আল্লাহ তা‘আলা আদম এবং তার সন্তানদের কাছ থেকে যে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন তা সত্য - ১

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

وَالْمِيثَاقُ الَّذِي أَخَذَهُ اللَّهُ تَعَالَى مِنْ آدَمَ وَذُرِّيَّتِهِ حَقٌّ

আল্লাহ তা‘আলা আদম এবং তার সন্তানদের কাছ থেকে যে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন তা সত্য।

........................................................

ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِن بَنِي آدَمَ مِن ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَىٰ ۛ شَهِدْنَا ۛ أَن تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَٰذَا غَافِلِينَ

‘‘আর হে নাবী! লোকদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই সময়ের কথা যখন তোমার রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলেছিল নিশ্চয়ই তুমি আমাদের রব, আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা আমি এ জন্য করেছি যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, আমরা তো এ কথা জানতাম না’’। (সূরা আল ‘আরাফ: ১৭২)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর এ মর্মে সাক্ষী বানিয়েছেন যে, আল্লাহ তাদের প্রভু ও মালিক। তিনি ব্যতীত আর কোনো সত্য মাবুদ নেই।[1]

আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে সমস্ত বনী আদমকে বের করার ব্যাপারেও অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এগুলোতে এও বলা হয়েছে যে, তাদের মধ্যকার জান্নাতীদেরকে জাহান্নামীদেরকে আলাদা করা হয়েছে। এগুলোর কোনোটিতে তাদের থেকে এ সাক্ষ্য নেয়ার কথা বলা হয়েছে যে, তাদের রব হলেন একমাত্র আল্লাহ।

ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল রহিমাহুল্লাহ আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা আরাফা দিবসে আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তার বংশধরকে বের করে অঙ্গীকার নিয়েছেন। তিনি তার পিঠ থেকে তার প্রত্যেক সন্তানকে বের করেছেন। অতঃপর তার সামনে ছড়িয়ে দিয়েছেন। অতঃপর তাদের সাথে আল্লাহ তা‘আলা সামনা সামনি হয়ে কথা বলেছেন। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছেন الست بربكم؟ ‘‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’’ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ

তারা সকলেই বলেছে, হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা আমি এ জন্য করেছি যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, আমরা তো এ কথা জানতাম না। অথবা তোমরা এ কথা বলতে না পারো যে, শির্কের সূচনা তো আমাদের বাপ-দাদারা আমাদের পূর্বেই করেছিলো এবং পরবর্তীকালে তাদের বংশে আমাদের জন্ম হয়েছে। তবে কি ভ্রষ্টাচারী লোকেরা যে অপরাধ করেছিল সে জন্য তুমি আমাদের পাকড়াও করছো? (সূরা আরাফ: ১৭২-১৭৩) ইমাম নাসাঈ, ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতিম এবং আবু আব্দুল্লাহ হাকেম মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেছেন। হাকেম হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেন, হাদীছের সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক ছহীহ। তারা তাদের কিতাবে হাদীছটি উল্লেখ করেননি।[2]

উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল রহিমাহুল্লাহ আরো বর্ণনা করেন যে, তাকে যখন উপরোক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, তখন তিনি বললেন, আমি শুনেছি, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা আদমকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ডান হাত দ্বারা তার পিঠ মাসেহ করে তার থেকে তার কিছু বংশধরকে বের করেছেন। তারপর তিনি বলেছেন, আমি এদেরকে সৃষ্টি করেছি জান্নাতের জন্য। তারা জান্নাতবাসী হওয়ার আমলই করবে।

তিনি দ্বিতীয়বার তার পিঠে হাত মারলেন। এবারও তার থেকে কিছু বংশধর বের করলেন। এদের সম্পর্কে বললেন যে, আমি তাদেরকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তারা জাহান্নামবাসীদের আমলই করবে। তখন এক ব্যক্তি বলল, তাহলে আমলের প্রয়োজন কী?

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো বান্দাকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন, তখন তাকে জান্নাতে যাওয়ার আমল করার তাওফীক দেন। সে জান্নাতবাসী হওয়ার কোনো একটি আমল করেই মৃত্যু বরণ করে। ফলে সে জান্নাতেই প্রবেশ করে। আর যখন তিনি জাহান্নামের জন্য কাউকে সৃষ্টি করেন, তাকে জাহান্নামবাসীদের আমলেই লাগিয়ে দেন। এতে করে সে জাহান্নামবাসীদের কোনো একটি আমল করেই মৃত্যু বরণ করে। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। ইমাম আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে আবী হাতিম, ইবনে জারীর এবং ইবনে হিববান তার ছহীহতে এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[3]

ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করলেন, তখন তার পিঠে হাত বুলালেন। এতে তার পিঠ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি হবে, তার সবগুলোই বের হয়ে আসলো। আর আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রত্যেকের কপালে দুই চোখের মাঝখানে উজ্জল একটি নূর স্থাপন করলেন। অতঃপর তাদেরকে আদম আলাইহিস সালামের সামনে পেশ করা হলো। আদম আলাইহিস সালাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আমার রব! এরা কারা? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, এরা হলো তোমার সন্তান। আদম তাদের মধ্যে এমন একজন লোকের কপালের নূর দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি তখন বললেন, হে আমার রব! এ লোকটি কে? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তিনি হলেন, আখেরী যামানায় তোমার বংশের একজন লোক। তার নাম দাউদ। আদম আলাইহিস সালাম বললেন, হে আমার রব! তার বয়স কত? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, ৬০ বছর। তিনি বললেন, হে আমার রব! আমার বয়স থেকে কেটে ৪০ বছর নিয়ে তার বয়স ১০০ করে দাও। আদমের বয়স যখন শেষ হলো তখন মালাকুল মাওত আসলেন। আদম তখন বললেন, আমার বয়স কি আরো ৪০ বছর অবশিষ্ট রয়ে যায়নি? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তুমি কি তোমার সন্তান দাউদকে ৪০ বছর দিয়ে দাওনি? আদম তা অস্বীকার করলেন। তাই তার সন্তানরাও অস্বীকার করে। আদম ভুলে গিয়েছিলেন তাই তার সন্তানেরাও ভুলে যায়। আদম আলাইহিস সালাম গুনাহ করেছিলেন, তাই তার সন্তানেরাও গুনাহ করে।[4] ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেন, এ হাদীছটি হাসান ছহীহ। ইমাম হাকেমও হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেন, হাদীছটি ছহীহ মুসলিমের শর্তে ছহীহ, তবে তিনি তা বর্ণনা করেননি।

ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল রহিমাহুল্লাহ আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

يقال للرجل من أَهْلِ النَّارِ يوم القيامة أرأيت لَوْ كان لَكَ مَا على الارْضِ مِنْ شَيْءٍ أكُنْتَ مفْتَدِيا بِهِ؟ قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: فيقول فَقَدْ أردت منك أَهْوَنَ مِنْ هَذَا قد أخذت عليك فِي ظهر آدَمَ؛ أَنْ لا تُشْرِكَ بِي شيئا فَأَبَيْتَ إِلا أن تشرك بي شيئا (بخارى:3334)

‘‘আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন জাহান্নামবাসীদের কাউকে জিজ্ঞাসা করবেন, দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ যদি তোমার হাসিল হয়ে যায়, তাহলে এ আযাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বিনিময় স্বরূপ তুমি কি সব সম্পদ দিয়ে দিবে? সে বলবে, হ্যাঁ। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ্ বলবেন, অথচ তুমি যখন আদমের পৃষ্ঠে ছিলে তখন আমি তোমার কাছে এর চেয়ে অতি সহজ একটি বিষয় চেয়েছিলাম। তা হচ্ছে আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। কিন্তু তুমি তা মানতে অস্বীকার করেছো এবং শির্কে লিপ্ত হয়েছো। হাদীছটি ইমাম বুখারী এবং মুসলিমও বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তার সবগুলো হাদীছ প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা আদমের পিঠ থেকে তার বংশধরকে বের করে জান্নাতীদের থেকে জাহান্নামীদেরকে আলাদা করেছেন। এখান থেকেই একদল লোক বলেছে, দেহ সৃষ্টি করার পূর্বেই রূহ সৃষ্টি করা হয়েছে।[5] তবে হাদীছগুলো এ কথা প্রমাণ করে না যে, দেহের পূর্বেই স্থায়ীভাবে রূহ সৃষ্টি করা হয়েছে। এগুলো সর্বোচ্চ যা প্রমাণ করে, তা হলো মহান স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা রূহগুলোর আকৃতি বানিয়েছেন, তাদের সৃষ্টি, বয়স এবং কর্ম নির্ধারণ করেছেন। অতঃপর উক্ত আকৃতিগুলো তাদের সৃষ্টির মূল উপাদান থেকে বের করেছেন। অতঃপর তিনি সেগুলোকে সেই উপাদানের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বনী আদমকে তার জন্য নির্ধারিত সময়ে বের হওয়ার বিষয়টি নির্ধারণ করেছেন। হাদীছগুলো প্রমাণ করে না যে, রূহগুলো স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি হয়ে আছে, সবগুলো রূহ এক স্থানে মজুদ আছে ও পরস্পর কথা বলছে। এ কথা প্রমাণ করে না যে, সেই স্থান থেকে দলে দলে বিভক্ত করে রূহগুলো দেহে পাঠানো হয়। যেমনটি বলেছেন ইমাম ইবনে হাযম রহিমাহুল্লাহ। এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছসমূহ এ কথার প্রমাণ বহন করে না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের নির্ধারণ অনুযায়ী একদলের পরে আরেক দল রূহ সৃষ্টি করেন। তাই পূর্বের নির্ধারণ অনুপাতেই সৃষ্টিজগতের মধ্যে সৃষ্টিসমূহ অস্তিত্বে আসে। সমস্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রেই আল্লাহ তা‘আলার এ নিয়ম। আল্লাহ তা‘আলা এগুলোর তাকদীর ও বয়স নির্ধারণ করেছেন এবং এগুলোর বিশেষণ-বৈশিষ্ট্য ও অবস্থা-আকার-আকৃতি দান করেছেন। অতঃপর তিনি পূর্বের তাকদীর অনুযায়ী অস্তিত্বে আনয়ন করেছেন।[6]

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীছগুলো আদিতে তাকদীর নির্ধারণ করার কথা প্রমাণ করে। এগুলো থেকে কিছু কিছু হাদীছ প্রমাণ করে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি হবে তাদের ছবি বের করে দেখিয়েছেন এবং সেগুলোকে দুইভাবে বিভক্ত করেছেন এবং জাহান্নামীদের থেকে জান্নাতীদেরকে আলাদা করেছেন।

আর সমস্ত আদম সন্তানকে আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করার পর তাদের থেকে স্বীকারোক্তি নেয়ার ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে দু’টি মাওকুফ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এখান থেকেই পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের অনেক আলেম বলেছেন এ সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হলো তাদেরকে তাওহীদের উপর সৃষ্টি করা। যেমনটি সূরা আরাফের ১৭৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: شَهِدْنَا ‘‘আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি’’। এর অর্থ হলো, তারা বলেছে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রভু। ইবনে আববাস ও উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে এ কথা বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আরো বলেন, একজনকে অন্যজনের উপর সাক্ষী বানিয়েছেন।

আবার কেউ কেউ বলেছেন, شَهِدْنَا ‘‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি’’, এটি হলো ফেরেশতাদের কথা। আর ওয়াক্ফ করতে হবে بلى শব্দের উপর। মুজাহিদ, যাহহাক এবং সুদ্দী এ মত পোষণ করেছেন। ইমাম সুদ্দী আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের এবং ফেরেশতাদের সম্পর্কে খবর দিয়েছেন যে, তারা বনী আদমের স্বীকৃতির ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন।[7]

তবে প্রথম অর্থটিই অধিক সুস্পষ্ট। অর্থাৎ তাওহীদের উপর তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাওহীদের দলীল-পত্র তাদের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। অন্য কথাগুলো সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। তবে তার পক্ষে কোনো দলীল নেই। আয়াতের বাহ্যিক অর্থও প্রথম অর্থকেই সমর্থন করে।

জেনে রাখা আবশ্যক যে, কতিপয় মুফাস্সির শুধু এ কথাই উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তার বংশধরদেরকে বের করে তাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করেছেন। অতঃপর তাদেরকে আদমের পীঠে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ইমাম ছা’লাবী, বগবী এবং অন্যান্য ইমামগণ এ কথাই বলেছেন। অন্যদিকে কতিপয় মুফাস্সির এ কথা উল্লেখ করেননি। তারা শুধু এতটুকু উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা কেবল রুবুবিয়াত ও উলুহিয়াতের দলীল-প্রমাণ পেশ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের মধ্যে যে বিবেক-বুদ্ধি স্থাপন করেছেন, তা তার রুবুবীয়াত এবং একত্বের সাক্ষ্য দিয়েছে। ইমাম যামাখশারী এবং অন্যান্য ইমামগণ এ কথা উল্লেখ করেছেন।

কোনো কোনো মুফাস্সির উভয় কথাই উল্লেখ করেছেন।[8] ওয়াহেদী, ফখরুদ্দীন রাযী, ইমাম কুরতুবী এবং অন্যান্য ইমাম এ কথা উল্লেখ করেছেন। তবে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী প্রথম মতটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দিকে সম্বন্ধ করেছেন। আর দ্বিতীয় কথাটিকে মুতাযেলাদের দিকে সম্বন্ধ করেছেন। নিঃসন্দেহে আয়াতটি প্রমাণ করে যে, অঙ্গীকার আদমের পিঠ থেকেই নেয়া হয়েছিল এবং তাতে এ কথাও পাওয়া যাচ্ছে যে, আদমের সন্তানদের পিঠ থেকেও অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল। তবে কতক হাদীছ প্রমাণ করে যে, আদমের পীঠ থেকে তার বংশধরদেরকে বের করা হয়েছিল এবং সেখানে তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী বানানো হয়েছিল। কতক হাদীছ এও প্রমাণ করে যে, সাক্ষী বানানো হয়েছে এবং ফায়ছালা করা হয়েছে যে, তাদের কতক যাবে জান্নাতে এবং কতক যাবে জাহান্নামে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমারের হাদীছে এ কথাই বর্ণিত হয়েছে। কিছু কিছু হাদীছে অঙ্গীকার গ্রহণ করা এবং আদমকে তার বংশধর দেখানোর কথা বর্ণিত হয়েছে। জান্নাত ও জাহান্নামের ফায়ছালা এবং সাক্ষী রাখার কথা বলা হয়নি। আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে এটি বর্ণিত হয়েছে।

প্রথম মতের প্রবক্তাগণ যেভাবে সাক্ষ্য নেয়ার কথা বলেছেন, তাদের মতের পক্ষের হাদীছটি আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে মাওকুফ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীছকে মুহাদ্দিছগণ যঈফ বলেছেন। ছহীহ ও বুখারীর শর্তে রচিত মুস্তাদরাক আল-হাকেম ব্যতীত অন্য কোনো ছহীহ গ্রন্থকার হাদীছটি বর্ণনা করেননি। আর আবু আব্দুল্লাহ আল হাকেম তার ছহীহ গ্রন্থে স্বীয় শর্তের ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শনের বিষয়টি সর্বজন বিদিত।

আর যে হাদীছে জান্নাতী ও জাহান্নামীদেরকে আলাদা করার কথা এসেছে, তাতে তাকদীরের দলীল রয়েছে। এর সমর্থনে রয়েছে অনেক হাদীছ। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের মধ্যে তাকদীর নির্ধারণের ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই। বিদআতী ও বাতিলপন্থী কাদারীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরাই এতে মতভেদ করেছে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ বলেছেন, অঙ্গিকার নেয়া হয়েছে আদমের সন্তানদের থেকে এবং সাক্ষী রাখা হয়েছে তাদেরকেই। তবে তাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের মধ্যে এ অঙ্গিকার নেয়ার ধরণ ও পদ্ধতি সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। আমি যদি নিজের উপর কিতাবটি সংক্ষিপ্ত করার শর্তারোপ না করতাম, তাহলে এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলো সবিস্তারে উল্লেখ করতাম। সেই সঙ্গে হাদীছগুলোর ব্যাপারে যত কথা বলা হয়েছে, যত বোধগম্য অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে এবং আয়াতে কারীমার শব্দসমূহে যত দলীল রয়েছে তাও উল্লেখ করতাম।

ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, এ আয়াতটির অর্থের মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে। তাই আলেমগণ এর ব্যাখ্যায় অনেক কথা বলেছেন। আমার পক্ষে যতদূর জানা সম্ভব হয়েছে, তার আলোকে তাদের কথাগুলো থেকে কিছুটা উল্লেখ করবো। কেউ কেউ বলেছেন, আয়াতের অর্থ হলো, আল্লাহ তা‘আলা বনী আদমের একজনের পৃষ্ঠদেশ থেকে অন্যজনকে বের করেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

وَأَشْهَدَهُمْ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ

‘‘এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, আমি কি তোমাদের রব নই? (সূরা আল আরাফ:১৭২)।

এর অর্থ হলো তিনি তাদেরকে তাওহীদের দলীল-প্রমাণ দেখিয়েছেন। কেননা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক লোকই জানে যে, তার এক প্রভু রয়েছেন। তিনি পবিত্র ও সমুন্নত। এটিই তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী বানানোর অর্থ।

যেমন আসমান-যমীনের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ ‘‘তারা বলল, আমরা অনুগত হয়ে আগমন করলাম’’। ইমাম কাফফাল এ মত পোষণ করেছেন এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা মানুষের দেহ সৃষ্টি করার আগেই তাদের রূহ সৃষ্টি করেছেন।[9]

রূহ সৃষ্টি করে তাতে এমন ইলম ও মারেফত স্থাপন করেছেন, যাতে তারা আল্লাহর সম্বোধন বুঝতে সক্ষম হয়েছে। এরপর ইমাম কুরতুবী এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলো উল্লেখ করেছেন। ইমাম কুরতুবীর কথা আরো বাকী রয়েছে।

বনী আদমের পৃষ্ঠদেশেই তাদের বংশধরকে বের করার পর তাদেরকে তাদের উপর সাক্ষী রাখার ব্যাপারে সর্বাধিক শক্তিশালী দলীল হলো বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছ। তাতে রয়েছে,

«فَقَدْ أردت منك أَهْوَنَ مِنْ هَذَا قد أخذت عليك فِي ظهر آدَمَ؛ أَنْ لا تُشْرِكَ بِي شيئا فَأَبَيْتَ إِلا أن تشرك بي شيئا»

হে বনী আদম! তুমি যখন আদমের পৃষ্ঠে ছিলে তখন আমি তোমার কাছে এর চেয়ে অতি সহজ একটি বিষয় চেয়েছিলাম। তা হচ্ছে আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। কিন্তু তুমি তা মানতে অস্বীকার করেছো এবং শির্কে লিপ্ত হয়েছো।[10]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, হে বনী আদম! আমি তোমার কাছে এর চেয়ে কম ও সহজতর একটি বিষয় চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তা করোনি। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এ হাদীছে আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদেরকে বের করার কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ প্রথম মতের প্রবক্তাগণ আদম সন্তানদেরকে যেভাবে বের করার কথা বর্ণনা করেছেন প্রথম বর্ণনাতে তা উল্লেখ করা হয়নি।

[1]. এ মতটিই অধিক বিশুদ্ধ এবং প্রাধান্যপ্রাপ্ত। আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে নয়; বরং তার সন্তানদের কতকের পৃষ্ঠদেশ থেকে কতককে বের করে ওয়াদা-অঙ্গিকার নিয়েছেন। উপরোক্ত আয়াতটি এ কথাকেই সমর্থন করে।

[2]. ছহীহ: আস ছহীহ ১৬২৩।

[3]. ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, অন্য হাদীছ দ্বারা সমর্থিত হওয়ার কারণে হাদীছটি সহীহ। দেখুন, শাইখের তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২২০।

[4]. ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: শাইখের তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২২১।

[5]. দার্শনিক ও মুতাযেলা সম্প্রদায় এ কথা বলেছে। তাদের মতে মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই তাদের রূহ আলাদাভাবে সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে রূহসমূহকে দেহের পূর্বে সৃষ্টি করে এক স্থানে রাখা হয়নি। বরং আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাদের সৃষ্টির উপাদান থেকে একবার বের করেছেন এবং আকৃতি দিয়েছেন। অতঃপর তাদের বয়স, আমল ইত্যাদি নির্ধারণ করে তাদের সৃষ্টির উপাদানের মধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

[6]. এটিই সালাফে সালেহীনদের মত।

[7]. অর্থাৎ রূহ জগতে ফেরেশতাগণ বনী আদমের স্বীকৃতির উপর সাক্ষী হয়েছে।

[8]. প্রথম কথাটি হলো আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তার বংশধরদেরকে বের করে অঙ্গিকার নিয়েছেন। আর দ্বিতীয় কথাটি হলো তাদেরকে তাওহীদের উপর সৃষ্টি করেছেন এবং তাওহীদের দলীল-পত্র দেখিয়েছেন।

[9]. আশায়েরা সম্প্রদায় এ মত পোষণ করেছে।

[10]. ছহীহ বুখারী হা/৬৫৫৭, মুসনাদে আহমাদ। এ হাদীছ প্রমাণ করে যে, আদমের পৃষ্ঠেই তার সন্তানদেরকে তাওহীদের দলীল-প্রমাণ দেখানো হয়েছে এবং সম্বোধন করা হয়েছে। পৃষ্ঠদেশ থেকে বাহিরে আনয়ন করা হয়নি।
আল্লাহ তা‘আলা আদম এবং তার সন্তানদের কাছ থেকে যে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন তা সত্য - ২

অতঃপর ইমাম ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ বলেন, প্রথম মতটি অর্থাৎ যদি বলা হয় প্রকৃত পক্ষেই আল্লাহ তা‘আলা আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তার বংশধরকে বের করেছেন এবং তাদেরকে পরস্পরের উপর সাক্ষী বানিয়েছেন, তাহলে এতে দু’টি আশ্চর্যজনক বিষয় আবশ্যক হয়।

(১) সমস্ত মানুষ তখন কথা বলেছে এবং রবের প্রতি ঈমানের স্বীকৃতি দিয়েছে, এর মাধ্যমে তাদের উপর কিয়ামতের দিন হুজ্জত কায়েম হবে।[11]

(২) আয়াতটি প্রমাণ করে যে, আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকেই তার বংশধরকে বের করা হয়েছে।

আসলে একাধিক কারণে আয়াত তা প্রমাণ করে না।

(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছেন। আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করা হয়েছে, এ কথা বলা হয়নি।

(২) তিনি বলেছেন যে, তাদের বংশধর বের করেছেন। তার পৃষ্ঠ দেশ থেকে বের করা হয়েছে, -এটি বলা হয়নি। এটিকে আরবী ব্যাকরণের পরিভাষায় بدل البعض অথবা بدل الاشتمال বলা হয়। আর বাদলুল ইশতেমাল হওয়াই অধিক উত্তম।

(৩) আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, তাদের বংশধরদেরকে বের করেছেন। তার বংশধরদেরকে বের করা হয়েছে, এ কথা বলা হয়নি।[12]

(৪) আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ ‘‘তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী বানিয়েছেন’’। সাক্ষীদাতার জন্য সাক্ষ্যের বিষয় স্মরণ রাখা আবশ্যক। মানুষ শুধু দুনিয়াতে আগমন করার পর যে সাক্ষ্য দেয় তাই স্মরণ করে। এর আগের সাক্ষ্যের কথা তো কেউ মনে করছে না।

(৫) আল্লাহ তা‘আলা এখানে সাক্ষ্য দেয়ার হিকমত সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন। আর তা হলো এর মাধ্যমে তিনি কিয়ামতের দিন মানুষের উপর দলীল কায়েম করবেন। যাতে কিয়ামতের দিন তারা এ কথা বলতে না পারে, إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ ‘‘আমরা তো এ কথা জানতাম না’’। অথচ দলীল-প্রমাণ তো কায়েম করা হবে রসূলগণকে পাঠানোর মাধ্যমে এবং সেই ফিতরাতের মাধ্যমে যার উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا

‘‘সুসংবাদ দাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী রসূলগণকে প্রেরণ করেছি, যাতে রসূলগণের পরে আল্লাহর প্রতি অপবাদ আরোপ করার মত কোন অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে। আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা আন নিসা ৪:১৬৫)

(৬) এ আয়াতে তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে কিয়ামতের দিন এ কথা না বলে যে, إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ ‘‘আমরা তো এ কথা জানতাম না’’ (সূরা আরাফ: ১৭২)। আর এটি জানা কথা যে, আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করা এবং সে সময় তাদের থেকে অঙ্গিকার নেয়ার কথা কোনো মানুষই জানে না।[13] সুতরাং কেউ তো এটি স্মরণ করছে না।

(৭) আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ

‘‘অথবা তোমরা এ কথা বলতে না পারো যে, শির্কের সূচনা তো আমাদের বাপ-দাদারা আমাদের পূর্বেই করেছিলো এবং পরবর্তীকালে তাদের বংশে আমাদের জন্ম হয়েছে। তবে কি বাতিলপন্থীরা যে অপরাধ করেছিল সে জন্য তুমি আমাদের ধ্বংস করছো?’’। (সূরা আল ‘আরাফ ৭ : ১৭৩)

এখানে সাক্ষ্য গ্রহণের মধ্যে দু’টি হিকমত উল্লেখ করা হয়েছে।

(ক) যাতে তারা অজ্ঞতার অযুহাত পেশ করতে না পারে।

(খ) বাপ-দাদাদের তাকলীদ তথা অন্ধ অনুসরণের অযুহাতও যেন পেশ করতে না পারে। সুতরাং যে ব্যক্তি গাফেল, তার কোনো অনুভূতি থাকে না। আর মুকাল্লিদ অন্যের অনুসরণ করে। এ দু’টি হিকমত বাস্তবায়ন করার জন্য রসূল পাঠানো এবং তাওহীদের উপর সৃষ্টি করে দলীল-প্রমাণ কায়েম করার প্রয়োজন ছিল।[14]

(৮) আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ ‘‘তবে কি বাতিলপন্থীরা যে অপরাধ করেছিল সে জন্য তুমি আমাদের ধ্বংস করছো?’’ (সূরা আরাফ:১৭৩)।

অর্থাৎ বাপ-দাদাদের কুফুরী ও শির্ক করার কারণে যদি আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে শাস্তি দেন তাহলে তারা অবশ্যই বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! বাতিলপন্থীরা যে অপকর্ম করেছে, তার কারণে কি তুমি আমাকে শাস্তি দিবে? আমরা তো বাতিলপন্থী নই। বরং আমরা তো কেবল মুকাল্লিদ। আমাদের বাপ-দাদারা শির্ক করেছে। আমরা ছিলাম তাদের পরবর্তী বংশধর। তাই আমরা শির্কের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করেছি। সুতরাং অন্যের অপরাধের কারণে কিভাবে আমাদেরকে শাস্তি দিবেন?

অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাকলীদের কারণে কাউকে শাস্তি দিবেন না। তিনি কেবল শাস্তি দিবেন রসূলদের বিরোধীতা করার কারণে এবং তাদের প্রতি মিথ্যারোপ করার কারণে। আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি জনপদগুলোকে যুলুম সহকারে ধ্বংস করেন না যতক্ষণ না সেখানকার অধিবাসীরা প্রকৃত সত্য সম্পর্কে অবগত হয়’’। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা রসূল পাঠানোর মাধ্যমে সতর্ক করা এবং সকল প্রকার ওযর-অযুহাত দূর করার পরই জনপদগুলোকে ধ্বংস করেন।

(৯) আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা দুনিয়ার প্রত্যেক মানুষ থেকেই এ সাক্ষ্য ও স্বীকারোক্তি নিয়েছেন যে, তিনি তার প্রভু ও স্রষ্টা। তার কিতাবের অনেক জায়গাতেই তিনি এ স্বীকারোক্তি ও সাক্ষ্যের দ্বারা দলীল-পত্র কায়েম করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ

‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তবে অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ্। (সূরা লুকমান: ২৫)

এ সাক্ষ্য ও স্বীকারোক্তির বিষয়কেই তাদের উপর তাদের সাক্ষী বানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রসূলগণ এ সাক্ষ্যের কথাই তাদের জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قَالَتْ رُسُلُهُمْ أَفِي اللَّهِ شَكٌّ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ

‘‘তাদের রসূলগণ বলেছে, আল্লাহর ব্যাপারে কি সন্দেহ আছে, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা?’’ (সূরা ইবরাহীম: ১০)

(১০) আল্লাহ তা‘আলা মানুষের অন্তরে তার অস্তিত্ব ও তাওহীদে রুবুবীয়াতের সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ ও নিদর্শন স্থাপন করেছেন। এ দলীলগুলো আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ ও উলুহীয়াতকে আবশ্যক করে। আল্লাহ তা‘আলার আয়াত ও নির্দশনগুলো এ রকম। এগুলো তাওহীদের প্রমাণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَكَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ وَلَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

‘‘এভাবে আমি নিদর্শনসমূহ সুষ্পষ্টভাবে পেশ করে থাকি। আর এ জন্য করে থাকি যাতে তারা ফিরে আসে’’।[15] (সূরা আল আরাফ: ১৭৪)

এখানে নিদর্শন বলতে ঐ ফিতরাত উদ্দেশ্য, যার উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। প্রত্যেক সন্তানই ফিতরাত তথা তাওহীদের উপর জন্মগ্রহণ করে। এ ফিতরাত ব্যতীত অন্য কিছুর উপর কোনো শিশুই জন্ম গ্রহণ করে না। এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। এতে কোনো রদবদল নেই। ইতিপূর্বে এ বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।

ইমাম ইবনে আতীয়া এবং অন্যান্য ইমামগণ এ অর্থটি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু তারা ঐ হাদীছগুলোর প্রকাশ্য অর্থ স্বীকার করতে ইতস্তবোধ করেছেন, যাতে সুস্পষ্টভাবেই ঘোষণা করা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত বনী আদমকে তাদের বাপদাদাদের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করেছেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী বানিয়েছেন। অতঃপর যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শাইখ আবু মানসুর মাতুরীদি রহিমাহুল্লাহ শারহুত্ তাবীল গ্রন্থে এ উভয় মতই উল্লেখ করেছেন। উভয় মত উল্লেখ করার পর তিনি দ্বিতীয় মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। অর্থাৎ রূহ জগতে আল্লাহ তা‘আলা বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদেরকে বের করে তাদের থেকে সাক্ষ্য ও স্বীকারোক্তি নেয়ার মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত কথা বলার পর তিনি এ দিকেই ঝুকে পড়েছেন।

নিঃসন্দেহে তাওহীদে রুবুবীয়াতের স্বীকৃতি প্রদান করা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব। তাদের মধ্যে শির্ক প্রবেশ করে বাইরে থেকে। সন্তানেরা বাপদাদাদের তাকলীদ করেই শির্ক করে থাকে। কিয়ামতের দিন যখন তারা এ বলে ঝগড়া করবে যে, তাদের বাপদাদারা শির্ক করেছিল। আর তারা বাপদাদাদের অনুসরণ করেই শির্ক করেছে। যেমন পানাহার, বাসস্থান ও পোষাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে সন্তানেরা পিতাদের অনুসরণ করে থাকে তখন তাদেরকে বলা হবে, তোমরা তো স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করতে। আরো স্বীকার করতে যে, আল্লাহ তা‘আলাই তোমাদের রব, তার কোনো শরীক নেই। তোমরা নিজেদের উপর নিজেরাই সাক্ষ্য দিয়েছো। কোনো মানুষ নিজের উপর কোনো বিষয়ের স্বীক…ৃত প্রদান করাকেই সাক্ষ্য প্রদান বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَىٰ أَنفُسِكُمْ

‘‘হে ঈমানদারগণ! ন্যায়ের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত এবং আল্লাহর জন্য সাক্ষী হয়ে যাও, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে হয়’’। (সূরা আন নিসা: ১৩৫)

এখানে এভাবে বলা উদ্দেশ্য নয় যে, আমি নিজের উপর এ সাক্ষ্য দিচ্ছি। বরং যে ব্যক্তি কোনো বিষয় স্বীকার করলো, সে নিজের উপর তার সাক্ষ্য দিল। সুতরাং তাদেরকে বলা হবে, তোমরা যেহেতু তাওহীদ সম্পর্কে জানতে পেরেছো, তার স্বীকৃতি প্রদান করেছো এবং তার উপর নিজেরাই সাক্ষ্য দিয়েছো, তাই সে স্বীকৃতি থেকে সরে এসে শির্কের দিকে গেলে কেন? শুধু তাই নয়; জ্ঞাত ও নিশ্চিত বিষয়কে ছেড়ে অবাস্তব জিনিসের দিকে কেন গেলে? তোমরা কেন এমন লোকদের তাকলীদ করে শির্ক করতে গেলে, যাদের সাথে কোনো দলীল-প্রমাণ নেই। তবে পার্থিব জীবনের বিষয়াদির কথা ভিন্ন। এতে বাপদাদাদের তাকলীদ করাতে কোনো অসুবিধা নেই। দুনিয়াবী বিষয়াদির ক্ষেত্রে বাপদাদাদের তাকলীদ করার মধ্যেই সন্তানদের কল্যাণ রয়েছে। তবে তাদের তাকলীদ করে শির্ক করা মোটেই উচিত হয়নি। কেননা তোমাদের কাছে তাওহীদের ইলম ছিল এবং তোমরা নিজেরাই নিজেদের উপর সাক্ষ্য দিয়েছিলে যে আল্লাহই তোমাদের রব। এ সাক্ষ্য দেয়াই শির্কের অসারতাকে সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করে দেয়। সেই সঙ্গে তোমাদের অবস্থা আরো সুস্পষ্ট করে দেয় যে, তোমরা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছো।

শিশু তার পিতা-মাতা থেকে যে দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তা হলো প্রশিক্ষণ এবং অভ্যাসগত দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থা। দুনিয়ার কল্যাণ অর্জন ও স্বার্থ লাভ করার জন্যই শিশু তার পিতা-মাতার অনুসরণ করে। কেননা শিশুর জন্য একজন পরিচর্যাকারী ও প্রশিক্ষক আবশ্যক। পিতা-মাতাই শিশুর পরিচর্যা করার সর্বাধিক উপযোগী। এ জন্যই ইসলামী শরীয়তের বিধানে দুনিয়ার বাহ্যিক হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে শিশু পিতা-মাতার দ্বীনের অনুগামী হয়ে থাকে। বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী এ দ্বীনের উপর কোনো শিশু মারা গেলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে শাস্তি দিবেন না। তবে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর সে বিবেকবান হলে এবং তার উপর দলীল-প্রমাণ কায়েম করা হলে তার উপর অহী এবং বিবেক-বুদ্ধি ভিত্তিক দ্বীনের অনুসরণ করা আবশ্যক। বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে জানা যায় যে, নাবী-রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাওহীদের যে দ্বীন নিয়ে এসেছেন এবং আদম সন্তানদের পৃষ্ঠদেশে তাদের থেকে তাওহীদের যেই স্বীকৃতি নিয়েছেন, তাই সঠিক দ্বীন।

ঐ দিকে পিতা-মাতা যদি সঠিক দ্বীনের অনুসারী হয়ে থাকে, তাহলে শিশুও সঠিক দ্বীনের অনুসারী হয়। যেমন সত্যবাদী ইউসুফ তার পিতাদের দ্বীনের অনুসারী ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَاتَّبَعْتُ مِلَّةَ آبَائِي إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ

‘‘আমি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের দ্বীন অনুসরণ করেছি’’ (সূরা ইউসুফ:৩৮)। ইয়াকুব আলাইহি সালাম তার সন্তানদেরকে বলেছেন,

مَا تَعْبُدُونَ مِن بَعْدِي قَالُوا نَعْبُدُ إِلَٰهَكَ وَإِلَٰهَ آبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِلَٰهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ

‘‘আমার পর তোমরা কার ইবাদত করবে? তারা সবাই জবাব দিল আমরা সেই এক আল্লাহর ইবাদত করবো, যাকে আপনি এবং আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল ও ইসহাক ইলাহ হিসেবে মেনে এসেছেন আর আমরা তারই অনুগত মুসলিম’’। (সূরা আল বাকারা: ১৩৩) তবে শিশুর বাপ-দাদারা যদি নাবী-রসূলদের বিরোধী হয়, তাহলে শিশুর উপর বাপদাদাদের অনুসরণ পরিত্যাগ করে নাবী-রসূলদের অনুসরণ করা আবশ্যক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَوَصَّيْنَا الْإِنسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْنًا وَإِن جَاهَدَاكَ لِتُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا

‘‘আমি মানুষকে নিজের পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু যদি তারা তোমার উপর চাপ দেয় যে, তুমি এমন কিছুকে আমার সাথে শরীক করো যাকে তুমি আমার শরীক হিসেবে জানো না, তাহলে তাদের আনুগত্য করো না’’। (সূরা আনকাবুত: ৮)

সুতরাং যে ব্যক্তি না জেনে ও না বুঝে বাপদাদার অনুসরণ করলো এবং তার নিকট সুবিদিত সত্য সুস্পষ্ট হওয়ার পরও তা থেকে সরে দাঁড়ালো না সে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করলো। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ

‘‘তাদের যখন বলা হয়, আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেছেন তা মেনে চলো, জবাবে তারা বলে আমাদের বাপ-দাদাদের যে পথের অনুসারী পেয়েছি আমরা সে পথেই চলবো। যদিও তাদের বাপ-দাদাদের বিবেক-বুদ্ধি ছিল না এবং তারা সুপথগামী ছিল না তবুও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে?’’ (সূরা বাকারা: ১৭০)

যারা ইসলামী সমাজে এবং ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের অনেকের অবস্থা ঠিক এ রকম। তাদের কেউ তার পিতার অনুসরণ করে। তার বাপ-দাদারা যে আক্বীদাহ ও মাযহাবের অনুসরণ করেছে, সেও তার অনুসরণ করতে চায়। যদিও সে আক্বীদাহ ও মাযহাব ভুল হয়ে থাকে এবং তার বাপদাদারা তাতে পূর্ণ প্রজ্ঞার উপর না থাকে। বরং তারা শুধু মুসলিমদের ঘরে জন্মগ্রহণকারী হিসাবে মুসলিম ছিল। জেনে-বুঝে ও দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করে তারা দ্বীন ইসলামকে পালন করেনি। এ ধরণের লোককে যখন কবরে জিজ্ঞাসা করা হবে, من ربك তোমার প্রভু কে? জবাবে সে বলবে, হায় আফসোস! আমি তো এটি জানি না। লোকদেরকে একটি কথা বলতে শুনতাম। আমিও তা বলেছি।

সুতরাং বুদ্ধিমান লোকের উচিত এবিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা, নিজেকে নসীহত করা এবং আল্লাহ তা‘আলার পথে চলা। সে যেন গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে দেখে এবং নির্ধারণ করে সে কোন্ দলের অন্তর্ভুক্ত? আল্লাহ তা‘আলাই তাওফীক প্রদানকারী। তাওহীদে রুবুবীয়াত সাব্যস্ত করার জন্য কোনো প্রকার দলীল-প্রমাণের প্রয়োজন হয়না। মানুষের জন্মগত স্বভাবের মধ্যেই তাওহীদে রুবুবীয়াত ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। স্রষ্টার নিদর্শন ও তাওহীদের দলীল-প্রমাণ খুঁজে বের করার জন্য মানুষের সর্বপ্রথম দৃষ্টি দেয়া দরকার তার নিজের মধ্যে। সে ছিল এক সময় নগণ্য শুক্রবিন্দু। যা বের হয়েছে পিতার পৃষ্ঠদেশ ও মাতার বক্ষদেশ থেকে। অর্থাৎ মায়ের বুকের হাড্ডী থেকে। অতঃপর সেই শুক্রবিন্দু তিনটি অন্ধকারের মধ্যে একটি সংরক্ষিত স্থানে রাখা হয়েছে। সেখানে পিতা-মাতা এমনকি সমস্ত সৃষ্টিকূলের কারো তদবীরের প্রয়োজন হয়নি। এ শুক্রবিন্দুটি যদি মায়ের গর্ভাশয়ের বাইরে কোনো পাত্রের মধ্যে কিংবা সংরক্ষিত স্থানে রেখে তাকে মানব আকৃতি প্রদান করার জন্য দুনিয়ার সমস্ত জ্ঞানী লোক এক জোট হয়ে চেষ্টা করতো, তাহলেও তারা তাকে মানব আকৃতি দিতে সক্ষম হতো না। এতে প্রকৃতির কোনো প্রভাব নেই।[16] সম্পূর্ণরূপে স্রষ্টার কুদরতই এখানে কার্যকর হয়। কেননা শুক্রবিন্দু প্রথমে সম্পূর্ণ মৃত থাকে। এতে কোনো জীবন থাকে না। আসলে মৃতের কোনো কাজ ও তদবীর থাকে না। অর্থাৎ মৃত শুক্রবিন্দু থেকে সুন্দর আকৃতির মানুষ তৈরী হওয়া কিংবা প্রাণী জগৎ তৈরী হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

যে ব্যক্তি মাতৃগর্ভের শুক্রকীট নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে এবং এক স্তর থেকে অন্য স্তরে তার রূপান্তরের বিষয়টির প্রতি গভীর দৃষ্টি দিবে সে এর মধ্যে তাওহীদে রুবুবীয়াতের দলীল-প্রমাণ খুঁজে পাবে। তাওহীদে রুবুবীয়াই বান্দাকে তাওহীদে উলুহীয়াতের দিকে নিয়ে যায়।সুতরাং জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধির দলীলের মাধ্যমে যখন কেউ জানতে পারবে যে, তার এমন এক মহান প্রভু রয়েছেন, যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন সে তাকে বাদ দিয়ে কিভাবে অন্যের ইবাদত করতে পারে!! আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে বান্দা যতই চিন্তা-গবেষণা করবে, ততই স্রষ্টার প্রতি তার ইয়াকীন বৃদ্ধি পাবে এবং তাওহীদ সম্পর্কেও তার গভীর জ্ঞান লাভ হবে। বান্দা নিশ্চিতভাবেই জানতে পারবে যে, আল্লাহ ছাড়া তার আর কোনো প্রভু নেই এবং তিনি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই। আল্লাহ তা‘আলাই তাওফীক দাতা।

[11]. আসলে এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। মানুষ তখন কথা বলেছে এবং ঈমানের স্বীকৃতি দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা এ কথা কুরআনে বলেছেন। সহীহ হাদীছে এর ব্যাখ্যা এসেছে। আল্লাহ তাআলা রূহ সৃষ্টি করেছেন এবং কথা বলিয়েছেন। যেমন তিনি অন্যান্য সৃষ্টিকে কথা বলিয়ে থাকেন।

[12]. এ তিনটি কথার মাধ্যমে ইমাম ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, আদমের সন্তানদের পৃষ্ঠদেশ থেকেই তাদের বংশধরকে বের করা হয়েছে। আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে নয়। কেননা বহুবচনের শব্দের মাধ্যমে উল্লেখ করার কারণে বুঝা যায় যে, পিতাদের পৃষ্ঠদেশ থেকে পুত্রদেরকে বের করা হয়েছে। এভাবে বনী আদমের সর্বশেষ লোকসমূহকে বের করা হয়েছে। আর যদি বলা হতো আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করা হয়েছে, তাহলে শুধু আদম থেকে সরাসরি জন্মগ্রহণ করেছে, তাদেরকেই বুঝানো হতো। কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী বংশধরদেরকে বুঝানো হতো না।

[13]. দু’ভাবে এ কথার জবাব দেয়া যেতে পারে। এখানে বের করা ও সাক্ষী বানানো সম্পর্কে গাফেল থাকলেও তাওহীদ সম্পর্কে তারা গাফেল ছিল না। বের করা ও সাক্ষী বানানোর উদ্দেশ্য এটিই। সুতরাং কিয়ামতের দিন তারা যেন এ কথা বলতে না পারে যে, আমরা তাওহীদ সম্পর্কে গাফেল ছিলাম। কেননা তাদের সৃষ্টিগত স্বভাবের মধ্যেই তাওহীদ রয়েছে। দ্বিতীয় জবাব হলো, দুনিয়ার জীবনে বের করা ও তাওহীদের স্বীকৃতি প্রদানের কথা মনে না থাকলেও আখেরাতে স্মরণ করা এবং স্বীকার করা অসম্ভব নয়। অথবা অহংকারের কারণে তাদের কেউ কেউ অস্বীকার করতেও পারে। অথচ উচিত ছিল স্মরণ করা।

[14]. বস্তুত রসূল পাঠানো, তাওহীদের উপর সৃষ্টি করা এবং সাক্ষ্য নেয়া সবগুলোই ধর্তব্য। এখানে কোনো পারস্পরিক বৈপরিত্য নেই।

[15]. অর্থাৎ বিদ্রোহ ও বিকৃতি -বিভ্রান্তির নীতি পরিত্যাগ করে বন্দেগী ও আল্লাহর আনুগত্যের আচরণের দিকে যেন ফিরে আসে।

[16]. শাইখ এখানে ঐসব প্রকৃতি বাদীদের জবাব দিয়েছেন, যারা স্র্ষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। যারা মনে করে সবকিছু প্রকৃতির নিয়মে কিংবা এমনিতেই সৃষ্টি হয়। শাইখ এখানে তাদের জবাব দিয়েছেন। মাতৃগর্ভে শুক্রকীট থেকে সুন্দর মানুষ তৈরীর বিষয়টি প্রকৃতিবাদীদের ভ্রান্ত ধারণাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়। এটি মহান স্রষ্টার সীমাহীন কুদরত এবং সুনিপুন কৌশলের প্রমাণ বহন করে। তিনটি অন্ধকারের মধ্যে তুচ্ছ মৃত একটি শুক্রকীট থেকে এত সুন্দর গঠনের মানুষের সৃষ্টিকে যারা প্রকৃতির নিয়মের দিকে সম্বন্ধ করে, তারা মূর্খ ছাড়া আর কিছু নয়। মূলত গ্রীক দর্শন থেকে প্রকৃতি বাদের ধারণা এসেছে। মূর্খ-অজ্ঞ মূর্তিপূজক গ্রীক জাতিই সর্বপ্রথম সৃষ্টিজগতের সবকিছুকে প্রকৃতির দিকে সম্বন্ধ করার ধারণা উদ্ভাবন করে।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে