জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত মুযাফফর বিন মুহসিন ২১৮ টি
জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত মুযাফফর বিন মুহসিন ২১৮ টি
উক্ত গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা - প্রথম অংশ

আমলের মাধ্যমে ব্যক্তি পরিচয় ফুটে উঠে ও আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। সৎ আমল করা একজন মুসলিম ব্যক্তির প্রধান দায়িত্ব। আর সেজন্যই তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ আমলের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের প্রয়োজন মনে করে না। যে আমল সমাজে চালু আছে সেটাই করে থাকে। এমনকি আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম ছালাতের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। অথচ সমাজে প্রচলিত ছালাতের হুকুম-আহকাম অধিকাংশই ত্রুটিপূর্ণ। ওযূ, তায়াম্মুম, ছালাতের ওয়াক্ত, আযান, ইক্বামত, ফরয, নফল, বিতর, তাহাজ্জুদ, তারাবীহ, জুম‘আ, জানাযা ও ঈদের ছালাত সবই বিদ‘আত মিশ্রিত এবং যঈফ ও জাল হাদীছে আক্রান্ত। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাতের সাথে আমাদের ছালাতের কোন মিল নেই। বিশেষ করে জাল ও যঈফ হাদীছের করালগ্রাসে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত সমাজ থেকে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। ফলে সমাজ জীবনে প্রচলিত ছালাতের কোন প্রভাব নেই। নিয়মিত মুছল্লী হওয়া সত্ত্বেও অনেকে নানা অবৈধ কর্মকান্ড ও দুর্নীতির সাথে জড়িত।

সমাজে মসজিদ ও মুছল্লীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেলেও দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সূদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতি, যুলুম-নির্যাতন, রাহাজানি কমছে না। অথচ আল্লাহ তা‘আলার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা হল, ‘নিশ্চয়ই ছালাত অন্যায় ও অশ্লীল কর্ম থেকে বিরত রাখে’ (সূরা আনকাবূত ৪৫)। অতএব মুছল্লীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম বন্ধ হবে, নিঃসন্দেহে কমে যাবে এটাই আল্লাহর দাবী। কিন্তু সমাজে প্রচলিত ছালাতের কোন কার্যকারিতা নেই কেন? এ জন্য মৌলিক তিনটি কারণ চিহ্নিত করা যায়।

(এক) খুলূছিয়াতে ত্রুটি রয়েছে। অর্থাৎ ছালাত আদায় করি কিন্তু একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে তা পেশ করি না। অধিকাংশ মুছল্লী মসজিদেও সিজদা করে মাযারেও সিজদা করে, রাসূল (ছাঃ)-কেও সম্মান করে পীরেরও পূজা করে, ইসলামকেও মানে অন্যান্য তরীক্বা ও বিজাতীয় মতবাদেরও অনুসরণ করে। এই আক্বীদায় ছালাত আদায় করলে ছালাত হবে না। একনিষ্ঠচিত্তে একমাত্র আল্লাহর জন্যই সবকিছু করতে হবে, তাঁরই আইন ও বিধান মানতে হবে।[1]

(দুই) রাসূল (ছাঃ)-এর পদ্ধতিতে ছালাত আদায় না করা। অধিকাংশ মুছল্লীই তার ছালাত সম্পর্কে উদাসীন। তিনি যত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমানই হোন লক্ষ্য করেন না, তার ছালাত রাসূল (ছাঃ)-এর তরীক্বায় হচ্ছে কি-না। অথচ ছালাতের প্রধান শর্তই হল, রাসূল (ছাঃ) যেভাবে ছালাত আদায় করেছেন ঠিক সেভাবেই আদায় করা।[2] এ ব্যাপারে শরী‘আতের নির্দেশ অত্যন্ত কঠোর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘সুতরাং দুর্ভোগ ঐ সমস্ত মুছল্লীদের জন্য, যারা ছালাতের ব্যাপারে উদাসীন, যারা লোক দেখানোর জন্য আদায় করে’ (মাঊন ৪-৬)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ক্বিয়ামতের মাঠে বান্দার সর্বপ্রথম হিসাব নেওয়া হবে ছালাতের। ছালাতের হিসাব শুদ্ধ হলে তার সমস্ত আমলই সঠিক হবে আর ছালাতের হিসাব ঠিক না হলে, তার সমস্ত আমল বরবাদ হবে’।[3]

জনৈক ছাহাবী রাসূল (ছাঃ)-এর উপস্থিতিতে তিনবার ছালাত আদায় করেন। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) তিনবারই তাকে বলেন, তুমি ফিরে যাও এবং ছালাত আদায় কর, তুমি ছালাত আদায় করোনি।[4] ঐ ব্যক্তি তিন তিনবার অতি সাবধানে ছালাত আদায় করেও রাসূল (ছাঃ)-এর পদ্ধতি মোতাবেক না হওয়ায় তা ছালাত বলে গণ্য হয়নি। উক্ত হাদীছ থেকে বুঝা যায় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর তরীক্বায় ছালাত আদায় না করলে কা‘বা ঘরে ছালাত আদায় করেও কোন লাভ নেই। তাঁর ছাহাবী হলেও ছালাত হবে না। অন্য হাদীছে এসেছে, হুযায়ফাহ (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে ছালাতে রুকূ-সিজদা পূর্ণভাবে আদায় করতে না দেখে ছালাত শেষে তাকে ডেকে বললেন, তুমি ছালাত আদায় করনি। যদি তুমি এই অবস্থায় মারা যাও, তাহলে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে যে ফিতরাতের উপর আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন সেই ফিতরাতের বাইরে মারা যাবে।[5] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হুযায়ফা (রাঃ) তাকে প্রশ্ন করলে বলে, সে প্রায় ৪০ বছর যাবৎ ছালাত আদায় করছে। তখন তিনি উক্ত মন্তব্য করেন।[6] অতএব বছরের পর বছর ছালাত আদায় করেও কোন লাভ হবে না, যদি তা রাসূল (ছাঃ)-এর পদ্ধতি মোতাবেক না হয়।

(তিন) হারাম উপার্জন। ‘হালাল রূযী ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত’ কথাটি সমাজে প্রচলিত থাকলেও এর প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। প্রত্যেককে লক্ষ্য করা উচিৎ তার খাদ্য, পানীয়, পোশাক, আসবাবপত্র হালাল না হারাম। কারণ হারাম মিশ্রিত কোন ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র। তিনি পবিত্র বস্ত্ত ছাড়া কবুল করেন না’।কারো খাদ্য, পানীয় ও পোশাক হারাম হলে তার প্রার্থনা গ্রহণযোগ্য হবে না।[7] তাই দুর্নীতি, আত্মসাৎ, প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ এবং সূদ-ঘুষ, জুয়া-লটারী ও অবৈধ পন্থায় প্রাপ্ত অর্থ ভক্ষণ করে ইবাদত করলে কোন লাভ হবে না।

মুছল্লী উক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতন না হওয়ার কারণে ছালাত যেমন পরিশুদ্ধ হয় না, তেমনি মুছল্লীর মাঝে একাগ্রতা ও মনোযোগ আসে না। ফলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ছালাতের কার্যকর কোন প্রভাবও পড়ে না।

অতএব আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে এমন ছালাত আদায় করতে চাইলে ছালাতকে অবশ্যই পরিশুদ্ধ করতে হবে এবং একমাত্র রাসূল (ছাঃ)-এর দেখানো পদ্ধতিতেই আদায় করতে হবে। অন্য সব পদ্ধতি বর্জন করতে হবে। কারণ অন্য কোন তরীক্বায় ছালাত আদায় করলে কখনোই একাগ্রতা ও খুশূ-খুযূ সৃষ্টি হবে না। আর আল্লাহভীতি ও একনিষ্ঠতা স্থান না পেলে মুছল্লী পাপাচার থেকে মুক্ত হতে পারবে না (সূরা বাক্বারাহ ২৩৮; মুমিনূন ২)। মনে রাখতে হবে যে, এই ছালাত যদি দুনিয়াবী জীবনে কোন প্রভাব না ফেলে, তাহলে পরকালীন জীবনে কখনোই প্রভাব ফেলতে পারবে না। তাই দলীয় গোঁড়ামী, মাযহাবী ভেদাভেদ, তরীক্বার বিভক্তিকে পিছনে ফেলে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাতের পদ্ধতি অাঁকড়ে ধরতে হবে। ফলে সকল মুছল্লী একই নীতিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছালাত আদায়ের সুযোগ পাবে। পুনরায় মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে। ছালাতের মাধ্যমেই সমাজ দুর্নীতি মুক্ত হবে। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনে শান্তির ফল্গুধারা প্রবাহিত হবে।

চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, দেশে প্রচলিত ইসলামী দলগুলো সমাজের সংস্কার কামনা করে এবং এ জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে থাকে। কিন্তু তাদের মাঝে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত নেই। মাযহাব ও তরীক্বার নামে যে ছালাত প্রচলিত আছে, সেই ছালাতই তারা আদায় করে যাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে তারা যদি নিজেদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে মাযহাবী গোঁড়ামীর উপর রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শকে প্রাধান্য দিতে না পারেন, তাহলে জাতীয় জীবনে তারা কিভাবে ইসলামের শাসন কায়েম করবেন? বিশেষ করে রাসূল (ছাঃ)-এর তরীক্বায় ছালাত আদায় করতে তো সামাজিক ও প্রশাসনিক কোন বাধা নেই। তাহলে মূল কারণ কী? মাযহাবী আক্বীদা ও মায়াবন্ধনই মূল কারণ।

এক্ষণে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত প্রতিষ্ঠার জন্য কিভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করা প্রয়োজন। আমাদের একান্ত বিশ্বাস নিম্নোক্ত ব্যক্তিবর্গ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলে ইনশাআল্লাহ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাওয়া যাবে।

(ক) সম্মানিত ইমাম, খত্বীব ও আলেমগণ। সাধারণ মানুষকে সংশোধনের দায়িত্ব মূলতঃ তাদের উপরই অর্পিত হয়েছে। তাই তারা ছালাতের সঠিক পদ্ধতি জেনে মুছল্লীদেরকে বাস্তব প্রশিক্ষণ প্রদান করবেন। প্রয়োজনে জুম‘আর দিন মিম্বরে দাঁড়িয়ে ছালাত শিক্ষা দিবেন।[8] তবে অনেক হক্বপন্থী আলেম সঠিক বিষয়টি জানা সত্ত্বেও সামাজিক মর্যাদার কারণে প্রকাশ করেন না। তারা কি আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোকে ভয় পান না (রহমান ৪৬; নাযিয়াত ৪০)? তাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, যাবতীয় সম্মানের মালিক আল্লাহ (আলে ইমরান ২৬; নিসা ১৩৯)। অতএব তারা উক্ত দায়িত্বে অবহেলা করলে মুছল্লীদের ভুল ছালাতের পাপের ভার ক্বিয়ামতের দিন তাদেরকেও বহন করতে হবে।[9] আর যদি গোঁড়ামী করে জাল, যঈফ ও ভিত্তিহীন-বানোয়াট হাদীছ কিংবা বিদ‘আতী পদ্ধতিতে ছালাত শিক্ষা দেন এবং রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাতকে অবজ্ঞা করেন তবে তাদের শাস্তি আরো কঠোর হবে।[10] উক্ত ইমাম, খত্বীব ও আলেমগণ যেন আল্লাহকে ভয় করেন। আল্লাহ তাদের অন্তরের খবর রাখেন (হূদ ৫)।

(খ) দ্বীনের দাঈ, মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও পরিবারের অভিভাবকগণ। যে সমস্ত দাঈ সমাজের সর্বস্তরে দাওয়াতী কার্যক্রম পরিচালনা করেন, আলোচনা, বক্তব্য, সেমিনার, সম্মেলন, জালসা ইত্যাদি করে থাকেন, তারা আক্বীদা সংশোধনের দাওয়াত প্রদান করার পর বিশুদ্ধভাবে ছালাত আদায়ের গুরুত্ব আলোচনা করবেন এবং তার পদ্ধতি তুলে ধরবেন।[11] তারা যদি ছহীহ দলীল ছাড়া দাওয়াতী কাজ করেন তবে তা হবে জাহেলিয়াতের দাওয়াত, যার পরিণাম অত্যন্ত ভায়াবহ।[12] মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যদি এক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেন, তবে সমাজে দ্রুত এর প্রভাব পড়বে। কারণ তারা কিতাব দেখে, পর্যালোচনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত পেশ করতে পারবেন।[13] অনুরূপ পরিবারের অভিভাবকগণ যদি তাদের সন্তানদেরকে শুরুতেই রাসূল (ছাঃ)-এর তরীক্বায় ছালাত শিক্ষা দেন, তবে সমাজ থেকে প্রচলিত বিদ‘আতী ছালাত দ্রুত বিদায় নিবে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত প্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ সন্তানদেরকে ছালাত শিক্ষা দেয়ার মূল দায়িত্ব অভিভাবকের।[14] পক্ষান্তরে তারা যদি অবহেলা করেন এবং বিদ‘আতী ছালাতকেই চালু রাখেন, তবে তারাও আল্লাহর কাছে মুক্তি পাবেন না। তাদের সন্তানেরা উল্টা তাদের বিরুদ্ধে নালিশ করবে (আহযাব ৬৭-৬৮; ফুছি্ছলাত ২৯)।

(গ) সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত জ্ঞানী-গুণী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, কলেজের শিক্ষক ও বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত অনেক জ্ঞানী ব্যক্তিও ছালাত আদায় করেন। প্রশাসনিক ব্যক্তি হিসাবে বিচারপতি, ম্যাজিস্ট্রেট, সচিব, ডিসি, এসপি, ওসি এবং জনপ্রতিনিধি হিসাবে মন্ত্রী, এমপি, চেয়ারম্যান, পরিচালক, সভাপতি, দায়িত্বশীল বিভিন্ন শ্রেণীর অনেকেই ছালাত আদায় করেন। তারা নিজেদের ছালাত যাচাই করে আদায় করলে সমাজ উপকৃত হয়। কারণ সাধারণ জনগণ তাদের প্রতি দৃষ্টি রাখে। তারাও মসজিদের ইমামকে বা অন্যান্য মুছল্লীদেরকে ছহীহ হাদীছ মোতাবেক ছালাত আদায়ের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। ছালাত যেহেতু অন্যায়-অশ্লীল কর্ম থেকে বিরত রাখে, তাই বিশুদ্ধ ছালাত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিতে পারেন। কিন্তু অশনিসংকেত হল, এই শ্রেণীর অধিকাংশ মানুষই সমাজে অনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে শিরক ও বিদ‘আতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকেন। এটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। পৃথিবীতে যে যে শ্রেণীরই মানুষ হোন না কেন আল্লাহর কাছে তাক্বওয়া ছাড়া কোনকিছুর মূল্য নেই।[15] অতএব তারা যদি ক্ষমতা ও দম্ভের কারণে ছহীহ হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করেন, তবে তাদেরকেও নমরূদ, আযর, ফেরআউন, হামান, কারূণ ও আবু জাহলদের ভাগ্যবরণ করতে হবে। ইবরাহীম (আঃ)-এর পিতা আযরের জন্য সুপারিশ করলেও আল্লাহ কবুল করবেন না। বরং তাঁর সামনে আযরকে পশুতে পরিণত করা হবে, নর্দমায় ডুবানো হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।[16] কারণ ইবরাহীম (আঃ) তাকে অহির দাওয়াত দিয়েছিলেন কিন্তু সে দাপট দেখিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিল (মারইয়াম ৪২-৪৬)। তারা বহু বছর রাজত্ব করেও চরম অপমান ও লাঞ্ছনা নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। বর্তমান নেতারা স্বল্প সময়ের ক্ষমতা পেয়ে দাপট দেখাতে চান। কিন্তু পূর্ববর্তীদের কথা এতটুকুও চিন্তা করেন না। বর্তমানে বিভিন্ন সমাজে ও মসজিদে সমাজপতিদের দাপটে অসংখ্য বিদ‘আত চালু আছে। অতএব ক্ষমতাশীনরা সাবধান!

(ঘ) তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজ। তারুণ্যের ঢেউ ও যৌবনের উদ্যমকে যে আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে পরিচালনা করবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের মাঠে তাঁর আরশের নীচে ছায়া দান করবেন।[17] সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হল ছালাত। তারা উন্মুক্ত ও স্বাধীনচেতা কাফেলা হিসাবে যদি যাচাই সাপেক্ষে খোলা মনে ছালাতের সঠিক পদ্ধতি গ্রহণ করে তবে সমাজ সংস্কার দ্রুত সম্ভব হবে। বরং যারা নেতৃত্বের আসনে বসে প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখিয়ে সুন্নাত বিরোধী আমল চালু রাখতে চায়, তাদেরকেও তারা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে। কিন্তু যে সমস্ত ছাত্র ও যুবক বিদ‘আতী ছালাতে অভ্যস্ত থাকে এবং ছালাতকে যাচাই না করে তবে তাদের মত হতভাগা আর কেউ নেই। কারণ তারা এর জবাব না দেয়া পর্যন্ত ক্বিয়ামতের মাঠে পার পাবে না।[18]

(ঙ) গ্রন্থকার, লেখক, কলামিষ্ট, প্রাবন্ধিক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী। তাদের মধ্যেও অনেকে ছালাতে অভ্যস্ত এবং দ্বীনদার তাক্বওয়াশীল মানুষ আছে। সমাজে তাদের যেমন মর্যাদা আছে তেমনি ব্যক্তি প্রভাবও আছে। রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তারাও অবদান রাখতে পারেন। কিন্তু তারা যদি নিজেদের ছালাত বিশুদ্ধভাবে আদায় না করেন, তবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন অন্যদেরকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবেন। কারণ সমাজে তারা শ্রদ্ধার পাত্র। মানুষ তাদেরকে অনুসরণ করে। তাই তাদের দায়িত্বও বেশী। তারা নিজেদের পেশার ব্যাপারে যতটা সচেতন ও তথ্য উদ্ঘাটনে যতটা অনুসন্ধানী, বিশুদ্ধভাবে ছালাত আদায়ের ক্ষেত্রে ততটা অনুরাগী নন। অথচ এটা চিরস্থায়ী আর অন্যান্য বিষয় ক্ষণস্থায়ী।

জাল-যঈফ হাদীছ মিশ্রিত প্রচলিত ছালাত উঠিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত প্রতিষ্ঠা করা নিঃসন্দেহে কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে নিম্নের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিলে ইনশাআল্লাহ মাযহাবী গোঁড়ামী ও প্রাচীন ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করা সহজ হবে।

(১) ছালাতের যাবতীয় আহকাম ছহীহ দলীল ভিত্তিক হতে হবে।

ছালাত ইবাদতে তাওক্বীফী যাতে দলীল বিহীন ও মনগড়া কোন কিছু করার সুযোগ নেই। প্রমাণহীন কোন বিষয় পাওয়া গেলে তা সঙ্গে সঙ্গে পরিত্যাগ করতে হবে। কত বড় ইমাম, বিদ্বান, পন্ডিত, ফক্বীহ বলেছেন বা করেছেন তা দেখার প্রয়োজন নেই। কারণ প্রমাণহীন কথার কোন মূল্য নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَاسْأَلُوْا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لاَ تَعْلَمُوْنَ- بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ ‘সুতরাং তোমরা যদি না জান তবে স্পষ্ট দলীলসহ আহলে যিকিরদের জিজ্ঞেস কর’ (সূরা নাহল ৪৩-৪৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম সর্বদা দলীলের ভিত্তিতেই মানুষকে আহবান জানাতেন।[19]

ইসলামের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ মুহাদ্দিছ ওলামায়ে কেরামও দলীলের ভিত্তিতে মানুষকে আহবান জানিয়েছেন। ইমাম আবু হানীফা (৮০-১৫০হিঃ) বলেন, لَايَحِلُّ لِأَحَدٍ أَنْ يَّأْخُذَ بِقَوْلِنَا مَا لَمْ يَعْلَمْ مِنْ أَيْنَ أَخَذْنَاهُ ‘ঐ ব্যক্তির জন্য আমাদের কোন বক্তব্য গ্রহণ করা হালাল নয়, যে জানে না আমরা উহা কোথা থেকে গ্রহণ করেছি’।[20]

ইমাম শাফেঈ (১৫০-২০৪হিঃ) বলেন, إِذَا رَأَيْتَ كَلاَمِىْ يُخَالِفُ الْحَدِيْثَ فَاعْمَلُوْا بِالْحَدِيْثِ وَاضْرِبُوْا بِكَلاَمِىْ الْحَائِطَ. ‘যখন তুমি আমার কোন কথা হাদীছের বরখেলাফ দেখবে, তখন হাদীছের উপর আমল করবে এবং আমার কথাকে দেওয়ালে ছুড়ে মারবে’।[21] ইমাম মালেক (৯৩-১৭৯হিঃ), ইমাম আহমাদ (১৬৪-২৪১হিঃ) সহ অন্যান্য ইমামও একই কথা বলেছেন।[22]

(২) জাল ও যঈফ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত সকল প্রকার আমল নিঃসঙ্কোচে ও নিঃশর্তভাবে বর্জন করতে হবে।

জাল ও যঈফ হাদীছ দ্বারা কোন শারঈ বিধান প্রমাণিত হয় না। জাল হাদীছের উপর আমল করা পরিষ্কার হারাম।[23] সে কারণ ছাহাবায়ে কেরাম যঈফ ও জাল হাদীছের বিরুদ্ধে সর্বদা সোচ্চার ছিলেন। আস্থাহীন, ত্রুটিপূর্ণ, অভিযুক্ত, পাপাচারী, ফাসিক্ব শ্রেণীর লোকের বর্ণনা তারা গ্রহণ করতেন না। প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ অন্যান্য মুহাদ্দিছগণও এর বিরুদ্ধে ছিলেন। ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর চূড়ান্ত মূলনীতি ছিল যঈফ হাদীছ ছেড়ে কেবল ছহীহ হাদীছকে অাঁকড়ে ধরা। তাই দ্ব্যর্থহীনভাবে তিনি ঘোষণা করেন, إِذَا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ ‘যখন হাদীছ ছহীহ হবে সেটাই আমার মাযহাব’।[24]

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেন, إِنَّ الْعَالِمَ إِذَا لَمْ يَعْرِفِ الصَّحِيْحَ وَالسَّقِيْمَ وَالنَّاسِخَ والْمَنْسُوْخَ مِنَ الْحَدِيْثِ لاَيُسَمَّى عَالِمًا. ‘নিশ্চয়ই যে আলেম হাদীছের ছহীহ-যঈফ ও নাসিখণ্ডমানসূখ বুঝেন না তাকে আলেম বলা যাবে না’। ইমাম ইসহাক্ব ইবনু রাওয়াহাও একই কথা বলেছেন।[25] ইমাম মালেক, শাফেঈ (রহঃ)-এর বক্তব্যও অনুরূপ।[26]

মুহাদ্দিছ যায়েদ বিন আসলাম বলেন, مَنْ عَمِلَ بِخَبْرٍ صَحَّ أَنَّهُ كِذْبٌ فَهُوَ مِنْ خَدَمِ الشَّيْطَانِ. ‘হাদীছ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও যে তার উপর আমল করে সে শয়তানের খাদেম’।[27] অতএব ইমাম হোন আর ফক্বীহ হোন বা অন্য যেই হোন শরী‘আত সম্পর্কে কোন বক্তব্য পেশ করলে তা অবশ্যই ছহীহ দলীলভিত্তিক হতে হবে। উল্লেখ্য যে, কিছু ব্যক্তি নিজেদেরকে মুহাদ্দিছ বলে ঘোষণা করছে এবং না জেনেই যেকোন হাদীছকে যখন তখন ছহীহ কিংবা যঈফ বলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এরা আলেম নামের কলঙ্ক। এদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা দ্রঃ ‘যঈফ ও জাল হাদীছ বর্জনের মূলনীতি’ শীর্ষক বই)।

(৩) প্রচলিত কোন আমল শারঈ দৃষ্টিকোন থেকে ভুল প্রমাণিত হলে সাথে সাথে তা বর্জন করতে হবে এবং সঠিকটা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র গোঁড়ামী করা যাবে না। পূর্বপুরুষদের মাঝে চালু ছিল, বড় বড় আলেম করে গেছেন, এখনো অধিকাংশ আলেম করছেন, এখনো সমাজে চালু আছে, এ সমস্ত জাহেলী কথা বলা যাবে না।

ভুল হওয়া মানুষের স্বভাবজাত। মানুষ মাত্রই ভুল করবে, কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তবে ভুল করার পর যে সংশোধন করে নেয় সেই সর্বোত্তম। আর যে সংশোধন করে না সে শয়তানের বন্ধু। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, كُلُّ ابْنِ آدَمَ خَطَّاءٌ وَخَيْرُ الْخَطَّائِيْنَ التَّوَّابُوْنَ. ‘প্রত্যেক আদম সন্তান ভুলকারী আর উত্তম ভুলকারী সে-ই যে তওবাকারী’।[28] যারা ভুল করার পর তওবা করে এবং সংশোধন করে নেয় আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন এবং ইহকাল ও পরকালে চিন্তামুক্ত রাখবেন (আন‘আম ৪৮, ৫৪)। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও ভুল করেছেন এবং সংশোধন করে নিয়েছেন।[29] সাহো সিজদার বিধানও এখান থেকেই চালু হয়েছে। অনুরূপ চার খলীফাসহ অন্যান্য ছাহাবীদেরও ভুল হয়েছে।[30] বিশেষ করে ওমর (রাঃ) ছাহাবীদের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও অনেক বিষয় অজানা ও স্মরণ না থাকার কারণে ভুল সিদ্ধান্ত পেশ করেছিলেন। কিন্তু সঠিক বিষয় জানার পর বিন্দুমাত্র দেরী না করে তার প্রতি আত্মসমর্পণ করেছেন।[31] তাই একথা অনুস্বীকার্য যে, আগের আলেমগণ অনেক কিছু জানতেন। তবে তারা সবকিছু জানতেন, তারা কোন ভুল করেননি এই দাবী সঠিক নয়। কারণ তিনি আদম সন্তান হলে ভুল করবেনই। এমনকি আল্লাহ তা‘আলা যাকে নির্বাচন করে মুজাদ্দিদ হিসাবে পাঠান, তিনিও ভুল করতে পারেন বলে রাসূল (ছাঃ) ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।[32] সুতরাং সাধারণ আলেমের ভুল হবে এটা অতি স্বাভাবিক। তাই যিদ না করে ভুল সংশোধন করে নেয়াই উত্তম বান্দার বৈশিষ্ট্য। তাছাড়া অনেক সময় আল্লাহ তা‘আলা এবং রাসূল (ছাঃ) কোন বিধানকে রহিত করেছেন এবং তার স্থলে অন্যটি চালু করেছেন (বাক্বারাহ ১০৬)। তখন সেটাই সকল ছাহাবী গ্রহণ করেছেন। গোঁড়ামী করেননি, কোন প্রশ্ন করেননি। তাদের থেকেও আমরা শিক্ষা নিতে পারি। কারণ ভুল সংশোধন না করে বাপ-দাদা বা বড় বড় আলেমদের দোহাই দেওয়া অমুসলিমদের স্বভাব (বাক্বারাহ ১৭০; লোকমান ২১)। তাছাড়া এটাও বিশ্বাস করতে হবে যে, অসংখ্য পথভ্রষ্ট আলেম থাকবে যারা মানুষকে জাহান্নামের দিকে ডাকবে।[33] ইসলামের নামে অসংখ্য ভ্রান্ত দল থাকবে। তারা নতুন নতুন শরী‘আত আবিষ্কার করবে এবং জনগণকে বিভ্রান্ত করবে।[34] এগুলো রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী। সুতরাং উক্ত আলেম ও দলের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। তাদের দোহাই দেয়া যাবে না।

(৪) খুঁটিনাটি বলে কোন সুন্নাতকে অবজ্ঞা করা যাবে না :

ইসলামের কোন বিধানই খুঁটিনাটি নয়। অনুরূপ কোন সুন্নাতই ছোট নয়। রাসূল (ছাঃ) তাঁর উম্মতের জন্য ছোট বড় যা কিছু বলেছেন সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত।[35] সুতরাং উক্ত ভ্রান্ত আক্বীদা থেকে বেরিয়ে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর যেকোন সুন্নাতকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। কেননা সুন্নাতকে অবজ্ঞা করা ও খুঁটিনাটি বলে তাচ্ছিল্য করা অমার্জনীয় অপরাধ। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীগণ এই অবহেলাকে মুহূর্তের জন্যও বরদাশত করেননি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা বারা ইবনু আযেব (রাঃ)-কে ঘুমানোর দু‘আ শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তার এক অংশে তিনি বলেন, ‘(হে আল্লাহ!) আপনার নবীর প্রতি ঈমান আনলাম, যাকে আপনি প্রেরণ করেছেন’। আর বারা (রাঃ) বলেন, ‘এবং আপনার রাসূলের প্রতি ঈমান আনলাম, যাকে আপনি প্রেরণ করেছেন’। উক্ত কথা শুনে রাসূল (ছাঃ) তার হাত দ্বারা বারার বুকে আঘাত করে বলেন, বরং ‘আপনার নবীর প্রতি ঈমান আনলাম যাকে আপনি প্রেরণ করেছেন’।[36] এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘নবীর’ স্থানে ‘রাসূল’ শব্দটিকে বরদাশত করলেন না। জনৈক ছাহাবী ছালাতের মধ্যে সামান্য ত্রুটি করলে তিনি তাকে ডেকে বলেন, হে অমুক! তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না। তুমি কি দেখ না কিভাবে ছালাত আদায় করছ?[37]

রাসূল (ছাঃ) একদিন ছালাতের জন্য তাকবীরে তাহরীমা বলতে শুরু করেছেন। এমতাবস্থায় দেখতে পেলেন যে, এক ব্যক্তির বুক কাতার থেকে সম্মুখে একটু বেড়ে গেছে তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহর বান্দারা! হয় তোমরা কাতার সোজা করবে, না হয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের চেহারা সমূহকে বিকৃতি করে দিবেন’।[38] নবী (ছাঃ) একদা এক ব্যক্তিকে ডান হাতের উপর বাম হাত রেখে ছালাত আদায় করতে দেখে তিনি ডান হাতটাকে বাম হাতের উপর করে দেন।[39]

অতএব ছালাতের যেকোন আহকামকে খুঁটিনাটি বলে অবজ্ঞা করা যাবে না। বরং সেগুলো পালনে বাহ্যিকভাবে যেমন নানাবিধ উপকার রয়েছে, তেমনি অঢেল নেকীও রয়েছে। যেমন- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের পিছনে রয়েছে ধৈর্যের যুগ। সে সময় যে ব্যক্তি সুন্নাতকে শক্ত করে অাঁকড়ে ধরে থাকবে সে তোমাদের সময়ের ৫০ জন শহীদের নেকী পাবে’।[40] বর্তমান যুগের প্রত্যেক সুন্নাতের পাবন্দ ব্যক্তির জন্যই এই সুসংবাদ।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (কাতারের মধ্যে দু’জনের) ফাঁক বন্ধ করবে, আল্লাহ তা‘আলা এর বিনিময়ে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর তৈরি করবেন’।[41] যে ব্যক্তি ছালাতে স্বশব্দে আমীন বলবে এবং তা ফেরেশতাদের আমীনের সাথে মিলে যাবে, তার পূর্বের পাপ সমূহ ক্ষমা করা হবে।[42] উক্ত সুন্নাতগুলো সাধারণ কিন্তু নেকীর ক্ষেত্রে কত অসাধারণ তা কি আমরা লক্ষ্য করি?

সবচেযে বড় বিষয় হল, এই সুন্নাতগুলো সমাজে চালু করতে শত শত হক্বপন্থী আলেমের রক্ত প্রবাহিত হয়েছে। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে, অন্ধ কারাগারে জীবন দিতে হয়েছে, দীপান্তরে কালাপানির ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। যেমন বুকের উপর হাত বাঁধা, জোরে আমীন বলা, রাফঊল ইয়াদায়েন করা ইত্যাদি। আর সেই সুন্নাত সমূহকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা কত বড় অন্যায় হতে পারে?

(৫) সঠিক পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করতে গিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই যে, কতজন লোক তা করছে, কোন্ মাযহাবে চালু আছে, কোন্ ইমাম কী বলেছেন বা আমল করেছেন কিংবা কোন্ দেশের লোক করছে আর কোন্ দেশের লোক করছে না :

আল্লাহ প্রেরিত সংবিধান চিরন্তন, যা নিজস্ব গতিতে চলমান। এই মহা সত্যকেই সর্বদা অাঁকড়ে ধরে থাকতে হবে একাকী হলেও। ইবরাহীম (আঃ) নানা যুলুম-অত্যাচার সহ্য করে একাই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। তাই তিনি বিশ্ব ইতিহাসে মহা সম্মানিত হয়েছেন (নাহল ১২০; বাক্বারাহ ১২৪)। সমগ্র জগতের বিদ্রোহী মানুষরা তার সম্মান ছিনিয়ে নিতে পারেনি। সংখ্যা কোন কাজে আসেনি। মূলকথা হল- অহীর বিধান সংখ্যা, দেশ, অঞ্চল, বয়স, সময়, মেধা কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করে না। অনেকে বলতে চায়, চার ইমামের পরে মুহাদ্দিছগণের জন্ম। সুতরাং ইমামদের কথাই গ্রহণযোগ্য। অথচ ছাহাবীরা সুন্নাতকে অগ্রাধিকার দিতে বয়স্ক ব্যক্তি উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও মাত্র ৬/৭ বছরের বাচ্চাকে দিয়ে ছালাত পড়িয়ে নিয়েছেন।[43] ওমর (রাঃ) কনিষ্ঠ ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরীর নিকট থেকে কারো বাড়ীতে গিয়ে তিনবার সালাম দেওয়া সংক্রান্ত হাদীছের পক্ষে সাক্ষী গ্রহণ করেন। কারণ তিনি এই হাদীছ জানতেন না।[44] অতএব মহা সত্যের উপর কোন কিছুর প্রাধান্য নেই। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘হক্ব-এর অনুসারী দলই হল জামা‘আত যদিও তুমি একাকী হও’।[45] অতএব হক্বপন্থী ব্যক্তি একাকী হলেও সেটাই জান্নাতী দল।

[1]. সূরা কাহ্ফ ১১০; বাইয়েনাহ ৫; ছহীহ মুসলিম হা/৬৭০৮, ২/৩১৭ পৃঃ, ‘সৎ কাজ ও সদাচরণ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১০।

[2]. ইমাম আবু আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ইসমাঈল আল-বুখারী, ছহীহ বুখারী (রিয়ায : মাকতাবাতু দারিস সালাম, ১৯৯৯ খৃঃ/১৪১৭ হিঃ), হা/৬৩১; ছহীহ বুখারী (করাচী ছাপা : ক্বাদীমী কুতুবখানা, আছাহহুল মাতাবে‘ ২য় প্রকাশ : ১৩৮১হিঃ/১৯৮১খৃঃ), ১ম খন্ড, পৃঃ ৮৮, (ইফাবা হা/৬০৩, ২/৫২ পৃঃ), ‘আযান’ অধ্যায়, ‘মুসাফিরদের জন্য আযান যখন তারা জামা‘আত করবে’ অনুচ্ছেদ-১৮; মুহাম্মাদ ইবনু আব্দিল্লাহ আল-খত্বীব আত-তিবরীযী, মিশকাতুল মাছাবীহ, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৯৮৫/১৪০৫), হা/৬৮৩, ১/২১৫ পৃঃ; ভারতীয় ছাপা, পৃঃ ৬৬; মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী, বঙ্গানুবাদ মিশকাত (ঢাকা : এমদাদিয় পুস্তকালয়, আগস্ট ২০০২), হা/৬৩২, ২/২০৮ পৃঃ, ‘ছালাত’ অধ্যায়, ‘সংশ্লিষ্ট আযান’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ বুখারী হা/৬০০৮, ৭২৪৬।

[3]. আবুল ক্বাসেম সুলায়মান ইবনু আহমাদ আত-ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব (কায়রো : দারুল হারামাইন, ১৪১৫), হা/১৮৫৯; মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছ আছ-ছহীহাহ হা/১৩৫৮।

[4]. ছহীহ বুখারী হা/৭৫৭, ১/১০৪-১০৫, (ইফাবা হা/৭২১, ২/১১০ পৃঃ), ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯৫; মিশকাত হা/৭৯০, ৭৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭৩৪, ২য় খন্ড, পৃঃ ২৫০।

[5]. ছহীহ বুখারী হা/৭৯১, ১/১০৯ পৃঃ, (ইফাবা হা/৭৫৫, ২/১২৫ পৃঃ), ‘আযান’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১১৯; ছহীহ ইবনে হিববান হা/১৮৯৪; মিশকাত হা/৮৮৪, পৃঃ ৮৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৮২৪, ২/২৯৫ পৃঃ।

[6]. ছহীহ সুনানে নাসাঈ, তাহক্বীক্ব : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, (রিয়ায : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, তাবি), হা/১৩১২, ১/১৪৭ পৃঃ; ছহীহ ইবনে হিববান হা/১৮৯৪, সনদ ছহীহ।

[7]. মুসলিম হা/২৩৯৩, ১/৩২৬ পৃঃ, ‘যাকাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২০; মিশকাত হা/২৭৬০, পৃঃ ২৪১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৬৪০, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ১-২।

[8]. ছহীহ বুখারী হা/৯১৭, ১/১২৫ পৃঃ, (ইফাবা হা/৮৭১, ২/১৮৪ পৃঃ), ‘জুম‘আ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৬; ছহীহ মুসলিম হা/১২৪৪, ১/২০৬ পৃঃ; মিশকাত হা/১১১৩, পৃঃ ৯৯; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০৪৫, ৩য় খন্ড, পৃঃ ৬৫।

[9]. সূরা নাহল ২৫; আহযাব ৬৭-৬৮; মায়েদাহ ৬৭; ছহীহ বুখারী হা/১৩৮৬, ১/১৮৫ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৩০৩, ২/৪২৭ পৃঃ), ‘জানাযা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৯৩; মিশকাত হা/৪৬২১, পৃঃ ৩৯৫-৩৯৬।

[10]. আন‘আম ১৪৪; নাহল ২৫; হা-ক্কাহ ৪৪-৪৬; ছহীহ বুখারী হা/১০৯, ১/২১, (ইফাবা হা/১১০, ১/৭৮ পৃঃ), ‘ইলম’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩৮।

[11]. ছহীহ বুখারী হা/৭৩৭২, ২/১০৯৬ পৃঃ, ‘তাওহীদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১।

[12]. আহমাদ হা/১৭৮৩৩; তিরমিযী হা/২৮৬৩, ‘আমছাল’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৩; মিশকাত হা/৩৬৯৪।

[13]. সূরা তওবা ১২২; ছহীহ বুখারী হা/৭২৪৬, ২/১০৭৬ পৃঃ, ‘খবরে আহাদ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১।

[14]. সূরা ত্ব-হা ১৩২; আবুদাঊদ হা/৪৯৫, পৃঃ ৭১, ‘ছালাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২৬; মিশকাত হা/৫৭২, পৃঃ ৫৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫২৬, ২/১৬১ পৃঃ, ‘ছালাত’ অধ্যায়।

[15]. হুজুরাত ১৩; আহমাদ হা/২৩৫৩৬।

[16]. ছহীহ বুখারী হা/৩৩৫০, ১/৪৭৩ পৃঃ, ‘নবীদের ঘটনাবলী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮; মিশকাত হা/৫৫৩৮, পৃঃ ৪৮৩, ‘হাশর’ অনুচ্ছেদ।

[17]. ছহীহ বুখারী হা/১৪২৩, ১/১৯১ পৃঃ, (ইফাবা হা/১৩৪০, ৩/১৯ পৃঃ), ‘যাকাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৬; মিশকাত হা/৭০১, পৃঃ ৬৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৬৪৯, ২/২১৬ পৃঃ।

[18]. তিরমিযী হা/২৪১৬, ২/৬৭ পৃঃ, ‘ক্বিয়ামতের বর্ণনা’ অধ্যায়; মিশকাত হা/৫১৯৭, পৃঃ ৪৪৩, ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়।

[19]. সূরা ইউসুফ ১০৮; নাজম ৩-৪; হা-ক্কাহ ৪৪-৪৬; ছহীহ বুখারী হা/৫৭৬৫, ২য় খন্ড, পৃঃ ৮৫৮, ‘চিকিৎসা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৮; আহমাদ ইবনু শু‘আইব আবু আব্দির রহমান আন-নাসাঈ, সুনানুন নাসাঈ আল-কুবরা (বৈরুত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪১১/১৯৯১), হা/১১১৭৪, ৬/৩৪৩ পৃঃ; আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দির রহমান আবু মুহাম্মাদ আদ-দারেমী, সুনানুদ দারেমী (বৈরুত : দারুল কিতাব আল-আরাবী, ১৪০৭ হিঃ), হা/২০২; সনদ হাসান, মিশকাত হা/১৬৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৫৯, ১/১২৩ পৃঃ; ছহীহ বুখারী হা/১৪৬৫, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৯৮, ‘যাকাত’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৪৬; মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫১৬২।

[20] . ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুআক্কেঈন আন রাবিবল আলামীন (বৈরুত : দারুল কুতুব আল ইলমিয়াহ, ১৯৯৯৩/১৪১৪), ২য় খন্ড, পৃঃ ৩০৯; ইবনু আবেদীন, হাশিয়া বাহরুর রায়েক্ব ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃঃ ২৯৩; মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, ছিফাতু ছালাতিন নাবী (ছাঃ) মিনাত তাকবীর ইলাত তাসলীম কাআন্নাকা তারাহু (রিয়ায : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ১৯৯১/১৪১১), পৃঃ ৪৬।

[21]. আল-খুলাছা ফী আসবাবিল ইখতিলাফ, পৃঃ ১০৮; শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী, ইক্বদুল জীদ ফী আহকামিল ইজতিহাদ ওয়াত তাক্বলীদ (কায়রো : আল-মাতবাআতুস সালাফিয়াহ, ১৩৪৫হিঃ), পৃঃ ২৭।

[22]. শারহু মুখতাছার খলীল লিল কারখী ২১/২১৩ পৃঃ; ইক্বদুল জীদ ফী আহকামিল ইজতিহাদ ওয়াত তাক্বলীদ, পৃঃ ২৮।

[23]. সূরা আন‘আম ১৪৪; আ‘রাফ ৩৩; হুজুরাত ৬; ছহীহ বুখারী হা/৫১৪৩ ও ৬০৬৪, ২/৮৯৬ পৃঃ; ইমাম আবুল হুসাইন মুসলিম বিন হাজ্জাজ আল-কুশাইরী, ছহীহ মুসলিম (দেওবন্দ : আছাহহুল মাতাবে‘ ১৯৮৬), হা/৬৫৩৬, ২/৩১৬; মিশকাত হা/৫০২৮, পৃঃ ৪২৭।

[24]. আব্দুল ওয়াহহাব শা‘রাণী, মীযানুল কুবরা (দিল্লী : ১২৮৬ হিঃ), ১ম খন্ড, পৃঃ ৩০।

[25]. আলবানী, ছহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব (রিয়ায : মাকতাবাতুল মা‘আরিফ, ২০০০/১৪২১), ১/৩৯, ভূমিকা দ্রঃ; আবু আব্দিল্লাহ আল-হাকিম, মা‘রেফাতু উলূমিল হাদীছ, পৃঃ ৬০।

[26]. ছহীহ মুসলিম, মুক্বাদ্দামাহ দ্রঃ, ১/১২ পৃঃ, ‘যা শুনবে তাই প্রচার করা নিষিদ্ধ’ অনুচ্ছেদ-৩; প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আল-খত্বীব, আস-সুন্নাহ ক্বাবলাত তাদবীন (রৈরুত : দারুল ফিকর, ১৯৮০/১৪০০), পৃঃ ২৩৭।

[27]. মুহাম্মাদ তাহের পাট্টানী, তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত (বৈরুত : দারুল এহইয়াইত তুরাছ আল-আরাবী, ১৯৯৫/১৪১৫), পৃঃ ৭; ড. ওমর ইবনু হাসান ফালাতাহ, আল-ওয়ায‘উ ফিল হাদীছ (দিমাষ্ক : মাকতাবাতুল গাযালী, ১৯৮১/১৪০১), ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৩৩।

[28]. ছহীহ তিরমিযী হা/২৪৯৯, ২/৭৬ পৃঃ,; মিশকাত হা/২৩৪১, পৃঃ ২০৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২২৩২, ৫/১০৪ পৃঃ।

[29]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, বুখারী হা/১২২৯, ১/১৬৪ পৃঃ এবং ১/৬৯ পৃঃ, (ইফাবা হা/১১৫৭, ২/৩৪৬); মিশকাত হা/১০১৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৯৫১, ৩/২৫ পৃঃ।

[30]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুআক্কেঈন ২/২৭০-২৭২।

[31]. বুখারী হা/৪৪৫৪, ২/৬৪০-৬৪১ পৃঃ, (ইফাব হা/৪১০২, ৭/২৪৪ পৃঃ), ‘মাগাযী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৮৩; ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৫৩, ২/২১০ পৃঃ, ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-৭।

[32]. ছহীহ বুখারী হা/৭৩৫২, ২/১০৯২ পৃঃ, (ইফাবা হা/৬৮৫০, ১০/৫১৮ পৃঃ), ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-২১; মিশকাত হা/৩৭৩২, পৃঃ ৩২৪।

[33]. বুখারী হা/৭০৮৪, ২/১০৪৯ পৃঃ, (ইফাবা হা/৬৬০৫, ১০/৩৮০ পৃঃ), ‘ফিতনা সমূহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১১; মুসলিম হা/৩৪৩৫; মিশকাত হা/৫৩৮২, পৃঃ ৪৬১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৫১৪৯, ১০/৩ পৃঃ।

[34]. আবুদাঊদ হা/৪৫৯৭, ২/৬৩১ পৃঃ, ‘সুন্নাহ’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; মিশকাত হা/১৭২, পৃঃ ৩০, সনদ ছহীহ, ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।

[35]. আবুদাঊদ হা/১৪৫, পৃঃ ১৯; মিশকাত হা/৪০৮, পৃঃ ৪৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৭৪, ২/৮৩ পৃঃ, ‘ওযূর সুন্নাত’ অনুচ্ছেদ।

[36]. آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِيْ أَنْزَلْتَ وَنَبِيِّكَ الَّذِي أَرْسَلْتَ قَالَ الْبَرَاءُ فَقُلْتُ وَبِرَسُوْلِكَ الَّذِيْ أَرْسَلْتَ قَالَ فَطَعَنَ بِيَدِهِ فِيْ صَدْرِيْ ثُمَّ قَالَ وَنَبِيِّكَ الَّذِيْ أَرْسَلْتَ -তিরমিযী হা/৩৩৯৪, ২/১৭৬-১৭৭, ‘দু‘আ সমূহ’ অধ্যায়, ‘ঘুমানোর জন্য বিছানায় গিয়ে দু‘আ পড়া’ অনুচ্ছেদ; ছহীহ বুখারী হা/৬৩১১, ২/৯৩৪ পৃঃ, ‘দু‘আ সমূহ’ অধ্যায়-৮৩, অনুচ্ছেদ-৬; ছহীহ মুসলিম হা/৭০৫৭, ২/৩৪৮ পৃঃ, ‘দু‘আ ও যিকির’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১৭।

[37]. আহমাদ হা/৯৭৯০, সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৮১১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৭৫৫, ২/২৬২ পৃঃ।

[38]. خَرَجَ يَوْمًا فَقَامَ حَتَّى كَادَ يُكَبِّرُ فَرَأَى رَجُلاً بَادِيًا صَدْرُهُ مِنَ الصَّفِّ فَقَالَ عِبَادَ اللهِ لَتُسَوُّنَّ صُفُوْفَكُمْ أَوْ لَيُخَالِفَنَّ اللَّهُ بَيْنَ وُجُوْهِكُمْ-ছহীহ মুসলিম হা/১০০৭, ১/৮২ পৃঃ, ‘ছালাতে কাতার সোজা করা’ অনুচ্ছেদ; মিশকাত হা/১০৮৫, পৃঃ ৯৭; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০১৭।

[39]. عَنْ جَابِرٍ قَالَ مَرَّ رَسُوْلُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِرَجُلٍ وَهُوَ يُصَلِّي وَقَدْ وَضَعَ يَدَهُ الْيُسْرَى عَلَى الْيُمْنَى فَانْتَزَعَهَا وَوَضَعَ الْيُمْنَى عَلَى الْيُسْرَى -মুসনাদে আহমাদ হা/১৫১৩১; ছহীহ আবুদাঊদ হা/৭৫৫, পৃঃ ১১০, সনদ হাসান।

[40]. إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ زَمَانَ صَبْرٍ لِلمُتَمَسِّكِ فِيْهِ أَجْرُ خَمْسِيْنَ شَهِيْدًا فَقَالَ عُمَرُ يَا رَسُوْلَ اللَّهِ، مِنَّا أَوْ مِنْهُمْ؟ قَالَ مِنْكُمْ. -ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল কাবীর হা/১০২৪০; মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীছ আছ-ছহীহাহ ওয়া শাইয়ুন মিন ফিক্বহিহা ওয়া ফাওয়াইদিহা (বৈরুত : আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, ১৯৮৫/১৪০৫), হা/৪৯৪; সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘ হা/২২৩৪।

[41]. مَنْ سَدَّ فُرْجَةً فِيْ صَفٍّ رَفَعَهُ اللهُ بِهَا دَرَجَةً وَبَنَى لَهُ بَيْتًا فِى الْجَنَّةِ -ত্বাবারাণী, আওসাত্ব হা/৫৭৯৭; সনদ ছহীহ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৮৯২।

[42]. বুখারী হা/৭৮০, ১ম খন্ড, পৃঃ ১০৭, (ইফাবা হা/৭৪৪ ও ৭৪৬, ২/১২১ পৃঃ); মুসলিম হা/৯৪২, ১ম খন্ড, পৃঃ ১৭৬; আবুদাঊদ হা/৯৩২ ও ৯৩৩, ১/১৩৫ পৃঃ; তিরমিযী হা/২৪৮, ১/৫৭ ও ৫৮ পৃঃ; ইবনু মাজাহ হা/৮৫৬।

[43]. ছহীহ বুখারী হা/৪৩০২, ২/৬১৫-৬১৬ পৃঃ, ‘মাগাযী’ অধ্যায়-৬৭, অনুচ্ছেদ-৫০; মিশকাত হা/১১২৬, পৃঃ ১০০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১০৫৮, ৩/৭১ পৃঃ।

[44]. ছহীহ মুসলিম হা/৫৬২৬, ২/২১০ পৃঃ, ‘আদব’ অধ্যায়, ‘অনুমতি’ অনুচ্ছেদ-৭; মিশকাত হা/৪৬৬৭, পৃঃ ৪০০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৪৬২ ৯/১৯ পৃঃ।

[45]. إِنَّ الْجَمَاعَةَ مَا وَافَقَ الْحَقَّ وَ إِنْ كُنْتَ وَحْدَكَ -ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাষ্ক ১৩/৩২২ পৃঃ; সনদ ছহীহ, আলবানী, মিশকাত হা/১৭৩-এর টীকা দ্রঃ, ১/৬১ পৃঃ; ইমাম লালকাঈ, শারহু উছূলিল ই‘তিক্বাদ ১/১০৮ পৃঃ।
উক্ত গ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা - দ্বিতীয় অংশ

(৬) কোন দলীয় বা মাযহাবী স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য কৌশল করে কিংবা অপব্যাখ্যা করে শরী‘আতকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না :

উক্ত জঘন্য নীতির জয়জয়কার চলছে সহস্র বছর ধরে। একশ্রেণীর মানুষ অতি সামান্য জ্ঞান নিয়ে আল্লাহর জ্ঞানের উপর প্রভাব খাটিয়ে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করছে। এই অপকৌশলের যে কী শাস্তি তা তারা ভুলে গেছে। মূল শরী‘আতকে উপেক্ষা করে দলীয় সিদ্ধান্ত ও মাযহাবী নীতি প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য থাকলে বানী ইসরাঈলের মত তাদের উপর আল্লাহর গযব নেমে আসা অস্বাভাবিক নয়। দাঊদ (আঃ)-এর সময় তারা মহা সত্যকে না মেনে মিথ্যা কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। ফলে তারা বানর ও শূকরে পরিণত হয়েছিল এবং একই দিনে সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল (বাক্বারাহ ৬৫; মায়েদা ৬০)। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করে মানুষকে যারা বিভ্রান্ত করবে তাদের পরিণাম এমনই হওয়া উচিৎ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কুরআন তোমার পক্ষে দলীল হতে পারে, আবার বিপক্ষেও দলীল হতে পারে’।[46] সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের জানা উচিৎ যে, শারঈ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমি যাই করি এবং যে উদ্দেশ্যেই করি অন্তরের খবর আল্লাহ সবই জানেন (মুলক ১৩; আলে ইমরান ১১৯)।

উক্ত মিথ্যা কৌশল অবলম্বন করতে গিয়ে অসংখ্য হাদীছ জাল করা হয়েছে, হাদীছের শব্দ পরিবর্তন করা হয়েছে, বিভিন্ন অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ তুলে দেয়া হয়েছে, অনুবাদে কারচুপি করা হয়েছে, ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাদীছের উপর ছুরি চালান হয়েছে। বিশ্বশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ আলবানী (রহঃ)-এর বিশ্ব নন্দিত ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত’ বইটি এদেশে বিকৃত করে অনুবাদ করা হয়েছে। আলবানীর নামে সচিত্র নামায শিক্ষার মিথ্যা সিডি ছাড়া হয়েছে। প্রবীণ আলেমরা পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। কারণ তারা মাযহাবী জাল ছিন্ন করতে রাযী নন।

প্রচলিত ফেক্বহী গ্রন্থ ও বাজারের নামায শিক্ষা বই সম্পর্কে হুঁশিয়ারী :

রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাত সমাজ থেকে উঠে যাওয়ার কারণ হল, বিভিন্ন মাযহাব ও তরীক্বার নামে প্রণীত ফেক্বহী গ্রন্থ ও বাজারে প্রচলিত ‘নামায শিক্ষা’ বই। এগুলোই বিদ‘আতী ছালাতের ভিত্তি। লেখকগণ জাল ও যঈফ হাদীছ এবং মিথ্যা কাহিনীর মর্মান্তিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেননি। নিজেদের মাযহাবের কর্মকান্ডকে প্রমাণ করার জন্য জাল ও যঈফ হাদীছের আশ্রয় নিয়েছেন এবং নিজ নিজ মাযহাবের জন্য পৃথক পৃথক ফিক্বহী গ্রন্থ রচনা করেছেন। অনুরূপভাবে অন্য মাযহাবের দলীল খন্ডন করার জন্য রচনা করেছেন পৃথক পৃথক ফিক্বহী উছূল। ফক্বীহগণের এই করুণ বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে আল্লামা মারজানী হানাফী বলেন,

وَقَوْلُ الْفُقَهَاءِ يَحْتَمِلُ الْخَطَاءَ فِىْ أَصْلِهِ وَغَالِبُهُ خَالٍ عَنِ الْإِسْنَادِ ... فَإِنَّهُ يَحْتَمِلُ أَنْ يَكُوْنَ مَوْضُوْعًا قَدِ افْتَرَى عَلَيْهِ غَيْرَهُ.

‘ফক্বীহদের বক্তব্যে ভুল হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে গেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, সেগুলো সনদ বিহীন। .. নিঃসন্দেহে তা জাল হওয়ারই প্রমাণ বহন করে, যা অন্যের উপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে’।[47] আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী হানাফী (রহঃ) ফিক্বহ গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন,

فَكَمْ مِنْ كِتَابٍ مُعْتَمَدٍ اِعْتَمَدَ عَلَيْهِ أَجِلَّةُ الْفُقَهَاءِ مَمْلُوْءٌ مِنَ الْأَحَادِيْثِ الْمَوْضُوْعَةِ وَلاَ سِيَّمَا الْفَتَاوَى فَقَدْ وَضَّحَ لَنَا بِتَوْسِيْعِ النَّظْرِ أَنَّ أَصْحَابَهَا وَإِنْ كَانُوْا مِنَ الْكَامِلِيْنَ لَكِنَّهُمْ فِىْ نَقْلِ الْأَخْبَارِ مِنَ الْمُتَسَاهِلِيْنَ.

‘অনেক বিশ্বস্ত কিতাব, যার উপর বড় বড় ফক্বীহগণ নির্ভরশীল, সেগুলো জাল হাদীছ সমূহে পরিপূর্ণ। বিশেষ করে ফাতাওয়ার কিতাব সমূহ। গভীর দৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে যে, ঐ সকল গ্রন্থ প্রণয়নকারীগণ যদিও পূর্ণ ইলমের অধিকারী, কিন্তু হাদীছ সংকলনের ক্ষেত্রে তারা ছিলেন শিথিলতা প্রদর্শনকারী’।[48] অন্যত্র তিনি আরো পরিষ্কারভাবে সকলকে সাবধান করে দিয়ে বলেন,

أَلاَتَرَى إِلَى صَاحِبِ الْهِدَايَةِ مِنْ أَجِلَّةِ الْحَنَفِيَّةِ وَالرَّافِعِىِّ شَارِح ِالْوَجِيْزِ مِنْ أَجِلَّةِ الشَّافِعِيَّةِ مَعَ كَوْنِهِمَا مِمَّنْ يُشَارُ إِلَيْهَا بِالْأنَامِلِ وَيَعْتَمِدُ عَلَيْهِ الْأمَاجِدُ وَالْأَمَاثِلُ قَدْ ذَكَرَا فِىْ تَصَانِيْفِهِمَا مَالَمْ يُوْجَدْ لَهُ أَثَرٌ عِنْدَ خَبِيْرٍ بِالْحَدِيْثِ.

(হে পাঠক!) তুমি কি হেদায়া রচনাকারীকে দেখ না, যিনি শীর্ষস্থানীয় হানাফীদের অন্যতম? এছাড়া ‘আল-ওয়াজীয’-এর ভাষ্যকার রাফেঈকে দেখ না, যিনি শাফেঈদের শীর্ষস্থানীয়? এই দু’জন ঐ সকল প্রধান ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত, যাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয় এবং যাদের উপর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম ব্যক্তিগণ নির্ভর করে থাকেন। অথচ উক্ত কিতাবদ্বয়ে তারা এমন অনেক বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, মুহাদ্দিছগণের নিকট যেগুলোর কোন চিহ্ন পর্যন্ত পাওয়া যায় না’।[49] শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়াহ (৬৬১-৭২৮হিঃ) বহু পূর্বেই প্রভাবিত ফক্বীহদের সম্পর্কে বলে গেছেন,

وَجَمْهُوْرُ الْمُتَعَصِّبِيْنَ لاَيَعْرِفُوْنَ مِنَ الْكِتَابِ وَالسُّنَّةِ إِلاَّمَاشَاءَ اللهُ بَلْ يَتَمَسَّكُوْنَ بِأَحَادِيْثَ ضَعِيْفَةٍ وَآرَاءٍ فَاسِدَةٍ أَوْ حِكَايَاتٍ عَنْ بَعْضِ الْعُلَمَاءِ والشُّيُوْخِ.

‘মাশাআল­াহ দু’একজন ব্যতীত মাযহাবী গোঁড়ামী প্রদর্শনকারীদের কেউই কুরআন-সুন্নাহ বুঝেন না; বরং তারা অাঁকড়ে ধরেন যঈফ ও জাল হাদীছের ভান্ডার, বিভ্রান্তিকর রায়-এর বোঝা এবং কতক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি ও কথিত আলেমদের কল্প-কাহিনীর সমাহার’।[50]

সুধী পাঠক! আমাদের আলোচনা পড়লেই উক্ত মন্তব্যগুলোর বাস্তবতা প্রমাণিত হবে ইনশাআল্লাহ। উক্ত ফেক্বহী গ্রন্থ ছাড়াও অনেক বড় বড় বিদ্বান ছালাত সম্পর্কে বই লিখেছেন কিন্তু সেগুলোও জাল, যঈফ ও বানোয়াট কথাবার্তায় পরিপূর্ণ। প্রচলিত ‘তাবলীগ জামাআত’ কর্তৃক প্রণীত ‘ফাযায়েলে আমল’ বা ‘তাবলীগী নিছাব’ তার অন্যতম। বিভিন্ন ত্বরীকা ও যিকিরপন্থীদের বইগুলো তো মিথ্যা কাহিনীর ‘উপন্যাস সিরিজ’। বর্তমানে মুখরোচক শিরোনামে কিছু বই বাজারে ছাড়া হচ্ছে, যেগুলো প্রতারণা ও শঠতায় ভরপুর। তাই মুছল্লী হিসাবে ছালাত সংক্রান্ত মাসআলাগুলো যাচাই করা আবশ্যক।

সম্মানিত মুছল্লী!

বর্তমান সমাজে যে ছালাত প্রচলিত আছে, তা জাল ও যঈফ হাদীছ ভিত্তিক বানোয়াট ছালাত। রাসূল (ছাঃ) যে পদ্ধতিতে ছালাত আদায় করতেন, সেই পদ্ধতি কোন মসজিদেই চালু নেই বললেই চলে। ২৪১ হিজরীর পূর্বে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (১৬৪-২৪১ হিঃ) বলে গেছেন, ‘তুমি যদি এই যুগের একশ’ মসজিদেও ছালাত আদায় করো, তবুও তুমি কোন একটি মসজিদেও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের (রাঃ) ছালাত দেখতে পাবে না। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমাদের নিজেদের ছালাত এবং তোমাদের সাথে যারা ছালাত আদায় করে, তাদের ছালাতের প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখ’।[51]

বারোশ’ বছর পর আমরা যদি আজ তাঁর কথাটি বিশ্লেষণ করি, তাহলে আমরা আমাদের ছালাতের ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাব। তাই ভেজালমুক্ত ছালাত মুছল্লীর সামনে তুলে ধরার জন্যই ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছালাত’ শীর্ষক এই লেখনী। ওযূ ও তায়াম্মুম সংক্রান্ত আলোচনার পর ফরয ছালাতসহ অন্যান্য ছালাতে যে সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, সেগুলো উক্ত লেখনীতে সন্নিবেশিত হয়েছে। অতঃপর সঠিক পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। তাই নিজের ছালাতকে পরিশুদ্ধ করার জন্য প্রত্যেক মুছল্লীর কাছে এই বইটি থাকা অপরিহার্য বলে আমরা মনে করি। সেই সাথে যাদের সামর্থ্য আছে তাদের উচিৎ অন্য মুছল্লীর নিকট বইটি পৌঁছে দিয়ে সহযোগিতা করা। ফলে ঐ মুছল্লী বিশুদ্ধভাবে ছালাত আদায় করে যত ছওয়াব পাবেন, তার সমপরিমাণ ছওয়াব ঐ ব্যক্তিও পাবেন, যিনি সহযোগিতা করলেন।[52]পরিশেষে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি- তিনি যেন আমাদের এই খেদমতটুকু কবুল করেন। যারা বইটি প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং প্রকাশনায় সহযোগিতা করেছেন আল্লাহ যেন তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাতে প্রভূত কল্যাণ দান করেন- আমীন!!


[46]. ছহীহ মুসলিম হা/৫৫৬, ১/১১৮ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪২৫), ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; মিশকাত হা/২৮১, পৃঃ ৩৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৬২, ২/৩৮ পৃঃ।

[47]. নাযেরাতুল হক্ব-এর বরাতে আল-ইরশাদ, পৃঃ ১৪৬; হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, পৃঃ ১৪৬।

[48]. আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী, জামে‘ ছাগীর-এর ভূমিকা নাফে‘ কাবীর, পৃঃ ১৩; ছিফাতু ছালাতিন নবী, পৃঃ ৩৭।

[49]. আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌভী, আজওয়াবে ফাযেলাহ-এর বরাতে আল-ইরশাদ, পৃঃ ১৫৭; হাক্বীক্বাতুল ফিক্বহ, পৃঃ ১৫১।

[50]. ইমাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ, মাজমূউ ফাতাওয়া ২২/২৫৪-২৫৫।

[51]. আবুল হুসাইন ইবনে আবী ইয়ালা, ত্বাবাক্বাতুল হানাবিলাহ ১/৩৫০ পৃঃ- لَوْ صَلَّيْتَ فِىْ مِائَةِ مَسْجِدٍ مَا رَأَيْتَ أَهْلَ مَسْجِدٍ وَاحِدٍ يُقِيْمُوْنَ الصَّلاَةَ عَلَى مَا جَاءَ عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَنْ أَصْحَابِهِ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ فَاتَّقُوا اللهَ وَانْظُرُوْا فِىْ صَلاَتِكُمْ وَصَلاَةَ مَنْ يُّصَلِّىْ مَعَكُمْ

[52]. মুসলিম হা/৫০০৭; মিশকাত হা/২০৯।

ইসলাম পবিত্রতাকে ঈমানের অর্ধেক বলে স্বীকৃতি দিয়েছে[1] এবং ‘পবিত্রতা ছালাতের চাবি’ বলেও ঘোষণা করেছে।[2] তাই মুসলিম মাত্রই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সর্বদা সচেতন থাকবে, যাতে ঈমান জাগ্রত থাকে। বিশেষ করে ছালাতের ওযূর ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দিবে। কারণ ওযূ না হলে ছালাত হবে না।[3] সুতরাং ওযূ বিষয়ে যে সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, সেগুলো আমাদেরকে সংশোধন করে নিতে হবে।

(১) মিসওয়াক করার ফযীলত ৭০ গুণ :

শরী‘আতে মিসওয়াক করার গুরুত্ব অনেক। তবে মিসওয়াক করার ফযীলত সম্পর্কে বর্ণিত উক্ত প্রসিদ্ধ কথাটি জাল।

(أ) عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  تَفْضُلُ الصَّلاَةُ الَّتِىْ يُسْتَاكُ لَهَا عَلَى الصَّلاَةِ الَّتِى لاَ يُسْتَاكُ لَهَا سَبْعِيْنَ ضِعْفًا.

(ক) আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ছালাত মিসওয়াক করে আদায় করা হয়, সেই ছালাতে মিসওয়াক করা বিহীন ছালাতের চেয়ে ৭০ গুণ বেশী নেকী হয়।[4]

তাহক্বীক্ব : ইমাম বায়হাক্বী উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন,

وَقَدْ رَوَاهُ مُعَاوِيَةُ بْنُ يَحْيَى الصَّدَفِىُّ عَنِ الزُّهْرِىِّ وَلَيْسَ بِالْقَوِىِّ وَرُوِىَ مِنْ وَجْهٍ آخَرَ عَنْ عُرْوَةَ عَنْ عَائِشَةَ وَمِنْ وَجْهٍ آخَرَ عَنْ عَمْرَةَ عَنْ عَائِشَةَ وَكِلاَهُمَا ضَعِيْفٌ وَفِىْ طَرِيْقِ الْوَجْهِ الْآخِرِ عَنْ عُرْوَةَ الْعَاقِدِىِّ وَ هُوَ كَذَّابٌ.

মু‘আবিয়া ইবনু ইয়াহইয়া যুহরী থেকে বর্ণনা করেছে। সে নির্ভরযোগ্য নয়। অন্য সূত্রে উরওয়া আয়েশা থেকে বর্ণনা করেছে। কিন্তু তারা উভয়েই যঈফ। অন্য সূত্রে উরওয়া আক্বেদী থেকে বর্ণনা করেছে। কিন্তু সে মিথ্যুক।[5]

(ب) رَكْعَتَانِ بِسِوَاكٍ أَفْضَلُ مِنْ سَبْعِيْنَ رَكْعَةً بِغَيْرِ سِوَاكٍ.

(খ) মিসওয়াক করে দুই রাক‘আত ছালাত আদায় করা- মিসওয়াক বিহীন সত্তর রাক‘আত ছালাত পড়ার সমান।[6] উল্লেখ্য, প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের অন্যতম প্রবক্তা মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ কান্দালভী প্রণীত ‘মুন্তাখাব হাদীস’ গ্রন্থে ফযীলত সংক্রান্ত অনেক জাল বা মিথ্যা হাদীছ উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত বর্ণনাটি তার অন্যতম।[7]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। ইমাম বাযযার বলেন, এর সনদে মু‘আবিয়া নামে একজন রাবী রয়েছে। সে ছাড়া আর কেউ এই হাদীছ বর্ণনা করেনি। ইবনু হাজার আসক্বালানী তাকে যঈফ বলেছেন। এছাড়া মুহাম্মাদ ইবনু ওমর নামে আরেকজন রাবী রয়েছে। সে মিথ্যুক।[8]

(ج) عَنْ زَيْدِ بنِ خَالِدٍ الْجُهَنِيِّ قَالَ مَا كَانَ رَسُوْلُ اللهِ  يَخْرُجُ مِنْ ِشَيْءٍ مِنَ الصَّلَوَاتِ حَتَّى يَسْتَاكَ.

(গ) যায়েদ ইবনু খালেদ আল-জুহানী (রাঃ) বলেন, মিসওয়াক না করে রাসূল (ছাঃ) কোন ছালাতের জন্য বাড়ী থেকে বের হতেন না।[9]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ।[10]

(د) عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ فِى السِّوَاكِ عَشْرُ خِصَالٍ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ تَعَالَى وَمَسْخَطَةٌ لِلشَّيْطَانِ وَمَفْرَحَةٌ لِلْمَلاَئِكَةِ جَيِّدٌ لِلَّثَةِ وَيُذْهِبُ بِالْحَفْرِ وَيَجْلُو الْبَصَرَ وَيُطَيِّبُ الْفَمَ وَيُقَلِّلُ الْبَلْغَمَ وَهُوَ مِنَ السُّنَّةِ وَيَزِيْدُ فِى الْحَسَنَاتِ.

(ঘ) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, মিসওয়াকের ১০টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। (১) মহান প্রতিপালকের সন্তুষ্টি (২) শয়তানের অসন্তুষ্টি (৩) ফেরেশতাদের জন্য আনন্দ (৪) আলজিভের সৌন্দর্য (৫) দাঁতের আবরণ দূর করে (৬) চোখকে জ্যোতিময় করে (৭) মুখকে পবিত্র করে (৮) কফ হরাস করে (৯) এটি সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত (১০) নেকী বৃদ্ধি করে।[11]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি নিতান্তই যঈফ। ইমাম দারাকুৎনী হাদীছটি বর্ণনা করে বলেন, মু‘আল্লা ইবনু মাঈন দুর্বল ও পরিত্যক্ত রাবী।[12]

(ه) عَنِ بْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ  قَالَ السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ وَمَجْلاَةٌ ِللْبَصَرِ.

(ঙ) ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, মিসওয়াক মুখ পরিষ্কারকারী, প্রতিপালকের সন্তুষ্টির কারণ ও চোখের জন্য জ্যোতিময়।[13]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। ইমাম ত্বাবারাণী বলেন, হারিছ বিন মুসলিম ছাড়া বাহরে সিক্বা থেকে অন্য কেউ এই হাদীছ বর্ণনা করেননি।[14]

(و) عَنْ أَبِيْ أُمَامَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ  قَالَ تَسَوَّكُوْا فَإِنَّ السِّوَاكَ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ مَا جَاءَنِىْ جِبْرِيْلُ إِلَّا أَوْصَانِىْ بِالسِّوَاكِ حَتَّى لَقَدْ خَشِيْتُ أَنْ يُفْرَضَ عَلَيَّ وَعَلَى أُمَّتِىْ وَلَوْلاَ أَنِّىْ أَخَافُ أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِىْ لَفَرَضْتُهُ لَهُمْ وَإِنِّىْ لَأَسْتَاكُ حَتَّى لَقَدْ خَشِيْتُ أَنْ أُحْفِيَ مَقَادِمَ فَمِىْ.

(চ) আবু উমামা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা মিসওয়াক কর। নিশ্চয়ই মিসওয়াক মুখ পরিষ্কারকারী ও আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ। যখনই জিবরীল আমার নিকট আসেন, তখনই আমাকে মিসওয়াক করার জন্য বলেন। এমনকি আমি ভয় করি যে, আমার ও আমার উম্মতের উপর তা ফরয করা হয় কি-না। আমার উম্মতের উপর কঠিন হয়ে যাওয়ার ভয় না করলে মিসওয়াক করা আমি উম্মতের উপর ফরয করে দিতাম। আমি মিসওয়াক করতেই থাকি এমনকি আশংকা করি যে, আমি হয়ত আমার মুখের সামনের দিক ক্ষয় করে ফেলব।[15]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। উক্ত বর্ণনার সনদে অনেক ত্রুটি রয়েছে। ওছমান ইবনু আবীল আতেকা নামক একজন রাবী রয়েছে। ইমাম আহমাদ, ইবনু মাঈন এবং নাসাঈ তাকে যঈফ বলেছেন। এছাড়াও আলী ইবনু যায়েদ আবু আব্দিল মালেক নামের একজন রাবী রয়েছে। ইমাম বুখারী তাকে মুনকার বলেছেন। ইবনু হাতেম এই হাদীছকে যঈফ বলেছেন।[16]

(ز) عَنْ أَبِىْ أَيُّوْبَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  أَرْبَعٌ مِنْ سُنَنِ الْمُرْسَلِيْنَ الْحَيَاءُ وَالتَّعَطُّرُ وَالسِّوَاكُ وَالنِّكَاحُ.

(ছ) আবু আইয়ূব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, চারটি বিষয় নবীদের সুন্নাত। (ক) লজ্জা করা। অন্য বর্ণনায় খাতনা করার কথা রয়েছে (খ) সুগন্ধি ব্যবহার করা (গ) মিসওয়াক করা ও (ঘ) বিবাহ করা।[17]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। উক্ত বর্ণনায় কয়েকটি ত্রুটি রয়েছে। আইয়ূব ও মাকহূলের মাঝে রাবী বাদ পড়েছে। হাজ্জাজ বিন আরত্বাহ নামক রাবীর দোষ রয়েছে। এছাড়াও এর সনদে আবু শিমাল রয়েছে। তাকে আবু যুর‘আহ ও ইবনু হাজার আসক্বালানী অপরিচিত বলেছেন।[18]

[1]. ছহীহ মুসলিম হা/৫৫৬, ১/১১৮ পৃঃ, (ইফাবা হা/৪২৫), ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ-১; মিশকাত হা/২৮১, পৃঃ ৩৮; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৬২, ২/৩৭ পৃঃ।

[2]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/৬১, ১/৯ পৃঃ; তিরমিযী হা/৩, ১/৫ পৃঃ; মিশকাত হা/৩১২, পৃঃ ৪০; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৯১, ২/৫১ পৃঃ।

[3]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/১০১, ১/১৪ পৃঃ; ছহীহ ইবনে মাজাহ হা/৩৯৮ ও ৩৯৯, পৃঃ ৩২; মিশকাত হা/৪০৪, পৃঃ ৪৬; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৭০, ২/৮২, ‘ওযূর সুন্নাত সমূহ’ অনুচ্ছেদ।

[4]. বায়হাক্বী, সুনানুল কুবরা হা/১৫৯, ১ম খন্ড, পৃঃ ৬১-৬২; হাকেম হা/৫১৫; ইবনু খুযায়মাহ হা/১৩৭; মিশকাত হা/৩৮৯, পৃঃ ৪৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৫৯, ২/৭৬ পৃঃ।

[5]. আলবানী, মিশকাত হা/৩৮৯-এর টীকা দ্রঃ, ১/১২৪ পৃঃ।

[6]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হা/১৮০৩; মুসনাদে বাযযার ১/২৪৪ পৃঃ।

[7]. ঐ, মুন্তাখাব হাদীস, অনুবাদ : মাওলানা মুহাম্মাদ সা‘আদ (ঢাকা : দারুল কুতুব, দ্বিতীয় প্রকাশ : আগস্ট ২০১০), পৃঃ ২৯৯।

[8].لا نعلم رواه إلا معاوية قلت وهو الصدفي قال الحافظ ضعيف সিলসিলা যঈফাহ হা/১৫০৩-এর ভাষ্য দ্রঃ; যঈফুল জামে‘ আছ-ছাগীর হা/৩১২৭।

[9]. ত্বাবারাণী হা/৫২৬১; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ৩০০।

[10]. যঈফ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব হা/১৪৩।

[11]. দারাকুৎনী ১/৫৮; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪০১৬, ৯/২১ পৃঃ; ফাযায়েলে আমল (বাংলা) ফাযায়েলে নামায অংশ, পৃঃ ৬৮-৬৯।

[12]. مُعَلَّى بْنُ مَيْمُوْنٍ ضَعِيْفٌ مَتْرُوْكٌ -দারাকুৎনী ১/৫৮; সিলসিলা যঈফাহ হা/৪০১৬, ৯/২১ পৃঃ।

[13]. ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৭৪৯৬।

[14]. لم يرو هذا الحديث عن بحر السقاء إلا الحارث بن مسلم -আল-মু‘জামুল আওসাত্ব হা/৭৪৯৬; সিলসিলা যঈফাহ হা/৫২৭৬।

[15]. যঈফ ইবনু মাজাহ হা/২৮৯, পৃঃ ২৫; আহমাদ হা/২২৩২৩; ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭৭৯৬; মিশকাত হা/৩৮৬, পৃঃ ৪৫; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৫৬, ২/৭৫ পৃঃ; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯৮।

[16]. علي بن زيد أبو عبد الملك الألهاني الدمشقي قال فيه البخاري منكر الحديث، وقال ابن حاتم الرازي ضعيف الحديث، أحاديثه منكرة، মুগাল্লাত্বঈ, শরহে সুনানে ইবনে মাজাহ (সঊদী আরব : মাকতাবাহ নিযার মুছত্বফা আল-বায, ১৪১৯ হিঃ), ১/৬২ পৃঃ।

[17]. যঈফ তিরমিযী হা/১০৮০, ১/২০৬; মিশকাত হা/৩৮২, পৃঃ ৪৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৫২, ২/৭৪ পৃঃ, ‘মিসওয়াক করা’ অনুচ্ছেদ; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ২৯৭।

[18]. মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী, ইরওয়াউল গালীল ফী তাখরীজে আহাদীছি মানারিস সাবীল (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ১৪০৫/১৯৮৫), হা/৭৫, ১ম খন্ড, পৃঃ ১১৭।
(২) যায়তুন দ্বারা মিসওয়াক করা ফযীলতপূর্ণ

যায়তুন দ্বারা মিসওয়াক করার জন্য উৎসাহ প্রদান করা হয় এবং বিশেষ গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়। অথচ এর পক্ষে শারঈ কোন বিধান নেই। এ মর্মে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা জাল।

(أ) عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ  قَالَ نِعْمَ السِّوَاكُ الزَّيْتُوْنُ مِنْ شَجَرةٍ مُبارَكَةٍ يُطَيِّبُ الْفَمَ ويُذْهِبُ الحَفْرَ وَهُوَ سِوَاكِىْ وسِوَاكُ الْأَنْبِيَاءِ قَبْلِىْ.

(ক) মু‘আয বিন জাবাল বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, উত্তম মিসওয়াক হল বরকতপূর্ণ যায়তুন গাছ, যা মুখকে পবিত্র করে ও দাঁতের আবরণ দূর করে। এটা আমার মিসওয়াক ও আমার পূর্বের নবীগণের মিসওয়াক।[1]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। উক্ত বর্ণনার সনদে মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্ব আল-উকাশী নামে একজন মিথ্যুক রাবী আছে। ইমাম যাহাবী, দারাকুৎনী, ইবনু হাজার আসক্বালানী সহ অন্যান্য মুহাদ্দিছও তাকে মিথ্যুক বলে অভিহিত করেছেন।[2] ইমাম হায়ছামী বলেন, এর সনদে মুহাম্মাদ ইবনু মুহছিন উকাশীও আছে। সে চরম মিথ্যাবাদী।[3]

(ب) عَنْ أَبِىْ خَيْرَةَ الصَّبَّاحِىِّ قَالَ كُنْتُ فِى الْوَفْدِ الَّذِيْنَ أَتَوْا رَسُوْلَ اللهِ  مِنْ عَبْدِ الْقَيْسِ فَزَوَّدَنَا الأَرَاكَ نَسْتَاكُ بِهِ فَقُلْنَا يَا رَسُوْلَ اللهِ عِنْدَنَا الْجَرِيْدُ وَلَكِنَّا نَقْبَلُ كَرَامَتَكَ وَعَطِيَّتَكَ فَقَالَ رَسُوْلُ اللهِ  اللهُمَّ اغْفِرْ لِعَبْدِ الْقَيْسِ إِذْ أَسْلَمُوْا طَائِعِيْنَ غَيْرَ مُكْرَهِيْنَ إِذْ قَعَدَ قَوْمِىْ لَمْ يُسْلِمُوْا إِلاَّ خَزَايَا مَوْتُوْرِيْنَ.

(খ) আবু খায়রাহ ছববাহী (রাঃ) বলেন, আমি আব্দুল ক্বায়স প্রতিনিধি দলের সাথে ছিলাম, যারা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে গিয়েছিল। তিনি পাথেয় বাবদ মিসওয়াক করার জন্য আমাদেরকে আরাক গাছের ডাল দিলেন, যাতে আমরা তা দ্বারা মিসওয়াক করি। আমরা বললাম, আমাদের নিকট মিসওয়াক করার জন্য খেজুরের ডাল রয়েছে। তবে আমরা আপনার সম্মানজনক দান গ্রহণ করছি। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! আব্দুল ক্বায়েসের প্রতিনিধি দলকে ক্ষমা করুন। কারণ তারা আনুগত্য স্বীকার করে ইসলাম গ্রহণ করেছে, অসন্তুষ্টিতে নয়। আর আমার সম্প্রদায় অপমানিত ও তীর-ধনুকের কবলে না পড়ে ইসলাম গ্রহণ করেনি।[4]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি যঈফ। এর সনদে দাঊদ ইবনু মাসাওয়ার নামক রাবী রয়েছে। সে অপরিচিত, কেউ তাকে নির্ভরযোগ্য বলেননি। তার শিক্ষক মুক্বাতিল বিন হুমামও অপরিচিত।[5]

[1]. ত্বাবারাণী, আল-আওসাত্ব, হা/৬৮৯।

[2]. আহমাদ ইবনু আলী ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী, তাহযীবুত তাহযীব (বৈরুত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১৪১৫/১৯৯৪), ৯/৩৭১ পৃঃ।

[3]. فيه محمد بن محصن العكاشي وهو كذاب সিলসিলা যঈফাহ হা/৫৩৬০ ও ৫৫৭০।

[4]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/১৮৩৫৯; মুন্তাখাব হাদীস, পৃঃ ৩০০।

[5]. ইমাম বুখারী, তারীখুল কাবীর ৩/২৪৭ পৃঃ।

মিসওয়াক দ্বারাই মুখ পরিষ্কার করা সুন্নাত। মিসওয়াক না থাকলে আঙ্গুল দ্বারা মিসওয়াক করা যায়। কিন্তু শুধু আঙ্গুল দ্বারা মিসওয়াক করাই যথেষ্ট, একথা ঠিক নয়। এর পক্ষে যে হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তা জাল।

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ  قَالَ يَجْزِئ مِنَ السِّوَاكِ الْأَصَابِعُ.

আনাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেন, আঙ্গুল দ্বারা মিসওয়াক করাই যথেষ্ট।[1]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে আবু গাযিয়া নামক একজন রাবী রয়েছে। সে মুহাদ্দিছগণের ঐকমত্যে যঈফ। বরং দারাকুৎনী তাকে হাদীছ জালকারী বলে অভিযুক্ত করেছেন। এছাড়াও কাছীর ইবনু আব্দুল্লাহ আল-মুযানী নামক রাবীকেও মুহাদ্দিছগণ মিথ্যুক বলেছেন। তাছাড়া আরো অনেক ত্রুটি রয়েছে।[2]

[1]. বায়হাক্বী ১/৪০, ইবনু আদী ৫/৩৩৪।

[2]. اتفقوا على تضعيفه ، بل اتهمه الدارقطني بالوضع সিলসিলা যঈফাহ হা/২৪৭১; ইরওয়াউল গালীল হা/৬৯; যঈফুল জামে হা/৬৪১৫।
(৪) ছিয়াম অবস্থায় কাঁচা ডাল দ্বারা মিসওয়াক না করা

উক্ত ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। বরং কাঁচা হোক শুকনা হোক যেকোন ডাল দ্বারা মিসওয়াক করা যাবে।[1]

উল্লেখ্য, তাবলীগ জামাআতের ‘ফাযায়েলে আমল’ বইয়ে বলা হয়েছে, ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, মিসওয়াকের এহতেমাম করার মধ্যে সত্তরটি উপকার রয়েছে। তার মধ্যে একটি মৃত্যুর সময় কালেমায়ে শাহাদত নসীব হয়।[2] উক্ত দাবী উদ্ভট ও ভিত্তিহীন। এভাবে শরী‘আতকে হেই প্রতিপন্ন করা হয়েছে।

মিসওয়াক সম্পর্কে ছহীহ হাদীছ :

عَنْ عَائِشَةَ عَن النَّبِيِّ  قَالَ السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ.

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মিসওয়াক হল মুখ পরিষ্কারকারী এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণ’।[3]

عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ أَمَرَ بِالسِّوَاكِ وَقَالَ قَالَ النَّبِيُّ  إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا تَسَوَّكَ ثُمَّ قَامَ يُصَلِّي قَامَ الْمَلَكُ خَلْفَهُ فَتَسَمَّعَ لِقِرَاءَتِهِ فَيَدْنُو مِنْهُ أَوْ كَلِمَةً نَحْوَهَا حَتَّى يَضَعَ فَاهُ عَلَى فِيْهِ فَمَا يَخْرُجُ مِنْ فِيْهِ شَيْءٌ مِنَ الْقُرْآنِ إِلاَّ صَارَ فِىْ جَوْفِ الْمَلَكِ فَطَهِّرُوْا أَفْوَاهَكُمْ لِلْقُرْآنِ.

আলী (রাঃ) মিসওয়াক করার নির্দেশ দান করতেন এবং বলতেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘নিশ্চয় বান্দা যখন মিসওয়াক করে ছালাত আদায়ের জন্য দাঁড়ায়, তখন ফেরেশতা তার পিছনে দাঁড়ায়। অতঃপর তার ক্বিরাআত শুনতে থাকে এবং তার কিংবা তার কথার নিকটবর্তী হয়। এমনকি ফেরেশতার মুখ তার মুখের উপর রাখে। তার মুখ থেকে কুরআনের যা বের হয়, তা ফেরেশতার পেটের মাঝে প্রবেশ করে। সুতরাং তোমরা কুরআন তেলাওয়াতের জন্য মুখ পরিষ্কার রাখ’।[4] উল্লেখ্য, মিসওয়াকের গুরুত্ব সম্পর্কে আরো অনেক হাদীছ রয়েছে।

[1]. ছহীহ বুখারী হা/১৯৩৪, ১/২৫৯ পৃঃ, ‘ছিয়াম’ অধ্যায়-৩৬, অনুচ্ছেদ-২৭- بَابُ سِوَاكِ الرَّطْبِ وَالْيَابِسِ لِلصَّائِمِ।

[2]. ফাযায়েলে নামায অংশ, ৬৯ পৃঃ।

[3]. ছহীহ নাসাঈ হা/৫, ১/৩ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৮১, পৃঃ ৪৪; বঙ্গানুবাদ হা/৩৫১, ২/৭৪ পৃঃ; ইরওয়া হা/৬৬।

[4]. আবুবকর আহমাদ ইবনু আমর আল-বাছরী আল-বাযযার, মুসনাদুল বাযযার হা/৬০৩, ১/১২১ পৃঃ; সনদ জাইয়িদ, সিলসিলা ছহীহাহ হা/১২১৩, ৩/২৮৭ পৃঃ।
(৫) মাথায় টুপি দিয়ে বা মাথা ঢেকে টয়লেটে যাওয়া

পেশাব-পায়খানায় যাওয়ার সময় মাথায় টুপি দেওয়া বা মাথা ঢেকে যাওয়ার প্রথা সমাজে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এর শারঈ কোন ভিত্তি নেই। উক্ত মর্মে যে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে তা জাল।

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ كَانَ النَّبِىُّ  إِذَا دَخَلَ الْخَلاَءَ غَطَّى رَأْسَهُ وَإِذَا أَتَى أَهْلَهُ غَطَّى رَأْسَهُ.

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) যখন পায়খানায় প্রবেশ করতেন, তখন তাঁর মাথা ঢেকে নিতেন এবং যখন স্ত্রী সহবাস করতেন, তখনও মাথা ঢাকতেন।[1]

তাহক্বীক্ব : হাদীছটি জাল। এর সনদে মুহাম্মাদ ইবনু ইউনুস আল-কাদীমী নামক রাবী রয়েছে। সে এই হাদীছ জাল করেছে। এছাড়া তার শিক্ষক আলী ইবনু হাইয়ান আল-মাখযূমীকে ইবনু হাজার আসক্বালানী মাতরূক বলেছেন। এছাড়া অন্যান্য মুহাদ্দিছও এই হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।[2]

[1]. বায়হাক্বী, আস-সুনানুল কুবরা হা/৪৬৪।

[2]. সিলসিলা যঈফাহ হা/৪১৯২।
(৬) পানি থাকা সত্ত্বেও কুলুখ নেওয়া অথবা কুলুখ নেওয়ার পর পুনরায় পানি নিয়ে ইস্তিঞ্জা করা

পানি থাকা অবস্থায় কুলুখ নেওয়া শরী‘আত সম্মত নয়। পানি না পাওয়া গেলে কুলুখ নেওয়া যাবে। তবে পুনরায় পানি ব্যবহার করতে হবে না। কুলুখ নেওয়ার পর পানি নেওয়া সম্পর্কে যে হাদীছ বর্ণনা করা হয় তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ نَزَلَتْ هَذِهِ الآيَةُ فِىْ أَهْلِ قُبَاءَ فِيْهِ رِجَالٌ يُحِبُّوْنَ أَنْ يَتَطَهَّرُوْا وَاللهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِيْنَ فَسَأَلَهُمْ رَسُوْلُ اللهِ ؟ فَقَالُوْا نَتَّبِعُ الْحِجَارَةَ الْمَاءَ.

ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, নিম্নোক্ত আয়াত কুবাবাসীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। ‘এতে এমন কতিপয় লোক রয়েছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্র হওয়াকে ভালবাসে। আর আল্লাহ উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জনকারীকে ভালবাসেন’ (তওবা ১০৮)। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেছিল, (আমরা ইস্তিঞ্জা করার সময়) ঢিল নেওয়ার পর পানি নিই।

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল বা মিথ্যা। এই বর্ণনার কোন ভিত্তি পাওয়া যায় না।[1] ইমাম বাযযার এটি বর্ণনা করে বলেন, ‘যুহরী থেকে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল আযীয ছাড়া অন্য কেউ একে বর্ণনা করেছেন বলে আমার জানা নেই। আর সে তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছে।[2] ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২ হিঃ) বলেন,

مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ الْعَزِيْزِ ضَعَّفَهُ أَبُوْ حَاتِمٍ فَقَالَ لَيْسَ لَهُ وَلَا لِأَخَوَيْهِ عِمْرَانَ وَعَبْدِ اللهِ حَدِيْثٌ مُسْتَقِيْمٌ وَعَبْدُ اللهِ بْنُ شَبِيْبٍ ضَعِيْفٌ أَيْضًا.

মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল আযীযকে আবু হাতেম যঈফ বলেছেন। তিনি আরো বলেন, তার ও তার দুই ভাই ইমরান ও আব্দুল্লাহ কারো একটি হাদীছও সঠিক নয়। তাছাড়া আব্দুল্লাহ ইবনু শাবীবও দুর্বল।[3]

উক্ত বর্ণনার বিরোধী ছহীহ হাদীছ :

উক্ত হাদীছ যে জাল তার বাস্তব প্রমাণ হল নিম্নের ছহীহ হাদীছ, যেখানে ঢিলের কথাই নেই।

عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِىِّ  قَالَ نَزَلَتْ هَذِهِ الآيَةُ فِى أَهْلِ قُبَاءَ فِيْهِ رِجَالٌ يُحِبُّوْنَ أَنْ يَتَطَهَّرُوْا قَالَ كَانُوْا يَسْتَنْجُوْنَ بِالْمَاءِ فَنَزَلَتْ فِيْهِمْ هَذِهِ الآيَةُ.

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এই আয়াতটি কুবাবাসীদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। ‘এতে এমন কতিপয় লোক রয়েছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্র হওয়াকে ভালবাসে’ (তওবা ১০৮)। তিনি বলেন, তারা পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করত।[4] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ أَيُّوْبَ الْأَنْصَارِيِّ وَجَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ وَأَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّ هَذِهِ الْآيَةَ نَزَلَتْ فِيْهِ رِجَالٌ يُحِبُّوْنَ أَنْ يَتَطَهَّرُوْا وَاللهُ يُحِبُّ الْمُطَّهِّرِيْنَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ  يَا مَعْشَرَ الْأَنْصَارِ إِنَّ اللهَ قَدْ أَثْنَى عَلَيْكُمْ فِى الطُّهُوْرِ فَمَا طُهُوْرُكُمْ قَالُوْا نَتَوَضَّأُ لِلصَّلَاةِ وَنَغْتَسِلُ مِنْ الْجَنَابَةِ وَنَسْتَنْجِىْ بِالْمَاءِ قَالَ فَهُوَ ذَاكَ فَعَلَيْكُمُوْهُ.

আবু আইয়ূব আনছারী, জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ ও আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, নিশ্চয়ই এই আয়াত যখন অবতীর্ণ হয়- ‘তথায় (কুবায়) এমন কতিপয় লোক রয়েছে, যারা পবিত্রতা লাভ করাকে ভালবাসে এবং আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, হে আনছারগণ! এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের পবিত্রতার প্রশংসা করেছেন। তোমরা কিভাবে পবিত্রতা অর্জন কর? তারা বলল, আমরা ছালাতের জন্য ওযূ করে থাকি, অপবিত্রতা হতে গোসল করে থাকি এবং পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করে থাকি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, এটাই তার কারণ। সুতরাং তোমরা সর্বদা এটা করতে থাকবে।[5]

মূল কথা হল, অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীরা শুধু ঢিল দ্বারা ইস্তিঞ্জা করত। কিন্তু কুবাবাসীরা অন্যদের তুলনায় শুধু পানি দিয়ে ইস্তিঞ্জা করতেন। সে জন্যই আল্লাহ তাদের প্রশংসা করেছেন।

আরেকটি জাল হাদীছ :

عَنْ عَائِشَةَ رَضِىَ اللهُ عَنْهَا مُرْنَ أَزْوَاجَكُنَّ أَنْ يَتَّبِعُوْا الْحِجَارَةَ بِالْمَاءِ مِنْ أَثَرِ الْغَائِطِ وَالْبَوْلِ فَإِنِّيْ أَسْتَحْيِيْهِمْ وَإِنَّ النَّبِيَّ  كاَنَ يَفْعَلُهُ.

আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘তোমরা তোমাদের স্বামীদেরকে বলে দাও, তারা যেন পেশাব-পায়খানার সময় ঢিল নেওয়ার পর পানি ব্যবহার করে। আমি তাদেরকে বলতে লজ্জাবোধ করছি। কারণ রাসূল (ছাঃ) এটা করেন।[6]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল। এ শব্দে কোন বর্ণনা নেই। শায়খ আলবানী (রহঃ) বলেন, এর কোন ভিত্তি নেই।[7] উক্ত বর্ণনার বিরোধী সরাসরি ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেখানে কুলুখ নেওয়ার কথা নেই; বরং শুধু পানি নেওয়ার কথা রয়েছে। যেমন-

عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ مُرْنَ أَزْوَاجَكُنَّ أَنْ يَسْتَطِيْبُوْا بِالْمَاءِ فَإِنِّىْ أَسْتَحْيِيْهِمْ فَإِنَّ رَسُوْلَ اللهِ  كَانَ يَفْعَلُهُ.

আয়েশা (রাঃ) বলেন, তোমরা তোমাদের স্বামীদের বলে দাও, তারা যেন পানি দ্বারা পবিত্রতা হাছিল করে। কারণ আমি তাদেরকে বলতে লজ্জাবোধ করছি। নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা করে থাকেন।[8]

অতএব সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত উক্ত মিথ্যা প্রথাকে অবশ্যই উচ্ছেদ করতে হবে। পানি থাকা সত্ত্বেও যেন কোন স্থানে কুলুখের স্তূপ সৃষ্টি না হয়। কারণ প্রকৃত ফযীলত পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করার মধ্যেই রয়েছে।

[1]. সিলসিলা যঈফাহ হা/১০৩১-এর ভাষ্য দ্রঃ।

[2]. لا نعلم أحدا رواه عن الزهري الا محمد بن عبد العزيز ولا عنه الا ابنه- তালখীছ, পৃঃ ৪১, দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল হা/৪২, ১/৮২ পৃঃ।

[3]. ইবনু হাজার আল-আসক্বালানী, তালখীছুল হাবীর ফী আহাদীছির রাফইল কাবীর হা/১৫১; দ্রঃ ইরওয়াউল গালীল হা/৪২, ১/৮২ পৃঃ।

[4]. আবুদাঊদ হা/৪৪, ১/৭ পৃঃ, ‘পবিত্রতা’ অধ্যায়-১, অনুচ্ছেদ-২৩, সনদ ছহীহ; মুস্তাদরাক হাকেম হা/৬৭৩।

[5]. ছহীহ ইবনে মাজাহ হা/৩৫৫, পৃঃ ২৯-এর শেষ হাদীছ, সনদ ছহীহ; মিশকাত হা/৩৬৯, পৃঃ ৪৪; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৪১, ‘পেশাব-পায়খানার শিষ্টাচার’ অনুচ্ছেদ; আলোচনা দ্রঃ সিলসিলা যঈফাহ হা/১০৩১, ৩/১১৩ পৃঃ।

[6]. ইরওয়াউল গালীল হা/৪২।

[7]. ইরওয়াউল গালীল ১/৮২ পৃঃ।

[8]. ছহীহ তিরমিযী হা/১৯, ১/১১ পৃঃ; ছহীহ নাসাঈ হা/৪৬, ১/৮ পৃঃ।

কুলুখ নিয়ে চল্লিশ কদম হাঁটা, কাশি দেওয়া, নাচানাচি করা, দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকা, টয়লেটে কুলুখের আবর্জনার স্তূপ তৈরি করা সবই নব্য মূর্খতা। ইসলামে এরূপ বেহায়াপনার কোন স্থান নেই। মিথ্যা ফযীলতের ধোঁকা মানুষকে এত নীচে নামিয়েছে। উল্লেখ্য যে, পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের পেশাবে অপবিত্রতার মাত্রা বেশী।[1] অথচ তাদের ব্যাপারে এ ধরনের চরম ফতোয়া দেয়া হয় না। অনুরূপভাবে একই ব্যক্তি যখন টয়লেট থেকে বের হয় তখন কিন্তু হাঁটাহাঁটি করে না, কুলুখও ধরে না। এগুলো তামাশা মাত্র। এই অভ্যাস ইসলামের বিশ্বজনীন মর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। ইসলাম সৌন্দর্য মন্ডিত জীবন বিধান। যাবতীয় নোংরামী এখানে নিষিদ্ধ। শরী‘আতে পেশাব থেকে সাবধানতা অবলম্বনের কথা বলা হয়েছে। তাই বলে এর নামে নতুন আরেকটি বিদ‘আত তৈরি করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। পেশাবের ছিটা কাপড়ে লেগে যাওয়ার আশংকায় ইসলাম তার জন্য সুন্দর বিধান দিয়েছে। আর তা হল, ওযূ করার পর হাতে পানি নিয়ে লজ্জাস্থান বরাবর ছিটিয়ে দেওয়া। যেমন-

كَانَ رَسُوْلُ اللهِ  إِذَا بَالَ يَتَوَضَّأُ وَيَنْتَضِحُ.

‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন পেশাব করতেন, তখন ওযূ করতেন এবং পানি ছিটিয়ে দিতেন’।[2] অতএব প্রচলিত বেহায়াপনার আশ্রয় নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। নারী-পুরুষ সকলকে এ ব্যাপারে সাবধান ও সতর্ক থাকতে হবে।

[1]. আবুদাঊদ হা/৩৭৬, ১/৫৪ পৃঃ; সনদ ছহীহ, মিশকাত হা/৫০২, পৃঃ ৫২; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৪৬৮, ২/১২৫ পৃঃ, ‘পবিত্র’ অধ্যায়, ‘অপবিত্রতা হতে পবিত্রকরণ’ অনুচ্ছেদ- يُغْسَلُ مِنْ بَوْلِ الْجَارِيَةِ وَيُرَشُّ مِنْ بَوْلِ الْغُلاَمِ ; বুখারী হা/২২২ ও ২২৩।

[2]. ছহীহ আবুদাঊদ হা/১৬৬ ও ৬৭, ১/২২ পৃঃ; মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৫১৫; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৮৪১; মিশকাত হা/৩৬৬ পৃঃ ৪৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৩৮, ২/৬৮ পৃঃ; ছহীহ নাসাঈ হা/১৬৮; মিশকাত হা/৩৬১, পৃঃ ৪৩; বঙ্গনুবাদ মিশকাত হা/৩৩৪, ২/৬৭ পৃঃ।
(৮) ওযূর অবশিষ্ট পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা যাবে না এবং ইস্তিঞ্জা করার পর অবশিষ্ট পানি দ্বারা ওযূ করা যাবে না বলে ধারণা করা

উক্ত বিশ্বাস সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন নির্দেশনা পাওয়া যায় না। বরং তাঁরা যে পাত্রে ওযূ করতেন সে পাত্রের পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জাও সম্পন্ন করতেন।[1] উল্লেখ্য যে, আবুদাঊদ ও নাসাঈতে হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে, একদা রাসূল (ছাঃ) যে পাত্রের পানিতে ইস্তিঞ্জা করেন, তার বিপরীত পাত্রে ওযূ করেন।[2] মূলতঃ পাত্রের পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল বলেই অন্য পাত্র তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। মুহাদ্দিছগণ এমনটিই বলেছেন।[3]

[1]. ছহীহ বুখারী হা/১৫০-১৫২, (ইফাবা হা/১৫২, ১/১০২ পৃঃ); ছহীহ মুসলিম হা/৬৪৩; মিশকাত হা/৩৪২; ছহীহ মুসলিম হা/৫৭৮; ১/১২৩ পৃঃ; মিশকাত হা/৩৯৪, ৪১১; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৬২, ২য় খন্ড, পৃঃ ৭৭; আবুদাঊদ হা/১৬৮; মিশকাত হা/৩৬১, পৃঃ ৪৩; বুখারী হা/১৮৭-এর অনুচ্ছেদ দ্রঃ ১/৩১ পৃঃ।

[2]. আবুদাঊদ হা/৪৫, ১/৭ পৃঃ; নাসাঈ হা/৯৪; মিশকাত হা/৩৬০, পৃঃ ৪৩; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/৩৩৩, ২/৬৬ পৃঃ, ‘পেশাব-পায়খানার শিষ্টাচার’ অনুচ্ছেদ।

[3]. ليس المعنى أنه لا يجوز التوضىء بالماء الباقي من الاستنجاء أو بالإناء الذي استنجى به وإنما أتى بإناء آخر لأنه لم يبق من الأول شيء أو بقي قليل والإتيان بالإناء الآخر اتفاقي كان فيه الماء فأتى به -আল্লামা মুহাম্মাদ শামসুল হক আযীমাবাদী, আওনুল মা‘বূদ শরহে সুনানে আবী দাঊদ (বৈরুত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১৪১৫ হিঃ), ১ম খন্ড, পৃঃ ৪৫।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২১৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 19 20 21 22 পরের পাতা »