(২) ফযীলতের আশায় মাথায় পাগড়ী বাঁধা :
ফযীলত মনে করে ছালাতের সময় পাগড়ী বাঁধার কোন ছহীহ হাদীছ নেই। এর পক্ষে যে সমস্ত বর্ণনা প্রচলিত আছে, সেগুলো সবই জাল।
(أ) عَنْ جَابِرٍ عَنِ النَّبِىِّ قَالَ رَكْعَتَانِ بِعِمَامَةٍ خَيْرٌ مِنْ سَبْعِيْنَ رَكْعَةً بِغَيْرِ عِمَامَةٍ.
(ক) জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত, নবী (ছাঃ) বলেন, পাগড়ী পরে দুই রাক‘আত ছালাত পড়া পাগড়ী বিহীন সত্তর রাক‘আত ছালাত পড়ার চেয়েও উত্তম।[1]
তাহকবীক্ব : বর্ণনাটি জাল। এর সনদে আহমাদ ইবনু ছালেহ নামে একজন মিথ্যুক রাবী আছে। সে হাদীছ জাল করত।[2]
(ب) عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ الصَّلاَةُ فِى الْعِمَامَةِ تَعْدِلُ بِعَشْرَةِ آلاَفِ حَسَنَةٍ.
(খ) আনাস (রাঃ) বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, পাগড়ী পরে ছালাত আদায় করা দশ হাযার নেকীর সমপরিমাণ।[3]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। উক্ত বর্ণনার সনদে আবান ও ইবনু আর্রাক নামে দুইজন মিথ্যুক রাবী আছে।[4]
(ج) عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلاَةٌ بِعِمَامَةٍ تَعْدِلُ خَمْسًا وَّعِشْرِيْنَ صَلاَةً بِغَيْرِ عِمَامَةٍ وَجُمُعُةً بِعِمَامَةٍ تَعْدِلُ سَبْعِيْنَ جُمُعَةً بِغَيْرِ عِمَامَةٍ إِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَيَشْهَدُوْنَ الْجُمُعَةَ مُعْتَمِّيْنَ وَلاَ يَزَالُوْنَ يُصَلُّوْنَ عَلَى أَصْحَابِِ الْعَمَائِمِ حَتَّى تَغْرُبَ الشَّمْسُ.
(গ) ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, পাগড়ী পরে ছালাত আদায় করা পাগড়ী বিহীন পঁচিশ ওয়াক্ত ছালাত আদায়ের সমান, পাগড়ী পরে এক জুম‘আ আদায় করা সত্তর জুম‘আ আদায়ের সমান। জুম‘আর দিনে ফেরেশতাগণ পাগড়ী পরিহিত ব্যক্তিদের নিকট উপস্থিত হন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত তাদের জন্য দু‘আ করেন।[5]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। এর সনদে আব্বাস ইবনু কাছীর নামে মিথ্যুক রাবী আছে।[6] ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, বর্ণনাটি জাল।[7]
(د) عَنْ أَنَسٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ إِنَّ ِللهِ مَلاَئِكَةً مُوَكِّلِيْنَ بِأَبْوَابِ الْجَوَامِعِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ يَسْتَغْفِرُوْنَ لِأَصْحَابِ الْعَمَائِمِ الْبِيْضِ.
(ঘ) আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর এমন কিছু ফেরেশতা আছেন, যারা জুম‘আর দিনে জামে মসজিদের দরজায় নিযুক্ত থাকেন। তারা সাদা পাগড়ী পরিহিত ব্যক্তিদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।[8]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল।[9] এর সনদে ইয়াহ্ইয়া বিন শাবীব নামে মিথ্যুক রাবী আছে।
(ه) عَنْ أَبِى الدَّرْدَاءِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلاَئِكَتَهُ يُصَلُّوْنَ عَلَى أَصْحَابِ الْعَمَائِمِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ.
(ঙ) আবু দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা ও ফেরেশতামন্ডলী জুম‘আর দিনে পাগড়ী পরিহিত ব্যক্তিদের উপর রহমত বর্ষণ করেন।[10]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল বা মিথ্যা। উক্ত বর্ণনার সনদে আইয়ূব ইবনু মুদরাক নামে মিথ্যুক রাবী রয়েছে।[11]
(و) عَنْ طَلْحَةَ بْنِ يَزِيْدَ بْنِ رُكاَنَةَ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّهِ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله لاَ تَزَالُ أُمَّتِىْ عَلَى الْفِطْرَةِ مَا لَبِسُوا الْعَمَائِمَ عَلَى الْقَلاَنِسِ.
(চ) তবালহা বিন ইয়াযীদ বিন রুকানা তার পিতা হতে দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আমার উম্মত ততদিন ফিৎরাতের উপর থাকবে, যত দিন তারা টুপির উপর পাগড়ী পরবে।[12]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি জাল। এর সনদে মুহাম্মাদ বিন ইউনুস আল-কুদাইমী নামে একজন মিথ্যুক রাবী আছে। এছাড়া আরো দুইজন রাবী দুর্বল রয়েছে।[13]
(ز) عَنْ رُكَانَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله اَلْعِمَامَةُ عَلَى الْقَلَنْسُوَةِ فَصْلُ مَا بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْمُشْرِكِِيْنَ يُعْطَى يَوَمَ الْقِيَامَةِ بِكُلِّ كَوْرَةٍ يَدُوْرُهَا عَلَى رَأْسِهِ نُوْرًا.
(ছ) রুকানা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, টুপির উপর পাগড়ী পরিধান করা মুসলিম ও মুশরিকদের মাঝে পার্থক্য। ক্বিয়ামতের দিন পাগড়ীর প্রত্যেক পাক তার মাথার উপর জ্যোতি স্বরূপ ঘুরবে।[14]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি বাতিল।[15]
(ح) عَنْ رُكَانَةَ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ يَقُوْلُ إِنَّ فَرْقَ مَا بَيْنَنَا وَبَيْنَ الْمُشْرِكِيْنَ الْعَمَائِمُ عَلَى الْقَلَانِسِ.
(জ) রুকানা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, আমাদের ও মুশরিকদের মাঝের পার্থক্য হল- টুপির উপর পাগড়ী পরিধান করা।[16]
তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। ইমাম তিরমিযী বলেন, حَدِيْثٌ غَرِيْبٌ وَإِسْنَادُهُ لَيْسَ بِالْقَائِمِ وَلاَ نَعْرِفُ أَبَا الْحَسَنِ الْعَسْقَلاَنِىَّ وَلاَ ابْنَ رُكَانَةَ ‘এই হাদীছ দুর্বল। এর সনদ ভিত্তিশীল নয়। আমরা আবুল হাসান আসক্বালানীকেও চিনি না এবং ইবনু রুকানাকেও চিনি না। ইমাম মিযযী বলেন, এর সনদে আবু জা‘ফর নামে একজন অপরিচিত রাবী আছে।[17]
(ط) عَنْ عَلِىٍّ عَنِ النّبِىِّ قَالَ إِنَّ اللهَ عَزَّ وَ جَلَّ أَمَدَّنِىْ يَوْمَ بَدْرٍ وَحُنَيْنٍ بِمَلاَئِكَةٍ يَعْتَمُّوْنَ هَذِهِ الِعَمَّةِ إِنَّ الْعِمَامَةَ حَاجِزَةٌ بَيْنَ الْكُفْرِ وَالْإِيْمَانِ.
(ঝ) আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, নিশ্চয় মহান আল্লাহ আমাকে বদর ও হুনাইনের যুদ্ধের দিন ঐ সমস্ত ফেরেশতা দ্বারা সাহায্য করেছেন, যারা পাগড়ী পরিহিত অবস্থায় ছিলেন। নিশ্চয় এই পাগড়ী কুফর ও ঈমানের মাঝের প্রাচীর।[18]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি নিতান্তই যঈফ। এর সনদে আশ‘আছ বিন সাঈদ এবং আব্দুল্লাহ বিন বুসর নামে দুইজন ত্রুটিপূর্ণ রাবী আছে।[19]
(ى) مَنِ اعْتَمَّ فَلَهُ بِكُلِّ كَوْرَةٍ حَسَنَةٌ فَإِذَا حَطَّ فَلَهُ بِكُلِّ حِطَّةٍ حِطَّةٌ خَطِيْئَةٌ.
(ঞ) যে ব্যক্তি পাগড়ী পরিধান করবে, তার প্রত্যেক পাকে একটি করে নেকী হবে। আর যে পাক কম করে দিবে তার জন্য কমিয়ে দেয়া প্রত্যেক পাকে পাপ হবে।[20]
তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল।[21] উল্লেখ্য যে, উক্ত মর্মে আরো অনেক জাল হাদীছ প্রচলিত আছে।[22]
সুধী পাঠক! উক্ত জাল বর্ণনাগুলোর কারণেই আজ সমাজে পাগড়ী প্রথা চালু আছে। মিথ্যা ফযীলতের ধোঁকায় পড়ে অসংখ্য মানুষ লম্বা লম্বা পাগড়ী পরাকে অধিক গুরুত্ব দেয়। সচেতন ব্যক্তিদেরকে এই প্রতারণা থেকে সাবধান থাকতে হবে। উল্লেখ যে, উক্ত ফযীলতের আশা না করে কেউ চাইলে মাথায় পাগড়ী বা রূমাল ব্যবহার করতে পারে।[23] তবে তা শুধু ছালাতের সাথে সম্পৃক্ত নয়।
[2]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৬৯৯, ১২/৪৪৬ পৃঃ ।
[3]. সিলসিলা যঈফাহ হা/১২৯।
[4]. সিলসিলা যঈফাহ হা/১২৯।
[5]. সিলসিলা যঈফাহ হা/১২৭, ১/২৪৯ পৃঃ।
[6]. সিলসিলা যঈফাহ হা/১২৭-এর আলোচনা দ্রঃ।
[7]. লিসানুল মীযান ৩/২৪৪ পৃঃ- هذا حديث موضوع।
[8]. সুয়ূত্বী, আল-ফাতাওয়া ১/৫৮ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৯৫।
[9]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৩৯৫-এর আলোচনা দ্রঃ।
[10]. আবু নু‘আইম, আল-হিলইয়া ৫/১৮৯-১৯০ পৃঃ; ত্বাবারাণী, আল-কাবীর, সিলসিলা যঈফাহ হা/১৫৯।
[11]. ইবনুল জাওযী, কিতাবুল মাওযূ‘আত ২/১০৫ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/১৫৯।
[12]. দায়লামী ৩/১৭৫ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৭২।
[13]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৭২-এর আলোচনা দ্রঃ।
[14]. বাওয়ারদী, সিলসিলা যঈফাহ হা/১২১৭।
[15]. সিলসিলা যঈফাহ হা/১২১৭, ৩/৩৬২ পৃঃ।
[16]. তিরমিযী হা/১৭৮৪, ১/৩০৮ পৃঃ, ‘পোশাক’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৪৩৪০; সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৭২।
[17]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৭২।
[18]. মুসনাদে ত্বায়ালিসী হা/১৫৪; সিলসিলা যঈফাহ হা/৩০৫২।
[19]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৩০৫২-এর আলোচনা দ্রঃ।
[20]. ইমাম হায়ছামী, আহকামুল লিবাস ২/৯ পৃঃ; সিলসিলা যঈফাহ হা/৭১৮।
[21]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৭১৮।
[22]. সিলসিলা যঈফাহ হা/২৩৪৭, ১৫৯৩, ১২৯৬; সাখাবী, আল-মাক্বাছিদুল হাসানাহ, সিলসিলা যঈফাহ হা/১৫৯৩।
[23]. ছহীহ মুসলিম হা/৩৩৭৫-৩৩৭৮; মিশকাত হা/১৪১০।