(দুই) শুধু জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া যাবে না। অনেক শীর্ষ বিদ্বান এই দাবী করেছেন। শায়খ আলবানী (রহঃ) জেহরী ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়ার বিষয়টিকে ‘মানসূখ’ বলেছেন।[1] সেই সাথে অনেক আছারকেও বিশুদ্ধ বলেছেন।[2] দলীল হিসাবে নিম্নের হাদীছ পেশ করা হয়েছে।
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা জেহরী ছালাতের সালাম ফিরিয়ে বললেন, এই মাত্র আমার সাথে তোমাদের কেউ ক্বিরাআত পড়ল কি? জনৈক ব্যক্তি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি পড়েছি। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের সাথে কুরআন নিয়ে ঝগড়া করতে চাই না। উক্ত কথা শুনার পর লোকেরা জেহরী ছালাতে ক্বিরাআত পড়া হতে বিরত থাকল।[3] আরেকটি হাদীছ পেশ করা হয়-
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّمَا جُعِلَ الْإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوْا وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوْا.
আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ইমাম নির্ধারণ করা হয় তার অনুসরণ করার জন্য। সুতরাং যখন তিনি তাকবীর দিবেন, তখন তোমরা তাকবীর দাও আর যখন তিনি ক্বিরাআত পড়েন তখন চুপ থাক।[4]
عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ أَنَّهُ سَأَلَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ عَنِ الْقِرَاءَةِ مَعَ الإِمَامِ فَقَالَ لاَ قِرَاءَةَ مَعَ الإِمَامِ فِىْ شَىْءٍ وَزَعَمَ أَنَّهُ قَرَأَ عَلَى رَسُوْلِ اللهِ (وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى) فَلَمْ يَسْجُدْ.
আত্বা ইবনু ইয়াসার একদা যায়েদ ইবনু ছাবেত (রাঃ)-কে ইমামের সাথে ক্বিরাআত পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, কোন কিছুতে ইমামের সাথে ক্বিরাআত নেই। রাবী ধারণা করেন যে, তিনি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট সূরা নাজম পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি সিজদা করেননি।[5]
পর্যালোচনা : (ক) উক্ত দলীলগুলোর প্রথমটিতে এসেছে, ‘লোকেরা ক্বিরাআত পড়া বন্ধ করে দিল’। উক্ত অংশ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম বুখারী প্রতিবাদ করেছেন যে, উক্ত অংশ যুহরীর পক্ষ থেকে সংযোজিত।[6] ইবনু হাজার আসক্বালানীও একই মত ব্যক্ত করেছেন।[7] যা আমরা যঈফ হাদীছের ধারাবাহিকতায় প্রথমে উল্লেখ করেছি। সুতরাং যে বর্ণনা নিয়ে শুরু থেকেই মতানৈক্য রয়েছে, তাকে শক্তিশালী দলীল হিসাবে কিভাবে গ্রহণ করা যাবে?
(খ) দ্বিতীয় হাদীছে বলা হয়েছে, ‘যখন ক্বিরাআত করবেন তখন তোমরা চুপ থাক’। এই অংশটুকু নিয়েও মুহাদ্দিছগণের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম আবুদাঊদ হাদীছটি দুই স্থানে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু উভয় স্থানেই প্রতিবাদ করেছেন।[8] যদিও ইমাম মুসলিম ছহীহ বলেছেন।[9] তবে মতবিরোধ আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এছাড়া ‘ইমামের ক্বিরাআত মুক্তাদীর ক্বিরাআত’ এই বর্ণনাটিও পেশ করা হয়। যদিও মুহাদ্দিছগণের প্রায় সকলেই যঈফ বলেছেন।[10]
(গ) উক্ত হাদীছগুলো ত্রুটিমুক্ত হিসাবে গ্রহণ করে যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন্ ক্বিরাআত পড়ার সময় চুপ থাকতে হবে? ছালাতে কোন্ ক্বিরাআত পাঠ করা সমস্যা? রাসূল (ছাঃ) যে ক্বিরাআতের প্রতিবাদ করেছিলেন, তা কি সূরা ফাতিহা ছিল, না অন্য সূরা ছিল? উক্ত হাদীছে তা উল্লেখ নেই। এর জবাব কী হবে। এরপর আরেকটি বিষয় হল, শুধু কি জেহরী ছালাতে ক্বিরাআত পড়লেই সমস্যা হয়, না সের্রী ছালাতেও সমস্যা হয়? নিম্নের হাদীছটি কী সাক্ষ্য দেয়?
عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ أَنَّ النَّبِىَّ صَلَّى الظُّهْرَ فَجَاءَ رَجُلٌ فَقَرَأَ خَلْفَهُ ( سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى) فَلَمَّا فَرَغَ قَالَ أَيُّكُمْ قَرَأَ قَالُوْا رَجُلٌ قَالَ قَدْ عَرَفْتُ أَنَّ بَعْضَكُمْ خَالَجَنِيْهَا.
ইমরান ইবনু হুছাইন (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) একদা যোহরের ছালাত আদায় করছিলেন। এমতাবস্থায় জনৈক ব্যক্তি এসে তার পিছনে সূরা আ‘লা পাঠ করল। যখন তিনি ছালাত শেষ করলেন তখন বললেন, তোমাদের কে তেলাওয়াত করল? তারা বলল, অমুক ব্যক্তি। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমি বুঝতে পারলাম, তোমাদের কেউ আমাকে এর দ্বারা বিরক্ত করল।[11]
সুধী পাঠক! ক্বিরাআত পড়া যদি সমস্যা হয় তবে নীরবে পঠিত ছালাতেও সমস্যা হতে পারে। তখন যোহর ও আছরেও সূরা ফাতিহা পড়া যাবে না। কারণ উক্ত ছালাত যোহরের ছালাত ছিল। অথচ যোহর ও আছর ছালাতে ছাহাবায়ে কেরাম সূরা ফাতিহা তো পড়তেনই ইমামের পিছনে অন্য সূরাও পাঠ করতেন।[12] মূল কথা তো এটাই যে, মুক্তাদীর সরবে ক্বিরাআত জেহরী ছালাতের জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি সের্রী ছালাতের জন্যও ক্ষতিকর। কিন্তু চুপে চুপে পড়লে কোন সমস্যা নেই। দ্বিতীয়তঃ উক্ত ছাহাবী নিঃসন্দেহে সূরা ফাতিহা না পড়ে সূরা আ‘লা পড়েননি। তাহলে হাদীছে সূরা ফাতিহার কথা উল্লেখ না করে শুধু সূরা আ‘লা পড়াকে দোষারোপ করা হল কেন? সুতরাং বুঝা যাচ্ছে যে, সূরা ফাতিহা পড়ায় কোন দোষ নেই। তাই ক্বিরাআত বলতে যে সূরা ফাতিহা নয় তা পরিষ্কার। বরং অন্য সূরা পাঠ করা নিষেধ।
তাছাড়া যায়েদ ইবনু ছাবেত (রাঃ) থেকে যে আছার বর্ণিত হয়েছে, সেখান থেকেও ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ক্বিরাআত বলতে সূরা ফাতিহা নয়। যেমন ইমাম নববী বলেন, ‘যায়েদের কথাই প্রমাণ বহন করে যে, সেটা সূরা ফাতিহার পরের সূরা যা জেহরী ছালাতে পড়া হয়’।[13] তাছাড়া নিম্নের হাদীছটিও প্রমাণ করে যে, জেহরী ছালাতেও সূরা ফাতিহা পড়া যাবে।
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ كُنَّا نَقْرَأُ فِى الظُّهْرِ وَالْعَصْرِ خَلْفَ الإِمَامِ فِى الرَّكْعَتَيْنِ الأُولَيَيْنِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَسُورَةٍ وَفِى الأُخْرَيَيْنِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ.
জাবের ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমরা যোহর ও আছর ছালাতে প্রথম দুই রাক‘আতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা ও অন্য একটি সূরা পাঠ করতাম। আর পরের দুই রাক‘আতে শুধু সূরা ফাতিহা পাঠ করতাম।[14] নিঃসন্দেহে উক্ত হাদীছটির মুখ্য বিষয় হল, ইমামের পিছনে অন্য সূরা পাঠ করা। অর্থাৎ জেহরী ছালাতে শুধু সূরা ফাতিহা পড়া হত। তবে যোহর ও আছর ছালাতে অন্য সূরাও পড়া হত।
[2]. দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ হা/৯৯২।
[3]. আবুদাঊদ হা/৮২৬, ১/১২০ পৃঃ; তিরমিযী হা/৩১২, ১/৭১ পৃঃ; নাসাঈ হা/৯১৯।
[4]. আবুদাঊদ হা/৬০৪, ১/৮৯ পৃঃ, ও হা/৯৭৩, ১/১৪০ পৃঃ; নাসাঈ হা/৯২১-৯২২; মিশকাত হা/৮২৭ ও ৮৫৭।
[5]. ছহীহ মুসলিম হা/১৩২৬, ১/২১৫ পৃঃ, ‘মসজিদ সমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২১।
[6]. বুখারী, আল-ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম হা/৬৮, পৃঃ ৭১; তানক্বীহ, পৃঃ ২৮৮।
[7]. ঐ, তালখীছুল হাবীর, ১/২৪৬।
[8]. আবুদাঊদ হা/৬০৪, ১/৮৯ পৃঃ, ও হা/৯৭৩, ১/১৪০ পৃঃ- قَالَ أَبُو دَاوُدَ وَهَذِهِ الزِّيَادَةُ «وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا» لَيْسَتْ بِمَحْفُوظَةٍ الْوَهَمُ عِنْدَنَا مِنْ أَبِى خَالِدٍ।
[9]. মুসলিম হা/৯৩২।
[10]. ইবনু মাজাহ হা/৮৫০; ফাৎহুল বারী হা/৭৫৬-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ, ২/২৮৩ পৃঃ। ইমাম বুখারী বলেন, هذا خبر لم يثبت عند أهل العلم من أهل الحجاز وأهل العراق وغيرهم لإرساله وانقطاعه -জুযউল ক্বিরাআত, পৃঃ ২০।
[11]. আবুদাঊদ হা/৮২৮, ১/১২০ পৃঃ, সনদ ছহীহ; বায়হাক্বী, ক্বিরাআতু খালফাল ইমাম; ইরওয়া হা/৩৩২-এর আলোচনা দ্রঃ।
[12]. ইবনু মাজাহ হা/৮৪৩, পৃঃ ৬১; সনদ ছহীহ, আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/৫০৬।
[13]. ছহীহ মুসলিম শরহে নববীসহ হা/১৩২৬-এর আলোচনা দ্রঃ ১/২১৫-ان قول زيد محمول على قراءة السورة التي بعد الفاتحة في الصلاة الجهرية فان المأموم لا يشرع له قراءتها وهذا التأويل متعين।
[14]. ইবনু মাজাহ হা/৮৪৩, পৃঃ ৬১; সনদ ছহীহ, আলবানী, ইরওয়াউল গালীল হা/৫০৬।