কুরআনই একমাত্র ইলাহী গ্রন্থ, যার বাহক ও প্রচারক মাত্র একজন। যিনি হ’লেন শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম। মানছূরপুরী বলেন, অথচ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ-এর পেশকারী ঋষিদের সংখ্যা শতাধিক এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে সময়ের ব্যবধান শতাধিক বছরের। বাইবেলের অবস্থাও তথৈবচ। এ কিতাবের পেশকারী হিসাবে তিনি ত্রিশজনের নামের তালিকা দিয়েছেন। যাদের মধ্যে হযরত মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, যাকারিয়া (আঃ) প্রমুখ আম্বিয়ায়ে কেরাম ছাড়াও রয়েছে অন্যান্যদের নাম। যারা যুগে যুগে বাইবেল পেশ করেছেন। অথচ কোনটার সাথে কোনটার পুরোপুরি মিল নেই। এমনকি হযরত মূসা (আঃ) যে দশটি ফলকে (عَشَرَةُ أَلْوَاحٍ) লিখিত তওরাত নিয়ে এসেছিলেন, তার উম্মত তাতে প্রথমেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল (বাক্বারাহ ২/৫৫-৫৬, ৯৩)। অনুরূপভাবে ইনজীলের অবস্থা। সেখানে হযরত ঈসা (আঃ)-এর শাগরিদদের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ পাওয়া যায়। যার কোনটির সঙ্গে কোনটির পুরোপুরি মিল নেই। বরং প্রায় সবটাই কথিত সেন্ট (Saint) তথা সাধুদের কপোলকল্পিত। যাকে আল্লাহর কেতাব বলে চালানো হচ্ছে। যেদিকে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইঙ্গিত করেছেন (বাক্বারাহ ২/৭৯)।
উল্লেখ্য যে, মসীহ ঈসা নিজের জন্য ১২ জন শাগরিদ বাছাই করেছিলেন, যারা বনু ইস্রাঈলের বারোটি গোত্রের সামনে তাঁর দ্বীনের প্রচার করবে। কিন্তু এতবড় একজন কামেল উস্তাদের সঙ্গে থেকেও তারা এমন অযোগ্য প্রমাণিত হন যে, মসীহকে তাদের উদ্দেশ্যে একাধিকবার একথা বলতে হয়েছিল যে, তোমাদের মধ্যে এক সরিষাদানা পরিমাণ ঈমান থাকলেও তোমরা এরূপ করতে পারতে না’। মসীহ তাদেরকে বারবার তিরষ্কার করতেন এজন্য যে, তাঁর সঙ্গে জেগে থেকেও তারা কখনো দো‘আ-ইস্তেগফারে শরীক হ’ত না। মসীহের আসমানে উঠে যাবার পর উক্ত বারো জন শাগরিদের মধ্যে আক্বীদা ও আমলগত বিষয়ে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। যেমন (১) শরী‘আতের (তাওরাতের) বিধান সমূহ মান্য করা যরূরী কি-না (২) অন্য জাতির নিকটে ঈসায়ী ধর্মের প্রচার সিদ্ধ হবে কি-না (৩) খাৎনা করা কেবল ইসরাঈলীদের জন্য না ঈসায়ী ধর্মে আগত সকলের জন্য আবশ্যক ইত্যাদি। এরপর তাদের মধ্যে আল্লাহ, মারিয়াম ও ঈসার নামে ত্রিত্ববাদের প্রসার ঘটে। যাতে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। ঈসা (আঃ) ৩০ বছর বয়সে দাওয়াত শুরু করেন এবং ৩৩ বছর বয়সে তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। তিন বছরে মাত্র ১২ জন শাগরিদ হয়। যার মধ্যে একজন গাদ্দার প্রমাণিত হয়। অবশ্য ‘কিতাবুল আ‘মাল-এর লেখক সাধু লূক-এর মতে তাঁর সমর্থকের সংখ্যা ছিল ১২৪ জন।[1]
পক্ষান্তরে কুরআন শুরু হয়েছে যাঁর মাধ্যমে, শেষও হয়েছে তাঁর মাধ্যমে। এর একটি শব্দ ও বর্ণেও অন্য কোন ব্যক্তি যুক্ত নন। কুরআন বুঝার জন্য অন্য কোন সহায়ক কুরআনও নাযিল হয়নি। যেমন হিন্দুদের ঋগ্বেদ বুঝতে গেলে সাম বেদ, অথবর্ব বেদ ইত্যাদির মুখাপেক্ষী হ’তে হয়। অনুরূপভাবে ইহূদী-খৃষ্টানদের নিউ টেষ্টামেন্ট পূর্ণতা পায় না ওল্ড টেষ্টামেন্ট ব্যতীত। আবার চারটি ইনজীল (أَنَاجِيلُ أَرْبعَة) অপূর্ণ থাকে সেন্ট লূক-এর কিতাবুল আ‘মাল ব্যতীত। অথচ কুরআন নিজেই সবকিছুর ব্যাখ্যা تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ (নাহল ১৬/৮৯)। এরপরেও প্রয়োজনীয় ও বিস্তৃত ব্যাখ্যার জন্য কুরআনের বাহক রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ সমূহ মওজুদ রয়েছে। যা আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট (নাজম ৫৩/৩-৪; ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৯)।
উল্লেখ্য যে, হিন্দুরা চারটি বেদ-এর কথা বললেও মনু তিনটি বেদ-এর কথা বলেন, যাতে অথবর্ব বেদ নেই। সংস্কৃতের কোন কোন প্রাচীন গ্রন্থে প্রায় ৩২টি বইয়ের উপরে বেদ-এর নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া সাধারণ হিন্দুরা বেদকে ‘ঈশ্বরের বাণী’ মনে করলেও তাদের বহু বিদ্বান একে ‘মানুষের কথা’ বলে থাকেন এবং প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক বর্তমান বেদ-কে আসল বেদ মনে করেন না।[2] পক্ষান্তরে কুরআনের অনুসারী হৌন বা না হৌন সকলেই কুরআনকে আল্লাহর কালাম এবং তাকে অবিকৃত বলে বিশ্বাস করে থাকেন।
[2]. মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/২৭৪-৭৫।