যাকাত বিধানের সারসংক্ষেপ ইসলামহাউজ.কম ৪৩ টি
যাকাত বিধানের সারসংক্ষেপ ইসলামহাউজ.কম ৪৩ টি

আরবী الزكاة ‘যাকাত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বৃদ্ধি ও উন্নতি। যাকাত শব্দের আভিধানিক আরেকটি অর্থ হয় التطهير (তাতহির), যার বাংলা অনুবাদ পবিত্র করা। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿قَدۡ أَفۡلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ٩﴾ [الشمس: 9]

“সে নিশ্চিত সফল হয়েছে যে তাকে (নফসকে) পবিত্র করেছে”। [সূরা আশ-শামস, আয়াত: ৯]

যাকাতের কারণে সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তাই যাকাতকে যাকাত বলা হয়। যাকাতের কারণে নেকিও বর্ধিত হয়। আরেকটি কারণ হলো, যাকাত নফসকে কৃপণতার ন্যায় বদ অভ্যাস থেকে পবিত্র করে, তাই অভিধানের দ্বিতীয় অর্থও শরঈ‘ যাকাতে পাওয়া যায়।

ইসলামী পরিভাষায়, নির্দিষ্ট সম্পদের ভেতর শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত পরিমাণকে যাকাত বলা হয়, যা বিশেষ শ্রেণি ও নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করতে হয়। জ্ঞাতব্য যে, কুরআন, সুন্নাহ ও মুসলিম উম্মাহর ঐকমত্যে যাকাত ফরয, এতে কারও দ্বিমত নেই।

যাকাতের প্রতি উৎসাহ প্রদান ও যাকাত না দেওয়ার পরিণতি

১. আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿خُذۡ مِنۡ أَمۡوَٰلِهِمۡ صَدَقَةٗ تُطَهِّرُهُمۡ وَتُزَكِّيهِم بِهَا وَصَلِّ عَلَيۡهِمۡۖ إِنَّ صَلَوٰتَكَ سَكَنٞ لَّهُمۡۗ وَٱللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ١٠٣﴾ [التوبة: 103]

“তাদের সম্পদ থেকে সদকা নাও, এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে এবং তাদের জন্য দো‘আ কর, নিশ্চয় তোমার দো‘আ তাদের জন্য প্রশান্তিদায়ক”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩]

অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿إِنَّ ٱلۡمُتَّقِينَ فِي جَنَّٰتٖ وَعُيُونٍ ١٥ ءَاخِذِينَ مَآ ءَاتَىٰهُمۡ رَبُّهُمۡۚ إِنَّهُمۡ كَانُواْ قَبۡلَ ذَٰلِكَ مُحۡسِنِينَ ١٦ كَانُواْ قَلِيلٗا مِّنَ ٱلَّيۡلِ مَا يَهۡجَعُونَ ١٧ وَبِٱلۡأَسۡحَارِ هُمۡ يَسۡتَغۡفِرُونَ ١٨ وَفِيٓ أَمۡوَٰلِهِمۡ حَقّٞ لِّلسَّآئِلِ وَٱلۡمَحۡرُومِ ١٩﴾ [الذاريات: 15-19]

“নিশ্চয় মুত্তাকিরা থাকবে জান্নাতসমূহে ও ঝর্ণাধারায়, তাদের রব তাদের যা দিবেন তা তারা খুশীতে গ্রহণকারী হবে। ইতোপূর্বে এরাই ছিল সৎকর্মশীল। রাতের সামান্য অংশই এরা ঘুমিয়ে কাটাতো। আর রাতের শেষ প্রহরে এরা ক্ষমা চাওয়ায় রত থাকত। আর তাদের সম্পদে রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক”। [সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত: ১৫-১৯]

অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿وَٱلَّذِينَ يَكۡنِزُونَ ٱلذَّهَبَ وَٱلۡفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ فَبَشِّرۡهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٖ ٣٤﴾ [التوبة:34]

“যারা সোনা ও রূপা পুঞ্জীভূত করে রাখে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, তুমি তাদেরকে বেদনাদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৩৪]

অপর আয়াতে তিনি বলেন:

﴿وَلَا يَحۡسَبَنَّ ٱلَّذِينَ يَبۡخَلُونَ بِمَآ ءَاتَىٰهُمُ ٱللَّهُ مِن فَضۡلِهِۦ هُوَ خَيۡرٗا لَّهُمۖ بَلۡ هُوَ شَرّٞ لَّهُمۡۖ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُواْ بِهِۦ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۗ ١٨٠﴾ [آل عمران:180]

“আল্লাহ যাদেরকে তার অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর, যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল, কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮]

২. ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে ইয়ামান পাঠানোর সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন:

«إنك تأتي قوماً من أهل الكتاب، فادْعُهُم إلى شهادة أنْ لا إله إلا الله، وأني رسول الله، فإنْ هم أطاعوا لذلك، فأعْلِمْهُم أن الله افترض عليهم خمس صلوات في كل يوم وليلة، فإنْ هم أطاعوا لذلك، فأعْلِمْهُم أن الله افترض عليهم صدقة تُؤخَذ مِن أغنيائهم فتُرَدّ في فقرائهم، فإنْ هم أطاعُوا لذلك، فإيَّاكَ وَكَرَائِمُ أموالهم (يعني لا تأخذ الزكاة مِن أفضل أموالهم وأحَبّهَا إليهم كما سيأتي)، واتقِ دعوة المظلوم، فإنه ليس بينها وبين الله حِجاب».

“তুমি কিতাবিদের এক কওমের নিকট যাচ্ছ, অতএব, তাদেরকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আমি আল্লাহর রাসূল’ সাক্ষীর দিকে আহ্বান কর, যদি তারা এতে আনুগত্য প্রকাশ করে, তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, প্রত্যেক দিন ও রাতে আল্লাহ তাদের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। যদি তারা এতে আনুগত্য প্রকাশ করে, তাদেরকে জানিয়ে দাও যে, আল্লাহ তাদের ওপর সদকা ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের থেকে গ্রহণ করে তাদেরই গরীবদের মাঝে বণ্টন করা হবে, যদি তারা এতে আনুগত্য প্রকাশ করে, তুমি তাদের দামী সম্পদ গ্রহণ করা পরিহার কর, (অর্থাৎ যে সম্পদ তাদের নিকট অতি উত্তম ও অধিক পছন্দনীয় যাকাত হিসেবে সেখান থেকে তুমি গ্রহণ করবে না, সামনে এ সম্পর্কে আলোচনা আসছে), আর মজলুমের দো‘আ থেকে বাঁচ। কারণ, তার মাঝে ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা নেই”।[1]

>
[1] সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।

যাকাত ইসলামের একটি ফরয ও রুকন, যথাসম্ভব সম্পদের যাকাত দ্রুত বের করা ওয়াজিব। সকল আলিম একমত যে, যাকাত ত্যাগ করা কবিরা গুনাহ। যদি কেউ জানে যাকাত ফরয, তারপরও যাকাত ফরয হওয়াকে অস্বীকার করে যাকাত প্রদান থেকে বিরত থাকে, সে কাফির ও ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত। মুসলিম শাসকের দায়িত্ব কুফরির কারণে তাকে হত্যা করা। আর যদি সে নতুন মুসলিম হয় অথবা ইলম ও ইসলামী জ্ঞানের শহর থেকে দূরে অবস্থান করে, না-জানার কারণে তাকে অবকাশ দিবে, যদি সে মুসলিমদের পাশে থেকে না জানার দাবি করে, তার কথায় কর্ণপাত করা হবে না। কারণ, যাকাত ইসলামের অপরিহার্য বিধান, মুসলিম মাত্র সবাই তা জানে।

অতএব, যদি কেউ যাকাত ত্যাগ করে, শাসক জোরপূর্বক তার থেকে যাকাত আদায় করবে এবং তাকে শাসাবে ও শাস্তি দিবে। শাস্তির একটি উদাহরণ: যাকাত আদায় শেষে শাস্তিস্বরূপ তার অর্ধেক সম্পদ নিয়ে নিবে, আর অর্ধেক সম্পদ দ্বারা উদ্দেশ্য যে সম্পদের যাকাত দেয় নি তার অর্ধেক। এটিই আলিমদের বিশুদ্ধ মত। উদাহরণত, কারও ওপর স্বর্ণ ও ফসল দু’টি বস্তুর যাকাত ফরয, সে ফসলের যাকাত দিয়েছে স্বর্ণের যাকাত দেয় নি, বরং কৃপণতা করেছে, তার ক্ষেত্রে শুধু স্বর্ণের ওপর শাস্তি হবে, যেমন তার থেকে জোরপূর্বক প্রথম স্বর্ণের যাকাত বের করবে, অতঃপর অবশিষ্ট স্বর্ণের অর্ধেক গ্রহণ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«... وَمَن منعها فإنا آخِذُوها، وَشَطْرَ مالِهِ (يعني وآخِذوا نصف ماله أيضاً بعد الزكاة)، عَزمَة مِن عَزَمات ربنا تبارك وتعالى (يعني أنَّ هذا أمرٌ أوْجَبَهُ اللهُ تعالى على الحاكم)».

“আর যে যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, আমরা সেটি গ্রহণ করব এবং আরও গ্রহণ করব তার সম্পদের অর্ধেক। (অর্থাৎ যাকাত শেষে অবশিষ্ট সম্পদ থেকে অর্ধেক গ্রহণ করব)। এটি আমাদের রবের কড়া নির্দেশ থেকে একটি নির্দেশ। (অর্থাৎ শাসকের ওপর বিধানটি আল্লাহ ওয়াজিব করে দিয়েছেন)”।[1]

>
[1] সহীহুল জামে‘, হাদীস নং ৪২৬৫।

বিভিন্ন প্রকার যাকাত রয়েছে, যেমন স্বর্ণের যাকাত, চেক ও ব্যাংক নোটের যাকাত, যাকাতুল ফিতর, ব্যবসায়ী পণ্যের যাকাত, গুপ্তধনের যাকাত, জীব-জন্তুর যাকাত এবং ফল ও ফসলের যাকাত।

যাকাত ফরয হওয়ার শর্তসমূহ:

১ম শর্ত: ব্যক্তির স্বাধীন হওয়া: যাকাত ফরয হওয়ার জন্য ব্যক্তির স্বাধীন হওয়া জরুরি, কারণ গোলাম-দাসের ওপর যাকাত ফরয নয়, তবে তাদের পক্ষ থেকে যাকাতুল ফিতর আদায় করা জরুরি, যার বর্ণনা সামনে আসছে।

২য় শর্ত: মুসলিম হওয়া

জ্ঞাতব্য যে, যাকাত ফরয হওয়ার জন্য ব্যক্তির সাবালিগ ও বিবেক সম্পন্ন হওয়ার জরুরি নয়। এটিই আলিমদের বিশুদ্ধ মত। অতএব, নাবালক ও পাগলের সম্পদে যাকাত ফরয। অভিভাবকগণ তাদের সম্পদ থেকে যাকাত বের করবেন।[1]

৩য় শর্ত: সম্পদ নিসাব পরিমাণ হওয়া: শরী‘আত কর্তৃক সম্পদের নির্দিষ্ট পরিমাণকে নিসাব বলা হয়। সম্পদ নির্দিষ্ট পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি হলে তাতে যাকাত ওয়াজিব। বিভিন্ন প্রকার সম্পদ যেমন স্বর্ণ, রূপা, ফসল ও জতুষ্পদ প্রাণীর যাকাতের নিসাব কি, সামনে তার আলোচনা আসছে।

৪র্থ শর্ত: নিসাব পরিমাণ সম্পদে হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া: কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«لا زكاة في مالٍ، حتى يَحُول عليه الحَوْل».

“কোনো সম্পদেই যাকাত নেই, যতক্ষণ না তার ওপর এক বছর পূর্ণ হবে”।[2]

সম্পদ যেদিন নিসাব পরিমাণ হবে সেদিন থেকে হিজরী বছর গণনা শুরু করবে, তবে শর্ত হচ্ছে বছর শেষ পর্যন্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদ স্থির থাকা অথবা ক্রমান্বয়ে বর্ধিত হওয়া। যদি বছরের মধ্যবর্তী সম্পদ নিসাব থেকে কমে যায়, অতঃপর একই বছর পুনরায় নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে বিশুদ্ধ মতে দ্বিতীয়বার যখন সম্পদ নিসাব পরিমাণ হবে, তখন থেকে বছর গণনা শুরু করবে, প্রথম তারিখ গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ নিসাব থেকে সম্পদ কমে যাওয়ার কারণে বছর শেষ হয়ে গেছে। অধিকাংশ আলিমের মাযহাব এটি।

তবে কতক সম্পদ রয়েছে, যার যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য এক বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি নয়। যেমন, জমি থেকে উৎপন্ন ফল ও ফসল। কারণ জমি থেকে যে দিন উৎপন্ন ফল ও ফসল কাটা হয় সেদিন তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَءَاتُواْ حَقَّهُۥ يَوۡمَ حَصَادِهِۦۖ ١٤١﴾ [الأنعام: 141]

“আর তার (অর্থাৎ ফল ও ফসলের) হক দিয়ে দাও, যে দিন তা কাটা হয়”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৪১]অনুরূপ জতুষ্পদ প্রাণীর বাচ্চার যাকাত, অর্থাৎ হিজরী বছরের মধ্যবর্তী যদি কোন পশু বাচ্চা জন্ম দেয়, সেই বাচ্চা নিসাবের সাথে যোগ হবে। সামনে তার আলোচনা আসছে। অনুরূপ ব্যবসায়ী পণ্যের মুনাফা, অর্থাৎ বছরের মাঝখানে অর্জিত মুনাফা মূলধনের সাথে যোগ হবে, যদিও মুনাফার ওপর এক বছর পূর্ণ না হয়। অনুরূপ গুপ্তধন, তার ওপরও হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি নয়, সামনে তার বর্ণনা আসছে। উল্লেখ্য, যাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য যেসব সম্পদে হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি নয়, তার বিস্তারিত বর্ণনা নির্দিষ্ট স্থানে আসছে।

>
[1] আশ-শারহুল মুমতি: (৬/২০২-৩)।

[2] দেখুন: সহীহুল জামে‘: হাদীস নং ৭৪৯৭।

অলঙ্কার দু’প্রকার:

প্রথম প্রকার: দু’টি নগদ মুদ্রা, অর্থাৎ স্বর্ণ ও রূপা। স্বর্ণ ও রূপার যাকাত সম্পর্কে আহলে ইলমগণ একাধিক মত পোষণ করেছেন। কেউ ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন দেখতে হবে: স্বর্ণ-রূপা সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য গ্রহণ করার জন্য, না সঞ্চয় করে রাখার জন্য, না ব্যবসা বা অন্য কোনো কাজের জন্য। অধিক বিশুদ্ধ মত হচ্ছে: নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ-রূপার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে, যে উদ্দেশ্যেই তা সংগ্রহ করুক। কারণ যাকাত ওয়াজিব হওয়ার দলীল সবপ্রকার স্বর্ণ-রূপাকে শামিল করে, কোনো প্রকার স্বর্ণ-রূপা যাকাত থেকে বাদ দেওয়া হয় নি। তাই বলে যারা বলেন ব্যবহার করার স্বর্ণ-রূপার ওপর যাকাত ফরয নয়, তাদের কথাকে মূল্যহীন জ্ঞান করছি না, যেহেতু এটি আলিমদের মাঝে বিরোধপূর্ণ মাসআলা, তাতে দ্বিমত করার সুযোগ আছে।

জ্ঞাতব্য: নারীর মালিকানাধীন স্বর্ণ-রূপার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে, যদি তার নিকট যাকাত দেওয়ার অর্থ না থাকে, যাকাত পরিমাণ অলঙ্কার বিক্রি যাকাত দিবে। কেউ যদি তাকে যাকাতের ক্ষেত্রে সাহায্য করে, যেমন স্বামী বা নিকট আত্মীয় তবে তাতে কোনোও সমস্যা নেই।

দ্বিতীয় প্রকার: স্বর্ণ-রূপা ব্যতীত অন্যান্য বস্তু যেমন হীরা, মুক্তা, ইয়াকুত, মোতি, মুক্তোদানা, গোমেদ-পীতবর্ণ মণিবিশেষ ইত্যাদি বস্তুর ভেতর যাকাত ওয়াজিব হয় না; তার মূল্য যাই হোক, তবে ব্যবসার জন্য হলে ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা সামনে আসছে।

স্বর্ণের নিসাব: স্বর্ণের নিসাব বিশ দিরহাম স্বর্ণ, যা ওজন করলে ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ হয়। কারও মালিকানাধীন যদি ৮৫ গ্রাম বা ততোধিক স্বর্ণ থাকে, ক্যারেট যাই হোক, তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। যাকাতের পরিমাণ এক-দশমাংশের এক চতুর্থাংশ, অর্থাৎ মোট স্বর্ণের ২.৫ পার্সেন্ট।

যাকাত দেওয়ার নিয়ম: ব্যক্তির মালিকানায় যে ক্যারেট স্বর্ণ রয়েছে সেই ক্যারেটের একগ্রাম স্বর্ণের বাজার দর জানবে প্রথম। যদি একাধিক ক্যারেটের স্বর্ণ থাকে, যে ক্যারেট স্বর্ণ বেশি আছে তার বাজার দর জানবে, অতঃপর একগ্রাম স্বর্ণের মূল্যকে তার নিকট যে ক’গ্রাম স্বর্ণ রয়েছে তার সংখ্যা দিয়ে পূরণ দিবে। এভাবে স্বর্ণের গ্রামকে মুদ্রায় পরিণত করবে, অতঃপর ক্যালকুলেটর দিয়ে মোট মূল্য থেকে ২.৫% বের করবে, যে অংক আসবে তাই স্বর্ণের যাকাত।

উদাহরণ: কেউ ২১ ক্যারেট ১০০ গ্রাম স্বর্ণের মালিক, সে তার যাকাত বের করার জন্য প্রথম ২১ ক্যারেট স্বর্ণের বাজার দর জানবে, যদি একগ্রাম স্বর্ণের দাম হয় ১০,০০০ টাকা, যাকাতের হিসেব হবে নিম্নরূপ: ১০০ (গ্রাম-স্বর্ণ)* ১০,০০০ (টাকা, যা একগ্রাম স্বর্ণের মূল্য)* ২.৫% (যাকাত) অর্থাৎ ১০০* ১০,০০০* ২.৫%=২৫০০০ টাকা।

রূপার নিসাব: ২০০ দিরহাম রূপা, যা ওজন করলে ৫৯৫ গ্রাম হয়। কারও মালিকানায় যদি ২০০ দিরহাম বা তার চেয়ে বেশি রূপা থাকে এবং তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, তবেই তাতে যাকাত ফরয হবে। যাকাতের পরিমাণ: এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ মোট রূপার ২.৫%।

যাকাত বের করার নিয়ম: যে ক্যারেট রূপা তার কাছে রয়েছে, প্রথম তার বাজার দর জানবে, আর যদি একাধিক ক্যারেটের রূপা থাকে, যে ক্যারেট রূপা বেশি রয়েছে তার বাজার দর জানবে। অতঃপর যত গ্রাম রূপা তার মালিকানায় রয়েছে তার সংখ্যা দিয়ে একগ্রাম রূপার বাজার দরকে গুণ দিবে, গুণফল থেকে ২.৫% যাকাত বের করবে, যে অংক বের হবে সেটি ৫৯৫ গ্রাম রূপার যাকাত।

উদাহরণ: কেউ ৬০০ গ্রাম রূপার মালিক, সে যখন তার যাকাত বের করার ইচ্ছা করবে প্রথম একগ্রাম ৮০ ক্যারেট রূপার বাজার দর জানবে। যদি মনে করি একগ্রাম রূপার মূল্য ১০০ টাকা, নিম্নের নিয়মে যাকাত বের করবে: ৬০০ (গ্রাম-রূপা)* ১০০ (টাকা, যা একগ্রাম-রূপার মূল্য)* ২.৫% = ১৫০০ টাকা। অর্থাৎ একগ্রাম রূপার মূল্য যদি হয় ১০০ টাকা, ৬০০ গ্রাম রূপার যাকাত আসবে ১৫০০ টাকা।

জ্ঞাতব্য: স্বর্ণ-রূপা দ্বারা উদ্দেশ্য খালিস স্বর্ণ-রূপা, সেটি মুদ্রা হতে পারে, যেমন স্বর্ণের জুনাই বা পরিশোধিত স্বর্ণও হতে পারে, যা দিয়ে এখনো গহনা তৈরি করা হয় নি। অনুরূপ আকরিক অর্থাৎ অশোধিত স্বর্ণ-রূপার বিধান।

মাসআলা: কেউ স্বর্ণ-রূপা দু’টি বস্তুর মালিক, একটিও নিসাব বরাবর নয়, সে কি স্বর্ণ-রূপা জমা করবে? অর্থাৎ স্বর্ণ ও রূপার বাজার দর যোগ করে যদি দেখে শুধু স্বর্ণ বা শুধু রূপার নিসাব বরাবর হয়, তার কি যাকাত দেওয়া ওয়াজিব?

আহলে ইলমদের বিশুদ্ধ মত মোতাবেক এই অবস্থায় স্বর্ণের সাথে রূপা যোগ করা জরুরি নয়, স্বর্ণ বা রূপা কারও ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না স্বতন্ত্রভাবে স্বর্ণ বা রূপা যাকাতের নিসাব বরাবর হবে। কেননা বিশুদ্ধতম অভিমত হচ্ছে, স্বর্ণ ও রূপা স্বতন্ত্র দু’টি বস্তু, একটির সাথে অপরটি যোগ করে নিসাব পূর্ণ করার কোনও দলীল নেই।

এ কথা নগদ অর্থের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, অর্থাৎ কেউ যদি নগদ অর্থের মালিক হয়, যাকাতের নিসাব পূর্ণ করার জন্য স্বর্ণ বা রূপা বা ব্যবসায়ী পণ্যের সাথে নগদ অর্থ যোগ করা জরুরি। কারণ, যাকাতের সম্পদ বলতে যা বুঝানো হয়, অলঙ্কার, নগদ অর্থ ও ব্যবসায়ী পণ্য তার অন্তর্ভুক্ত। এ কথার অর্থ স্বর্ণের যাকাত টাকা দিয়ে, টাকার যাকাত স্বর্ণ দিয়ে আদায় করা বৈধ। কারণ, একটি অপরটির প্রতিনিধিত্ব করে। অতএব, কারও নিকট যদি নগদ অর্থ ও স্বর্ণ থাকে, একটির সাথে অপরটি যোগ করা জরুরি। অর্থাৎ স্বর্ণকে টাকার অংকে নিয়ে আসবে, অতঃপর নগদ অর্থ ও স্বর্ণের মূল্য হিসেব করবে, যদি নিসাব পরিমাণ হয় উভয়ের যাকাত দিবে, অর্থাৎ যৌথভাবে স্বর্ণ ও নগদ অর্থের যাকাত দিবে, যদি তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়। অনুরূপ কারও নিকট যদি নগদ অর্থ ও রূপা থাকে অথবা নগদ অর্থ, স্বর্ণ ও রূপা থাকে, সে স্বর্ণ-রূপার মূল্য ও নগদ অর্থ যোগ করে যাকাত দিবে, তবে একটি বিষয় স্মরণ রাখবে যে, এক বস্তু থেকে একই বছর দু’বার যাকাত গ্রহণ করা যাবে না।

ব্যাংক নোট যেমন ডলার, জুনাই, রিয়াল ও অন্যান্য মুদ্রা, যা নগদ অর্থ হিসেবে পরিচিত। অনুরূপ অর্থের বিভিন্ন দলীল, যেমন চেক, বিল, বিনিয়োগ সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজপত্র, যার বৈষয়িক মূল্য রয়েছে।

জ্ঞাতব্য যে, ব্যাংক নোট ও চেক মূলত তার মূল্যের দলীলস্বরূপ, অতএব, তার মূল্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত ওয়াজিব হবে। প্রতি হাজারে পঁচিশ টাকা যাকাত আসবে।

আরেকটি জিজ্ঞাসা, টাকার নিসাবের মানদণ্ড কি, স্বর্ণ, না-রূপার মূল্য?

উত্তর: রূপার নিসাবের মূল্যকে টাকার নিসাবের মানদণ্ড করাই উত্তম, অর্থাৎ ব্যাংক নোট, চেক ও অন্যান্য ডকুমেন্টের মূল্য যদি ৫৯৫ গ্রাম রূপার মূল্য বরাবর হয় তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এভাবে যাকাত দেওয়া উত্তম কয়েকটি কারণে:

প্রথমত: এতে রয়েছে সতর্কতা ও দায়-মুক্তি, কেননা হতে পারে আল্লাহর নিকট রূপার মূল্যের ভিত্তিতে যাকাত ওয়াজিব হয়েছে। কারণ, নিসাব পরিমাণ রূপার মূল্য নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ অপেক্ষা অনেক কম।

দ্বিতীয়ত: নিসাব পরিমাণ রূপার মূল্যকে টাকার যাকাতের মানদণ্ড নির্ধারণ করা হলে গরীবদের উপকার হয়। কারণ স্বর্ণ অপেক্ষা রূপার মূল্য কম। তাই রূপার নিসাবে যে পরিমাণ লোকের ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়, স্বর্ণের নিসাবে সে পরিমাণ লোকের ওপর যাকাত ওয়াজিব হয় না। অতএব, রূপার নিসাবে যাকাত দানকারীর সংখ্যা বাড়বে, ফলে গরীবরা উপকৃত হবে। তবুও আমরা তাদেরকে তিরস্কার করি না, যারা দ্বিতীয় মতকে গ্রহণ করে স্বর্ণের মূল্য হিসেব করে যাকাত দিবেন। কারণ, মাসআলাটি আলিমদের মাঝে বিরোধপূর্ণ।

অতএব, মালিক যদি রূপার নিসাবের ভিত্তিতে যাকাত দেয়, প্রথম রূপার বাজার দর জানবে। উদাহরণত ৮০ ক্যারেট রূপার বাজার দর জানবে। কারণ, ৮০ ক্যারেট রূপা মানুষের মাঝে প্রচলিত ও সচরাচর আদান-প্রদান করা হয়, অতঃপর এক গ্রাম রূপার মূল্যকে ৫৯৫ দিয়ে গুণ দিবে, যে অংক আসবে সেটি রূপার নিসাবের মূল্য। এবার দেখবে রূপার নিসাবের মূল্য ও যাকাত দানকারীর স্বর্ণ-রূপার মূল্য ও নগদ অর্থ বরাবর কি না, যদি বরাবর বা তার চেয়ে বেশি হয়, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব, অর্থাৎ প্রত্যেক হাজার থেকে পঁচিশ টাকা যাকাত দিবে, যা যাকাত দানকারীর মোট সম্পদের ২.৫%। উদাহরণত কেউ ১০০০০০ এক লক্ষ টাকার মালিক, তার যাকাত হবে: ১০০০০০* ২.৫%= ২৫০০ টাকা। যদি রূপার মূল্যকে মানদণ্ড মানা হয়।

আর যদি স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থের যাকাত বের করার সময় দ্বিতীয় ফতোয়া মোতাবেক স্বর্ণের মূল্যকে যাকাতের মানদণ্ড মানা হয়, প্রথম ২১ ক্যারেট স্বর্ণের বাজার দর জানবে। কারণ, এই ক্যারেট স্বর্ণ সবার নিকট পরিচিত ও সচরাচর আদান-প্রদান করা হয়, অতঃপর একগ্রাম স্বর্ণের মূল্যকে ৮৫ দিয়ে গুণ দিবে, গুণফল ৮৫ গ্রাম স্বর্ণের বাজার মূল্য, যা স্বর্ণের নিসাব। যদি কারও স্বর্ণ-রূপার মূল্য ও নগদ অর্থ এই পরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি হয়, তার ওপর দ্বিতীয় ফতোয়া মোতাবেকও যাকাত ওয়াজিব হবে, অর্থাৎ প্রতি হাজার থেকে পঁচিশ টাকা যাকাত দিবে, যেমন পূর্বে বলেছি।

আলিমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন যে, মানুষের নিকট যার যাকাতের নিসাব পরিমাণ ঋণ বা পাওনা আছে এবং সে ঋণের ওপর হিজরী এক বছরও পূর্ণ হয়েছে, তার যাকাত বের করা কি ওয়াজিব?

আলিমদের বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, ঋণের ওপর যাকাত নেই, ঋণ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত বা অনিশ্চিত যাই হোক। ঋণ ফেরত পাওয়া নিশ্চিত যেমন দেনাদার ঋণ স্বীকার করে, ভবিষ্যতে অস্বীকার করবে না এবং তার থেকে উসুল করাও সম্ভব। ঋণ ফেরত পাওয়া অনিশ্চিত যেমন দেনাদার ঋণ অস্বীকার করে অথবা গরীব-ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য তার নেই অথবা ঋণ নিয়ে টালবাহানাকারী। এসব ক্ষেত্রে যাকাত নেই। কারণ, ঋণ তার পূর্ণ আয়ত্তে নেই, সে তাতে কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা রাখে না, যেহেতু তার কাছে নেই, তবুও যারা বলেন, ঋণের ওপর যাকাত ফরয তাদের মতকে মূল্যহীন বলি না।

কয়েকটি জ্ঞাতব্য:

১. মানুষের নিকট যাদের বকেয়া রয়েছে, সেই বকেয়ার সাথে যুক্ত হবে বকেয়া মাহর। অর্থাৎ বকেয়া মাহর স্বামীর ওপর স্ত্রীর ঋণ হিসেবে গণ্য হবে। অনুরূপ ঋণ গণ্য হবে কাস্টমারের নিকট থাকা দোকানির অবশিষ্ট কিস্তি। এতদ ভিন্ন অন্যান্য ঋণের ওপরও যাকাত নেই, যতক্ষণ না মালিক তা হস্তগত করবে। হাতে পাওয়ার পর থেকে যখন এক বছর পূর্ণ হবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে। এটিই আলিমদের বিশুদ্ধ মত। অনুরূপ কারও যদি সম্পদ থাকে, আর সে সম্পদ চুরি বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাতেও যাকাত ওয়াজিব হবে না। কারণ, তার ওপর মালিকের পুরোপুরি কর্তৃত্ব নেই, যদি সম্পদ ফেরত পায় তবুও তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না হাতে পাওয়ার পর থেকে তার ওপর এক বছর পূর্ণ হবে। এটিই বিশুদ্ধ মত, যেমন ঋণ ফেরত পাওয়ার মাসআলায় বলেছি।

২. ঋণী ব্যক্তির মাসআলা: অর্থাৎ যার নিকট মানুষের ঋণ আছে, তার ঋণের ওপর যদি এক বছর পূর্ণ হয় যাকাত দিবে কি না? উত্তর: হ্যাঁ, যাকাত দিবে, তবে ঋণের সম্পদ তার আয়ত্তে ও কর্তৃত্বে থাকা শর্ত।

৩. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ওপর যদি যাকাত ফরয হয়, যেমন সে নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ অথবা রূপা অথবা ব্যবসায়ী পণ্যের মালিক, সে যাকাত দিবে, ঋণের কারণে তার যাকাত মওকুফ হবে না। এটি আলিমদের বিশুদ্ধতম মত। সে তার নিজের সম্পদের সাথে (যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে), ঋণ থেকে প্রাপ্ত অর্থ যোগ করবে, অতঃপর সম্পূর্ণ সম্পদ থেকে ২.৫% যাকাত বের করবে। কারণ, তার আয়ত্তে থাকা সকল সম্পদের ওপর যাকাত ওয়াজিব, যার অন্তর্ভুক্ত ঋণ থেকে প্রাপ্ত অর্থও।

৪. যদি যাকাত বের করার সময় ঋণ পরিশোধ করার নির্দিষ্ট মেয়াদ চলে আসে, আগে ঋণ পরিশোধ করবে। ঋণ পরিশোধ করার পর যদি যাকাতের নিসাব থেকে সম্পদ কমে যায়, তার ওপর যাকাত নেই, কারণ নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই। অনুরূপ কারও ওপর মান্নত ওয়াজিব অথবা কাফফারা ওয়াজিব, যেমন যিহার বা কসমের কাফফারা। যদি কাফফারা আদায় বা মান্নত পুরো করার পর নিসাব থেকে সম্পদ কমে যায়, তার ওপরও যাকাত নেই, যদিও তার ওপর এক বছর পূর্ণ হয়েছে। পুনরায় যখন নিসাব পরিমাণ হবে সঙ্গে-সঙ্গে যাকাত দিবে, হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা করবে না। কারণ, আগেই তাতে বছর পূর্ণ হয়েছে। আহলে ইলমদের এটিই বিশুদ্ধ মত।

৫. একটি প্রশ্ন: কোনও ফকিরের নিকট কারও পাওনা আছে, সে পাওনা মওকুফ করে যাকাত গণ্য করা যাবে কি?

আলিমগণ এ মাসআলায় দু’টি মত পোষণ করেছেন:

এক. ফকিরের ঋণ মওকুফ করে যাকাত গণ্য করা যাবে না।

দুই. ফকিরের ঋণ মওকুফ করে যাকাত গণ্য করা যাবে। এটিই আলিমদের বিশুদ্ধ অভিমত। হাসান বসরি রহ. এতে একটি শর্ত দিয়েছেন: “যে ঋণ সে মওকুফ করবে, তার থেকে কর্জ নেওয়া ঋণ হতে হবে”। দ্বিতীয়ত ঋণী ব্যক্তির যাকাতের হকদার হওয়া জরুরি। যাকাতের হকদার কারা সামনে তার বর্ণনা আসছে। অতএব, ব্যবসায়ী যদি কাস্টমারের ঋণ মওকুফ করে যাকাত গণ্য করে তবে তাতে যাকাত আদায় হবে না।

৬. যদি পাওনাদার ঋণগ্রস্ত ফকীরকে এই শর্তে যাকাত দেয় যে, যাকাতের টাকা দিয়ে সে তার পাওনা পরিশোধ করবে, তাহলে কারও মতেই যাকাত আদায় হবে না। কারণ সে ফেরত বা রিটার্ন করার শর্তারোপ করেছে। যদি ঋণগ্রস্ত নিয়ত করে যাকাতের টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ দিবে, আর যাকাত দানকারী এই নিয়তে যাকাত দেয় যে, যাকাতের টাকা নিয়ে সে আমার ঋণ পরিশোধ করবে, তবে কেউ মুখে প্রকাশ করেনি, তাহলে তার যাকাত আদায় হবে এবং ঋণগ্রস্ত ফকীরও ঋণ থেকে মুক্ত হবে, যদি ঋণ পরিশোধ করে।

৭. যদি বাড়ি নির্মাণ অথবা হজ অথবা বিবাহ অথবা কোনও উদ্দেশ্যে টাকা জমা করে, যা নিসাব পরিমাণ এবং তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে।

৮. ‘ঋণ’ দ্বারা উদ্দেশ্য কারও নিকট সাব্যস্ত পাওনা, যেমন কর্জ করা ঋণ, আসবাব-পত্র ক্রয় করার কিস্তি, বকেয়া ভাড়া, স্বামীর জিম্মায় স্ত্রীর মাহর ও স্ত্রীর জিম্মায় স্বামী থেকে খোলা করার বিনিময় (অর্থ বা কোনও কিছুর বিনিময়ে স্বামী থেকে স্ত্রীর বিচ্ছেদ গ্রহণকে খোলা বলা হয়)। এসব ক্ষেত্রে পাওনাদারের ওপর যাকাত নেই। আলিমদের এটিই বিশুদ্ধ মত।

৯. যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়, মালিক এখনো যার যাকাত আদায় করেনি, ইতোমধ্যে যদি নিসাব থেকে সম্পদ কমে যায়, যেমন চুরি বা ধ্বংস হয় অথবা পুড়ে যায় অথবা পশু মরে নিসাব থেকে কমে যায় অথবা যে জন্যই হোক নিসাব থেকে সম্পদ হ্রাস হয়, এই অবস্থায় যাকাত দিতে হবে কিনা আহলে ইলমগণ দ্বিমত করেছেন। কেউ বলেছেন: যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। কেউ বলেছেন: সম্পদ হ্রাসের ক্ষেত্রে যদি মালিকের সীমালঙ্ঘন অথবা অবহেলা দায়ী না হয় যাকাত দেওয়া ওয়াজিব নয়।

দু’টি মত থেকে প্রথম মতটি অধিক বিশুদ্ধ, সম্পদ ধ্বংসের ক্ষেত্রে মালিক দায়ী হোক বা না-হোক, যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। কারণ, যাকাত আল্লাহর হক ও একটি ঋণ, নিসাবের ওপর এক বছর পূর্ণ হওয়ার সাথেই মালিকের ওপর আল্লাহর হক সাব্যস্ত হয়ে গেছে, যা আদায় করা ব্যতীত মওকুফ হবে না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«فدَيْن اللهِ أحَقُّ أنْ يُقضَى».

“আল্লাহর ঋণ আদায় করার দাবি বেশি”।[1]

১০. যদি কেউ এক প্রকার সম্পদ একই শ্রেণির দ্বিতীয় প্রকার সম্পদ দ্বারা বিনিময় করে, যেমন ২১ ক্যারেট স্বর্ণ ২২ ক্যারেট স্বর্ণ দ্বারা বিনিময় করে অথবা টাকাকে ডলার করে অথবা পণ্য দিয়ে স্বর্ণ কিনে কিংবা স্বর্ণ দিয়ে পণ্য কিনে, এই অবস্থায় আগের পণ্য বা স্বর্ণের হিজরী বছর অব্যাহত থাকবে, বিনিময় করার কারণে বছর ভাঙ্গবে না। আর যদি এক শ্রেণির সম্পদ আরেক শ্রেণির সম্পদ দিয়ে বিনিময় করে, তাহলে আগের সম্পদের বছর অব্যাহত থাকবে না, নতুন সম্পদের জন্য নতুন বছর শুরু হবে। যেমন, কেউ মেষ বা বকরির মালিক, সে যদি এক জাতের মেষ বা বকরি দিয়ে আরেক জাতের মেষ বা বকরি বিনিময় করে, যার মূল্য নিসাব বরাবর বা তার চেয়ে বেশি, তাহলে পূর্বের বছর চলমান থাকবে। আর যদি বকরি বা মেষ দ্বারা গরু বা মহিষ বিনিময় করে, তখন পূর্বের বছর অব্যাহত থাকবে না, বরং গরু বা মহিষ থেকে নতুন বছর শুরু হবে।

এই নীতি থেকে ব্যবসায়ী পণ্য বাদ যাবে, সামনে তার আলোচনা আসছে। ব্যবসার এক পণ্য অপর পণ্য দিয়ে বিনিময় করলে বছর অব্যাহত থাকবে। যদি পূর্বের পণ্যের ব্যবসা ত্যাগ করে নতুন পণ্যের ব্যবসা আরম্ভ করে, তবুও বিশুদ্ধ মত মোতাবেক বছর অব্যাহত থাকবে। কারণ, ব্যবসার উদ্দেশ্য পণ্য বিনিময় করে সম্পদ বৃদ্ধি করা নির্দিষ্ট পণ্য মুখ্য উদ্দেশ্য নয়।

আরেকটি জ্ঞাতব্য, স্বর্ণ ও রূপা দু’জাতের দু’টি মুদ্রা গণ্য করা হয়। আলিমদের বিশুদ্ধ মত এটি। অতএব, বছরের মাঝে কেউ যদি স্বর্ণ দিয়ে রূপা খরিদ করে অথবা রূপা দিয়ে স্বর্ণ খরিদ করে বছর ভেঙ্গে যাবে এবং বিনিময় করার পর থেকে নতুন বছর শুরু করবে।এক পণ্য দিয়ে অপর পণ্য বিনিময় করার উদ্দেশ্য যদি হয় যাকাত থেকে অব্যাহতি ও যাকাত ফাঁকি দেওয়া, তবে সে পাপী ও শাস্তির উপযুক্ত হবে।

[1] সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম।

অর্থাৎ যেসব বস্তু দিয়ে ব্যবসা করা হয়, যেমন ব্যবসার নানা পণ্য, জমি, গাড়ি ও ব্যবসার অন্যান্য সামগ্রী। অধিকাংশ আলিম বলেন: ব্যবসায়ী পণ্যে যাকাত ওয়াজিব। এটিই বিশুদ্ধ মত।

ব্যবসায়ী পণ্যে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্তসমূহ:

ক. মালিকানা পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যবসায়ী পণ্যের পূর্ণ মালিক হওয়া, যেমন ক্রয় বা হেবা বা মিরাস বা অন্য কোনোভাবে ব্যবসায়ী পণ্যের পূর্ণ মালিক হওয়া। এটিই বিশুদ্ধ মত। অতএব, কেউ যদি ব্যবসায়ী পণ্যের আমানতদার বা রক্ষণাবেক্ষণকারী বা জিম্মাদার হয় তার ওপর যাকাত ফরয হবে না।

খ. ব্যবসায়ী পণ্যের উদ্দেশ্য ব্যবসা হওয়া, যদি জমা ও ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে সম্পদের মালিক হয়, ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে গণ্য হবে না।

গ. ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য স্বর্ণ বা রূপার নিসাব সমপরিমাণ হওয়া, অর্থাৎ সে যদি যাকাতের জন্য স্বর্ণের নিসাবকে গ্রহণ করে, তাহলে দেখবে তার ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য স্বর্ণের নিসাবের মূল্য বরাবর কি-না। আর যদি রূপার হিসেব আমলে নেয়, তাহলে দেখবে তার ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য রূপার নিসাবের মূল্য বরাবর কি-না।

ঘ. ব্যবসায়ী পণ্যের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া।

কয়েকটি জরুরি বিষয়:

১. উদাহরণত কেউ যদি গাড়ি অথবা নিজের ব্যবহারের জন্য জমি অথবা বাড়ি নির্মাণ করার জন্য খরিদ করে, যা দিয়ে তার ব্যবসার নিয়ত ছিল না, অতঃপর প্রয়োজন না থাকায় অথবা অধিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সেটি বিক্রি করে দেয়, এতে উক্ত গাড়ি ও জমি ব্যবসায়ী পণ্য হবে না। কারণ, এগুলো ব্যবসার জন্য খরিদ করা হয় নি। অতএব, তাতে যাকাত নেই। আর যদি নিজের সংগ্রহে রাখার জন্য কোনও বস্তু খরিদ করে অতঃপর সেটি দিয়ে ব্যবসা করার সিদ্ধান্ত নেয়, যখন থেকে ব্যবসার সিদ্ধান্ত নিবে তখন থেকে ব্যবসায়ী পণ্য হবে। তার নিসাব পরিমাণ মূল্যের ওপর যদি হিজরী এক বছর পূর্ণ হয় যাকাত ওয়াজিব হবে।

২. ব্যবসায়ী পণ্য যদি নিসাব পরিমাণ হয়, প্রতি হিজরী বছর তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে। অধিকাংশ আলিম এ কথা বলেছেন, এটিই বিশুদ্ধ।

৩. যদি ব্যবসায়ী পণ্যে যাকাত ওয়াজিব হয়, নিম্নের নিয়মে যাকাত বের করবে:

প্রথমত: হিজরী এক বছর পূর্ণ হলে ব্যবসার পণ্য পৃথক করবে, যেমন যাকাত দানকারীর নিকট যত মাল আছে সব মালের বর্তমান পাইকারি দর জানবে, অর্থাৎ যে মূল্য দিয়ে কিনেছে বা যে দামে বিক্রি করবে সেই দাম নয়, বরং বর্তমান দাম হিসেব করবে।

দ্বিতীয়ত: যাকাতের জন্য নিজের তরলমানি বা নগদ-ক্যাশ হিসেব করবে। যেমন, স্বর্ণ, রূপ ও নগদ অর্থ, তবে যার যাকাত দিয়েছে একই বছর তার ওপর দ্বিতীয়বার যাকাত ওয়াজিব হবে না। অতঃপর তার সাথে ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য যোগ করবে, উদাহরণস্বরূপ যদি স্বর্ণ, রূপা ও নগদ অর্থ থাকে, স্বর্ণ ও রূপার মূল্য হিসেব করবে নিম্নের পদ্ধতিতে: একগ্রাম স্বর্ণের বাজার দরকে তার নিকট যত গ্রাম স্বর্ণ রয়েছে, সেই সংখ্যা দিয়ে পূরণ দিবে; একই পদ্ধতি অনুসরণ করবে রূপার ক্ষেত্রে, অতঃপর স্বর্ণ ও রূপার মূল্যের সাথে যোগ করবে নগদ অর্থ, অতঃপর স্বর্ণ-রূপার মূল্য, নগদ অর্থ ও ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য যোগ করবে। এভাবে পুরো সম্পদের যাকাত বের করবে, এক হাজার টাকা থেকে ২৫ টাকা, অর্থাৎ স্বর্ণ ও রূপার মূল্য, নগদ অর্থ ও ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য থেকে ২.৫ পার্সেন্ট যাকাত দিবে।

কেউ যদি স্বর্ণ ও রূপার ব্যবসা করে, সে স্বর্ণ-রূপার যাকাত দিবে ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে, যদি তার শর্ত পূরণ হয়। এ মাসআলায় ব্যবহারের অলঙ্কার যোগ হবে না, কারণ সেটি ব্যবসায়ী পণ্য নয়, অতএব, তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না।

গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি জ্ঞাতব্য:

ক. যদি কারও নিকট ঋণ থাকে তার ওপর যাকাত নেই। এটি বিশুদ্ধ মত।

খ. কেউ যদি ঋণগ্রস্ত হয়, আর বছর শেষে ঋণ পরিশোধ করার সময় হয়, তবে আগে ঋণ দিবে, ঋণের যাকাত তার ওপর নেই। যদি ঋণ পরিশোধ করার সময় না হয়, তাহলে ঋণ এবং ঋণ থেকে প্রাপ্ত মুনাফা ও ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য যোগ করে যাকাত দিবে, কারণ তার মালিকানায় থাকা সকল সম্পদের যাকাত দেওয়া তার ওপর ওয়াজিব।

গ. চলতি বছর ট্যাক্স, কাস্টমস, কর্মচারীদের বেতন, ঘর ভাড়া, ব্যক্তিগত ও সংসার খরচ বাবদ যা ব্যয় হয়েছে তার ওপর যাকাত নেই।

৪. জ্ঞাতব্য যে, ব্যবহারের আসবাব-পত্রে যাকাত নেই, অর্থাৎ যে ঘরে ব্যবসায়ী পণ্য রাখা হয় সে ঘরের যাকাত নেই। কারণ যাকাত ওয়াজিব হয় ব্যবসায়ী পণ্যের ওপর। হ্যাঁ, কেউ যদি ঘরের ব্যবসা করে এবং এক বা একাধিক ঘরের মূল্য যাকাতের নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয হবে, যদি হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়।

অনুরূপ যেসব আসবাব-পত্র মূলধন, যেমন উৎপাদন যন্ত্র, মেশিন ও পরিবহন গাড়ি ইত্যাদির ওপর যাকাত নেই। অনুরূপ ভাড়ায় চালিত ট্যাক্সির ওপর যাকাত নেই, তবে তার মুনাফায় যাকাত ওয়াজিব, যদি তার নিসাব পরিমাণ মুনাফার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়।

৫. কেউ এক পণ্যের ব্যবসা করে, অতঃপর যদি দ্বিতীয় পণ্যের ব্যবসা শুরু করে, কোন পণ্য থেকে বছর গুনবে?

এ মাসআলায় বিশুদ্ধ মত ও উত্তম পন্থা হচ্ছে প্রথম পণ্য থেকে বছর গণনা করা। কারণ, ব্যবসার ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্যই আসল, পণ্য আসল নয়।

৬. ইবন তাইমিয়াহ রহ. বলেছেন: ব্যবসায়ী পণ্যের যাকাত ব্যবসায়ী পণ্য দিয়ে দেওয়া বৈধ, অনুরূপ তার মূল্য দিয়ে দেওয়াও বৈধ।

৭. দু’জন ব্যক্তি এক পণ্যের ব্যবসা করে, তাদের কারও অংশই নিসাব পরিমাণ নয়, কিন্তু দু’জনের অংশ যৌথভাবে নিসাব পরিমাণ হয়ে যায়, এমতাবস্থায় তাদের কারও ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না তাদের প্রত্যেকের অংশ যাকাতের নিসাব সমপরিমাণ হবে। হ্যাঁ, দু’জন থেকে যার অংশ নিসাব পরিমাণ হবে, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে, অপরের ওপর নয়।

বছরের মধ্যবর্তী উপার্জিত অর্থের হুকুম

আমরা পূর্বে জেনেছি যে, যার সম্পদ যাকাত পরিমাণ নয়, তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, তবে যদি সম্পদ বৃদ্ধি পায়, যেমন ব্যবসায় মুনাফা হল বা পশু বাচ্চা জন্ম দিল ইত্যাদি, যা পূর্বের সম্পদের সাথে যোগ করলে নিসাব পরিমাণ হয়, ইতোপূর্বে যা নিসাব পরিমাণ ছিল না, তবে নিসাব পরিমাণ হওয়ার পর থেকে হিজরী বছর গণনা শুরু করবে, যদি বছর শেষ হয় ও সম্পদ না কমে তবে তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে।

আর যদি বছরের মধ্যবর্তী বৃদ্ধি পাওয়া সম্পদ ছাড়াই শুরু থেকে নিসাব পরিমাণ থাকে, অতঃপর বছরের মাঝে মুনাফা হয় বা পশু বাচ্চা দেয়, তবে এই বর্ধিত সম্পদের যাকাত কীভাবে দিবে এ ব্যাপারে আহলে ইলমগণ মতভেদ করেছেন। অধিকাংশ আলিম বলেছেন, (তাদের কথাই বিশুদ্ধ) বর্ধিত সম্পদকে তিন ভাগ করবে:

১. বর্ধিত সম্পদ হয় মূল সম্পদ থেকে উৎপন্ন হবে, যেমন ব্যবসায়ী পণ্যের মুনাফা বা বছরের মাঝখানে পশুর জন্ম দেওয়া বাচ্চা ইত্যাদি। এ জাতীয় সম্পদ মূল সম্পদের সাথে যোগ হবে এবং বছর শেষে সকল সম্পদের যাকাত দিবে। অর্থাৎ মূল সম্পদ এবং তার থেকে অর্জিত মুনাফার যাকাত দিবে, বছরের মাঝখানে অর্জিত সম্পদের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি নয়, যে দিন বর্ধিত হবে সে দিন থেকে মূল সম্পদের সাথে যুক্ত হবে এবং মূল সম্পদের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়াই যথেষ্ট।

২. অথবা বর্ধিত সম্পদ অন্য খাত থেকে হাসিল হবে, যে খাত আগে তার মালিকানায় ছিল না। যেমন, সে নিসাব পরিমাণ স্বর্ণের মালিক ছিল, অতঃপর বছরের মাঝে রূপার মালিক হয়েছে, এই রূপা স্বর্ণের সাথে যোগ করবে না, কারণ স্বর্ণ ও রূপা পৃথক দু’টি মুদ্রা। এটিই বিশুদ্ধ মত। যদি এই রূপা শুরু থেকে নিসাব পরিমাণ হয়, তার জন্য পৃথক বছর গণনা করবে, আর যদি নিসাব পরিমাণ না হয় তার ওপর যাকাত নেই।

৩. অথবা কেউ ৪০টি বকরির মালিক, যার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়েছে, অতঃপর সে আরও এক শো বকরি খরিদ করল বা কেউ তাকে হেবা করল, তবে হেবা বা ক্রয় করা বকরির ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ না তার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হবে। অর্থাৎ চল্লিশটি বকরির ওপর বছর পূর্ণ হলে যাকাত দিবে, ক্রয় বা হেবা সূত্রে মালিক হওয়া বকরির জন্য পৃথক বছর হিসেব করবে এবং সে হিসেবে তার যাকাত দিবে। এটি হাম্বলী ও শাফেঈ মতাবলম্বীদের অভিমত। আবু হানিফা বলেন: ক্রয় বা হেবা সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ পূর্বের সম্পদের সাথে যোগ করবে, অতঃপর সব সম্পদের যাকাত দিবে, যেমন আমরা পূর্বে বলেছি।

বর্ধিত সম্পদের উদাহরণ:

১. যদি কারও নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, আর বছরের মাঝে স্বর্ণের ওপর ব্যবসায়ী পণ্য কিনে, তাহলে পণ্য মুনাফার অন্তর্ভুক্ত হবে, অর্থাৎ যখন স্বর্ণের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হবে, তখন স্বর্ণ ও ব্যবসায়ী পণ্য উভয় থেকে যাকাত বের করবে। প্রতি বছরই এরূপ করবে। অনুরূপভাবে কারও নিকট যদি নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ থাকে, অতঃপর বছরের মাঝে নগদ অর্থ হাসিল করে, তবে স্বর্ণ ও নগদ অর্থের যাকাত দিবে। পূর্বের হালতসমূহে অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ স্বর্ণ-রূপা ও নগদ অর্থ যাই থাক, যার বছর পূর্ণ হবে, তার যাকাত বের করবে এবং মাঝখানে উপার্জন করা পণ্যকে তার মুনাফা জ্ঞান করবে।

২. যদি দু’জন ব্যক্তি মুদারাবার ভিত্তিতে ব্যবসায় শরীক হয়, যেমন একজন নিসাব পরিমাণ সম্পদ দিল এই শর্তে যে, দ্বিতীয় ব্যক্তি তা দিয়ে প্রথম ব্যক্তির স্বার্থে ব্যবসা করবে, অতঃপর উভয়ে ব্যবসায় মুনাফা অর্জন করে। যখন মূলধনের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হবে, মূলধনের মালিক বা প্রথম পক্ষের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে, সে মূলধন ও মুনাফার যাকাত দিবে, কারণ নিসাব পরিমাণ মূলধনের ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হয়েছে, তার মুনাফার ওপর হিজরী এক বছর পূর্ণ হওয়া শর্ত নয়, তাই মূলধনের সাথে মুনাফা যোগ করে মুনাফার যাকাত দিবে। আর দ্বিতীয় ব্যক্তি, যে প্রথম ব্যক্তির সম্পদ দিয়ে মুদারাবার ভিত্তিতে ব্যবসা করছে, তার মুনাফার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে না, যদি তাতে যাকাতের নিসাব পরিমাণ না হয়।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 পরের পাতা »