নিশ্চয় মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নির্বাচিত বান্দা, মনোনীত নাবী এবং পছন্দনীয় রসূল।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

وَإِنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ الْمُصْطَفَى وَنَبِيُّهُ الْمُجْتَبَى وَرَسُولُهُ المرتضى

নিশ্চয় মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার নির্বাচিত বান্দা, মনোনীত নাবী এবং পছন্দনীয় রসূল।

.........................................................

ব্যাখ্যা: ইস্তেফা-নির্বাচিত করা, ইজতেবা-মনোনীত করা এবং ইরতেযা-পছন্দ করা এ তিনটি শব্দের অর্থ প্রায় একই রকম। জেনে রাখা দরকার যে, আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে সৃষ্টির মধ্যে পূর্ণতা তৈরী হয়। বান্দার ইবাদত যতই বৃদ্ধি পাবে, তার পূর্ণতা তত বৃদ্ধি পাবে এবং তার মর্যাদা ততই উন্নীত হবে।

যে ব্যক্তি এ ধারণা করবে, কোনো কোনো মাখলুক বা অলী-আওলীয়া আল্লাহর ইবাদতের গন্ডির আওতামুক্ত এবং ইবাদতের শৃঙ্খল থেকে বের হয়ে আসার মাধ্যমে অধিকতর পূর্ণতা অর্জিত হয়, সে সর্বাধিক মুর্খ ও পথভ্রষ্ট।[1] আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের ব্যাপারে বলেন,

وَقَالُوا اتَّخَذَ الرَّحْمَٰنُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ عِبَادٌ مُّكْرَمُونَ

‘‘এরা বলে, করুণাময় আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। সুবহানাল্লাহ! তারা তো তার মর্যাদাশালী বান্দা’’। (সূরা আম্বীয়া: ২৬) এ রকম আয়াত আরো অনেক রয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা অনেক ফযীলতপূর্ণ ঘটনা ও স্থানে তার নাবীকে ‘আবদ’ নামে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা মিরাজের ঘটনায় বলেন,

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

‘‘পবিত্র তিনি যিনি নিয়ে গেছেন এক রাতের কিয়দাংশে নিজের বান্দাকে মাসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশকে আমি করেছি বরকতময়। যাতে আমি তাকে নিজের কিছু নিদর্শন দেখাই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَأَنَّهُ لَمَّا قَامَ عَبْدُ اللَّهِ يَدْعُوهُ كَادُوا يَكُونُونَ عَلَيْهِ لِبَدًا

‘‘আর আল্লাহর বান্দা যখন তাকে ডাকার জন্য দাঁড়ালো তখন তারা সবাই তার নিকট ভিড় জমালো’’। (সূরা জিন: ১৯) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

فَأَوْحَىٰ إِلَىٰ عَبْدِهِ مَا أَوْحَىٰ

‘‘তখন আল্লাহ তার বান্দার প্রতি যা অহী করার ছিল তা অহী করলেন’’ (সূরা নাযম: ১০)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَإِن كُنتُمْ فِي رَيْبٍ مِّمَّا نَزَّلْنَا عَلَىٰ عَبْدِنَا فَأْتُوا بِسُورَةٍ مِّن مِّثْلِهِ وَادْعُوا شُهَدَاءَكُم مِّن دُونِ اللَّهِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ

‘‘আর যে কিতাবটি আমি আমার বান্দার উপর নাযিল করেছি সেটি আমার কিনা, এ ব্যাপারে যদি তোমরা সন্দেহ পোষণ করো তাহলে তার মতো একটি সূরা তৈরি করে আনো এবং নিজেদের সমস্ত সমর্থক গোষ্টীকে ডেকে আনো আল্লাহকে ছাড়া। যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাকো’’। (সূরা আল বাকারা: ২৩)

সুতরাং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর সর্বাধিক ইবাদতকারী বান্দা ছিলেন বলেই তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বাধিক মর্যাদাবান হওয়ার যোগ্য হয়েছেন। এ জন্যই কিয়ামতের দিন যখন লোকেরা নাবীদের কাছে শাফা‘আতের আবেদন করার পর ঈসা আলাইহিস সালামের কাছে তা কামনা করবে, তখন তিনি বলবেন, তোমরা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে যাও। তিনি আল্লাহ তা‘আলার এমন একজন বান্দা, যার পূর্বের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়েছে। তিনি আল্লাহ তা‘আলার পরিপূর্ণ ইবাদত করার মাধ্যমে এ মর্যাদা অর্জন করেছেন।

ইমাম ত্বহাবী রাহিমাহুল্লাহুর উক্তি: وإن محمدا -এ বাক্যটিকে কিতাবের শুরুর দিকে উল্লেখিত إن الله واحد لاشريك له -এর উপর সম্পর্ক করে উহার ‘হামযাহ’ -এর নীচে যের দিয়ে পড়া হয়েছে। আর ইমাম ত্বহাবী রাহিমাহুল্লাহুর উক্তি: نقول في توحيد الله থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত সবগুলো বাক্যই قول এর معمول হয়েছে।

কালাম শাস্ত্রবিদ ও যুক্তিবিদদের থেকে এ কথা প্রসিদ্ধ রয়েছে যে, মুজেযার মাধ্যমে নাবীদের নবুওয়াত সাব্যস্ত করা হয়েছে। তাদের অনেকেই মুজেযার মাধ্যম ব্যতীত অন্য কোনো মাধ্যমে নাবীদের নবুওয়াত সাব্যস্ত করতে সম্পূর্ণ নারাজ।[2]

তবে মুতাযেলাদের অনেকেই নাবী ছাড়া অন্যদের পক্ষ হতে অলৌকিক ঘটনা প্রকাশিত হওয়াকে অস্বীকার করেছে। এমনকি তারা অলীদের কারামত, যাদুর হাকীকত ও প্রভাব এবং অনুরূপ অন্যান্য বিষয়কেও অস্বীকার করেছে।

[1]. সুফীবাদের দাবিদার এক শ্রেনীর অজ্ঞ লোক বলে থাকে যে, অলীগণের যখন মারেফত হাসিল হয়ে যায় এবং তিনি যখন ‘ফানা ফিল্লাহ’র স্তরে পৌঁছে যান তখন তার উপর শরীয়াতের বিধি-বিধান মানার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না এবং তার নিকট হালাল-হারামেরও কোনো ব্যবধান থাকে না। (নাউযুবিল্লাহ)

[2]. তাদের এ কথা সঠিক নয়। কারণ নাবীদের নবুওয়াত সাব্যস্ত করার জন্য মুজিযা ছাড়াও আরো অনেক মাধ্যম রয়েছে। যা থেকে শাইখ ইবনে আবীল ইয্ কতিপয় পদ্ধতি উল্লেখ করেছেন।
মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক

নাবীদের মুজেযা নিঃসন্দেহে তাদের নবুওয়াতের পক্ষে একটি শক্তিশালী দলীল। তবে তাদের নবুওয়াতের দলীলসমূহ কেবল মুজেযার মধ্যেই সীমিত নয়। কেননা সর্বাধিক সত্যবাদী অথবা সর্বাধিক মিথ্যুকরাই নবুওয়াতের দাবি করে থাকে। সত্য নবুওয়াত এবং তার মিথ্যা দাবি কখনো এক হতে পারে না। অজ্ঞরাই কেবল সত্যিকার নবুওয়াত এবং নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। সত্যিকার নাবী ও ভন্ড নাবীর এমন অনেক আলামত রয়েছে, যা উভয়কে পরিষ্কার করে বর্ণনা করে দেয়। নবুওয়াতের দাবিদার ছাড়াও সাধারণ সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর মাঝে পার্থক্য করার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। সুতরাং যারা নবুওয়াতের দাবি করবে, তারা সত্যবাদী কি না, তার মাঝে পার্থক্য করা যাবে না কেন?

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবি হাস্সান বিন ছাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খুব সুন্দর বলেছেন,

لَوْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ آيَاتٌ مُبَيِّنَةٌ... كَانَتْ بَدِيهَتُهُ تَأْتِيكَ بِالْخَبَرِ

‘‘তার মধ্যে যদি নবুওয়াতের সুস্পষ্ট বাহ্যিক নিদর্শনগুলো নাও থাকতো, তাহলে তার চাল-চলন, স্বভাব-চরিত্র, স্বাভাবিক অবস্থা এবং আচার-আচরণই তোমাকে বলে দিবে যে তিনি একজন সত্য নাবী’’।

এ পর্যন্ত যত মিথ্যুক নবুওয়াতের দাবি করেছে তাদের সকলের মূর্খতা, মিথ্যা ও পাপাচার সুস্পষ্ট হয়েছে। সে সঙ্গে তার মধ্যে শয়তানের গোলামি করার বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। যার মধ্যে সামান্য বিবেক-বুদ্ধিমান লোকও নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারের চালবাজি ও ধোঁকাবাজি ধরে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। কেননা যিনি নাবী বা রসূল হবেন, তিনি মানুষকে অবশ্যই অনেক সংবাদ প্রদান করবেন, অনেক বিষয়ের আদেশ করবেন এবং এমন অনেক কাজ করবেন, যার মাধ্যমে তার সত্যতা প্রকাশিত হবে। আর মিথ্যুক যে বিষয়ের আদেশ করবে, যে সংবাদ প্রদান করবে এবং সে যা করবে, তার মধ্যেই বিভিন্নভাবে মিথ্যা প্রকাশিত হয়ে যাবে। সত্যবাদীর বিষয়টি সম্পূর্ণ এর বিপরীত। শুধু তাই নয়; দুই জন লোক যদি এমন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের দাবি করে, যাতে একজন সত্যবাদী এবং অন্যজন মিথ্যুক, তাতে সত্যবাদী থেকে মিথ্যুক অবশ্যই আলাদা হবে। যদিও তা প্রকাশ হতে কখনো দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। কেননা সত্যবাদিতা মানুষকে সৎকাজের দিকে পরিচালিত করে এবং মিথ্যাবাদিতা মানুষকে পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়।

ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ، فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ، حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللَّهِ صِدِّيقًا، وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ، حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللَّهِ كَذَّابًا

‘‘তোমরা অবশ্যই সত্য বলবে। কারণ সত্য মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে ও নেকীর পথ দেখায় এবং নেকী জান্নাতের দিকে চালিত করে। আর মানুষ সদা সত্য বলতে থাকলে এবং সত্যের অনুসন্ধান করতে থাকলে পরিশেষে আল্লাহর নিকট সে সিদ্দীক হিসাবে পরিগণিত হয়। আর তোমরা মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকবে। কেননা মিথ্যা মানুষকে পাপ কাজের পথ দেখায় এবং পাপ কাজ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আর মানুষ সদা মিথ্যা বলতে থাকলে এবং মিথ্যার অনুসন্ধান করতে থাকলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট মিথ্যুক হিসাবে তার নাম লিপিবদ্ধ হয়ে যায়’’।[1] এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ يُلْقُونَ السَّمْعَ وَأَكْثَرُهُمْ كَاذِبُونَ وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ

‘‘হে লোকেরা! আমি কি তোমাদের জানাবো শয়তানরা কার উপর অবতীর্ণ হয়? তারা তো প্রত্যেক মিথ্যুক বদকারের উপর অবতীর্ণ হয়। শোনা কথা কানে ঢুকিয়ে দেয় এবং এর বেশির ভাগই হয় মিথ্যা। আর ভ্রান্তরাই কেবল কবিদের পেছনে চলে। তুমি কি দেখনা তারা উপত্যকায় উদ্ভ্রামেত্মর মতো ঘুরে বেড়ায় এবং এমনসব কথা বলে যা তারা করে না’’? (সূরা শুআরা: ২১-২৬)

সুতরাং গণক এবং তাদের অনুরূপ লোকেরা যদিও কখনো কখনো অদৃশ্যের কিছু কিছু খবর বলতে পারে এবং তা সত্যও হয়, তথাপিও তারা এত মিথ্যা ও পাপাচারে লিপ্ত হয়, যা সুস্পষ্ট করে দেয় যে, তারা যেসব খবর প্রদান করে, তা ফেরেশতাদের থেকে গৃহীত নয় এবং তারা স্বয়ং নাবীদেরও অন্তর্ভুক্ত নয়। এ জন্যই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে সাইয়্যাদকে বলেছিলেন,

إِنِّي قَدْ خَبَأْتُ لَكَ خَبِيئًا فَقَالَ ابْنُ صَيَّادٍ هُوَ الدُّخُّ فَقَالَ اخْسَأْ فَلَنْ تَعْدُوَ قَدْرَكَ

‘‘আমি তোমার জন্য একটি বিষয় গোপন করে রেখেছি। পারলে বলে দাও তো আমি কী গোপন করেছি? ইবনে সাইয়্যাদ বললো, সেটি হল الدخ (ধূয়া)। এ কথা শুনে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি লাঞ্ছিত হও। তুমি নিজের সীমার বাইরে যেতে পারবে না’’।[2]

ইবনে সাইয়্যাদ নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছিল, يَأْتِينِي صَادِقٌ وَكَاذِبٌ আমার কাছে সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী উভয়ই আগমন করে।[3] সে আরো বলেছিল, أَرَى عَرْشًا عَلَى الْمَاءِ আমি পানির উপর একটি আরশ দেখতে পাচ্ছি।[4] পানির উপর সে যে আরশ দেখতো, তা ছিল শয়তানের আরশ।

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ ‘‘গোমরাহ লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে চলে’’ (সূরা আশ শুয়ারা ২৬ : ২২৪)। الغاوي হলো ঐ ব্যক্তি যে, স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলে। যদিও পরিণামে তা তার জন্য ক্ষতিকর হয়।

[1]. ছহীহ মুসলিম হা/২৬০৭, তিরমিযী হা/১৯৭১।

[2]. ছহীহ বুখারী ১৩৫৪, ছহীহ মুসলিম ২৯৩০।

[3]. ছহীহ বুখারী ১৩৫৪, ছহীহ মুসলিম ২৯৩০।

[4]. ছহীহ মুসলিম ২৯২৫।
নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজেযা সম্পর্কে কিছু কথা - ১

যে ব্যক্তি রাসূলের সত্যবাদিতা, ওয়াদা-অঙ্গিকার রক্ষা করা এবং তার কথা ও কাজের মিল থাকার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করবে, সে নিশ্চিতভাবেই জানতে পারবে যে, তিনি কবি কিংবা গণক নন। লোকেরা মিথ্যুক থেকে সত্যবাদীকে বিভিন্ন দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে থাকে। যেমন তারা বিভিন্ন প্রকার পেশা যেমন লেখালেখি, কাপড় বুনানো, কৃষিকাজ, নাহুশাস্ত্র, ডাক্তারী, ফিকাহশাস্ত্র ইত্যাদির দাবিদারকে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা করে থাকে। নবুওয়াতের দাবিদারের মধ্যে ইলম ও আমল থাকতে হবে। রাসূলের মধ্যে অবশ্যই ইলম ও আমল থাকবে। তার মধ্যে থাকবে সর্বোত্তম ইলম ও সর্বোত্তম আমল।

সুতরাং সত্য নাবী ও মিথ্যাবাদী কিভাবে এক হতে পারে? গবেষক আলেমদের মতে একজন বা দুইজন বা তিনজনের খবরের সাথে কখনো এমন কিছু আলামত বিদ্যমান থাকে যার কারণে তা দ্বারাও অকাট্য ইলম অর্জিত হয়। যেমন কেউ অন্য কারো সন্তুষ্টি, ভালোবাসা, ক্রোধ, আনন্দ দুঃশ্চিন্তা ইত্যাদি অভ্যন্তরীন অবস্থা এমন আলামতের মাধ্যমে জানতে পারে, যা তার চেহারার মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় এ আলামতগুলো ব্যাখ্যা করে বুঝানো সম্ভব হয় না।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَوْ نَشَاءُ لَأَرَيْنَاكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُم بِسِيمَاهُمْ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِي لَحْنِ الْقَوْلِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ أَعْمَالَكُمْ

‘‘আমি চাইলে তাদেরকে চাক্ষুষ দেখিয়ে দিতাম। আর তুমি তাদের চেহারা দেখেই চিনতে পারতে। তবে বাচনভঙ্গি থেকে তুমি তাদেরকে অবশ্যই চিনে ফেলবে। আল্লাহ তোমাদের সব আমল ভালো করেই জানেন’’। (সূরা মুহাম্মাদ: ৩০)

কোনো কোনো আলেম বলেছেন, কেউ অন্তরে কিছু গোপন করলে, আল্লাহ তা‘আলা তা তার চেহারা এবং জবানের মাধ্যমে প্রকাশ করে দেন। সুতরাং সংবাদ দাতার সত্যবাদিতা ও মিথ্যাবাদিতা যেহেতু আনুসাঙ্গিক বিভিনণ আলামত দ্বারা প্রকাশিত হয়ে যায়, সেহেতু নবুওয়াত ও রেসালাতের দাবিদারের দাবির সত্যতা প্রকাশিত হবে না কেন? সত্য নাবীর সত্যতার বিষয়টি কিভাবে গোপন থাকতে পারে? অসংখ্য দলীলের মাধ্যমে সত্য নাবীর সত্যতা এবং মিথ্যাবাদির মিথ্যাচারিতার মাঝে পার্থক্য হবে না কেন?

এ জন্যই খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যেহেতু নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যতা ও ন্যায় পরায়ণতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তাই অহী অবতীর্ণ সূচনা হওয়ার পর তিনি যখন খাদীজাকে বললেন,

إِنِّي قَدْ خَشِيتُ عَلَى نَفْسِي" ، فقالت: كلا والله لا يخزيك الله، إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ، وَتَصْدُقُ الْحَدِيثَ، وَتَحْمِلُ الْكَلَّ، وَتُقِرِّي الضَّيْفَ، وَتُكْسِبُ الْمَعْدُومَ، وَتُعِينُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ

‘‘আমি আমার নিজের জীবন নাশের আশঙ্কা করছি, খাদীজা তখন বললেন, কখনোই নয়; আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, সদা সত্য কথা বলেন, দুর্বল ও দুঃখীদের খেদমত করেন। বঞ্চিত ও অভাবীগণের উপার্জনের ব্যবস্থা করেন। মেহমানদারী করেন এবং বিপদগ্রস্তদেরকে সাহায্য করেন।[1]

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নিজ থেকে মিথ্যাবাদি হওয়ার আশঙ্কা করেননি। কারণ তিনি নিজের সম্পর্কে ভালো করেই জানতেন যে, তিনি মিথ্যা বলেন না। তিনি কেবল ভয় করেছেন যে, শত্রুরা তার বিরোধীতা শুরু করবে কি না এবং তারা তাকে মিথ্যাবাদী হিসাবে সাব্যস্ত করেন কি না। তাই খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তার উপরোক্ত গুণাবলী উল্লেখ করে আশ্বস্ত করলেন যে, এমনটি হওয়া অসম্ভব। কারণ তাকে সর্বোত্তম চরিত্র ও সুমহান গুণাবলীসহ সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি সম্পর্কিত নীতি হলো, তিনি যাকে প্রশংসনীয় চরিত্র ও গুণাবলীসহ সৃষ্টি করেন, তাকে তিনি কখনো লাঞ্ছিত করেন না।

এমনি নাজ্জাশী ছাহাবীদের থেকে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংবাদ জানার পর এবং তাদের নিকট থেকে কুরআন শ্রবণ করার পর বললেন,

إِنَّ هَذَا وَالَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ لَيَخْرُجُ مِنْ مِشْكَاةٍ وَاحِدَةٍ

নিশ্চয় এ বাণী এবং মূসা আলাইহিস সালাম যা নিয়ে এসেছেন, তা একই উৎস থেকে বের হয়েছে।[2]

وَكَذَلِكَ وَرَقَةُ ابْنُ نَوْفَلٍ، لَمَّا أَخْبَرَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَا رَآهُ، وَكَانَ وَرَقَةُ [قَدْ] تَنَصَّرَ، وَكَانَ يَكْتُبُ الْإِنْجِيلَ بِالْعَرَبِيَّةِ، فَقَالَتْ لَهُ خَدِيجَةُ: "أَيْ عَمِّ! اسْمَعْ مِنِ ابْنِ أَخِيكَ مَا يَقُولُ، فَأَخْبَرَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَا رَأَى فَقَالَ: هَذَا [هُوَ] النَّامُوسُ الَّذِي كَانَ يَأْتِي مُوسَى

এমনি যখন খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে তার চাচাত ভাই ওরাকা ইবনে নওফল ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উয্যার নিকট গেলেন, তখন ওরাকাও অনুরূপ কথা বলেছেন। ওরাকা জাহেলী যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানী ভাষায় কিতাব লিখতেন। তাই আল্লাহর ইচ্ছা ও তাওফীক অনুযায়ী তিনি ইঞ্জিলের অনেকাংশ ইবরানী ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তাকে তার ভাতিজা অর্থাৎ রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট থেকে সব কথা শুনতে বললেন। ওরাকা তার ভাতিজার ঘটনা শুনতে চাইলেন। রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তার সব ঘটনা শুনালেন। ওরাকা তাকে বললেন, এ সে ফেরেশতা যাকে মূসা (আ.)এর নিকট আল্লাহ নাযিল করেছিলেন।[3]

وَكَذَلِكَ هِرَقْلُ مَلِكُ الرُّومِ، فَإِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا كَتَبَ إِلَيْهِ كِتَابًا يَدْعُوهُ فِيهِ إِلَى الْإِسْلَامِ، طَلَبَ مَنْ كَانَ هُنَاكَ مِنَ الْعَرَبِ، وَكَانَ أَبُو سُفْيَانَ قَدْ قَدِمَ فِي طَائِفَةٍ مِنْ قُرَيْشٍ فِي تِجَارَةٍ إِلَى الشَّامِ، وَسَأَلَهُمْ عَنْ أَحْوَالِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَسَأَلَ أَبَا سُفْيَانَ، وَأَمَرَ الْبَاقِينَ إِنْ كَذَبَ أَنْ يُكَذِّبُوهُ، فَصَارُوا بِسُكُوتِهِمْ مُوَافِقِينَ لَهُ فِي الْأَخْبَارِ، سَأَلَهُمْ: هَلْ كَانَ فِي آبَائِهِ مِنْ مَلِكٍ؟ فَقَالُوا: لَا، قَالَ: هَلْ قَالَ هَذَا الْقَوْلَ أَحَدٌ قَبْلَهُ؟ فَقَالُوا: لَا، وَسَأَلَهُمْ: أَهْوَ ذُو نَسَبٍ فِيكُمْ؟ فَقَالُوا: نَعَمْ، وَسَأَلَهُمْ: هَلْ كُنْتُمْ تَتَّهِمُونَهُ بِالْكَذِبِ قَبْلَ أَنْ يَقُولَ مَا قَالَ؟ فَقَالُوا: لَا، مَا جَرَّبْنَا عَلَيْهِ كَذِبًا، وَسَأَلَهُمْ: هَلِ اتَّبَعَهُ ضُعَفَاءُ النَّاسِ أَمْ أَشْرَافُهُمْ؟ فَذَكَرُوا أَنَّ الضُّعَفَاءَ اتَّبَعُوهُ؟ وَسَأَلَهُمْ: هَلْ يَزِيدُونَ أَمْ يَنْقُصُونَ؟ فَذَكَرُوا أَنَّهُمْ يَزِيدُونَ، وَسَأَلَهُمْ: هل يرجع أَحَدٌ مِنْهُمْ عَنْ دِينِهِ سُخْطَةً لَهُ بَعْدَ أَنْ يَدْخُلَ فِيهِ؟ فَقَالُوا: لَا، وَسَأَلَهُمْ: هَلْ قَاتَلْتُمُوهُ؟ قَالُوا: نَعَمْ، وَسَأَلَهُمْ عَنِ الْحَرْبِ بَيْنَهُمْ وَبَيْنَهُ؟ فَقَالُوا: يُدَالُ عَلَيْنَا مَرَّةً وَنُدَالُ عَلَيْهِ أُخْرَى، وَسَأَلَهُمْ: هَلْ يَغْدِرُ؟ فَذَكَرُوا أَنَّهُ لَا يَغْدِرُ، وَسَأَلَهُمْ: بِمَاذَا يَأْمُرُكُمْ؟ فَقَالُوا: يَأْمُرُنَا أَنْ نَعْبُدَ اللَّهَ وَحْدَهُ لَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا، وَيَنْهَانَا عَمَّا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا، وَيَأْمُرُنَا بِالصَّلَاةِ وَالصِّدْقِ وَالْعَفَافِ وَالصِّلَةِ. وَهَذِهِ أَكْثَرُ مِنْ عَشْرِ مَسَائِلَ، ثُمَّ بَيَّنَ لَهُمْ مَا فِي هَذِهِ الْمَسَائِلِ مِنَ الْأَدِلَّةِ، فَقَالَ: سَأَلْتُكُمْ هَلْ كَانَ فِي آبَائِهِ مِنْ مَلِكٍ؟ فَقُلْتُمْ: لَا، قُلْتُ: لَوْ كَانَ فِي آبَائِهِ [مِنْ] مَلِكٍ لَقُلْتُ: رَجُلٌ يَطْلُبُ مُلْكَ أَبِيهِ، وَسَأَلْتُكُمْ هَلْ قَالَ هَذَا الْقَوْلَ [فِيكُمْ] أَحَدٌ قَبْلَهُ؟ فَقُلْتُمْ: لَا، فَقُلْتُ: لَوْ قَالَ هَذَا الْقَوْلَ أَحَدٌ [قَبْلَهُ] لَقُلْتُ: رَجُلٌ ائْتَمَّ بِقَوْلٍ قِيلَ قَبْلَهُ، وَسَأَلْتُكُمْ هَلْ كُنْتُمْ تَتَّهِمُونَهُ بِالْكَذِبِ قَبْلَ أَنْ يَقُولَ مَا قَالَ؟ فَقُلْتُمْ: لَا، فَقُلْتُ: قَدْ عَلِمْتُ أَنَّهُ لَمْ يَكُنْ لِيَدَعَ الْكَذِبَ عَلَى النَّاسِ ثم يذهب فيكذب على الله تعالى، وَسَأَلْتُكُمْ أَضُعَفَاءُ النَّاسِ يَتْبَعُونَهُ أَمْ أَشْرَافُهُمْ؟ فَقُلْتُمْ: ضُعَفَاؤُهُمْ وَهُمْ أَتْبَاعُ الرُّسُلِ، يَعْنِي فِي أَوَّلِ أَمْرِهِمْ، ثُمَّ قَالَ: وَسَأَلْتُكُمْ هَلْ يَزِيدُونَ أَمْ يَنْقُصُونَ؟ فَقُلْتُمْ، بَلْ يَزِيدُونَ، وَكَذَلِكَ الْإِيمَانُ حَتَّى يَتِمَّ، وَسَأَلْتُكُمْ هَلْ يَرْتَدُّ أَحَدٌ مِنْهُمْ عَنْ دِينِهِ سُخْطَةً لَهُ بَعْدَ أَنْ يَدْخُلَ فِيهِ؟ فَقُلْتُمْ: لَا، وَكَذَلِكَ الْإِيمَانُ، إِذَا خَالَطَتْ بَشَاشَتُةُ الْقُلُوبَ لَا يَسْخَطُهُ أَحَدٌ

এমনি রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াসও অনুরূপ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রোমের সম্রাটের কাছে চিঠি লিখলেন, তখন সে সময় সেখানে যে সমস্ত আরব লোক উপস্থিত ছিল, তাদেরকে ডাকলেন। তখন আবু সুফিয়ান এক বাণিজ্যিক কাফেলায় শরীক হয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রোমের সম্রাট তখন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থা সম্পর্কে উপস্থিত আরবদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন। হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন এবং বাকীদেরকে বললেন, তারা যেন আবু সুফিয়ান মিথ্যা বললে সাথে সাথে তা ধরিয়ে দেয়। সুতরাং হিরাক্লিয়াস প্রশ্ন করতে লাগলেন এবং আবু সুফিয়ান সেসব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল। বাকীরা চুপ থেকে তার সংবাদকে সমর্থন করে যাচ্ছিল।

হিরাক্লিয়াস যেসব প্রশ্ন সেদিন করেছিলেন, তার মধ্যে নিমেণর প্রশ্নগুলো অন্যতম। তিনি আবু সুফিয়ানকে প্রশ্ন করলেন, তার পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কেউ রাজা-বাদশাহ ছিলেন কি? আবু সুফিয়ান বললো না। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, তার পূর্বে অন্য কেউ অনুরূপ কথা বলেছে কি? আবু সুফিয়ান বললো, না। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি তোমাদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ বংশের লোক? আবু সুফিয়ান বললো, হ্যাঁ। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, লোকটি বর্তমানে যা বলছে, তোমরা কি এর পূর্বে কখনো তার প্রতি মিথ্যাবাদীতার অভিযোগ করেছো? আবু সুফিয়ান বলল, আমরা তার উপর কখনো মিথ্যা বলার অভিযোগ পেশ করতে পারিনি। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশালী লোকেরা তার অনুসরণ করেছে? না দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা? আবু সুফিয়ান বলল, দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা।

হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, তার অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে? আবু সুফিয়ান বললো তার অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, কেউ তার দ্বীন গ্রহণ করার পর দোষ-ত্রুটি দেখে পুনরায় দ্বীন পরিত্যাগ করে কি? আবু সুফিয়ান বলল, না। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি তার সাথে কখনো যুদ্ধ করেছো? আবু সুফিয়ান বললো, হ্যাঁ। হিরাক্লিয়াস এবার তাদের মাঝে এবং তার মধ্যকার যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আবু সুফিয়ান বললো, যুদ্ধের ফলাফল আমাদের ও তার মধ্যে ঘূর্ণায়মান। কখনও তিনি বিজয়ী হয়েছেন আবার কখনও আমরা বিজয়ী হয়েছি। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি ওয়াদা ভঙ্গ করেন? আবু সুফিয়ান বললো, না। তবে বর্তমানে আমরা তার সাথে একটি সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ আছি। জানি না তিনি এতে কি করবেন।

আবু সুফিয়ান বলেন, এ কথাটি ব্যতীত আমি তার বিরুদ্ধে অন্য কিছু বলার সাহস পেলাম না। হিরাক্লিয়াস বললেন, তিনি তোমাদেরকে কিসের আদেশ দেন? আবু সুফিয়ান বললো, তিনি আমাদেরকে বলেন, এক আল্লাহর ইবাদত করো। তার সাথে অন্য কিছুকে শরীক করো না। তোমাদের পূর্ব পুরুষরা যেসব বস্তুর উপাসনা করত তা ছেড়ে দাও। তিনি আমাদেরকে ছলাতের আদেশ দেন। তিনি আরো আদেশ দেন, তোমরা সত্য বলো, অন্যায় থেকে বিরত থাকো এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো। এভাবে হিরাক্লিয়াস দশাধিক প্রশ্ন করলেন। অতঃপর এগুলোর মধ্যে তার নবুওয়াতের সত্যতার পক্ষে যেসব দলীল-প্রমাণ রয়েছে, তাও উল্লেখ করলেন। সম্রাট আবু সুফিয়ানকে বললেন, আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কেউ রাজা-বাদশাহ ছিলেন কি? তুমি বলেছো, না। তার পূর্ব পুরুষদের মধ্যে যদি কেউ রাজা-বাদশাহ থাকতো, তাহলে আমি বলতাম, তিনি এমন ব্যক্তি যিনি তার পূর্বপুরুষদের রাজত্ব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তোমাদের মধ্যে ইতিপূর্বে অন্য কেউ এরূপ কথা বলেছে কি? তুমি বলেছো না। সুতরাং আমি বলছি, ইতিপূর্বে যদি কেউ এ ধরণের কথা বলত, তাহলে আমি বলতাম, তিনি তার পূর্বসূরি ব্যক্তির কথাই বলছেন।

আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, বর্তমানে তিনি যা বলছেন, ইতিপূর্বে তোমরা কি কখনও তার উপর মিথ্যাবাদীতার অভিযোগ করেছো? তুমি বলেছো, না। তাই আমি বিশ্বাস করি যে, মানুষের সাথে মিথ্যা বলা ছেড়ে দিয়ে তিনি আল্লাহ সম্পর্কে কখনও মিথ্যা বলতে পারেন না। তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, সম্মানিত ও ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ তার অনুসরণ করেছে, না দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা? তুমি বলেছা, দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা তার অনুসরণ করছে। মূলতঃ দুর্বল ও অসহায়গণই নাবী-রসূলদের অনুসারী হয়ে থাকে। অর্থাৎ শুরুর দিকে দুর্বলরাই নাবী-রসূলদের দ্বীন কবুল করে। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে? তুমি বলেছো, তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নিশ্চয়ই ঈমানের বিষয়টি এরূপই হয়ে থাকে, যতক্ষণ না তা পূর্ণতায় রূপ নেয়। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার দ্বীনে দিক্ষীত হওয়ার পর নাখোশ হয়ে কেউ ধর্মান্তরিত হয়েছে কি? তুমি বলেছা, না। ঈমানের আলো যখন অন্তরে প্রবেশ করে তখন এরূপই হয়ে থাকে।[4]

এগুলোই সত্যের সবচেয়ে বড় দলীল। বাতিল ও মিথ্যার মুখোশ পরিশেষে অবশ্যই উন্মুক্ত হয়। সত্যের সন্ধানীরা তখন মিথ্যা পরিহার করে। আর যারা সত্যের সন্ধানী নয়, তারা তা থেকে সবসময় দূরে থাকে। মূলতঃ মিথ্যা সামান্য পরেই পরাভূত হয়। হিরাক্লিয়াস বলেন, আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার সাথে তোমাদের যুদ্ধের ফলাফল কী হয়েছে? তুমি বলেছো, যুদ্ধের ফলাফল আমাদের ও তার মধ্যে ঘূর্ণায়মান। কখনও তিনি বিজয়ী হয়েছেন আবার কখনও আমরা বিজয়ী হয়েছি। রসূলগণের অবস্থা ঠিক এ রকম। তাদেরকে কখনো বিপদাপদ ও কষ্টের মধ্যে ফেলে পরীক্ষা করা হয়। অতঃপর তাদের পরিণাম ভালো হয়। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি কি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন? তুমি বলেছো, না।

প্রকৃতপক্ষে রসূলগণ এরূপই হয়ে থাকেন। তারা কখনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না। হিরাক্লিয়াসের এ কথা বলার কারণ হলো, তিনি রসূলদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার নীতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা কখনো তাদেরকে বিজয়ী করেন আবার কখনো তাদেরকে বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। আর তারা কখনোই গাদ্দারী করেন না। সুতরাং হিরাক্লিয়াস অবগত ছিলেন যে, এগুলো সত্য নাবীর আলামত। আর সত্য নাবী-রসূল ও মুমিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম সুন্নাত হলো, তিনি তাদেরকে সুখ-শান্তি ও বিপদাপদের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। যেন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও ধৈর্যধারণ করার মর্যাদা লাভ করেন।

ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَا يَقْضِي اللَّهُ لِلْمُؤْمِنِ قَضَاءً إِلَّا كَانَ خَيْرًا لَهُ، وَلَيْسَ ذَلِكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ

‘‘ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহ তা‘আলা যে ফায়ছালাই করেন না কেন, তাই তার জন্য ভালো। মুমিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো জন্য এমনটি হয় না। মুমিন বান্দার কল্যাণ হলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এতে তার জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর মুমিন ব্যক্তির অকল্যাণ হলে ধৈর্যধারণ করে। এতেও তার জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে’’।[5]

[1]. ছহীহ মুসলিম ১৬০, ছহীহ বুখারী ৪৯৫৩।

[2]. হাসান: সীরাতে ইবনে ইসহাক, (১/৩৫৭-৩৬৩), ইবনে হিশাম, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে কাসীর।

[3]. ছহীহ বুখারী হা/৩, ছহীহ মুসলিম হা/১৬০।

[4]. ছহীহ বুখারী ৭।

[5]. ছহীহ মুসলিম, (৮/২২৭)
নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজেযা সম্পর্কে কিছু কথা - ২

উহুদ যুদ্ধে মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদের জয়লাভ করার মধ্যে কী হিকমতে ইলাহী রয়েছে, আল্লাহ তা‘আলা তা কুরআনুল কারীমে উল্লেখ করেছেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,

وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ إِنْ يَمْسَسْكُمْ قَرْحٌ فَقَدْ مَسَّ الْقَوْمَ قَرْحٌ مِثْلُهُ وَتِلْكَ الْأَيَّامُ نُدَاوِلُهَا بَيْنَ النَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَدَاءَ وَاللَّهُ لَا يُحِبُّ الظَّالِمِينَ وَلِيُمَحِّصَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا وَيَمْحَقَ الْكَافِرِينَ

‘‘আর তোমরা নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখ করো না। যদি তোমরা মুমিন হও তবে তোমরাই জয়ী হবে। তোমরা যদি আহত হয়ে থাকো, তবে তারাও তো তেমনি আহত হয়েছে। আর এ দিনগুলোকে আমি মানুষের মধ্যে পালাক্রমে আবর্তন ঘটিয়ে থাকি। এভাবে আল্লাহ্ জানতে চান, কারা ঈমানদার আর তিনি তোমাদের কিছু লোককে শহীদ হিসাবে গ্রহণ করতে চান। আর আল্লাহ্ অত্যাচারীদেরকে ভালবাসেন না। আর এ কারণে আল্লাহ্ ঈমানদারদেরকে পাক-সাফ করতে চান এবং কাফেরদেরকে ধ্বংস করে দিতে চান’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৩৯-১৪১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوا أَن يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ

‘‘লোকেরা কি মনে করেছে, আমরা ঈমান এনেছি কেবল এ কথা বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবে না?’’ (সূরা আনকাবুত: ২) আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি ও তার হিকমত সম্পর্কে অনুরূপ আরো অনেক আয়াত ও হাদীছ রয়েছে, যা বিবেক-বুদ্ধিকে হয়রান করে দেয়।

হিরাক্লিয়াসের প্রশ্নের মধ্যে আরো রয়েছে যে, আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, তিনি তোমাদেরকে কিসের আদেশ দেন? তুমি বলেছো যে, তিনি তোমাদেরকে এক আল্লাহর ইবাদতের আদেশ দেন এবং তার সাথে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করেন এবং মূর্তি পূজা করতে নিষেধ করেন। তোমাদেরকে ছলাতের আদেশ দেন, সত্য বলতে, পবিত্র থাকতে এবং আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার আদেশ করেন। সে সঙ্গে তিনি তোমাদের পূর্ব পুরুষগণ দ্বারা পূজিত বস্তুর পূজা করতে নিষেধ করেন। এগুলো নাবীদের গুণাবলী। আমি জানতাম যে, একজন নাবী আগমন করবেন। তবে আমি ধারণা করতাম না যে, তিনি তোমাদের মধ্য থেকেই হবেন। আমার ইচ্ছা হয় যে, আমি তার কাছে যাই। আমি যদি রোমের রাজত্বের মালিক না হতাম, তাহলে আমি অবশ্যই তার কাছে চলে যেতাম। তোমার কথা যদি সত্য হয়, তাহলে অচিরেই তার রাজত্ব আমার এ দু’পা রাখার স্থান পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।

আবু সুফিয়ান বিন হারবকে উদ্দেশ্য করে হিরাক্লিয়াস উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন। আবু সুফিয়ান তখনো ছিল কাফের। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে সে তখনো কঠোর শত্রুতা ও ঘৃণা পোষণ করতো। আবু সুফিয়ান বলেন, হিরাক্লিয়াসের রাজ দরবার থেকে বের হওয়ার সময় আমি সঙ্গীদের সাথে বললাম, ইবনে আবী কাবশার (মুহাম্মাদের) ব্যাপারটি তো দেখছি অনেক বড় আকার ধারণ করেছে। রোমকদের সম্রাটও তাকে অনেক বড় করে দেখছে। আমি সবসময়ই বিশ্বাস করতাম যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীন জয়লাভ করবে। পরিশেষে আল্লাহ আমাদের মধ্যে ইসলাম ঢুকিয়ে দিলেন। আমি তখনো ইসলামকে অপছন্দ করতাম।

জেনে রাখা আবশ্যক যে, মানুষের অন্তরে অনেকগুলো বিষয়ের সমন্বয়ে যে বিশ্বাস অর্জিত হয়, তা থেকে কতিপয় বিষয় দ্বারা সেই পরিমাণ বিশ্বাস অর্জিত হয় না। বরং মানুষ যে পরিতৃপ্তি, কৃতজ্ঞতা, খুশী ও দুঃখ কষ্ট অনুভব করে, তা অনেকগুলো জিনিস একসাথে একত্রিত হওয়ার কারণেই অর্জিত হয়। তা থেকে কোনো কিছু বাদ পড়লে ঐ জিনিসগুলোর কতিপয়ের দ্বারা তা অর্জিত হয় না। বরং কতিপয়ের দ্বারা কেবল অপূর্ণ তৃপ্তি কিংবা আংশিক আনন্দ অথবা সামান্য দুঃখ কষ্ট অনুভব হয়।

কোনো খবরের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান ও বিশ্বাসের কথাটিও অনুরূপ। খবরে ওয়াহেদ বা একক ব্যক্তির সংবাদ দ্বারা এক প্রকার ধারণা অর্জিত হয়। অন্যজনের খবরের দ্বারা তা শক্তি অর্জন করে। পরিশেষে তা দ্বারা অকাট্য ইলম হাসিল হয়। এভাবে কোনো বিষয়ের প্রতি মানুষের ইলম বৃদ্ধি পায় এবং শক্তিশালী হয়। এমনি সত্যবাদী কিংবা মিথ্যাবাদী হওয়ার দলীলগুলো শক্তিশালী ও মজবুত হয়।

এভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পৃথিবীতে তার নাবী-রসূল ও মুমিন বান্দাদেরকে যে কারামত ও সম্মান প্রদান করেছেন, তার প্রভাব ও প্রমাণ চিরস্থায়ী করে রেখেছেন। সে সঙ্গে কাফেরদের উপর যে আযাব ও শাস্তি নাযিল করেছেন, তাও চিরস্থায়ী হয়ে আছে। যেমন নূহ আলাইহিস সালামের জাতিকে মহাপস্নাবন দ্বারা পস্নাবিত করা, ফেরাউন ও তার বাহিনীকে ডুবিয়ে মারা ইত্যাদি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কুরআনের সূরা শুআরায় পরপর একাধিক নাবীর ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যেমন মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা, ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ঘটনা, নূহ আলাইহিস সালামের ঘটনা এবং অন্যান্য নাবীদের ঘটনা। প্রত্যেক ঘটনার শেষে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَآيَةً وَمَا كَانَ أَكْثَرُهُم مُّؤْمِنِينَ وَإِنَّ رَبَّكَ لَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ

‘‘এ ঘটনার মধ্যে একটি বিরাট নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু এদের অধিকাংশ মুমিন নয়৷ নিশ্চয় তোমার রব পরাক্রমশালী ও দয়াময়?’’ (সূরা শুআরা: ৬৭-৬৮)

মোট কথা, পৃথিবীতে এমন লোক রয়েছে, যারা বলে থাকে মুহাম্মাদ আল্লাহর রসূল! আরেক দল লোক তাদের অনুসরণ করেছে। আরেক দল লোক তাদের বিরোধীতা করেছে। আর আল্লাহ তা‘আলা তার রসূল ও মুমিনদেরকে সাহায্য করেছেন এবং তাদের পরিণাম ভালো করেছেন। তাদের শত্রুদেরকে শাস্তি দিয়েছেন। এ কথাগুলো সুস্পষ্টভাবে মুতাওয়াতির সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। নাবী-রসূলদের অনুসারীদেরকে পুরস্কৃত করা এবং তাদের বিরোধীদের শাস্তি প্রদানের খবরগুলো অতীতের পারস্য সম্রাট এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের খবরাদির চেয়ে অধিক সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্যভাবেই বর্ণনা করা হয়। যেমন বুকরাত, জালিনুস, বাতলাইমুস, সুকরাত, আফলাতুন, এরিষ্টেটোল এবং তাদের অনুসারীদের খবরাদির চেয়ে নাবী-রসূল ও তাদের অনুসারীদের খবরাদি অধিক সুস্পষ্ট।

বর্তমানে আমরা যখন মুতাওয়াতির সূত্রে নাবী-রসূলদের অনুসারী এবং তাদের শত্রুদের খবরসমূহ জানতে পেরেছি, তখন আমরা নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছি যে, নাবী-রসূলগণই সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সত্যবাদী ছিলেন। একাধিক মাধ্যম ও পদ্ধতিতেই আমরা এটি অবগত হতে পেরেছি।

(১) তারা তাদের জাতিকে সংবাদ দিয়েছেন যে, তাদের অনুসারীগণ বিজয়ী হবে, তাদের শত্রুরা লাঞ্ছিত হবে এবং তাদের পরিণাম ভালো ও দীর্ঘস্থায়ী হবে।

(২) আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রসূল ও তার অনুসারীদেরকে সাহায্য করেছেন এবং তাদের শত্রুদেরকে ধ্বংস করেছেন। যে অবস্থা ও পরিপ্রেক্ষিতে তা সংঘটিত হয়েছে যেমন ফেরাউনের ডুবে মরা, বন্যার মাধ্যমে নূহ আলাইহিস সালামের জাতি ধ্বংস হওয়া এবং তাদের অন্যান্য অবস্থা যে ব্যক্তি সঠিকভাবে তা বুঝতে পারবে, সে রসূলদের সত্যতা সম্পর্কে অবশ্যই জানতে পারবে।

(৩) নাবী-রসূলদের শরীয়াত এবং তার বিস্তারিত অবস্থা সম্পর্কে যারা জানতে পারবে, তাদের কাছে পরিষ্কার হবে যে, নাবী-রসূলগণই ছিলেন আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে সর্বাধিক জ্ঞানী। কোনো মিথ্যুক ও মূর্খদের দ্বারা এটি বুঝা সম্ভব নয়। নাবী-রসূলগণ যে মঙ্গল, রহমত, হেদায়াত, কল্যাণ এবং সৃষ্টির জন্য যেসব উপকারী উপদেশ নিয়ে এসেছেন ও তাদেরকে ক্ষতিকর পথ থেকে বিরত রাখার জন্য যেসব নির্দেশনা প্রদান করেছেন, সে সম্পর্কে যারা জানতে পারবে তারা জানতে সক্ষম হবে যে, তা এমন একজন দয়াবান, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি দ্বারাই সম্ভব, যিনি সৃষ্টির জন্য কল্যাণ ও উপকার ছাড়া অন্য কিছু কামনা করেন না।

নাবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াতের যেসব মুজেযা ও প্রমাণ রয়েছে, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার স্থান এটি নয়। অন্যস্থানে তা আলোচনা করা হয়েছে। অনেক আলেম এ বিষয়ে স্বতন্ত্র কিতাব রচনা করেছেন। যেমন ইমাম বায়হাকী এবং অন্যান্য আলেমগণ এ বিষয়ে একটি মূল্যবান কিতাব লিখেছেন।

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াতকে অস্বীকার করা আল্লাহ তা‘আলার রুবুবীয়াতের মধ্যে আপত্তির শামিল। সে সঙ্গে তার প্রতি যুলুম ও অজ্ঞতার সম্বন্ধ করার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার সম্পূর্ণ উর্ধ্বে। শুধু তাই নয়; বরং আল্লাহ তা‘আলাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা ছাড়া অন্য কিছু নয়। এ কথার বিস্তারিত ব্বিরণ এ যে, মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যদি এক শ্রেণীর মানুষের নিকট সত্য নাবী না হয়ে থাকেন; বরং তারা যদি তাকে একজন যালেম শাসক মনে করে থাকে, তার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে এমন সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল, যার কারণে তিনি আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা করেছেন, কোনো কোনো জিনিসকে হালাল ও কোনো কোনো জিনিসকে হারাম করেছেন, ফরযসমূহ নির্ধারণ করেছেন, শরীয়তের বিধি-বিধান চালু করেছেন, পূর্বের শরীয়তসমূহ বাতিল করেছেন, বিরোধীদের গর্দান দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন, হত্যা করেছেন, তাদের নারীদেরকে দাসীতে পরিণত করেছেন, তাদের ধন-সম্পদকে গণীমত হিসাবে ব্যবহার করেছেন, শিশুদের গোলাম বানিয়েছেন এবং বাড়িঘর দখল করেছেন। এভাবেই তার জন্য পৃথিবীর বিজয় সম্পন্ন হয়েছে।

উপরোক্ত বিষয়ের সবগুলোই তিনি আল্লাহর হুকুম ও পছন্দ অনুযায়ী করেছেন বলে চালিয়ে দিয়েছেন, আল্লাহ তা‘আলা একটানা ২৩ বছর পর্যন্ত হকপন্থীদের উপর তার এরূপ অপকর্ম দেখেছেন, তার সমস্ত কাজ-কর্ম সমর্থন করেছেন, তাকে সাহায্য করেছেন, তার কাজকর্মকে সমুন্নত করেছেন এবং অলৌকিক ক্ষমতার মাধ্যমে তার জন্য বিজয়ের পথ সহজ করে দিয়েছেন। এমনটি হতেই পারে না। শুধু তাই নয়; আল্লাহ তা‘আলা তার অন্যায় দু‘আ কবুল করেছেন, তার শত্রুদেরকে ধ্বংস করেছেন এবং তার মর্যাদা উন্নীত করেছেন। এ রকম ধারণা তাদের পক্ষ হতে চরম মিথ্যাচার, আল্লাহর নামে অপবাদ ও যুলুম ছাড়া অন্য কিছু নয়। ঐ ব্যক্তির চেয়ে অধিক জালেম আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা করে, নাবীদের শরীয়াতকে বাতিল ও পরিবর্তন করে এবং আল্লাহর বন্ধুদেরকে হত্যা করে।

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্য নাবী হিসাবে বিশ্বাস না করার অর্থ এও দাড়ায় যে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত সত্যের পথিকদের বিরুদ্ধে তার জন্য আল্লাহর সাহায্য অব্যাহত ছিল, আল্লাহ তা‘আলা তার কাজের সমর্থন করেছেন, ডান হাত দিয়ে তাকে কঠোরভাবে পাকড়াও করেননি এবং তার ঘাড়ের রগ কেটে দেননি। এমন ধারণার ফলাফল এ দাড়ায় যে, এ সৃষ্টিজগতের কোনো স্রষ্টা, পরিচালক ও ব্যবস্থাপক নেই। নাউযুবিল্লাহ।

যদি এর কোনো প্রজ্ঞাবান ও ক্ষমতাবান ব্যবস্থাপক থাকতেন, তাহলে তাকে প্রতিহত করতেন, তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিতেন এবং সৎকর্মশীলদের জন্য তাকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ বানাতেন। যালেম রাজা-বাদশাহদের জন্য এ ছাড়া অন্য কিছু শোভনীয় নয়। সুতরাং যিনি রাজাধিরাজ এবং যিনি সর্বাধিক ন্যায় বিচারক, তিনি তাকে শাস্তি না দিয়ে ছাড়তে পারেন না।

মূলকথা হলো, আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মর্যাদাকে সমুন্নত করেছেন, তার দাওয়াতকে বিজয়ী করেছেন এবং সত্য নাবী হিসাবে সকল দেশের সকল মানুষের নিকট তার সাক্ষ্যকে প্রকাশ করেছেন। একই সঙ্গে আমরা অস্বীকার করিনা যে, পৃথিবীতে অনেকেই নবুওয়াতের মিথ্যা দাবি করেছিল। এমনকি অনেকের শক্তিও অর্জিত হয়েছিল। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি এবং তারা দীর্ঘকাল নবুওয়াতের দাবির উপর টিকেও থাকতে পারেনি। বরং আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর তার রসূল এবং রাসূলের অনুসারীদেরকে শক্তিশালী করেছেন। তারা তাদেরকে সমূলে বিনাশ করে দিয়েছেন। নবুওয়াতের মিথ্যুক দাবিদারদের ব্যাপারে পূর্ব থেকে চলে আসা আল্লাহ তা‘আলার নীতি এটিই। কাফেররাও এ নীতি সম্পর্কে অবগত রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَمْ يَقُولُونَ شَاعِرٌ نَّتَرَبَّصُ بِهِ رَيْبَ الْمَنُونِ قُلْ تَرَبَّصُوا فَإِنِّي مَعَكُم مِّنَ الْمُتَرَبِّصِينَ

‘‘এসব লোক কি বলে যে, এ ব্যক্তি কবি, যার ব্যাপারে আমরা কালের আবর্তনের অপেক্ষা করছি। তাদেরকে বলো, ঠিক আছে অপেক্ষা করতে থাকো, আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি’’। (সূরা তূর: ৩০-৩১)

আপনি অবশ্যই অবগত আছেন যে, আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণতা, হিকমত ও কুদরতের দাবি হলো, যারা আল্লাহর ব্যাপারে মিথ্যা বলবে, তিনি তাদেরকে দীর্ঘ দিন অবকাশ দিবেন না। তাদেরকে ধ্বংস করে তিনি তার মুমিন বান্দাদের জন্য উপদেশ হিসাবে রেখে দিবেন। আল্লাহর উপর মিথ্যা রচনাকারীদের ব্যাপারে এ নীতি বহু আগে থেকেই চলে হয়ে আসছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَمْ يَقُولُونَ افْتَرَىٰ عَلَى اللَّهِ كَذِبًا فَإِن يَشَإِ اللَّهُ يَخْتِمْ عَلَىٰ قَلْبِكَ وَيَمْحُ اللَّهُ الْبَاطِلَ وَيُحِقُّ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ إِنَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ

‘‘এ লোকেরা কি বলে, এ ব্যক্তি আল্লাহর বিরুদ্ধে অপবাদ তৈরী করেছে? আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমার দিলের উপর মোহর মেরে দিতেন। তিনি বাতিলকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং নিজের আদেশে সত্যকে প্রমাণ করে দেখান। তিনি অন্তরের গোপন বিষয়ও জানেন’’। (সূরা শুরা: ২৪)

‘‘তোমার দিলের উপর মোহর মেরে দিতেন’’ এ বাক্যের মর্মার্থ বাস্তবায়ন হওয়া আল্লাহর ইচ্ছার সাথে শর্তযুক্ত। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এমন সুদৃঢ় সংবাদ প্রদান করেছেন, যার সাথে কোনো শর্ত জড়িয়ে দেননি। তা হলো তিনি বাতিলকে নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَمَا قَدَرُوا اللَّهَ حَقَّ قَدْرِهِ إِذْ قَالُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ عَلَىٰ بَشَرٍ مِّن شَيْءٍ

‘‘তারা আল্লাহর যথাযথ বড়ত্ব ও মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারেনি, যখন তারা বলল, আল্লাহ কোনো মানুষের উপর কিছুই নাযিল করেননি’’। (সূরা আনআম: ৯১)

এখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন, যে ব্যক্তি বলবে আল্লাহ তা‘আলা কাউকে রসূল হিসাবে পাঠাননি এবং কারো সাথে কথা বলেননি, তারা আল্লাহ তা‘আলার যথাযথা বড়ত্ব ও মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারেনি।

আলেমগণ নাবী ও রাসূলের মধ্যে একাধিক পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে সর্বোত্তম কথা হলো, যার নিকট আল্লাহ তা‘আলা আকাশের খবর পাঠিয়েছেন, তাকে যদি অন্যের নিকট সে খবর পৌঁছানোর আদেশ দেয়া হয়, তাহলে তিনি হবেন নাবী ও রসূল। আর তাকে যদি অন্যের নিকট সে খবর পৌঁছানোর আদেশ না দেয়া হয়, তাহলে তিনি হবেন নাবী; রসূল নন।[1]

সুতরাং রসূল নাবীর চেয়ে অধিকতর খাস। অর্থাৎ তাদের সংখ্যা নাবীদের সংখ্যার চেয়ে কম। সে হিসেবে প্রত্যেক রসূলই নাবী, কিন্তু প্রত্যেক নাবী রসূল নন। যাদের নিকট রসূল পাঠানো হয়েছে, তাদের দিক থেকে রেসালাত একটি ব্যাপক অর্থবোধক পরিভাষা। কারণ নাবী ও সাধারণ মানুষগণ তাদের দাওয়াতের আওতাধীন। নবুওয়াত রেসালাতের অংশ বিশেষ। রেসালাতের বাহকগণ অধিকতর খাস বিশেষত্বের অধিকারী। অর্থাৎ তাদের সংখ্যা নাবীদের তুলনায় কম এবং রেসালাত ও রাসূলের মর্যাদা নবুওয়াত ও নাবীর মর্যাদার চেয়ে বেশী।

সৃষ্টির জন্য রসূল পাঠানো আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম বিরাট নেয়ামত স্বরূপ। বিশেষ করে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পাঠানো আমাদের জন্য সর্ববৃহৎ নেয়ামত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِّنْ أَنفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ

‘‘আল্লাহ মুমিনদের প্রতি তাদেরই মধ্য থেকেই একজন রসূল পাঠিয়ে বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তার আয়াত তাদেরকে পাঠ করে শুনান, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও জ্ঞান শিক্ষা দেন। অথচ এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত ছিল’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৬৪) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ

‘‘হে মুহাম্মাদ! আমি তোমাকে সৃষ্টিজগতের জন্য আমার রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি’’। (সূরা আল আম্বীয়া: ১০৭)

[1]. কোনো কোনো আলেম নাবী ও রাসূলের মধ্যে এভাবে পার্থক্য করাকে সমর্থন করেন না। তারা বলেন, আল্লাহ তাআলা কাউকে নাবী বানিয়ে পাঠাবেন এবং তাকে তাবলীগ করার আদেশ দিবেন না, -এটি কিভাবে সম্ভব? এমনটি হতেই পারে না। কেননা কুরআন ও হাদীছের অনেক দলীল প্রমাণ করে যে, নাবীগণও তাবলীগ করেছেন। যেই হাদীছে ৭০ হাজার লোক ورأيت النبي ومعه الرجل والرجلان ورأيت النبي وليس معه أحد বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে যাবে বলে উল্লেখ হয়েছে, সেখানে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘‘আমি দেখলাম, কোনো কোনো নাবীর সাথে মাত্র একজন অনুসারী রয়েছে। আবার কোনো কোনো নাবীর সাথে রয়েছে দুইজন। সেই সঙ্গে এমন নাবীও দেখলাম, যার সাথে কোনো অনুসারী নেই’’। সুতরাং তাবলীগ করা ব্যতীত অনুসারী হয় কিভাবে? এতে বুঝা গেল যারা নাবী ও রাসূলের মধ্যে উপরোক্ত পার্থক্য করেছেন, তাদের কথা সঠিক নয়। শাইখ ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ নাবী ও রাসূলের মধ্যে যে পার্থক্য উল্লেখ করেছেন, এটি অপ্রাধান্য প্রাপ্ত মত।

অতএব, নাবী ও রাসূলের মধ্যকার পার্থক্যের ব্যাপারে সঠিক কথা হলো, যাকে আল্লাহ তাআলা নতুন শরীয়াত দিয়ে কাফের ও মুশরিক সম্প্রদায়ের নিকট পাঠিয়েছেন এবং তার মাঝে ও তার সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছে তিনি হলেন রসূল। আর যাকে পূর্ববর্তী রাসূলের শরীয়াতকে নবায়ন ও সংশোধন করার জন্য পাঠানো হয়েছে, তিনিই হলেন নাবী। সে হিসাবে নাবী ও রসূল উভয়কেই তাবলীগ করার আদেশ করা হয়েছে এবং তারা উভয়েই সেই দায়িত্ব পালন করেছেন।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৫ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে