তাকদীর সম্পর্কে আসল কথা হলো, এটি সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে আল্লাহর একটি গোপন বিষয়; যা নৈকট্যপ্রাপ্ত কোনো ফেরেশতা কিংবা প্রেরিত কোনো নাবীও অবহিত নন। এ সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা অথবা অনুরূপ আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া ব্যর্থ হওয়ার কারণ, বঞ্চনার সিঁড়ি এবং সীমালংঘনের স্তর। অতএব সাবধান! এ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা এবং কুমন্ত্রণা হতে সতর্ক থাকুন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তাকদীর সম্পর্কিত জ্ঞান তার সৃষ্টিকুল থেকে গোপন রেখেছেন এবং তাদেরকে এর উদ্দেশ্যে অনুসন্ধান করতে নিষেধ করেছেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ ‘তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হবে না; বরং তারা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সূরা আম্বিয়া: ২৩) অতএব, যে ব্যক্তি একথা জিজ্ঞাসা করবে তিনি কেন এ কাজ করলেন? সে আল্লাহর কিতাবের হুকুম অমান্য করল। আর যে ব্যক্তি কিতাবের হুকুম অমান্য করল, সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

"وَأَصْلُ الْقَدَرِ سِرُّ اللَّهِ تَعَالَى فِي خَلْقِهِ، لَمْ يَطَّلِعْ عَلَى ذَلِكَ مَلَكٌ مُقَرَّبٌ، وَلَا نَبِيٌّ مُرْسَلٌ، وَالتَّعَمُّقُ وَالنَّظَرُ فِي ذَلِكَ ذَرِيعَةُ الْخِذْلَانِ، وَسُلَّمُ الْحِرْمَانِ، وَدَرَجَةُ الطُّغْيَانِ، فَالْحَذَرَ كُلَّ الْحَذَرِ مِنْ ذَلِكَ نَظَرًا وَفِكْرًا وَوَسْوَسَةً، فَإِنَّ اللَّهَ تَعَالَى طَوَى عِلْمَ الْقَدَرِ عَنْ أَنَامِهِ، وَنَهَاهُمْ عَنْ مَرَامِهِ، كَمَا قَالَ تَعَالَى فِي كِتَابِهِ: (لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ) [الْأَنْبِيَاءِ: 23]. فَمَنْ سَأَلَ: لِمَ فَعَلَ؟ فَقَدْ رَدَّ حُكْمَ الْكِتَابِ، وَمَنْ رَدَّ حُكْمَ الْكِتَابِ، كَانَ مِنَ الْكَافِرِينَ"

তাকদীর সম্পর্কে আসল কথা হলো, এটি সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে আল্লাহর একটি গোপন বিষয়; যা নৈকট্যপ্রাপ্ত কোনো ফেরেশতা কিংবা প্রেরিত কোনো নাবীও অবহিত নন। এ সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা অথবা অনুরূপ আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া ব্যর্থ হওয়ার কারণ, বঞ্চনার সিঁড়ি এবং সীমালংঘনের স্তর। অতএব সাবধান! এ সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা এবং কুমন্ত্রণা হতে সতর্ক থাকুন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা তাকদীর সম্পর্কিত জ্ঞান তার সৃষ্টিকুল থেকে গোপন রেখেছেন এবং তাদেরকে এর উদ্দেশ্যে অনুসন্ধান করতে নিষেধ করেছেন। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَا يُسْأَلُ عَمَّا يَفْعَلُ وَهُمْ يُسْأَلُونَ ‘‘তিনি যা করেন সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হবে না; বরং তারা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সূরা আম্বিয়া: ২৩) অতএব, যে ব্যক্তি একথা জিজ্ঞাসা করবে তিনি কেন এ কাজ করলেন? সে আল্লাহর কিতাবের হুকুম অমান্য করল। আর যে ব্যক্তি কিতাবের হুকুম অমান্য করল, সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হলো।

...................................................

ব্যাখ্যা: তাকদীর সম্পর্কে আসল কথা হলো, এটি সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে আল্লাহর একটি বিষয়। অর্থাৎ তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই ধ্বংস করেন, তিনিই কাউকে ফকীর বানান, তিনিই ধনী বানান, তিনিই মৃত্যু দান করেন, তিনিই জীবন দান করেন, তিনিই গোমরাহ করেন এবং তিনিই হেদায়াত দান করেন। আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাকদীর হলো আল্লাহর গোপন রহস্য। সুতরাং আমরা এটি উন্মুক্ত করার চেষ্টা করবো না। এ মাস‘আলা সম্পর্কে মানুষের মতভেদ খুবই প্রসিদ্ধ।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতে সবকিছুই আল্লাহর ফায়ছালা ও নির্ধারণ অনুপাতেই হয়ে থাকে। আল্লাহ তা‘আলাই বান্দার কর্মের স্রষ্টা।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ‘‘প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ’’। (সূরা কামার: ৪৯)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا ‘‘এবং তিনি প্রত্যেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তার একটি তাকদীর বা পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন’’। (সূরা ফুরকান: ২)

কাফের যেই কুফুরী করে তা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাতেই হয়; কিন্তু তিনি কুফুরীকে পছন্দ করেন না। তিনি সৃষ্টিগত দিক থেকে কুফুরী সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেন। কিন্তু দ্বীন হিসাবে পছন্দ করেন না।

কাদারীয়া ও মুতাযেলা সম্প্রদায়ের লোকেরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের বিরোধিতা করেছে।[1] তারা ধারণা করে যে, আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদের থেকে ঈমান সংঘটিত হওয়ার ইচ্ছা করেন। কিন্তু কাফের কুফুরীর ইচ্ছা করে। তারা এমন ধারণা থেকে বাঁচার জন্য এ কথা বলেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা কুফুরী সৃষ্টির ইচ্ছা করেছেন এবং কুফুরী করার কারণেই শাস্তি দিয়ে থাকেন। আসলে তাদের অবস্থা হলো ঐ লোকের মতো যে উত্তপ্ত বালুর উপর দাড়িয়ে থাকার কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য আগুনে ঝাপ দিয়েছে। কেননা তারা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর জিনিস থেকে পালিয়ে এসে তার চেয়ে বেশী ক্ষতিকর জিনিসের মধ্যে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ যদি বলা হয়, আল্লাহ তা‘আলা বান্দার কর্মের স্রষ্টা, আর বান্দার কর্মের মধ্যে যেহেতু ভালো-মন্দ উভয়ই রয়েছে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলার দিকে মন্দের সম্বন্ধ হয়ে যায়। এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তারা বলেছে বান্দার কর্ম বান্দা নিজেই সৃষ্টি করে। এখন যেই সমস্যাটি হলো, তাদের পূর্বেরটির চেয়ে আরো বেশী ভয়াবহ। এতে করে আল্লাহর ইচ্ছার উপর কাফেরের ইচ্ছা জয়লাভ করা আবশ্যক হয়।

অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা ইচ্ছা করেছেন যে, কাফের ঈমান আনয়ন করুক। এ ক্ষেত্রে কাফের যদি ঈমান না আনে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায় যে, আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর কাফেরের ইচ্ছা জয়লাভ করেছে। নাউযুবিল্লাহ। কেননা তাদের মতেও আল্লাহ তা‘আলা কাফের থেকে ঈমান সংঘটিত হওয়ার ইচ্ছা করেছেন। আর কাফের কুফুরী করার ইচ্ছা করেছে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা বাস্তবায়ন না হয়ে কাফেরের ইচ্ছাই বাস্তবায়ন হয়েছে!! সে সঙ্গে এরূপ বিশ্বাস থেকে একাধিক স্রষ্টাও সাব্যস্ত হয়ে যায়!! এ আক্বীদাহ হচ্ছে সর্বাধিক নিকৃষ্ট আক্বীদাহ। এ কথার উপর কোনো দলীল নেই। বরং এটি কুরআন ও হাদীছের দলীলের সুস্পষ্ট বিপরীত।

বাকীয়া ইবনুল ওয়ালীদ রহিমাহুল্লাহর হাদীছ থেকে ইমাম আওযাঈর সনদে লালাকায়ী বর্ণনা করেন যে, আমাদের কাছে আলা ইবনুল হাজ্জাজ বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন মুহাম্মাদ বিন উবাইদ আল-মক্কী, তিনি বর্ণনা করেছেন আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আমাদের কাছে একজন লোক এসেছে, যে তাকদীরকে অস্বীকার করে। জবাবে তিনি বললেন, আমাকে দেখিয়ে দাও। তখন তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তারা বললো, আপনি তাকে কী করবেন। ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, সেই সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে। আমি যদি সক্ষম হই, তাহলে আমি তার নাক কেটে ফেলবো। আমি যদি তার ঘাড় ধরতে পারি, তাহলে তার ঘাড় মটকিয়ে ফেলবো। কেননা আমি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,

كَأَنِّي بِنِسَاءِ بَنِي فِهْرٍ يَطُفْنَ بِالْخَزْرَجِ تَصْطَفِقُ أَلْيَاتُهُنَّ مُشْرِكَاتٍ

‘‘আমি যেন বনী ফিহিরের মহিলাদেরকে দেখছি, তারা মুশরিক অবস্থায় তাদের নিতম্ব নাড়াতে নাড়াতে খাযরাজ গোত্রে বিচরণ করছে’’।

তারা এমনভাবে কোমড় নাড়াচ্ছে, যাতে তাদের একজনের নিতম্ব অন্যজনের নিতম্বে লেগে যাচ্ছে। এ হচ্ছে দ্বীন ইসলামের মধ্যে প্রথম শির্ক। আল্লাহর শপথ! তাদের এ নিকৃষ্ট মতবাদ তাদেরকে এ পর্যন্ত নিয়ে ঠেকাবে যে, তারা বলবে আল্লাহ তা‘আলা কল্যাণকর বিষয়গুলো সৃষ্টি করেননি, যেমন তারা আল্লাহ তা‘আলাকে মন্দের স্রষ্টা মনে করেনি’’।[2]

গ্রন্থকারের কথা, এ হচ্ছে দ্বীন ইসলামের মধ্যে প্রথম শির্ক, এখান থেকে শেষ পর্যন্ত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর বক্তব্য।

তাকদীরে বিশ্বাস করা তাওহীদের প্রতি বিশ্বাসকে সুশৃঙ্খল করে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার একত্বে বিশ্বাস করবে, কিন্তু তাকদীরে অবিশ্বাস করবে তার এ মিথ্যারোপ তাওহীদকে ত্রুটিযুক্ত করে।[3] আমর বিন হায়ছাম বলেন, আমরা একদা নৌকায় আরোহন করলাম। নৌকাতে আমাদের সাথে একজন অগ্নিপূজক এবং একজন তাকদীরে অবিশ্বাসী মুসলিম ছিল। তাকদীরে অবিশ্বাসী লোকটি অগ্নিপূজককে বলল, ইসলাম কবুল করো। অগ্নিপূজক বলল, আল্লাহ তা‘আলা চাইলে ইসলাম গ্রহণ করবো। তাকদীরে অবিশ্বাসী মুসলিম বলল, আল্লাহ তা‘আলা তো চায় যে তুমি মুসলিম হয়ে যাও। কিন্তু শয়তান তা চায় না। অগ্নিপূজক বলল, তোমার কথা থেকে বুঝা যাচ্ছে, আল্লাহ চান আমি মুসলিম হয়ে যাই, কিন্তু শয়তান তা চায় না। তাহলে তো শয়তানের ইচ্ছাই জয়লাভ করেছে। তাহলে তো দেখা যাচ্ছে শয়তানই আল্লাহর চেয়ে বেশী শক্তিশালী! আমি অধিক শক্তিশালীর সাথেই থাকবো। নাউযুবিল্লাহ

আসল কথা হলো কাদারীয়া বা মুতাযেলারা বান্দার কর্মে বান্দাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন মনে করে। ভালো-মন্দ সবকিছু যে আল্লাহর ইচ্ছাতে হয়, তাতে তারা বিশ্বাস করে না। তারা মনে করে মন্দ কাজগুলো আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি নয়। এগুলো বান্দা নিজেই সৃষ্টি ও সম্পাদন করে। তাই তাদের মতে বান্দার কুফুরীতে আল্লাহর কোনো ইচ্ছা থাকে না। আল্লাহ তা‘আলা কাফের থেকে ঈমানের ইচ্ছা করলেও কাফের না চাইলে কাফেরের ইচ্ছাই জয়লাভ করে।

বর্ণিত আছে যে, তাকদীরে অবিশ্বাসী মুতাযেলী ইমাম আমর বিন উবাইদ একদা ছাত্রদেরকে পড়াচ্ছিল। তখন একজন গ্রাম্য লোক এসে বলল, হে লোক সকল! আমার উট চুরি হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে আপনারা দুআ করুন, তিনি যেন আমার উটটি আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। আমর বিন উবাইদ তখন বলল, হে আল্লাহ! তুমি চাওনি যে, তার উট চুরি হোক। তারপরও চুরি হয়েছে। এখন তুমি তার উটটি ফিরিয়ে দাও। এতে গ্রাম্য লোকটি বলল, আমার জন্য তোমার দু‘আর কোনো প্রয়োজন নেই। আমর বিন উবাইদ বলল, কেন? আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আল্লাহর ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও যেহেতু চুরি হয়েছে, তাই এখন তিনি ফিরিয়ে দিতে চাইলেও সম্ভবত ফিরিয়ে দিতে পারবেন না!!

জনৈক ব্যক্তি আবু ইসাম কুস্ত্তল্লানিকে বলল, আল্লাহ তা‘আলা যদি আমাকে হেদায়াত থেকে বঞ্চিত করে গোমরাহিতে নিক্ষেপ করেন, অতঃপর শাস্তি দেন, তাহলে আপনার অভিমত কী? এরপরও কি আল্লাহ তা‘আলা ইনসাফকারী হবেন? আবু ইসাম এতে বললেন, হেদায়াতের মালিক যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা, তাই তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করবেন। যাকে ইচ্ছা তা থেকে বঞ্চিত করবেন।

আর কুরআন ও সুন্নাহর একাধিক দলীল প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা সবকিছুর তাকদীর নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَوْ شِئْنَا لَآتَيْنَا كُلَّ نَفْسٍ هُدَاهَا وَلَٰكِنْ حَقَّ الْقَوْلُ مِنِّي لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ

‘‘আমি যদি চাইতাম তাহলে পূর্বাহ্নেই প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার হেদায়াত দিয়ে দিতাম। কিন্তু আমার সে কথা পূর্ণ হয়ে গেছে, যা আমি বলেছি যে, আমি জাহান্নাম জিন ও মানুষ দিয়ে ভরে দেবো’’। (সূরা সাজদা: ১৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَآمَنَ مَن فِي الْأَرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا أَفَأَنتَ تُكْرِهُ النَّاسَ حَتَّىٰ يَكُونُوا مُؤْمِنِينَ

‘‘যদি তোমার রবের ইচ্ছা হতো তাহলে সারা দুনিয়াবাসী ঈমান আনতো। তবে কি তুমি মুমিন হবার জন্য লোকদের উপর জবরদস্তি করবে?’’। (সূরা ইউনুস: ৯৯)

আল্লাহ তা‘আলা সূরা তাকবীরের ২৯ নং আয়াতে বলেন,

وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

‘‘তোমরা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছার বাইরে কিছুই ইচ্ছা করতে পারো না’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা দাহারের ৩০ নং আয়াতে বলেন,

وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلِيمًا حَكِيمًا

‘‘তোমাদের চাওয়ায় কিছুই হয় না যদি আল্লাহ না চান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাবান’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আনআমের ৩৯ নং আয়াতে বলেন,

مَن يَشَإِ اللَّهُ يُضْلِلْهُ وَمَن يَشَأْ يَجْعَلْهُ عَلَىٰ صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

‘‘আল্লাহ যাকে চান বিপথগামী করেন আবার যাকে চান সত্য সরল পথে পরিচালিত করেন’’।

আল্লাহ তা‘আলা সূরা আনআমের ১২৫ নং আয়াতে বলেন,

فَمَن يُرِدِ اللَّهُ أَن يَهْدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلْإِسْلَامِ وَمَن يُرِدْ أَن يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا كَأَنَّمَا يَصَّعَّدُ فِي السَّمَاءِ كَذَٰلِكَ يَجْعَلُ اللَّهُ الرِّجْسَ عَلَى الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ

‘‘আল্লাহ যাকে সত্যপথ দেখাবার ইচ্ছা করেন তার বক্ষদেশ ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। আর যাকে তিনি গোমরাহীতে নিক্ষেপ করার ইচ্ছা করেন, তার বক্ষদেশ খুব সংকীর্ণ করে দেন। যাতে মনে হয় সে কষ্ট করে আকাশের দিকে উঠার চেষ্টা করছে’’।

অর্থাৎ জোর খাটিয়ে যেমন আকাশের দিকে উঠা সম্ভব নয়, ঠিক তেমনি আল্লাহ যার বক্ষকে সংকীর্ণ করে দেন তার মধ্যে ঈমান ও তাওহীদের আলো ঢুকানো সম্ভব হয়না। আল্লাহ তা‘আলা তার বক্ষকে ইসলামের জন্য খুলে না দেয়া পর্যন্ত তাতে ঈমান ও তাওহীদ প্রবেশ করে না। এমনিভাবে আল্লাহ তা‘আলা অবিশ্বাসীদের উপর অপবিত্রতা চাপিয়ে দেন’’।

যারা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা এবং ভালোবাসা ও পছন্দকে একই রকম মনে করে, তাদের থেকেই মূলতঃ গোমরাহির উৎপত্তি হয়েছে। জাবরীয়া ও মুতাযেলারা প্রথমত আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও ভালোবাসাকে এক সমান মনে করেছে। অতঃপর জাবরীয়ারা মুতাযেলাদের থেকে আলাদা হয়ে বলেছে, সৃষ্টিজগতের সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলার ফায়ছালা ও নির্ধারণ অনুযায়ী হয়ে থাকে। সুতরাং সৃষ্টিজগতে যা কিছু হয়, সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা ও পছন্দ অনুপাতেই হয়ে থাকে।[4]

আর তাকদীরে অবিশ্বাসী কাদারীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা বলেছে, আল্লাহ তা‘আলার কাছে পাপাচার প্রিয় নয়। তিনি তা পছন্দও করেন না। সুতরাং তিনি তা সৃষ্টি, নির্ধারণ ও পছন্দ করেননি। পাপাচার তার ইচ্ছা ও সৃষ্টির বাইরে।

কুরআন ও সুন্নাহর বহু দলীল-প্রমাণ এবং মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা সম্পর্কিত কিছু দলীল ইতিপূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। এ পর্যায়ে আমরা আল্লাহ তা‘আলার ভালোবাসা সম্পর্কে কিছু দলীল উল্লেখ করবো।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الْفَسَادَ ‘‘আল্লাহ বিপর্যয় মোটেই পছন্দ করেন না’’। (সূরা আল বাকারা: ২০৫)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, وَلَا يَرْضَىٰ لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ ‘‘কিন্তু তিনি তার বান্দার জন্য কুফুরী পছন্দ করেন না’’। (সূরা যুমার: ৭)

আল্লাহ তা‘আলা শির্ক, যুলুম, অশ্লীলতা, অহঙ্কার এবং অন্যান্য পাপাচার থেকে নিষেধ করার পর বলেন, كُلُّ ذَلِكَ كَانَ سيِّئُهُ عِنْدَ رَبِّكَ مَكْرُوْهًا

‘‘এ বিষয়গুলোর মধ্য থেকে প্রত্যেকটির খারাপ দিক তোমার রবের কাছে অপছন্দনীয়’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৩৮)

ছহীহ বুখারীতে নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে,

«إِنَّ اللَّهَ كره لَكُمْ ثلاثا قِيلَ وَقَالَ وَكَثْرَةَ السُّؤَالِ وَإِضَاعَةَ الْمَالِ»

‘‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য তিনটি বিষয় অপছন্দ করেছেন। তোমাদের জন্য অর্থহীন কথা বলা, বেশী বেশী প্রশ্ন করা এবং ধন-সম্পদ নষ্ট করা অপছন্দ করেছেন’’।[5]

মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ أَنْ يُؤْخَذَ بِرُخَصِهِ، كَمَا يَكْرَهُ أَنْ تُؤْتَى مَعْصِيَتُهُ

আল্লাহ যেসব কাজের অনুমতি দিয়েছেন, তা গ্রহণ করাকে পছন্দ করেন। আর তিনি অপছন্দ করেন পাপাচারে লিপ্ত হওয়াকে।[6] নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু‘আতে বলেছেন,

«أللهم إني أَعُوذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ وَأَعُوذُ بِمُعَافَاتِكَ مِنْ عُقُوبَتِكَ وأعوذبك منك»

‘‘হে আল্লাহ! তোমার সন্তুষ্টির উসীলায় তোমার ক্রোধ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তোমার ক্ষমার উসীলায় তোমার শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং তোমার আযাব থেকে তোমার কাছেই আশ্রয় চাচ্ছি।[7]

প্রিয় পাঠক! আপনি লক্ষ্য করুন! নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি সিফাতের মাধ্যমে তার ক্রোধ থেকে এবং তার ক্ষমা করে দেয়া সিফাতের মাধ্যমে শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। উপরোক্ত সিফাতগুলোর মধ্যে সন্তুষ্টি নামক সিফাতটির প্রভাব হলো ক্ষমা এবং ক্রোধ নামক সিফাতটির প্রভাব হলো শাস্তি দেয়া। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এখানে আল্লাহ তা‘আলার এক সিফাতের উসীলায় অন্য সিফাত থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করা হয়েছে। প্রথমটি হলো মূল সিফাত আর দ্বিতীয়টি হলো তার প্রভাব। দু‘আটির শেষে সবগুলো সিফাতকেই আল্লাহ তা‘আলার সত্তার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। মূলতঃ সবকিছুই একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে।

হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। আমি যা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তা তোমার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে এবং তোমার যেই সন্তুষ্টি ও ক্ষমার উসীলায় তোমার অসন্তুষ্টি ও শাস্তি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তাও তোমার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। তুমি যদি ইচ্ছা করো, তাহলে তোমার বান্দার উপর সন্তুষ্ট হবে এবং তাকে ক্ষমা করে দিবে। আর ইচ্ছা করলে তুমি তার উপর ক্রোধান্বিত হবে এবং তাকে শাস্তি দিবে।

সুতরাং আমি যা অপছন্দ করি, তা থেকে আমার আশ্রয় প্রার্থনা এবং উহা আমার উপর আপতিত হওয়াতে বাধা প্রদান করাও তোমার ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। প্রিয়-অপ্রিয় সবই তোমার ফায়ছালা ও ইচ্ছাতেই হয়ে থাকে। তোমার শাস্তি থেকে তোমার কাছেই আমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি, তোমার শক্তি, ক্ষমতা ও রহমতের উসীলায় ঐ বিপদাপদ, অকল্যাণ ও ক্ষতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যা তোমার শক্তি, ইনসাফ ও হিকমতের কারণে হয়ে থাকে।তুমি ব্যতীত অন্য কারো ক্ষতি থেকে অন্যের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি না এবং তোমার কাছে এমন কোনো ক্ষতি থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি না, যা তোমার অনিচ্ছায় প্রকাশিত হয়। বরং তা তোমার নিকট থেকেই আগমন করে। উপরোক্ত কথাগুলোতে তাওহীদের যে পরিমাণ মারেফত এবং আল্লাহ তা‘আলার উবুদীয়াত রয়েছে, তা কেবল আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী, তার মারেফত এবং প্রকৃত উবুদীয়াত সম্পর্কে অবগত আলেমগণ ব্যতীত অন্য কেউ জানে না।

[1]. ছাহাবীদের যুগের পর থেকেই এ মাস‘আলায় মতভেদ শুরু হয়েছে। তারা সকলেই তাকদীরে বিশ্বাসী ছিলেন। তাদের যুগে এ মাসআলাতে কোনো দ্বিমত ছিল না। তাদের যুগের একদম শেষপ্রামেত্ম এ মাস‘আলায় মতভেদ শুরু হয়। তখন কেবল আব্দুল্লাহ ইবনে উমার এবং ইবনে আববাসসহ মাত্র কয়েকজন ছাহাবী জীবিত ছিলেন। তারাও তাকদীর অস্বীকার কারীদের কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। এ মাস‘আলায় মতভেদ করা থেকেই উম্মতের মধ্যে শির্কের সূত্রপাত ঘটেছে।

[2]. হাদীছটি যঈফ। দেখুন ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহর টিকাসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২৪৪।

[3]. যঈফ।

[4]. তাদের এ কথা সম্পূর্ণ বাতিল। সৃষ্টিজগতে যা কিছু হয়, সবই আল্লাহর পছন্দ অনুপাতে হয় না। আল্লাহ তা‘আলা পাপাচার সৃষ্টি করেছেন এবং তা হতে নিষেধ করেছেন। পাপাচারী থেকে যে পাপাচার সংঘটিত হয়, তাও আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়; কিন্তু তিনি উহাকে পছন্দ করেন না। পক্ষান্তরে তিনি আনুগত্যের কাজসমূহ সৃষ্টি করেছেন এবং বান্দাদেরকে তা বাস্তবায়ন করার হুকুম করেছেন। আনুগত্যের কাজ বাস্তবায়ন হওয়াকে তিনি পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন।

[5]. ছহীহ বুখারী হা/১৪৭৭, ছহীহ মুসলিম হা/৫৯৩।

[6]. ছহীহ: মুসনাদে আহমাদ হা/৫৮৬৬।

[7]. ছহীহ: আবূ দাউদ ১৪২৭।
ক্ষতিকর ও অপছন্দনীয় জিনিস সৃষ্টি করার তাৎপর্য বা হেকমত - ১

এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে এমন জিনিসের ইচ্ছা করেন যা তিনি পছন্দ করেন না ও ভালোবাসেন না? তিনি কিভাবে এর ইচ্ছা করেন ও তৈরি করেন? কিভাবে তিনি একই সাথে তার ইচ্ছা করেন এবং ঘৃণা করেন।

এ প্রশ্ন থেকেই উম্মত বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে। এ থেকেই তাদের মত ও পথ বিভিন্ন হয়েছে। এ জাতিয় প্রশ্নের জবাবে ইমাম ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা করেন, তা দুই প্রকার।

(১) যা মূলগত দিক থেকেই আল্লাহ তা‘আলা যা ইচ্ছা করেছেন। যেমন ঈমান ও আনুগত্যের কাজগুলো তিনি মূলগত দিক থেকেই পছন্দ করে সৃষ্টি করেছেন। মুমিনদের থেকে তিনি চেয়েছেন যে, তারা এগুলো বাস্তবায়ন করুক।

(২) যা মূলগত দিক থেকে ইচ্ছা করেননি: বরং অন্য কারণে ইচ্ছা করেছেন। যেমন তিনি পাপাচারকেও সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন, কিন্তু মূলগত দিক থেকে এগুলোকে ভালোবেসে সৃষ্টি করেননি। বরং অন্য একটি উদ্দেশ্যে তথা বান্দাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য সৃষ্টি করেছেন।

যা তিনি মূলগত দিক থেকে ইচ্ছা করেছেন এবং তাতে যেই কল্যাণ রয়েছে তা মূলতই প্রিয়।[1] তাকে দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা সরাসরি স্বীয় উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন। আর যা অন্য কারণে ইচ্ছা করেছেন, তা দ্বারা তিনি সরাসরি উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেন না। তার ব্যক্তিসত্তার দিকে তাকালে তাতে কোনো কল্যাণও দেখা যায়না। তবে এ কথা সঠিক যে ইবলীসকে সৃষ্টি করার পিছনে আল্লাহ তা‘আলার অন্য একটি মাকসুদ ও উদ্দেশ্য রয়েছে। সুতরাং ইবলীস তার নফ্স ও সত্তার দিক থেকে নিন্দিত ও ঘৃণীত। কিন্তু বিশেষ একটি হেকমত ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য ইবলীসকে সৃষ্টি করার প্রয়োজন ছিল।

ইবলীস সৃষ্টির মধ্যে দু’টি বিষয় একসাথে মিলিত হয়েছে। তাকে ঘৃণা করা এবং তাকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করা। বিষয় দু’টি পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। কেননা উভয়ের সাথে সম্পৃক্ত ও সংশিস্নষ্ট বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। বিষয়টি ঠিক অরুচিকর ঔষধের ন্যায়। মানুষ যখন জানতে পারে যে, অরুচিকর ঔষধের মধ্যে তার আরোগ্য রয়েছে, তখন সে তিতা লাগলেও তা সেবন করে। কারণ তা পান করার মধ্যে তার স্বার্থ রয়েছে।

ঠিক এমনি মানুষের শরীরের কোনো অঙ্গে যখন পচন ধরে, তখন সে যদি জানতে পারে যে, উহা কেটে ফেলে দেয়ার মধ্যেই তার কল্যাণ রয়েছে, তাহলে অপছন্দ হলেও সে শরীরের অঙ্গ কেটে ফেলে। কেননা সে বুঝতে পেরেছে যে, অঙ্গটি কেটে ফেলাই শরীরের বাকী অংশের জন্য নিরাপদ। মুসাফির যখন জানতে পারে যে, দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার মধ্যে তার কল্যাণ রয়েছে এবং তা অতিক্রম করার মাধ্যমে সে প্রিয় বস্তু লাভ করতে পারবে, তখন কষ্ট লাগলেও বহু দূরের পথ ভ্রমণ করে।[2] প্রতিটি বুদ্ধিমান মানুষই এ অপছন্দনীয় কাজগুলো করার ইচ্ছা করে এবং প্রবল ধারণা রাখে যে, এতে তার কল্যাণ রয়েছে। যদিও তার কাছে অনেক ক্ষেত্রে পরিণাম অস্পষ্ট থাকে।

সুতরাং যেই মহান সত্তার কাছে কোনো কিছুই অস্পষ্ট নয়, তিনি এমন অপছন্দনীয় বস্তু সৃষ্টি করবেন না কেন, যার পরিণাম ভালো হয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা কোনো জিনিসকে অপছন্দ করেন। এ অপছন্দ করা উহাকে অন্য একটি উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করার পরিপন্থি নয়। কেননা উহা সৃষ্টি করার মাধ্যমে এমন একটি প্রিয় জিনিস হাসিল হয়, যা উহা সৃষ্টি না হলে হত না। উদাহরণ স্বরূপ ইবলীস সৃষ্টি করার বিষয়টি পেশ করা যেতে পারে। এ ইবলীসই মানুষের দ্বীন, আমল, আক্বীদাহ এবং সৎ ইচ্ছা ধ্বংসের মূল কারণ। সে অনেক বনী আদমের দুর্ভাগ্যের কারণে পরিণত হয়েছে। এ ইবলীসের কারণেই মানুষ এমন অপকর্মে লিপ্ত হয়, যাতে তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ক্রোধের শিকার হয়। ইবলীস আল্লাহর পছন্দনীয় ও প্রিয় আমলগুলোর বিপরীত কর্মকান্ড সংঘটিত হওয়ার কারণ। এত কিছু সত্ত্বেও তাকে সৃষ্টি করার কারণে আল্লাহ তা‘আলার অনেক প্রিয় জিনিস অর্জিত হয়। সুতরাং ইবলীস না থাকার চেয়ে থাকাই ভালো।

(১) পরস্পর বিপরীতমুখী জিনিস সৃষ্টি করে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের নিকট স্বীয় কুদরত প্রকাশ করেছেন। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা এ নিকৃষ্টতম অপদার্থটি সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেক পাপাচারের মূল কারণ হলো এ শয়তান। আল্লাহ তা‘আলা তাকে জিবরীলের বিপরীতে সৃষ্টি করেছেন। জিবরীল হলেন সৃষ্টিকূলের সকল প্রকার কল্যাণের মাধ্যম।[3]

সকল কল্যাণের মূলেই রয়েছেন তিনি। আসমান থেকে তিনিই সমস্ত নাবী-রাসূলের নিকট অহী নিয়ে আগমন করেছেন। সুতরাং মহান আল্লাহ এটি সৃষ্টি করেছেন ঐটিও সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে তার কুদরত প্রকাশিত হয়েছে। যেমন তিনি দিন সৃষ্টি করেছেন। তার বিপরীতে রাত সৃষ্টি করেছেন। তিনি রোগ-ব্যাধি সৃষ্টি করেছেন, তার বিপরীতে চিকিৎসা সৃষ্টি করেছেন। জীবন ও মরণ সৃষ্টি করেছেন, ভালো ও মন্দ সৃষ্টি করেছেন এবং কল্যাণ ও অকল্যাণ সৃষ্টি করেছেন। সমস্ত সৃষ্টিই যদি ভালো হতো, তাহলে বুঝা সম্ভব ছিল না যে, এগুলো ভালো। সুতরাং মন্দের মন্দত্ব অনুভব করা ব্যতীত ভালোর ভালোত্ব বুঝা সম্ভব নয়। তিনি তাওহীদ ও শির্ক সৃষ্টি করেছেন, সুন্নাত ও বিদআত সৃষ্টি করেছেন, আনুগত্য ও পাপাচার সৃষ্টি করেছেন এবং অলী-আওলীয়া ও আল্লাহর দুশমন সৃষ্টি করেছেন, মুত্তাকী ও পাপাচারী সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির এ বৈপরিত্য তার পরিপূর্ণ কুদরত, শক্তি, রাজত্ব এবং ক্ষমতার উৎকৃষ্টতম দলীল। তিনি এ পরস্পর বিপরীতমুখী জিনিসগুলো সৃষ্টি করেছেন। এগুলো থেকে কতকের বিপরীত অন্য কতককে সৃষ্টি করেছেন। এগুলোকে তিনি তার পরিচালনা ও তদবীরের মহল বানিয়েছেন। সুতরাং সৃষ্টিজগত থেকে কিছু সৃষ্টি যদি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা হেকমত ও তার রাজত্বের পরিপূর্ণ পরিচালনা ও পরিচর্যার মধ্যে ত্রুটি দেখা দিবে।

(২) ইবলীস ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার পিছনে আরো যেসব হেকমত রয়েছে, তার মধ্য থেকে আরেকটি হেকমত হলো এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার প্রতাপশালীতা সংক্রান্ত নামগুলোর প্রভাব সৃষ্টির উপর পতিত হয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলার নামগুলোর মধ্যে রয়েছে, القَهَّار (পরাক্রমশালী), المنتقم (প্রতিশোধ গ্রহণকারী), العدل (ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী), الضَّار (ক্ষতিকারক), شديد العقاب (কঠিন শাস্তি প্রদানকারী), سريع العقاب (দ্রুত শাস্তি প্রদানকারী, ذو البطش الشديد (কঠোরভাবে পাকড়াওকারী), الخَافِض (নিচুকারী), المذل (অপদস্তকারী) ইত্যাদি। কেননা আল্লাহ তা‘আলার এ অতি সুন্দর নাম ও কর্মগুলো তার কামালিয়াত তথা পূর্ণতার পরিচায়ক। এমন কিছু সৃষ্টি থাকা প্রয়োজন, যাদের উপর এ সিফাতগুলোর প্রভাব পড়তে পারে। সুতরাং সৃষ্টির মধ্যে যদি এমন কিছু সৃষ্টি না থাকতো, যাদেরকে পরাভুত করা হবে, যাদের হিসাব নেয়া হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে, তাহলে القهار নামের প্রভাব প্রকাশ পেতো না। অনুরূপ অপরাধী না থাকলে ذو البطش الشديد (কঠোরভাবে পাকড়াওকারী) সিফাতের প্রভাব প্রকাশ পেতো না, নীচু হওয়ার যোগ্য কেউ না থাকলেالخَافِض (নিচুকারী) নামের প্রভাব প্রকাশ পেতো না। অপমানিত হওয়ার যোগ্য কেউ না থাকলে المذل (অপদস্তকারী) নামের প্রভাব প্রকাশিত হতো না।[4] অন্যান্য নামের ক্ষেত্রে কথা একই।

(৩) ইবলীস ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার পিছনে আরো যেসব হেকমত রয়েছে, তার মধ্যে আরেকটি হেকমত হলো এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার ঐ সমস্ত নামের প্রভাব বান্দাদের উপর পড়বে, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে তার সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতা এবং তার বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেয়ার অর্থ। তিনি যদি এমন কোনো অপছন্দনীয় কাজ সৃষ্টি না করতেন, যা এ সমস্ত অতি সুন্দর নামগুলোর প্রভাব প্রকাশ হওয়ার কারণ হয়, তাহলে তার নামগুলোর হেকমত ও উপকারীতা অকেজো হয়ে যেত। এ দিকে ইঙ্গিত করেই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«لولم تذنبوا لذهب الله بكم ولجاء بقوم يذنبون ويستغفرون فيغفر لهم»

‘‘তোমরা যদি অপরাধ না করতে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে ধ্বংস করে তোমাদের স্থলে এমন লোক সৃষ্টি করতেন, যারা অপরাধ করার পর তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতো। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন’’।[5]

(৪) ইবলীস ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার পিছনে আরো যেসব হেকমত রয়েছে, তার মধ্য থেকে আরেকটি হেকমত হলো এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা সম্পর্কিত নামসমূহের প্রভাব প্রকাশিত হয়। কেননা তিনি হলেন প্রজ্ঞাবান ও সুবিজ্ঞ। তিনি প্রত্যেক জিনিসকে যথাস্থানে স্থাপন করেন এবং প্রত্যেক জিনিসের জন্য যেই স্থান উপযুক্ত তিনি তাকে সেখানেই রাখেন। তিনি কোনো জিনিসকে তার নির্দিষ্ট স্থানে না রেখে অন্য স্থানে রাখেন না। তার পরিপূর্ণ ইলম, হেকমত ও জ্ঞান যে জিনিস যে স্থানে রাখার দাবি করে, তাকে তিনি সেই স্থান বাদ দিয়ে অন্য স্থানে রাখেন না। তিনি কাকে রসূল বানাবেন তা তিনিই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি আরো অবগত আছেন যে, কে রেসালাত কবুল করার জন্য বেশী উপযোগী এবং কে তা পেয়ে বেশী কৃতজ্ঞ হবে। কে রেসালাতের উপযুক্ত নয়, তিনি তাও জানেন। তিনি যদি অপছন্দনীয় কাজকর্ম সৃষ্টি না করতেন, তাহলে অনেক হেকমত বাতিল হয়ে যেত এবং বহু উপকার ছুটে যেত। মন্দ জিনিসগুলোর মধ্যে যেই ক্ষতি রয়েছে, তার কারণে যদি সৃষ্টি না করা হতো, তাহলে উক্ত জিনিসগুলোর মধ্যে যে পরিমাণ ক্ষতি রয়েছে, তার তুলনায় বহুগুণ বড় উপকার হাত ছাড়া হতো। এটি ঠিক সূর্যের তাপ, বৃষ্টি এবং বাতাসের ক্ষতির মতই। তাতে যে পরিমাণ ক্ষতি রয়েছে, তার তুলনায় উপকার অনেক বেশী।

(৫) ইবলীস ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার পিছনে আরো যেসব হেকমত রয়েছে, তার মধ্য থেকে আরেকটি হেকমত হলো এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতের মধ্যে ভিন্নতা আসে। ইবলীস ও তার বাহিনী সৃষ্টি না করা হলে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার ফযীলত অর্জন এবং তার রাস্তায় শাহাদাতের মর্যাদা অর্জন করা থেকে আল্লাহর বান্দাগণ বঞ্চিত হতো। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদ করা তার নিকট অত্যন্ত প্রিয় একটি ইবাদত। আল্লাহ তা‘আলা যদি শুধু ভালো আমলই সৃষ্টি করতেন এবং সমস্ত মানুষই যদি মুমিন হতো, তাহলে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ এবং তার আনুসাঙ্গিক বিষয়গুলো বাতিল হয়ে যেত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার জন্য কাউকে ভালোবাসা এবং তার জন্যই কাউকে শত্রু বানানোর ইবাদতটি অচল হয়ে যেত। সেই সঙ্গে সৎ কাজের আদেশ করা, অসৎ কাজের নিষেধ করা, আল্লাহর পথে ধৈর্য ধারণ করা, কুপ্রবৃত্তির বিরোধীতা করা, আল্লাহ তা‘আলার প্রিয় আমলকে প্রাধান্য দেয়া, তাওবা করা, ক্ষমা প্রার্থনা করা, আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা, যাতে করে তিনি বান্দাকে তার শত্রু এবং শত্রুর ষড়যন্ত্র ও কষ্ট থেকে নিরাপত্তা দান করেন। ইবলীস ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার পিছনে এমনি আরো অনেক হেকমত রয়েছে, যা মানুষের বিবেক-বুদ্ধি সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে অক্ষম।

[1]. উদাহরণ স্বরূপ মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করার বিষয়টি পেশ করা যেতে পারে। এটি আল্লাহ তা‘আলার কর্মসমূহের অন্যতম একটি কর্ম। তিনি স্বীয় ইচ্ছায় মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করেছেন। মূলতই মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি করার মধ্যে বিরাট কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যক্তিগত থেকেই প্রিয়।

আর আল্লাহ যা অন্য কারণে ও বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, তার ব্যক্তিসত্তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নাও থাকতে পারে এবং তার ব্যক্তিসত্তার দিকে দৃষ্টি দিলে সেখানে কোনো মঙ্গল নাও দেখা যেতে পারে। কিন্তু অন্য একটি উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য মাধ্যম স্বরূপ তাকে সৃষ্টি করেছেন। যেমন ধরুন আল্লাহ তাআলা ইবলীসকে সৃষ্টি করেছেন। তাকে সৃষ্টি করা মূলগত দিক থেকে উদ্দেশ্য নয়, তার ব্যক্তিসত্তার দিকে তাকালে দেখা যায় তার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই।

কিন্তু আল্লাহ তাআলার হেকমতের দাবি এই যে, তিনি মানুষকে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে এক শ্রেণী হবে কাফের আরেক শ্রেণী হবে মুমিন। আল্লাহ তাআলা বলেন, وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً ‘‘আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে সমস্ত মানুষকে এক জাতিতে পরিণত করতে পারতেন। (সূরা হুদ: ১১৮) কিন্তু তিনি ইচ্ছা করেন নি। তার হেকমতের দাবি হলো মানুষ দু’টি জাতিতে বিভক্ত হবে। সুতরাং আদি থেকে এই হলো হেকমতের দাবি। এই মর্মে আল্লাহ তাআলার ফায়ছালা হয়ে গেছে যে, একদল মানুষ জান্নাতে যাবে আরেক দল যাবে জাহান্নামে। এটি একটি মীমাংসিত বিষয়।

ইবলীস নামক অকল্যাণটি মূলত উদ্দেশ্য নয়, সে আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রিয়ও নয়। তবে তার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার অন্য একটি উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়েছে। তা হলো তার কারণে একদলকে জান্নাতে প্রবেশ করানো এবং আরেকদলকে জাহান্নামে প্রবেশ করানো। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা ইবলীসকে পছন্দ করে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেননি; বরং অন্য কারণে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং ইবলীসকে সৃষ্টি করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার হেকমত এভাবে পূর্ণ হয়েছে এক শ্রেণীর মানুষ ইবলীসের অবাধ্য হয়ে জান্নাতে যাবে আরেক শ্রেণীর মানুষ তার আনুগত্য করে জাহান্নামে যাবে। সুতরাং ইবলীস সৃষ্টি করার ফলে অনেক স্বার্থ অর্জিত হয়েছে এবং আল্লাহ তাআলার মহা হিকমত বাস্তবায়ন হয়েছে। যদিও সত্তাগত দিক থেকে ইবলীস খুবই নিকৃষ্ট, মূলগত দিক থেকেও সে অপ্রিয়। তবে তার মাধ্যমে যেহেতু আল্লাহর ফায়ছালার দিকে পৌঁছা যায় এবং হেকমত বাস্তবায়ন হয়, তাই আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।

[2]. মানুষ হাজার হাজার মাইলের পথ অতিক্রম করে মক্কায় আগমণ করে। দিন-রাত অনেক কষ্ট করে আল্লাহর ঘরের নিকট উপস্থিত হয়। আল্লাহর ঘর দেখে সে আনন্দ পায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে একই জিনিস একদিক থেকে কষ্টকর। কিন্তু উহাতে যেই ফলাফল ও সুখণ্ডশান্তি অর্জিত হয়, তার দিকটা বিবেচনায় খুব ভালো। সুতরাং একই জিনিস একদিক থেকে প্রিয় এবং মূলগত দিক থেকে অপ্রিয় হওয়ার কারণে উহা পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়। কোনো ডাক্তার যদি তার রোগীকে বলে তোমার এই অঙ্গটি কেটে ফেললে আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা ৮০% কিংবা ৭০%, তাহলে রোগী অঙ্গ কেটে ফেলতে রাযি হয়ে যায়। এখানে রোগী আরোগ্য লাভের ৮০% বা ৭০% সম্ভাবনা থাকার কারণেই মনের মধ্যে ভালো একটি প্রিয় আশা নিয়ে কষ্টকর এবং অপছন্দনীয় একটি কাজ করে ফেলে। সুতরাং তার প্রিয় আশাটি বাস্তবায়নের ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত নয়।

সাধারণ একটি আল্লাহর সৃষ্টি যেখানে পরিণাম সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত না হয়েই ভালো ফলাফলের আশা নিয়ে একটি ঝুকিপূর্ণ ও কষ্টকর কাজের দিকে অগ্রসর হয়, সেখানে মহান স্রষ্টা আল্লাহ সবকিছু অবগত, মন্দ বিষয় সৃষ্টি করা থেকে কল্যাণ ও ভালো ফলাফল অর্জিত হওয়ার ব্যাপারে যেহেতু সম্পূর্ণ নিশ্চিত, তাই তার জন্য মন্দ জিনিস সৃষ্টি করা মোটেই দোষণীয় নয়।

[3]. এখানে লেখকের এটি উদ্দেশ্য নয় যে, জিবরীল সর্বোত্তম সৃষ্টি। কেননা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন সর্বোত্তম সৃষ্টি।

[4]. এ সমস্ত নাম তার বিপরীত অর্থবোধক নাম উল্লেখ ছাড়া আল্লাহর জন্য ব্যবহার করা শোভা পায় না। এগুলো যদি এককভাবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে পূর্ণতার স্থলে অপূর্ণতা ও ত্রুটি বুঝায়। যেমন الضَّار النّاَفِع (ক্ষতিকারক ও কল্যাণকারী), الخَافِض الرَّافِع (নিচুকারী ও উত্তোলনকারী), الْمَانِع الْمُعْطِي (দাতা ও প্রতিরোধকারী), المُعِزُّ المُذِلُّّ (সম্মানদাতা ও অপমানকারী) ইত্যাদি। সুতরাং এককভাবে শুধু الضَّار,الخَافِض , الْمَانِع এবং المُذِلُّ ব্যবহার করা জায়েয নেই।

[5]. ছহীহ মুসলিম হা/২৭৪৯।
ক্ষতিকর ও অপছন্দনীয় জিনিস সৃষ্টি করার তাৎপর্য বা হেকমত - ২

এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, ইবলীস, কুফুরী, পাপাচার, অকল্যাণ ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি না করে উপরোক্ত স্বার্থগুলো হাসিল করা কি সম্ভব ছিল না?

এ প্রশ্নটি মূলতই ভুল। এতে গাছ রোপন করা ছাড়াই ফল কামনা করার ধারণাকে আবশ্যক করে। বিবাহ করা ছাড়াই সন্তান পাওয়ার ধারণাকে আবশ্যক করে। নড়াচড়াকারীর অস্তিত্ব ব্যতীত কোনো কিছুর নড়াচড়া আবশ্যক করে। তাওবাকারী ব্যতীত তাওবার অস্তিত্বকে আবশ্যক করে।[6]

কেউ যদি আপনাকে বলে আল্লাহ তা‘আলা কি বিবাহ ছাড়া আমাকে সন্তান দিতে পারেন না? আপনি অবশ্যই বলবেন, এটি একটি বাতিল প্রশ্ন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা এভাবে তোমাকে সন্তান দেয়ার ইচ্ছাই করেননি। তিনি চেয়েছেন, বান্দা নিজে উপায়-উপকরণ ও মাধ্যম গ্রহণ করবে। তারপর আল্লাহ তা‘আলা ফলাফল প্রদান করবেন। তিনি চেয়েছেন, বান্দা বিবাহ করবে। এর মাধ্যমে সে দুনিয়ার সর্বাধিক আনন্দ উপভোগ করবে, তার যৌন ক্ষুধা হালালভাবে নিবারণ করবে এবং চক্ষু শিতলকারী সন্তানাদিও লাভ করবে।

অতঃপর যদি প্রশ্ন করা হয়, ইবলীস, কুফুরী, পাপাচার, অকল্যাণ ও ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করার মাধ্যমে যখন বিশেষ একটি হেকমত বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে কি এদিক বিবেচনায় এগুলো আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রিয় হতে পারে? না কি এগুলো সকল দিক থেকেই অপছন্দনীয়?

দু’ভাবে এ প্রশ্নের জবাব দেয়া যেতে পারে।

(১) পাপাচার ও অন্যায় কর্ম কখনো কখনো যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার প্রিয় বস্তুর দিকে নিয়ে যায়, সেদিক বিবেচনায় এগুলো তার নিকট প্রিয় কি না? কেননা এগুলো বান্দাকে পরবর্তীতে আল্লাহর আনুগত্য, তার ইবাদতের দিকে নিয়ে যায়। যদিও এগুলোকে মূলগত দিক থেকে তিনি অপছন্দ করেন, যারা এতে লিপ্ত হয়, তাদেরকে ঘৃণা করেন এবং শাস্তি দেন। এটি হলো আল্লাহ তা‘আলার দিক থেকে

(২) বান্দার দিক বিবেচনায় এগুলোর প্রতি তার সন্তুষ্ট থাকা জায়েয কি না? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কোনো মুসলিম পাপাচার পছন্দ করে না। কেননা কমপক্ষে অন্তর দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে সরিষার দানা পরিমাণ ঈমানও থাকে না। মানুষ কখনো কখনো হাত দ্বারা কিংবা জবান দ্বারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা রাখে না। তবে অন্তর দিয়ে অবশ্যই অন্যায়কে অপছন্দ করতে হবে। সুতরাং এমন কোনো মুমিন পাওয়া যাবে না, যিনি অন্তর দিয়ে পাপাচারকে পছন্দ করে।

আপনার কাছে যদি কোনো মুমিন এসে বলে, আমি মুমিন, কিন্তু আমি এ পাপাচারগুলো অপছন্দ করি। যেহেতু এগুলো আল্লাহ তা‘আলাই বিশেষ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, সে হিসাবে আমি এগুলোর প্রতি সন্তুষ্ট থাকি। আমি যে এগুলোকে পছন্দ করি, তা কিন্তু নয়। পাপাচার হিসাবে এগুলোকে পছন্দ করি না। প্রত্যেক মুসলিমের উচিত অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। তবে এগুলোকে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য মুসীবত হিসাবে সৃষ্টি করেছেন, সে হিসাবে এগুলোকে তাকদীরের বিষয় বলে সমর্থন করি।

অতঃপর ইমাম ইবনে আবীল ইয রহিমাহুল্লাহ বলেন, অকল্যাণকর বস্তু এবং অকল্যাণের উপকরণগুলোর মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। কিন্তু সৃষ্টিগত ও অস্তিত্বগত দিক থেকে তাতে কোনো অকল্যাণ নেই। সৃষ্টি ও অস্তিত্বগত দিক থেকে পাপাচার সৃষ্টি হওয়া ভালো। এর মাধ্যমে অকল্যাণ তখনই হয়, যখন তাকে ভালোর দ্বারা প্রতিহত করা হয় না। কেননা মূলতঃ গতি সম্পন্ন করে ও নড়াচড়া করার শক্তি দিয়ে ক্ষতিকর বস্তু সৃষ্টি করা হয়েছে। ইলম ও সঠিক সিদ্বামেত্মর মাধ্যমে যদি এটিকে পরাজিত করা হয়, তাহলে তা ভালোর দিকে ধাবিত হয়।

উদাহরণ স্বরূপ ঈমানের শত্রু ইবলীস, বিষাক্ত সাপ ও কীট-পতঙ্গ এবং অন্যান্য ক্ষতিকর বস্তু সৃষ্টির বিষয়টি পেশ করা যেতে পারে। আর যদি পাপাত্মাকে সংশোধন না করে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে সেভাবেই রেখে দেয়া হয়, তাহলে তা স্বীয় স্বভাব অনুযায়ী সৎকাজের বিপরীত দিকে ধাবিত হয়। পাপাত্মাগুলোর নড়াচড়ার শক্তি থাকলেই তাকে ভালো কিংবা খারাপ বলা যায় না। আল্লাহ তা‘আলা ভালো উদ্দেশ্যেই এ নড়াচড়া সৃষ্টি করেছেন। গতি ও নড়াচড়াটি মন্দের দিকে সম্বন্ধ হওয়া থেকেই তা ক্ষতিকর হয়। মূলতঃ নড়াচড়াটি ক্ষতিকর নয়। যুলুমের দিকে নড়াচড়া, সীমালংঘনের দিকে নড়াচড়া ইত্যাদি।

ক্ষতি ও কষ্টকর বিষয় যদি যথাস্থানে না রেখে অন্যস্থানে রাখা হয়, তাহলে দোষের কিছু নয়। এতে বুঝা গেল, যে কষ্ট ও শাস্তি পাওয়ার যোগ্য তাকে কষ্ট দিলে যুলুম হয় না। সুতরাং কষ্ট ও ক্ষতির ব্যাপারটি আপেক্ষিক। এ জন্য ইসলামী শরীয়াত পাপাচার ও অবাধ্যতার কারণে যে শাস্তি নির্ধারণ করেছে, তা যদি যথাস্থানে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে দোষারোপের কিছুই থাকে না। তবে যাকে শাস্তি দেয়া হলো, সে তো কষ্ট পাবেই এবং তাকে অপছন্দ করবেই। কারণ মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি এরূপ যে, সবসময় আরামদায়ক জিনিস গ্রহণ করার জন্য প্রস্ত্তত থাকে। কষ্ট সহ্য করতে চায় না।

সুতরাং তার জন্য কষ্ট স্বীকার করা ক্ষতিকর হলেও যে ব্যক্তি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করার কারণে তাকে শাস্তি দিলো সে ভালোই করেছে। কেননা সে শাস্তিটা যথাযোগ্য স্থানে প্রয়োগ করেছে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সকলদিক বিবেচনায় কোনো কিছুকেই শুধু অকল্যাণের জন্য সৃষ্টি করেননি। আল্লাহ তা‘আলার হেকমত ও প্রজ্ঞা এটিকে অস্বীকার করে। সুতরাং সকল দিক বিবেচনায় কোনো ক্ষতিকর জিনিস সৃষ্টি করা মহান প্রভুর শানের খেলাফ। এ ধরণের জিনিস সৃষ্টি করার মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। সেটি সৃষ্টি হওয়া আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পূর্ণতার গুণাবলীর জন্য অসম্ভব। আল্লাহ তা‘আলার হাতেই সমস্ত কল্যাণ। অকল্যাণের সম্বন্ধ তার দিকে শোভনীয় নয়।

কোনো কোনো সৃষ্টি আমাদের দৃষ্টিতে ক্ষতিকর মনে হলেও আল্লাহ তা‘আলা তাকে শুধু ক্ষতির জন্য সৃষ্টি করেননি। ভালো উদ্দেশ্যেই তিনি তা সৃষ্টি করেছেন। এ জন্যই অকল্যাণের সম্বন্ধ আল্লাহর দিকে নয়। আল্লাহ তা‘আলার দিকে যা কিছুর সম্বন্ধ করা হয়, তার সবগুলোর মধ্যেই সৃষ্টি করার দিক বিবেচনায় কল্যাণ রয়েছে। অকল্যাণকে কোনো পক্ষের দিকে সম্বন্ধ না করার আগে সাধারণত ক্ষতিকর হিসাবেই ধরা হয়। অর্থাৎ অকল্যাণকর জিনিসগুলো দুই দিক থেকে মূল্যায়নযোগ্য। আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু এগুলোর স্রষ্টা, তাই এতেও কল্যাণ রয়েছে। আর বান্দার দিক থেকে যেহেতু এটি সংঘটিত হয়, তাই এর মধ্যে ক্ষতি রয়েছে। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার দিকে সম্বন্ধ করা হলে তাতে কোনো অকল্যাণ থাকে না। আল্লাহ তা‘আলার দিকে সম্বন্ধ না করা হলেই তাতে অকল্যাণ আছে বলে ধরা হয়। অর্থাৎ যেমন ধরুন কেউ যখন আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী করে যেমন যেনা-ব্যভিচার করে, তখন এটিকে দুইভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা এটি সৃষ্টি করে ভালোই করেছেন। কেননা তিনি বিনা হিকমতে কোনো কিছুই সৃষ্টি করেন না। এ হেকমতগুলো আমরা কখনো জানতে পারি। আবার কখনো জানতে পারি না। তবে বান্দার দিক থেকে সংঘটিত হয় বলে এতে নিঃসন্দেহে ক্ষতি রয়েছে। কেননা বান্দা যখন আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হয় এবং তার হুরমতের সীমা লংঘন করে, তখন নিঃসন্দেহে তা ক্ষতিকর। তবে যখন আল্লাহ তা‘আলার দিক থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলে মূল্যায়ন করবো, তখন এভাবে মূল্যায়ন করবো যে, এটি আল্লাহর নির্ধারণ অনুপাতেই সৃষ্টি হয়েছে। এতে কল্যাণ ও হেকমত রয়েছে। আমরা তা জানি কিংবা না জানি।[7] সুতরাং কথাটির মধ্যে গভীরভাবে চিন্তা করা আবশ্যক।

এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু অকল্যাণ সৃষ্টি করেছেন এবং তার ইচ্ছাও করেছেন, তাহলে আল্লাহর দিকে তার সম্বন্ধ হওয়া শোভনীয় হয়না কেন? জবাবে বলা হবে যে, সৃষ্টিগত দিক থেকে খারাপ জিনিস সৃষ্টি করা দোষণীয় নয়। সুতরাং সৃষ্টিগত দিক থেকে আল্লাহ তা‘আলার দিকে মন্দের সম্বন্ধ করা দোষণীয় নয়। এ দিক মূল্যায়নে ইবলীস ও মন্দ সৃষ্টি করা ক্ষতিকর নয়। ভালো কাজ ও তার উপকরণ দিয়ে পাপাচারকে দএ না করলে খারাপ জিনিস দ্বারা মানুষ কষ্ট পেয়ে থাকে। যার হাতে রয়েছে সকল কল্যাণ, তার দিকে অকল্যাণের সম্বন্ধ শোভনীয় হয় না। এ বিষয়টি আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে আপনি জেনে রাখুন যে, কল্যাণের উপকরণ হলো তিনটি। কল্যাণের উপর সৃষ্টি করা, প্রস্ত্তত করা এবং কল্যাণের উপকরণ সংগ্রহ করাতে সাহায্য করা। কল্যাণ সৃষ্টি করা ভালো। আল্লাহ তা‘আলা এটি সৃষ্টি করেছেন। এমনি কল্যাণ প্রস্ত্তত করা এবং তা অর্জনে সাহায্যও আসে আল্লাহর পক্ষ হতে। আল্লাহর পক্ষ হতে সাহায্য আসে না, তাতেই অকল্যাণ হয়। সাহায্য না থাকার কারণেই অকল্যাণ হয়।

তবে মন্দ সৃষ্টি করা দোষণীয় নয়। মন্দকে ভালোর দ্বারা মোকাবেলা না করলেই অকল্যাণ আসে। অর্থাৎ তাকে স্বীয় স্বভাব ও অভ্যাসের উপর ছেড়ে দিলে তার দ্বারা মানুষ কষ্ট পায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা যদি আমাদেরকে আমাদের নফসের উপর ছেড়ে দিতেন, তাহলে আমরা ধ্বংস হয়ে যেতাম। এ জন্যই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর কাছে এ বলে দু‘আ করতেন যে, তিনি যেন তাকে এক পলকের জন্যও তার নফসের উপর ছেড়ে না দেন। কাফেরদেরকে আল্লাহ তা‘আলা তাদের নফসের উপর একাকী ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীর দিকে ধাবিত হয়েছে। এ কারণে নয় যে, কাফেরদের অস্তিত্ব অকল্যাণের কারণ নয়। আল্লাহ তা‘আলাই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং তাদেরকে সৃষ্টি করার ইচ্ছা করা এবং অস্তিত্বে আনয়ন করা কল্যাণকর। তাদের মধ্যে অকল্যাণ এ কারণে এসেছে যে, তাদেরকে বিনা সহায়তায় ছেড়ে দেয়া হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে হেদায়াতের জন্য মদদ করেন নি। বরং তাদেরকে নিজেদের নফসের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তাই তাদের কাছে অকল্যাণ এসেছে তাদের নফসের পক্ষ হতে, শয়তানের পক্ষ হতে এবং তাদের অপকর্মের কারণে।

কেউ যদি প্রশ্ন করে, আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু ভালো-মন্দ সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, তাই তিনি ভালোটি অর্জন করতে বান্দাকে সাহায্য করেননি কেন? অকল্যাণ থেকে বান্দাকে ফিরিয়ে রাখেননি কেন? শাইখ ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, আল্লাহ তা‘আলার হেকমত এটি ছিল না যে, তিনি অমঙ্গল সৃষ্টি করবেন এবং তা থেকে বিরত থাকতে বান্দাকে সাহায্যও করবেন। বরং হেকমত এটি ছিল যে, তিনি অমঙ্গল সৃষ্টি করবেন এবং তা পরিত্যাগে বান্দাকে সাহায্য করা বর্জন করবেন। কেননা অমঙ্গল বর্জনে তাকে সাহায্য করলে আল্লাহ তা‘আলা যে উদ্দেশ্যে বান্দাদেরকে সৃষ্টি করেছেন, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো না।[8]

যদি প্রশ্ন করা হয় যে, সকল মানুষকে আনুগত্যের উপর সাহায্য করা হলোনা কেন? আসলে এ প্রশ্নটি একদম বাতিল। এ প্রশ্নের অর্থ হলো, মানুষ ও শয়তানকে ফেরেশতাদের মত করে সৃষ্টি করা হলোনা কেন? অথবা সৃষ্টির সকলেই ফেরেশতা হলোনা কেন? এ প্রশ্নের জবাবে আমরা বলবো যে, এটি একটি বাতিল প্রশ্ন। বরং সকল মাখলুক একই রকম না হওয়ার মধ্যেই আল্লাহ তা‘আলার হেকমত বাস্তবায়ন হয়েছে। এ ধরণের প্রশ্ন যারা করে, তাদের ধারণা হলো, সকল সৃষ্টিকে এক সমান করাই সর্বাধিক হেকমতপূর্ণ। এ ধারণা মুর্খতার পরিচায়ক। বরং সকল বস্তুর পরস্পরের মধ্যে বিরাট পার্থক্য থাকাটাই হেকমতপূর্ণ। তবে সৃষ্টির প্রত্যেক শ্রেণীর মধ্যে সৃষ্টিগত দিক থেকে কোনো পারস্পরিক অসংগতি নেই। তবে সৃষ্টিগত দিক বাদ দিয়ে সৃষ্টির মধ্যে অন্যান্য কারণে পারস্পরিক তারতম্য হয়। যেমন কোনো সৃষ্টির মধ্যে ভালো গুণাবলী বিদ্যমান থাকা বা কোনোটির মধ্যে উহা না থাকার কারণেই উভয়ের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য হয়। আল্লাহ তা‘আলা সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, এ দিক থেকে সব সৃষ্টিই কল্যাণকর। আল্লাহ তা‘আলা কোনো জিনিসকেই সকল দিক বিবেচনায় ক্ষতিকর বানিয়ে সৃষ্টি করেন নি। কল্যাণের মাধ্যমে সাহায্য না করার কারণেই কোনো কোনো সৃষ্টির মধ্যে অকল্যাণ আসে। যে সৃষ্টির মধ্যে অকল্যাণ রয়েছে, তার মধ্যেও চলাচল ও নড়াচড়া করার শক্তি রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা যদি তাকে তাওফীক দেন, তাহলে উহা ভালোর দিকে পরিচালিত হয়।[9] আর যদি তাওফীক না দিয়ে এবং সাহায্য না করে তাকে আপন অবস্থায় ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে তার নফ্সে আম্মারা, শয়তান এবং কুপ্রবৃত্তি তাকে অন্যায়ের দিকে টেনে নেয়। যদিও তার সামনে সত্য সুস্পষ্ট থাকে।

সুতরাং সৃষ্টিগত দিক থেকে সৃষ্টির মধ্যে কোনো অসংগতি ও বৈষম্য নেই। তবে মর্যাদার দিক থেকে অনেক তারতম্য ও বৈষম্য আছে। আল্লাহ তা‘আলার সর্বাধিক উত্তম সৃষ্টি হলেন মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তার মোকাবেলায় তিনি ইবলীস সৃষ্টি করেছেন। ইবলীস হলো সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক নিকৃষ্ট। উভয়ের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে।

হে পাঠক! আপনি যদি উপরের কথাগুলো বুঝতে না পারেন, তাহলে নিম্নের লাইনটি নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করুন।

إذا لم تستطع شيئا فدعه... وجاوزه إلى ما تستطيع

তুমি যখন কোনো কাজ করতে অক্ষম হবে, তখন উহা ছেড়ে দিয়ে এমন একটি কাজে যোগদান করো, যা তুমি করতে সক্ষম।

এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে তার বান্দার জন্য এমন জিনিস পছন্দ করেন, যাতে তিনি বান্দাকে সাহায্য করেন না? এর জবাব হলো, বান্দাকে আনুগত্যের কাজের উপর বাধ্য করা হলে আল্লাহ তা‘আলার কাছে এ আনুগত্যের চেয়ে বড় অন্য একটি প্রিয় বস্তু ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারো কারো নিকট থেকে আনুগত্য বাস্তবায়ন হলে উহার বড় একটি বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। যা আল্লাহ তা‘আলার কাছে উক্ত আনুগত্যের কাজের চেয়ে অধিক অপছন্দনীয়। আল্লাহ তা‘আলা নিমেণর আয়াতটির মধ্যে এদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَوْ أَرَادُوا الْخُرُوجَ لَأَعَدُّوا لَهُ عُدَّةً وَلَٰكِن كَرِهَ اللَّهُ انبِعَاثَهُمْ فَثَبَّطَهُمْ وَقِيلَ اقْعُدُوا مَعَ الْقَاعِدِينَ

‘‘আর সত্যি সত্যিই যদি তারা বের হবার ইচ্ছা থাকতো তাহলে তারা সে জন্য কিছু প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতো। কিন্তু আল্লাহ তাদের যাত্রাকে অপছন্দ করেছেন। ফলে তিনি তাদেরকে পিছিয়ে দিলেন আর বলা হলো, তোমরা বসে পড়া লোকদের সাথে বসে থাকো’’। (সূরা আত তাওবা: ৪৬)

এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি তার রাসূলের সাথে তাবুক যুদ্ধে মুনাফেকদের বের হওয়াকে অপছন্দ করেছেন। অথচ তাতে বের হওয়া ছিল বিরাট একটি ইবাদত। তিনি যখন তাদের বের হওয়াকে অপছন্দ করেছেন, তখন তিনি তাদেরকে তা থেকে পিছিয়ে দিয়েছেন।

মুনাফেকরা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাবুক যুদ্ধে বের হলে কী পরিমাণ ক্ষতি হতো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এখানে তা থেকে কতিপয় ক্ষতির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন,

لَوْ خَرَجُوا فِيكُم مَّا زَادُوكُمْ إِلَّا خَبَالًا

‘‘তারা যদি তোমাদের সাথে বের হতো তাহলে তোমাদের মধ্যে অনিষ্ট ছাড়া আর কিছুই বাড়াতো না’’। (সূরা আত তাওবা: ৪৭)

অর্থাৎ তারা ফাসাদ ও অকল্যাণ ছাড়া অন্য কিছুই বৃদ্ধি করতো না। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَلَأَوْضَعُوا خِلَالَكُمْ يَبْغُونَكُمُ الْفِتْنَةَ وَفِيكُمْ سَمَّاعُونَ لَهُمْ

‘‘তারা ফিতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদের মধ্যে প্রচেষ্টা চালাতো। আর তোমাদের লোকদের অবস্থা হচ্ছে, তোমাদের মধ্যে এখনো এমন লোক আছে যারা তাদের কথা আড়ি পেতে শোনে’’। (সূরা আত তাওবা: ৪৭)

অর্থাৎ তাদের থেকে গ্রহণ করে এবং তাদের ডাকে সাড়া প্রদান করে। সুতরাং তাদের কথা শ্রবণ এবং তাদের কথা গ্রহণ করা থেকে এমন ফাসাদ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা ছিল, যা তাদের বের হওয়ার কল্যাণের চেয়ে অধিক বড়। সুতরাং তাদেরকে পিছিয়ে রাখার মধ্যেই আল্লাহ তা‘আলার হেকমত নিহিত ছিল এবং একনিষ্ঠ মুমিনদের জন্য রহমত স্বরূপও ছিল। অন্যান্য ক্ষেত্রেও এ উপমাটিকে মূলনীতি হিসাবে গ্রহণ করুন এবং এর উপর কিয়াস করুন।

(২) পাপাচার ও অন্যায় কর্মের প্রতি অপছন্দ বান্দার দিক থেকেও হয়ে থাকে। এমনটি হওয়া সম্ভব; বরং এটিই বাস্তব। বান্দা পাপাচার ও সীমালংঘনের কাজকে অপছন্দ ও ঘৃণা করে। অথচ এটি বান্দার ইচ্ছাতেই সংঘটিত হয়ে থাকে। এটি যেহেতু আল্লাহর অবগতি, নির্ধারণ, ইচ্ছা এবং সৃষ্টিগত হুকুএে হয়ে থাকে, তাই বান্দা এতে রাযী থাকে। সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহ পেয়েও বান্দা খুশী হয় এবং তার পক্ষ থেকে এর বিপরীত কিছু আসলে অসন্তুষ্ট হয়।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, যেমন ধরুন কারো আত্মীয় ছ্বলাত পড়ে না। তার আত্মীয়ের পক্ষ হতে এমন কাজ হওয়াকে সে খুব অপছন্দ করে। এতে সে কষ্টও পায় এবং বিরক্তি প্রকাশ করে। কেউ যখন তাকে এসে এ উপদেশ দেয় যে, দেখো ভাই! এসব কিছুই তাকদীর। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাকদীরের উপর সবর করতে বলেছেন। তোমার মা-বাপ ছ্বলাত পড়ে না। এটি আল্লাহর পক্ষ হতে একটি মুসীবত এবং তা আল্লাহর হুকুমে। এর উপর তোমার সবর-ধৈর্য ধারণ করা আবশ্যক। আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন, তাতে তুমি সন্তুষ্ট থাকো। সুতরাং দেখা যাচ্ছে বান্দার পক্ষ হতে আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী হওয়া খুশীর খবর নয়; কিন্তু তা যেহেতু আল্লাহর নির্ধারণ অনুযায়ী হয়ে থাকে, তাই আমরা তাতেও নাখোশ-অসন্তুষ্ট হবো না।

এটি সুফীদের একদলের কথা। তারা বলেছে, আল্লাহর পক্ষ হতে ভালো-মন্দ যা কিছুই হোক না কেন, আমরা তাতে সন্তুষ্ট আছি। আর বান্দার পক্ষ হতে পাপাচার হলে আমরা তাকে অপছন্দ করি। আরেকদল পাপাচারকে সাধারণভাবে অপছন্দ করেছে। আল্লাহর নির্ধারণ হিসাবে অপছন্দ করেনি। আসলে এ কথা এবং পূর্বোক্ত কথার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। পাপাচার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার অবগতি, তার লিখন এবং উহার ইচ্ছাকে অপছন্দ করে না। বরং আল্লাহ তা‘আলার আদেশ-নিষেধ ও শরীয়াত বিরোধী হওয়ার কারণে পাপাচারকে অপছন্দ করেন। এটিই হলো এ ক্ষেত্রে মূল বিষয়। পাপাচার ও অন্যায় কর্মের সম্বন্ধ যখন আল্লাহর দিকে করা হবে, তখন তা অপছন্দনীয় হবে না। আর যখন বান্দার দিকে করা হবে, তখন অপছন্দনীয় হবে।

[6]. মূলতঃ এটি সাব্যস্ত করাই লেখকের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার এমন কতিপয় অতি সুন্দর নাম রয়েছে, যা ইবলীস ও পাপাচার সৃষ্টি না করলে তার প্রভাব বান্দার উপর পড়তো না এবং তা দ্বারা বান্দা কোনো উপকারই হাসিল করতে পারতো না। যেমন ধরুন আল্লাহ তাআলা, العفو الغفور الغفار ইত্যাদি। এই নামগুলোর দাবি হলো, সৃষ্টিসমূহের মধ্যে এমন কিছু সৃষ্টি থাকবে, যারা গুনাহ করবে। গুনাহ করার পর তারা তাওবা করবে। তাওবা করা বিরাট একটি এবাদত। এতে করে আল্লাহ তাআলার ক্ষমাকারী, দয়াকারী, ক্ষমাশীল নামের মধ্যে যেই ক্ষমা, দয়া ও সহনশীলতা রয়েছে, তার প্রভাব বান্দার উপর পড়বে। বান্দা তার মাধ্যমে উপকৃত হবে। আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমেও উপাস্য হবেন।

[7]. ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, আল্লাহ তা‘আলার এমন কতিপয় অতি সুন্দর নাম রয়েছে, যা ইবলীস ও পাপাচার সৃষ্টি না করা হলে তার প্রভাব বান্দার উপর পড়া সম্ভব হতো না এবং উহা দ্বারা বান্দা কোনো উপকারই হাসিল করতে পারতো না। যেমন ধরুন আল্লাহ তা‘আলার العفو الغفور الغفار ইত্যাদি নাম রয়েছে। এই নামগুলোর দাবি হলো, তার বান্দাদের মধ্যে এমন কিছু বান্দা থাকবে, যারা গুনাহ করবে। গুনাহ করার পর তারা তাওবা করবে। তাওবা বিরাট একটি ইবাদত। এতে করে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমাকারী, দয়াকারী, ক্ষমাশীল নামের মধ্যে যে ক্ষমা, দয়া ও সহনশীলতা রয়েছে, তার প্রভাব বান্দার উপর পড়বে। বান্দা তার মাধ্যমে উপকৃত হবে। আল্লাহ তা‘আলা এর মাধ্যমেও উপাস্য হবেন।

[8]. সে সাথে আরো বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যই তাদের মধ্যে স্বাধীনতা সৃষ্টি করেছেন। তিনি দেখতে চেয়েছেন কে তাকে ভালোবেসে স্বেচ্ছায় তার ইবাদত করে। তিনি ইচ্ছা করলে সকলের স্বাধীনতা খর্ব করতে পারতেন এবং সকল মানুষকে ঈমানের উপর বাধ্য করতে পারতেন। এ ব্যাপারে তিনি সম্পূর্ণ ক্ষমতাবান। কুফুরী করা এবং আনুগত্যের কাজ বর্জন করার ক্ষমতা কারো থাকতো না। কিন্তু তা করলে আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতার বাস্তবায়ন হলেও তার আদল বা ইনসাফ গুণের ব্যাঘাত ঘটতো। কারণ আনুগত্যের উপর বাধ্য করে পুরস্কার দেয়া ইনসাফের পরিপন্থী। সে সঙ্গে অনর্থক কাজও বটে। আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু অনর্থক কাজের সম্পূর্ণ উর্ধ্বে এবং তিনি যেহেতু বান্দার উপর বিন্দুমাত্র যুলুম করেন না, তাই তাকে পুরস্কৃত করা কিংবা শাস্তি দেয়ার আগে স্বেচ্ছায় হেদায়াত ও আনুগত্যের পথ বেছে নেয়ার কিংবা তা না করার স্বাধীনতা দেয়ার প্রয়োজন ছিল।

আরো বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা পাহাড়-পর্বত, আসমান-যমীন এবং চন্দ্র-সূর্য ও দিবা-রাত্রিসহ আরো এমন অনেক বস্তু সৃষ্টি করেছেন, যাদের মধ্যে আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করা ব্যতীত অন্য কোন ইচ্ছা ও স্বাধীনতা রাখা হয়নি। তারা আল্লাহর অনুগত ও বাধ্যগত। পাহাড়কে আল্লাহ তাআলা যেখানে স্থাপন করেছেন, সেখান থেকে এক চুল পরিমাণও সরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে না। আসমানের সমস্ত ফেরেশতা দিবা-রাত্রি অবিরাম আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করছে। তাদের মধ্যে পাপাচারের বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও রাখা হয়নি।

ঐদিকে আল্লাহ তাআলা চেয়েছেন আরেক প্রকার মাখলুক সৃষ্টি করতে, যাদের মধ্যে ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকবে। তারা ইচ্ছা করলে আল্লাহকে ভালবেসে ও ভয় করে আল্লাহর আনুগত্য করতে পারবে। আর তা না করে স্বীয় ইচ্ছায় ব্যতিক্রমও করতে পারবে। জিন ও ইনসান হচ্ছে এই প্রকার মাখলুক। আল্লাহ তাদেরকে জড়পদার্থের মত না করে তাদের মধ্যে ইচ্ছাশক্তি স্থাপন করেছেন। যাতে করে তিনি উভয় প্রকার সৃষ্টির দ্বারা উভয়ভাবেই এবাদতের উপাস্য হতে পারেন। (আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)

[9]. আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণের পথে চলতে সাহায্য করেন না এবং অন্যায়ের পথ থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করেন না, যতক্ষণ না বান্দা বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে নিজে উদ্যোগ নিয়ে কল্যাণের পথে অগ্রসর হয়। বান্দা যখন তার ভিতরকার উৎকৃষ্ট স্বভাব ও সৃষ্টিগত ভালোগুণসমূহ জাগিয়ে তুলে এবং কল্যাণের দিকে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তা‘আলা তখনই কেবল বান্দাকে হেদায়াতের পথে আরো এগিয়ে দেন। অকল্যাণ ও পাপাচার হতে তাকে হেফাযত করেন। অপরপক্ষে, যে বান্দা অন্তর দিয়ে হেদায়াত কামনা করে না এবং বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে ভালো পথে অগ্রসর হয় না, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জোর করে কল্যাণের পথে চলতে বাধ্য করেন না। কারণ এতে করে মানুষ সৃষ্টির পিছনে আল্লাহ তাআলা যে হেকমত রেখেছেন, তা বাস্তবায়ন হওয়া সম্ভব হয় না। অর্থাৎ তাকে পরীক্ষা করা সম্ভব হয় না। আর বাধ্য করে হেদায়াত ও ঈমানের পথে এনে পুরস্কার দেয়াও অনর্থক হয়। আল্লাহ তাআলা অনর্থক কাজ করার বহু উর্ধ্বে। ঐদিকে কুফুরী ও পাপাচারের উপর বাধ্য করার পর শাস্তি দিলে আল্লাহ তাআলার আদল ও ইনসাফ ঠিক থাকে না। মহাপবিত্র সেই সত্তা, যিনি সকল প্রকার যুলুম ও অনর্থ কাজ করার বহু উর্ধ্বে।
ক্ষতিকর ও অপছন্দনীয় জিনিস সৃষ্টি করার তাৎপর্য বা হেকমত - ৩

কেউ যদি বলে, বান্দা ভালো-মন্দ কিছুই করে না। যা কিছু হয় সবকিছু আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। তার জবাবে আমরা বলবো যে, এটি হলো জাবরীয়াদের মাযহাব।[10] জাবরীয়া মতবাদের লোকদের পক্ষে এ সংকীর্ণ স্থান থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। ঐ দিকে তাকদীরকে অস্বীকারকারী কাদারীয়া মতবাদের লোকদের পক্ষে জাবরীয়াদের তুলনায় তাদের মাযহাব থেকে বের হয়ে আসা অনেক সহজ। অর্থাৎ জাবরীয়াদের মাজহাব কাদারীয়াদের মাযহাবের চেয়ে অধিক নিকৃষ্ট। কেননা কাদারীয়ারা খারাপ কাজ, পাপাচার ও গুনাহর কাজের সম্বন্ধ কেবল বান্দার দিকেই করে; আল্লাহর দিকে করে না। অপর পক্ষে জাবরীয়ারা সমস্ত পাপকাজের সম্বন্ধ আল্লাহর দিকেই করে এবং বলে এতে বান্দার কোন ইচ্ছা ও স্বাধীনতা নেই। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার বহু উর্ধ্বে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা কাদারীয়া ও জাবরীয়াদের মধ্যখানে। তারা উভয় শ্রেণীর বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছে। তারা বলে আল্লাহ তা‘আলা সবকিছুর স্রষ্টা। এ হিসাবে আল্লাহর দিকে পাপাচারের সম্বন্ধ করা ঠিক আছে। বান্দা যেসব পাপাচার ও নাফরমানী করে থাকে তা আল্লাহ তা‘আলার তাকদীর, ফায়ছালা এবং তার সৃষ্টি ও নির্ধারণগত ইচ্ছা অনুপাতেই হয়ে থাকে। কিন্তু ইহা তার শরীয়তগত ইচ্ছা, আদেশ ও নিষেধের বিরোধী। এ জন্যই তাদেরকে গুনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে শাস্তি দেয়া হবে। কেননা তারা তাদের ইচ্ছাতেই পাপাচারে লিপ্ত হয়েছে। এমনি তাদের ইচ্ছাতে আনুগত্যের কাজ করে বলেই তাদেরকে উত্তম বিনিময় দেয়া হয়।

যদি বলা হয় পাপাচার ও গুনাহর কাজ সৃষ্টি করার মধ্যে হেকমত রয়েছে এবং আল্লাহর ইচ্ছাতে বান্দারা তাতে লিপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে এর কারণে অনুতপ্ত হওয়া এবং তাওবা করার প্রয়োজন হয় কেন?

কোনো জিনিসকে তার আসল অবস্থায় না দেখে অন্যভাবে দেখার কারণে যার চোখ অন্ধ হয়ে গেছে, সে-ই কেবল এ ধরণের প্রশ্ন করতে পারে। পৃথিবীতে যেহেতু আল্লাহর ইচ্ছা ও হেকমতের দাবি ব্যতীত কোনো কিছুই হয় না, তাই তিনি চাইলে পাপাচারও সংঘটিত হতো না। সুতরাং গুনাহর কারণে তাওবার দরকার নেই। কারণ তা আল্লাহর নির্ধারণ অনুযায়ী হয়েছে। তাতে আল্লাহ তা‘আলার হেকমত রয়েছে। এ কারণেই সুফীরা পাপাচারকেও আনুগত্যের কাজ হিসাবে দেখে। কেননা তা আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্ধারণ অনুপাতেই হয়ে থাকে। তাদের কেউ কেউ বলেছে, আমি যদি আল্লাহর আদেশের বিরোধীতা করে থাকি, তা তার ইচ্ছার অনুরূপ করেছি। তাদের কোনো এক কবি বলেছেন,

أصبحت منفعلاً لما تختاره مني ففعلي كله طاعات

আমার জন্য তুমি যা কিছু নির্ধারণ করো আমি তাই করি। সুতরাং আমার সমস্ত কাজই তোমার আনুগত্য স্বরূপ।

যারা এ রকম বলে, তারা সৃষ্টিকূলের মধ্যে সর্বাধিক মুর্খ এবং আল্লাহ সম্পর্কে সর্বাধিক অজ্ঞ। সেই সঙ্গে তারা আল্লাহর সৃষ্টি ও তার দ্বীন সম্পর্কিত হুকুম-আহকাম সম্পর্কেও অজ্ঞ। শরীয়াতের আদেশ ও হুকুম অনুযায়ী কাজ করার মধ্যেই রয়েছে আল্লাহর আনুগত্য। আল্লাহর ইচ্ছা ও তাকদীর অনুযায়ী পাপাচারে লিপ্ত হলে আনুগত্য হয় না। তাকদীর অনুযায়ী কাজ হলেই যদি সৎকাজ হয়ে যেতো, তাহলে ইবলীসও আল্লাহর সর্বাধিক আনুগত্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতো। সেই সঙ্গে নূহ, হুদ, সালেহ, লুত, শুআইব ও ফেরআউনের সম্প্রদায়ের লোকেরাও পূর্ণ ঈমানদার হতো। কেননা তারাও আল্লাহর নির্ধারণ অনুপাতেই পাপাচার ও অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছে। যারা তাদেরকে ঈমানদার মনে করে তারা একদম মূর্খ। তবে কেউ যখন নিজেকে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম দেখে, নিজের মধ্যে তাকদীরের বিধান বাস্তবায়ন হতে দেখে, নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর প্রতি মুহতাজ মনে করে এবং চোখের পলকের জন্যও আল্লাহর হেফাযত থেকে নিজেকে অমূখাপেক্ষী মনে করে না, তখন সে আল্লাহর ইচ্ছাতেই সবকিছু করে। এ অবস্থায় সে নিজের ইচ্ছায় কিছুই করে না। বান্দা যখন এ অবস্থায় পৌঁছে যায়, তখন তার থেকে পাপাচারের কল্পনাও হতে পারে না। কেননা তখন সে সুরক্ষিত দূর্গের মাধ্যমে পরিবেষ্টিত থাকে। তখন সে আল্লাহর ইচ্ছাতেই শুনে, আল্লাহর ইচ্ছাতেই দেখে এবং আল্লাহর ইচ্ছাতেই ধরে এবং আল্লাহর ইচ্ছাতেই চলে। এ অবস্থায় বান্দার পক্ষ হতে পাপাচার সংঘটিত হওয়ার কল্পনাও করা যায় না। বান্দা যখন এ অবস্থার বাইরে চলে যায় এবং একাকী হয়ে যায় তখন তার উপর নফসের হুকুম চেপে বসে। এ সময়ই সে গাফিলতির জালে আটকা পড়ে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করতে শুরু করে।

অতঃপর প্রবৃত্তির এ ঘন কুয়াশা যখন তার উপর থেকে উঠে যায়, তখনই সে অনুতপ্ত হয়, তাওবা করে এবং আল্লাহ তা‘আলার দিকে ফিরে আসে। কেননা পাপাচারে ডুবে থাকার কারণে সে তার রব থেকে দূরে সরে গিয়ে স্বীয় নফসের চাহিদা পুরণের কাজে মগ্ন ছিল। সুতরাং সে যখন পূর্বের অবস্থা থেকে ফিরে এসেছে, তাই তার বর্তমান সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। ফলে সে তার রবের সাথে যুক্ত হয়েছে।

এখন যদি প্রশ্ন করা হয় যে, কুফুরী যদি আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারণ অনুযায়ী হয়ে থাকে এবং আমাদেরকে যেহেতু আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারণের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার আদেশ করা হয়েছে, তাই কিভাবে আমরা তাকদীর অনুযায়ী নির্ধারিত বিষয়ের প্রতিবাদ করতে পারি?

এর জবাবে প্রথমত: বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ তা‘আলা যা নির্ধারণ করেছেন এবং যেসব বিষয়ের ফায়ছালা করেছেন, তার সবগুলোর প্রতি আমাদেরকে সন্তুষ্ট থাকতে বলা হয়নি। আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতে এ ধরণের কোনো আদেশ খুঁজে পাওয়াও যাবে না। বরং আল্লাহ তা‘আলার ফায়ছালার মধ্যে এমন বিষয় রয়েছে, যাতে সন্তুষ্ট হওয়ার মত এবং তাতে এমন কিছু রয়েছে, যা অপছন্দনীয়। কেননা বিচারক যখন রায় প্রদান করে তখন তিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফায়ছালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন না। বরং কিছু কিছু রায়কে তিনি অপছন্দ করেন। যাদের বিরুদ্ধে রায় প্রদান করা হয়ে থাকে, তাদের উপরও মানুষ ক্রোধান্বিত হয়, তাদেরকে ঘৃণা করা হয়, তিরস্কার করা হয় এবং তাদের উপর লা’নত করা হয়।

দ্বিতীয়ত: বলা যেতে পারে যে, এখানে দু’টি বিষয় রয়েছে।

(১) আল্লাহ তা‘আলা যা নির্ধারণ করেন। আর এটি এমন কাজ, যা আল্লাহ তা‘আলার সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত

(২) আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারণকৃত বিষয়। আর এটি হলো আল্লাহ তা‘আলার সত্তা থেকে আলাদা একটি বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা যা নির্ধারণ ও ফায়ছালা করেন, তার সবগুলোর মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ, ইনমাফ এবং বিরাট হেকমত। এর সবগুলোর প্রতিই আমরা সন্তুষ্ট।

ঐ দিকে নির্ধারণকৃত বিষয়গুলো দু’প্রকার।

(১) যার প্রতি আমরা সন্তুষ্ট থাকি।

(২) আর তা থেকে এমন কিছু বিষয়ও রয়েছে, যাতে আমরা সন্তুষ্ট হই না।

তৃতীয় জবাব হলো, আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারণের দু’টি সম্পর্ক ও সম্বন্ধ রয়েছে। একটি সম্পর্ক হলো আল্লাহ তা‘আলার দিকে। এ দিক থেকে তার প্রতি সন্তুষ্ট হওয়া জরুরী। অন্য সম্পর্কটি হচ্ছে বান্দার দিকে। এ সম্পর্কের দিক থেকে তাকদীরের নির্ধারণ দুই প্রকার। একটির প্রতি মানুষ সন্তুষ্ট হয় এবং অন্যটির প্রতি মানুষ সন্তুষ্ট হয় না।

উদাহরণ স্বরূপ আত্মহত্যার বিষয়টি পেশ করা যেতে পারে। আত্মহত্যার বিষয়টিকে দুইভাবে মূল্যায়ন করা যেতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা এ বিষয়টি নির্ধারণ করেছেন, লিখেছেন, এটি সৃষ্টি করার ইচ্ছা করেছেন এবং নিহত ব্যক্তির বয়স ও হায়াত এ পর্যন্তই নির্ধারণ করেছেন। আত্মহত্যার সময় পর্যন্তই তার শেষ বয়স নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার এ ফায়ছালা ও নির্ধারণের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা জরুরী। আর যার পক্ষ হতে আত্মহত্যা নামক অপরাধটি সংঘটিত হয়, যে নিজেকে হত্যা করে, এটি উপার্জন করে, স্বীয় ইচ্ছায় এদিকে অগ্রসর হয় এবং স্বীয় কর্মের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নাফরমানী করে। এ দিক বিবেচনায় আমরা তাকে ও তার কাজকে ঘৃণা করি এবং তার প্রতি আমরা সন্তুষ্ট থাকি না।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, والتعمق والنظر في ذلك ذريعة الخذلان، وسُلم الحرمان ودرجة الطغيان ‘‘এ সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা করা অথবা অনুরূপ আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া ব্যর্থ হওয়ার কারণ, বঞ্চনার সিঁড়ি এবং সীমালংঘনের ধাপ’’।

কোনো কিছুর অনুসন্ধান করতে গিয়ে উহার গভীরতায় প্রবেশ করাকে مبالغة বলা হয়। তাকদীরের বিষয়ে বেশী অনুসন্ধান চালানো এবং উহার ব্যাপারে বেশী বেশী কথা বলা অপদস্ত হওয়ার কারণ। الذريعة শব্দের অর্থ হলো মাধ্যম ও কারণ। الذريعة, الدرجة এবং السلم পরস্পর সামর্থ বোধক। এমনি الخذلان, الحرمان এবং الطغيان পরস্পর সামর্থ বোধক শব্দ। তবে الخذلان (বিফল হওয়া) শব্দটি الظفر (সফল হওয়া) শব্দের বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর الطغيان শব্দটি الاستقامة শব্দের বিপরীত অর্থে ব্যবহৃত হয়।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, فالحذر كل الحذر من ذلك نظرا وفكرا ووسوسة অতএব সাবধান! তাকদীর সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা এবং কুমন্ত্রণা হতে পূর্ণ সতর্ক থাকুন।

আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট ছাহাবীদের একদল লোক এসে জিজ্ঞাসা করলো,

إِنَّا نَجِدُ فِي أَنْفُسِنَا مَا يَتَعَاظَمُ أَحَدُنَا أَنْ يَتَكَلَّمَ بِهِ قَالَ وَقَدْ وَجَدْتُمُوهُ قَالُوا نَعَمْ قَالَ ذَاكَ صَرِيحُ الْإِيمَانِ

‘‘আমরা আমাদের অন্তরে কখনো কখনো এমন বিষয় অনুভব করি, যা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করা আমাদের কাছে খুব কঠিন মনে হয়। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সত্যিই কি তোমরা এরকম পেয়ে থাক? তারা বললেন হ্যাঁ, আমরা এরকম অনুভব করে থাকি। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এটি তোমাদের ঈমানের স্পষ্ট প্রমাণ’’।[11]

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: এটি তোমাদের ঈমানের স্পষ্ট প্রমাণের লক্ষণ। এর মাধ্যমে তিনি ইঙ্গিত করেছেন, তারা এ ব্যাপারে কথা বলাকে খুব বড় অপরাধ মনে করতেন। ইমাম মুসলিম আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ হতে আরো বর্ণনা করেন যে, নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একদা ওয়াসওয়াসা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো। জবাবে তিনি বললেন, "تلك محض الإيمان" এটি শুধু ঈমানেরই আলামত।[12]

আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছেও একই কথা বলা হয়েছে। মানুষের মনের ওয়াসওয়াসা ও মানুষ তার মনের সাথে কথা বলা দুই জন মানুষের পরস্পরিক কথা-বার্তার মতই। সুতরাং শয়তানী ওয়াসওয়াসা দূর করার চেষ্টা করা এবং তার কুমন্ত্রণাকে বড় মনে করা সুস্পষ্ট ও খাঁটি ঈমানের লক্ষণ। এ ব্যাপারে এটিই ছিল ছাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারী তাবেঈদের তরীকা। তাদের যুগের পরে এমন এক শ্রেণীর লোক আগমন করলো, যারা অনুমানের উপর ভিত্তি করে তাকদীর সম্পর্কে ওয়াসওয়াসা সংক্রান্ত বিষয়াদি লিখে অনেক কাগজ-কালি নষ্ট করেছে। এগুলো নিছক সন্দেহ ছাড়া অন্য কিছু নয়। এরা এগুলো লিখে বিশাল পরিমাণ কাগজ কালো করার সাথে সাথে মানুষের অন্তরগুলো কালো করে ফেলেছে। সত্যকে ধ্বংস করার জন্য তারা অন্যায় বিতর্ক করেছে। এ জন্যই শাইখ ইলমুল কালাম, তাকদীর ও তাকদীর সংক্রান্ত বিষয়ে বেশী গবেষণা করার নিন্দা করেছেন। আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

«إِنَّ أَبْغَضَ الرِّجَالِ إِلَى اللَّهِ الأَلَدُّ الْخَصِمُ»

‘‘আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি সর্বাধিক ঘৃণিত, যে সর্বাধিক ঝগড়াটে’’।[13]

ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল রহিমাহুল্লাহ আমাদের কাছে আবু মুআবিয়া হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন আমর বিন শুআইব থেকে দাউদ বিন ইবনে আবী হিন্দ, আমর বিন শুআইব বর্ণনা করেন তার পিতা থেকে, তার পিতা বর্ণনা করেন তার দাদা থেকে। তিনি বলেন, একদিন রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘর থেকে বের হলেন। লোকেরা তখন তাকদীর সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক করছিল। বর্ণনাকারী বলেন, তাকদীর সম্পর্কে তর্ক করতে দেখে রাগে তার চেহারা এমন হলো যে মনে হচ্ছিল তাতে ডালিমের দানা ফুড়ে দেয়া হয়েছে। বর্ণনাকারী বলেন, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে বললেন, তোমাদের কী হলো? তোমরা আল্লাহর কিতাবের এক অংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে দাড় করাচ্ছো কেন? তোমাদের পূর্বের লোকেরা এ কারণেই ধ্বংস হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমি সেই মজলিসে উপস্থিত না হয়ে যতটা খুশী হয়েছি, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্য কোনো মজলিসে উপস্থিত না হতে পেরে ততটা খুশী হতে পারিনি।[14]

ইমাম ইবনে মাজাহ এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَاسْتَمْتَعْتُم بِخَلَاقِكُمْ كَمَا اسْتَمْتَعَ الَّذِينَ مِن قَبْلِكُم بِخَلَاقِهِمْ وَخُضْتُمْ كَالَّذِي خَاضُو

‘‘তোমরাও একইভাবে নিজেদের অংশের স্বাদ উপভোগ করেছো। যেমন তারা করেছিল এবং তারা যেমন অনর্থক বিতর্কে লিপ্ত ছিল তেমনি বিতর্কে তোমরাও লিপ্ত রয়েছো’’। (সূরা আত তাওবা: ৬৯) এ আয়াতে الخلاق শব্দটি النصيب তথা অংশ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারার ২০০ নং আয়াতে বলেন,

وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ

‘‘এ ধরনের লোকের জন্য আখেরাতে কোনো অংশ নেই’’। (সূরা আল বাকারা: ২০০)

অর্থাৎ তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা যেভাবে তাদের দুনিয়ার অংশ উপভোগ করেছিল, তোমরাও সেভাবে তোমাদের দুনিয়ার অংশ উপভোগ করেছো। তারা যেভাবে অন্যায় বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিল, তোমরাও সেভাবে অন্যায় বিতর্কে লিপ্ত হয়েছো। তোমরা ঐ দল বা শ্রেণী কিংবা প্রজন্মের ন্যায় অনর্থক বিতর্কে লিপ্ত হয়েছো। আল্লাহ তা‘আলা এখানে দুনিয়ার অংশ উপভোগ করা এবং অনর্থক বিতর্ককে একসাথে উল্লেখ করেছেন। কারণ এ দু’টি কারণেই মানুষের দ্বীন ধ্বংস হয়। অন্যায়-অপকর্ম এবং খারাপ আকীদার কারণেই মানুষের দ্বীন ও দুনিয়া ধ্বংস হয়। নফসের প্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণেই প্রথমটি সংঘটিত হয়। আর দ্বিতীয়টি সংঘটিত হয় দ্বীনের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করার কারণে।

ইমাম বুখারী আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«تَأْخُذَ أُمَّتِي مأَخْذِ الْقُرُونِ قَبْلَهَا شِبْرًا بِشِبْرٍ، وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ» قالوا: فَارِسَ وَالرُّومِ؟ قَالَ: فمَنِ النَّاسُ إِلاَّ أُولَئكَ»

‘‘আমার উম্মত পূর্ববর্তীদের চালচলন হুবহু অনুসরণ করবে। যেমন এক বিঘত অন্য এক বিঘতের এবং এক বাহু অন্য বাহুর সমান হয়। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, পূর্ববর্তী উম্মত বলতে পারসিক ও রোমানদের বুঝানো হয়েছে? তিনি বললেন, তাদেরকে ছাড়া আর কারা উদ্দেশ্য হতে পারে?’’[15]

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, এক পায়ের জুতা যেমন অন্য পায়ের অনুরূপ হয়, ঠিক তেমনি আমার উম্মতের উপর ঐরূপ অবস্থা আগমন করবে। এমনকি তাদের কেউ তার মায়ের সাথে প্রকাশ্যে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে থাকলে আমার উম্মতের মধ্যেও এমন লোক পাওয়া যাবে। আর বনী ইসরাঈলের লোকেরা তাদের দ্বীনের ব্যাপারে বিভক্ত হয়েছিল ৭২ দলে। আর এ উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। এর দ্বারা তিনি বিদআতী দল উদ্দেশ্য করেছেন। মাত্র একটি দল ব্যতীত বাকী সব দলই জাহান্নামে যাবে। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রসূলুল্লাহ! সেটি কোন্ জামা‘আত? তিনি তখন বললেন,

«مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى»

‘‘আমি যে হকের উপর আছি এবং আমার ছাহাবীগণ যে হকের উপর রয়েছে, যারা সে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, তারাই হবে সেই নাজাত প্রাপ্ত জামা‘আত।[16] ইমাম তিরমিযী এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।

আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

"تَفَرَّقَتِ [الْيَهُودُ] عَلَى إِحْدَى وَسَبْعِينَ فِرْقَةً أَوِ اثْنَتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً"، وَالنَّصَارَى مِثْلَ ذَلِكَ، وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِي عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً

ইহুদীরা বিভক্ত হয়েছিল ৭১ অথবা ৭২ দলে। খ্রিষ্টানরাও বিভক্ত হয়েছিল ৭১ অথবা ৭২ দলে। আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। ইমাম আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ এবং তিরমিযী এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেন, হাসান- ছহীহ।

মুআবীয়া বিন আবু সুফিয়ান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ইহুদী-খিৃষ্টানরা তাদের দ্বীনের ব্যাপারে বিভক্ত হয়েছিল ৭২ দলে। আর এ উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে।[17]

এখানে প্রবৃত্তির অনুসারী ও বিদ‘আতী দল উদ্দেশ্য। একটি দল ব্যতীত বাকীসব দল জাহান্নামে যাবে। আর এরা হলো জামা‘আত।

এ উম্মতের মধ্যে যে মাস‘আলাটি নিয়ে সবচেয়ে বড় মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো তাকদীরের মাস‘আলা। এতে রয়েছে অনেক দীর্ঘ আলোচনা।

[10]. এ মতাদর্শের মাধ্যমে তারা বান্দাকে মরা কাঠ ও পাথরে পরিণত করেছে। তাদের মতে বান্দাকে আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে ঘুরান বান্দা সেভাবেই ঘুরে। তার নিজস্ব কোন স্বাধীনতা ও এখতিয়ার নেই। তাই ভাল-মন্দ সবই একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতাতেই হয়। এ যেন শিশুর হাতে লাটিম এবং কাঠ-পস্নাষ্টিকের পুতুলের মতই। তারা আরো বলে, মানুষের পানাহার করা, ঘুমানো, আল্লাহর আনুগত্য করা এবং পাপাচারে লিপ্ত হওয়া বাতাস তুলা উড়িয়ে নেয়া এবং বন্যার পানি খড়কুটা ভাসিয়ে নেয়ার মতই। এগুলোতে বান্দার কোনো ইচ্ছা ও স্বাধীনতা নেই। শিশুর হাতে লাটিম শিশুর সম্পূর্ণ অনুগত ও বাধ্যগত, পুতুলকে শিশু যেভাবে নাচায় পুতুল সেভাবেই নাচে। বান্দাও আল্লাহর হাতে ঠিক সেরকমই। (নাউযুবিল্লাহ)

সম্ভবত এই জাবরীয়াদের মতবাদ থেকেই ভোগবাদ, সর্বেশ্বরবাদ, ওয়াহদাতুল উজুদ (সর্বেশ্বরবাদ) এবং বস্তাপঁচা সুফীবাদের সূচনা হয়েছে। কেননা সুফীবাদের মধ্যে যারা ওয়াহদাতুল উজুদে বিশ্বাসী তারা কোন কিছুকেই হারাম মনে করেনা। মদ, জিনা-ব্যভিচারসহ সকল প্রকার কবীরা গুনাহতে লিপ্ত হওয়াই তাদের জন্য বৈধ। তারা মনে করে সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়। বান্দার এখানে কোন ইচ্ছা ও স্বাধীনতা নেই।

তাদের এ কথা মানুষের সুস্থ বিবেক ও বোধশক্তির সুস্পষ্ট বিরোধী। তাদের কথা মানা হলে নাবী-রসূল পাঠানো অযথা ও নিরর্থক হয়ে যায়। তাদের কথা যদি সঠিকই হতো, তাহলে অতীতে যারা নাবী-রসূলদের দাওয়াত অস্বীকার করলো, তাদেরকে আল্লাহ তাআলা শাস্তি দিলেন কেন? কিয়ামতের দিন তাদেরকে জাহান্নামে দিবেন কেন? বান্দার কাজ অন্যের দ্বারা হলে তার কাজের জন্য মানুষ তাকেই দোষে কেন? তার ভাল কাজের প্রশংসা করে কেন? বান্দার কাজ যদি আল্লাহর দ্বারাই হয়ে থাকে, তাহলে কি বান্দাকে শাস্তি দেয়া কিংবা ছাওয়াব দেয়া অন্যায় ও নিরর্থক হয় না? অথচ আল্লাহ তাআলা যুলুম ও নিরর্থক কাজ করা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র।

মোটকথা জাবরীয়ারা আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমতা ও সবকিছুর উপর তার সার্বভৌমত্ব সাব্যস্ত করতে গিয়ে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে। তারা আল্লাহ তা‘আলার আদল-ইনসাফ ও ন্যায় বিচারের কথা বলতে গেলে ভুলেই গিয়েছে। তাদের কথা থেকে আল্লাহর একচ্ছত্র ক্ষমতার বিশেষণ সাব্যস্ত হলেও আল্লাহ তা‘আলার আরেকটি সিফাত অচল হয়ে যায়। আল্লাহ তা‘আলার আদল তথা ন্যায় বিচারের দাবী হচ্ছে, তিনি বান্দাদের উপর মোটেই যুলুম করেন না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ وَإِن تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا وَيُؤْتِ مِن لَّدُنْهُ أَجْرًا عَظِيمًا

‘‘আল্লাহ কারো উপর এক অণু পরিমাণও যুলুম করেন না। যদি কেউ একটি সৎকাজ করে, তাহলে আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে তাকে মহাপুরস্কার প্রদান করেন’’। (সূরা নিসা: ৪০) আল্লাহ তাআলা সুরা আনফালের ৫১ নং আয়াতে আরো বলেন,

ذَٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيكُمْ وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ

‘‘এ হচ্ছে সেই অপকর্মের প্রতিফল যা তোমরা আগেই প্রেরণ করেছো। আল্লাহ তার বান্দাদের উপর যুলুমকারী নন। এ রকম আরো অনেক আয়াত রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা যুলুম করা থেকে পবিত্র। সুতরাং বান্দাকে তার আদেশ বাস্তবায়ন করার স্বাধীনতা না দিয়ে এবং নিজের সম্পূর্ণ ইচ্ছা ও ক্ষমতাবলে পাপ কাজে বাধ্য করে শাস্তি দিলে ন্যায় বিচারের ব্যাঘাত ঘটে। তাই তিনি তার আদল বা ন্যায় বিচার ঠিক রাখার জন্য বান্দাকে স্বাধীনতা দিয়েছেন। যাতে করে স্বেচ্ছায় আনুগত্যের কাজ করে সে নিজেই পুরস্কার পায় আবার আনুগত্যের খেলাফ করলে সে নিজেই শাস্তি ভোগ করে। যাতে করে আল্লাহ তাআলার উপর যুলুম করার কোন অভিযোগ না আসে। (আল্লাহ তাআলাই অধিক অবগত রয়েছেন)

আল্লাহ তাআলার সবগুলো সিফাতকেই একসাথে সাব্যস্ত করতে হবে। একটি মানতে গিয়ে আরেকটি ছেড়ে দিলে চলবেনা। তাই আল্লাহর আদলের দাবী হলো তিনি কাজ করার বা না করার স্বাধীনতা ও এখতিয়ার না দিয়ে কাউকে শাস্তি দিবেন না। জাবরীয়াদের কথা মানতে গেলে আল্লাহর আদল সিফাতটি ছুটে যায়।

সুতরাং বান্দার কাজ প্রকৃতপক্ষে বান্দা তার নিজস্ব ইচ্ছাতেই করে। যদিও তা আল্লাহর সৃষ্টি। আমরা সবাই জানি যে, বান্দার হাতে অস্ত্র থাকলে বান্দাই সেটি চালায়। সে অস্ত্র দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে না কি ডাকাতি করবে অথবা নিরপরাধ মানুষকে খুন করবে এ ব্যাপারে সে স্বাধীন। তার হাতে পয়সা থাকলে সে পয়সা দিয়ে মদ ক্রয় করবে? না কুরআনের তাফসীর ক্রয় করবে? এটি তার ইচ্ছাধীন।

আপনি যদি আপনার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন: কোথায় যাচ্ছো? বন্ধু হয়ত জবাব দিবে জামাআতের সাথে নামায আদায়ের ইচ্ছায় ঘর থেকে বের হয়েছি কিংবা বলবে বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা করছি......। সুতরাং জানা গেল যে, বান্দার ইচ্ছাতেই বান্দা কাজ করে। আল্লাহ তাআলা বান্দার মধ্যে সেই ইচ্ছা সৃষ্টি করেছেন।

সুতরাং আল্লাহ তাআলা তাকে যে স্বাধীনতা দিয়েছেন, তার অপব্যবহার করলে এবং আল্লাহর মর্জির খেলাফ চললে সে নিন্দিত হয়। আর তার ইচ্ছার সঠিক ব্যবহার করলে এবং উহাকে আল্লাহর মর্জি মোতাবেক চালালে আল্লাহ তাআলা তাকে সৎপথে চলতে সাহায্য করেন। (আল্লাহ তাআলাই অধিক অবগত)

[11]. মুসলিম ১৩২, কিতাবুল ঈমান, অনুচ্ছেদ: অন্তরের ওয়াস্ ওয়াসা।

[12]. ছহীহ মুসলিম ১৩৩।

[13]. মুত্তাফাকুন আলাইহি, ছহীহ বুখারী ৭১৮৮, ছহীহ মুসলিম ২৬৬৮।

[14]. হাদীছটি ছহীহ। ইমাম আহমাদ এবং অন্যান্য ইমামগণ ইহা বর্ণনা করেছেন।

[15]. ছহীহ বুখারী ৭৩১৯।

[16]. হাসান: তিরমযী ২৬৪১, মুস্তাদরাক হাকীম ৪৪৪।।

[17]. ছহীহ, দেখুন, শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২৬৫।
আল্লাহর কর্ম সম্পর্কে এ কথা বলা যাবে না যে, তিনি কেন এটি করেছেন?

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, فمن سأل: لم فعل؟ فقد رد حكم الكتاب، ومن رد حكم الكتاب،كان من الكافرين ‘‘অতএব যে ব্যক্তি একথা জিজ্ঞেস করবে তিনি কেন এ কাজ করলেন? সে আল্লাহর কিতাবের হুকুম অমান্য করল। আর যে ব্যক্তি কিতাবের হুকুম অমান্য করল, সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হল’’।

আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান, তার কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান, তার রসূলসমূহের প্রতি ঈমান এবং তার ইবাদতের মূলভিত্তি হলো সবকিছু মাথা পেতে মেনে নেয়া এবং ইসলামী শরীয়াতের আদেশ-নিষেধসমূহের বিস্তারিত হেকমত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা না করা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এমন কোনো নাবীর উম্মতের কথা আমাদেরকে বলেননি, যারা তাদের নাবীর প্রতি ঈমান আনয়ন করা এবং নাবীর আনিত দ্বীনের প্রতি বিশ্বাস করার পর তাকে আদেশ-নিষেধের হেকমত সম্পর্কে বিস্তারিত জিজ্ঞাসা করেছিল। আল্লাহর পক্ষ হতে তিনি যেই দ্বীন প্রচার করেছেন, তারা হেকমতের কথা জিজ্ঞাসা করেনি। তারা যদি তাদের নাবীকে এগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতো, তাহলে তারা তাদের নাবীর প্রতি ঈমানদার হতে পারতো না। বরং তারা তাদের নাবীর প্রতি অনুগত হয়েছে এবং তার কথা মেনে নিয়েছে। তাদের নাবী যেসব আদেশ-নিষেধ ও বিধিবিধান নিয়ে এসেছেন, তা থেকে যেগুলোর হেকমত তারা জানতে পেরেছে, তা তো জানতে পেরেছেই। আর যেসব বিষয়ের হেকমত তারা জানতে পারেনি, তা মেনে নেয়ার জন্য ঐগুলোর হেকমত জানার অপেক্ষা করেনি। হেকমত সম্পর্কে জানাকে তারা নবুওয়াতের শানের অন্তর্ভুক্ত মনে করেনি। তাদের রসূলকে তারা হেকমত সম্পর্কে প্রশ্ন করার অনেক উর্ধ্বে মনে করতো।

ইঞ্জিলে বর্ণিত হয়েছে, হে বনী ইসরাঈল! তোমরা এ কথা বলো না যে, আমাদের রব কেনো এ আদেশ করেছেন? বরং তোমরা বলো, আমাদের রব কিসের আদেশ দিয়েছেন? এ জন্যই এ উম্মতের পূর্বসূরীগণ ছিলেন জ্ঞান-বুদ্ধির দিক দিয়ে অধিক পরিপূর্ণ। তারা তাদের নাবীকে কখনো এ প্রশ্ন করতেন না যে, আল্লাহ তা‘আলা কেন আমাদেরকে এ আদেশ করেছেন? কেন এ নিষেধ করেছেন? কেন এটি নির্ধারণ করেছেন? কেন তিনি এটি করেছেন? তারা ভালো করেই জানতেন যে, এ ধরণের প্রশ্ন করা ঈমান ও আনুগত্যের পরিপন্থি। তারা আরো জানতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, পরিপূর্ণরূপে আত্মসমর্পন না করলে ইসলামের উপর কারো অবস্থান সুদৃঢ় হয় না।

সুতরাং দ্বীনের সকল বিষয়ের প্রতি যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শনের প্রথম স্তর হলো উহাকে সত্যায়ন করা। অতঃপর তা বাস্তবায়ন করার প্রতি সুদৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করা। অতঃপর বাস্তবায়ন করতে কোনো প্রকার বিলম্ব না করা। সে সঙ্গে যেসব বিষয় দ্বীনের বিধিবিধান মেনে চলার প্রতিবন্ধক হয়, তা থেকে সাবধান থাকা। অতঃপর পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের বিষয়গুলো পালন করার ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া। হেকমত জানার অপেক্ষায় না থেকে আদেশগুলো বাস্তবায়ন করা। এমন যেন না হয় যে, হেকমত জানতে পারলে আদেশ বাস্তবায়ন করবে এবং তা জানতে না পারলে বাস্তবায়ন করা হতে বিরত থাকবে। কেননা এরূপ করা আনুগত্যের পরিপন্থি। এটি মানুষের দ্বীন পালনের পথে বিরাট বাধাও বটে।

ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ ইবনে আব্দিল বারের বরাত দিয়ে বলেন, ইলম অর্জনের আগ্রহ নিয়ে, নিজ থেকে মূর্খতা দূর করার জন্য এবং দ্বীন পালনের জন্য জরুরী মনে করে কোনো বিষয় জানার জন্য প্রশ্ন করলে কোনো অসুবিধা নেই। কেননা অজানা রোগের চিকিৎসাই হলো প্রশ্ন করা। যে ব্যক্তি বিদ্রোহী হয়ে এবং জানার আগ্রহ ছাড়াই প্রশ্ন করবে, তার জন্য কোনো প্রশ্ন করা জায়েয নেই।

ইবনুল আরাবী বলেন, আলেমের উচিত দলীলের ভিত্তিতে কথা বলা, গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত করা, ইজতেহাদের যোগ্যতা অর্জন করা এবং মাসায়েল নির্গত করার জন্য সহায়ক দলীল-প্রমাণ প্রস্ত্তত করা। তিনি আরো বলেন, নতুন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হলে অথবা যুদ্ধ-বিগ্রহ সংক্রান্ত কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে যথাযথ পন্থায় তা সমাধানের চেষ্টা করা হলে আল্লাহ তা‘আলা মুজতাহিদের জন্য সে ব্যাপারে সঠিক পন্থা উন্মুক্ত করে দিবেন। ইবনুল আরাবীর উক্তি এখানেই শেষ।

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘কোনো লোকের ইসলাম সুন্দর করার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে অনর্থক কথা বলা বাদ দেয়া’’।[1] ইমাম তিরমিযী এবং অন্যান্য ইমামগণ এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের হুকুম প্রত্যাখ্যান করবে তার কাফের হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কোনো দলীলের ভিত্তিতে যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের তাবীল করবে, তার জন্য সঠিক কথা বর্ণনা করা হবে। যাতে করে সে ভুল পথ বর্জন করতে পারে।

আল্লাহ তা‘আলা যা করেন, সে ব্যাপারে তাকে প্রশ্ন করা যাবে না। কেননা তার সকল কাজই হেকমত, রহমত ও ইনসাফে পরিপূর্ণ। তা যে শুধু প্রতাপশালী ও ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তা নয়। যে এ বলে থাকে জাহাম বিন সাফওয়ান ও তার অনুসারীরা। শাইখের উক্তি: ولا نكفر أحدا من أهل القبلة بذنب ما لم يستحله، ‘‘আহলে কিবলার কেউ গুনাহ করলেই আমরা তাকে কাফের বলি না, যতক্ষণ না সে হালাল মনে করে সেই গুনাহয় লিপ্ত হয়’’- এ অংশের ব্যাখ্যা করার সময় এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্বিরণ আসবে। ইনশা-আল্লাহ।

[1]. দেখুন, শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২৬৮।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৫ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে