ক- বাই‘ তথা বেচাকেনার পরিচিতি:

বাই‘ (البيع) শব্দটি (باع) এর মাসদার। শাব্দিক অর্থ মালের বিনিময় মাল নেওয়া বা বিনিময় পরিশোধ করে তার বিনিময়ে বস্তু গ্রহণ করা।

পারিভাষিক অর্থে বেচাকেনা হলো, এমন আর্থিক লেনদেন যা নির্দিষ্ট বস্তু বা কোনো উপকারের স্থায়ী মালিকানা সাব্যস্ত করে। যা কোনো নৈকট্য অর্জনের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয় না।

বাই‘ তথা বেচাকেনার হুকুম:

বাই‘ তথা বেচাকেনা জায়েয হিসেবে শরী‘আতসম্মত। কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসের ভিত্তিতে এটা জায়েয হওয়া প্রমাণিত।

খ- বাই‘ তথা বেচাকেনা জায়েয হওয়ার হিকমত:

যেহেতু অর্থ, পণ্য ও বস্তু বিভিন্ন মানুষের কাছে ছড়িয়ে আছে। একজন মানুষ অন্যের কাছে যা আছে তার প্রতি মুখাপেক্ষী। আবার উক্ত ব্যক্তি যেহেতু বিনিময় পরিশোধ ছাড়া অন্যকে বস্তুটি দিবে না সেহেতু বেচাকেনা জায়েয করা হয়েছে। বেচাকেনা বৈধ হওয়ার দ্বারা মানুষ তার অভাব পূরণ করতে সক্ষম হয় এবং তার প্রয়োজনীয় জিনিস লাভ করতে পারে। এজন্যই আল্লাহ মানুষের এসব প্রয়োজন মিটাতে বেচাকেনা হালাল করেছেন।

বাই‘ তথা বেচাকেনার রুকনসমূহ:

বেচাকেনার রুকন হলো:

১- সিগাহ তথা বেচাকেনার শব্দ: ইজাব তথা বেচাকেনার প্রস্তাব ও কবুল তথা প্রস্তাবনা গ্রহণ করা।

২- ক্রেতা ও বিক্রেতা।

৩- বেচাকেনার বস্তু ও দাম।

সিগাহ তথা বেচাকেনার শব্দ:

ক্রেতা ও বিক্রেতার একজনের বেচাকেনার প্রস্তাব ও অন্যজনের গ্রহণ করার শব্দ বা যেসব শব্দ বেচাকেনার ওপর উভয়ের সন্তুষ্টি বুঝায় তাই বেচাকেনার শব্দ। যেমন বিক্রেতা বলল, আমি এ জিনিসটি এমন কিছুর বিনিময়ে আপনার কাছে বিক্রি করলাম বা আপনাকে দিলাম বা আপনাকে মালিক বানালাম ইত্যাদি। আর ক্রেতা তথা খরিদদার বলল, আমি জিনিসটি ক্রয় করলাম বা মালিক হলাম বা ক্রয় করলাম বা গ্রহণ করলাম বা এ জাতীয় কোনো শব্দ বলা।

কর্মবাচক ক্রিয়া দ্বারা বেচাকেনা বিশুদ্ধ হবে, চাই তা ক্রেতা-বিক্রেতা যে কোনো একই ব্যক্তির পক্ষ থেকে হোক কিংবা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের পক্ষ থেকেই হোক।

টেলিফোনে বেচাকেনা:

টেলিফোনে কথা বলা বেচাকেনার বৈঠক হিসেবে ধর্তব্য। ফোনে কথা শেষ হওয়া মানে এ বৈঠক সমাপ্ত হওয়া। কেননা ‘উরফ তথা প্রচলিতভাবে ফোনে কথা শেষ মানে উভয়ের বেচাকেনা শেষ বলেই ফয়সালা করা হয়।

বেচাকেনা শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলী:

বেচাকেনা শুদ্ধ হওয়ার শর্ত সাতটি। সেগুলো হচ্ছে:

১- ক্রেতা ও বিক্রেতা বা তাদের স্থলাভিষিক্ত উভয়ের সন্তুষ্ট।

২- ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়ের বেচাকেনা জায়েয হওয়া অর্থাৎ উভয়ে স্বাধীন, মুকাল্লাফ তথা শরী‘আতের বিধানের উপযোগী হওয়া এবং জ্ঞানবান হওয়া।

৩- বিক্রয়ের জিনিসটির ব্যবহার বৈধ হওয়া। অতএব সেসব জিনিস বেচা-কেনা করা জায়েয নেই যেসব জিনিস ব্যবহারে কোনো উপকার নেই (অর্থাৎ বেহুদা জিনিস) বা যেসব জিনিস ব্যবহার করা হারাম, যেমন: মদ, শূকর ইত্যাদি অথবা যাতে এমন উপকার রয়েছে যা কেবল নিরুপায় হলেই ব্যবহার করা যায় যেমন মৃতপ্রাণি।

৪- বেচাকেনার সময় বিক্রিত জিনিস বিক্রেতা বা তার পক্ষ থেকে বিক্রির জন্য অনুমোদিত ব্যক্তির মালিকানায় থাকা।

৫- বিক্রিত জিনিসটি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা, তার গুণাগুণ জানা ও দেখার মাধ্যমে।

৬- বিক্রয়ের জিনিসের দাম নির্দিষ্ট থাকা।

৭- বিক্রয়ের জিনিসটি হস্তান্তরযোগ্য হওয়া। অতএব, পলাতক বা হাওয়ায় উড়ন্ত কোনো কিছু ইত্যাদি বেচাকেনা করা শুদ্ধ হবে না।

বেচাকেনার মধ্যে শর্ত প্রদানের বিধান:

বেচাকেনার মধ্যে শর্তাবলী দুভাগে বিভক্ত। প্রথম প্রকার সহীহ শর্ত, যাতে বেচাকেনা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যায়, আর দ্বিতীয় প্রকার ফাসিদ শর্ত, যাতে বেচাকেনা চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। বেচাকেনার মধ্যে সহীহ শর্ত যেমন, মূল্য পুরোটাই বা সুনির্দিষ্ট অংশ বাকী রাখা বা সুনির্দিষ্ট বস্তু বন্ধক রাখা বা সুনির্দিষ্ট বস্তু গ্যারান্টি হিসেবে রাখা। কেননা এসব শর্ত বেচাকেনার সুবিধার্থেই করা হয়। অথবা বিক্রিত জিনিসের ক্ষেত্রে কোনো গুণাগুণ থাকা শর্ত করা। কারণ হাদীসে এসেছে,

«الْمُسْلِمُونَ عَلَى شُرُوطِهِمْ»

“মুসলিমের উচিৎ সন্ধির শর্তের উপর স্থির থাকা।”।[1]

অনুরূপভাবে ক্রেতা তার বিক্রিত জিনিসের ওপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিক্রেতার কাছে উপকারের শর্তারোপ করা সহীহ। যেমন, বসতঘরে একমাস থাকার শর্তারোপ করা।

আর ফাসিদ শর্ত, তা দু’প্রকার। তন্মধ্যে কিছু ফাসিদ শর্ত আছে যা মূল বেচাকেনাকেই বাতিল করে দেয়। যেমন, এক বেচাকেনার ওপর আরেকটি বেচাকেনার শর্ত জুড়ে দেওয়া, উদাহরণত: ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে অগ্রিম হাওলাত দেওয়ার শর্ত কিংবা অন্য কিছু বিক্রি করার শর্ত, অথবা ইজারা দেওয়ার শর্ত অথবা ঋণ দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া।

আবার কিছু শর্ত আছে যাতে বেচাকেনা বাতিল হয় না তবে শর্ত বাতিল হয়ে যায়। যেমন, কারও পক্ষ থেকে এমন শর্ত দেওয়া যে, বিক্রিত জিনিসের কোনো লোকসান তার ওপর বর্তাবে না বা ক্রয়-বিক্রয়ের জিনিস চালু রাখবে নতুবা সে তা ফেরত দিবে। অথবা জিনিসটিকে ক্রেতা বিক্রি করতে পারবে না বা দান করতে পারবে না। তবে এসব শর্ত যদি কোনো নির্দিষ্ট স্বার্থ সংরক্ষণ করে তখন সে শর্ত দেওয়া শুদ্ধ হবে।

নিষিদ্ধ বেচাকেনা:

যেসব জিনিস কল্যাণকর ও বরকতময় সেসব জিনিসে ইসলাম বেচাকেনা বৈধ করেছে। যেসব বেচাকেনার মধ্যে অস্পষ্টতা বা অজ্ঞতা বা ধোকা বা মানুষের জন্য ক্ষতিকর বা কারো ওপর আক্রমণের আশঙ্কা থাকে ইত্যাদি যা মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, ঝগড়া ও মনোমালিন্য সৃষ্টি হয় সেসব বেচাকেনা ইসলাম হারাম করেছে। এসব বেচাকেনার মধ্যে অন্যতম:

১- আল-মুলামাসা: (ছোয়া-স্পর্শের বেচাকেনা)

যেমন কেউ কাউকে বলল, আপনি যে কাপড়টিই স্পর্শ করবেন তা এত টাকার বিনিময়ে আপনার। এ ধরনের বেচা-কেনা ফাসিদ। কেননা এতে অজ্ঞতা ও ধোকা রয়েছে।

২- বাই‘য়ুল মুনাবাযা: (নিক্ষেপ-ছোঁড়ার বেচা-কেনা)

যেমন, এভাবে বলা, যে কাপড়টি আপনি আমার দিকে ছুঁড়ে মারবেন তা এত টাকার বিনিময়ে আপনার। এ ধরণের বেচা-কেনাও ফাসিদ। কেননা এতে অজ্ঞতা ও ধোকা রয়েছে।

৩- বাই‘য়ুল হুসাত: (ঢিল ছোঁড়ার বেচাকেনা)

যেমন কেউ এভাবে বলা, আপনি এ কঙ্করটি নিক্ষেপ করুন, তা যে জিনিসটির ওপর পরবে তা এত টাকার বিনিময়ে আপনার। এ ধরণের বেচাকেনাও ফাসিদ। কেননা এতে অজ্ঞতা ও ধোকা রয়েছে।

৪- বাই‘য়ুন নাজশ: (দালালীর বেচাকেনা)

কেউ মূল্য বৃদ্ধির জন্য অন্যকে শোনানোতে কোনো জিনিসের দাম বলা অথচ সে জিনিসটি কিনবে না। এ ধরণের বেচাকেনা হারাম। কেননা এতে ক্রেতাকে ধোকা দেওয়া হয় এবং তাকে প্রতারিত করা হয়।

৫- বাই‘আতাইন ফী বাই‘আহ (এক বেচাকেনায় দু’টি বেচাকেনা থাকা)

যেমন কেউ বলল, আমি আপনার কাছে এ জিনিসটি বিক্রয় করলাম এ শর্তে যে আপনি আমার কাছ ঐ জিনিসটি বিক্রি করবেন বা আপনি আমার কাছ থেকে এ জিনিসটি ক্রয় করবেন। অথবা এভাবে বলা, এ জিনিসটি আপনার কাছে নগদ দশ টাকায় বা বাকীতে বিশ টাকায় বিক্রি করলাম এবং দু’টির একটি নির্দিষ্ট না করেই দুজনে আলাদা হয়ে যাওয়া। এ ধরণের বেচাকেনা সহীহ নয়; কেননা এ ধরণের বেচাকেনায় প্রথম অবস্থায় বিক্রিটি শর্তের সাথে ঝুলে থাকে, আর দ্বিতীয় অবস্থায় বেচাকেনার মূল্য স্থির হয় নি।

৬- শহরের লোক গ্রামের কারও বিক্রেতা হওয়া:

অর্থাৎ গ্রামের কেউ শহরে পণ্য নিয়ে আসার আগেই তার থেকে কম মূল্যে ক্রয় করে বেশি মূল্যে বিক্রি করা: দৈনিক বাজারদরের চেয়ে বেশি মূল্যে দালালদের বেচাকেনা।

৭- একজনের বেচাকেনার ওপর আরেকজনের বেচাকেনা:

যেমন কেউ একটি জিনিস দশ টাকায় ক্রয় করতে চাইলে তাকে বলা যে, এটি আমার থেকে নয় টাকায় ক্রয় করতে পারবে।

৮- কোনো বস্তু হস্তগত করার আগেই তা আবার বিক্রি করা।

৯- বাই‘য়ুল ‘ঈনাহ:

যেমন কোনো বস্তু নির্দিষ্ট মেয়াদে বিক্রি করে অতঃপর তার থেকে নগদে অল্প দামে ক্রয় করা। ১০- জুমু‘আর সালাতের দ্বিতীয় আযান হলে যাদের ওপর জুমু‘আর সালাত আদায় করা ফরয তাদের বেচাকেনা।

>
[1] আবু দাউদ, আকদিয়্যাহ, হাদীস নং ৩৫৯৪।
২- রিবা তথা সুদ-এর বিধান, প্রকারভেদ; সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থায় ইসলামের পদ্ধতিসমূহ

ক. রিবা তথা সুদের পরিচিতি:

الربا শব্দটি সাধারণত অতিরিক্ত ও বৃদ্ধি অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন, বলা হয়, ربا المال إذا زاد ونما সম্পদ যখন বৃদ্ধি পায় ও বাড়ে। আবার বলা হয়, أربى على الخمسين زاد পঞ্চাশের বেশি বেড়েছে। তবে সাধারণত সব ধরণের হারাম বেচাকেনাকে রিবা বা সুদ বলা হয়।

ফিকহবিদদের পরিভাষায়:

الزيادة في أشياء مخصوصة.

“নির্দিষ্ট কিছু জিনিসের মধ্যে অতিরিক্ত গ্রহণ করাকে রিবা বলা হয়”।

অথবা

هو عقد على عوض مخصوص غير معلوم التماثل في معيار الشرع حالة العقد، أو مع تأخير في البدلين أو أحدهما.

“তা এমন এক বিশেষ বিনিময় চুক্তি; যা সংঘটিত হওয়ার সময় শরী‘আতের মাপকাঠি অনুযায়ী সমতা বিধান করা হয় নি। অথবা তা এমন এক বিশেষ বিনিময় চুক্তি; যাতে উভয় জিনিস বাকীতে বা একটি জিনিস বাকীতে বিনিময় করা হয়েছে”।

খ. সুদ হারাম হওয়ার তাৎপর্য:

নিম্নোক্ত অনেক কারণে ইসলাম সুদকে হারাম করেছে:

১- প্রচেষ্টা ও ফলাফলের মধ্যে সামঞ্জস্যতা না থাকা। কেননা সুদ বিনিয়োগকারী যা অর্জন করে ও লাভ করে তা কোনো প্রকার প্রচেষ্টা, পরিশ্রম ও কাজ না করেই পেয়ে থাকে এবং সে ব্যবসায় ক্ষতির ভাগও বহন করে না।

২- সুদ গ্রহীতারা কর্ম বিমুখ হওয়ার কারণে সমাজে অর্থনীতি ধ্বংস হওয়া এবং তারা অতিরিক্ত লাভের প্রত্যাশায় নিজেরা আরাম আয়েশ ও অলসতায় জীবন যাপন করবে এবং ঋণ গ্রহীতাদের ওপর আরো ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিবে।

৩- মানুষের মধ্যে সাহায্য সহযোগিতা না থাকার কারণে সমাজে উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী নিঃশেষ হয়ে যাবে। যা সমাজে আত্মত্যাগ, ভালোবাসা ও অন্যকে প্রধান্য দেওয়ার পরিবর্তে সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে, মানুষের মাঝে আমিত্ব তথা অহংকার ও হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিবে।

৪- সমাজকে উঁচু-নিচু দু’টি শ্রেণিতে বিভক্ত করে দিবে। এক শ্রেণি হবে তাদের সম্পদের দ্বারা সুবিধাভোগী ও নির্যাতনকারী শাসকগোষ্ঠি; অন্যদিকে আরেক শ্রেণি হবে নিতান্ত গরীব-মিসকীন ও দুর্বল, যাদের পরিশ্রম ও কষ্ট অন্যায়ভাবে অন্যরা ভোগ করবে।

গ. রিবা বা সুদের প্রকারভেদ:

আলেমদের কাছে রিবা বা সুদ দু’ধরণের। তা হলো:

১- রিবা নাসীয়া: ‘নাসীয়া’ শব্দের অর্থ বাকী ও বিলম্বের সুদ। সুদসহ ঋণ ফেরত দিতে বিলম্বের বিনিময়ে ঋণ ও ঋণের সুদের ওপর অতিরিক্ত সুদ গ্রহণ করা। একে সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সুদ (রিবা বিল-আজাল) বলা হয়।

২- রিবা ফদল: শাব্দিক অর্থে ফদল (অতিরিক্ত) শব্দটি নকস (কমতি) এর বিপরীত।

পারিভাষিক অর্থে, একই জাতীয় দু’টি জিনিসের মধ্যে একটির বিনিময়ে অতিরিক্ত নেওয়া। যেমন, স্বর্ণের পরিবর্তে সমপরিমাণ স্বর্ণ না নিয়ে অতিরিক্ত স্বর্ণ গ্রহণ করা, এমনিভাবে গমের পরিবর্তে অতিরিক্ত গম নেওয়া ইত্যাদি যেসব জিনিসে প্রচলিতভাবে সুদ হয়ে থাকে। একে বেচাকেনার সাথে সংশ্লিষ্ট সুদ (রিবা আল-বাই‘) বা গোপন সুদ (রিবা আল-খফী) ও বলা হয়।

  • শাফে‘ঈ মাযহাবের লোকেরা তৃতীয় আরেক প্রকারের সুদের কথা বলেছেন, তা হলো ‘হস্তগত করার সাথে সংশ্লিষ্ট সুদ’ (রিবা আলইয়াদ)। অর্থাৎ মূল্য ও বস্তু অথবা দু’টির যেকোনো একটি নগদ গ্রহণ না করে বিলম্বে গ্রহণ করা।
  • কেউ কেউ চতুর্থ আরেক প্রকারের সুদের কথা বলেছেন, তা হলো ঋণ সম্পৃক্ত সুদ (রিবা আলকারদ্ব)। আর তা হলো, বেচাকেনার মধ্যে কোনো উপকারের শর্তারোপ করা।
  • তবে এসব (তৃতীয় ও চতুর্থ) প্রকার সুদ প্রকৃতপক্ষে আলেমদের বর্ণিত উপরোক্ত প্রকারভেদের বাইরে নয়। কেননা তারা যাকে ‘হস্তগত করার সাথে সংশ্লিষ্ট সুদ’ (রিবা আলইয়াদ) বা ‘ঋণ সম্পৃক্ত সুদ’ (রিবা আলকারদ্ব) বলা হয়েছে তা উপরোক্ত দু’প্রকারের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব।
  • আধুনিক অর্থনীতিবিদরা সুদকে ‘ক্ষয়িষ্ণু সুদ’ (ইসতিহলাকি) ও ‘উৎপাদনশীল বর্ধিষ্ণু সুদ’ (ইনতাজি) এই দু’ভাগে ভাগ করেছেন।

১- ‘ক্ষয়িষ্ণু সুদ’ (ইসতিহলাকি) হচ্ছে, খাদ্য-দ্রব্য ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় ধ্বংসশীল খাদ্য-দ্রব্য ও ঔষধপত্র ইত্যাদি ক্রয় করতে নেওয়া ঋণের ওপর প্রদত্ত অতিরিক্ত সুদ।

২- ‘উৎপাদনশীল বর্ধিষ্ণু সুদ’ (ইনতাজি) হচ্ছে: উৎপাদন কাজে ঋণের ওপর নেওয়া অতিরিক্ত সুদ। যেমন, ফ্যাক্টরি বানানো বা চাষাবাদ বা ব্যবসায়িক কাজে ঋণ নেওয়া।

  • অর্থনীতিবিদরা সুদকে আরও দু’প্রকারে ভাগ করেছেন। তা হলো:

১- দ্বিগুণ সুদ (মুদ্বা‘আফ): যে লেনদেনে সুদের পরিমাণ অনেক বেশি।

২- সামান্য সুদ (বাসীত): যে লেনদেনে সুদের পরিমাণ অনেক কম থাকে।

ইসলাম সব ধরণের সুদের কারবার হারাম করেছে, চাই তা রিবাল ফদল বা রিবা নাসীয়া হোক, এতে সুদের পরিমাণ কম হোক বা বেশি হোক, ক্ষয়প্রাপ্ত খাদ্য-দ্রব্যে হোক বা উৎপদনশীল কাজে নিয়োজিত হোক। উপরোক্ত সব প্রকারের সুদ আল্লাহর নিম্নোক্ত আয়াতে হারামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰاْ﴾ [البقرة: ٢٧٥]

“অথচ আল্লাহ বেচা-কেনা হালাল করেছেন এবং সুদ হারাম করেছেন।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৫]

ঘ. সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনে ইসলামের পদ্ধতিসমূহ:

সুদের লেনদের থেকে পরিত্রাণ পেতে ইসলাম বিকল্প কিছু পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে। সেগুলো নিম্নরূপ:

১- ইসলাম মুদারাবা লেনদেন বৈধ করেছে: ইসলাম সুদবিহীন অর্থ ব্যবস্থা প্রচলনে মুদারাবা তথা অংশীদারিত্ব ব্যবসা জায়েয করেছে। এতে একজনের মূলধন থাকবে এবং অন্যজন ব্যবসায়ে কাজ করবে। আর এভাবে অর্জিত লভ্যাংশ উভয়ের মধ্যকার চুক্তি অনুসারে পাবে। তবে ব্যবসায়ে ক্ষতি হলে মূলধন বিনিয়োগকারীর ওপর বর্তাবে। আর শ্রমদাতার ওপর ক্ষতির ভাগ বর্তাবে না, যেহেতু তার কষ্ট ও শ্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই সে অর্থের ক্ষতির অংশীদার হবে না।

২- ইসলাম বাই‘য়ে সালাম তথা মূল্য নগদ পরিশোধ আর বস্তু বাকীতে বেচাকেনা বৈধ করেছে: অর্থাৎ কারো নগদ অর্থের বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিলে সে উক্ত জিনিসের উৎপাদনের সময় আসার আগে উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করে এবং ফিকহশাস্ত্রে বর্ণিত শর্তানুযায়ী বেচাকেনা করা বৈধ।

৩- ইসলাম বাকীতে বেচাকেনা বৈধ করেছে: নগদ বিক্রি মূল্যের চেয়ে বাকীতে বেশি মূল্যে বিক্রি করা জায়েয। মানুষের সুবিধার্থে এবং সুদের লেনদেন থেকে মুক্ত হতে ইসলাম এ বেচাকেনা বৈধ করেছে।

৪- ইসলাম কর্যে হাসানা তথা বিনা লাভে ঋণ প্রদানের জন্য নানা ধরনের সংস্থা হওয়াকে উৎসাহিত করেছে। ব্যক্তি বা সমষ্টি বা সরকারী বা বেসরকারী যেকোনো ধরণের সংস্থাকে এ ঋণের জন্য ইসলাম উৎসাহিত করেছে; যাতে উম্মাতের মধ্যে পরস্পর সামাজিক সহযোগিতা ও দায়ভার বাস্তবায়িত হয়।

৫- ইসলাম ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে, অভাবী ফকীরকে, বিপদগ্রস্ত পথিক প্রভৃতি অভাবী মানুষের প্রয়োজন মিটাতে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে যাকাতের বিধান প্রচলন করেছে।

সমাজে ব্যক্তির প্রয়োজন মিটাতে ও মানুষের সম্মান সংরক্ষণে ইসলাম উপরোক্ত পদ্ধতিসমূহ খুলে দিয়েছে। এভাবে তার অভাব মিটাতে সে সুউচ্চ উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়, তার প্রয়োজনের সুরক্ষা হয়, কর্ম ও উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

ব্যাংকের লাভ ও এর হুকুম:

ফায়েদা অর্থ লাভ, বহুবচনে ফাওয়ায়েদ। অর্থনীতিবিদদের মতে ব্যাংকের ফায়েদা বা লাভ মানে নগদ অর্থ। বস্তুত: ব্যাংক ও সমবায়ী বাক্সগুলো আমানত বা জমার অর্থ রাখার বিনিময়ে যে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে বা ঋণ নিলে তার ওপর যে অতিরিক্ত টাকা গ্রহণ করে, তাই ব্যংকের দৃষ্টিতে লাভ হিসেবে তারা বর্ণনা করে থাকে।

এটা মূলত রিবা বা সুদ। বরং এটিই আসল সুদ, যদিও ব্যাংক একে লাভ বলে থাকে। নিঃসন্দেহে এ ধরণের লাভ কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা কর্তৃক হারাম সুদের অন্তর্ভুক্ত।

ঋণের বিনিময়ে উল্লিখিত অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ হারাম হওয়া সম্পর্কে আলেমদের ইজমা বর্ণিত আছে। তারা যেটাকে কর্জ বা ঋণ বলে থাকে তা আসলে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি মুহাম্মাদ ইবন ইবরাহীম রহ.-এর মতে ঋণ নয়। কেননা কর্জের উদ্দেশ্য হলো ইহসান, হৃদ্যতা ও সহযোগিতা করা। অথচ এ ধরণের লেনদেন প্রকৃতপক্ষে নির্দিষ্ট মেয়াদে টাকার বেচাকেনা করা ও শর্তের ভিত্তিকে নির্দিষ্ট মেয়াদে লাভ করা। অতএব, বুঝা গেল ব্যাংক কর্জের বিনিময়ে বা জমাকৃত অর্থের বিনিময়ে যে অতিরিক্ত লাভ দেওয়া ও নেওয়া করে তাকে পুরোপুরি সুদই বলে। সুদ ও ব্যাংকের লাভ একটি অপরটির নাম মাত্র।

ক- ইজারা তথা ভাড়ার পরিচিতি:

নির্দিষ্ট মেয়াদে দু’জনের মধ্যে বৈধ উপকারের বিনিময় চুক্তি করা।

খ- ইজারার হুকুম:

ইজারা জায়েয। এটা দুপক্ষের মাঝে অত্যাবশ্যকীয় চুক্তি।

গ- ইজারা শরী‘আতসম্মত হওয়ার হিকমত:

ইজারা মূলত মানুষের মাঝে পরস্পর সুবিধা বিনিময়। শ্রমিকদের কাজের প্রয়োজন, থাকার জন্য ঘরের দরকার, মালামাল বহন, মানুষের আরোহণ ও সুবিধার জন্য পশু, গাড়ি ও যন্ত্রের দরকার। আর ইজারা তথা ভাড়ায় খাটানো বৈধ হওয়ায় মানুষের জন্য অনেক কিছু সহজ হয়েছে ও তারা তাদের প্রয়োজন মিটাতে সক্ষম হচ্ছে।

ঘ- ইজারার প্রকার:

ইজারা দু’প্রকার। তা হচ্ছে:

১- নির্দিষ্ট জিনিস ও আসবাবপত্র ভাড়া দেওয়া। যেমন, কেউ বলল, আমি আপনাকে এ ঘর বা গাড়িটি ভাড়া দিলাম।

২- কাজের ওপর ভাড়া দেওয়া। যেমন, কেউ দেয়াল নির্মাণ বা জমি চাষাবাদ ইত্যাদি করতে কোনো শ্রমিককে ভাড়া করল।

ঙ- ইজারার শর্তাবলী:

ইজারার শর্ত চারটি। তা হলো:

১- লেনদেনটি জায়েয হওয়া।

২- উপকারটি নির্দিষ্ট হওয়া। যেমন, ঘরে থাকা বা মানুষের খিদমত বা ইলম শিক্ষা দেওয়া ইত্যাদি।

৩- ভাড়া নির্ধারণ করা।

৪- উপকারটি বৈধ হওয়া। যেমন ঘরটি বসবাসের জন্য হওয়া। অতএব, কোনো হারাম উপকার সাধনে যেমন, যিনা, গান বাজনা, ঘরটি গীর্যার জন্য ভাড়া দেওয়া বা মদ বিক্রির জন্য ব্যবহার করা ইত্যাদি হারাম কাজের সুবিধার জন্য ভাড়া দেওয়া বৈধ নয়।

মাসআলা:

কেউ বিনা চুক্তিতে গাড়ি, বিমান, ট্রেন ও নৌকা ইত্যাদিতে আরোহণ করলে বা দর্জিকে কাপড় কাটতে বা সেলাই করতে দিলে বা কুলিকে দিয়ে বোঝা বহন করালে তার এসব কাজ জায়েয হবে এবং তাকে সেখানকার ‘উরফ তথা প্রচলিত নিয়মানুসারে ভাড়া প্রদান করতে হবে। কেননা ‘উরফ তথা প্রচলিত প্রথা এসব ব্যাপারে ও এ জাতীয় আরো অন্যান্য ব্যাপারে কথা বলে চুক্তি করার মতোই।

চ- ভাড়াকৃত জিনিসের শর্তাবলী:

ভাড়াকৃত নির্দিষ্ট জিনিসের মধ্যে শর্ত হচ্ছে সেটি ভালো করে দেখা ও এর গুণাবলী জানা, এর প্রদত্ত উপকারের ব্যাপারে চুক্তি করা, এর অংশের ওপর চুক্তি নয়, সেটা সমর্পন করতে সমর্থ হওয়া, বাস্তবেই তাতে উপকার থাকা এবং ভাড়াকৃত জিনিসটি ভাড়া প্রদানকারীর মালিকানাধীন থাকা বা তার ভাড়া দেওয়ার অনুমতি থাকা।

ছ- ইজারার আরো কিছু মাসয়ালা:

  • ওয়াকফকৃত জিনিসের ভাড়া দেওয়া জায়েয। ভাড়া প্রদানকারী মারা গেলে চুক্তিটি বাতিল না হয়ে পরবর্তী যিনি ওয়াকফের রক্ষণাবেক্ষণে আসবেন তার কাছে চুক্তিটি থাকবে এবং তিনি বাকী ভাড়া গ্রহণ করবেন।
  • যেসব জিনিস বেচাকেনা হারাম সেসব জিনিস ভাড়া দেওয়াও হারাম, তবে ওয়াকফ, স্বাধীন ব্যক্তিকে আযাদ ও উম্মে ওয়ালাদ তথা মালিকের কাছে যে দাসীর বাচ্চা হয়েছে এসব বাদে। কেননা এসব জিনিসে ভাড়া জায়েয।
  • ভাড়াকৃত জিনিসটি নষ্ট হয়ে গেলে এবং উপকার সাধন শেষ হয়ে গেলে ইজারা বাতিল হয়ে যাবে।
  • শিক্ষাদান, মসজিদ নির্মাণ ইত্যাদি কাজের বিনিময়ে ভাড়া (পারিশ্রমিক) নেওয়া জায়েয। আর হজের বিনিময়ে প্রয়োজন হলে পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয।
  • ইমাম, মুয়াযযিন বা কুরআন শিক্ষাদানকারী বাইতুল মাল থেকে পারিশ্রমিক গ্রহণ করলে অথবা নিঃশর্তভাবে তাদেরকে প্রদান করা হলে তাদের জন্য তা গ্রহণ করা বৈধ।
  • ভাড়াগ্রহণকারী অবহেলা ও সীমালঙ্ঘন না করলে ভাড়াকৃত জিনিস তার কাছে নষ্ট হলে এর কোনো জরিমানা দিতে হবে না।
  • চুক্তি করার দ্বারা ভাড়া দেওয়া ওয়াজিব হয়ে যায়, ভাড়াকৃত জিনিস ফেরত দেওয়ার সময় ভাড়াও জমা দেওয়া ওয়াজিব, তবে দুজনে বিলম্বে বা কিস্তিতে প্রদানে রাজি থাকলে তাও জায়েয। আর শ্রমিক তার কাজ শেষ করলে সে তার পারিশ্রমিকের অধিকারী হবে।

১- ওয়াকফের শাব্দিক ও পারিভাষিক পরিচিতি:

ওয়াকফের শাব্দিক অর্থ:

الوقف (ওয়াকফ) শব্দটি وقف এর মাসদার। এর বহুবচন أوقاف যেমন বলা হয়, (وقف الشيء وأوقفه وحبسه وأحبسه وسبّله) কোনো কিছু ওয়াকফ করা, আটকে রাখা, উৎসর্গ করা। সবগুলোই একই অর্থে ব্যবহৃত হয়।

আর পারিভাষিক অর্থে, বস্তুর মূল স্বত্ব ধরে রেখে (মালিকানায় রেখে) এর উপকারিতা ও সুবিধা প্রদান করা।

২- ওয়াকফ শরী‘আতসম্মত হওয়ার মূল দলীল:

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত ও উম্মতের ইজমার দ্বারা ওয়াকফ শরী‘আতসম্মত হয়। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত হলো, সহীহ বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হাদীস,

«أن عمر قال: يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنِّي أَصَبْتُ أَرْضًا بِخَيْبَرَ لَمْ أُصِبْ مَالًا قَطُّ أَنْفَسَ عِنْدِي مِنْهُ، فَمَا تَأْمُرُ بِهِ؟ قَالَ: «إِنْ شِئْتَ حَبَسْتَ أَصْلَهَا، وَتَصَدَّقْتَ بِهَا» قَالَ: فَتَصَدَّقَ بِهَا عُمَرُ، أَنَّهُ لاَ يُبَاعُ وَلاَ يُوهَبُ وَلاَ يُورَثُ».

“(উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু খায়বারে কিছু জমি লাভ করেন। তিনি এ জমির ব্যাপারে পরামর্শের জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন) এবং বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমি খায়বারে এমন উৎকৃষ্ট কিছু জমি লাভ করেছি যা ইতোপূর্বে আর কখনো পাই নি। আপনি আমাকে এ ব্যাপারে কী আদেশ দেন? রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তুমি ইচ্ছা করলে জমির মূল স্বত্ত্ব ওয়াকফে আবদ্ধ করতে এবং উৎপন্ন বস্তু সাদকা করতে পার।” বর্ণনাকারী ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেন, উমার ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এ শর্তে তা সদকা (ওয়াকফ) করেন যে, তা বিক্রি করা যাবে না, তা দান করা যাবে না এবং কেউ এর উত্তরাধীকারী হবে না”।[1]

ফলে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর উৎপন্ন বস্তু অভাবগ্রস্ত, আত্মীয়-স্বজন, দাসমুক্তি, আল্লাহর রাস্তায়, মুসাফিরও মেহমানদের জন্য সদকা করে দেন। বর্ণনাকারী আরও বলেন, যিনি এর মুতাওয়াল্লী হবে তার জন্য সম্পদ সঞ্চয় না করে যথাবিহীত খাওয়া কোনো দোষের বিষয় নয়।

ওয়াকফ শুধু মুসলিমদের বৈশিষ্ট্য। জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের যাদেরই সামর্থ ছিলো তারা সকলেই ওয়াকফ করেছেন।

উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা এটি প্রমাণিত হয় যে, বর্তমানে মানুষ যা করে তা আসলে সাহাবীগণের কাজের বিপরীত। কেননা বর্তমানে মানুষ সাধারণত অসিয়ত করে থাকেন, ওয়াকফ করেন না।

৩- ওয়াকফ শরী‘আতসম্মত হওয়ার হিকমত:

১- আল্লাহ যাদেরকে ধন-সম্পদ দিয়ে প্রশস্ত করেছেন তাদের কল্যাণকর ও তাঁর আনুগত্যের কাজে কিছু দান করতে তিনি উৎসাহিত করেছেন যাতে তাদের সম্পদ তাদের মৃত্যুর পরেও এর মূলস্বত্ব অবশিষ্ট থেকেও এর ফায়েদা মানুষ ভোগ করতে পারে এবং তার জীবন শেষ হলেও এর সাওয়াব উক্ত ব্যক্তি পেতে পারে। হতে পারে তার মৃত্যুর পরে তার ওয়ারিশরা তার সম্পদ যথাযথ হিফাযত করবে না, ফলে তার আমল শেষ হয়ে যাবে এবং এতে তার পরিণাম দুর্দশাগ্রস্ত হবে। এসব সম্ভাবনা দূরীকরণে এবং কল্যাণকর কাজে অংশীদার হতে ইসলাম মানুষের জীবদ্দশায় ওয়াকফ করার পদ্ধতি শরী‘আতসম্মত করেছে। যাতে ওয়াকফকারী নিজে মরে যাওয়ার পরেও এসব ভালো কাজে সম্পৃক্ত থাকতে পারে, ফলে তিনি জীবদ্দশায় যেভাবে দান করতে চাইতেন মরনের পরেও সেভাবে সাওয়াব পাবেন।

২- মসজিদ, মাদ্রাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি কল্যাণকর কাজ এবং এসবের দেখভাল ও রক্ষণাবেক্ষণের মূল হলো ওয়াকফ করা। যুগে যুগে যেসব মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার অধিকাংশ ওয়াকফের দ্বারাই হয়েছে। এমনকি মসজিদে ব্যবহৃত আসবাবপত্র, বিছানা, কার্পেট, পরিস্কার পরিচ্ছন্নের জিনিসপত্র ও মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণে নিয়োজিত ব্যক্তিদের যাবতীয় খরচ এসব ওয়াকফের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।

৪- ওয়াকফের শব্দাবলী:

ওয়াকফের স্পষ্ট কিছু শব্দ আছে, তা হলো:

(وقفت) আমি ওয়াকফ করলাম বা (حبست) আমি এর মূল মালিকানা আটকে ওয়াকফ রাখলাম বা (سبّلت) আমি আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করলাম।

আর ওয়াকফের অস্পষ্ট ও ঈঙ্গিতপূর্ণ শব্দ হলো:

(تصدقت) আমি দান করলাম বা (حرّمت) আমি এটি আমার জন্য হারাম করলাম বা (أبدت) আমি মানুষের জন্য সারাজীবনের জন্য দান করলাম।

তবে অস্পষ্ট ও ঈঙ্গিতপূর্ণ শব্দে ওয়াকফ করলে নিচের তিনটি জিনিসের যে কোনো একটি পাওয়া যেতে হবে।

১- ওয়াকফের নিয়ত করা। কেউ এসব শব্দ বলে ওয়াকফের নিয়ত করলে ওয়াকফ হয়ে যাবে।

২- এসব অস্পষ্ট ও ঈঙ্গিতপূর্ণ শব্দ বলার সাথে স্পষ্ট শব্দ পাওয়া গেলে বা অন্য ঈঙ্গিতপূর্ণ শব্দ পাওয়া যায় তাহলেও ওয়াকফ হবে। যেমন, এভাবে বলা,

تصدقت بكذا صدقة موقوفة أو محبّسة أو مسبّلة أو مؤبدة أو محرمة.

“আমি এটি ওয়াকফ হিসেবে দান করলাম বা মূলস্বত্ব রেখে ওয়াকফ হিসেবে দান করলাম বা উৎসর্গ করলাম বা সারাজীবনের জন্য দান করলাম বা এটি আমার জন্য হারাম”।

৩- ওয়াকফের বস্তুটি নিম্নোক্ত শব্দাবলী দ্বারা বর্ণনা করা। যেমন, বলা

محرمة لا تباع ولا توهب.

ওয়াকফের বস্তুটি আমার জন্য হারাম, তা বিক্রি করা যাবে না, তা দান করা যাবে না।

শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে যেমন ওয়াকফ করা যায় তেমনি ব্যক্তির কাজের দ্বারাও ওয়াকফ করা যায়। যেমন কেউ নিজের জমিতে মসজিদ নির্মাণ করল এবং লোকজনকে তাতে সালাত আদায় করতে অনুমতি দিলো।

৫- ওয়াকফের প্রকারভেদ:

প্রথম থেকে ওয়াকফটি কাদের জন্য করা হয়েছে সে হিসেবে ওয়াকফ দু’প্রকার।

১- খাইরী তথা কল্যাণকর কাজে ওয়াকফ।

২- আহলী তথা পরিবার পরিজনের জন্য ওয়াকফ।

১- খাইরী তথা কল্যাণকর কাজে ওয়াকফ:

ওয়াকফকারী শুরু থেকেই জনকল্যাণকর কাজে বস্তুটি ওয়াকফ করল; যদিও তা নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। এরপরে ওয়াকফটি নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য হবে। যেমন কেউ হাসপাতাল বা মাদ্রাসার জন্য জমি ওয়াকফ করল। অতঃপর পরবর্তীতে তা তার সন্তানদের জন্য হবে।

২- আহলী তথা পরিবার পরিজনের জন্য ওয়াকফ:

শুরুতে নিজের বা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের নামে ওয়াকফ হবে। পরবর্তীতে তা জনকল্যাণ কাজে ওয়াকফ হবে। যেমন কেউ তার নিজের নামে ওয়াকফ করল, অতঃপর তা তার সন্তানদের হবে, অতঃপর তা জনকল্যাণ কাজে ওয়াকফ হবে।

৬- যেসব জিনিস ওয়াকফ করা যায়:

ওয়াকফের স্থান তথা যেসব জিনিস ওয়াকফ করা যায় তা হলো মূল্যবান স্থাবর সম্পত্তি যা ব্যক্তির মালিকানায় বর্তমান রয়েছে। যেমন, জমি, ঘর-বাড়ি ইত্যাদি অথবা স্থানান্তরযোগ্য জিনিস। যেমন, বই, কাপড়, অস্ত্র ইত্যাদি। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

وَأَمَّا خَالِدٌ: فَإِنَّكُمْ تَظْلِمُونَ خَالِدًا، قَدِ احْتَبَسَ أَدْرَاعَهُ وَأَعْتُدَهُ فِي سَبِيلِ اللَّهِ.

“আর খালিদ ইবন ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু, তার ওপর তোমরা অবিচার করছ। কেননা সে তার বর্ম এবং অন্যান্য সস্পদ আল্লাহর রাস্তায় ওয়াকফ করে দিয়েছে।”[2]

আলেমগণ একমত যে, মসজিদে মাদুর ও মোমবাতি ওয়াকফ করা নিন্দনীয় নয়।

পরিধানের জন্য গহনা ওয়াকফ করা ও ধার দেওয়া জায়েয। কেননা এগুলো উপকারী জিনিস। সুতরাং জায়গা জমির মতো এগুলোও ওয়াকফ করা যাবে।

৭- ওয়াকফকারীর শর্তসমূহ:

ওয়াকফকারীর মধ্যে কতিপয় শর্ত থাকতে হবে, নতুবা তার ওয়াকফ করা জায়েয হবে না। শর্তগুলো হচ্ছে:

১- ওয়াকফকারী দান করার যোগ্য হতে হবে। অতএব, জবরদখলকারী ও যার মালিকানা এখনও স্থির হয় নি এমন লোকদের পক্ষ থেকে ওয়াকফ করা জায়েয হবে না।

২- ওয়াকফকারী বিবেববান (জ্ঞানসম্পন্ন) হতে হবে। অতএব, পাগল ও বিকারগ্রস্ত ব্যক্তির ওয়াকফ শুদ্ধ হবে না।

৩- বালিগ তথা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। অতএব, শিশুর ওয়াকফ শুদ্ধ হবে না, চাই সে ভালো-মন্দ পার্থক্যকারী হোক বা না হোক।

৪- বুদ্ধিমান হওয়া। অতএব, নির্বোধ বা দেউলিয়া বা অসচেতন লোক যাদের ওপর আইনি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তাদের ওয়াকফ শুদ্ধ হবে না।

৮- ওয়াকফকৃত জিনিসের শর্তাবলী:

ওয়াকফকৃত জিনিসটির মধ্যে যাতে ওয়াকফ বাস্তবায়ন করা যায় সেজন্য ওয়াকফকৃত জিনিসের মধ্যে কিছু শর্ত রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে:

১- ওয়াকফকৃত জিনিসটির মূল্য থাকতে হবে। যেমন, জায়গা জমি ইত্যাদি।

২- ওয়াকফকৃত জিনিসটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্ঞাত থাকা।

৩- ওয়াকফকৃত বস্তুটি ওয়াকফের সময় ওয়াকফকারীর মালিকানায় থাকা।

৪- ওয়াকফকৃত বস্তুটি সুনির্দিষ্ট হবে, এজমালী সম্পত্তি হবে না। অতএব, বহু মানুষের মালিকানাধীন কোনো বস্তুর একাংশ ওয়াকফ করা শুদ্ধ হবে না।

৫- ওয়াকফকৃত জিনিসটিতে অন্যের অধিকার সম্পৃক্ত না থাকা।

৬- ওয়াকফকৃত বস্তুটি দ্বারা ‘উরফ তথা প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী উপকার গ্রহণ সক্ষম হওয়া।

৭- ওয়াকফকৃত জিনিসটিতে বৈধ উপকার থাকা।

৯- ওয়াকফকৃত বস্তু থেকে উপকার সাধনের পদ্ধতি:

নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে ওয়াকফকৃত বস্তু থেকে উপকার অর্জন করা যায়:

ঘর-বাড়িতে বসবাস করে, আরোহণকারী পশু ও যানবাহনে আরোহণ করে, জীবজন্তুর পশম, দুধ, ডিম, লোম সংগ্রহ করে উপকার নেওয়া যায়।

১০- ওয়াকফ ও অসিয়তের মধ্যে পার্থক্য:

১- ওয়াকফ হলো মূলস্বত্ব নিজের রেখে বস্তুটির উপকার দান করা, অন্যদিকে অসিয়ত হলো দানের মাধ্যমে মৃত্যুর পরে বস্তুগত বা অবস্তুগত (উপকার) জিনিসের মালিক বানানো।

২- অধিকাংশ আলেমদের মতে, ওয়াকফ করলে তা বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে এবং ওয়াকফ ফেরত নেওয়া যায় না। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেছেন,

: «إِنْ شِئْتَ حَبَسْتَ أَصْلَهَا، وَتَصَدَّقْتَ بِهَا».

“তুমি ইচ্ছা করলে জমির মূল স্বত্ত্ব ওয়াকফে আবদ্ধ রেখে উৎপন্ন বস্তু সদকা করতে পার।”[3]

অন্যদিকে অসিয়ত করলে বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যকীয় হলেও অসিয়তকারী তার অসিয়তের পুরোটাই বা আংশিক ফেরত নিতে পারবে।

৩- ওয়াকফকৃত বস্তুটি কারো মালিকানায় প্রবেশ করা থেকে বেরিয়ে যাবে, শুধু বস্তুটির উপকার যাদের জন্য ওয়াকফ করা হয়েছে তাদের জন্য নির্ধারিত হবে। পক্ষান্তরে, অসিয়াতের বস্তুটি যাদের জন্য অসিয়ত করা হয়েছে তাদের মালিকানায় যাবে বা এর উপকার অসিয়তকৃতদের জন্য নির্ধারিত হয়ে যাবে।

৪- ওয়াকফের উপকারের মালিকানা যাদের জন্য ওয়াকফ করা হয়েছে তারা ওয়াকফকারীর জীবদ্দশায়ই পাবে এবং তার মৃত্যুর পরেও ভোগ করবে। কিন্তু অসিয়তের মালিকানা অসিয়তকারীর মৃত্যুর পর ছাড়া ভোগ করতে পারবে না।

৫- ওয়াকফের সর্বোচ্চ সীমা নির্দিষ্ট নয়; পক্ষান্তরে অসিয়তের সর্বোচ্চ সীমা শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত। আর তা হলো মোট সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ। তবে ওয়ারিশের অনুমতি সাপেক্ষে এর বেশিও করা যায়।৬- ওয়ারিশের জন্য ওয়াকফ করা জায়েয, কিন্তু ওয়ারিশের অনুমতি ব্যতীত ওয়ারিশের জন্য অসিয়ত করা জায়েয নেই।

>
[1] সহীহ বুখারী, শুরুত, হাদীস নং ২৫৮৬; সহীহ মুসলিম, অসিয়্যাহ, হাদীস নং ১৬৩৩; তিরমিযী, আহকাম, হাদীস নং ১৩৭৫; নাসাঈ, আহবাস, হাদীস নং ৩৬০৪; আবু দাউদ, ওয়াসাইয়া, হাদীস নং ২৮৭৮; ইবন মাজাহ, আহকাম, হাদীস নং ২৩৯৬; মুসনাদ আহমদ, ২/৫৫।

[2] সহীহ বুখারী, যাকাত, হাদীস নং ১৩৯৯; সহীহ মুসলিম, যাকাত, হাদীস নং ৯৮৩; তিরমিযী, মানাকিব, হাদীস নং ৩৭৬১; নাসাঈ, যাকাত, হাদীস নং ২৪৬৪; আবু দাউদ, যাকাত, হাদীস নং ১৬২৩; মুসনাদ আহমদ, ২/৩২৩।

[3] সহীহ বুখারী, শুরুত, হাদীস নং ২৫৮৬; সহীহ মুসলিম, অসিয়্যাহ, হাদীস নং ১৬৩৩; তিরমিযী, আহকাম, হাদীস নং ১৩৭৫; নাসাঈ, আহবাস, হাদীস নং ৩৬০৪; আবু দাউদ, ওয়াসাইয়া, হাদীস নং ২৮৭৮; ইবন মাজাহ, আহকাম, হাদীস নং ২৩৯৬; মুসনাদ আহমদ, ২/৫৫।

 ক- অসিয়তের পরিচিতি:

অসিয়ত হলো কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পরে কোনো কিছু করা বা হওয়ার নির্দেশনা প্রদান। আমানত পৌঁছে দেওয়া, সম্পদ দান করা, কন্যা বিয়ে দেওয়া, মৃতব্যক্তিকে গোসল দেওয়া, তার জানাযা পড়ানো, মৃতব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ বন্টন করা ইত্যাদি অসিয়তের অন্তর্ভুক্ত।

খ- অসিয়ত শরী‘আতসম্মত হওয়ার মূলভিত্তি:

কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার দ্বারা অসিয়ত শরী‘আতসম্মত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿كُتِبَ عَلَيۡكُمۡ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ ٱلۡمَوۡتُ إِن تَرَكَ خَيۡرًا ٱلۡوَصِيَّةُ﴾ [البقرة: ١٨٠]

“তোমাদের উপর ফরয করা হয়েছে যে, যখন তোমাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হবে, যদি সে কোনো সম্পদ রেখে যায়, তবে তা অসিয়ত করবে।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮০]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَا حَقُّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ لَهُ شَيْءٌ يُوصِي فِيهِ، يَبِيتُ لَيْلَتَيْنِ إِلَّا وَوَصِيَّتُهُ مَكْتُوبَةٌ عِنْدَهُ».

“কোনো মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয় যে, তার অসিয়তযোগ্য কিছু রয়েছে আর সে দু’রাত কাটাবে অথচ তার কাছে তার অসিয়ত লিখিত থাকবে না।”[1]

গ- যেসব শব্দ দ্বারা অসিয়ত কার্যকর হবে:

১- মুখে বলার দ্বারা।

২- লেখার দ্বারা।

৩- স্পষ্ট বুঝা যায় এমন ইশারার দ্বারা।

প্রথমত: মুখে বলার দ্বারা:

আলেমদের মধ্যে মুখে স্পষ্ট বলার দ্বারা অসিয়ত কার্যকর হওয়াতে কোনো মতভেদ নেই। যেমন কেউ বলল, আমি অমুককে এ অসিয়ত করলাম। অথবা মুখে স্পষ্ট শব্দে না বলে এমন অস্পষ্ট শব্দে বলা যাতে ঈঙ্গিত বহন করে যে তিনি এ শব্দ দ্বারা অসিয়ত করেছেন। যেমন, কেউ কাউকে বলল,

“আমি আমার মৃত্যুর পরে অমুককে এটার মালিক বানালাম অথবা তোমরা সাক্ষ্য থাকো আমি অমুককে এ জিনিসের অসিয়ত করলাম ইত্যাদি”।

দ্বিতীয়ত: লিখিতভাবে অসিয়ত করা:

কেউ কথা বলতে অক্ষম হলে যেমন বোবা বা জিহ্বায় সমস্যা থাকলে তখন তার আক্বল (জ্ঞান) থাকলে এবং কখা উচ্চারণের সম্ভাবনা আর না থাকলে সে লিখিতভাবে অসিয়ত করলে তা কার্যকর হবে।

তৃতীয়ত: বুঝার মতো ইশারা দ্বারা:

বোবা বা জিহ্বায় সমস্যা থাকলে সে ব্যক্তি ইশারায় অসিয়ত করলে তার অসিয়ত কার্যকর হবে, তবে শর্ত হলো যার জিহ্বায় সমস্যা আছে তার চিরতরে কথা বলার সম্ভাবনা না থাকা।

ঘ- অসিয়তের হুকুম:

অসিয়ত করা শরী‘আতসম্মত ও এটি শরী‘আতির আদিষ্ট বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ شَهَٰدَةُ بَيۡنِكُمۡ إِذَا حَضَرَ أَحَدَكُمُ ٱلۡمَوۡتُ حِينَ ٱلۡوَصِيَّةِ ٱثۡنَانِ﴾ [المائ‍دة: ١٠٦]

“হে মুমিনগণ, যখন তোমাদের কারো নিকট মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন অসিয়তকালে তোমাদের মাঝে তোমাদের মধ্য থেকে দু’জন (ন্যায়পরায়ণ) ব্যক্তি সাক্ষী হবে।” [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ১০৬]

ঙ- অসিয়তের প্রকারভেদ:

১- ওয়াজিব অসিয়ত।

যার ওপর ঋণ, অন্যের হক, আমানত ও অঙ্গিকার রয়েছে তাকে এসব কিছু স্পষ্টভাবে লিখিত রাখা ওয়াজিব যাতে নগদ ও বাকী সব দেনা-পাওয়ানা নির্দিষ্ট করা থাকে। যার কাছে অন্যের আমানত ও অঙ্গিকার রয়েছে তা এমনভাবে স্পষ্ট থাকা যাতে অসিয়তকৃত ব্যক্তি ওয়ারিশদের সাথে স্পষ্টভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে।

২- সুন্নাত অসিয়ত:

এ ধরণের অসিয়ত করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। অসিয়তকারী তার সম্পদের এক তৃতীয়াংশ ওয়ারিশ ব্যতীত অন্যদের জন্য অসিয়ত করবে। এ ধরণের কল্যাণকর ও জনহিতকর কাজে অসিয়ত করা মুস্তাহাব, চাই তা আত্মীয়-স্বজন বা অনাত্মীয় বা নির্দিষ্ট স্থান যেমন অমুক মসজিদ বা অনির্দিষ্ট স্থান যেমন মসজিদ, মাদ্রাসা, লাইব্রেরী, আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল ইত্যাদি যাই হোক।

চ- অসিয়তের পরিমাণ:

মোট সম্পদের এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করা জায়েয নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সা‘আদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেছেন,

«أُوصِي بِمَالِي كُلِّهِ؟ قَالَ: «لاَ» ، قُلْتُ: فَالشَّطْرُ، قَالَ: «لاَ» ، قُلْتُ: الثُّلُثُ، قَالَ: «فَالثُّلُثُ، وَالثُّلُثُ كَثِيرٌ».

“হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমি কি আমার সমুদয় মালের অসিয়ত করে যাব? তিনি বললেন, না। আমি বললাম, তবে অর্ধেক? তিনি বললেন, না। আমি বললাম, তবে এক তৃতীয়াংশ। তিনি বললেন, আর এক তৃতীয়াংশও অনেক।”[2]

ওয়ারিশের জন্য অসিয়ত করা জায়েয নেই, এমনিভাবে ওয়ারিশ ছাড়া অন্যদের জন্য ওয়ারিশের অনুমতি ব্যতীত এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করাও জায়েয নেই।

ছ- যেসব কাজে অসিয়ত শুদ্ধ হবে:

১- ন্যায়-সঙ্গতভাবে অসিয়ত করতে হবে।

২- আল্লাহ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে যেভাবে অসিয়ত শরী‘আতসম্মত করেছেন অসিয়ত সেভাবে হতে হবে।

৩- অসিয়তকারী তার কাজে একনিষ্ঠ থাকতে হবে এবং অসিয়তের দ্বারা ভালো ও কল্যাণকর কাজের নিয়ত করবে।

জ- অসিয়তকারীর শর্তাবলী:

১- অসিয়তকারী দান করার যোগ্য হতে হবে।

২- সে অসিয়তকৃত বস্তুর মালিক হতে হবে।

৩- সে খুশী মনে ও স্বেচ্ছায় অসিয়ত করতে হবে।

ঝ- অসিয়তকৃত ব্যক্তি বা সংস্থার শর্তাবলী:

১- অসিয়তটি কল্যাণ ও বৈধ স্থানে হতে হবে।

২- অসিয়ত করার সময় যার জন্য অসিয়ত করবে তার বাস্তবে বা উহ্যভাবে অস্তিত্ব থাকতে হবে। অতএব, অস্তিত্বহীন কিছুর জন্য অসিয়ত করা শুদ্ধ নয়। কেবল জানা ব্যক্তি বা সংস্থার জন্যই অসিয়ত শুদ্ধ হবে।

৩- অসিয়তকৃত ব্যক্তি নির্দিষ্ট হওয়া।

৪- অসিয়তকৃত ব্যক্তি মালিকানার যোগ্য হওয়া বা মালিকানার অধিকারী হওয়া।

৫- অসিয়তকৃত ব্যক্তি অসিয়তকারীর হত্যাকারী না হওয়া।

৬- অসিয়তকৃত ব্যক্তি অসিয়তকারীর ওয়ারিশ না হওয়া।

ঞ- অসিয়তকৃত বস্তুর শর্তাবলী:

১- অসিয়তকৃত বস্তুটি ওয়ারিশ হওয়ার যোগ্য সম্পদ হওয়া।

২- অসিয়তকৃত বস্তুটি শরী‘আতের মাপকাঠিতে মূল্যমান সম্পদ হওয়া।

৩- সম্পদটি মালিকানা হওয়ার যোগ্য হওয়া, যদিও অসিয়ত করার সময় তার অস্তিত্ব না থাকে।

৪- অসিয়তকৃত বস্তুটি অসিয়ত করার সময় অসিয়তকারীর মালিকানায় থাকা।

৫- অসিয়তকৃত বস্তুটি শর‘ঈ গুনাহ বা হারাম বস্তু না হওয়া।

ট- যেভাবে অসিয়ত সাব্যস্ত হবে:

সর্বসম্মতভাবে লিখিত আকারে অসিয়ত করা মুস্তাহাব। অসিয়তের শুরুতে বিসমিল্লাহ, আল্লাহর সানা ও হামদ লিখবে। অতঃপর, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সালাত ও সালাম জানাবে। অতঃপর বিসমিল্লাহ, আল্লাহর হামদ ও রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর সালাত ও সালামের পরে লিখিত আকারে বা মৌখিকভাবে অসিয়তের সাক্ষ্যদ্বয়ের নাম ঘোষণা করবে।

ঠ- অসিয়তের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি:

১- শাসকের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

২- বিচারকের পক্ষ থেকে ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

৩- মুসলিমের পক্ষ থেকে নির্বাচিত কোনো ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

ড- অসিয়ত ভঙ্গের কারণসমূহ:

১- স্পষ্ট বা ইশারায় অসিয়ত ফেরত নেওয়া।

২- শর্তযুক্ত অসিয়তে শর্ত পাওয়া না গেলে।

৩- অসিয়তের জন্য ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি না থাকলে।

৪- অসিয়তকারী অসিয়ত করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেললে।

৫- অসিয়তকারী মুরতাদ হয়ে গেলে কতিপয় আলেমের মতে অসিয়ত ভঙ্গ হয়ে যাবে।

৬- অসিয়তকৃত ব্যক্তি অসিয়ত ফেরত দিলে।

৭- অসিয়তকারীর আগে অসিয়তকৃত ব্যক্তি মারা গেলে।

৮- অসিয়তকৃত ব্যক্তি অসিয়তকারীকে হত্যা করলে।

৯- অসিয়তকৃত বস্তুটি ধ্বংস হয়ে গেলে বা তাতে অন্যের মালিকানা প্রকাশ পেলে।১০- ওয়ারিশদের অনুমতি ব্যতীত কোনো ওয়ারিশকে অসিয়ত করলে অসিয়ত ভঙ্গ হয়ে যাবে।

[1] সহীহ বুখারী, অসাইয়া, হাদীস নং ২৫৮৭; সহীহ মুসলিম, অসিয়ত, হাদীস নং ১৬২৭; তিরমিযী, জানায়েয, হাদীস নং ৯৭৪; নাসাঈ, অসাইয়া, হাদীস নং ৩৬১৬; আবু দাউদ, অসাইয়া, হাদীস নং ২৮৬২; ইবন মাজাহ, অসাইয়া, হাদীস নং ২৬৯৯; মুসনাদ আহমদ, ২/৮০; মুয়াত্তা মালিক, আকদিয়া, হাদীস নং ১৪৯২।

[2] সহীহ বুখারী, অসাইয়া, হাদীস নং ২৫৯১; সহীহ মুসলিম, অসিয়ত, হাদীস নং ১৬২৮; তিরমিযী, অসাইয়া, হাদীস নং ২১১৬; নাসাঈ, অসাইয়া, হাদীস নং ৩৬২৮; আবু দাউদ, অসাইয়া, হাদীস নং ২৮৬৪; মুসনাদ আহমদ, ১/১৬৮; মুয়াত্তা মালিক, আকদিয়া, হাদীস নং ১৪৯৫; দারেমী, অসাইয়া, হাদীস নং ৩১৯৬।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৫ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে