বাকী অংশটুকু অনুরূপ।
এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, নিশ্চয়ই লেখক হাদীসের সংকলনস্থ বর্ণনা করতে ভুল করেছে অর্থাৎ কিতাবের বাচনভঙ্গি অনুযায়ী হাদীসটি যে বর্ণনা করেছেন সে সাহাবীর নাম উল্লেখকরণে। সুতরাং লেখকের জন্য এবং আবূ ক্বাতাদাহ্ হতে বর্ণিত আবূ ক্বাতাদাহ্ এর হাদীসের স্থানে আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত বলা উচিত ছিল। হাদীসটি আবূ দাঊদ, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ এবং বায়হাক্বীও সংকলন করেছেন।
পরিচ্ছেদঃ ২৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইমামের দায়িত্ব
১১৩১-[৩] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ তোমাদের যারা মানুষের সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করায় সে যেন সালাত সংক্ষেপ করে। কারণ (তার পেছনে) মুক্তাদীদের মধ্যে রোগী, দুর্বল, বুড়োও থাকে (তাদের প্রতি খেয়াল রাখাও দরকার)। আর তোমাদের কেউ যখন একা একা সালাত আদায় করবে সে যত ইচ্ছা সালাত দীর্ঘ করতে পারে। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ مَا عَلَى الإِمَامِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «إِذا صلى أحدكُم النَّاس فَلْيُخَفِّفْ فَإِنَّ فِيهِمُ السَّقِيمَ وَالضَّعِيفَ وَالْكَبِيرَ. وَإِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ لِنَفْسِهِ فَلْيُطَوِّلْ مَا شَاءَ»
ব্যাখ্যা: (إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمُ النَّاسَ) অর্থাৎ ফরয বা নফল সালাতের ইমাম হয়ে তোমাদের কেউ যখন মানুষকে নিয়ে সালাত আদায় করবে। মুসলিমের এক বর্ণনা এসেছে, তোমাদের কেউ যখন মানুষের ইমামতি করবে।
(فَلْيُخَفِّفْ) হালকাকরণ বিষয়টি তুলনামূলক নির্দেশের আওতাভুক্ত। কখনো একই বস্ত্ত বা বিষয় এক সম্প্রদায়ের অভ্যাসের দিকে সম্বন্ধ করে হালকা, অন্য সম্প্রদায়ের অভ্যাসের দিকে সম্বন্ধ করে লম্বা। সুতরাং সম্প্রদায়ের মাঝে সর্বাধিক দুর্বল ব্যক্তির বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে তবে এ শর্তে যে, ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নাতের মাঝে কোন প্রকার ত্রুটি করা যাবে না। সুতরাং সকল কিছু পূর্ণাঙ্গ আদায়ের সাথে সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) হালকা করতে হবে।
হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ ‘উসমান বিন আবিল ‘আস কর্তৃক আবূ দাঊদ ও নাসায়ী সংকলিত হাদীস থেকে (التخفيف) বা হালকাকরণ এর যে সংজ্ঞা বা পরিচিতি গ্রহণ করা হয়েছে তা সর্বোত্তম সংজ্ঞা বা পরিচিতি। তাতে আছে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘উসমান বিন আবিল ‘আসকে বললেনঃ তুমি তোমার সম্প্রদায়ের ইমাম। তুমি তাদের মাঝে সর্বাধিক দুর্বল ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টি রাখবে। এর সানাদ হাসান, এর মূলও মুসলিমে আছে।
(فَإِنَّ فِيهِمُ السَّقِيمَ وَالضَّعِيفَ وَالْكَبِيرَ) ইমাম মুসলিম এক বর্ণনাতে একটু বেশি উল্লেখ করেছেন তা হল (الضَّعِيفَ) ত্ববারানী ‘উসমান বিন আবিল ‘আস কর্তৃক একটু বেশি বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে গর্ভবতী নারী ও দুগ্ধদানকারিণী নারী এর কথা। ত্ববারানীর অপর বর্ণনাতে ‘আদী বিন হাতিম-এর হাদীসে আছে মুসাফিরের কথা। আবূ মাস্‘ঊদ ও ‘উসমান বিন আবিল ‘আস-এর আগত হাদীসদ্বয়ে রসূলের উক্তি (ذَا الْحَاجَةِ) বা প্রয়োজন বোধকারী উল্লেখিত সকল গুণাবলীকে অন্তর্ভুক্ত করবে।
এটি মুসলিমের এক বর্ণনাতে আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) এর হাদীস কর্তৃকও প্রমাণিত হয়েছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্তি ‘কেননা তাদের মাঝে.....’ শেষ পর্যন্ত যা হাদীসে এসেছে তা বর্ণিত নির্দেশের কারণ। সুতরাং অবস্থার চাহিদা অনুপাতে তাদের মাঝে যখন উল্লেখিত গুণে গুণান্বিত কোন ব্যক্তি থাকবে না অথবা তারা যখন সালাত দীর্ঘ করার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে এমন কোন স্থানে সীমাবদ্ধ থাকবে যেখানে তারা ছাড়া অন্য কেউ শামিল হবে না তখন সালাত দীর্ঘ না করার কারণ না থাকার কারণে সালাত দীর্ঘ করতে কোন ক্ষতি সাধন হবে না। তবে ইবনু আবদিল বার বলেনঃ আমার মতে সালাত হালকাকরণকে আবশ্যক করে দেয় এমন কোন কারণ অবহিত হওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপদ থাকা যায় না।
কেননা ইমাম যদিও তার পেছনের মুক্তাদীদের শক্তি সামর্থ্য সম্পর্কে বুঝতে পারেন কিন্তু ব্যস্ত করে দেয় এমন কোন ঘটনা তাদের কখন ঘটবে তা তিনি জানেন না এবং কোন প্রয়োজন তাদের সামনে উপস্থিত হবে ও প্রস্রাব বা অন্য কোন বিপদে পতিত হবে তাও তিনি জানেন না। ইয়া‘মুরী বলেনঃ হুকুম আহকাম অধিকাংশের সাথে সম্পর্কিত। বিরলতার সাথে না। সুতরাং ইমামদের জন্য সাধারণভাবে জামা‘আতের সালাতকে হালকা করাই উচিত হবে। তিনি বলেন, এটি ঠিক অনুরূপ যেমন মুসাফিরের সালাতের ক্ষেত্রে ক্বসর করার বিধান প্রণয়ন করা হয়েছে। আর এর কারণ দর্শানো হয়েছে কাঠিন্যতাকে। যদিও সফরে অনেক ক্ষেত্রে ‘আমল করা কষ্ট হয় না। তথাপিও ক্বসর প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। কেননা মুসাফির জানে না কখন তার ওপর কি সমস্যা সৃষ্টি হবে।
(فَلْيُطَوِّلْ مَا شَاءَ) অর্থাৎ ক্বিরাআতে, রুকূ‘তে, সাজদাতে, ধীর-স্থিরতাতে, দু’ সাজদার মাঝে বসা ও তাশাহুদে যে পরিমাণ ইচ্ছা হয় লম্বা করবে।
মুসলিমের এক বর্ণনাতে আছে সে যেভাবে ইচ্ছা সালাত আদায় করবে অর্থাৎ হালকা, দীর্ঘ যেভাবে ইচ্ছা অর্থাৎ সে তার ইচ্ছানুযায়ী হালকা বা দীর্ঘ করাতে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে কোন সালাতের সময় নিজ সময় থেকে বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত বা কোন সালাত নিষিদ্ধ সময়ের মাঝে প্রবেশ হওয়া পর্যন্ত সালাত দীর্ঘ করা উচিত হবে না। সিরাজ-এর মুসনাদে আছে ‘‘আর যখন ব্যক্তি একাকী সালাত আদায় করবে তখন ইচ্ছা হলে সালাত দীর্ঘ করবে।’’ হাদীসটি ইমামদের সালাত হালকাকরণ শারী‘আতসম্মত হওয়ার উপর প্রমাণ বহন করছে। আরও প্রমাণ বহন করছে দুর্বলতা, অসুস্থতা, বার্ধক্যতা, প্রয়োজন ও এগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট উল্লেখিত কারণগুলোর ক্ষেত্রে সালাত দীর্ঘ করা বর্জন করার উপর।
তবে বিদ্বানগণ মতানৈক্য করেছেন উল্লেখিত নির্দেশ ওয়াজিবের জন্য নাকি সুন্নাতের জন্য ব্যবহৃত? কুসত্বলানী বলেছেনঃ এক দল রসূলের উক্তি (فَلْيُخَفِّفْ) এর মাঝে নির্দেশের বাহ্যিক দিক লক্ষ্য করে নির্দেশটি আবশ্যকতার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। যেমন ইবনু হাযম, ইবনু আবদিল বার ও ইবনু বাত্ত্বাল। ইবনু ‘আবদুল বার-এর ভাষ্য এ হাদীসটিতে ঐ ব্যাপারে সর্বাধিক স্পষ্ট দলীল রয়েছে যে, জামা‘আতের ইমামদের ওপর আবশ্যক জামা‘আতকে হালকা করা আর এটা মূলত রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক এ ব্যাপারে তাদের নির্দেশ দেয়ার কারণে। এমতাবস্থায় জামা‘আতের সালাত দীর্ঘ করা তাদের পক্ষে বৈধ হবে না, কেননা সালাত হালকা করার ব্যাপারে নির্দেশের মাঝে সালাত দীর্ঘ করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
সালাত হালকা করার দ্বারা উদ্দেশ্য হল তা এমনভাবে হওয়া যাতে সালাতের সুন্নাত ও তার উদ্দেশে কোন ক্ষতি হয় না। শাওকানী নায়লুল আওতারে বলেছেন, ইবনু ‘আবদিল বার বলেনঃ প্রত্যেক ইমামের পক্ষে জামা‘আতের সালাতকে হালকা করা একটি সুন্নাতসম্মত বিষয়। যার ব্যাপারে বিদ্বানগণ একমত। তবে তা পূর্ণাঙ্গ সালাতের সর্বাধিক কম (সময়ের) সালাত। পক্ষান্তরে সালাতের কোন অংশকে বিলুপ্ত করা, কোন অংশের হ্রাস করা উদ্দেশ্য না। কেননা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতে কাকের মতো ঠোকর দেয়া থেকে নিষেধ করেছেন।
একদা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে সালাত আদায় করতে দেখলেন যে, তার রুকূ' পূর্ণাঙ্গভাবে করেনি। তখন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি ফিরে যাও অতঃপর সালাত আদায় কর; কেননা তুমি সালাত আদায় করনি। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেনঃ আল্লাহ ঐ ব্যক্তির দিকে লক্ষ্য করবে না যে তার রুকূ‘ সাজদাতে পিঠ সোজা করবে না। অতঃপর তিনি বলেন, আমরা সালাত পূর্ণাঙ্গ হওয়ার যে শর্ত করেছি সে অনুযায়ী যে ব্যক্তি সম্প্রদায়ের ইমামতি করবে এমন প্রত্যেক ইমামের পক্ষে জামা‘আতের সালাত হালকা করা সুন্নাতসম্মত হওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্বানদের মাঝে কোন মতানৈক্য জানি না।
‘উমার বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) থেকে একটি বর্ণনা রয়েছে, নিশ্চয়ই তিনি বলেন, তোমরা আল্লাহকে তাঁর বান্দাদের প্রতি রাগান্বিত করিও না তা এভাবে যে, তোমাদের কেউ তার সালাতে দীর্ঘ করবে ফলে দীর্ঘতা পেছনে মুক্তাদীদের ওপর কঠিন হয়ে যাবে।
পরিচ্ছেদঃ ২৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইমামের দায়িত্ব
১১৩২-[৪] ক্বায়স ইবনু আবূ হাযিম (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ মাস্’ঊদ (রাঃ) আমাকে বলেছেন, একদিন এক লোক রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে আবেদন করল, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহর শপথ, অমুক লোক খুব দীর্ঘ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) পড়াবার জন্যে আমি ফজরের (ফজরের) সালাতে দেরী করে আসি। আবূ মাস্’ঊদ বলেন, সেদিন অপেক্ষা উপদেশ করার সময় আর কোন দিন তাঁকে (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে) আজকের মতো এত রাগ করতে দেখিনি। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ তোমাদের কেউ কেউ (দীর্ঘ করে সালাত আদায় করে) মানুষকে বিরক্ত করে তোলে। (সাবধান!) তোমাদের যে লোক মানুষকে (জামা’আতে) সালাতে ইমামতি করবে। সে যেন সংক্ষেপে সালাত আদায় করায়। কারণ মুক্তাদীদের মাঝে দুর্বল, বুড়ো, প্রয়োজনের তাড়ার লোকজন থাকে। (বুখারী, মুসলিম)[1]
بَابُ مَا عَلَى الإِمَامِ
وَعَنْ قَيْسِ بْنِ أَبِي حَازِمٍ قَالَ: أَخْبَرَنِي أَبُو مَسْعُودٍ أَنَّ رَجُلًا قَالَ: وَاللَّهِ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي لَأَتَأَخَّرُ عَنْ صَلَاةِ الْغَدَاةِ مِنْ أَجْلِ فُلَانٍ مِمَّا يُطِيلُ بِنَا فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَوْعِظَةٍ أَشَدَّ غَضَبًا مِنْهُ يَوْمَئِذٍ ثُمَّ قَالَ: إِنَّ مِنْكُمْ مُنَفِّرِينَ فَأَيُّكُمْ مَا صَلَّى بِالنَّاسِ فَلْيَتَجَوَّزْ: فَإِنَّ فِيهِمُ الضَّعِيفَ وَالْكَبِير وَذَا الْحَاجة
ব্যাখ্যা: (إِنَّ رَجُلًا) হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেনঃ লোকটির নাম সম্পর্কে আমি অবহিত হতে পরিনি। যে দাবি করেছেন নিশ্চয়ই লোকটি হাযম বিন উবাই বিন কা‘ব সে ধারণা করেছেন মাত্র, কেননা তার ঘটনা মু‘আয-এর সাথে ছিল (যেমন আবূ দাঊদ সালাত হালকাকরণ অধ্যায়ে একে বর্ণনা করেছেন) উবাই বিন কা‘ব-এর সাথে না।
(إِنِّي لَأَتَأَخَّرُ عَنْ صَلَاةِ الْغَدَاةِ) অর্থাৎ আমি জামা‘আতের সাথে ভোরের (ফজরের) সালাতে উপস্থিত হতে অবশ্যই বিলম্ব করে থাকি।
বুখারীর অন্য বর্ণনাতে আছে, (صَلَاةَ الْفَجْرِ) ফাজরের (ফজরের) সালাত। সালাতকে আলোচনার সাথে নির্দিষ্ট করার কারণ কেননা ফাজরের (ফজরের) সালাতে ক্বিরাআত (কিরআত) অধিকাংশ সময় দীর্ঘ হয়ে থাকে। কেননা এ সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) থেকে সালাম ফিরানো ঐ ব্যক্তির জন্য সালাতের প্রতি অভিমুখী হওয়ার সময় এ সালাতের প্রতি যার অভ্যাস রয়েছে (مِنْ أَجْلِ فُلَانٍ) অর্থাৎ তার এলাকা বা গোত্রের মসজিদের ইমাম। ত্বীবী বলেনঃ সালাত দীর্ঘ করা থেকে উদ্দেশ্য হল ক্বিরাআতে দীর্ঘ করা। আর এটি সালাতে ক্বিরাআত (কিরআত) পাঠ অধ্যায়ে পূর্বোক্ত মু‘আয-এর ঘটনা ছাড়া অন্য একটি ঘটনা।
হাফিয বলেন, মু‘আয-এর ঘটনা আবূ মাস্‘ঊদ-এর এ হাদীসের বিপরীত। কেননা মু‘আয-এর ঘটনা ছিল ‘ইশার সালাতে এবং তাতে ইমাম ছিল মু‘আয, তা ছিল মসজিদে বানী সালামাতে। পক্ষান্তরে এ ঘটনা ফজরের সালাতে মসজিদে কুবাতে ছিল। এখানে অস্পষ্ট ইমামকে যে মু‘আয-এর মাধ্যমে তাফসীর করেছেন সে তা সন্দেহবশতঃ করেছে। বরং ফাজরের (ফজরের) ইমাম দ্বারা উবাই বিন কা‘ব উদ্দেশ্য। যেমন আবূ ইয়া‘লা একে জাবির (রাঃ) হতে ‘ঈসা বিন জারিয়ার বর্ণনার মাধ্যমে হাসান সানাদে সংকলন করেছেন। জাবির (রাঃ) বলেন, উবাই বিন কা‘ব কুবাবাসীদের নিয়ে সালাত আদায় করতে গিয়ে দীর্ঘ সূরাহ্ পাঠ করতে শুরু করেন। এমতাবস্থায় এক আনসারী গোলাম সালাতে প্রবেশ করে দীর্ঘ সূরাহ্ শুনতে পেয়ে সালাত থেকে বের হয়ে যান তখন উবাই রাগান্বিত হয়ে গোলামের নামে অভিযোগ নিয়ে রসূলের কাছে আসেন অপরদিকে গোলাম উবাই এর নামে অভিযোগ নিয়ে রসূলের কাছে আসেন। অভিযোগ শুনে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগান্বিত হন যে, তাঁর চেহারাতে রাগ প্রকাশ পায়। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিশ্চয়ই তোমাদের কেউ এমন আছে যারা মানুষকে জামা‘আতের সাথে সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করা থেকে পিছ পা করে দেয়। সুতরাং তোমরা যখন জামা‘আতে সালাত আদায় করবে তখন তোমরা সালাত হালকা করবে। কেননা তোমাদের পেছনে দুর্বল, বয়স্ক, অসুস্থ ও প্রয়োজনমুখী মানুষ থাকে।
(أَشَدَّ غَضَبًا مِنْهُ يَوْمَئِذٍ) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাগান্বিত হওয়ার কারণ উপদেশের বিরোধিতা করার কারণে হয়ত এ ব্যাপারে মু‘আয-এর ঘটনা দ্বারা পূর্বে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল অথবা যা জানা উচিত হবে তা শিক্ষার ক্ষেত্রে কমতি করেছিল অথবা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের সামনে যা উপস্থাপন করছেন সে ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদানের লক্ষ্যে। যাতে রসূলের কথা শুনে তারা পূর্বোক্ত আচরণ পরবর্তীতে না করে।
(إِنَّ مِنْكُمْ مُنَفِّرِيْنَ) বিরক্তি সৃষ্টি করে সালাতকে এ পরিমাণ দীর্ঘ করার মাধ্যমে মানুষকে জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করা থেকে দূরে রাখে। হাদীসে সালাত দীর্ঘকারীকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দিষ্টভাবে সম্বোধন করেননি; বরং ব্যক্তিটি অপমানিত হওয়ার আশংকায় তার প্রতি অনুগ্রহপূর্বক ও রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে উত্তম চরিত্রের পরিচয়দান পূর্বক ব্যাপক সম্বোধন করেছেন।
(فَلْيَتَجَوَّزْ) এক বর্ণনাতে এসেছে ‘‘যে মানুষকে নিয়ে সালাত আদায় করবে সে যেন হালকা করে’’। অন্য বর্ণনাতে এসেছে ‘‘যে মানুষের ইমামতি করবে সে যেন সংক্ষিপ্ত করে’’।
(فَإِنَّ فِيهِمُ الضَّعِيفَ وَالْكَبِير) বুখারীর এক বর্ণনাতে এসেছে কেননা তাদের মাঝে অসুস্থ এবং দুর্বল আছে। এখানে দুর্বল দ্বারা অসুস্থ ব্যক্তিই উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে কিতাবে উল্লেখিত দুর্বল দ্বারা ঐ ব্যক্তি উদ্দেশ্য যে গঠনগত দুর্বল যেমন পাতলা বা বৃদ্ধ। হাদীসটি ঐ ব্যাপারে প্রমাণ বহন করে যে, যখন কোন ইমামের মাঝে সালাত অধিক দীর্ঘ করার অভ্যাস পাওয়া যাবে তখন জামা‘আতে সালাত আদায় থেকে পেছানো বৈধ হবে। আরও প্রমাণ বহন করে যে, দীনের ব্যাপারে অসমীচীন কাজ দেখলে রাগান্বিত হওয়া বৈধ। আরও বুঝা যাচ্ছে মুক্তাদীদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করে সালাত হালকা করতে হবে। পরিশেষে হাদীস থেকে যে নিষেধাজ্ঞাটি প্রমাণিত হচ্ছে জামা‘আত থেকে পিছ পা করার জন্য কোন কিছু করা যাবে না, করলে তার ব্যাপারে হুমকি রয়েছে।
পরিচ্ছেদঃ ২৭. প্রথম অনুচ্ছেদ - ইমামের দায়িত্ব
১১৩৩-[৫] আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ তোমাদেরকে ইমাম সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) আদায় করাবেন। বস্তুতঃ যদি সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) ভালভাবে পড়ায় তবে তোমাদের জন্যে সফলতা আছে (তার জন্যেও আছে)। আর সে যদি কোন ভুল করে ফেলে তাহলে তোমরা সাওয়াব পাবে। তার জন্যে সে পাপী হবে। (বুখারী)[1]
بَابُ مَا عَلَى الإِمَامِ
وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «يُصَلُّونَ لَكُمْ فَإِنْ أَصَابُوا فَلَكُمْ وَإِنْ أَخْطَئُوا فَلَكُمْ وَعَلَيْهِمْ» . رَوَاهُ الْبُخَارِيُّ
وَهَذَا الْبَابُ خَالٍ عَنِ الْفَصْلِ الثَّانِي
ব্যাখ্যা: (فَإِنْ أَصَابُوا) কিরমানী বলেনঃ ইমামগণ যদি সালাত, রুকন, শর্ত ও সুন্নাতসমূহ সহকারে আদায় করে। ‘আয়নী বলেনঃ তারা যদি সালাত (সালাত/নামায/নামাজ) পূর্ণাঙ্গ আদায় করে এর উপর প্রমাণ বহন করছে ‘উক্ববাহ্ বিন ‘আমির-এর ঐ হাদীস যা হাকিম, বুখারী ও মুসলিমের শর্তে মারফূ' সূত্রে বর্ণনা করেছেন আর তা এ শব্দে ‘‘যে মানুষের ইমামতি করবে অতঃপর পূর্ণ করবে’’। অপর কপিতে আছে ‘‘অতঃপর যে ব্যক্তি সঠিকভাবে সালাতের ইমামতি করবে তার সালাত তার ও মুক্তাদী সকলের পক্ষে হবে (অর্থাৎ ইমাম মুক্তাদী সকলের পুণ্যের কারণ)’’। পক্ষান্তরে এ সালাত থেকে যদি কিছু কমতি করে তাহলে তা ইমামের বিপক্ষে হবে এবং মুক্তাদীদের পক্ষে হবে।
‘আবদুর রহমান বিন হারমালাহ্ এবং ‘উক্ববাহ্ থেকে বর্ণনাকারী আবূ ‘আলী আল হামদানী-এর সানাদের বিচ্ছিন্নতা থাকার দরুন ইমাম ত্বহাবী একে দোষী সাব্যস্ত করেছেন।
‘উবায়দুল্লাহ মুবারকপূরী বলেনঃ আমি বলব, ‘উক্ববার এ হাদীসটি ইমাম হাকিম মুসতাদরাকে প্রথম খন্ডে ২১০ পৃষ্ঠাতে বর্ণনা করেছেন, বুখারী ও মুসলিমের শর্তে সহীহ হাদীস বর্ণনার পর। ইমাম যাহাবী অনুকূল করেছেন। আহমাদ আবূ দাঊদ এবং প্রমুখগণ এ হাদীস সংকলন করেছেন। মুনযিরী আবূ ‘আলী আল মিসরী (হামদানী) কর্তৃক তারগীব গ্রন্থে বলেনঃ আবূ ‘আলী বলেছেনঃ আমরা একদা ‘উক্ববাহ্ বিন ‘আমির-এর সাথে ভ্রমণ করলে আমাদের কাছে সালাতের সময় ঘনিয়ে আসলো, অতঃপর আমরা ইচ্ছা করলাম ‘উক্ববাহ্ আমাদের আগে বেড়ে ইমামতি করুক কিন্তু তিনি বললেন, আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের ইমামতি করবে সে যদি পূর্ণাঙ্গভাবে সালাত আদায় করে তাহলে সে সালাত তার ও মুক্তাদীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ সালাত হিসেবে গণ্য হবে। আর যদি সালাত পূর্ণাঙ্গভাবে না আদায় করে থাকে তাহলে সে সালাত মুক্তাদীদের জন্য পূর্ণাঙ্গ সালাত হিসেবে গণ্য হবে আর ইমামের ওপর পাপ বর্তাবে।
ইমাম আহমাদ একে বর্ণনা করেছেন এবং বর্ণিত শব্দ তার। আবূ দাঊদ ও ইবনু মাজাহ একে বর্ণনা করেছেন। হাকিম একে বর্ণনা করেছেন ও সহীহ বলেছেন। ইবনু খুযায়মাহ্ ও ইবনু হিব্বান একে তাদের সহীহ কিতাবদ্বয়ে বর্ণনা করেছেন তাদের উভয়ের শব্দ ‘‘যে ব্যক্তি মানুষের ইমামতি করবে, সঠিক সময়ে ও পূর্ণাঙ্গভাবে আদায় করবে তাহলে সে সালাত ইমামের ও মুক্তাদীদের পক্ষে হবে। আর যে ব্যক্তি এ সালাত কিছু কমতি করবে তা তার বিপক্ষে হবে মুক্তাদীদের পক্ষে হবে।’’
মুনযিরী বলেনঃ এ বর্ণনাটি তাদের কাছে ‘আবদুর রহমান বিন হারমালাহ্ আসলামী কর্তৃক আর তিনি আবূ ‘আলী আল মিসরী থেকে। আর হাদীস বিশারদ কর্তৃক ‘আবদুর রহমান এর এতটুকু সমালোচনা করা হয়েছে যে, তার হাদীস দলীল হিসেবে টিকবে না তবে পরীক্ষার জন্য লেখা যেতে পারে। আর এ হাদীসটি যাহাবী, মুনযিরী ও হাফিয এর কাছে সহীহ অথবা হাসান যা দলীলযোগ্য।
তারা ত্বহাবীর উক্তির প্রতি লক্ষ্য করেনি। ত্বহাবী বলেনঃ আবূ ‘আলী হামদানী থেকে ‘আবদুর রহমান বিন হারমালার হাদীস শ্রবণের বিষয় জানা যায়নি। বিষয়টি দৃষ্টি নিক্ষেপের দাবীদার। আর কিভাবে ত্বহাবীর উক্তির দিকে দৃষ্টি দেয়া হবে অথচ বায়হাক্বীর ৩য় খন্ডে ১২৭ পৃষ্ঠাতে ‘আবদুর রহমান বিন হারমালাহ্ (الإخبار) শব্দের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন, আমাকে আবূ ‘আলী হামদানী খবর দিয়েছেন।
(فَلَكُمْ) তোমাদের সালাতের সাওয়াব। হাফিয বলেনঃ ইমাম আহমাদ অনুরূপভাবে ইমাম বায়হাক্বী একটু বেশি বর্ণনা করেছেন তাতে আছে (ولهم) অর্থাৎ তোমাদের সালাতের সাওয়াব। হাদীসটিতে (ولهم) উল্লেখ না করে কৃতিমতা থেকে অমুখাপেক্ষী থাকা হয়েছে। যা মাজহারের উক্তির দিকে ইঙ্গিত করছে। মাজহারের উক্তি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (فَلَكُمْ) উক্তির উপর সীমাবদ্ধ থেকেছেন, কেননা সালাত সঠিকভাবে সম্পন্ন করার সাওয়াব উত্তম পুরুষ হতে নাম পুরুষের দিকে অতিক্রম করার বিষয়টি স্পষ্ট।
ক্বারী বলেন, (فَلَكُمْ) উল্লেখ করার দ্বারা (ولهم) বুঝা যাচ্ছে। একমতে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই হাদীসটি সঠিক সময়ে সালাত আদায় করতে ইমামের ভুল করণে প্রয়োগ করা হয়েছে। ইবনু বাত্ত্বাল এবং ত্বহাবী বলেনঃ এর অর্থ হল ইমামগণ যদি সঠিক সময়ে সালাত প্রতিষ্ঠা করে। এ ব্যাপারে তারা মারফূ‘ভাবে হাসান সূত্রে ‘আবদুল্লাহ বিন মাস্‘ঊদ থেকে ইমাম নাসায়ী ও অন্যান্যদের বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণ পেশ করেছেন। হাদীসটিতে আছে অচিরেই তোমরা এমন সম্প্রদায়সমূহ পাবে যারা সালাতের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া অন্য সময়ে সালাত অদায় করবে। সুতরাং তোমরা যদি তাদের নাগাল পাও তাহলে সালাতের সঠিক সময় হিসেবে তোমরা যা জান সে সময়ে তোমরা তোমাদের ঘরসমূহে সালাত আদায় করবে।
পুনরায় তোমরা তাদের সাথে সালাত আদায় করবে এবং তা নফল হিসেবে গণ্য করবে। বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে যা প্রতীয়মান হয় তা হল (أَصَابُوا) থেকে উদ্দেশ্য সঠিক সময়ে সালাত বর্জন অপেক্ষাও ব্যাপক। আহমাদের চতুর্থ খন্ডে ১৪৫ পৃষ্ঠাতে উল্লেখিত ‘উক্ববাহ্ বিন ‘আমির-এর হাদীস কর্তৃক এক বর্ণনাতে আছে, যে ব্যক্তি মানুষের ইমামতি করবে অতঃপর সঠিক সময়ে ও পূর্ণাঙ্গভাবে সালাত আদায় করবে তাহলে সে সালাত তার ও মুক্তাদীদের পক্ষে হবে তথা তাদের সকলের সাওয়াবের কারণ হবে।
পক্ষান্তরে যে ইমাম এ সালাত থেকে সামান্যতম ঘাটতি করবে তাহলে সে সালাত তার বিপক্ষে অবস্থান নিবে, মুক্তাদীদের বিপক্ষে নিবে না। আহমাদের আরেক বর্ণনাতেও চতুর্থ খন্ড ১৪৭ পৃষ্ঠাতে আছে অতঃপর তারা যদি সঠিক সময়ে সালাত প্রতিষ্ঠা করে, রুকূ‘ এবং সাজদাকে পূর্ণাঙ্গভাবে করে তাহলে তা তোমাদের মুক্তাদীদের ও তাদের তথা ইমামদের সকলের পক্ষে হবে। আর যদি তারা সালাত সঠিক সময়ে আদায় না করে থাকে এবং পূর্ণাঙ্গভাবে করে তাহলে তা তোমাদের মুক্তাদীদের ও তাদের তথা ইমামদের সকলের পক্ষে হবে। আর যদি তারা সালাত সঠিক সময়ে আদায় না করে থাকে এবং পূর্ণাঙ্গভাবে রুকূ' ও সিজদা্ (সিজদা/সেজদা) না করে থাকে তাহলে সে সালাত তোমাদের মুক্তাদীদের পক্ষে ও তাদের তথা ইমামদের বিপক্ষে হবে। প্রথম বর্ণনাটিকে ইমাম বায়হাক্বীও বর্ণনা করেছেন।
(وَإِنْ أَخْطَئُوا) তারা যদি তাদের সালাতে পাপে জড়িত হয় যেমন উযূ (ওযু/ওজু/অজু) বিহীন হওয়া। হাফিয বলেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনি হাদীসে উল্লেখিত (الخْطَأ) দ্বারা (المعمر) তথা ইচ্ছাকৃত ভুলের বিপরীত অনিচ্ছাকৃত ভুল উদ্দেশ্য করেননি। কেননা সে রকম অনিচ্ছাকৃত ভুলে কোন পাপ নেই।
(وَعَلَيْهِمْ) ভুলের শাস্তি ইমামের উপর বর্তাবে। সুতরাং ইমামের ভুল মুক্তাদীর সালাত বিশুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলবে না আর তা তখন যখন মুক্তাদী সঠিকভাবে সালাত আদায় করবে।
সুতরাং সালাতের পর যদি এমন কিছু প্রকাশ পায় যে, ইমাম জুনুবী, উযূ বিহীন, অথবা তার শরীরে অপবিত্রতা আছে তাহলে সে কারণে মুক্তাদীর ওপর সালাত দোহরানো আবশ্যক হবে না। ইমাম বাগাবী শারহুস্ সুন্নাতে বলেনঃ এ হাদীসে ঐ ব্যাপারে প্রমাণ রয়েছে যে, যখন কোন ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়কে নিয়ে উযূ (ওযু/ওজু/অজু) বিহীন অবস্থাতে সালাত আদায় করবে তখন তার পেছনে মুক্তাদীদের সালাত বিশুদ্ধ হবে তবে তাকে সালাত দোহরাতে হবে। এর উপর আরও প্রমাণ বহন করে মাজদুবনু তায়মিয়্যাহ্ মুনতাক্বাতে যা উল্লেখ করেছেন তা। তাতে ‘উমার (রাঃ) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে, নিশ্চয়ই তিনি মানুষকে নিয়ে সালাত আদায় করেছেন এমতাবস্থায় তিনি জুনুবী যা তিনি আগে জানতে পারেননি। পরে জানতে পেরে তিনি আদায় করা সালাত দোহরিয়েছেন, মুক্তাদীগণ দোহরায়নি। এমনিভাবে ‘উসমান (রাঃ) এবং ‘আলী (রাঃ) হতে তার উক্তি বর্ণনা করা হয়েছে। ইমাম শাফি‘ঈ এদিকেই গিয়েছেন।
তার মতে মুক্তাদী শুধু অনুকূল্যতার ক্ষেত্রে ইমামের অনুসারী। সালাত শুদ্ধ বা অশুদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে না। ইমাম মালিক ও আহমাদও এ ধরনের উক্তি করেছেন। রসূলের উক্তি (أَخْطَأوا) এর বাহ্যিক দিক ঐ কথার উপর প্রমাণ বহন করে যা ইমাম বাগবীর উল্লেখিত উক্তি অপেক্ষা ব্যাপক। যেমন রুকূ‘নসমূহে ভুল করা। যেমনিভাবে ক্বারী বলেছেন, তারা যদি সঠিকভাবে আদায় করে অর্থাৎ রুকন ও শর্তসমূহ থেকে তাদের ওপর যা আবশ্যক সবকিছু যদি তারা সঠিকভাবে আদায় করে এবং এগুলোর কোনটিতে যদি তারা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি করার মাধ্যমে ভুল করে।
এ হাদীসে ঐ ব্যাপারে প্রমাণ রয়েছে যে, যে ইমাম সালাতের রুকন এবং অন্যান্য বিষয় থেকে কোন কিছুতে ত্রুটি করার মাধ্যমে সালাত প্রতিষ্ঠা করবে তাতে মুক্তাদীর সালাত বিশুদ্ধ হবে তবে শর্ত হল যখন মুক্তাদী সালাত পূর্ণভাবে আদায় করবে। এ মতটি শাফি‘ঈর একমত এ শর্তে যে, ইমাম খলীফা বা তার স্থলাভিষিক্ত হতে হবে। তবে হানাফী মতাবলম্বী ইমাম ত্বহাবী ও অন্যান্যগণ ভুলকরণ বিষয়টিকে তারা সঠিক সময় সালাত আদায় না করার দিকে চাপিয়ে দিয়েছেন। যেমন ইতিপূর্বে গত হয়েছে।
কেননা তাদের কাছে মুক্তাদী সাধারণভাবে ইমামের অনুসারী অর্থাৎ সালাত বিশুদ্ধ হওয়া ও নষ্ট হওয়া সকল ক্ষেত্রে। সুতরাং তাদের মতে ইমাম সালাত আদায় করানোর পর যদি ইমামের স্মরণ আসে তিনি জুনুবী অথবা অযূবিহীন অবস্থায় সালাত আদায় করেছেন তাহলে ইমাম ও মুক্তাদী সকলের ওপর আদায় করা সালাত পুনরায় আদায় আবশ্যক। এ ব্যাপারে তারা রসূলের উক্তি (ইমাম দায়ী) দ্বারা প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। এর অর্থের ব্যাপারে আযান অধ্যায়ে আলোচনা অতিবাহিত হয়েছে।
তবে আমার নিকট প্রণিধানযোগ্য মাসআলাহ্ ওটা যেদিকে ইমাম শাফি‘ঈ ও তার অনুকূলে অন্যান্য ইমামগণ পক্ষাবলম্বন করেছেন। মুহাল্লাব বলেন, হাদীসটিতে ঐ ব্যাপারে প্রমাণ রয়েছে যে, যখন কোন নেতার তরফ থেকে বিপদের আশংকা করা হবে তখন নেতা পুণ্যবান বা পাপী যাই হোক না কেন তার পেছনে সালাত আদায় করা যাবে। হাদীসটি ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন। আহমাদও বর্ণনা করেছেন। বায়হাক্বী তার কিতাবে ৩য় খন্ডে ১২৭ পৃষ্ঠাতে। ইবনু হিব্বান তার সহীহ গ্রন্থে।
তার শব্দ হল অচিরেই আসবে অথবা হবে এমন সম্প্রদায় যারা সালাত আদায় করবে অতঃপর তারা যদি পূণাঙ্গভাবে সালাত আদায় করে তাহলে তা তাদের পক্ষে তথা তাদের সাওয়াবের কারণ হবে আর যদি তারা সালাতে ঘাটতি করে তাহলে তা তাদের বিপক্ষে যাবে ও তোমাদের পক্ষে হবে।