উসূলে ফিক্বহ (ফিক্বহের মূলনীতি) ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ (العام) শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ) ৪ টি

العام এর সংজ্ঞা: العام এর আভিধানিক অর্থ অন্তর্ভুক্তকারী।

عام এর পারিভাষিক অর্থ:

اللفظ المستغرق لجميع أفراده بلا حصر

عام হলো এমন শব্দ যা কোনরূপ সীমাবদ্ধতা ছাড়াই তার সমস্ত একককে অন্তর্ভূক্ত করে। যেমন: আল্লাহর বাণী:

إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ

পূণ্যবান লোকেরা থাকবে পরম স্বাচ্ছন্দ্যে (সূরা আল-ইনফিতার ৮২:১৩)।

আমাদের ভাষ্য: المستغرق لجميع أفراده (যা তার সমস্ত একককে শামিল করে)। এ অংশ দ্বারা ঐ সকল জিনিস বিলুপ্ত হয়েছে যা কেবল একটি বিষয়কে অন্তর্ভূক্ত করে। যেমন: নির্দিষ্ট নাম। যা কেবল একটি একককে অন্তর্ভূক্ত করে। আর হ্যাঁ বাচক অর্থের প্রেক্ষাপটে অনির্দিষ্ট বিশেষ্য প্রযোজ্য হয়। যেমন: আল্লাহর বাণী:

فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ

একটি দাস মুক্ত করতে হবে (সূরা আল-মুজাদালাহ ৫৮:৩)।

উক্ত আয়াতাংশ ব্যাপকভাবে সমস্ত একককে অন্তর্ভূক্ত করে না। বরং অনির্দিষ্টভাবে যে কোন একজনকে অন্তর্ভূক্ত করে।

بلا حصر (সীমাহীন) এ অংশ দ্বারা ঐ সব জিনিস বিলুপ্ত হয়েছে যা সীমাবদ্ধতার সাথে তার সমস্ত একককে অন্তর্ভূক্ত করে। যেমন: সংখ্যাবাচক বিশেষ্য একশ, এক হাজার ইত্যাদি।

عام এর শব্দরূপ ৭ টি। যথা:

(১) মৌলিকগত ভাবে শব্দ ব্যাপক অর্থের উপর প্রমাণ করে। যেমন:

كل وجميع، وكافة، وقاطبة، وعامة؛

كل- সব, সবাই, جميع - সবাই, كافة - সকল, قاطبة - সমস্ত, عامة - ব্যাপক।

আল্লাহর বাণী:

إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ

আমি সব কিছু পরিমিত করে সৃষ্টি করেছি (সূরা আল-ক্বামার ৫৪:৪৯)।

(২) أسماء الشرط শর্তের অর্থ জ্ঞাপক বিশেষ্য। যেমন: আল্লাহর বাণী:

مَنْ عَمِلَ صَالِحاً فَلِنَفْسِه

যে কেউ ভালো কাজ করে, সে তার নিজের জন্যই করে (সূরা আল-জাছিয়া ৪৫:১৫)।

فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ

তোমরা যে দিকেই মুখ ফেরাও সে দিকেই আল্লাহর চেহারা রয়েছে (সূরা আল-বাক্বারা ২:১১৫)।

أسماء الاستفهام প্রশ্নবোধক বিশেষ্য: আল্লাহর বাণী:

فَمَنْ يَأْتِيكُمْ بِمَاءٍ مَعِينٍ

কে তোমাদের নিকট পৌছে দিবে প্রবাহমান পানি? (সূরা আল-মূলক ৬৭:৩০)।

مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ

তোমরা রসূলদের কি জবাব দিয়েছিলে? (সূরা আল-ক্বাছাছ ২৮:৬৫)।

فأين تذهبون

তোমরা যাচ্ছো কোথায়? (সূরা আত-তাকভীর ২৯:২৬)।

(৪) (الأسماء الموصولة) সম্বন্ধ সূচক বিশেষ্য: আল্লাহ বলেন,

وَالَّذِي جَاءَ بِالصِّدْقِ وَصَدَّقَ بِهِ أُولَئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ) [الزمر:33]

যারা সত্য এনেছে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে তারাইতো আল্লাহভীরু (সূরা আয-যুমার ৩৯:৩৩)।

তিনি আরো বলেন,

وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا

যারা আমার পথে সাধনায় আত্ন নিয়োগ করে অবশ্যই আমি তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করবো (সূরা আল-আনকাবূত ২৯:৬৯)।

إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لِمَنْ يَخْشَى

যারা ভয় করে, তাদের জন্য এতে উপদেশ রয়েছে (সূরা আন-নাযি‘আত ৭৯:২৬)।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَلِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْض

আসমান সমূহ ও জমিনের মাঝে যা কিছু রয়েছে সব কিছু আল্লাহর জন্যই (সূরা আলে ইমরান ৩:১২৯)।

(৫) النكرة في سياق النفي أو النهي أو الشرط أو الاستفهام الإنكاري (না বোধক অথবা নিষেধ সূচক অথবা শর্ত কিংবা অস্বীকৃতিজ্ঞাপক প্রশ্নবোধক শব্দের প্রেক্ষাপটে অনির্দিষ্ট বিশেষ্য ব্যবহৃত হওয়া। আল্লাহর বাণী:

وما من اله الا الله

আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই (সূরা আলে-ইমরান ৩:৬২)। তিনি আরোও বলেন,

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئاً

আল্লাহর ইবাদত করো, তার সাথে কাউকে শরীক করো না (সূরা আন-নিসা ৪:৩৬)।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

إِنْ تُبْدُوا شَيْئاً أَوْ تُخْفُوهُ فَإِنَّ اللَّهَ كَانَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيماً

তোমরা কোন বিষয় প্রকাশ করো অথবা গোপন করো আল্লাহ সর্ব বিষয়ে জ্ঞাত (সূরা আল-আহযাব ৩৩:৫৪)।

مَنْ إِلَهٌ غَيْرُ اللَّهِ يَأْتِيكُمْ بِضِيَاءٍ أَفَلا تَسْمَعُونَ

আল্লাহ ব্যতীত এমন কোন ইলাহ আছে কি যে তোমাদেরকে আলো এনে দিতে পারে? তবুও কি তোমরা শুনবে না? (সূরা ক্বাছাছ ২৮:৭১)।

(৬) المعرّف بالإضافة তথা বিশেষ্যপদ إضافة- সম্বন্ধ সূচক পদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট হওয়া হোক তা একবচন অথবা বহুবচন। যেমন: আল্লাহর বাণী:

وأذكروا نعمة الله عليكم

তোমরা ঐ নি‘আমতের কথা স্মরণ করো যা আল্লাহ তোমাদের দান করেছেন (সূরা আ‘রাফ ৭:৭৪)।

(৭) المعرف بأل الاستغراقية সমুদয় অর্থ জ্ঞাপক أل এর মাধ্যমে বিশেষ্যপদ নির্দিষ্ট হওয়া। হোক তা একবচন বা বহুবচন। যেমন: আল্লাহর বাণী:

وَخُلِقَ الْإِنْسَانُ ضَعِيفاً

মানুষকে দুর্বল করে সৃষ্টি করা হয়েছে (সূরা নিসা ৪:২৮)।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَإِذَا بَلَغَ الْأَطْفَالُ مِنْكُمُ الْحُلُمَ فَلْيَسْتَأْذِنُوا كَمَا اسْتَأْذَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِم

তোমাদের সন্তান-সন্ততিরা বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তারাও যেন তাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় অনুমতি প্রার্থনা করে (সূরা আন-নূর ২৪:৫৯)।কোন বিষয়ে বক্তা ও শ্রোতার অবগত হওয়া অনুসারে أل العهدية দ্বারা মা‘রেফা বা নির্দিষ্ট হয়। যদি তাদের জ্ঞাত বিষয়টি عام হয় তাহলে এ أل দ্বারা মা‘রেফা বা নির্দিষ্ট শব্দটি عام হবে। আর শব্দের জ্ঞাত বিষয়টি خاصًّ হলে أل দ্বারা নির্দিষ্ট বিশেষ্য পদটিও خاصًّ হবে।[1]

[1]. ال তিন প্রকার। العهدية -الجنسية- الاستغراقية এর মধ্যে শুধুমাত্র ال الاستغراقية - عام এর ফায়দা দেয়। এই ال চেনার উপায় হলো: ال এর স্থলে كل শব্দ ব্যবহৃত করা শুদ্ধ হবে। যেমন: আয়াতের الانسان শব্দটির ال হলো الاستغراقية । কাজেই উক্ত ال এর স্থলে كل শব্দ ব্যবহার করলেও অর্থের কোন পরিবর্তন হবে না। আবার অন্য ভাবেও এটাকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

যেমন: ১. ذكري -যেখানে উদ্দেশ্যপুর্ণ বিষয়টি পূর্বে উল্লেখ করা থাকে। যেমন: فعصى فرعون الرسول -আয়াতে الرسول দ্বারা উদ্দেশ্য মুসা আ: যার উলে­খ পূর্বে করা হয়েছে।

২.حضوري -উদ্দেশ্যপূর্ণ বিষয়টি উপস্থিত থাকে। যেমন বলা: أكرم الرجل

৩. ذهني -উদ্দেশ্যপূর্ণ জিনিস বক্তা ও শ্রোতার মস্তিস্কে থাকে। যেমন: তুমি বলবে, قال الامام এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ইমাম আহমাদ।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَراً مِنْ طِينٍ) [صّ:71]

স্মরণ করো, তোমার প্রতিপালক ফিরিস্তাদেরকে বলেছিলেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি কাদা মাটি থেকে (সূরা ছব ৩৮:৭১)।

তিনি আরোও বলেন,

فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ

যখন আমি তাকে সুষম করবো এবং তাতে আমার রূহ ফুঁকে দিবো, তখন তোমরা তার প্রতি সিজদানাবত হও (সূরা ছব ৩৮:৭২)।

فَسَجَدَ الْمَلائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ

তখন ফিরিস্তারা সকলেই সিজাদানাবত হলো (সূরা ছব ৩৮:৭৩)।[1]

خاصًّ এর উদাহরণ: আল্লাহর বাণী:

كَمَا أَرْسَلْنَا إِلَى فِرْعَوْنَ رَسُولاً

যেমন পাঠিয়েছিলাম ফিরআউনের নিকট (সূরা মুযাম্মিল ৭৩:১৫)।

فَعَصَى فِرْعَوْنُ الرَّسُولَ فَأَخَذْنَاهُ أَخْذاً وَبِيلاً

ফিরআউন সেই রসূলকে অমান্য করেছিল, ফলে আমি তাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলাম (সূরা মুযযাম্মিল ৭৩:১৫)।

جنس বা জাতিবাচক أل দ্বারা বিশেষ্যপদ মা‘রেফা বা নির্দিষ্ট হলে ঐ পদটি তার সকল একককে অন্তর্ভূক্ত করে না। অতএব, যখন তুমি বলো, নারী অপেক্ষা পুরুষ উত্তম। এ কথার দ্বারা এটা উদ্দেশ্যে নয় যে, প্রত্যেক পুরুষলোক প্রত্যেক নারী থেকে উত্তম। বরং উদ্দেশ্যে হলো নারী জাতি থেকে পুরুষ জাতি উত্তম। যদিও কতিপয় নারী পুরুষ থেকে উত্তম।

[1].আয়াতের দ্বিতীয় الْمَلَائِكَةُ এর ال হলো العهدية ,এর দ্বারা الاستغراق বা عام এর অর্থ উদ্দেশ্য হবে। কেননা, প্রথম الْمَلَائِكَةُ এর ال হলো الاستغراقية
ব্যাপক অর্থবোধক শব্দানুসারে আমল করা

(العمل بالعام) অর্থাৎ ব্যাপক অর্থবোধক শব্দানুসারে আমল করা।

عام শব্দের ব্যাপক অর্থ অনুযায়ী আমল করা আবশ্যক যতক্ষণ না তার নির্দিষ্টতা প্রমাণ হয়। আল-কুরআন ও হাদীছের নছ-মূল রচনার মর্মার্থের দাবী অনুসারে আমল করা ওয়াজীব। যতক্ষণ না তার বিপরীতে কোন দলীল পাওয়া যায়।

عام নির্দিষ্ট কারণের প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হলে তার ব্যাপকতা অনুসারে আমল করা ওয়াজীব। কেননা, শব্দের ব্যাপকতাই ধর্তব্য, নির্দিষ্ট কারণ ধর্তব্য নয়। তবে কোন দলীলের মাধ্যমে যদি عام নির্দিষ্টতার অর্থ দেয়, যা ঐ কারণের অবস্থার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, যে কারণের প্রেক্ষিতে আম বর্ণিত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে عام তার সাদৃশ্য পূর্ণ বিষয়ের সাথে খাছ-নির্দিষ্ট হবে।

عام কে খাছ-নির্দিষ্টকারী দলীল নেই এমন উদাহরণ হলো: যিহারের আয়াত সমূহ। কেননা, আউস বিন ছামিত (রা.) এর যিহার করার কারণে আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়। অতএব, যিহারের হুকুম আউস বিন ছামিতসহ সকলের ক্ষেত্রে ব্যাপক অর্থ প্রযোজ্য হবে। عام কে খাছ-নির্দিষ্ট করার উদাহরণ: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী:

ليس من البر الصيام في السفر

সফরে ছিয়াম পালন করা পূণ্যের কাজ নয়।[1]

এ হাদীছটি বর্ণিত হওয়ার কারণ হলো, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন এক সফরে ছিলেন। অতঃপর তিনি মানুষের সমাবেশ লক্ষ্য করলেন, সেখানে এক ব্যক্তিকে ছায়া দেয়া হচ্ছিল, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কি হচ্ছে? ছাহাবীরা বললেন, তিনি ছিয়াম রেখেছেন। এমতবস্থায় তিনি বললেন, সফরে ছিয়াম পালন করা পূণ্যের কাজ নয়।

عام ঐ ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট, যার অবস্থা এ ব্যক্তির অবস্থার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। আর তা হলো সফরে ছিয়াম পালন করা কষ্টকর। উক্ত عام কে এভাবে খাছ করার দলীল হলো সফর কষ্টকর না হলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে ছিয়াম রাখতেন। আর পূণ্যহীন কাজ তিনি কখনোই পালন করতেন না।

[1]. ছহীহ বুখারী ১৯৪৬।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৪ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে