উসূলে ফিক্বহ (ফিক্বহের মূলনীতি) ক্বিয়াস (القياس) শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ৩ টি

القياس এর সংজ্ঞা: القياس ক্বিয়াস-এর আভিধানিক অর্থ হলো অনুমান করা, সমান করা। পারিভাষিক অর্থ:

تسوية فرع بأصل في حكم لعلة جامعة بينهما

‘‘ক্বিয়াস হলো কোন হুকুমের ক্ষেত্রে মূল দলীলের সাথে শাখাগত দলীলকে উভয়ের মাঝে সমন্বয়কারী ইল্লত (হুকুমের কারণ) থাকার কারণে সমান করা।’’[1]

الفرع (শাখা): الفرع দ্বারা উদ্দেশ্য যাকে ক্বিয়াস করা হয়।

الأصل (মূল): الأصل দ্বারা উদ্দেশ্য যার উপর অন্যকে ক্বিয়াস করা হয়।

الحكم (বিধি-বিধান): الحكم হলো শারঈ দলীল যা (বিধি-বিধান) দাবী করে।

যেমন: ওয়াজিব, হারাম, ছহীহ ও ফাসেদ প্রভৃতি।

العلة হলো: العلة হলো ঐ অন্তর্নিহিত অর্থ যার কারণে الأصل (মূল) এর হুকুম সাব্যস্ত হয়।

এ চারটি হলো ক্বিয়াসের রুকন বা ভিত্তি। যে সব দলীলের মাধ্যমে শারঈ হুকুম সাব্যস্ত হয় তার অন্যতম হলো ক্বিয়াস। এটি শারঈ দলীল হিসাবে গণ্য হওয়ার ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ ও ছাহাবীদের বাচনিক দলীল রয়েছে।

কুরআনের দলীলের মধ্যে অন্যতম দলীল হলো:

(১) আল্লাহর বাণী:

اللَّهُ الَّذِى أَنزَلَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ وَالْمِيزَان

‘‘আল্লাহ যিনি সত্য সহ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং তিনি আরও অবতীর্ণ করেছেন ন্যায়দন্ড (সূরা শুরা ৪২:১৭)।’’

الْمِيزَان (দাঁড়িপাল্লা) হলো যার দ্বারা বিভিন্ন জিনিস ওযন করা হয় এবং সেগুলির মাঝে তুলনা করা হয়।

(২) আল্লাহর বাণী:

كَمَا بَدَأْنَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُّعِيدُهُ

‘‘যেভাবে আমি প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, সেভাবেই আমি দ্বিতীয় বার সৃষ্টি করবো (সূরা আল-আম্বিয়া ২১ : ২১৪)।’’

وَاللهُ الَّذِيْ أَرْسَلَ الرِّيَاحَ فَتُثِيْرُ سَحَابًا فَسُقْنٰهُ إِلٰى بَلَدٍ مَيِّتٍ فَأَحْيَيْنَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا ج كَذَالِكَ النُثُوْرُ

‘‘অর্থ: আল্লাহই বায়ু প্রেরণ করেন, অত:পর সে বায়ু মেঘমালা সঞ্চারিত করে। অত:পর আমি তা মৃত ভূখন্ডের দিকে পরিচালিত করি। অত:পর তদ্বারা সে ভূখন্ডকে তার মৃত্যুর পর সঞ্জীবিত করে দেই। এমনিভাবে হবে পুনরুত্থান (সূরা ফাতির ৩৫:৯)।’’

আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি জীবকে পুনরায় সৃষ্টি করাকে প্রথমবার সৃষ্টি করার সাথে সাদৃশ্য দিয়েছেন এবং মৃত ব্যক্তিদেরকে জীবিত করাকে জমিন জীবিত করার সাথে সাদৃশ্য দিয়েছেন। এটিই হলো ক্বিয়াস। সুন্নাহ হতে দলীল হলো-

(১) যে মহিলা তার মা মারা যাওয়ার পর মায়ের পক্ষ থেকে ছিয়াম পালন করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার জবাবে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বক্তব্য:

أرأيت لو كان على أمك دين فقضيته ، أكان يؤدي ذالك عنها؟

‘‘তোমার কি অভিমত, যদি তোমার মায়ের ঋণ থাকে, অতঃপর তা পরিশোধ করো, তবে কি তা আদায় হয়ে যাবে? মহিলা জবাবে বললেন, হ্যাঁ। এবার তিনি বললেন, তাহলে তোমার মায়ের পক্ষ থেকে ছিয়াম পালন করো।’’[2]

(২) ‘‘এক ব্যক্তি এসে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমার একজন কালো সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার কি উট আছে? লোকটি বললো, হ্যাঁ। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সেগুলোর রং কি? লোকটি বললো, লাল বর্ণের। তিনি বললেন, সেখানে কি ছাই বর্ণের উটও আছে? লোকটি বললো, জ্বী, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এ রং কোথা থেকে আসলো? লোকটি বললো, হয়তো এটি বংশগত কারণে হয়েছে। এবার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও জবাবে বললেন, তাহলে তোমার সন্তানও হয়তো বংশগত কারণে এমন হয়েছে।’’[3]

কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত এ রকম প্রতিটি দৃষ্টান্তই ক্বিয়াসের উপর প্রমাণ বহন করে। কেননা, এতে কোন জিনিসকে তার সমজাতীয় জিনিসের পর্যায়ভূক্ত করার’ বিষয়টি নিহিত আছে।

ছাহাবীদের বক্তব্য থেকে অন্যতম দলীল হলো শাসন কার্য ফয়সালার ক্ষেত্রে আবু মুসা আল আশআ‘রী (রা.) এর উদ্দেশ্যে চিঠিতে উমার (রা.) বলেন, ‘‘... তারপর তোমার বুঝ, যা তোমার কাছে প্রতিভাত হয়, তদানুযায়ী ফায়সালা করবে। যে মাসআ‘লার ব্যাপারে কুরআন-হাদীছে কোন দলীল নেই তা তোমার কাছে পেশ করা হলে তুমি ঐ সব মাসআ’লাকে অন্যান্য বিষয়ের সাথে ক্বিয়াস বা পারস্পরিক তুলনা করবে এবং উপমা সম্পর্কে জ্ঞান রাখবে। তারপর তোমার ধারণানুসারে যা আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয় এবং হক্বের সাথে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ হয়, তার উপরই নির্ভর করবে।’’[4]ইবনুল কাইয়ুম (রহঃ) বলেছেন, ‘‘এটি অত্যন্ত মর্যাদাবান চিঠি, যা উম্মাহ গ্রহণ করে নিয়েছেন। ইমাম মুযনী (রহঃ) বলেন, ছাহাবীদের যুগ থেকে তার যুগ পর্যন্ত সকল ফকীহ একমত যে, ‘নিশ্চয় হক্বের অনুরূপ জিনিসও হক্ব এবং বাতিলের অনুরূপ জিনিসও বাতিল হিসাবে বিবেচিত’ এবং তারা ফিক্বহের সকল বিধি-বিধানের ক্ষেত্রে ক্বিয়াসের ব্যবহার করছেন।’’[5]

[1]. যেমন: হাদীছে গোবর দিয়ে শৌচাকার্য করতে নিষেধ করা হয়েছে। নিষেধের কারণ বলা হয়েছে যে, এটি নাপাক। (ছহীহ বুখারী/১৫৬) এর উপর কিয়াস করে বলা হয় যে, শুকনা রক্ত দিয়ে শৌচাকার্য করা নিষেধ। যে হুকুম সরাসরি দলীল দিয়ে সাব্যস্ত হয়, সেটি আসল। যাকে এ আসলের উপর কিয়াস করা হয়, তাকে শাখা বলা হয়। এখানে গোবর দিয়ে শৌচাকার্য করা নিষেধের হুকুমটি আসল। শুকনা রক্ত দিয়ে শৌচকার্য করা নিষেধের হুকুমটি শাখা। কিয়াস করার জন্য জন্য আসল ও শাখার ইল্লত বা কারণ একই হতে হয়। এখানে গোবর দিয়ে শৌচাকার্য করতে নিষেধের কারণ হলো এগুলো নাপাক। এর ভিত্তিতে শুকনা রক্ত দিয়ে শৌচকার্য করা নিষেধ হবে; কারণ এখানেও ঐ কারণটি পাওয়া গেছে। কেননা শুকনো রক্তও নাপাক।

[2]. ছ্বহীহ বুখারী হা/১৯৫৩, ছ্বহীহ মুসলিম হা/১১৪৮।

[3]. ছ্বহীহ বুখারী হা/৫৩০৫, ছ্বহীহ মুসলিম হা/১৫০০।

[4]. বাইহাকী ১০/১১৫, দারাকুৎনী ৪/২০৬-২০৭

[5]. ইগাসাতুল লাহফান ১/৮৬
ক্বিয়াস করার ক্ষেত্রে শর্তাবলী (شروط القياس)

ক্বিয়াসের অনেক শর্ত রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো:

(১) ক্বিয়াস তার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী দলীলের সাথে বিরোধপূর্ণ হবে না। কাজেই যে ক্বিয়াস نص বা কুরআন-হাদীছের সুস্পষ্ট দলীল, ইজমা ও ছাহাবীদের বক্তব্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়, তা গ্রহণযোগ্য নয়। (যখন আমরা বলি যে, ছাহাবীদের বক্তব্য দলীলযোগ্য)।

সুতরাং যে ক্বিয়াস পূর্বোক্ত দলীল সমূহের সাথে বিরোধপূর্ণ হয়, তাকে فاسد الاعتبار বা গ্রহণের অযোগ্য ক্বিয়াস হিসাবে অভিহিত করা হয়। এর দৃষ্টান্ত হলো প্রাপ্তবয়স্কা মহিলা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই ক্রয়-বিক্রয় করতে পারে, এর উপর ক্বিয়াস করে বলা যে, প্রাপ্ত বয়স্কা মহিলা অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিবাহ করতে পারবে। এ ক্বিয়াসটি نص এর সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে فاسد الاعتبار বা অগ্রণযোগ্য। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, لا نكاح الا بولي অর্থাৎ অভিভাবক ছাড়া কোন বিবাহ নেই।[1]

(২) মূল দলীলের হুকুমটি نص বা ইজমার মাধ্যমে সাব্যস্ত হতে হবে। সুতরাং যদি মূল হুকুমটি ক্বিয়াসের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়, তাহলে তার উপর অন্যকে কিবয়াস করা যাবে না। বরং এটিকে প্রথম মূলের উপর ক্বিয়াস করতে হবে। কেননা, সেদিকে ফিরে যাওয়াই উত্তম। কারণ যে বিষয়কে আসল নির্ধারণ করে তার উপর শাখাকে ক্বিয়াস করা হয়, অনেক সময় তা ছহীহ হয় না। এখানে আরো কারণ হলো فرع কে فرع এর উপর ক্বিয়াস করা, অতঃপর সেই فرع কে আবার أصل এর উপর ক্বিয়াস করা কোন উপকার ছাড়াই দীর্ঘসূত্রতা মাত্র।

এর দৃষ্টান্ত হলো এটা বলা যে, ভূট্টাতে সুদ প্রযোজ্য হবে চাউলের উপর ক্বিয়াস করে। চাউলে সুদ প্রযোজ্য হয় গমের উপর ক্বিয়াস করে। এভাবে ক্বিয়াস করা শুদ্ধ নয়। বরং এভাবে বলতে হবে যে, ভূট্টাতে সুদ প্রযোজ্য হবে গমের উপর ক্বিয়াস করে। এর কারণ হলো, যাতে نص দ্বারা সাব্যস্ত أصل এর উপর ক্বিয়াস করা যায়।

(৩) أصل এর হুকুম একটি জ্ঞাত علة থাকতে হবে। যাতে أصل ও فرع এর علة এর মাঝে সমন্বয় করা যায়। যদি মূলের হুকুম কেবল ইবাদত হয়, তাহলে তার উপর অন্য কিছুকে ক্বিয়াস করা যাবে না। এর দৃষ্টান্ত হলো উটের মাংসের উপর ক্বিয়াস করে এটা বলা যে, উট পাখির মাংস খেলে ওযু ভেঙ্গে যাবে। যেহেতু উটের সাথে উট পাখির মিল রয়েছে। এক্ষেত্রে বলা হবে, এ ক্বিয়াস ছহীহ নয়। কারণ মূলের হুকুমের জ্ঞাত কোন কারণ নেই।[2] প্রসিদ্ধ মতানুসারে এটা নিরঙ্কুশ ইবাদত।

(৪) হুকুমের সাথে সংগতিপূর্ণ অর্থকে ইল্লত ধরতে হবে, যার গ্রহণযোগ্যতা শরীয়তের মূলনীতি থেকে জানা যাবে। যেমন: মদ হারামের ইল্লত বা কারণ হলো মাদকতা আসা বা মাতাল হওয়া। ইল্লতের অর্থ যদি দূরবর্তী গুণকে ধারণ করে, যার সাথে হুকুমের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই, তাহলে সেটিকে ইল্লত হিসাবে নির্ধারণ করা যাবে না। যেমন: সাদা, কালো প্রভৃতি। এর উদাহরণ হলো আব্দুল্লাহ বিন আব্বাসের হাদীছ যখন বারীরাকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করা হয়, তখন তাঁর স্বামীর ব্যাপারে তাকে ঐচ্ছিকতা প্রদান করা হয়। আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন, তার স্বামী কালো দাস ছিলো। এখানে আব্দুল্লাহ বিন আববাসের বক্তব্য ‘কালো’ একটি দূরবর্তী গুণ; যার সাথে ঐচ্ছিকতা প্রদানের হুকুমের সাথে কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। এ জন্য কোন দাসীকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করা হলে তার স্বামী যদি দাস হয়, তবে তাকে ঐচ্ছিকতা প্রদান করা হবে। যদিও তার স্বামী ফর্সা হয়। অনুরূপ ভাবে স্বামী স্বাধীন থাকলে, দাসীকে স্বাধীন করার পরও তার জন্য ঐচ্ছিকতা সাব্যস্ত হবে না, যদিও তার স্বামী কালো হয়।

(৫) أصل এর ন্যায় فرع এর মাঝেও ইল্লত বিদ্যমান থাকা। যেমন: বাবা-মাকে ‘উহ্’ বলা নিষেধের উপর ক্বিয়াস করে বাবা-মাকে প্রহার করা নিষেধ করা। কেননা, উভয়ের ক্ষেত্রে কারণ হলো কষ্ট দেওয়া। কাজেই فرع এর মাঝে ইল্লত পাওয়া না গেলে ক্বিয়াস শুদ্ধ হবে না।এর দৃষ্টান্ত হলো এরূপ বলা যে, গমের মধ্যে সুদ হারামের কারণ হলো এটি পরিমাপযোগ্য। অতঃপর এটা বলা যে, গমের উপর ক্বিয়াস করে আপেলেও সুদ প্রযোজ্য হবে। এ ক্বিয়াস শুদ্ধ নয়। কারণ فرع এর মাঝে ইল্লত পাওয়া যায়নি। কেননা, আপেল পরিমাপযোগ্য নয়। (বরং ওযনযোগ্য)।

[1]. ছ্বহীহ: তিরমিযী হা/১১০১. আবূ দাউদ হা/২০৮৫, ইবনু মাজাহ হা/১৮৮০

[2]. হাদীছে উটের গোশত খেলে ওযু ভেঙ্গে যাওয়ার কথা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কেন ওযু ভেঙ্গে যায়, এর কোন ইল্লত বা কারণ বর্ণনা করা হয়নি। যেহেতু এর কোন কারণ জানা যায় না, কাজেই এর উপর অন্যকে কিয়াস করা যাবে না। কেননা, কিয়াস করার জন্য শর্ত হলো আসলের এর হুকুমের ইল্লত জানা থাকতে হবে।

ক্বিয়াস দু’প্রকারে বিভক্ত। যথা:

১. الجل (সুস্পষ্ট ক্বিয়াস)।

২. الخفي (অস্পষ্ট ক্বিয়াস)।

১. الجلي (সুস্পষ্ট ক্বিয়াস) যে ক্বিয়াসের ক্ষেত্রে علة (কারণ) نص (কুরআন-হাদীছের স্পষ্ট ভাষ্য) অথবা ইজমার মাধ্যমে জানা যায় অথবা যে কিয়াসে أصل ও فرع এর মাঝে অকাট্ট ভাবে পার্থক্য না থাকে, তাকে ক্বিয়াসে الجلي বা সুস্পষ্ট ক্বিয়াস বলে।

علة (কারণ) نص (কুরআন-হাদীছের স্পষ্ট ভাষ্য) দ্বারা সাব্যস্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত হলো

গোবর দ্বারা কুলুখ নেয়া নিষেধের উপর শুকনা-নাপাক রক্ত দ্বারা কুলুখ নেয়া নিষেধের ক্বিয়াস। কেননা, এখানে أصل এর হুকুমের ইল্লত বা কারণ নিম্নোক্ত نص দ্বারা সাব্যস্ত। نص হলো আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট দু’টি পাথর ও একটি গোবর (কুলুখ নেওয়ার জন্য) এনেছিলেন। অতঃপর তিনি পাথর দু’টি গ্রহণ করেন আর গোবর ফেলে দেন এবং বলেন, এটা ركس অর্থাৎ নাপাক।[1]

ইল্লত ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত হওয়ার দৃষ্টান্ত হলো রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিচারককে রাগান্বিত অবস্থায় বিচার-ফয়সালা করতে নিষেধ করেছেন।[2] রাগান্বিত ব্যক্তির বিচার-ফয়সালা করা নিষেধের উপর ক্বিয়াস করে পেশাব-পায়খানার বেগ প্রাপ্ত ব্যক্তির বিচার-ফয়সালা করা নিষেধের ক্বিয়াস, قياس جلي এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ أصل এর ইল্লত ইজমার মাধ্যমে সাব্যস্ত। আর তা হলো অন্তর ও চিন্তার অস্থিরতা।[3]

أصل ও فرع এর মাঝে অকাট্যভাবে পার্থক্য না থাকার দৃষ্টান্ত হলো ইয়াতিমের সম্পদ খেয়ে ধ্বংস করা হারাম হওয়ার উপর কিয়াস করে তার সম্পদ ব্যবহার করে ধ্বংস করা হারাম। কারণ উভয়ের মাঝে অকাট্যভাবে কোন পার্থক্য নেই।

২. الخفي (অস্পষ্ট ক্বিয়াস): যে ক্বিয়াস ইল্লত অনুসন্ধানের মাধ্যমে সাব্যস্ত করতে হয় এবং أصل ও فرع এর মাঝে পার্থক্য না থাকার বিষয়টি অকাট্ট ভাবে বলা যায় না, তাকে قياس خفي বলে। এর উদাহরণ হলো সুদ হারাম হওয়ার ক্ষেত্রে গমের উপর যবক্ষার ক্বিয়াস করা। ‘পরিমাপ যোগ্য’ হওয়ার কারণে উভয়টির সমন্বিত ইল্লত। এখানে ‘পরিমাপ যোগ্য’ কে ইল্লত বানানো نص বা ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত নয় এবং أصل ও فرع এর মাঝে পার্থক্য না থাকার ব্যাপারে অকাট্ট ভাবে বলা যায় না। কেননা, উভয়ের মাঝে এভাবে পার্থক্য করা যায় যে, গম খাদ্য দ্রব্য পক্ষান্তরে যবক্ষার খাদ্য দ্রব্য নয়।[4]

قياس الشبه (সাদৃশ্যমূলক কিয়াস): ক্বিয়াসের মাঝে আরেকটি হলো قياس الشبه। এটি হলো, যে ক্বিয়াসের فرع ভিন্ন ভিন্ন হুকুম সম্পন্ন দুটি أصل এর মাঝে দোদুল্যমান থাকে। উভয় أصل এর সাথে উক্ত فرع এর সাদৃশ্যতা রয়েছে। তাই উক্ত فرع কে অধিকতর সাদৃশ্যপূর্ণ أصل এর সাথে যুক্ত করা হবে। এর দৃষ্টান্ত হলো দাসকে স্বাধীন ব্যক্তির উপর ক্বিয়াস করে কোন জিনিসের মালিক বানিয়ে দিলে সে মালিক হবে? নাকি চতুষ্পদ প্রাণীর উপর ক্বিয়াস করে মালিক বানিয়ে দিলেও মালিক হবে না?

যখন আমরা স্বাধীন ব্যক্তি ও চতুষ্পদ জন্তু এ দু’টি أصل এর দিকে লক্ষ্য করবো, আমরা দেখতে পাবো যে, দাস শব্দটি فرع ও أصل উভয় এর মাঝে দোদুল্যমান। দাস জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, সে তার কর্মের শাস্তি ও ছাওয়াব পায়, সে বিবাহ করে, তালাক দেয় এ সব দিক দিয়ে স্বাধীন ব্যক্তির সাথে তার সাদৃশ্যতা রয়েছে। আবার তাকে বিক্রয় করা যায়, বন্ধক রাখা যায়, ওয়াকফ্ করা যায়, দান করা যায় এবং উত্তরাধিকার পণ্য বিবেচিত হয়। সে নিজে কারো ওয়ারিশ হতে পারে না, মূল্যের মাধ্যমে তার ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়,[5] তাকে ব্যবসার পণ্য বানানো যায়,[6] এ সব ক্ষেত্রে সে চতুষ্পদ প্রাণীর সাথে সাদৃশ্য রাখে। সুতরাং আমরা দেখতে পেলাম যে, অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে চতুষ্পদ প্রাণীর সাথেই তার সাদৃশ্যতা বেশী। সুতরাং এ ক্ষেত্রে তাকে চতুষ্পদ প্রাণীর হুকুমের সাথেই যুক্ত করা হবে।

এ প্রকারের ক্বিয়াস দুর্বল। কেননা, এখানে দাসের সাথে أصل এর অধিকাংশ হুকুমের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রাখা ছাড়া উপযুক্ত কোন ইল্লত নেই। উপরন্তু ভিন্ন হুকুমের আরো একটি أصل তার সাথে সাংঘর্ষিক রয়েছে।

قياس العكس : ক্বিয়াসের মধ্যে আরো এক ধরণের ক্বিয়াস রয়েছে। যাকে قياس العكس বা বিপরীতধর্মী ক্বিয়াস বলে। এটি হল أصل এর হুকুমের যে ইল্লত রয়েছে, তার বিপরীত ইল্লত فرع এর মাঝে বিদ্যমান থাকার কারণে أصل এর হুকুমের বিপরীত হুকুম فرع এর জন্য সাব্যস্ত করা।

উসুলবিদগণ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এর নিম্নোক্ত বাণীর মাধ্যমে এর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন।

وفي بضع أحدكم صدقة.. قالوا يا رسول الله! أياتي أحدنا شهوته ويكون له فيها أجر؟ قال: أرأيتم لو وضعها في حرام أكان عليه وزر؟ فكذالك اذا وضعها في الحلال كان له أجر

‘‘স্ত্রীর সাথে তোমাদের মেলা-মেশা করাতেও তোমাদের জন্য ছাওয়াব রয়েছে। ছাহাবীরা বললেন, আমাদের কোন ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ করবে, আর তাতেও তার জন্য সাওয়াব হবে? তিনি বললেন, তোমাদের কি অভিমত, ‍যদি সে এটি হারাম স্থানে ব্যবহার করতো, তবে কি তার পাপ হতো না? (নিশ্চয়ই হতো)। অনুরূপ ভাবে যখন সে এটাকে হালাল পন্থায় ব্যবহার করবে, তবে তার জন্য ছাওয়াব নির্ধারিত হবে।’’[7]


أصل এর হুকুমের ইল্লতের বিপরীত ইল্লত فرع এর মাঝে পাওয়ার কারণে فرع (অর্থাৎ বৈধ মিলন) এর জন্য أصل (অবৈধ মিলন) এর বিপরীত হুকুম সাব্যস্ত করেছেন। فرع এর জন্য রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাওয়াব সাব্যস্ত করেছেন। যেহেতু এটি বৈধ মিলন। যেমনিভাবে أصل এর জন্য পাপ সাব্যস্ত করেছেন। কেননা, এটি অবৈধ মিলন।

[1]. ছ্বহীহ বুখারী হা/১৫৬

[2]. ছ্বহীহ বুখারী হা/৭১৫৮

[3]. রাগান্বিত অবস্থায় বিচার ফায়ছালা করা নিষেধ। কারণ এ সময় মানুষের চিন্তা-চেতনা অস্থির থাকে। এর উপর ক্বিয়াস করে পেশাব-পায়খানার চাপ থাকা অবস্থায়ও বিচার ফায়ছালা করবে না। কেননা, এ অবস্থাতেও মানুষের চিন্তা-চেতনা অস্থির থাকে।

[4]. الأشنان (যবক্ষার) হলো বালুময় জায়গায় উৎপন্ন এক প্রকার উদ্ভিদ, যেগুলিকে কাপড়, হাত প্রভৃতি ধোয়ার জন্য ক্ষার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

[5]. অর্থাৎ কোন ব্যক্তি যদি কোন দাসকে হত্যা করে, তবে হত্যাকারী দাসের মালিককে দাসের মূল্য পরিশোধ করবে, যে মূল্য দিয়ে মালিক দাসটি ক্রয় করেছিলেন।

[6]. কিন্তু স্বাধীন ব্যক্তিকে হত্যা করলে, হত্যার বিনিময়ে হত্যা অথবা রক্তমূল্য (একশত উটের সমপরিমাণ মূল্য) পরিশোধ করতে হবে।

অর্থাৎ তাকে বেচা-কেনা করা যায়।

[7]. ছ্বহীহ মুসলিম হা/১০০৬
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৩ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে