ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। যেসব গুণের জন্য ইসলাম পৃথিবীর মানুষের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীন হিসেবে পরিচিত, সমতা তার মধ্যে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। ইসলাম নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা অত্যন্ত জোরের সাথে ব্যক্ত করেছে।[1] মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَن يَعۡمَلۡ مِنَ ٱلصَّٰلِحَٰتِ مِن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَدۡخُلُونَ ٱلۡجَنَّةَ وَلَا يُظۡلَمُونَ نَقِيرٗا ١٢٤ ﴾ [النساء: ١٢٤]
‘‘পুরুষ অথবা নারীর মধ্যে কেউ সৎ কাজ করলে ও মুমিন হলে তারা জান্নাতে দাখিল হবে এবং তাদের প্রতি অনু পরিমাণও জুলুম করা হবে না।’’[2] পরকালে জান্নাতের চির শান্তি লাভের উপায় হিসেবে দুনিয়াতে আমাদের জন্য নাযিল হয়েছে দ্বীন। সুতরাং ইলমে দ্বীন জানা প্রত্যেক নর নারীর উপর একান্ত জরুরী।[3] এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন,
﴿قُلۡ هَلۡ يَسۡتَوِي ٱلَّذِينَ يَعۡلَمُونَ وَٱلَّذِينَ لَا يَعۡلَمُونَۗ إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٩ ﴾ [الزمر: ٩ ]
‘‘বল! যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? বোধশক্তিসম্পন্ন লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে।’’[4]
জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান বিকাশের পৃষ্ঠপোষকতা মুসলিমদের জন্য অবশ্য করণীয় বা ফরয। নারী পুরুষ ভেদে ইসলামের শিক্ষা (জ্ঞান অর্জন) বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘ইলম তলব করা প্রত্যেক মুসলিমের (নর নারী) জন্য ফরয।’’[5]
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা নারী পুরুষ সকল বিশ্বাসীকে লক্ষ্য করে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে তিনি শুধু জ্ঞানার্জনের তাকীদই দেননি, জ্ঞানার্জনের মর্যাদার বিষয়টিও আল্-কুরআনে একাধিকবার ব্যবহার করেছেন,
﴿يَرۡفَعِ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ مِنكُمۡ وَٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ دَرَجَٰتٖۚ ﴾ [المجادلة: ١١]
‘‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে আর যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে, আল্লাহ্ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন।’’[6]
জ্ঞানের মর্যাদা সম্পর্কে হাদীসে আরও বর্ণিত আছে, ‘‘যে ব্যক্তি ইলম তলব করার উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করেছে আল্লাহ তা‘আলা তার দ্বারা তাকে বেহেশতের পথ সমূহের একটি পথে পৌঁছে দেন।’’[7]
এ উক্তিটি ভেবে দেখার মত। কেননা জ্ঞানীদের কঠোর পরিশ্রম, সাধনা, ত্যাগ ও ধৈর্যের ফলে দ্বীনী জ্ঞান বিজ্ঞান সংরক্ষিত হয়ে অনাগত ভবিষ্যত বংশধরদের নিকট পৌঁছায়।[8]
নর নারী উভয়েরই বিদ্যা শিক্ষার অধিকার অবশ্যই আছে। আত্মিক উৎকর্ষ সাধন যা মানুষের সকল কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য এবং এর সাথে সঙ্গতি রেখেই জাগতিক উন্নতি ও কল্যাণ অর্জনের জন্য সে বিদ্যা ও জ্ঞান আদি নর নারীকে দেওয়া হয়েছিল। তার ওপর ভিত্তি করে চিন্তা, গবেষণা ও অনুশীলনের দ্বারা উত্তম জ্ঞান বুদ্ধিকে উত্তম কাজে লাগানোর স্বত্বাধিকার উভয়েরই আছে। বিদ্যা ও জ্ঞান অতি প্রয়োজনীয় বস্তু, এমনকি এটা ছাড়া মানুষ স্বীয় দ্বীনও সঠিকভাবে পালন করতে পারে না। তাই উত্তম দ্বীনী বিদ্যা ও জ্ঞানের বিষয় যদি সুদূর কোনো দেশেও থাকে, তবে সেখানে গিয়ে হলেও তা অর্জন করার তাকীদ রয়েছে।[9] আর দ্বীনের ইলম যারা হাসিল করেনি তাদের আমলও সঠিক হয় না।[10]
মহিলাদের প্রাথমিক শিক্ষাগার ও প্রশিক্ষণ স্থান হলো গৃহ। তাই পিতামাতা যাতে কন্যাদেরকে এবং স্বামী যাতে স্ত্রীকে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে শেখায় এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে, ইসলাম সেদিকে তাদের দৃষ্টি দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছেঃ
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ قُوٓاْ أَنفُسَكُمۡ وَأَهۡلِيكُمۡ نَارٗا ﴾ [التحريم: ٦]
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাও।’’[11] এ আয়াতের অর্থ আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এভাবে করেছেনঃ
علموا أنفسكم وأهليكم الخير وأدبوهم
‘‘তোমরা নিজেরা শেখ এবং পরিবারবর্গকে শেখাও সমস্ত কল্যাণময় রীতি-নীতি এবং তাদের আদব শিক্ষা দাও এবং এসব কাজে অভ্যস্ত করে তোল।’’[12]
>[2] সূরা আন্-নিসা : ১২৪।
[3] প্রিন্সিপাল মাওলানা আকবর, বেগম নূরজাহান, বাংলাদেশে মহিলা মাদ্রাসা আন্দোলন, (ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ফেব্রুয়ারী ১৯৮৮), পৃ. ৬।
[4] সূরা আয্-যুমার : ৯।
[5] মুহাম্মদ ইবনে ইয়াযিদ, ইবনু মাজাহ্, কিতাবুল ইলম, হাদীস নং ২২৪।
[6] .সূরা মুজাদালাহ্ : ১১।
[7] .ইমাম মহিউদ্দীন আন্-নববী, কিতাবুল ইলম্, পূর্বোক্ত, পৃ. ৩৪।
[8] .ফযিলা তাহের, মেয়েদের ইসলামী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, মাসিক দারুস সালাম, ঢাকা, দারুস সালাম, ডিসেম্বর জানুয়ারী ১৯৯৯, পৃ. ১২।
[9] .‘সুদূর কোন দেশে গিয়ে হলেও বিদ্যা অর্জনের তাকীদ’ সংক্রান্ত বিষয়টির দলিল হিসেবে বলা হয়, ‘‘সুদূর চীনে গিয়ে হলেও জ্ঞানান্বেষণ কর’’ থেকে। এ কথা হাদীস হিসাবে আমাদের সমাজে প্রচলিত। প্রকৃতপক্ষে, এটি আদৌ হাদীস কি-না, হাদীস বিশারদগণ যুগ যুগ ধরে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন। আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ এর সিলসিলাতুল আহাদীসিদ দ্বা‘য়ীফাহ, প্রথম খন্ডে ৪১৩ পৃষ্ঠায় এ ব্যাপারে লিখেছেন, ‘হাদীসটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। নবী কারীম (সাঃ)-এ কথা বলেননি।’
[10] প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা আকবর, বেগম নূরজাহান, পূর্বোক্ত, পৃ. ৭।
[11] .আল্-কুরআন, সূরা আত্-তাহরীম : ৬।
[12] .আল্লামা শাওকানী, ফাতহুল কাদীর, ৫ম খণ্ড, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৬।