জ্ঞানার্জনের কোনো বিকল্প ইসলামে নেই। সুতরাং ইসলাম জ্ঞানের আলোকবর্তিকা দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। ফলে ইসলাম জ্ঞান-বিজ্ঞানে অগ্রসর হতে থাকে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে জ্ঞানচর্চার যে প্রবাহ শুরু হয়, নারীরাও সেখানে শামিল হয়েছিল। পরবর্তীতে আববাসীয় ও উমাইয়্যা যুগে নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে।[1]
ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য না করে উভয়কে সমভাবে জ্ঞানার্জনের আদেশ দিয়েছে। কুরআনের নির্দেশও তাই। কুরআন সকল পাঠককেই আদেশ করছে পড়তে[2], চিন্তা-গবেষণা করতে[3], অনুধাবন করতে[4], এমনকি বিশ্ব প্রকৃতির মাঝে লুক্কায়িত বিভিন্ন নিদর্শন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে। নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাছে প্রথম যে ওহী নাযিল তার প্রথম শব্দ ছিল ‘ইকরা’ অর্থাৎ পাঠ কর। এখানে স্ত্রী-পুরুষ সকলকেই পাঠ করতে বলা হয়েছে। সুতরাং জ্ঞানার্জন শুধুমাত্র পুরুষের জন্য সীমাবদ্ধ করা হয়নি, পুরুষের মত নারীকেও জ্ঞানার্জনের পূর্ণ অধিকার দেয়া হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য জীবনব্যাপী জ্ঞানের সাধনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই আমাদের উচিত সর্বদা জ্ঞানার্জনে ব্রতী থাকা। এমনকি তিনি ক্রীতদাসীদেরকেও শিক্ষার সুযোগ দেয়ার নির্দেশ দান করেছেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বক্তৃতার আসরে যোগ দিতেন। বদর যুদ্ধে বন্দীদের শর্ত দেয়া হয়েছিল যে, তাদের মধ্যে যে কেউ দশজন মুসলিমকে বিদ্যা শিক্ষা দিবে তাদের প্রত্যেককেই বিনা মুক্তিপণে ছেড়ে দেয়া হবে।
ইসলামে পার্থিব শিক্ষা লাভ করার জন্য নারীকে শুধু অনুমতিই দেয়া হয়নি; বরং পুরুষের শিক্ষা-দীক্ষা যেমন প্রয়োজন মনে করা হয়েছে, নারীদের শিক্ষা-দীক্ষাও তদ্রূপ মনে করা হয়েছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা এবং অন্যান্য উচ্চ শিক্ষিতা মহিলারা শুধু নারীদের নয়, পুরুষদেরও শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। সাহাবী, তাবে‘য়ী এবং প্রসিদ্ধ পণ্ডিত তাঁদের নিকট হাদীস, তাফসীর ও ফিকহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন। অতএব, শিক্ষা ক্ষেত্রে ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে নি। উভয়ের অধিকার সমান।[5]
ইসলামে ধর্মীয় ও পার্থিব শিক্ষা লাভ করার জন্য নারীকে শুধু অনুমতিই দেওয়া হয়নি; বরং পুরুষের শিক্ষা-দীক্ষা যেমন প্রয়োজন মনে করা হয়েছে, নারীদের শিক্ষা-দীক্ষাও তদ্রূপ প্রয়োজন মনে করা হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে পুরুষগণ যেমন দ্বীনি ও নৈতিক শিক্ষা লাভ করত, নারীগণও তদ্রূপ করত। নারীদের জন্য সময় নির্ধারিত করা হত এবং সেই সময়ে তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হতে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে উপস্থিত হত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীগণ, বিশেষ করে আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা শুধু নারীদের নয় পুরুষদেরও শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। তাঁর নিকট হতে বড় বড় সাহাবী ও তাবে‘য়ীগণ হাদীস তাফসীর ও ফিকহ্ শিক্ষা করতেন। সম্ভ্রান্ত লোকদের তো কথাই নেই, দাস-দাসীদের পর্যন্ত শিক্ষা দান করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন।
অতএব, মূল শিক্ষা-দীক্ষার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অবশ্য শিক্ষার প্রকারে পার্থক্য আবশ্যক। ইসলামের দৃষ্টিতে নারীর প্রকৃত শিক্ষা এই যে, তদ্বারা তাকে আদর্শ স্ত্রী, আদর্শ মাতা এবং আদর্শ গৃহিনীরূপে গড়ে তোলা হবে। যেহেতু তার কর্মক্ষেত্র গৃহ, সেহেতু তাকে এমন শিক্ষা দেয়া প্রয়োজন যা এ ক্ষেত্রে তাকে অধিকতর উপযোগী করে তুলতে পারে। এ ছাড়া তার জন্য ঐ সকল বিদ্যা-শিক্ষারও প্রয়োজন যা মানুষকে প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে তুলতে, তার চরিত্র গঠন করতে এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রশস্ত করতে পারে। এই ধরনের শিক্ষা-দীক্ষা প্রত্যেক নারীর জন্য অপরিহার্য। এরপর কোনো নারী যদি অসাধারণ প্রজ্ঞা ও মানসিক যোগ্যতার অধিকারিণী হয় এবং এ সকল মৌলিক শিক্ষা-দীক্ষার পরও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে চায়, তাহলে ইসলাম তার পথে প্রতিবন্ধক হবে না। তবে শর্ত এই যে, কোনো অবস্থায়ই সে শরী‘আতে নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করবে না। শরী‘আতের গণ্ডির মধ্যে থেকে তাকে উচ্চ শিক্ষালাভে ব্রতী হতে হবে।[6]
ইসলাম যেভাবে পুরুষের উপর শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জন ফরয করে দিয়েছে, ঠিক তেমনি এটা ফরয করে দিয়েছে নারীদের উপর। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলিমদের তাঁর উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেছেন। এ ঘোষণায় তিনি পুরুষ বা মহিলা কাউকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেন নি। তিনি আরও বলেছেন, “জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের উপরই ফরয।”[7] এখানেও নর ও নারীর মধ্যে কোনো পার্থক্য না করে পুরুষ ও মহিলা উভয় সম্প্রদায়ের প্রত্যেককেই জ্ঞানার্জনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোটা মানব জাতিকে ধবংস হতে উদ্ধার করার লক্ষ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঐ বাণী সে যুগে এমন নজিরবিহীন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, যে যুগে পৃথিবীর কোথাও নারীর কোনো রকম ইয্যত-সম্মান ছিল না। তথাকথিত উন্নত জাতির লোকেরাও নারীদেরকে মানবের স্তর হতে বহিষ্কার করে জীব-জন্তুর স্তরে পৌঁছিয়ে দিয়েছিল। মহান আল্লাহ অশেষ রহমত করে তাঁর প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষার মাধ্যমে শুধু পুরুষদেরকেই নয়, বরং নারীদেরকেও সঠিক মানবতা ও মর্যাদার উঁচু চূঁড়ায় পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। বর্বরতার যুগে ক্রীত দাস-দাসীদের মান-ইয্যত বলতে কিছুই ছিল না। কিন্তু ইসলামের শিক্ষার মাধ্যমে তারাও এত উচ্চ আসনে আসীন হয়েছেন যে, অনেক সম্মানিত ব্যক্তিরাও তাঁদের নিকট হতে দীনি শিক্ষা গ্রহণের মুখাপেক্ষী হয়েছেন।
ইসলামের শিক্ষার আলোকে পুরুষদের মধ্য হতে যেমনি আবূ বকর, উমার, উসমান, আলী, ইবনে আব্বাস, ইবনে মাসউদ, ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম এবং হাসান বসরী, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইমাম আবূ হানীফা, ইমাম শাফেয়ী এর মত মহাপুরুষগণের আবির্ভাব ঘটেছিল, ঠিক তেমনি আয়েশা, হাফসা, শিফা বিনতে আব্দুল্লাহ, কারীমা বিনতে মিকদাদ, উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুন্নার মত মহিয়সী নারীও আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। মোটকথা, ইসলামের নির্ধারিত সীমা ও গণ্ডির মধ্যে অবস্থান করেই সে যুগের মহিলাগণ আত্মসংশোধন এবং জাতির খিদমতের উদ্দেশ্যে দীনি-শিক্ষা লাভ করতেন এবং নিজ সন্তানদেরকে এমন আদর্শবান করে গড়ে তুলতেন, যাতে তাঁরা নিজেদের যুগের পথিকৃৎ রূপে কওমের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন।[8]
শিক্ষা-দীক্ষা লাভ করার জন্য নারী জাতিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বহু হাদীসে তাকীদ দিয়েছেন। পুরুষদের জন্য শিক্ষা-দীক্ষাকে যেরূপ জরুরী মনে করা হয়েছে, মহিলাদের জন্যও তেমনি আবশ্যক মনে করা হয়েছে। পুরুষরা যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তা‘লীম গ্রহণ করতেন, তেমনি করতেন নারীরাও। শুধু সম্ভ্রান্ত মহিলাদেরকেই নয়, বরং দাসীদেরকেও শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বুখারী শরীফে বর্ণিত একটি হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যার নিকট কোনো দাসী আছে এবং সে তাকে শিক্ষা দান করে, ভালভাবে সুশিক্ষার ব্যবস্থা করে, ভদ্রতা ও শালীনতা শিক্ষা দেয়, এবং মর্যাদা দান করে, তার জন্যে রয়েছে দ্বিগুণ প্রতিদান।’’[9]
পুরুষ সাহাবীগণ যেমন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে দীনের গভীর জ্ঞান অর্জন করতেন, তেমনি মহিলা সাহাবীগণও নিঃসংকোচে জ্ঞান অর্জন করতেন। সুতরাং সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে যেমন পুরুষ মুফতী ছিলেন, তেমনি ছিলেন মহিলা মুফতী। উমর, আলী, যায়েদ ইবন সাবিত, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম প্রমুখ পুরুষ সাহাবীদের ন্যায় আয়েশা সিদ্দীকা, উম্মে সালমা, হাফসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুন্না প্রমুখ মহিলা সাহাবীগণও ফতোয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করতেন। মর্যাদাসম্পন্ন বহু পুরুষ সাহাবী তাঁদের নিকট ফতোয়া জিজ্ঞেস করতেন এবং তাঁদের ফতোয়া মেনে নিতেন। তিরমিযী শরীফে আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর সূত্রে একটি হাদীসে বর্ণিত আছে, ‘‘আমাদের মাঝে যখনই কোনো হাদীসের বিষয় নিয়ে সমস্যা দেখা দিত, আমরা তখনই আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার নিকট জিজ্ঞাসা করলে তার সমাধান পেয়ে যেতাম।’’[10]
ইলমে দীন শিক্ষা লাভ করার জন্য ইসলাম নারী জাতিকে শুধু সুযোগই দেয়নি বরং ফরয করে দিয়েছে। পুরুষগণ যেভাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ‘ইলমে দীন শিক্ষা লাভ করতো, তেমনি মহিলাদের জন্যও ‘ইলমে দীনের শিক্ষার স্বতন্ত্র ব্যবস্থা ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্রীতদাসীদেরকেও শিক্ষা দেয়ার জন্য নির্দেশ দান করেছেন। ইমাম বুখারী (র.) তাঁর সহীহ্ বুখারী গ্রন্থে মহিলা শিক্ষা সম্পর্কে পৃথক একটি শিরোনামও দিয়েছেন। যার বিশ্লেষণের দ্বারা নারী শিক্ষার জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থারই গুরুত্ব বোঝা যায়। সাহাবা এবং তাবে‘য়ীদের যুগেও বিকল্প পন্থায় মহিলাদের ইসলামী শিক্ষার প্রচলন ছিল। সে যুগে মহিলাদের মধ্যে বড় বড় বিদূষী, বিজ্ঞানী এবং হাদীসবেত্তা বিদ্যমান ছিলেন। আয়েশা, আসমা, উম্মে দারদা, ফাতেমা বিনতে কায়েস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুন্না প্রমুখ মহিলা সাহাবীদের ‘ইলমে যোগ্যতা ও ইসলামী আইন বিদ্যা সম্পর্কে তাবাকাতে ইবনে সা‘দ এবং মুসনাদে আহমদে বিবরণ রয়েছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর নিকট হতে অনেক সাহাবী ও তাবে‘য়ী দীনের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষালাভ করতেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি সর্বোত্তম যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়।’’ এ হাদীসে কুরআনের ‘ইলম শিক্ষা করার জন্য বলা হয়েছে। আর এ শিক্ষা পুরুষদের ন্যায় মহিলাদের জন্য সমভাবে প্রয়োজন। প্রখ্যাত জ্ঞানপ্রবর মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.) বেহেশতী জেওর নামক গ্রন্থে লিখেছেনঃ ‘‘এলাকার মুসলিম মহিলাদেরকে একত্র করে দীনি শিক্ষা দেয়া একান্ত দরকার।’’ শুধু নামায রোযার আহকাম, কুরআন শরীফ তিলাওয়াত ও সামান্য তাসবীহ-তাহলীল জানলেই ইসলামী জ্ঞানার্জন হলো না, বরং ইসলামী আকাইদ, ইবাদত, ব্যবহারিক জীবন ও সামাজিক জীবনের বিধি-বিধানের ‘ইলম অর্জন করা এবং অপর মুসলিমকে শরীয়তের অনুসরণে সংশোধন করা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্যই জরুরী। দীনের শিক্ষা ছাড়া বিধি-বিধানের সংস্কার সম্ভব নয়।
অমিয়া বাগদাদী নাম্নী জনৈকা মহিলা মদীনাতে ইমাম মালিক (র.)-এর নিকট ‘ইলমে হাদীস এবং ইমাম শাফেয়ী (র.)-এর নিকট ‘ইলমে ফিকহ শিক্ষা লাভ করেন। এমনিভাবে ইসলামের প্রথম যুগে মহিলারা হাদীস, তাফসীর ও ফিকহ এর বিশদ জ্ঞান অর্জন করে দীনের প্রচারণার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। আর এ শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রচারণা পর্দাহীনভাবে হয়নি। বরং পর্দার মাধ্যমেই হয়েছে। ‘‘মাদখাল’’ নামক কিতাবে বর্ণিত আছে যে, অতীতে মুসলিম মনীষীদের পত্নীগণ ইসলামী শরীয়তের বিষয়াদি লিখে মহিলাদের নিকট ব্যাপকভাবে প্রচার ও শিক্ষাদান কাজে আত্মনিয়োগ করেন। যার ফলে তাঁদেরই গর্ভে বড় বড় আলেম, ফকীহ ও ইমামের জন্ম হয়। যাদের দৃষ্টান্ত বর্তমান বিশ্বে দূর্লভ। পুরুষদের শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে যে সকল সুযোগ-সুবিধা আছে পর্দাজনিত কারণে মহিলাদের ক্ষেত্রে তা নেই। স্বাভাবিকভাবেই তাদের শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সীমিত। কাজেই পুরুষদের মত মহিলাদেরও বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি থাকা দরকার। মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (র.) বলেনঃ ‘‘এ সকল ফিতনা বা অসুবিধার জন্য শিক্ষা দায়ী নয়, বরং শিক্ষা পদ্ধতি অথবা পাঠ্যক্রম কিংবা ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনাই একমাত্র দায়ী।’’ সুতরাং বর্তমানে প্রচলিত ইসলাম বিরোধী তথা মানবতা বিরোধী সহশিক্ষার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতঃ মুসলিম মহিলা শিক্ষার ব্যবস্থা ব্যাপক করা এবং মহিলাদের চরিত্র গঠনসহকারে শরী‘আতের নীতি অনুসারে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র মুসলিম মহিলা বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো দরকার।[11]
[2] সূরা ‘আলাক : ১।
[3] সূরা সোয়াদ : ২৯।
[4] সূরা বাকারাহ্ : ১৬৪।
[5] অধ্যক্ষ মুহাম্মদ শামসুল হুদা, নারীর অধিকার ও মর্যাদা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৩-৪৬।
[6] সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদূদী, পর্দা ও ইসলাম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৪-৭৫।
[7] মুহাম্মাদ ইবন ইয়াযিদ ইবন মাজাহ, সুনান ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২২৪।
[8] মাওলানা আমীরুল ইসলাম ফরিদাবাদী, নবী (সা.)-এর পারিবারিক জীবন ও নারী স্বাধীনতা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৭৯-৮১‘।
[9] বুখারী, হাদীস নং ৯৭।
[10] মাওলানা নো‘মান আহমদ, ইসলামে নারীর মর্যাদা ও অধিকার, ঢাকাঃ শিবলী প্রকাশনী, ১৯৬৯, পৃ. ৯৪।
[11] .মাওলানা আতাউর রহমান কাসেমী, উৎকৃষ্ট নারী জীবন ও পর্দাতত্ত্ব, ঢাকাঃ আজিজিয়া কুতুবখানা, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪১৩ হিজরী, পৃ. ৩৪-৩৬।
কোনো যুবক-যুবতী যুগলকে যদি অবাধ মেলামেশা ও সহাবস্থানের সুযোগ করে দিয়ে বলা হয়, তোমরা কেউ কারো প্রতি আকৃষ্ট হয়ো না- তাহলে এ উপদেশও কখনও ফলপ্রসূ হতে পারে না। সহশিক্ষার কুফল কি হতে পারে তা আর ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সহশিক্ষা ব্যবস্থা গোটা মানবজাতিকে যে অকল্যাণ, অবক্ষয় এবং অশান্তি দান করেছে তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেও মানুষ এ থেকে মুক্তির কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ, মানব রচিত আইনে এ সমস্যার কোনো সমাধান নেই। আছে শুধু সমস্যা বৃদ্ধির অসংখ্য উপায়। সহশিক্ষা ব্যবস্থা মানব জাতির যে ভয়াবহ ও অপূরণীয় ক্ষতি করেছে তন্মধ্যে নৈতিক চরিত্রের অবনতি, দাম্পত্য জীবনে চরম অশান্তি, অসামাজিক ক্রিয়াকর্ম, যৌতুক প্রথা, তালাক, নারী ধর্ষণ, নারী হত্যা, মাদকদ্রব্যের অবাধ ব্যবহার, অযোগ্য সন্তানের প্রাদূর্ভাব, সামাজিক বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সহশিক্ষার কারণে নৈতিক চরিত্রের যে অবনতি ও অবক্ষয় হয়েছে তা বর্ণনাতীত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলেমেয়েরা অবাধ মেলামেশার সুযোগ পায়। ফলে তারা উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে।
সহশিক্ষার কুফল হলো দাম্পত্য জীবনে অশান্তি। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রত্যেক ছেলে ও মেয়ে বহু ছেলেমেয়ের সাথে অবাধে কথা বলার এবং যথেচ্ছা মেলামেশার করা সুযোগ পায়। এ অভ্যাসের কারণে সহপাঠী ও সহপাঠিনী ছাড়াও বাইরের ছেলেমেয়েদের সাথে তাদের অবাধ মেলামেশা চলে। এদের মধ্যে যার সাথে তথাকথিত প্রেম জমে ওঠে, তার সাথে বিয়ে না হলে, বিবাহিত জীবনে স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে মেনে নিতে পারে না। সারা জীবন চলে পরস্পরের মধ্যে ভুল বোঝাবোঝি। কেউ কাউকে বরদাশত্ করতে পারে না। আবার প্রেমের বিয়ে হলে পরস্পরের মধ্যে আকর্ষণের চেয়ে বিকর্ষণই ঘটে বেশি। এভাবেই সৃষ্টি হয় গরমিল আর পরিণামে ঘটে মর্মান্তিক ঘটনা- তালাক।
সহশিক্ষার বদৌলতে মেলামেশার কারণে একই সময়ে একজন যুবক কিংবা যুবতী অনেকের সাথে সম্পর্ক গড়ার সুযোগ পায়। একই নারী বা পুরুষকে নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। কেউ আবার একজনের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পর তাকে বাদ দিয়ে অপর একজনকে পেতে চায়। এর ফলে শুরু হয় রেষারেষি, এসিড নিক্ষেপ, খুন-খারাবি ইত্যাদি।অতএব, গোটা জাতিকে আল্লাহর গযব, অপূরণীয় ক্ষতি, ধ্বংস এবং বিপর্যয় থেকে সর্বস্তরে পৃথক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা জাতীয় কর্তব্য।[1]
>কুরআন ও হাদীসে শুধু নারীশিক্ষার কথা পৃথকভাবে বর্ণনা করা হয়নি। শিক্ষা সম্পর্কে যে কথাই বলা হয়েছে, তা নর ও নারী উভয়ের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। নর ও নারীর জন্য আলাদাভাবে কোনো আলোচনা করা হয় নি। শিক্ষা প্রসঙ্গে যে নির্দেশগুলো দেয়া হয়েছে, তাতে সাধারণত পুরুষবাচক ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন কুরআন মজীদে বলা হয়েছে, “তুমি পাঠ কর তোমার প্রভূর নামে।” আর হাদীস শরীফে বলা হয়েছে “তোমরা বিদ্যা অন্বেষণ কর।” এখানে এই নির্দেশ কেবল পুরুষের জন্য নয়, বরং নর ও নারী উভয়ের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য।
শুধু শিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, প্রায় সকল বিষয়েই কুরআন ও হাদীসে সাধারণ নির্দেশগুলো এভাবে পুরুষবাচক ক্রিয়াপদ দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে। যদিও এ দ্বারা নর ও নারী উভয়কেই সমভাবে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়
﴿ وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرۡكَعُواْ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ ٤٣ ﴾ [البقرة: ٤٣]
“তোমরা নামায পড়, যাকাত দাও এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।”[1] এখানে ব্যবহৃত দু’টি ক্রিয়াপদই পুরুষবাচক। কিন্তু এর দ্বারা নর ও নারী উভয়কেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। কেননা নামায পড়া এবং যাকাত দেওয়া নর ও নারী উভয়ের জন্য ফরয।
>শিক্ষা, জ্ঞান ও বুদ্ধির মূল উৎস হলেন আল্লাহ। নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ হতে মানুষের কাছে শিক্ষা ও জ্ঞান পৌঁছে। আল্লাহ হতে প্রাপ্ত শিক্ষা ও জ্ঞানের দ্বারা বুদ্ধির উন্মেষ ঘটে। এভাবে বিকশিত বুদ্ধি দ্বারা মানুষ চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করতে থাকে। মানুষের সামনে তখন আল্লাহর সৃষ্টি রাজ্যে লুক্কায়িত অনেক রহস্যের দ্বার উদ্ঘাটিত হয়। অজানা বহু বিষয় সম্পর্কে মানুষ জ্ঞান লাভ করে। সে অনেক কিছু আবষ্কিার করে এবং পৃথিবীকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলে। অতএব, আল্লাহ হতে প্রাপ্ত জ্ঞান বলেই মানুষ পৃথিবীকে সুশোভিত, সুসজ্জিত এবং সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে সক্ষম হয়েছে।
মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম মানব জাতির আদি পিতা আদম (আ.)-কে সৃষ্টি রাজ্যের যাবতীয় জীবজন্তু, পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-তরু, আসমান-যমীন, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগর, বস্তু-পদার্থ প্রভৃতি সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞান দান করেছিলেন। তাঁর মগজে আল্লাহ সকল বিষয়ের মৌলিক জ্ঞানের বীজ রোপণ করেছিলেন। যুগ যুগ ধরে বংশ পরম্পরায় আদম সন্তানেরা তাদের আদি পিতার মগজে রোপিত জ্ঞান উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে থাকে। বিদ্যা শিক্ষা এবং জ্ঞান সাধনার মাধ্যমে তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এ জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। আল্লাহর নিকট হতে সরাসরি প্রাপ্ত এ জ্ঞানের কারণেই আদম ও বনী আদম, ফেরেশতামণ্ডলী এবং সমগ্র সৃষ্টিকুলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে।[1] এ মর্মেই মহান আল্লাহ কালামে পাকে বলেছেন,
﴿وَعَلَّمَ ءَادَمَ ٱلۡأَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَى ٱلۡمَلَٰٓئِكَةِ فَقَالَ أَنۢبُِٔونِي بِأَسۡمَآءِ هَٰٓؤُلَآءِ إِن كُنتُمۡ صَٰدِقِينَ ٣١ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَآ إِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَآۖ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَلِيمُ ٱلۡحَكِيمُ ٣٢ ﴾ [البقرة: ٣١، ٣٢]
‘‘আর তিনি আদমকে নামসমূহ সব শিক্ষা দিলেন তারপর তা ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। সুতরাং বললেন, ‘তোমরা আমাকে এগুলোর নাম জানাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’। তারা বলল, ‘আপনি পবিত্র মহান। আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের কোনো জ্ঞান নেই। নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’’[2]
তাছাড়া লেখাপড়া বিদ্যা শিক্ষা এবং জ্ঞান অর্জনের আদেশ দান করে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেনঃ
﴿ ٱقۡرَأۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلَّذِي خَلَقَ ١ خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ مِنۡ عَلَقٍ ٢ ٱقۡرَأۡ وَرَبُّكَ ٱلۡأَكۡرَمُ ٣ ٱلَّذِي عَلَّمَ بِٱلۡقَلَمِ ٤ عَلَّمَ ٱلۡإِنسَٰنَ مَا لَمۡ يَعۡلَمۡ ٥ كَلَّآ إِنَّ ٱلۡإِنسَٰنَ لَيَطۡغَىٰٓ ٦ ﴾ [العلق: ١، ٦]
‘‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে ‘আলাক থেকে। পড়, আর তোমার রব মহামহিম। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে তা শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে জানত না।’’[3]
বিশ্বমানবতার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হলেন নবী ও রাসূলগণ। যুগে যুগে মানুষেরা তাঁদের মাধ্যমেই প্রকৃত শিক্ষা লাভ করেছে। নবী ও রাসূলগণের মধ্যে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ হলেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মহান আল্লাহ তাঁকে সারা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে মনোনীত করেছেন। তাঁর শিক্ষাদানের পাঠ্যসূচীও আল্লাহ পাকই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর আয়াতসমূহ পড়ে শোনানো, তাদেরকে পবিত্র করা এবং কিতাব ও জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দেয়া। এ মর্মে কুরআন মাজীদে আল্লাহ্ তা‘আলা ঘোষণা দিয়ে বলেন,
﴿هُوَ ٱلَّذِي بَعَثَ فِي ٱلۡأُمِّيِّۧنَ رَسُولٗا مِّنۡهُمۡ يَتۡلُواْ عَلَيۡهِمۡ ءَايَٰتِهِۦ وَيُزَكِّيهِمۡ وَيُعَلِّمُهُمُ ٱلۡكِتَٰبَ وَٱلۡحِكۡمَةَ وَإِن كَانُواْ مِن قَبۡلُ لَفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٖ ٢ ﴾ [الجمعة: ٢]
‘‘তিনিই উম্মীদের[4] মাঝে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন তাদের মধ্য থেকে, যে তাদের কাছে তেলাওয়াত করে তাঁর আয়াতসমূহ, তাদেরকে পবিত্র করে এবং তাদেরকে শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমাত। যদিও ইতঃপূর্বে তারা স্পষ্ট গোমরাহীতে ছিল।’’[5]
লেখাপড়া, বিদ্যা-শিক্ষা ও জ্ঞানানুশীলনের জন্য কিতাব বা গ্রন্থ অপরিহার্য। তাই মহান আল্লাহ বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ কথাটি বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেনঃ
﴿ الٓرۚ كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ لِتُخۡرِجَ ٱلنَّاسَ مِنَ ٱلظُّلُمَٰتِ إِلَى ٱلنُّورِ بِإِذۡنِ رَبِّهِمۡ إِلَىٰ صِرَٰطِ ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡحَمِيدِ ١ ﴾ [ابراهيم: ١]
এই কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আন, পরাক্রমশালী সর্বপ্রশংসিতের পথের দিকে।’’[6]
নর-নারী নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য লেখাপড়া করা, বিদ্যা শিক্ষা করা এবং জ্ঞান অন্বেষণ করা অপরিহার্য। কেননা এ ছাড়া মানুষের পূর্ণতা লাভের জন্য আর কোনো বিকল্প পথ নেই। সুতরাং এর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা যে কত বেশি তা আর ব্যাখ্যা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মহান আল্লাহ কালামে পাকে বলেছেন,
﴿ يُؤۡتِي ٱلۡحِكۡمَةَ مَن يَشَآءُۚ وَمَن يُؤۡتَ ٱلۡحِكۡمَةَ فَقَدۡ أُوتِيَ خَيۡرٗا كَثِيرٗاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٢٦٩ ﴾ [البقرة: ٢٦٩]
‘‘তিনি যাকে চান প্রজ্ঞা দান করে। আর যাকে প্রজ্ঞা দেয়া হয়, তাকে অনেক কল্যাণ দেয়া হয়। আর বিবেক সম্পন্নগণই উপদেশ গ্রহণ করে।’’[7]
আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্যে। আর ইবাদতের সারবস্তু হলো আল্লাহর ভয়। যাদের হৃদয়ে আল্লাহর ভয় আছে, তারাই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ইবাদত করে। আর যারা জ্ঞানী, কেবল তারাই আল্লাহকে ভয় করে থাকে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেনঃ
﴿ إِنَّمَا يَخۡشَى ٱللَّهَ مِنۡ عِبَادِهِ ٱلۡعُلَمَٰٓؤُاْۗ ﴾ [فاطر: ٢٨]
‘‘বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে।’’[8]
মহান আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করে তাকে মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষমতা দান করেছেন। আর সমগ্র মানবজাতির হেদায়াতের জন্য তিনি বিশ্বনবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর কুরআন নাযিল করেছেন। নিঃসন্দেহে এটা বান্দার প্রতি তাঁর অপার করুণার নিদর্শন। এ প্রসঙ্গে কুরআনে এসেছেঃ
﴿ عَلَّمَ ٱلۡقُرۡءَانَ ٢ خَلَقَ ٱلۡإِنسَٰنَ ٣ عَلَّمَهُ ٱلۡبَيَانَ ٤ ﴾ [الرحمن: ٢، ٤]
‘‘(পরম করুণাময়) তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন, তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনি তাকে শিখিয়েছেন ভাষা।’’[9]
যারা বিদ্যা শিক্ষা করে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে কেবল তারাই সৃষ্টি রাজ্যের রহস্য উপলব্ধি করতে পারে। তারা অনেক অজানা বস্তুকে জানতে পারে। আর যারা বিদ্যা শিক্ষা করে না, তারা এ থেকে চির বঞ্চিত। কাজেই বিদ্বান ও মূর্খ কখনও সমান হতে পারে না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ
﴿ قُلۡ هَلۡ يَسۡتَوِي ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُونَ وَٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَۗ ٩ ﴾ [الزمر: 9]
‘‘বল, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’’’[10]
যারা শিক্ষা অর্জন করে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হয়, তাদের সম্মুখে সৃষ্টি রাজ্যের রহস্যাবলীর দ্বার উম্মোচিত হয়। একমাত্র বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তিরাই এর সন্ধান পেয়ে থাকেন। মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে ঘোষণা করেছেনঃ
﴿ إِنَّ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱخۡتِلَٰفِ ٱلَّيۡلِ وَٱلنَّهَارِ لَأٓيَٰتٖ لِّأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ ١٩٠ ﴾ [ال عمران: ١٩٠]
‘‘নিশ্চয় আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য বহু নিদর্শন।’’[11]
﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦ خَلۡقُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱخۡتِلَٰفُ أَلۡسِنَتِكُمۡ وَأَلۡوَٰنِكُمۡۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّلۡعَٰلِمِينَ ٢٢ ﴾ [الروم: ٢٢]
‘‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আসমান ও যমীনের সৃষ্টি এবং তোমাদের বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য।’’[12]
﴿ فَتِلۡكَ بُيُوتُهُمۡ خَاوِيَةَۢ بِمَا ظَلَمُوٓاْۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَةٗ لِّقَوۡمٖ يَعۡلَمُونَ ٥٢ ﴾ [النمل: ٥٢]
‘‘সুতরাং ঐগুলো তাদের বাড়িঘর, যা তাদের যুলমের কারণে বিরান হয়ে আছে। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে সে কওমের জন্য যারা জ্ঞান রাখে।’’[13]
﴿ هُوَ ٱلَّذِي جَعَلَ ٱلشَّمۡسَ ضِيَآءٗ وَٱلۡقَمَرَ نُورٗا وَقَدَّرَهُۥ مَنَازِلَ لِتَعۡلَمُواْ عَدَدَ ٱلسِّنِينَ وَٱلۡحِسَابَۚ مَا خَلَقَ ٱللَّهُ ذَٰلِكَ إِلَّا بِٱلۡحَقِّۚ يُفَصِّلُ ٱلۡأٓيَٰتِ لِقَوۡمٖ يَعۡلَمُونَ ٥ ﴾ [يونس: ٥]
‘‘তিনিই সূর্যকে করেছেন দীপ্তিময় এবং চাঁদকে আলোময় আর তার জন্য নির্ধারণ করেছেন বিভিন্ন মনযিল, যাতে তোমরা জানতে পার বছরের গণনা এবং (সময়ের) হিসাব। আল্লাহ এগুলো অবশ্যই যথার্থভাবে সৃষ্টি করেছে্ন। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করেন।’’[14]
মহান আল্লাহ উল্লেখিত আয়াতসমূহে বিদ্যা শিক্ষার গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা এবং অপরিহার্যতা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। জ্ঞান অন্বেষণের জন্য নানাভাবে উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করার পর মানুষকে তিনি জ্ঞান লাভের জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করারও নির্দেশ দান করেছেন। তিনি বলেনঃ
﴿ وَقُل رَّبِّ زِدۡنِي عِلۡمٗا ١١٤ ﴾ [طه: ١١٤]
‘‘আর আপনি বলুন, ‘হে প্রভু! আপনি আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিন।’’’[15]
কোনো বিষয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করার পর অনেক শিক্ষার্থী গবেষণাকর্মে আত্মনিয়োগ করে। এ শ্রেণীর গবেষক শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মহান আল্লাহ বলেনঃ
﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَحۡمَةًۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢١ ﴾ [الروم: ٢١]
‘‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য যারা চিন্তা করে।’’[16]
>[2] .সূরা আল বাকারাহ্ : ৩১-৩২।
[3] .সূরা আল ‘আলাক : ১-৫।
[4] উম্মী দ্বারা তৎকালীন আরবের লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে।
[5] সূরা জুম‘আ : ২।
[6] সূরা ইবরহীম : ১।
[7] বাকারাহ্ : ২৬৯।
[8] সূরা ফাতির : ২৮।
[9] সূরা আর-রহমান : ২-৪।
[10] সূরাতুয্ যুমার : ৯।
[11] সূরা আলে ইমরান : ১৯০।
[12] সূরা আর্-রূম : ২২।
[13] সূরা আন্-নামল : ৫২।
[14] সূরা ইউনুস : ৫।
[15] সূরা ত্বা হা : ১১৪।
[16] সূরা আর্-রূম : ২১।
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। যেসব গুণের জন্য ইসলাম পৃথিবীর মানুষের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীন হিসেবে পরিচিত, সমতা তার মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। ইসলাম নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা অত্যন্ত জোরের সাথে ব্যক্ত করেছে।[1] মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَن يَعۡمَلۡ مِنَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ وَلَا يُظۡلَمُونَ نَقِيرٗا ١٢٤ ﴾ [النساء: ١٢٤]
‘‘পুরুষ অথবা নারীর মধ্যে কেউ সৎ কাজ করলে ও মুমিন হলে তারা জান্নাতে দাখিল হবে এবং তাদের প্রতি অনু পরিমাণও জুলুম করা হবে না।’’[2] পরকালে জান্নাতের চির শান্তি লাভের উপায় হিসেবে দুনিয়াতে আমাদের জন্য নাযিল হয়েছে দ্বীন। সুতরাং ইলমে দ্বীন জানা প্রত্যেক নর নারীর উপর একান্ত জরুরী।[3] এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন,
﴿قُلۡ هَلۡ يَسۡتَوِي ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُونَ وَٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٩ ﴾ [الزمر: ٩ ]
‘‘বল! যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।’’[4]
জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান বিকাশের পৃষ্ঠপোষকতা মুসলিমদের জন্য অবশ্য করণীয় বা ফরয। নারী পুরুষ ভেদে ইসলামের শিক্ষা (জ্ঞান অর্জন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘ইলম তলব করা প্রত্যেক মুসলিমের (নর নারী) জন্য ফরয।’’[5]
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা নারী পুরুষ সকল বিশ্বাসীকে লক্ষ্য করে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তিনি শুধু জ্ঞানার্জনের তাকীদই দেননি, জ্ঞানার্জনের মর্যাদার বিষয়টিও আল্-কুরআনে একাধিকবার ব্যবহার করেছেন,
﴿يَرۡفَعِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ دَرَجَٰتٖۚ ﴾ [المجادلة: ١١]
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে আর যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ্ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন।’’[6]
জ্ঞানের মর্যাদা সম্পর্কে হাদীসে আরও বর্ণিত আছে, ‘‘যে ব্যক্তি ইলম তলব করার উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করেছে আল্লাহ তা‘আলা তার দ্বারা তাকে বেহেশতের পথ সমূহের একটি পথে পৌঁছে দেন।’’[7]
এ উক্তিটি ভেবে দেখার মত। কেননা জ্ঞানীদের কঠোর পরিশ্রম, সাধনা, ত্যাগ ও ধৈর্যের ফলে দ্বীনী জ্ঞান বিজ্ঞান সংরক্ষিত হয়ে অনাগত ভবিষ্যত বংশধরদের নিকট পৌঁছায়।[8]
নর নারী উভয়েরই বিদ্যা শিক্ষার অধিকার অবশ্যই আছে। আত্মিক উৎকর্ষ সাধন যা মানুষের সকল কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য এবং এর সাথে সঙ্গতি রেখেই জাগতিক উন্নতি ও কল্যাণ অর্জনের জন্য সে বিদ্যা ও জ্ঞান আদি নর নারীকে দেওয়া হয়েছিল। তার ওপর ভিত্তি করে চিন্তা, গবেষণা ও অনুশীলনের দ্বারা উত্তম জ্ঞান বুদ্ধিকে উত্তম কাজে লাগানোর স্বত্বাধিকার উভয়েরই আছে। বিদ্যা ও জ্ঞান অতি প্রয়োজনীয় বস্তু, এমনকি এটা ছাড়া মানুষ স্বীয় দ্বীনও সঠিকভাবে পালন করতে পারে না। তাই উত্তম দ্বীনী বিদ্যা ও জ্ঞানের বিষয় যদি সুদূর কোনো দেশেও থাকে, তবে সেখানে গিয়ে হলেও তা অর্জন করার তাকীদ রয়েছে।[9] আর দ্বীনের ইলম যারা হাসিল করেনি তাদের আমলও সঠিক হয় না।[10]
মহিলাদের প্রাথমিক শিক্ষাগার ও প্রশিক্ষণ স্থান হলো গৃহ। তাই পিতামাতা যাতে কন্যাদেরকে এবং স্বামী যাতে স্ত্রীকে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে শেখায় এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে, ইসলাম সেদিকে তাদের দৃষ্টি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছেঃ
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا ﴾ [التحريم: ٦]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাও।’’[11] এ আয়াতের অর্থ আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এভাবে করেছেনঃ
علموا أنفسكم وأهليكم الخير وأدبوهم
‘‘তোমরা নিজেরা শেখ এবং পরিবারবর্গকে শেখাও সমস্ত কল্যাণময় রীতি-নীতি এবং তাদের আদব শিক্ষা দাও এবং এসব কাজে অভ্যস্ত করে তোল।’’[12]
>[2] সূরা আন্-নিসা : ১২৪।
[3] প্রিন্সিপাল মাওলানা আকবর, বেগম নূরজাহান, বাংলাদেশে মহিলা মাদ্রাসা আন্দোলন, (ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ফেব্রুয়ারী ১৯৮৮), পৃ. ৬।
[4] সূরা আয্-যুমার : ৯।
[5] মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযিদ, ইবনু মাজাহ্, কিতাবুল ইলম, হাদীস নং ২২৪।
[6] .সূরা মুজাদালাহ্ : ১১।
[7] .ইমাম মহিউদ্দীন আন্-নববী, কিতাবুল ইলম্, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪।
[8] .ফযিলা তাহের, মেয়েদের ইসলামী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, মাসিক দারুস সালাম, ঢাকা, দারুস সালাম, ডিসেম্বর জানুয়ারী ১৯৯৯, পৃ. ১২।
[9] .‘সুদূর কোন দেশে গিয়ে হলেও বিদ্যা অর্জনের তাকীদ’ সংক্রান্ত বিষয়টির দলিল হিসেবে বলা হয়, ‘‘সুদূর চীনে গিয়ে হলেও জ্ঞানান্বেষণ কর’’ থেকে। এ কথা হাদীস হিসাবে আমাদের সমাজে প্রচলিত। প্রকৃতপক্ষে, এটি আদৌ হাদীস কি-না, হাদীস বিশারদগণ যুগ যুগ ধরে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ এর সিলসিলাতুল আহাদীসিদ দ্বা‘য়ীফাহ, প্রথম খন্ডে ৪১৩ পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে লিখেছেন, ‘হাদীসটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। নবী কারীম (সাঃ)-এ কথা বলেননি।’
[10] প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আকবর, বেগম নূরজাহান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭।
[11] .আল্-কুরআন, সূরা আত্-তাহরীম : ৬।
[12] .আল্লামা শাওকানী, ফাতহুল কাদীর, ৫ম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৬।
শিক্ষা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের নির্দেশনার পাশাপাশি হাদীসেরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই নিজেকে একজন শিক্ষক হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়াও মহান আল্লাহ তাঁকে মানবজাতিকে কিতাব, হিকমত, উত্তম চরিত্র ইত্যাদি শিক্ষা দেয়ার জন্য রাসূল হিসেবে মনোনীত করেছেন। তাঁর নবুয়তী জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে যেসব বাণী বিধৃত হয়েছে সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো।
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«طلب العلم فريضة على كلّ مسلمٍ»
‘‘জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলানের উপর ফরয বা অপরিহার্য।’’[1]
আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«من سلك طريقا يلتمس فيه علما سهل الله له به طريقا إلى الجنة»
‘‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোনো পথ অবলম্বন করে, মহান আল্লাহ তাদ্বারা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।’’[2]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, মহান আল্লাহ ওহীযোগে আমাকে জানিয়েছেন-
‘‘যে ব্যক্তি বিদ্যাশিক্ষার জন্য কোনো পথ ধরে, আমি তার জন্য বেহেশতের পথ সুগম করে দেই।’’[3]
কাসীর ইবনে কায়েস বলেন, আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন যে, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছিঃ
«من سلك طريقا يطلب فيه علما سلك الله به طريقا من طرق الجنّة»
‘‘যে ব্যক্তি জ্ঞানার্জনের জন্য কোনো পথ গ্রহণ করে, মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতের একটি পথে পরিচালিত করেন।’’[4]
মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ يُرِدِ اللَّهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِي الدِّينِِ»
‘‘মহান আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তিনি তাকে দীনি গভীর ‘ইলম দান করেন।’’[5]
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«من خرج في طلب العلم فهو في سبيل الله حتى يرجع»
‘‘যে ব্যক্তি জ্ঞান অমেবষণ করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়, সে আল্লাহর পথেই চলতে থাকে, যতক্ষণ না ফিরে আসে।’’[6]
আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
«إن فضل العالم على العابد كفضل القمر ليلة البدر على سائر الكواكب»
‘‘পূর্ণিমার রাতে নক্ষত্রমালার উপর পূর্ণ চন্দ্রের যেরূপব মর্যাদা, আবিদের উপর আলিমের মর্যাদা ঠিক তদ্রূপ।’’[7]
শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো দীন ইসলামকে সঞ্জীবিত রাখা, ইবাদতের নিয়ম-কানুন জানা এবং সমাজের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা। ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ উদ্ধার করা, নিজের বাহাদুরী প্রকাশ করা এবং অপরকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য বিদ্যা শিক্ষা করা বৈধ নয়।
কা‘ব ইবনে মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ طَلَبَ العِلْمَ لِيُجَارِيَ بِهِ العُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِيَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللَّهُ النَّارَ»
‘‘যে ব্যক্তি এ উদ্দেশ্যে জ্ঞান অন্বেষণ করে যে, আলিমদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে, অথবা বোকা ও মূর্খ লোকদের সাথে বিতর্ক করবে এবং লোকদের দৃষ্টি তার দিকে আকৃষ্ট করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন।’’[8]
আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘‘কিয়ামতের দিন মর্যাদার দিক দিয়ে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি বলে সাব্যস্ত হবে সেই আলিম, যার ইলমের দ্বারা কোনো কল্যাণ সাধিত হয় না।’’[9]
এছাড়াও জ্ঞানীদের সুউচ্চ মর্যাদা বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَإِنَّ العَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الأَرْضِ حَتَّى الحِيتَانُ فِي المَاءِ، وَفَضْلُ العَالِمِ عَلَى العَابِدِ، كَفَضْلِ القَمَرِ عَلَى سَائِرِ الكَوَاكِبِ، إِنَّ العُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ»
‘‘জ্ঞানী ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আকাশ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা, এমনকি পানির নিচের মাছ। অজ্ঞ ইবাদত গুজারের তুলনায় জ্ঞানী ব্যক্তি ঠিক সেরকম মর্যাদাবান, যেমন পূর্ণিমার রাতের চাঁদ তারকারাজির উপর দীপ্তিমান। আর জ্ঞানীগণ নবীদের উত্তরাধিকারী।’’[10]
অতএব, নারীদের শিক্ষা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরী। কেননা, নারী কখনো মা, কখনো বোন, কখনো ছাত্রী আবার কখনো পরিবারের কর্তী হিসেবে আবির্ভূত হন। তাছাড়া মা ই তার সন্তানের প্রথম শিক্ষক। সামগ্রিকভাবে সুশিক্ষিতা মা স্বভাবতই জ্ঞানী, চরিত্রবান, ব্যক্তিত্ব সম্পন্না, নিষ্ঠাবান, নম্র ও ভদ্র। শিক্ষিত মায়ের এসব গুণ আপনাআপনিই সন্তানের মধ্যে সঞ্চারিত হয়।
নারীরা শুধু শিক্ষিত নয়, শিক্ষকও হতে পারেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ছিলেন অন্যতম একজন শিক্ষক। এছাড়াও উম্মে সালমা, উম্মে হাবিবা, হাফসা, আসমা বিনতে আবু বকর, মায়মুনা, উম্মে হানী প্রমুখ মহিলা সাহাবিয়ার নাম প্রথম সারিতে এসে যায়।অতএব আল্-কুরআন ও সুন্নাহর এই অমোঘ নির্দেশের মধ্য দিয়ে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম নারী শিক্ষার উপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। শিক্ষার অধিকার প্রদানের মাধ্যমেই ইসলাম নারীকে সুউচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত করেছে। কারণ, বিশ্বাসী ও জ্ঞানীদের উচ্চাসন দেবেন বলে আল্লাহ্ নিজেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।[11]
>[2] .আবূ বকর আহমদ ইবনুল হুসাইন আল্-বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, ২য় খণ্ড, বাবু ফী তালাবিল ইলম, বৈরুতঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়া, ১৯৯০, পৃ. ২৬২।
[3] .বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, ৫ম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩।
[4] .প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬২।
[5] .বুখারী, সহীহ্, ১ম খণ্ড, কিতাবুল ইলম, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬।
[6] .তিরমিযী, জামিউত্-তিরমিযী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬। হাদীসটিকে কেউ হাসান বলেছেন, আবার কেউ দুর্বল বলেছেন। [সম্পাদক]
[7] প্রাগুক্ত ।
[8] তিরমিযী, জামিউত্ তিরমিযী, ২য় খণ্ড, আবওয়াবুল ইলম, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৪ ।
[9] দারেমী, সুনান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৪।
[10] সুনান আত্-তিরমিযী, হাদীস নং ২৬৮২।
[11] ইসলামী দৃষ্টিতে নারী : একটি সমীক্ষা, ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, ৩৬ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, জানু-মার্চ, ১৯৯৭, পৃ. ৫৫।
শিক্ষা গ্রহণ সকল নরনারীর অবশ্যই কর্তব্য। ইসলামের প্রথম যুগে মাদ্রাসা ও উচ্চ বিদ্যালয়ে মেয়েরাও অধ্যয়ন করতেন। মসজিদে স্ত্রী পুরুষ একই সঙ্গে নামায পড়তেন। তখনও অবস্থাসম্পন্ন লোকেরা গৃহ শিক্ষক নিযুক্ত করে মেয়েদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করতেন। অথচ অজ্ঞতার যুগে নারীদের হেয় প্রতিপন্ন করা হত। তাই লেখাপড়া শেখানো ছিল কল্পনাতীত।[1]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী-পুরুষের জন্য শিক্ষা ফরয ঘোষণা করেন। তিনি পুরুষদের যেভাবে তালিম দিতেন মহিলাদেরও অনুরূপভাবে শিক্ষা দিতেন। তিনি বিভিন্ন হাদীসে জ্ঞান অন্বেষণে উৎসাহ প্রদান করেছেন। তিনি মহিলাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের জন্য একটি সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। এ সময় তিনি কেবল তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতেন। ঈদের সময় দেখা যেত তিনি পুরুষদের সামনে ভাষণ শেষ করে নারীদের সমাবেশে চলে যেতেন এবং সেখানে বক্তব্য রাখতেন।[2]
নারীদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য তিনি অভিভাবকদের বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করেছেন। শুধু আযাদ মহিলাই নয় ঘরের দাসী বাদীদেরও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করেননি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَمَنْ عَالَ ثَلَاثَ بَنَاتٍ أَوْ مِثْلَهُنَّ مِنَ الْأَخَوَاتِ فَأَدَّبَهُنَّ وَرَحِمَهُنَّ حَتَّى يُغْنِيَهُنَّ اللَّهُ أَوْجَبَ اللَّهُ لَهُ الْجَنَّةَ» . فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ الله واثنتين؟ قَالَ: «واثنتين»
“যে ব্যক্তি তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনটি বোনকে লালন-পালন করবে এবং তাদেরকে ভদ্রতা, শিষ্টাচার, উত্তম চালচলন ও আচার ব্যবহার শিক্ষা দিয়ে সাবলম্বী হতে সাহায্য করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দেবেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলো, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, কেউ যদি দুজনের জন্য এরূপ করে? তিনি বললেন, দু’জনের জন্য এরূপ করলেও হবে।[3]”
পুরুষদের শিক্ষার পাশাপাশি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী শিক্ষারও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি সপ্তাহের একটি বিশেষ দিনে নারীদের নিকট বক্তৃতা করতেন এবং তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। সম্ভ্রান্ত মহিলাদের তো কথাই নেই। এমনকি দাসীদেরকেও শিক্ষা দান করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন।’’[4]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়ে যে সমস্ত জ্ঞান চর্চার মজলিস অনুষ্ঠিত হতো মহিলারা অদূরে পর্দার অন্তরালে উপস্থিত থেকে তার উপকার লাভ করতেন। ইসলাম সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান অর্জনই ছিল এসব মজলিসে তাদের উপস্থিত হওয়ার উদ্দেশ্য। অনেক মহিলা ছিলেন, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখে কুরআন পাঠ শুনেই তা মুখস্থ করে ফেলতেন। কোনো সময়ে যদি তিনি মনে করতেন যে, মহিলারা তার কথা ঠিকমত শুনতে পাননি, তা হলে তিনি পুনরাবৃত্তি করতেন।[5]
আল্-কুরআনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশেষভাবে ঘরের মহিলাদের শিক্ষা দেয়ার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষ সমাজকে নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামী সমাজের মহিলারা দ্বীন সম্পর্কে জরুরী জ্ঞান লাভ করুক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ছিল বাসনা এবং চেষ্টা। কেবল নীতিগত জ্ঞান শিক্ষা দেয়াই লক্ষ্য ছিল না। সেই সঙ্গে বিভিন্ন কারিগরী শিক্ষা দেয়াও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ জন্য কেবল উপদেশ দিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি, আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছিলেন। পিতামাতা বা স্বামী যদি পারিবারিক পরিবেশে জরুরী দীনি শিক্ষাদানের ব্যবস্থা না করে, তা হলে ঘরের বাইরে গিয়েও সেই জ্ঞান লাভের সুযোগ মহিলাদের দিতে হবে, এই হচ্ছে ইসলামী আইনের বিধান। দীনি জ্ঞান লাভের জন্য নারীকে সুযোগ-সুবিধা দিতে গোটা সমাজই দায়িত্বশীল। এ পথে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা হলে তা দূর করতে হবে সমাজকেই। শুধু কিতাবী বিদ্যাই নারীদের জন্য যথেষ্ট নয়, তাদের চিন্তা-শক্তির উৎকর্ষ সাধন এবং অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতে চিন্তা ও গবেষণার মাধমে নব-নব সত্য তত্ত্ব উদ্ঘাটনের জন্য তাদের মানসিক শক্তির বিকাশ সাধনের ব্যবস্থা করাও ইসলামী সমাজের কর্তব্য।[6]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীর জন্য শিক্ষাকে সীমিত করে দেননি। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিয়েছেনঃ
﴿ وَٱلرَّٰسِخُونَ فِي ٱلۡعِلۡمِ يَقُولُونَ ءَامَنَّا بِهِۦ كُلّٞ مِّنۡ عِندِ رَبِّنَاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٧ ﴾ [ال عمران: ٧ ]
‘‘যারা জ্ঞানী ও বিদ্যান তারা বলেন, আমরা এর (কুরআন) প্রতি ঈমান এনেছি এবং কেবল বিবেক সম্পন্ন লোকেরাই (কোনো জিনিস থেকে) শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে।’’[7]
সুতরাং আল্-কুরআনকে বুঝবার জন্যও ইসলামের অনুসারীদের বিদ্যা ও জ্ঞানার্জন করতে হবে। এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী পুরুষের ক্ষেত্রে পার্থক্য করেন নি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারী শিক্ষার উপর অসাধারণ গুরুত্বারোপ করেছেন।[8]
মহান আল্লাহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রীদেরকে জ্ঞান চর্চার নির্দেশ দান করে বলেন,
﴿ وَٱذۡكُرۡنَ مَا يُتۡلَىٰ فِي بُيُوتِكُنَّ مِنۡ ءَايَٰتِ ٱللَّهِ وَٱلۡحِكۡمَةِۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ لَطِيفًا خَبِيرًا ٣٤ ﴾ [الاحزاب: ٣٤]
‘‘আর তোমাদের ঘরে আল্লাহর যে আয়াতসমূহ ও হিকতম পঠিত হয়- তা তোমরা স্মরণ রেখো। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি সূক্ষ্মদর্শী, সম্যক অবহিত।’’[9]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে নারী সমাজের মধ্যে ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত হওয়ার এমন অদম্য আকাঙ্খা ও উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছিল যে, সেজন্য তারা দিনরাত সবসময় ব্যতিব্যস্ত থাকতো। জ্ঞান আহরণের পথে কোনো বাধা ও প্রতিবন্ধকতা তাদেরকে নিরাশ ও ভগ্নোৎসাহ করতে পারতো না। আনসারী মহিলাদের সম্পর্কে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেনঃ
نعم النساء نساء الأنصار لم يكن يمنعنهن الحياء ان يتفقهن في الدين
‘‘আনসারী মহিলারা কতই না ভাল! দীনের বিধি-বিধান সম্পর্কে জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে লজ্জা-শরম তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।’’[10]
ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে সে যুগের মহিলারা কত গভীর ও সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে অধ্যয়ন করতেন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর নিম্নের উক্তি হতেই তা বোঝা যায়ঃ
‘‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে কুরআন মাজীদের কোনো আয়াত নাযিল হলে, আমরা তার শব্দগুলো হুবহু মুখস্থ না করলেও তার হালাল-হারাম এবং আদেশ-নিষেধগুলো স্মৃতিপটে গেঁথে নিতাম।’’[11]
ইবাদত এবং জ্ঞান চর্চার মজলিসে নারীরা বিশেষ উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে অংশগ্রহণ করতো। খাওলা বিনতে কায়েস আল্-জুহানিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুউচ্চ কণ্ঠের উল্লেখ করে বলেছেনঃ
كنت اسمع خطبة رسول الله صلى الله عليه وسلم يوم الجمعة وأنا في موخر النساء.
‘‘জুম‘আর দিনে আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খুতবা অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে শুনতে পেতাম। অথচ আমি মেয়েদের সর্বশেষ কাতারে থাকতাম।’’[12]
হারিসা ইবনু নু‘মানের এক কন্যা বর্ণনা করেছেনঃ
«ما حفظت "ق" إلا من في رسول الله صلى الله عليه وسلم»
‘‘আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুখ থেকে শুনেই সূরা কাফ মুখস্থ করেছিলাম। তিনি প্রত্যেক জুম‘আর খুতবাতে এটি পড়তেন।’’[13]
মেয়েদের উপদেশ ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও বিশেষ লক্ষ্য রাখতেন। যদি কোনো সময় তিনি বুঝতে পারতেন যে, মেয়েরা তার বক্তব্য ঠিকমত শুনতে পায় নি, তাহলে তিনি তাদের কাছে গিয়ে পুনরায় তা বলে দিতেন। আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এক ঈদের দিনের কথা উল্লেখ করে বলেছেন,
«فظن أنه لم يسمع النساء فوعظهن وأمرهن بالصدقة»
‘‘তিনি মনে করলেন যে, তাঁর কথা মেয়েদের কাছে পৌঁছাতে পারেন নি। তাই পুনরায় তিনি তাদেরকে নসীহত করলেন। তাদের সাদকা দেয়ার জন্য আদেশ দিলেন।’’[14]
ইসলাম জ্ঞানান্বেষণের জন্য নারীদের মনে অত্যন্ত গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। তাদের এই জ্ঞান-পিপাসা নিবারণের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণ ব্যবস্থা ছাড়াও মাঝে মধ্যে তাদের জন্য অতিরিক্ত সুযোগ করে দিতেন। আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে,
‘‘মহিলারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললো, আপনার কাছে পুরুষরা এত ভিড় লাগিয়ে থাকে যে, অনেক সময় আমাদের পক্ষে আপনার কথা শুনা সম্ভবই হয় না। অতএব আমাদের জন্য আপনি আলাদা একটি দিন ধার্য করে দিন। একথা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করে দিলেন। সেই দিন তিনি তাদের কাছে গিয়ে উপদেশ দিতেন এবং সৎকাজের নির্দেশ দান করতেন।’’[15]
মালিক ইবনে হুয়াইরিস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, আমরা কয়েকজন যুবক দীন সম্পর্কে জ্ঞান লাভের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে বিশ দিন পর্যন্ত অবস্থান করলাম। যখন তিনি বুঝতে পারলেন যে, আমরা বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছি, তখন তিনি বললেনঃ‘‘তোমরা তোমাদের স্ত্রী-পুত্রের কাছে ফিরে যাও এবং তাদের কাছেই অবস্থান কর। তাদেরকে দীন সম্পর্কে শিক্ষা দাও এবং তা মেনে চলার নির্দেশ দাও।’’[16]
>[2] ড. মোঃ আজহার আলী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬।
[3] শারহুস সুন্নাহ, হাদীস নং ৩৪৫৭।
[4] আবু আব্দুল্লাহ্ মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইল, কিতাবুল ইলম, পূর্বোক্ত, পৃ. ২০।
[5] মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, নারী, (ঢাকা, সিন্দাবাদ প্রকাশনী, ২য় সংস্কার ১৯৮৮), পৃ. ৫০-৫১।
[6] প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩।
[7] সূরা আলে ইমরান : ৭।
[8] ইউ.এ.বি. রাজিয়া আক্তার বানু, সংবিধান ও ধর্মে বাংলাদেশে মুসলিম নারীর অধিকার ও মর্যাদা : একটি পর্যালোচনা, ঢাকা, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইট পত্রিকা, দ্বাদশ খণ্ড, ২য় সংখ্যা, ডিসেম্বর ১৯৯৪, পৃ. ৫৮।
[9] আল্-কুরআন, সূরা আহযাব : ৩৪।
[10] মুসলিম, সহীহ্ মুসলিম, ১ম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬১।
[11] ইবন আবদি রাব্বিহি, আল্-ইকদুল ফরীদ, ১ম খণ্ড, কায়রোঃ মাতবাআতু লাজনাতিত্ তা’লীক, ১৯৬৫, পৃ. ২৭৬।
[12] ইবন সা‘দ, আত্-তাবাকাত, ৮ম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৭।
[13] .মুসলিম, সহীহ্ মুসলিম, ২য় খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৯৫।
[14] .বুখারী, সহীহুল বুখারী, ১ম খণ্ড, কিতাবুল ইলম, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০; মুহাম্মদ জামালুদ্দীন, মুসলিম নারীর পোষাক ও কর্ম, ঢাকাঃ এশা রাহনুমা, সাইন্স ল্যাবরেটরী, ১৯৯৮, পৃ. ৭২-৭৬।
[15] .বুখারী, সহীহুল বুখারী, প্রাগুক্ত, পৃ. ২০।
[16] .বুখারী, সহীহুল বুখারী, ১ম খণ্ড, কিতাবুল আযান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮৮।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরবর্তীকালে সাহাবীগণ ব্যক্তিগতভাবে নারীদের চিন্তা ও কর্মের সংশোধনের জন্য ব্যাপক চেষ্টা-সাধনা করেছেন। একইভাবে তাঁরা সমাজ সংস্কারের যে চেষ্টা-সাধনা করতেন তাতেও পুরুষদের সাথে নারীরাও অন্তর্ভুক্ত থাকত। আয়েযা নাম্নী এক মহিলা সাহাবী আব্দুল্লাহ্ ইব্নে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর বক্তৃতার উল্লেখ করে বলেছেন,
‘‘আমি আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-কে নারী ও পুরুষের উদ্দেশ্যে এই বলে নসীহত করতে দেখেছি যে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে তোমাদের মধ্যে থেকে যেই ফিতনার যুগের মুখোমুখী হবে সে যেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবাদের কর্মপন্থা দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করে।’’[1]
ফলে পূর্বে যে নারীরা জ্ঞান ও সংস্কৃতির সাথে একেবারেই অপরিচিত ছিল এখন তারা তার রক্ষক হয়ে দাঁড়ালো। চিন্তা ও সাহিত্যের জগতে যাদের কোনো অস্তিত্বই অনুভূত হতো না, এখন তারা জ্ঞান ও হিদায়াতের প্রদীপরূপে আত্মপ্রকাশ করলো।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর ছাত্র উরওয়া ইবন্ যুবায়র রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন,
‘‘আমি কুরআন, ইসলামের ফরযসমূহ, হালাল ও হারাম, কাব্য ও সাহিত্য, আরবদের ইতিহাস ও নসবনামা বিষয়ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর চেয়ে অধিক জ্ঞানী লোক আর দেখি নি। ।[2]
আরবী কাব্য ও কবিতায় উরওয়া ইবন্ যুবায়র রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর বেশ দখল ছিল। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রশংসা করা হলে তিনি বলতেন, কাব্য বিষয়ে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা -এর জ্ঞানের সাথে আমার জ্ঞানের কোনো তুলনাই চলে না। তিনি তো কথায় কথায় কবিতা থেকে প্রমাণ পেশ করতেন।[3]
মূসা ইবন্ তালহা বলেনঃ
‘‘আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর চেয়ে অধিক বাগ্মী ও শুদ্ধভাষী আর কাউকে দেখি নি।’’[4]
লোকেরা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর কাব্য ও সাহিত্য বিষয়ে জ্ঞানের তুলনায় চিকিৎসা বিষয়ক অধিক জ্ঞান দেখে বিস্মিত হতো। ইবনে আবী মূলায়কা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-কে বললেন, আমরা আপনার কবিত্ব ও বাগ্মীতা দেখে চমৎকৃত হই না। কারণ আপনি আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর কন্যা। আর আবূ বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর বাগ্মীতা সর্বজনস্বীকৃত। কিন্তু আপনি চিকিৎসা বিদ্যা কিভাবে শিখেছেন? আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বললেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ হয়ে পড়লে বাইরে থেকে আগত প্রতিনিধিদল তাঁর চিকিৎসা করতো। আমি সেগুলো মনে রাখতাম।[5]
ফারায়েযের অংক শাস্ত্রে তিনি এমন জ্ঞানের অধিকারিণী ছিলেন যে, বড় বড় সাহাবীগণ পর্যন্ত উত্তরাধিকার বিষয়ক মাসআলা-মাসায়েল তাঁর নিকট থেকে জেনে নিতেন।[6]
‘আমরাহ্ বিনতে আব্দুর রহমানও আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর একজন ছাত্রী ছিলেন। ইবনে ইমাদ হাম্বলী নিম্নোক্ত ভাষায় তার কথা উল্লেখ করেছেনঃ
‘‘আমরাহ্ বিনতে আব্দির রহমান আনসারী বিজ্ঞ ফিকহবিদ ছিলেন। তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর কোলে লালিত-পালিত হয়েছিলেন। অতএব, তাঁর নিকট থেকে তিনি সর্বাপেক্ষা বেশি সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি নির্ভরযোগ্য এবং মজবুত স্মৃতিশক্তি ও ধারণ ক্ষমতার অধিকারিণী ছিলেন। তাঁর বর্ণিত হাদীসসমূহ সর্বদা গৃহীত হতো।[7]
ইবন্ হিব্বান (র.) তাঁর সম্পর্কে লিখেছেনঃ‘‘তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞাত ছিলেন।’’[8]
>[2] .হাফিজ যাহাবী, তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, বৈরুতঃ দারু ইহ্ইয়ায়িত্ তুরাসিল আরাবী, তা. বি., পৃ.২৭।
[3] জালালুদ্দীন উমরী, ইসলামী সমাজে নারী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৩।
[4] ইবনে হাজার আল্-আসকালানী, আল্ ইসাবা ফী তামীযিস্ সাহাবা, ৪র্থ খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬০।
[5] হাকেম, মুসতাদরাক, ৪র্থ খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১।
[6] তদেব।
[7] .ইবনে ইমাদ হাম্বলী, শাজারাতুয্ যাহাব, ১ম খণ্ড, বৈরুতঃ আল্-মাকতাবাতুত্ তিজারী, তা. বি. পৃ. ১১৪।
[8] ইবনে হাজার আল্-আসকালানী, তাহযীবুত্ তাহযীব, ১২শ খণ্ড, বৈরুতঃ দারু ইহইয়ায়িত্ তুরাসিল আরাবী, তা. বি. পৃ. ১২৯।
তাবেয়ীদের যুগে বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ্ কাসিম ইবনু মুহাম্মদ (র.) ইমাম যুহরীকে বললেনঃ আমি তোমার মধ্যে জ্ঞান পিপাসা লক্ষ্য করছি। আমি কি তোমাকে জ্ঞানে পরিপূর্ণ একটি পাত্র দেখিয়ে দেব না? যুহরী বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। তিনি বললেন, ‘আমরাহ্ বিনতে আব্দুর রহমানের মজলিস কখনো ছেড়ে থেকো না। কারণ, তিনি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর কোলে লালিত-পালিত। অতএব, তিনি তাঁর জ্ঞানের পূর্ণ উত্তরাধিকারিণী। ইমাম যুহরী (র.) বললেন, তাঁর পরামর্শ অনুসারে আমি ‘আমরাহ্ বিনতে আব্দুর রহমানের খিদমতে হাজির হলে জানতে পারলাম, প্রকৃতই তিনি জ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার।[1]
হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (র.) উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা সম্পর্কে লিখেছেনঃ
‘‘উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা পরিপক্ক বুদ্ধি ও সঠিক সিদ্ধান্তের অধিকারিণী ছিলেন।’’[2]
উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর কন্যা যায়নাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা সম্পর্কে ইবনু আব্দিল বার (র.) বলেনঃ
‘‘তিনি তাঁর যুগের সর্বাপেক্ষা বড় ফকীহদের অন্যতম ছিলেন।’’[3]
আবূ রাফে‘ সায়িগ (র.) বলেনঃ
كنت إذا ذكرت امرأة فقيهة بالمدينة ذكرت زينب بنت أبي سلمة.
‘‘যখনই আমি ফিকহ্ শাস্ত্রে অভিজ্ঞ মদীনার কোনো মহিলার কথা স্মরণ করি, তখনই যায়নাব বিনতে আবূ সালামার কথা মনে পড়ে যায়।’’[4]
উম্মুল হাসান নামে উম্মে সালামার একজন দাসী ছিলেন। তিনি এতই যোগ্যতার অধিকারিণী ছিলেন যে, মেয়েদের মধ্যে নিয়মিত দ্বীনের প্রচার ও ওয়াজ নসীহত করতেন।’’[5]
উম্মূল মু’মিনীন সাফিয়্যা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা সম্পর্কে ইমাম নববী (র.) বলেন:
كانت عاقلة من عقلاء النساء
‘‘তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানবতী ও বুদ্ধি বিবেচনার অধিকারিণী মহিলাদের একজন।’’[6]
আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর স্ত্রী উম্মুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর জ্ঞান ও মর্যাদা এত উচ্চ পর্যায়ের ছিল যে, ইমাম বুখারী (র.) তাঁর আমলকে সহীহ্ বুখারী গ্রন্থে প্রমাণ ও উদাহরণ হিসেবে পেশ করেছেন। তিনি বলেছেন:
كانت أم الدرداء تجلس في صلاتها جلسة الرجل وكانت فقيهة
‘‘উম্মুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা একজন ফকীহ্ মহিলা ছিলেন। তিনি নামাযে পুরুষের মত করে বসতেন। তাঁর এই আমল দলীল হিসেবে গণ্য।’’[7]
‘‘তিনি বিবেক-বুদ্ধি, মর্যাদা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতার অধিকারিণী মহিলাদের মধ্যে গণ্য হতেন। এছাড়া তিনি ছিলেন ইবাদতগুজার এবং মুত্তাকী।’’[8]
‘‘তাঁর জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধিমত্তা ও মর্যাদা সম্পর্কে সবাই একমত।’’[9]
ফাতিমা বিনতে কায়েস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা অসাধারণ জ্ঞানের অধিকারিণী ছিলেন। একটি ফিকহী মাসআলার ব্যাপারে তিনি দীর্ঘদিন পর্যন্ত উমর এবং আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর সাথে বিতর্ক চালিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা তাঁর মতের পরিবর্তন ঘটাতে পারেন নি। এ কারণেই মুসলিম উম্মাহ অনেক বড় বড় ইমাম তাঁর সিদ্ধান্তকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম নববী (র.) লিখেছেন,
كانت من المهاجرات الأول ذات عقل وافر وكمال.
‘‘তিনি প্রথম যুগে হিজরতকারিণীদের একজন। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও পূর্ণতার অধিকারিণী ছিলেন।’’[10]
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর মা উম্মে সুলাইম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ছিলেন অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন একজন মহিলা সাহাবী। হাফিয ইবনে হাজার (র.) তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে বলেন,
‘‘তাঁর মর্যাদা এবং গুণাবলী অনেক এবং সর্বজনবিদিত।’’[11]
তাঁর সম্পর্কে ইমাম নববী (র.) বলেন:
كانت من فاضلات الصحابيات .
‘‘তিনি ছিলেন জ্ঞান ও মর্যাদার অধিকারিণী মহিলা সাহাবীদের একজন।’’[12]
উম্মে আতিয়্যাহ্ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন একজন মহিলা সাহাবী ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে ইমাম নববী (র.) লিখেছেন:
وهي من فاضلات الصحابيات والغازيات مع رسول الله صلى الله عليه وسلم.
‘‘তিনি উচ্চ মর্যাদা ও জ্ঞানের অধিকারিণী মহিলা সাহাবীদের একজন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে জিহাদেও শরীক হয়েছেন।’’[13]
হাফসা বিনতে সিরীন উম্মে আতিয়্যা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর একজন ছাত্রী ছিলেন। বার বছর বয়সেই তিনি কুরআন মাজীদ শিক্ষা করেন। তিনি বসরার বাসিন্দা ছিলেন। বসরার বিখ্যাত কাযী ও ফকীহ্ ইয়াস ইবনু মু‘আবিয়া তাঁর সম্পর্কে বলেন,
ما أدركت أحدا أفضِّلُ على حفصة.
‘‘আমি এমন কোনো লোক দেখি নি, যাকে হাফসা বিনতে সিরীনের উপর মর্যাদা দিতে পারি।’’[14]
তাবিয়ীদের ইমাম সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যেব তাঁর এক ছাত্রের সাথে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পরদিনই তিনি তার উস্তাদ ইমাম সাঈদের মজলিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন তাঁর স্ত্রী ইমাম সাঈদের কন্যা বললেন:
اجلس أعلمك علم سعيد.
‘‘আপনি বসুন। ইমাম সাঈদ আপনাকে যা শেখাবেন তা আমি আপনাকে শিখিয়ে দিব।’’[15]
ইমাম মালিক (র.)-এর নিকট তাঁর ছাত্ররা মুয়াত্তা অধ্যয়নকালে কোথাও কোনো ভুল করে ফেললে ইমাম সাহেবের কন্যা ঘরের ভেতর থেকে দরজায় করাঘাত করতেন। নিজের কন্যা সম্পর্কে ইমাম মালিক (র.)-এর এতটা আস্থা ছিল যে, দরজায় তাঁর করাঘাত শুনলেই তিনি ছাত্রদের বলতেন:
ارجع فالغلط معك.
‘‘তুমি আবার পড়। তোমার কোথাও ভুল হয়েছে।’’[16]
একবার আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একটি মাসআলা বর্ণনা করলেন। তখন উম্মে ইয়া‘কুব নাম্নী বানী আসাদ গোত্রের এক মহিলা তাঁর কাছে এসে বললেনঃ‘‘আমি পূর্ণ কুরআন পড়েছি। কিন্তু আপনি যে মাসআলা বর্ণনা করলেন তা কোথাও পাইনি।’’[17]
[2] ইবনে হাজার আল্-আসকালানী, আল্-ইসাবা ফী তামীযি্ সাহাবা, ৪র্থ খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৫৯।
[3] ইবনে আব্দিল বার, আল্ ইসতিয়াব ফী আসমাইল আসহাব, তাযকিরাত যায়নাব বিনতে আবূ সালামা, ৪র্থ খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮৫৫।
[4] ইবনে সা‘দ, আত্-তাবাকাত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫০।
[5] ইবনে হাজার আল্-আসকালানী, আল্-ইসাবা, প্রাগুক্ত, ৩১৭।
[6] ইমাম নববী, তাহযীবুল আসমা ওয়াস্ সিফাত, ২য় খণ্ড, মিশরঃ ইদারাতুত্ তারআতিল মুনীরয়্যাহ্, তা. বি. পৃ. ৩৪৯।
[7] বুখারী, সহীহুল বুখারী, ১ম খণ্ড, কিতাবুল আযান, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৪।
[8] ইবন আব্দিল বার, আল ইসতিয়ার ফী আসমাইল আসহাব, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৫৫।
[9] ইমাম নববী, তাহযীবুল আসমা ওয়াস্ সিফাত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬০।
[10] প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৫৩।
[11] ইবনে হাজার আল্-আসকালানী, তাহযীবুত্ তাহযীব, ১২শ খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৭২।
[12] ইমাম নববী, তাহযীবুল আসমা ওয়াস্ সিফাত, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬৩।
[13] প্রাগুক্ত, পৃ. ৩২৪।
[14] ইবনে হাজার আল্-আসকালানী, তাহযীবুত্ তাহযীব, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৯-৪১০।
[15] ইবনুল হাজ্জ, আল্-মাদখাল, ১ম খণ্ড, বৈরুতঃ দারুল ফিকর, তা. বি., পৃ. ২১৫।
[16] তদেব।
[17] মুসলিম, সহীহ্ মুসলিম, ৩য় খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৬৭৮।
উমাইয়া যুগে নারী শিক্ষার প্রতি যথোপযুক্ত দৃষ্টি প্রদান করা হতো। মুসায়েব এর স্ত্রী আয়েশা বিনতে সালেহ জোতির্বিদ্যা ও আরবের ইতিহাস সম্পর্কে এতখানি জ্ঞান লাভ করেন যে, একবার হিশাম ইবনে আব্দুল মালিক তার জ্ঞানের গভীরতায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে এক লাখ দিরহাম পুরস্কার দিয়েছিলেন। তাঁর দ্বিতীয়া স্ত্রী সাবিনা বিনতে হুসাইন কবিতা ও সাহিত্যের এক উঁচু দরের সমালোচক ছিলেন যে, ফারাযদাকের মত কবিও তাঁর প্রশংসা করেছিলেন। আব্দুল আযীয ইবনে মারওয়ানের কন্যা এবং ওয়ালিদ ইবনে আব্দুল মালিকের জ্ঞান প্রীতির কারণে তাঁদের বাড়িতে জ্ঞানী গুনী, কবি, সাহিত্যিক এবং ফকীহের আনাগোণা লেগেই থাকতো। আব্বাসীয় যুগের প্রথম দিকে নারীগণ সমাজে পুরুষের ন্যায় স্বাধীনতা ভোগ করতেন এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে নারীদের প্রভূত প্রভাব ছিল। আবুল আব্বাস আস্ সাফফাহ এর স্ত্রী উম্মে সালমা, মাহদী মহিয়সী খায়জুরান, মাহদীর কন্যা উলাইয়া, হারুন-অর-রশীদের মহিয়সী জুবায়দা প্রমুখ নারী রাজকার্যে যথেষ্ট কর্তৃত্ব খাটাতেন। হারুনের মহিয়সী জুবায়দা উচ্চ গুণ সম্পন্না কবি ছিলেন। মামুনের মহিয়সী বুরান ছিলেন সে যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকা। আব্বাসীয় আমলে ছেলেমেয়েদের লালন-পালন ও শিক্ষা দানের দায়িত্ব জননীদের উপর ন্যস্ত ছিল। মহিলাগণ সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করতেন।[1]
>