আল্লাহ তা‘আলা আদম এবং তার সন্তানদের কাছ থেকে যে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন তা সত্য - ১

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

وَالْمِيثَاقُ الَّذِي أَخَذَهُ اللَّهُ تَعَالَى مِنْ آدَمَ وَذُرِّيَّتِهِ حَقٌّ

আল্লাহ তা‘আলা আদম এবং তার সন্তানদের কাছ থেকে যে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন তা সত্য।

........................................................

ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِن بَنِي آدَمَ مِن ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَىٰ ۛ شَهِدْنَا ۛ أَن تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَٰذَا غَافِلِينَ

‘‘আর হে নাবী! লোকদের স্মরণ করিয়ে দাও সেই সময়ের কথা যখন তোমার রব বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলেছিল নিশ্চয়ই তুমি আমাদের রব, আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা আমি এ জন্য করেছি যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, আমরা তো এ কথা জানতাম না’’। (সূরা আল ‘আরাফ: ১৭২)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এখানে সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদের বংশধরদের বের করেছেন এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর এ মর্মে সাক্ষী বানিয়েছেন যে, আল্লাহ তাদের প্রভু ও মালিক। তিনি ব্যতীত আর কোনো সত্য মাবুদ নেই।[1]

আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে সমস্ত বনী আদমকে বের করার ব্যাপারেও অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এগুলোতে এও বলা হয়েছে যে, তাদের মধ্যকার জান্নাতীদেরকে জাহান্নামীদেরকে আলাদা করা হয়েছে। এগুলোর কোনোটিতে তাদের থেকে এ সাক্ষ্য নেয়ার কথা বলা হয়েছে যে, তাদের রব হলেন একমাত্র আল্লাহ।

ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল রহিমাহুল্লাহ আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা আরাফা দিবসে আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তার বংশধরকে বের করে অঙ্গীকার নিয়েছেন। তিনি তার পিঠ থেকে তার প্রত্যেক সন্তানকে বের করেছেন। অতঃপর তার সামনে ছড়িয়ে দিয়েছেন। অতঃপর তাদের সাথে আল্লাহ তা‘আলা সামনা সামনি হয়ে কথা বলেছেন। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছেন الست بربكم؟ ‘‘আমি কি তোমাদের প্রভু নই?’’ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

قَالُوا بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ أَوْ تَقُولُوا إِنَّمَا أَشْرَكَ آبَاؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَكُنَّا ذُرِّيَّةً مِنْ بَعْدِهِمْ أَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُونَ

তারা সকলেই বলেছে, হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি। এটা আমি এ জন্য করেছি যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা না বলে বসো, আমরা তো এ কথা জানতাম না। অথবা তোমরা এ কথা বলতে না পারো যে, শির্কের সূচনা তো আমাদের বাপ-দাদারা আমাদের পূর্বেই করেছিলো এবং পরবর্তীকালে তাদের বংশে আমাদের জন্ম হয়েছে। তবে কি ভ্রষ্টাচারী লোকেরা যে অপরাধ করেছিল সে জন্য তুমি আমাদের পাকড়াও করছো? (সূরা আরাফ: ১৭২-১৭৩) ইমাম নাসাঈ, ইবনে জারীর, ইবনে আবী হাতিম এবং আবু আব্দুল্লাহ হাকেম মুস্তাদরাকে বর্ণনা করেছেন। হাকেম হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেন, হাদীছের সনদ বুখারী ও মুসলিমের শর্ত মোতাবেক ছহীহ। তারা তাদের কিতাবে হাদীছটি উল্লেখ করেননি।[2]

উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল রহিমাহুল্লাহ আরো বর্ণনা করেন যে, তাকে যখন উপরোক্ত আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো, তখন তিনি বললেন, আমি শুনেছি, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা আদমকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ডান হাত দ্বারা তার পিঠ মাসেহ করে তার থেকে তার কিছু বংশধরকে বের করেছেন। তারপর তিনি বলেছেন, আমি এদেরকে সৃষ্টি করেছি জান্নাতের জন্য। তারা জান্নাতবাসী হওয়ার আমলই করবে।

তিনি দ্বিতীয়বার তার পিঠে হাত মারলেন। এবারও তার থেকে কিছু বংশধর বের করলেন। এদের সম্পর্কে বললেন যে, আমি তাদেরকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তারা জাহান্নামবাসীদের আমলই করবে। তখন এক ব্যক্তি বলল, তাহলে আমলের প্রয়োজন কী?

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোনো বান্দাকে জান্নাতের জন্য সৃষ্টি করেন, তখন তাকে জান্নাতে যাওয়ার আমল করার তাওফীক দেন। সে জান্নাতবাসী হওয়ার কোনো একটি আমল করেই মৃত্যু বরণ করে। ফলে সে জান্নাতেই প্রবেশ করে। আর যখন তিনি জাহান্নামের জন্য কাউকে সৃষ্টি করেন, তাকে জাহান্নামবাসীদের আমলেই লাগিয়ে দেন। এতে করে সে জাহান্নামবাসীদের কোনো একটি আমল করেই মৃত্যু বরণ করে। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। ইমাম আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে আবী হাতিম, ইবনে জারীর এবং ইবনে হিববান তার ছহীহতে এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[3]

ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করলেন, তখন তার পিঠে হাত বুলালেন। এতে তার পিঠ থেকে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি হবে, তার সবগুলোই বের হয়ে আসলো। আর আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রত্যেকের কপালে দুই চোখের মাঝখানে উজ্জল একটি নূর স্থাপন করলেন। অতঃপর তাদেরকে আদম আলাইহিস সালামের সামনে পেশ করা হলো। আদম আলাইহিস সালাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আমার রব! এরা কারা? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, এরা হলো তোমার সন্তান। আদম তাদের মধ্যে এমন একজন লোকের কপালের নূর দেখে মুগ্ধ হলেন। তিনি তখন বললেন, হে আমার রব! এ লোকটি কে? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তিনি হলেন, আখেরী যামানায় তোমার বংশের একজন লোক। তার নাম দাউদ। আদম আলাইহিস সালাম বললেন, হে আমার রব! তার বয়স কত? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, ৬০ বছর। তিনি বললেন, হে আমার রব! আমার বয়স থেকে কেটে ৪০ বছর নিয়ে তার বয়স ১০০ করে দাও। আদমের বয়স যখন শেষ হলো তখন মালাকুল মাওত আসলেন। আদম তখন বললেন, আমার বয়স কি আরো ৪০ বছর অবশিষ্ট রয়ে যায়নি? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তুমি কি তোমার সন্তান দাউদকে ৪০ বছর দিয়ে দাওনি? আদম তা অস্বীকার করলেন। তাই তার সন্তানরাও অস্বীকার করে। আদম ভুলে গিয়েছিলেন তাই তার সন্তানেরাও ভুলে যায়। আদম আলাইহিস সালাম গুনাহ করেছিলেন, তাই তার সন্তানেরাও গুনাহ করে।[4] ইমাম তিরমিযী রহিমাহুল্লাহ হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেন, এ হাদীছটি হাসান ছহীহ। ইমাম হাকেমও হাদীছটি বর্ণনা করার পর বলেন, হাদীছটি ছহীহ মুসলিমের শর্তে ছহীহ, তবে তিনি তা বর্ণনা করেননি।

ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল রহিমাহুল্লাহ আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

يقال للرجل من أَهْلِ النَّارِ يوم القيامة أرأيت لَوْ كان لَكَ مَا على الارْضِ مِنْ شَيْءٍ أكُنْتَ مفْتَدِيا بِهِ؟ قَالَ: نَعَمْ. قَالَ: فيقول فَقَدْ أردت منك أَهْوَنَ مِنْ هَذَا قد أخذت عليك فِي ظهر آدَمَ؛ أَنْ لا تُشْرِكَ بِي شيئا فَأَبَيْتَ إِلا أن تشرك بي شيئا (بخارى:3334)

‘‘আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন জাহান্নামবাসীদের কাউকে জিজ্ঞাসা করবেন, দুনিয়ার সমস্ত সম্পদ যদি তোমার হাসিল হয়ে যায়, তাহলে এ আযাব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য বিনিময় স্বরূপ তুমি কি সব সম্পদ দিয়ে দিবে? সে বলবে, হ্যাঁ। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আল্লাহ্ বলবেন, অথচ তুমি যখন আদমের পৃষ্ঠে ছিলে তখন আমি তোমার কাছে এর চেয়ে অতি সহজ একটি বিষয় চেয়েছিলাম। তা হচ্ছে আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। কিন্তু তুমি তা মানতে অস্বীকার করেছো এবং শির্কে লিপ্ত হয়েছো। হাদীছটি ইমাম বুখারী এবং মুসলিমও বর্ণনা করেছেন।

ইমাম আহমাদ বিন হান্বাল এ বিষয়ে আরো অনেক হাদীছ উল্লেখ করেছেন। তার সবগুলো হাদীছ প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা আদমের পিঠ থেকে তার বংশধরকে বের করে জান্নাতীদের থেকে জাহান্নামীদেরকে আলাদা করেছেন। এখান থেকেই একদল লোক বলেছে, দেহ সৃষ্টি করার পূর্বেই রূহ সৃষ্টি করা হয়েছে।[5] তবে হাদীছগুলো এ কথা প্রমাণ করে না যে, দেহের পূর্বেই স্থায়ীভাবে রূহ সৃষ্টি করা হয়েছে। এগুলো সর্বোচ্চ যা প্রমাণ করে, তা হলো মহান স্রষ্টা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা রূহগুলোর আকৃতি বানিয়েছেন, তাদের সৃষ্টি, বয়স এবং কর্ম নির্ধারণ করেছেন। অতঃপর উক্ত আকৃতিগুলো তাদের সৃষ্টির মূল উপাদান থেকে বের করেছেন। অতঃপর তিনি সেগুলোকে সেই উপাদানের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বনী আদমকে তার জন্য নির্ধারিত সময়ে বের হওয়ার বিষয়টি নির্ধারণ করেছেন। হাদীছগুলো প্রমাণ করে না যে, রূহগুলো স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি হয়ে আছে, সবগুলো রূহ এক স্থানে মজুদ আছে ও পরস্পর কথা বলছে। এ কথা প্রমাণ করে না যে, সেই স্থান থেকে দলে দলে বিভক্ত করে রূহগুলো দেহে পাঠানো হয়। যেমনটি বলেছেন ইমাম ইবনে হাযম রহিমাহুল্লাহ। এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছসমূহ এ কথার প্রমাণ বহন করে না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলা পূর্বের নির্ধারণ অনুযায়ী একদলের পরে আরেক দল রূহ সৃষ্টি করেন। তাই পূর্বের নির্ধারণ অনুপাতেই সৃষ্টিজগতের মধ্যে সৃষ্টিসমূহ অস্তিত্বে আসে। সমস্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রেই আল্লাহ তা‘আলার এ নিয়ম। আল্লাহ তা‘আলা এগুলোর তাকদীর ও বয়স নির্ধারণ করেছেন এবং এগুলোর বিশেষণ-বৈশিষ্ট্য ও অবস্থা-আকার-আকৃতি দান করেছেন। অতঃপর তিনি পূর্বের তাকদীর অনুযায়ী অস্তিত্বে আনয়ন করেছেন।[6]

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীছগুলো আদিতে তাকদীর নির্ধারণ করার কথা প্রমাণ করে। এগুলো থেকে কিছু কিছু হাদীছ প্রমাণ করে কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ সৃষ্টি হবে তাদের ছবি বের করে দেখিয়েছেন এবং সেগুলোকে দুইভাবে বিভক্ত করেছেন এবং জাহান্নামীদের থেকে জান্নাতীদেরকে আলাদা করেছেন।

আর সমস্ত আদম সন্তানকে আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করার পর তাদের থেকে স্বীকারোক্তি নেয়ার ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে দু’টি মাওকুফ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এখান থেকেই পূর্ববর্তী ও পরবর্তীকালের অনেক আলেম বলেছেন এ সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হলো তাদেরকে তাওহীদের উপর সৃষ্টি করা। যেমনটি সূরা আরাফের ১৭৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী: شَهِدْنَا ‘‘আমরা এর সাক্ষ্য দিচ্ছি’’। এর অর্থ হলো, তারা বলেছে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রভু। ইবনে আববাস ও উবাই ইবনে কা’ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে এ কথা বর্ণিত হয়েছে। ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আরো বলেন, একজনকে অন্যজনের উপর সাক্ষী বানিয়েছেন।

আবার কেউ কেউ বলেছেন, شَهِدْنَا ‘‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি’’, এটি হলো ফেরেশতাদের কথা। আর ওয়াক্ফ করতে হবে بلى শব্দের উপর। মুজাহিদ, যাহহাক এবং সুদ্দী এ মত পোষণ করেছেন। ইমাম সুদ্দী আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের এবং ফেরেশতাদের সম্পর্কে খবর দিয়েছেন যে, তারা বনী আদমের স্বীকৃতির ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়েছেন।[7]

তবে প্রথম অর্থটিই অধিক সুস্পষ্ট। অর্থাৎ তাওহীদের উপর তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাওহীদের দলীল-পত্র তাদের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। অন্য কথাগুলো সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। তবে তার পক্ষে কোনো দলীল নেই। আয়াতের বাহ্যিক অর্থও প্রথম অর্থকেই সমর্থন করে।

জেনে রাখা আবশ্যক যে, কতিপয় মুফাস্সির শুধু এ কথাই উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তার বংশধরদেরকে বের করে তাদের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায় করেছেন। অতঃপর তাদেরকে আদমের পীঠে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ইমাম ছা’লাবী, বগবী এবং অন্যান্য ইমামগণ এ কথাই বলেছেন। অন্যদিকে কতিপয় মুফাস্সির এ কথা উল্লেখ করেননি। তারা শুধু এতটুকু উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা কেবল রুবুবিয়াত ও উলুহিয়াতের দলীল-প্রমাণ পেশ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের মধ্যে যে বিবেক-বুদ্ধি স্থাপন করেছেন, তা তার রুবুবীয়াত এবং একত্বের সাক্ষ্য দিয়েছে। ইমাম যামাখশারী এবং অন্যান্য ইমামগণ এ কথা উল্লেখ করেছেন।

কোনো কোনো মুফাস্সির উভয় কথাই উল্লেখ করেছেন।[8] ওয়াহেদী, ফখরুদ্দীন রাযী, ইমাম কুরতুবী এবং অন্যান্য ইমাম এ কথা উল্লেখ করেছেন। তবে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী প্রথম মতটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দিকে সম্বন্ধ করেছেন। আর দ্বিতীয় কথাটিকে মুতাযেলাদের দিকে সম্বন্ধ করেছেন। নিঃসন্দেহে আয়াতটি প্রমাণ করে যে, অঙ্গীকার আদমের পিঠ থেকেই নেয়া হয়েছিল এবং তাতে এ কথাও পাওয়া যাচ্ছে যে, আদমের সন্তানদের পিঠ থেকেও অঙ্গীকার নেয়া হয়েছিল। তবে কতক হাদীছ প্রমাণ করে যে, আদমের পীঠ থেকে তার বংশধরদেরকে বের করা হয়েছিল এবং সেখানে তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী বানানো হয়েছিল। কতক হাদীছ এও প্রমাণ করে যে, সাক্ষী বানানো হয়েছে এবং ফায়ছালা করা হয়েছে যে, তাদের কতক যাবে জান্নাতে এবং কতক যাবে জাহান্নামে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমারের হাদীছে এ কথাই বর্ণিত হয়েছে। কিছু কিছু হাদীছে অঙ্গীকার গ্রহণ করা এবং আদমকে তার বংশধর দেখানোর কথা বর্ণিত হয়েছে। জান্নাত ও জাহান্নামের ফায়ছালা এবং সাক্ষী রাখার কথা বলা হয়নি। আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে এটি বর্ণিত হয়েছে।

প্রথম মতের প্রবক্তাগণ যেভাবে সাক্ষ্য নেয়ার কথা বলেছেন, তাদের মতের পক্ষের হাদীছটি আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে মাওকুফ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। এ হাদীছকে মুহাদ্দিছগণ যঈফ বলেছেন। ছহীহ ও বুখারীর শর্তে রচিত মুস্তাদরাক আল-হাকেম ব্যতীত অন্য কোনো ছহীহ গ্রন্থকার হাদীছটি বর্ণনা করেননি। আর আবু আব্দুল্লাহ আল হাকেম তার ছহীহ গ্রন্থে স্বীয় শর্তের ব্যাপারে শিথিলতা প্রদর্শনের বিষয়টি সর্বজন বিদিত।

আর যে হাদীছে জান্নাতী ও জাহান্নামীদেরকে আলাদা করার কথা এসেছে, তাতে তাকদীরের দলীল রয়েছে। এর সমর্থনে রয়েছে অনেক হাদীছ। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের মধ্যে তাকদীর নির্ধারণের ব্যাপারে কোনো মতভেদ নেই। বিদআতী ও বাতিলপন্থী কাদারীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরাই এতে মতভেদ করেছে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ বলেছেন, অঙ্গিকার নেয়া হয়েছে আদমের সন্তানদের থেকে এবং সাক্ষী রাখা হয়েছে তাদেরকেই। তবে তাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের মধ্যে এ অঙ্গিকার নেয়ার ধরণ ও পদ্ধতি সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। আমি যদি নিজের উপর কিতাবটি সংক্ষিপ্ত করার শর্তারোপ না করতাম, তাহলে এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলো সবিস্তারে উল্লেখ করতাম। সেই সঙ্গে হাদীছগুলোর ব্যাপারে যত কথা বলা হয়েছে, যত বোধগম্য অর্থ বর্ণনা করা হয়েছে এবং আয়াতে কারীমার শব্দসমূহে যত দলীল রয়েছে তাও উল্লেখ করতাম।

ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, এ আয়াতটির অর্থের মধ্যে অস্পষ্টতা রয়েছে। তাই আলেমগণ এর ব্যাখ্যায় অনেক কথা বলেছেন। আমার পক্ষে যতদূর জানা সম্ভব হয়েছে, তার আলোকে তাদের কথাগুলো থেকে কিছুটা উল্লেখ করবো। কেউ কেউ বলেছেন, আয়াতের অর্থ হলো, আল্লাহ তা‘আলা বনী আদমের একজনের পৃষ্ঠদেশ থেকে অন্যজনকে বের করেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

وَأَشْهَدَهُمْ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ

‘‘এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী বানিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, আমি কি তোমাদের রব নই? (সূরা আল আরাফ:১৭২)।

এর অর্থ হলো তিনি তাদেরকে তাওহীদের দলীল-প্রমাণ দেখিয়েছেন। কেননা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক লোকই জানে যে, তার এক প্রভু রয়েছেন। তিনি পবিত্র ও সমুন্নত। এটিই তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী বানানোর অর্থ।

যেমন আসমান-যমীনের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ ‘‘তারা বলল, আমরা অনুগত হয়ে আগমন করলাম’’। ইমাম কাফফাল এ মত পোষণ করেছেন এবং এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা মানুষের দেহ সৃষ্টি করার আগেই তাদের রূহ সৃষ্টি করেছেন।[9]

রূহ সৃষ্টি করে তাতে এমন ইলম ও মারেফত স্থাপন করেছেন, যাতে তারা আল্লাহর সম্বোধন বুঝতে সক্ষম হয়েছে। এরপর ইমাম কুরতুবী এ বিষয়ে বর্ণিত হাদীছগুলো উল্লেখ করেছেন। ইমাম কুরতুবীর কথা আরো বাকী রয়েছে।

বনী আদমের পৃষ্ঠদেশেই তাদের বংশধরকে বের করার পর তাদেরকে তাদের উপর সাক্ষী রাখার ব্যাপারে সর্বাধিক শক্তিশালী দলীল হলো বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছ। তাতে রয়েছে,

«فَقَدْ أردت منك أَهْوَنَ مِنْ هَذَا قد أخذت عليك فِي ظهر آدَمَ؛ أَنْ لا تُشْرِكَ بِي شيئا فَأَبَيْتَ إِلا أن تشرك بي شيئا»

হে বনী আদম! তুমি যখন আদমের পৃষ্ঠে ছিলে তখন আমি তোমার কাছে এর চেয়ে অতি সহজ একটি বিষয় চেয়েছিলাম। তা হচ্ছে আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না। কিন্তু তুমি তা মানতে অস্বীকার করেছো এবং শির্কে লিপ্ত হয়েছো।[10]

অন্য বর্ণনায় এসেছে, হে বনী আদম! আমি তোমার কাছে এর চেয়ে কম ও সহজতর একটি বিষয় চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি তা করোনি। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এ হাদীছে আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তাদেরকে বের করার কথা বলা হয়নি। অর্থাৎ প্রথম মতের প্রবক্তাগণ আদম সন্তানদেরকে যেভাবে বের করার কথা বর্ণনা করেছেন প্রথম বর্ণনাতে তা উল্লেখ করা হয়নি।

[1]. এ মতটিই অধিক বিশুদ্ধ এবং প্রাধান্যপ্রাপ্ত। আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে নয়; বরং তার সন্তানদের কতকের পৃষ্ঠদেশ থেকে কতককে বের করে ওয়াদা-অঙ্গিকার নিয়েছেন। উপরোক্ত আয়াতটি এ কথাকেই সমর্থন করে।

[2]. ছহীহ: আস ছহীহ ১৬২৩।

[3]. ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহ বলেন, অন্য হাদীছ দ্বারা সমর্থিত হওয়ার কারণে হাদীছটি সহীহ। দেখুন, শাইখের তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২২০।

[4]. ইমাম তিরমিযী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন: শাইখের তাহকীকসহ শারহুল আকীদাহ আত্ তাহাবীয়া, টিকা নং- ২২১।

[5]. দার্শনিক ও মুতাযেলা সম্প্রদায় এ কথা বলেছে। তাদের মতে মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই তাদের রূহ আলাদাভাবে সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে রূহসমূহকে দেহের পূর্বে সৃষ্টি করে এক স্থানে রাখা হয়নি। বরং আল্লাহ তাআলা তাদেরকে তাদের সৃষ্টির উপাদান থেকে একবার বের করেছেন এবং আকৃতি দিয়েছেন। অতঃপর তাদের বয়স, আমল ইত্যাদি নির্ধারণ করে তাদের সৃষ্টির উপাদানের মধ্যে ফিরিয়ে দিয়েছেন।

[6]. এটিই সালাফে সালেহীনদের মত।

[7]. অর্থাৎ রূহ জগতে ফেরেশতাগণ বনী আদমের স্বীকৃতির উপর সাক্ষী হয়েছে।

[8]. প্রথম কথাটি হলো আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে তার বংশধরদেরকে বের করে অঙ্গিকার নিয়েছেন। আর দ্বিতীয় কথাটি হলো তাদেরকে তাওহীদের উপর সৃষ্টি করেছেন এবং তাওহীদের দলীল-পত্র দেখিয়েছেন।

[9]. আশায়েরা সম্প্রদায় এ মত পোষণ করেছে।

[10]. ছহীহ বুখারী হা/৬৫৫৭, মুসনাদে আহমাদ। এ হাদীছ প্রমাণ করে যে, আদমের পৃষ্ঠেই তার সন্তানদেরকে তাওহীদের দলীল-প্রমাণ দেখানো হয়েছে এবং সম্বোধন করা হয়েছে। পৃষ্ঠদেশ থেকে বাহিরে আনয়ন করা হয়নি।