যাকাতুল ফিৎর হিসাবে কি পরিমাণ খাদ্যশস্য দিতে হবে তার স্পষ্ট বর্ণনা হাদীছে এসেছে,
فَرَضَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ، أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ عَلَى الْعَبْدِ وَالْحُرِّ، وَالذَّكَرِ وَالأُنْثَى، وَالصَّغِيْرِ وَالْكَبِيْرِ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ-
অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকাতুল ফিৎর হিসাবে মুসলমানদের ছোট-বড়, পুরুষ-নারী এবং স্বাধীন-দাস প্রত্যেকের উপর এক ছা‘ খেজুর অথবা এক ছা‘ যব ফরয করেছেন।[1]
অতএব প্রত্যেক মুসলিমকে যাকাতুল ফিৎর হিসাবে এক ছা‘ খাদ্যশস্য প্রদান করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে অর্ধ ছা‘ ফিৎরা প্রদানের যে প্রচলন রয়েছে তা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। সর্বপ্রথম মু‘আবিয়া (রাঃ) কোন এক প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র গমের ক্ষেত্রে অর্ধ ছা‘ ফিৎরা আদায়ের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। আর এটা ছিল মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর ইজতিহাদ যা আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) সহ অন্যান্য ছাহাবায়ে কেরাম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। হাদীছটি নিম্নরূপ-
عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِىِّ قَالَ كُنَّا نُخْرِجُ إِذْ كَانَ فِيْنَا رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم زَكَاةَ الْفِطْرِ عَنْ كُلِّ صَغِيْرٍ وَكَبِيْرٍ حُرٍّ أَوْ مَمْلُوْكٍ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ أَوْ صَاعًا مِنْ أَقِطٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيْبٍ فَلَمْ نَزَلْ نُخْرِجُهُ حَتَّى قَدِمَ عَلَيْنَا مُعَاوِيَةُ بْنُ أَبِيْ سُفْيَانَ حَاجًّا أَوْ مُعْتَمِرًا فَكَلَّمَ النَّاسَ عَلَى الْمِنْبَرِ فَكَانَ فِيْمَا كَلَّمَ بِهِ النَّاسَ أَنْ قَالَ إِنِّيْ أُرَى أَنَّ مُدَّيْنِ مِنْ سَمْرَاءِ الشَّامِ تَعْدِلُ صَاعًا مِنْ تَمْرٍ فَأَخَذَ النَّاسُ بِذَلِكَ. قَالَ أَبُوْ سَعِيْدٍ فَأَمَّا أَنَا فَلاَ أَزَالُ أُخْرِجُهُ كَمَا كُنْتُ أُخْرِجُهُ أَبَدًا مَا عِشْتُ-
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় প্রত্যেক ছোট-বড়, স্বাধীন-দাস এক ছা‘ করে খাদ্যবস্ত্ত অথবা এক ছা‘ পনির অথবা এক ছা‘ যব অথবা এক ছা‘ খেজুর অথবা এক ছা‘ কিশমিশ ‘যাকাতুল ফিৎর’ হিসাবে আদায় করতাম। আমরা এরূপভাবেই (যাকাতুল ফিৎর) বের করতাম। এমন সময় মু‘আবিয়া ইবনু আবূ সুফিয়ান (রাঃ) হজ্জ বা ওমরাহ উপলক্ষে মদ্বীনায় এলেন। (তাঁর সঙ্গে সিরিয়ার গমও এল)। তিনি মসজিদের মিম্বরে দাঁড়িয়ে জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমি মনে করি সিরিয়ার দুই মুদ (অর্ধ ছা‘) গম (মূল্যের দিক দিয়ে) মদ্বীনার এক ছা‘ খেজুরের সমতুল্য। অতঃপর লোকজন তা গ্রহণ করল। তখন আবুসাঈদ খুদরী (রাঃ) বললেন, ‘আমি যতদিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকব ততদিন তা (অর্ধ ছা‘ গমের ফিৎরা) কখনোই আদায় করব না। বরং (রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায়) আমি যা দিতাম তাই-ই দিয়ে যাব’।[2]
একদা আবুসাঈদ খুদরী (রাঃ) যাকাতুল ফিৎর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
لاَ أُخْرِجُ إِلاَّ مَا كُنْتُ أُخْرِجُ فِيْ عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه و سلم صَاعَ تَمْرٍ أَوْ صَاعَ شَعِيْرٍ أَوْ صَاعَ أَقِطٍ فَقَالَ لَهُ رَجُلٌ مِنَ القَوْمِ : لَوْ مُدَّيْنِ مِنْ قَمْحٍ؟ فَقَالَ : لاَ تِلْكَ قِيْمَةُ مُعَاوِيَةَ لاَ أَقْبَلُهَا وَلاَ أَعْمَلُ بِهَا-
অর্থাৎ আমি রাসূল (ছাঃ)-এর যামানায় যেমন এক ছা‘ খেজুর অথবা এক ছা‘ যব অথবা এক ছা‘ পনির হতে যাকাতুল ফিৎর বের করতাম, কখনোই এর ব্যতিক্রম বের করব না। তখন গোত্রের কোন এক ব্যক্তি বললেন, যদি অর্ধ ছা‘ গম দ্বারা হয়? তিনি বললেন, না; এটা মু‘আবিয়া (রাঃ) কর্তৃক নির্ধারিত মূল্য। আমি তা মানব না এবং তার উপর আমলও করব না।[3]
বুখারীর ভাষ্যকার হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন,
فِيْ حَدِيْثِ أَبِيْ سَعِيْدٍ مَا كَانَ عَلَيْهِ مِنْ شِدَّةِ الِاتِّبَاعِ وَالتَّمَسُّكِ بِالْآثَارِ وَتَرْكِ الْعُدُوْلِ إِلَى الِاجْتِهَادِ مَعَ وُجُوْدِ النَّصِّ وَفِيْ صَنِيْعِ مُعَاوِيَةَ وَمُوَافَقَةِ النَّاسِ لَهُ دَلَالَةٌ عَلَى جَوَازِ الِاجْتِهَادِ وَهُوَ مَحْمُوْدٌ لَكِنَّهُ مَعَ وُجُوْدِ النَّصِّ فَاسد الإِعْتِبَارِ-
অর্থাৎ উল্লিখিত হাদীছে নাছ বা দলীলের উপস্থিতিতে ইজতিহাদ বর্জন করার মাধ্যমে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর হাদীছ ধারণের দৃঢ়তা ও পূর্ণ ইত্তিবা প্রমাণিত হয়। আর মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর ইজতিহাদ এবং মানুষের তা গ্রহণ করার মাধ্যমে ইজতিহাদ জায়েয হওয়া প্রমাণ করে যা প্রশংসনীয়। কিন্তু যেখানে দলীল উপস্থিত সেখানে ইজতিহাদ অগ্রহণীয়।[4]
মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম মুহিউদ্দ্বীন নববী (৬৩১-৬৭৬ হিঃ) বলেন,
وَلَيْسَ لِلْقَائِلَيْنِ بِنِصْفِ صَاع حُجَّة إِلَّا حَدِيْثَ مُعَاوِيَةَ-
‘যারা অর্ধ ছা‘ গমের কথা বলেন, তাদের মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর এই হাদীছ ব্যতীত কোন দলীল নেই।[5]
অতএব স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, অর্ধ ছা‘ গম দ্বারা ফিৎরা আদায় করা মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নিজস্ব রায় মাত্র, রাসূল (ছাঃ)-এর উক্তি নয়। যাকে আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) সহ অন্যান্য ছাহাবায়ে কেরাম প্রত্যাখ্যান করে রাসূল (ছাঃ)-এর উক্তি ও আমল এক ছা‘ খাদ্যবস্ত্ত দ্বারা ফিৎরা আদায়ের উপর অটল ছিলেন। কেননা দলীল মওজূদ থাকতে ‘ইজতিহাদ’ বাতিল বলে গণ্য হয়। তাছাড়া হাদীছে যেসব খাদ্যদ্রব্যের নাম এসেছে তার সবগুলির মূল্য এক ছিল না। বরং মূল্যে পার্থক্য ছিল। তা সত্ত্বেও সকল খাদ্যদ্রব্য থেকে এক ছা‘ করে যাকাতুল ফিৎর আদায় করতে বলা হয়েছে। এতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খাদ্যদ্রব্যের মূল্যের প্রতি দৃকপাত না করে তার পরিমাণ বা ওযনকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বিপরীতে স্বয়ং রাষ্ট্রীয় আমীরের হুকুমকে ছাহাবায়ে কেরাম অগ্রাহ্য করেছেন শুধুমাত্র হাদীছের সার্বভৌম অধিকারকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। অনুরূপভাবে আমাদেরও উচিৎ হবে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সার্বভৌম অধিকারকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাথা পিছু এক ছা‘ ফিৎরা আদায় করা।
[2]. বুখারী হা/১৫০৮; মুসলিম হা/৯৮৫।
[3]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/২৪১৯; মুস্তাদরাক হাকেম হা/১৪৯৫; আল-আ‘যামী, সনদ হাসান।
[4]. ফাতহুল বারী ৩/৩৭৪ পৃঃ, ১৫০৮ নং হাদীছের ব্যাখ্যা।
[5]. শারহু মুসলিম, ইমাম নববী (রহঃ) ৩/৪৪৭ পৃঃ, ৩৮৪ নং হাদীছের ব্যাখ্যা।