রাহে বেলায়াত তৃতীয় অধ্যায় - দৈনন্দিন যিকর ওযীফা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ৩৮ টি
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ১. ঘুম ভাঙ্গার যিকর

পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলিতে আমরা যিকরের পরিচয়, গুরুত্ব, প্রকারভেদ, আদব ইত্যাদি বিষয় জানতে পেরেছি। এ অধ্যায়ে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শেখানো ও আচরিত ‘যিকর’গুলি বিস্তারিত আলোচনা করব। যিকরের মধ্যে আমরা ইসতিগফার, দু‘আ, সালাত, সালাম সবই উল্লেখ করব। কারণ আমরা দেখেছি যে, এগুলি সবই যিকর। দু‘আ, ইসতিগফার ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার যিকর রাসূলুল্লাহ (সা.) কখন কিভাবে পালন করেছেন বা করতে নির্দেশ দিয়েছেন তা আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

মুমিনের জীবন যিকর কেন্দ্রিক হবে। সে তার সাধ্যমতো সদা সর্বদা আল্লাহর যিকরে নিজের জিহ্বা ও হৃদয়কে আর্দ্র রাখবে। এছাড়াও যিকরের জন্য কুরআন ও হাদীসে বিশেষ ৬ টি দৈননিদন সময় উল্লেখ করা হয়েছে: (১). সকাল, (২). বিকাল, (৩). সন্ধ্যা, (৪). ঘুমানোর আগে, (৫). শেষ রাত্রে ও (৬). পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রশস্ত ও গুরুত্বপূর্ণ সময় সকাল। মুমিনের জীবনের প্রতিদিন শুরু হবে আল্লাহর যিকররের মধ্য দিয়ে। সকালেই সে তার প্রভুর যিকরের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় রুহানী খাদ্য ও শক্তি সংগ্রহ করবে, যা তাকে সারাদিন সকল প্রতিকূলতার মধ্যে পবিত্র হৃদয়ে আল্লাহর সাথে নিজেকে যুক্ত রাখতে সাহায্য করবে।


সকালের সময়কে আমরা দুভাগে ভাগ করছি - প্রথমত, ফজরের ফরয সালাত আদায় পর্যন্ত ও দ্বিতীয়ত, ফজরের সালাতের পর থেকে ‘সালাতুদ দোহা’ বা চাশতের নামায পর্যন্ত। প্রথম সময়ে সাধারণত মুমিন ঘুম থেকে উঠে ওযু করে সালাতের প্রস্তুতি নেন। ফজরের আযান হলে তিনি সুন্নাত সালাত আদায় করেন এবং পরে মসজিদে যেয়ে ফরয সালাত আদায় করেন। এই পর্যায়ে আমি ঘুম ভাঙ্গার যিকর, ওযুর যিকর, আযানের যিকর, ঘর থেকে বাহির হওয়া, মসজিদে গমন, সুন্নাত ও ফরয সালাত আদায়ের কিছু নিয়মাবলী আলোচনা করব। এগুলি মূলত সাধারণ বিষয়। মুমিন সকল সময়ে ওযু, গোসল, আযান ও সালাতে এগুলির দ্বারা উপকৃত হবেন বলে আশা রাখি। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমি সেই সকল যিকর আলোচনা করব যা মুমিন ফজরের সালাতের পর থেকে ‘দোহা’-র সালাত বা চাশতের নামায পর্যন্ত ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যে পালন করবেন।


সকালের যিকর: প্রথম পর্যায়

১. ঘুম ভাঙ্গার যিকর

রাতে ঘুম থেকে উঠা দুই প্রকার হতে পারে, রাতের বেলায় কোনো কারণে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া এবং স্বাভাবিকভাবে ভোরে ঘুম থেকে উঠা।


যিকর নং ৩৫ : রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে পালনীয় যিকর

(২, ৯, ৪, ১, ১০ ও ১৩ নং যিকর একত্রে) :

لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ الْحَمْدُ لِلَّهِ وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاللَّهُ أَكْبَرُ وَلا حَوْلَ وَلا قُوَّةَ إِلا بِاللَّهِ


উচ্চারণঃ লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়া‘হদাহু লা- শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু, ওয়া লাহুল ‘হামদ, ওয়া হুআ ‘আলা- কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদীর, ‘আল-‘হামদু লিল্লাহ’, ওয়া ‘সুব‘হা-নাল্লা-হ’, ওয়া লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়া ‘আল্লা-হু আকবার’, লা- ‘হাওলা ওয়া লা- ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ।

অর্থঃ “আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই, এবং প্রশংসা তাঁরই। এবং তিনি সর্বোপরি ক্ষমতাবান। সকল প্রশংসা আল্লাহর। আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করছি। আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। কোনো অবলম্বন নেই, কোনো ক্ষমতা নেই আল্লাহর (সাহায্য) ছাড়া।”


উবাদা ইবনু সামিত (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছে‘ন, “যদি কারো রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে যায় অতঃপর সে উপরের যিকরের বাক্যগুলি পাঠ করে এবং এরপর সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় অথবা কোনো প্রকার দু‘আ করে বা কিছু চায় তাহলে তার দু‘আ কবুল করা হবে। আর যদি সে এরপর উঠে ওযু করে (তাহাজ্জুদের) সালাত আদায় করে তাহলে তার সালাত কবুল করা হবে।”[1]

সুবহানাল্লাহ ! বিছানায় থাকা অবস্থাতেই, কোনোরূপ ওযু বা পবিত্রতা অর্জন ছাড়াই এই বাক্যগুলি পাঠ করলে এতবড় পুরস্কার!! এই যিকরের মধ্যে অতি পরিচিত যিকরের ৬ টি বাক্য রয়েছে, যা প্রায় সকল মুসলমানেরই মুখস্থ রয়েছে।


যিকর নং ৩৬ : স্বাভাবিকভাবে ভোরে ঘুম থেকে উঠার যিকর :

বিভিন্ন হাদীসে আল্লাহর যিকরের মধ্য দিয়ে দিনের শুভ ও কল্যাণময় সূচনা করতে ও যিকরের মধ্য দিয়ে দিনের কল্যাণময় সমাপ্তি করতে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ভোরে ঘুম থকে উঠে বিভিন্ন যিকর রাসূলুল্লাহ (সা.) পালন করতেন ও করতে শিখিয়েছেন। এখানে একটি যিকর উল্লেখ করছি:

الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا وَإِلَيْهِ النُّشُورُ


উচ্চারণঃ আল-‘হামদু লিল্লা-হিল লাযী আ‘হইয়া-না- বা‘দা মা- আমা-তানা ওয়া ইলাইহিন নুশূর।


অর্থঃ “সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে জীবিত করেছেন মৃত্যুর (ঘুমের) পরে, আর তাঁর কাছেই আমাদের ফিরে যেতে হবে।”হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) ও আবু যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘুম থেকে উঠে উপরের যিকরটি বলতেন।[2]

[1] সহীহ বুখারি ১/৩৮৭, নং ১১০৩।

[2] সহীহ বুখারি ৫/২৩৬, ২৩২৭, ২৩৩০, ৬/২৬৯২, নং ৫৯৫৩, ৫৯৫৫, ৫৯৬৫, ৫৯৫৯, সহীহ মুসলিম ৪/২০৮৩, নং ২৭১১।
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ২. ইস্তিঞ্জার যিকর

যিকর নং ৩৭ (ক) : ইস্তিঞ্জায় পূর্বে যিকর

بسم الله اللهم إني أعوذ بك من الخبث والخبائث


উচ্চারণঃ বিসমিল্লা-হ, আল্লা-হুম্মা, ইন্নী আ‘ঊযু বিকা মিনাল খুবুসি ওয়াল খাবা-ইসি।

অর্থঃ “আল্লাহর নামে। হে আল্লাহ, আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি - অপবিত্র, অকল্যাণ, খারাপ কর্ম থেকে বা পুরুষ ও নারী শয়তান থেকে।”

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইস্তিঞ্জার জন্য গমন করলে এই দু‘আটি পাঠ করতেন। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থের হাদীসে ‘বিসমিল্লাহ’ ছাড়া দু‘আটি বর্ণিত হয়েছে। মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা গ্রন্থে সংকলিত অন্য সহীহ হাদীসে দু‘আটির শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ উল্লেখ করা হয়েছে।[1]

ইস্তিঞ্জার সময় মুখের যিকর অনুচিত :

ইতোপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকরে রত থাকতেন। এই যিকর বলতে মুখে উচ্চারণের যিকর বুঝান হয়েছে। এই হাদীসের আলোকে মুসলিম উম্মাহর ফকীহগণ সকল অবস্থায় মুখে আল্লাহর যিকর করা সম্ভব ও উচিত বলে মত প্রকাশ করেছেন। তবে দুটি অবস্থায় যিকর না করাই উচিত বলে অধিকাংশ আলিম ও ফকীহ মত প্রকাশ করেছেন। প্রথমত, ইস্তিঞ্জায় রত থাকা অবস্থা। তবে অধিকাংশ ইমাম ও ফকীহ এই অবস্থায় মুখে যিকর মাকরূহ তানযিহী বা অনুচিত বলে মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম নববী লিখেছেনঃ প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার সময় কোনো প্রকার আল্লাহর যিকর করা মাকরূহ। তাসবীহ, তাহলীল, সালামের উত্তর প্রদান, হাঁচির উত্তর প্রদান, হাঁচি দিয়ে ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ বলা, আযানের জবাব দেওয়া ইত্যাদি কোনো প্রকারের যিকর মুমিন এই অবস্থায় এবং স্বামী-স্ত্রীর মিলন অবস্থায় করবেন না। যদি তিনি হাঁচি দেন তাহলে জিহ্বা না নেড়ে মনে মনে ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ বলবেন। এছাড়া প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তা বলাও এ সময়ে মাকরূহ। এই দুই অবস্থায় কথাবার্তা বা যিকর মাকরূহ তাহরীমি বা হারাম পর্যায়ের মাকরূহ নয়, বরং মাকরূহ তানযীহী বা “অনুচিত” পর্যায়ের মাকরূহ। এই অবস্থায় যিকর করলে গোনাহ হবে না, তবে যিকর না করাই উচিত। ইস্তিঞ্জায় রত ব্যক্তিকে সালাম প্রদান করাও মাকরূহ। অধিকাংশ ইমাম ও ফকীহের এ মত। ইবনু সীরীন, ইবরাহীম নাখয়ী প্রমুখ এ মতের বিরোধিতা করেছেন। তারা এই অবস্থায় যিকর, তাসবীহ-তাহলীল, সালামের উত্তর ইত্যাদি জায়েয বলেছেন।[2]


যিকর নং ৩৭ (খ) : ইস্তিঞ্জার পরের যিকর :

غفرانك


উচ্চারণঃ গুফরা-নাকা।
অর্থঃ “আপনার ক্ষমা প্রার্থনা করি।”

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইস্তিঞ্জা শেষে বেরিয়ে আসলে এই দু‘আটি বলতেন। হাদীসটি হাসান। কোনো কোনো যয়ীফ সূত্রে এই বাক্যটির পরে অতিরিক্ত কিছু বাক্য বলা হয়েছে।[3]

[1] সহীহ বুখারি ১/৬৬, নং ১৪২, ৫/২৩৩০, নং ৫৯৬৩, সহীহ মুসলিম ১/২৮৩, নং ৩৭৫, মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা ১/১১, সুনানু ইবনু মাজাহ ১/১০৯, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ২/৮৬০, নং ৪৭১৪।

[2] নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম ৪/৬৫, আল-আযকার, পৃ. ৫৩, ৫৪।

[3] তিরমিযী ১/১২, নং ৭, আবু দাউদ ১/৮ নং ৩০, হাকিম ১/২৬১, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ১/৪৮।
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৩. ওযুর যিকর

যিকর নং ৩৮ : ওযুর পূর্বের যিকর : (بسم الله)

উচ্চারণঃ বিসমিল্লা-হ।
অর্থঃ আল্লাহর নামে। অথবা, (بسم الله الرحمن الرحيم)
উচ্চারণঃ বিসমিল্লা-হির রা‘হমা-নির রা‘হীম।
অর্থঃ পরম করুণাময় দয়াবান আল্লাহর নামে।

ওযুর পূর্বে “বিসমিল্লা-হ” অথবা “বিসমিল্লা-হির রাহমা-নির রাহীম” বলা সুন্নাত। একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছেঃ

لا وضوء لمن لم يذكر اسم الله عليه


“ওযুর শুরুতে যে আল্লাহর নাম যিকর করল না তার ওযু হবে না।” হাদীসটি কয়েকটি দুর্বল সনদে বর্ণিত হয়েছে। তবে ভিন্ন ভিন্ন যয়ীফ সনদে বর্ণিত হওয়ার ফলে তা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।[1]


ওযুর আগে মুখে নিয়্যাত পাঠ খেলাফে সুন্নাত

এখানে উল্লেখ্য যে, ওযুর পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা ছাড়া অন্য কোনো মাসনূন যিকর নেই। আমাদের দেশে অনেকে ওযুর পূর্বে ‘নাওয়াইতু আন...’ ইত্যাদি শব্দে ওযুর নিয়্যাত বলেন বা পাঠ করেন। নিয়্যাত অর্থ উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা। যে কোনো ইবাদতের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য থাকা প্রয়োজন। এই নিয়্যাত মানুষের অন্তরের অভ্যন্তরীণ সংকল্প বা ইচ্ছা, যা মানুষকে উক্ত কর্মে উদ্বুদ্ধ বা অনুপ্রাণিত করেছে। নিয়্যাত, উদ্দেশ্য বা সংকল্প করতে হয়, বলতে বা পড়তে হয় না। রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো জীবনে একটিবারের জন্যও ওযু, গোসল, সালাত, সিয়াম ইত্যাদি কোনো ইবাদতের জন্য কোনো প্রকার নিয়্যাত মুখে বলেননি। তাঁর সাহাবীগণ, তাবেয়ীগণ, ইমাম আবু হানীফা (রহ)-সহ চার ইমাম বা অন্য কোনো ইমাম ও ফকীহ কখনো কোনো ইবাদতের নিয়্যাত মুখে বলেননি বা বলতে কাউকে নির্দেশ দেননি।

পরবর্তী যুগের কোনো কোনো আলিম এগুলি বানিয়েছেন। তাঁরাও বলেছেন যে, মুখের উচ্চারণের কোনো মূল্য নেই, মনের মধ্যে উপস্থিত নিয়্যাত বা উদ্দেশ্যই মূল, তবে এগুলি মুখে উচ্চারণ করলে মনের নিয়্যাত একটু পোক্ত বা দৃঢ় হয়। এজন্য এগুলি বলা ভালো। তাঁদের এই ভালোকে অনেকেই স্বীকার করেননি। মুজাদ্দিদে আলফে সানী ওযু, সালাত, সিয়াম ইত্যাদি যে কোনো ইবাদতের জন্য মুখে নিয়্যাত করাকে খারাপ বিদ‘আত হিসাবে নিন্দা করেছেন এবং কঠোরভাবে এর বিরোধিতা করেছেন। কারণ এভাবে মুখে নিয়্যাত বলার মাধ্যমে আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণের আজীবনের সুন্নাত - ‘শুধুমাত্র মনে মনে নিয়্যাত করা’-কে পরিত্যাগ করছি। আমি “এহ্ইয়াউস সুনান” গ্রন্থে এ বিষয়ে বিসাত রিত আলোচনা করেছি।[2]


ওযুর মধ্যে কোনো সহীহ মাসনূন যিকর নেই


ওযুর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলার পরে ওযু শেষ করার আগে কোনো প্রকারের মাসনূন যিকর নেই। আমাদের দেশে ধার্মিক মানুষদের মধ্যে ওযুর মধ্যে প্রত্যেক অঙ্গ ধোয়ার সময় কিছু কিছু দু‘আ পাঠের রেওয়ায আছে। এগুলি সবই বানোয়াট দু‘আ। ইমাম নাবাবী, মুল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে, ওযুর সময় বিভিন্ন অঙ্গ ধোয়া বা মাসেহ করার সময় যে সকল দু‘আ পাঠ করা হয় তা সবই ‘মাউযূ’ বা বানোয়াট মিথ্যা হাদীস। রাসূলুল্লাহ (সা.) বা সাহাবীগণ থেকে এ বিষয়ে সহীহ বা গ্রহণযোগ্য সনদে একটি দু‘আও বর্ণিত হয়নি।[3]

কোন কোন আলিম ও বুজুর্গ এ সকল দু‘আ গ্রহণ করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি, মুমিন যে কোনো সময় দু‘আ ও যিকর করতে পারে। কোনো সময়ে বা স্থানে মাসনূন যিকর বা দু‘আ না থাকলে সেখানে আমরা আমাদের বানানো দু‘আ করতে পারি। এ সকল দু‘আ না- জায়েয হবে না।

কথাটি বাহ্যত ঠিক হলেও এর ভিন্ন একটি দিক রয়েছে। মুমিন সর্বাবস্থায় যিকর বা দু‘আ করতে পারেন। তিনি মাসনূন শব্দ ছাড়াও নিজের বানানো শব্দে দু‘আ ও যিকর করতে পারেন, যদি তার অর্থ শরীয়ত-সঙ্গত হয়। কিন্তু মুমিন কোনো মাসনূন ইবাদত বা যিকর পরিবর্তন করতে পারেন না। এ ছাড়া মাসনূন ব্যতীত অন্য কোনো যিকরকে রীতি হিসাবে গ্রহণ করাও অনুচিত। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখা উচিতঃ


প্রথমত, যে সকল ইবাদত রাসূলুল্লাহ (সা.) পালন করেছেন সে সকল ইবাদতের মধ্যে বানোয়াট যিকর প্রবেশ করানো রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর সুন্নাতকে অবজ্ঞা করার পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। যেমন, সালাত, আযান, ওযু, গোসল, তায়াম্মুম, হাঁচি, ইত্যাদির মাসনূন পদ্ধতি ও যিকর নির্ধারিত রয়েছে। এগুলির মধ্যে কিছু বৃদ্ধি করার অর্থ রাসূলুল্লাহ (সা.) যতটুকু শিখিয়েছেন তাতে আমরা তৃপ্ত হতে পারলাম না। অথবা একথা মনে করা যে, তিনি যতটুকু শিখিয়েছে ততটুকু ভালো, তবে আরেকটু বেশি করলে তা আরো ভালো হবে। আমরা সকলেই বুঝতে পারি যে, এই চিন্তা খুবই অন্যায়।

তাহলে প্রশ্ন, হাদীসে যতটুকু বর্ণিত আছে তার বেশি কি আমরা দু‘আ করতে পারব না? এ প্রশ্নের উত্তর খুবই সহজ। মাসনূন ইবাদত, যিকর ও দু‘আর মধ্যে আমরা কোনো কম-বেশি করব না। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে অতিরিক্ত দু‘আ, যিকর ও ইবাদতের সময় ও সুযোগ শিক্ষা দিয়েছেন, সে সময়ে ও সুযোগে আমরা যত খুশি বেশি বেশি দু‘আ ও যিকর করতে পারব।

উদাহরণ হিসাবে সালাতের উল্লেখ করা যায়। সালাত মুমিনের জীবনের অন্যতম যিকর ও ইবাদত। মুমিন যত ইচ্ছা বেশি সালাত পড়তে পারেন এবং পড়া উচিত। তবে তিনি মাসনূন সালাতের মধ্যে বৃদ্ধি করতে পারেন না। তিনি যোহরের আগে বা পরে আসর পর্যন্ত যত ইচ্ছা নফল সালাত পড়তে পারেন। কিন্তু তিনি যোহরের আগের সুন্নাত সালাত বা পরের সুন্নাত সালাত ৬ রাকাত পড়তে পারেন না। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাঁর সাহাবীগণ আজীবন ওযু করেছেন, কিন্তু তাঁরা ওযুর সময় কোনো যিকর বা দু‘আ পাঠ করেছেন বলে কোনো নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত হয়নি। এ সময়ে দু‘আ বা যিকরের কোনো ফযীলতও তাঁরা বলেননি। কাজেই, এই সময়ে বিশেষভাবে কোনো দু‘আ করা সুন্নাতের স্পষ্ট খেলাফ।

দ্বিতীয়ত, ওযুর সময়ে যিকর বা দু‘আ না-জায়েয বা মাকরূহ নয়। মুমিন এ সময়ে মনের আবেগ হলে তাসবীহ তাহলীল করতে পারেন বা কোনো বিষয় মনে পড়লে সে জন্য দু‘আ করতে পারেন। হাঁচি দিলে ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ বা কেউ হাঁচি দিলে উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলতে পারেন, কাউকে সালাম দিতে পারেন বা কেউ সালাম দিলে উত্তর দিতে পারেন। এরূপভাবে যিকর বা দু‘আ তিনি করলে তা না-জায়েয হবে না। কিন্তু এই সময়ের জন্য কোনো দু‘আ বা যিকর তিনি রীতি হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন না। কারণ তাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)এর রীতি পরিবর্তন করা হবে এবং তাঁর সুন্নাত আংশিকভাবে নষ্ট হবে।

তৃতীয়ত, আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সুন্নাতেই নিরাপত্তা এবং সুন্নাতের বাইরে গেলেই ভয়। কাজেই, একান্ত বাধ্য না হয়ে সুন্নাতের বাইরে আমরা কেন যাব? বিভিন্ন যুক্তিতর্ক দিয়ে খেলাফে সুন্নাত কর্মকে জায়েয করার চেয়ে বিভিন্ন যুক্তিতর্ক দিয়ে নিজের মন ও প্রবৃত্তিকে সুন্নাতের মধ্যে আবদ্ধ রাখা উত্তম নয় কি? অগণিত সুন্নাত যিকর, দু‘আ ও ইবাদত আমরা করছি না, করতে চেষ্টা বা আগ্রহও করছি না। অথচ খেলাফে সুন্নাত কিছু কর্মের জন্য আমাদের আগ্রহ বেশি। এটা কি সুন্নাতের মহব্বতের পরিচায়ক? মহান আল্লাহ দয়া করে আমাদের প্রবৃত্তিকে সুন্নাতের অধীন করে দিন, আমীন।

ওযুর পরে পালনের জন্য একাধিক যিকর হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। এখানে তিনটি মাসনূন যিকর উল্লেখ করছি :


যিকর নং ৩৯ : ওযুর পরের যিকর-১

أَشْهَدُ أَنَّ لاَ إِلٰهَ إِلاَّ الله (وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ) وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ


উচ্চারণঃ আশহাদু আল্ লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু [ওয়া‘হদাহু লা- শারীকা লাহু] ওয়া আশহাদু আন্না মু‘হাম্মাদান ‘আবদুহু ওয়া রাসূলুহু।
অর্থঃ “আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই [তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই] এবং সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বান্দা (দাস) ও রাসূল (প্ররিত বার্তাবাহক)।”

উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যদি কেউ সুন্দরভাবে এবং পরিপূর্ণভাবে ওযু করে এরপর উক্ত যিকর পাঠ করে তাহলে জান্নাতের আটটি দরজাই তাঁর জন্য খুলে দেওয়া হবে, সে যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা করবে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।”[4]


যিকর নং ৪০ : ওযুর পরের যিকর-২

اللَّهُمَّ اجْعَلْنِي مِنَ التَوَّابِينَ ، واجْعَلْني مِنَ المُتَطَهِّرِينَ


উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মাজ্ ‘আলনী মিনাত তাওয়া-বীন ওয়াজ্ ‘আলনী মিনাল মুতাতাহ্ হিরীন।

অর্থঃ “হে আল্লাহ আপনি আমাকে তাওবাকারীগণের অন্তভর্ক্তু করুন এবং যারা গুরুত্ব ও পূর্ণতা সহকারে পবিত্রতা অর্জন করেন আমাকে তাঁদের অন্তর্ভুক্ত করুন।”

দু’আটি ইমাম তিরমিযী বর্ণিত একটি হাদীসে উপরের (৩৯) নং যিকরের (শাহাদাতের) পরে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদীসটির সনদ

সহীহ।[5]


যিকর নং ৪১ : ওযুর পরের যিকর-৩

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْكَ


উচ্চারণঃ সুব’হা-নাকা আল্লা-হুম্মা, ওয়া বি’হামদিকা, আশহাদু আল্ লা-ইলা-হা ইল্লা-আনতা, আস্তাগফিরুকা, ওয়া আতূবু ইলাইকা।

অর্থঃ “আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, হে আল্লাহ, এবং আপনার প্রশংসা জ্ঞাপন করছি। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আপনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই এবং আমি আপনার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনার নিকট (তাওবা) করছি।”

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি কেউ ওযু করার পরে উপরিউক্ত দ’আটি বলে, তাহলে তা একটি পত্রে লিখে তার উপর সীলমোহর অঙ্কিত করে রেখে দেওয়া হবে। কিয়ামতের আগে সেই মোহর ভাঙ্গা হবে না। হাদীসটির সনদ সহীহ।[6]

[1] তিরমিযী ১/৩৭-৩৮, নং ২৫, আহমাদ ৩/৪১, যাইলায়ী, নাসবুর রাইয়াহ ১/৩-৬, ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ১/৭২, নাবাবী, আল-আযকার পৃ. ৫৫, আলবানী, সহীহুল জামি’ ২/১২৫৬, নং ৭৫৭০।

[2] এহ্ইয়াউস সুনান, পৃ. ১০৬।

[3] নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ৫৭, ইবনুল কাইয়েম, আল-মানারুল মুনীফ (আবদুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ), পৃ. ১২০, আলী কারী, আল- আসবারুল মারফূআ, পৃ. ৩৪৫।

[4] সহীহ মুসলিম ১/২০৯, নং ২৩৪।

[5] সুনানুত তিরমিযী ১/৭৮, নং ৫৫, সহীহু সুনানিত তিরমিযী ১/১৮, সহীহুত তারগীব ১/১৬৬।

[6] নাসাঈ, সুনানুল কুবরা ৬/২৫, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ২/১০০, সহীহুত তারগীব ১/১৬৬-১৬৭।
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৪. ওযুর পরে সালাত বা তাহিয়্যাতুল ওযু

মূলত সালাতের জন্যই ওযু করা হয়। বিশেষ করে ওযুর পরেই দুই রাক’আত সালাতের গুরুত্ব হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। বিভিন্ন হাদীসে কষ্ট হলেও সুন্দর ও পরিপূর্ণরূপে সুন্নাতের পূর্ণ অনুসরণ করে ওযু করার বিশেষ ফযীলত ও সাওয়াব বর্ণিত হয়েছে। এরপর যখন মুমিন সালাত পড়েন তখন তার গোনাহ ক্ষমা করা হয়। উকবা ইবনু আমির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ وُضُوءَهُ ثُمَّ يَقُومُ فَيُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ مُقْبِلٌ عَلَيْهِمَا بِقَلْبه وَوَجْهِهِ (فيعلم ما يقول) إلاَّ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ

“যে কোনো মুসলিম যদি সুন্দরভাবে ওযু করে এরপর নিজের সমগ্র মন ও মুখ সালাতের দিকে ফিরিয়ে (দেহ-মনের সমগ্র অনুভূতি কেন্দ্রীভূত করে) এবং এভাবে সালাতে কী পাঠ করছে তা জেনে বুঝে দুই রাক’আত সালাত আদায় করে, তার সকল গোনাহ এমনভাবে ক্ষমা করা হয় যে, সে নবজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়।”[1]

এই অর্থে আরো অনেকগুলি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যে সকল হাদীসে ওযুর পরে মনোযোগ সহকারে দুই রাক’আত সালাতের এইরূপ অতুলনীয় ও অভাবনীয় পুরস্কারের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে।[2]

[1] সহীহ মুসলিম ১/২০৯, নং ২৩৪, মুসতাদরাক হাকিম ২/৪৩৩, সহীহুত তারগীব ১/১৫৫।

[2] সহীহুত তারগীব ১/১৬৭-১৬৮।
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৫. গোসলের যিকর

গোসলের জন্য পৃথক কোনো যিকর নেই। ওযুর শুরুতে ও শেষে যেসকল যিকর উল্লেখ করা হয়েছে, গোসলের আগে-পরেও সেসকল যিকর পালন করতে হবে।[1]

[1] নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ৫৭-৫৮।
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৬. আযানের যিকর

আযান দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ ফযীলতের ইবাদত। সকল মুসলিমের উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টি ও সাওয়াব অর্জনের উদ্দেশ্যে সুযোগ পেলে সালাতের জন্য আযান দেওয়া। সর্বাবস্থায় আমরা অধিকাংশ মানুষই আযান দিতে পারি না, বরং শ্রবণ করি। আমরাও যেন আযানকে কেন্দ্র করে অগণিত পুরস্কার, রহমত ও বরকত অর্জন করতে পারি সে সুযোগ প্রদান করছেন মহান রাব্বুল আলামীন।

আযানের পূর্বে কোনো মাসনূন যিকর নেই

আমাদের দেশে অনেক স্থানে আযানের পূর্বে মুয়াযযিন নিজে বা শ্রোতাগণ দরুদ সালাম পাঠ করেন। কোথাও আযানের পূর্বে মুয়াযযিন আ‘ঊযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ বলেন। এগুলি সবই সুন্নাত বিরোধী কর্ম। এ সকল কর্মকে যারা পছনদ করেন তাঁদের যুক্তি: দরুদ সালাম পাঠ তো কখনো না-জায়েয নয়। আ‘ঊযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ বললে তো কোনো দোষ নেই। কাজেই, ভালো কাজে কেন বাধা দেওয়া হবে?

কথাটি শুনতে খুবই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। কিন্তু এখানে সমস্যা জায়েয বা না-জায়েয নিয়ে নয়, সুন্নাত নিয়ে। অবিকল সুন্নাত অনুসারে বিলালের মতো আযান দিলে কি আমাদের কোনো অসুবিধা আছে? তাতে কি আমাদের সাওয়াব কম হবে?


এ সময়ে এসকল যিকর সুন্নাত-সম্মত নয়, বরং সুন্নাত বিরোধী। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে প্রায় ১০ বৎসর তাঁর মুয়াযযিনগণ এবং অন্যান্য অগণিত মুয়াযযিন মুসলিম জনপদগুলিতে আযান দিয়েছেন। তাঁর পরে সাহাবীগণের যুগে শতবৎসর ধরে অগণিত মুয়াযযিন আযান দিয়েছেন। তাঁরা কেউ কখনো একটিবারও আযানের আগে আ‘ঊযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ বা দরুদ পাঠ করে নেননি। এগুলির ফযীলত রাসূলুল্লাহ (সা.) জানতেন, তা সত্ত্বেও তিনি আযানের আগে এগুলি বলতে শিক্ষা দেননি। এজন্য এগুলি আযানের আগে না বলাই সুন্নাত। বললে সুন্নাত বর্জন করা হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাতকে ছোট করা হবে। মনে করা হবে যে, তাঁর শেখানো ও আচরিত আযানের মধ্যে একটু কমতি রয়ে গেছে, তাই শুরুতে এই বিষয়গুলি যুক্ত করে তাকে পূর্ণতা দেওয়া হলো।


এসকল মাসনূন যিকর বা ইবাদতের সাথে কোনো রকম সংযুক্তির ভয়াবহ পরিণতি সুন্নাত উঠে যাওয়া। যদি কোনো এলাকায় কয়েক বছর যাবৎ আ‘ঊযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ বলে আযান দেওয়া হয়, অথবা দরুদ পাঠ করে আযান দেওয়া হয় তাহলে একসময় এগুলি আযানের অংশে পরিণত হবে। তখন যদি কেউ এগুলি বাদে অবিকল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগের মতো করে আযান প্রদান করেন, তাহলে তাকে (আযান দেওয়াকে) খারাপ মনে করা হবে এবং তার (মুয়াযযিনের) আযানকে অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হবে ও তার (মুয়াযযিনের) সমালোচনা করা হবে। যদি কেউ বলে - এগুলিতো আযানের অংশ নয়; তাহলে বলা হবে - আমরাও বলছি না যে, এগুলি আযানের অংশ, তবে এগুলি বলা ভালো, এগুলির ফযীলত আছে, কেন সে এগুলি বলবে না? ... ইত্যাদি। এভাবে একসময় আমাদের আযান ও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আযান ভিন্ন রকমের হয়ে যাবে। সুন্নাত উঠে যাবে।


যিকর নং ৪২ : মুয়াযযিনের সাথে সাথে তার কথাগুলি বলা :

আমরা সাধারণত একে আযানের জবাব দেওয়া বলি। মুয়াযযিন আযানের মধ্যে যা যা বলবেন মুমিন শ্রোতাও তাই বলবেন। এ বিষয়ে হাদীসে কয়েকটি সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إِذَا سَمِعْتُمْ الْمُؤَذِّنَ فَقُولُوا مِثْلَ مَا يَقُولُ الْمُؤَذِّن


“যখন তোমরা মুয়াযযিনকে আযান দিতে শুনবে, তখন মুয়াযযিন যেরূপ বলে তদ্রূপ বলবে।”[1]


উপরের হাদীস ও পরবর্তী হাদীসটি থেকে বুঝা যায় যে, মুয়াযযিন যা বলবেন, আযান শ্রবণকারী অবিকল তাই বলবেন। কোনো ব্যতিক্রম বলতে বলা হয়নি। তবে উমার (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম শিক্ষা দিয়েছেন- মুয়াযযিন ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ ও ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ বললে, শ্রোতা ‘লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলবেন। এ হাদীসে তিনি আরো বলেনঃ

من قال ... من قلبه دخل الجنة


“এভাবে যে ব্যক্তি মুয়াযযিনের সাথে সাথে আযানের বাক্যগুলি অন্তর থেকে বলবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[2]

অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে ছিলাম। তখন বিলাল (রাঃ) দাঁড়িয়ে আযান দিলেন। বিলাল আযান শেষ করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেনঃ

من قال مثل ما قال هذا يقينا دخل الجنة


“এই ব্যক্তি (মুয়াযযিন) যা বলল, তা যদি কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলে তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[3]


ফজরের আযানের জবাবে খেলাফে সুন্নাত ব্যতিক্রম

আমাদের দেশের একটি বহুল প্রচলিত রীতি, ফজরের আযানের সময় যখন মুয়াযযিন “আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাঊম” - বলেন, তখন শ্রোতা “সাদাকতা ও বারিরতা (বারারতা)” অর্থাৎ, “তুমি সত্য বলেছ এবং পুণ্য করেছ” বলেন। আযানের জবাবে উক্ত কথাটি খেলাফে সুন্নাত। ইবনু হাজার আসকালানী, মুল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেছেন যে, আযানের জবাবে এই বাক্যটি বানোয়াট, মাওযূ ও ভিত্তিহীন। কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে রাসূলুল্লাহ (সা.) বা কোনো সাহাবী থেকে এই দু‘আটি বর্ণিত হয়নি। মূলত শাফেয়ী মযহাবের কোনো কোনো ফকীহ নিজের মন থেকে এই বাক্যটিকে এই সময়ে বলার জন্য মনোনীত করেন। পরবর্তী যুগে তা অন্যান্য মাযহাবের অনেক আলিম গ্রহণ করেছেন।[4]

এ সকল আলিম এই বাক্যটিকে এই সময়ে বলা পছন্দনীয় বলে মনে করেছেন। কারণ, “আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাঊম” -বাক্যের অর্থের সাথে এই কথাটি সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিন্তু এক্ষেত্রে কয়েকটি সমস্যা রয়েছে :

প্রথমত, এতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশের বিরোধিতা করা হচ্ছে। কারণ উপরের হাদীসগুলিতে আমরা দেখেছি যে, তিনি আমাদেরকে অবিকল মুয়াযযিনের অনুরূপ বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। একমাত্র “হাইয়া আলা ... “-এর সময় ছাড়া অন্য কোনো ব্যতিক্রম তিনি শিক্ষা দেননি। এ সকল হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশ যে, এই একমাত্র ব্যতিক্রম ছাড়া হুবহু মুয়াযযিনের মতোই বলতে হবে। মুয়াযযিন যখন “আস- সালাতু খাইরুম মিনান নাঊম” বলবেন, তখন শ্রোতাও অবিকল তা-ই বলবেন। এর ব্যতিক্রম করলে উপরের হাদীসগুলি পূর্ণরূপে মান্য করা হবে না।


দ্বিতীয়ত, এতে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সুন্নাতে নববীর প্রতি অবজ্ঞা করা হচ্ছে। কারণ আযান দেওয়া ও আযানের জবাব দেওয়া রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক আচরিত ও শেখানো একটি অত্যন্ত জরুরি ও প্রতিদিনে বহুবার পালন করার মতন ইবাদত। তিনি সুনির্দিষ্টভাবে আযান ও আযানের উত্তর প্রদানের পদ্ধতি সাহাবীগণকে শিখিয়েছেন এবং তাঁরা তা পালন করেছেন। তিনি আযানের উত্তরে এই বাক্যটি বলেন নি বা শেখান নি। সাহাবীগণও বলেন নি। এখানে অর্থের সামঞ্জস্যতার কথাও তাঁরা অনুভব করেন নি। তাঁদের পরে আমরা কী-ভাবে একটি মাসনূন ইবাদতের মধ্যে পরিবর্তন পরিবর্ধন করতে পারি? কী জন্যই-বা করব? অবিকল তাঁদের মতো আযানের জবাব দিলে কি আমাদের সাওয়াব কম হবে? না সেভাবে জবাব দিতে আমাদের কোনো কঠিন বাধা বা অসুবিধা আছে?


প্রিয় পাঠক, সুন্নাতের মধ্যে থাকা আমাদের নিরাপত্তা ও মুক্তির রক্ষাকবজ। সুন্নাতের বাইরে কোনো ইবাদত তৈরি করে আমরা কিভাবে বুঝব যে তা আল্লাহ কবুল করবেন? আল্লাহ আমাদেরকে সুন্নাতের মধ্যে থাকার তৌফিক প্রদান করুন ; আমীন।[5]


যিকর নং ৪৩ : মুয়াযযিনের শাহাদতের সময় অতিরিক্ত যিকর :

(وأنا اشهد) ان لا اله الا الله وحده لا شريك له وأن محمدا عبده ورسوله رضيت بالله رباً وبالإسلام ديناً وبمحمد نبياً

উচ্চারণঃ [ওয়া আনা আশহাদু] আল লা- ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু, ওয়া‘হদাহু, লা- শারীকা লাহু, ওয়া আন্না মু‘হাম্মাদান ‘আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। রাদ্বীতু বিল্লা-হি রাব্বান, ওয়া বিল ইসলা-মি দীনান, ওয়া বিমু‘হাম্মাদিন নাবিয়্যান।

অর্থঃ “এবং আমিও সাক্ষ্য দিচিছ যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোনো শরীক নেই। এবং মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রাসূল। আমি তুষ্ট ও সন্তুষ্ট আছি আল্লাহকে প্রভু হিসাবে, ইসলামকে দ্বীন হিসাবে এবং মুহাম্মাদকে (সা.) নবী হিসাবে।”

সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি মুআযযিনকে শুনে উপরের বাক্যগুলি বলবে তার সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।”[6]


যিকর নং ৪৪ : আযানের পরে দরুদ পাঠ

অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

إِذَا سَمِعْتُمْ الْمُؤَذِّنَ فَقُولُوا مِثْلَ مَا يَقُولُ ، ثُمَّ صَلُّوا عَلَيَّ ، فَإِنَّهُ مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلاةً صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ بِهَا عَشْرًا ، ثُمَّ سَلُوا اللَّهَ لِي الْوَسِيلَةَ ، فَإِنَّهَا مَنْزِلَةٌ فِي الْجَنَّةِ لا تَنْبَغِي إِلا لِعَبْدٍ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ ، وَأَرْجُو أَنْ أَكُونَ أَنَا هُوَ ، فَمَنْ سَأَلَ لِي الْوَسِيلَةَ حَلَّتْ لَهُ الشَّفَاعَةُ


“যখন তোমরা মুয়াযযিনকে আযান দিতে শুনবে, তখন সে যেরূপ বলে তদ্রূপ বলবে। এরপর আমার উপর সালাত পাঠ করবে ; কারণ যে ব্যক্তি আমার উপর একবার সালাত পাঠ করবে, আল্লাহ তাঁকে দশবার সালাত (রহমত) প্রদান করবেন। এরপর আমার জন্য ‘ওসীলা’ চাইবে ; কারণ ‘ওসীলা’ জান্নাতের সর্বোচচ স্থান, আল্লাহর একজন মাত্র বান্দাই এই মর্যাদা লাভ করবেন এবং আমি আশা করি আমিই হব সেই বান্দা। যে ব্যক্তি আমার জন্য ‘ওসীলা’ প্রার্থনা করবে, তাঁর জন্য শাফায়াত প্রাপ্য হয়ে যাবে।”[7]


যিকর নং ৪৫ : আযানের পরে ওসীলার দু‘আ চাওয়া

‘ওসীলা’ শব্দের অর্থ নৈকট্য। জান্নাতের সর্বোচচ স্তর যা আল্লাহর আরশের সবচেয়ে নিকটবর্তী তাকে ‘ওসীলা’ বলা হয়। এই স্থানটি আল্লাহর একজন বান্দার জন্যই নির্ধারিত, তিনি নবীয়ে মুসতাফা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.)। উপরের হাদীসে আমরা দেখেছি যে, তিনি আযানের পরে সালাত (দরুদ) পাঠের পরে তাঁর জন্য ওসীলা চেয়ে দু‘আ করতে উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সেজন্য মহান পুরস্কার - ‘শাফায়াত’ লাভের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। অন্যান্য হাদীসে ‘ওসীলা’ প্রার্থনার পদ্ধতি ও বাক্য তিনি শিখিয়ে দিয়েছেন। দু‘আটি নিম্নরূপঃ

للَّهُمَّ رَبَّ هَذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ وَالصَّلاةِ الْقَائِمَةِ ، آتِ مُحَمَّدًا الْوَسِيلَةَ وَالْفَضِيلَةَ ، وَابْعَثْهُ الْمَقَامَ الْمَحْمُودَ الَّذِي وَعَدْتَهُ


উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, রাব্বা হা-যিহিদ দা‘অ্ওয়াতিত তা-ম্মাতি ওয়াস স্বালা-তিল কবা-য়িমাতি, আ-তি মু‘হাম্মাদান আল-ওয়াসীলাতা ওয়াল ফাদীলাতা, ওয়াব‘আসহু মাকা-মাম মা‘হমদুানিল্লাযী্ ও‘য়াদতাহু।

অর্থঃ “হে আল্লাহ, এই পরিপূর্ণ আহবান এবং আগত সালাতের মালিক, আপনি প্রদান করুন মুহাম্মাদকে (সা.) ওসীলা (নৈকট্য) এবং মহা মর্যাদা এবং তাঁকে উন্নীত করুন সম্মানিত অবস্থানে, যা আপনি তাঁকে ওয়াদা করেছেন।”

জাবির ইবনু আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “মুয়াযযিনের আযান শুনে যে ব্যক্তি উপরের বাক্যগুলি বলবে, তাঁর জন্য কিয়ামতের দিন আমার শাফা’আত পাওনা হয়ে যাবে।”[8]

ওসীলার দু‘আর দুটি অতিরিক্ত বাক্য

আযানের পরে ওসীলার দু‘আর উপরের বাক্যগুলি সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। আমাদের দেশে প্রচলিত আযানের দু‘আর মধ্যে দুটি বাক্য অতিরিক্ত রয়েছে, যা উপরের দু‘আটিতে নেই। প্রথম বাক্যটিতে (والفضيلة) (ওয়াল ফাদীলাতা)-র পরে (والدرجة الرفيعة) (এবং সুঊচ্চ মর্যাদা) বলা হয়। দ্বিতীয় বাক্যটি দু‘আর শেষে: (إنك لا تخلف الميعاد) (নিশ্চয় আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেন না) বলা। এই দ্বিতীয় বাক্যটি একটি দুর্বল সনদে বর্ণিত হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে।[9] আর প্রথম বাক্যটি (ওয়াদ-দারাজাতার রাফী’আহ) একেবারেই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট ও মিথ্যা হাদীস নির্ভর।

ইবনু হাজার আসকালানী, সাখাবী, যারকানী, মুল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বলেছেন যে, এই বাক্যটি (ওয়াদ-দারাজাতার রাফী’য়াহ) বানোয়াট ও ভিত্তিহীন। মাসনূন দু‘আর মধ্যে এই ভিত্তিহীন বাক্যটি বৃদ্ধি করা সুন্নাত বিরোধী ও অন্যায়।[10]


মাইকে আযানের দু‘আ পাঠ

আযানের পরবর্তী মাসনূন ইবাদত, দরুদ পাঠ, ওসীলার দু‘আ পাঠ, নিজের জন্য দু‘আ চাওয়া। এগুলি সবই ব্যক্তিগতভাবে মনে মনে আদায় করা সুন্নাত। এগুলি জোরে জোরে বা সমবেতভাবে আদায় করা খেলাফে সুন্নাত। বর্তমানে আমাদের দেশে রেডিও ও টেলিভিশনের প্রভাবে বিভিন্ন মাসজিদে আযানের পরে মাইকে ওসীলার দু‘আ পাঠ করা হয়। এভাবে পাঠ করা সুন্নাত-বিরোধী। এভাবে দু‘আ পাঠের অর্থ মিনারে দাঁড়িয়ে আযান দিয়ে আযানের পরে ঠিক আযানের মতো চিৎকার করে দু‘আ পাঠ।


এভাবে দু‘আ পাঠের রীতি প্রচলনের ফলে আযানের পরে দরুদ পাঠের সুন্নাত ও আযানের পরে ওসীলার দু‘আ মনে মনে পাঠের সুন্নাতের মৃত্যু ঘটছে। সর্বোপরি একটি নতুন বিদ‘আত জন্মগ্রহণ করবে। কিছুদিন পরে দেখা যাবে, যদি কেউ অবিকল বিলালের মতো ও অন্যান্য সাহাবীগণের মতো শুধুমাত্র আযান জোরে দেন এবং পরের দু‘আ মনে মনে পাঠ করেন তখন মানুষে বলতে থাকবে, ‘আহা, দু‘আটা পড়ল না। একটু ঘাটতি থেকে গেল!’ - এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সময়কার আযান তাদের নিকট ‘অসম্পূর্ণ আযান’ বলে প্রতিপন্ন হবে।


আযান শেষে নিজের জন্য প্রার্থনা করা

দু‘আ কবুলের সময় আলোচনাকালে আমরা এ বিষয়ে বিভিন্ন হাদীস উল্লেখ করছি। এ সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে আযান সংশিলষ্ট যিকর শেষ করে নিজেদের পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণের জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে শিক্ষা দিয়েছেন। এই সময়ের প্রার্থনা আল্লাহ কবুল করেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

[1] সহীহ বুখারী ১/২২১, নং ৫৮৬, সহীহ মুসলিম ১/২৮৮, নং ৩৮৩।

[2] সহীহ মুসলিম ১/২৮৯, নং ৩৮৫।

[3] হাদিসটি হাসান। সহীহ ইবনু হিব্বান ৪/৫৫৩, মুসতাদরাক হাকিম ১/৩২১, মুসনাদ আহমাদ ২/৩৫২, নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ১/৫১০, ৬/১৪৬, সহীহুত তারগীব ১/১৭৭।

[4] নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম ৪/৮৮, আল-আযকার পৃ. ৬৬, ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ১/২১১।

[5] পাঠককে আবারো অনুরোধ করছি “এহইয়াউস সুনান” বইটি পাঠ করতে, সেখানে সুন্নাতের বাইরে ইবাদত বন্দেগী উদ্ভাবনের পরিণতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

[6] সহীহ মুসলিম ১/২৯০, নং ৩৮৬, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ১/২২০, সহীহ ইবনু হিব্বান ৪/৫৯১।

[7] সহীহ মুসলিম ১/২৮৮, নং ৩৮৪।

[8] সহীহ বুখারী ১/২২২, নং ৫৮৯, ৪/১৭৪৯, নং ৪৪৪২।

[9] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ১/৪১০, (৬০৩-৬০৪)।

[10] ইবনু হাজার, তালখীসুল হাবীর ১/২১১, সাখাবী, আল-মাকসিদ, পৃ. ২২২-২২৩, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ. ১০৭, মুল্লা আলী কারী, আল-মাসনূ, পৃ. ৭০-৭১, আল-আসরারুল মারফু’আ, পৃ. ১২২, মুবারাকপুরী, তুহফাতুল আহওয়াযী, পৃ. ১/৫৩২।
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৭. ইকামতের জবাব

ইকামতকেও হাদীস শরীফে ‘আযান’ বলা হয়েছে। এজন্য মুয়াযযিনকে ইকামত দিতে শুনলে আযানের মতো জবাব দেওয়া উচিত। মুয়াযযিন যা বলবেন, তাই বলতে হবে। “হাইয়া আলা ... “-এর সময় “লা হাওলা ... “ বলতে হবে। উপরের হাদীসগুলির আলোকে “কাদ কামাতিস সালাহ” বাক্যদ্বয়ও মুয়াযযিনের অনুরূপ বলা প্রয়োজন। একটি দুর্বল সনদের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার মুয়াযযিনের “কাদ কামাতিস সালাহ” বলতে শুনে বলেছিলেনঃ

أقامها الله وأدامها

“আল্লাহ একে (সালাতকে) প্রতিষ্ঠিত করুন এবং স্থায়ী করুন।” বাকি জবাব আযানের জবাবের নিয়মে প্রদান করেন।[1]

[1] সুনানু আবী দাউদ ১/১৪৫, নং ৫২৮, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ২/৯২-৯৩, তালখীসুল হাবীর ১/২১১।
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৮. সালাতই সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর - (ক) সানা বা শুরুর যিকর

৮. সালাতই সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর

মুমিন কিভাবে সারাদিন (২৪ ঘণ্টা) তাঁর মহান প্রভুর যিকর করবেন তা আমরা আলোচনা করছি। ওযু, আযান ইত্যাদির পরেই সালাত। সালাতই মুমিনের জীবনের শ্রেষ্ঠতম ও মহোত্তম যিকর। ইতঃপূর্বে আমরা বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি আলোচনা করেছি। প্রত্যেক মুমিনের প্রধান দায়িত্ব সালাতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল দু‘আ-মুনাজাত, যিকর ও তিলাওয়াত বিশুদ্ধ উচ্চারণে, অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে যথাসম্ভব বিনিয়, মনোযোগ, আবেগ ও আন্তরিকতার সাথে আদায় করা। আমি এখানে সংক্ষেপে সালাতের মধ্যকার কিছু যিকরের আলোচনা করছিঃ


(ক) সানা বা শুরুর যিকর

সালাতের শুরুতে তাকবীরে তাহরীমার পরেই যে দু‘আ বা যিকর পাঠ করা হয় তাকে আমরা সাধারণত ‘সানা’ বলি। এ সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন আবেগময় মর্মস্পর্শী দু‘আ ও যিকর পাঠ করতেন। এগুলির মধ্য থেকে একটি মাত্র দু‘আ আমরা সানা হিসাবে পাঠ করি। হানাফী মাযহাবের ইমামগণ ফরয সালাতের ক্ষেত্রে এই ‘সানা’ ও দ্বিতীয় আরেকটি দু‘আ পাঠ করতে বলেছেন। সুন্নাত-নফল সালাতের ক্ষেত্রে সকল মাসনূন ‘সানা’ পাঠ করা যায়। এ সকল মাসনূন সানা বা শুরুর দু‘আ অর্থসহ মুখস্ত করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দু’আ পাঠ করলে সালাতের মনোযোগ, বিনয় ও আন্তরিকতা বহাল থাকে। নইলে মুসল্লী অভ্যস্তভাবে খেয়াল না করেই কখন সানা পড়ে শেষ করেন তা টেরও পান না। এখানে সানার তিনটি দু‘আ লিখছিঃ


যিকর নং ৪৬ : সানার যিকর-১

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ. تَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ. وَلاَ إِلهَ غَيْرُكَ


উচ্চারণঃ সুব‘হা-নাকাল্লা-হুম্মা, ওয়া বি‘হামদিকা, ওয়া তাবা-রাকাসমুকা, ওয়া তা‘আ-লা- জাদ্দুকা, ওয়া লা- ইলা-হা গাইরুকা।

অর্থঃ “আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি, হে আল্লাহ, এবং আপনার প্রশংসাসহ। আর মহাবরকতময় আপনার নাম, মহা-উন্নত আপনার মর্যাদা। আর কোনো মা’বুদ নেই আপনি ছাড়া।”

আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাত শুরু করে এই তাসবীহ পাঠ করতেন।[1]

যিকর নং ৪৭ : সানার যিকর-২

আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাতের শুরুতে বলতেন :

وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض حنيفاً وما أنا من المشركين، إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين لا شريك له، وبذلك أمرت وأنا من المسلمين، اللهم أنت الملك لا إله إلا أنت، أنت ربي وأنا عبدك، ظلمت نفسي واعترفت بذنبي فاغفر لي ذنوبي جميعاً إنه لا يغفر الذنوب إلا أنت، واهدني لأحسن الأخلاق لا يهدي لأحسنها إلا أنت، واصرف عني سيئها لا يصرف عني سيئها إلا أنت، لبيك وسعديك والخير كله في يديك، والشر ليس إليك، أنا بك وإليك، تباركت وتعاليت، أستغفرك وأتوب إليك


উচ্চারণঃ ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাযী ফাতবারাস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদা ‘হানীফাও ওয়া মা- আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না স্বালা-তী ওয়া নুসূকী ওয়া মাহইয়া-ইয়া ওয়া মামা-তী লিল্লা-হি রাব্বিল ‘আলামীন। লা- শারীকা লাহু, ওয়া বিযা-লিকা উমিরতু, ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন। আল্লা-হুম্মা, আনতা রাব্বী, ওয়া আনা ‘আবদুকা। যালামতু নাফসী, ওয়া‘অ-তারাফতু বিযানবী, ফাগবফিরলী যুনূবী জামিয়ান; ইন্নাহু লা- ইয়াগবফিরুয যুনূবা ইল্লা-আনতা। ওয়াহদিনী লিআহসানিল আখলা-ক; লা- ইয়াহদী লিআহসানিহা- ইল্লা- আনতা। ওয়াসরিফ ‘আন্নী সাইয়িআহা- লা- ইয়াসরিফু ‘আন্নী সাইয়িআহা- ইল্লা- আনতা। লাব্বাইকা ওয়া সা‘অ্দাইকা। ওয়াল খাইরু কুল্লুহু ফী ইয়াদাইকা। ওয়াশ-শাররু লাইসা ইলাইকা। আনা বিকা ওয়া ইলাইকা। তাবা-রাকতা ওয়া তা‘আ-লাইতা। আস্তাগবফিরুকা ওয়া আতূবু ইলাইকা।

অর্থঃ “আমি সুদৃঢ়ভাবে আমার মুখমণ্ডল নিবদ্ধ করেছি তাঁর দিকে যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন এবং আমি শিরকে লিপ্ত মানুষদের অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয় আমার সালাত, আমার উৎসর্গ উপাসনা, আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহর জন্যই, তিনি মহাবিশ্বের প্রতিপালক প্রভু। তাঁর কোনো শরীক নেই। এবং এই জন্যই আমাকে আদেশ করা হয়েছে। এবং আমি আত্মসমর্পণকারীগণের অন্তর্ভুক্ত। হে আল্লাহ, আপনিই সম্রাট। আপনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আপনি আমার প্রভু এবং আমি আপনার দাস। আমি অত্যাচার করেছি আমার আত্মার উপর এবং আমি আমার পাপ স্বীকার করছি। অতএব আপনি আমার সকল পাপ ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয় আপনি ছাড়া কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না। আর আপনি পরিচালিত করুন আমাকে উত্তম আচরণে পথে, আপনি ছাড়া কেউ উত্তম আচরণের পথে পরিচালিত করতে পারে না। আর আপনি আমাকে খারাপ আচরণ থেকে দূরে রাখুন, আপনি ছাড়া আর কেউ খারাপ আচরণ থেকে দূরে রাখতে পারে না। আপনার ডাকে আমি সাড়া প্রদান করছি, আমি সানন্দে সাড়া প্রদান করছি। সকল কল্যাণ আপনার হাতে এবং অকল্যাণ আপনার দিকে নয়। আমি আপনারই সাহায্যে ও আপনারই দিকে। মহা বরকতময় আপনি এবং সুমহান আপনি। আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আপনারই দিকে প্রত্যাবর্তন করছি (তাওবা করছি)।”[2]

হানাফী মযহাবের ইমাম ও ফকীহগণ ফরয সালাতের সানা এই দুটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উত্তম বলে মতপ্রকাশ করেছেন। তবে হানাফী ফিকহের অধিকাংশ গ্রন্থে “আনা মিনাল মুসলিমীন” পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম আবু ইউসূফ (রহঃ) দুটি সানা একত্রে প্রত্যেক সালাতের শুরুতে পাঠ করা উত্তম ও মুসতাহাব বলে উল্লেখ করেছেন।[3]


জায়নামাযের দু‘আ খেলাফে সুন্নাত

আমাদের দেশে দ্বিতীয় সানাটি জায়নামাযের দু‘আ বলে অতি প্রচলিত। সালাত শুরু করার আগে সালাতে বা জায়নামাযে বা সালাতের স্থানে দাঁড়িয়ে এই দু‘আটি পাঠ করার রীতি সুন্নাত বিরোধী। রাসূলুল্লাহ (সা.) সেটা তাকবীরে তাহরীমার পরে পাঠ করেছেন। একদিনও তিনি তাকবীরে তাহরীমার আগে তা পাঠ করেননি। আমাদের ইমামগণও তাকবীরে তাহরীমার পরে পাঠ করা সুন্নাত বলেছেন। অথচ আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাত ও ইমামগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে মনগড়াভাবে এই দু‘আটিকে তাকবীরে তাহরীমার আগেই পড়ে নিচ্ছি।


পরবর্তী যুগের কোনো কোনো ফকীহ মনগড়াভাবে এই দু‘আটিকে তাকবীরে তাহরীমার আগে পড়া যাবে বলে মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, এই দু‘আর অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে পাঠ করলে সালাতের মধ্যে ‘আল্লাহর জন্যই সালাত পড়া’-এর দৃঢ় ইচ্ছা আরো দৃঢ়তর হয়। এইভাবে বানোয়াট যুক্তিতর্ক দিয়ে যদি আমরা সালাতের জন্য খেলাফে সুন্নাত রীতিনীতি তৈরি করতে থাকি তাহলে একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পদ্ধতির সালাত অপরিচিত হয়ে যাবে।


রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাতের মধ্যে শেষ বৈঠকে সালাত বা দরুদ পাঠের রীতি শিক্ষা দিয়েছেন। এখন আমরা কি সালাত কবুল হবে যুক্তি দিয়ে তা বাদ দিয়ে সালাতের তাকবীরে তাহরীমার আগে দরুদ পাঠের রীতি চালু করব? রাসূলুল্লাহ (সা.) চোখ মেলে সালাত পড়ার রীতি চালু করেছেন। আমরা কি মনোযোগ বৃদ্ধির যুক্তিতে চোখবুজে সালাতের রীতি চালু করব?

কখন কোন্ দু‘আ পড়লে সবচেয়ে বেশি ভালো হবে তা তিনিই জানতেন এবং শিখিয়েছেন। আমাদের দায়িত্ব অবিকল তাঁর অনুসরণ করা। আল্লাহ আমাদের সুন্নাতের মধ্যে তৃপ্ত থাকার তাওফীক দান করুন ; আমীন।


যিকর নং ৪৮: সানার যিকর-৩

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাতে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমার পরে কেরা’আত (সূরা পাঠ) শুরু করার আগে অল্প সময় চুপ করে থাকতেন। তখন আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল, আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবনি হোক, আপনি তাকবীরে তাহরীমা ও সূরা পাঠের মধ্যবর্তী সময়ে নীরব থাকেন, এ সময়ে আপনি কী বলেন? তিনি বললেন, আমি এ সময়ে বলিঃ

اللَّهُمَّ بَاعِدْ بَيْنِي وَبَيْنَ خَطَايَايَ كَمَا بَاعَدْتَ بَيْنَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ، اللَّهُمَّ نَقِّنِي مِنْ خَطَايَايَ كَمَا يُنَقَّى الثَّوْبُ الأَبْيَضُ مِنْ الدَّنَسِ، اللَّهُمَّ اغْسِلْنِي مِنْ خَطَايَايَ بِالْمَاءِ وَالثَّلْجِ وَالْبَرَدِ


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, বা-‘ইদ বাইনী ওয়া বাইনা খাত্বা-ইয়া-ইয়া কামা- বা-‘আদতা বাইনাল মাশরিক্বি ওয়াল মাগরিব। আল্লা-হুম্মা, নাক্কিনী মিনাল খাতা-ইয়া- কামা- ইউনাক্কাস সাওবুল আব্ইয়াদু মিনাদ দানাস। আল্লা-হুম্মাগসিল খাতা-ইয়া-ইয়া বিলমা-ই ওয়াস সালজি ওয়াল বারাদ।

অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনি দূরত্ব সৃষ্টি করে দিন আমার ও আমার পাপের মধ্যে যেমন দূরত্ব আপনি রেখেছেন পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে (আমাকে সকল প্রকার পাপ থেকে শত যোজন দূরে থাকার তাওফীক প্রদান করুন)। হে আল্লাহ, আপনি আমাকে পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র করুন পাপ থেকে, যেমনভাবে পরিচছনণ করা হয় ধবধবে সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে। হে আল্লাহ আপনি ধৌত করুন আমার পাপরাশী পানি, বরফ এবং শিল দ্বারা (আমার হৃদয়কে পাপমুক্তি ও অনন্ত প্রশান্তি প্রদান করুন)।”[4]

[1] সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ১/২৩৯, মুসতাদরাক হাকিম ১/৩৬০, ৩৬১, ৬৪৫, সুনানুত তিরমিযী ২/১০, ১১, ৩৪৭, সুনানু আবী দাউদ ১/২০৬।

[2] সহীহ মুসলিম ১/৫৩৪-৫৩৫, নং ৭৭১।

[3] ইমাম তাহাবী, শারহু মা’নীল আসার ১/১৯৭-১৯৯, সারাখসী, আল-মাবসূত ১/১২-১৩, আল-কাসানী, বাদাইউস সানাই ১/২০২।

[4] সহীহ বুখারী ১/২৫৯, নং ৭১১, সহীহ মুসলিম ১/৪১৯, নং ৫৯৮।
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৮. সালাতই সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর - (খ) রুকুর যিকর

রাসূলুল্লাহ (সা.) রুকুতে বিভিন্ন যিকর করতেন। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) (তাঁর ইন্তেকালের পূর্বে, সোমবার ফজরের সালাতের সময়) তাঁর ঘরের পর্দা সরান। তখন মানুষেরা আবু বকরের (রাঃ) পিছনে কাতারবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সালাতে রত ছিলেন। তিনি বলেন, হে মানুষেরা ... আমাকে রুকু ও সাজদার মধ্যে কুরআন পাঠ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কাজেই, তোমরা রুকুর মধ্যে প্রভুর তা’যীম-মহত্ব ঘোষণা করবে। আর সাজদার মধ্যে প্রাণপণে বেশি বেশি দু‘আ করবে; এ সময়ে তোমাদের দু‘আ কবুল হওয়ার সমাভ বনা খুবই বেশি।”[1]

মহান প্রভুর তা’যীম প্রকাশের জন্য অনেক প্রকার বাক্য তিনি শিক্ষা দিয়েছেন। তন্মধ্যে অন্যতমঃ


যিকর নং ৪৯ : রুকুর যিকর-১ (سُبْحَانَ رَبِّي الْعَظِيمِ)

উচ্চারণ: সুব‘হা-না রাবিবয়াল ‘আযীম।
অর্থ: মহাপবিত্র আমার মহান প্রভু।

মনের আবেগ নিয়ে এই ঘোষণা বার বার দিতে হবে। কমপক্ষে ৩ বার বলার নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)।


যিকর নং ৫০ : রুকুর যিকর-২

سبوح قدوس رب الملائكة والروح


উচ্চারণঃ সুব্বুহুন ক্বুদ্দূসুন রাব্বুল মালা-ইকাতি ওয়াররূ’হ।

অর্থঃ “মহাপবিত্র, মহামহিম, ফিরিশতা গণের এবং পবিত্রাত্মার প্রভু।”

(পূর্ববর্তী অধ্যায়ে উল্লেখিত ৮ নং যিকর)। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রুকু ও সাজদার মধ্যে এই তাসবীহ পাঠ করতেন।[2]


যিকর নং ৫১ : রুকুর যিকর-৩

اللَّهُمَّ لَكَ رَكَعْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَلَكَ أَسْلَمْتُ خَشَعَ لَكَ سَمْعِي وَبَصَرِي وَمُخِّي وَعِظَامِي وَعَصَبِي


উচ্চারণঃ আল্ল-হুম্মা লাকা রাকা’অ্তু, ওয়া বিকা আ-মানতু, ওয়া লাকা আসলামতু খাশা’আ লাকা সাম’ই ওয়া বাসারী ওয়া মুখখী ওয়া ‘আযমী, ওয়া ‘আসাবী।

অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনারই জন্য রুকু করেছি, এবং আপনার উপরেই ঈমান এনেছি এবং আপনারই কাছে সমর্পিত হয়েছি। ভক্তিতে অবনত হয়েছে আপনার জন্য আমার কর্ণ, আমার চক্ষু, আমার মস্তিষ্ক, আমার অস্থি ও আমার স্নায়ুতন্ত্র।”আলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রুকুতে এইগুলি বলতেন।[3]

[1] সহীহ মুসলিম ১/৩৪৮, নং ৪৭৯।

[2] সহীহ মুসলিম ১/৩৫৩, নং ৪৮৭।

[3] সহীহ মুসলিম ১/৫৩৪-৫৩৫, নং ৭৭১।
প্রথম পর্বঃ সকালের যিকর-ওযীফা - ৮. সালাতই সর্বশ্রেষ্ঠ যিকর - (গ). রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় যিকর

যিকর নং ৫২ : দাঁড়ানো অবস্থার যিকর-১

ربنا لك الحمد


উচ্চারণঃ রাব্বানা- লাকাল ‘হামদ।

অর্থঃ হে আমাদের প্রভু, আপনারই প্রশংসা।


রুকু থেকে উঠে পরিপূর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পরে কয়েক মুহূর্ত পরিপূর্ণ সোজা দন্ডায়মান থাকা ওয়াজিব। পরিপূর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়ানোর আগেই সাজদায় চলে গেলে সালাত নষ্ট হয়ে যাবে। এই সময়ে দাঁড়ানো অবস্থায় সকল ইমাম, মুক্তাদী ও একাকী সালাতী সকলের জন্যই সুন্নাত অন্তত একবার (রাব্বানা-, লাকাল ‘হামদ) বলা। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণ এই সময়ে অতিরিক্ত আরো কিছু বাক্য বলতেন। যেমন:-


যিকর নং ৫৩ : দাঁড়ানো অবস্থার যিকর-২

اللَّهُمَّ رَبّنَا لَكَ الْحَمْدُ مِلْءَ السَّمَاوَاتِ وَمِلْءَ الْأَرْضِ وَمِلْءَ مَا بَيْنَهُمَا وَمِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَيْءٍ بَعْدُ


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, রাব্বানা- লাকাল ‘হামদু, মিলআস সামা-ওয়া-তি ওয়া মিলআল আরদি ওয়া মিলআ মা- বাইনাহুমা, ওয়া মিলআ মা- শি‘তা মিন শাইয়িন বা’অ্দ।

অর্থঃ “হে আল্লাহ, আমাদের প্রভু, আপনার জন্যই প্রশংসা, আকাশসমূহ পরিপূর্ণ করে, পৃথিবী পরিপূর্ণ করে, উভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সব পরিপূর্ণ করে এবং এরপর আপনি যা কিছু ইচ্ছা করেন তা পরিপূর্ণ করে প্রশংসা আপনার।”

আব্দুল্লাহ ইবনু আবী আউফা, ইবনু আব্বাস, আলী (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবী বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) রুকু থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এই বাক্যগুলি বলতেন।[1]

যিকর নং ৫৪ : দাঁড়ানো অবস্থার যিকর-৩

اللَّهُمَّ رَبّنَا لَكَ الْحَمْدُ مِلْءَ السَّمَاوَاتِ وَمِلْءَ الْأَرْضِ وَمِلْءَ مَا بَيْنَهُمَا وَمِلْءَ مَا شِئْتَ مِنْ شَيْءٍ بَعْدُ أَهْلَ الثَّنَاءِ وَالْمَجْدِ لَا مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلَا مُعْطِيَ لِمَا مَنَعْتَ وَلَا يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ


উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, রাব্বানা- লাকাল ‘হামদু, মিলআস সামা-ওয়া-তি ওয়া মিলআল আরদি ওয়া মিলআ মা- বাইনাহুমা, ওয়া মিলআ মা- শি‘তা মিন শাইয়িন বা’অ্দ, আহলাস সানা-ই ওয়াল মাজদি। লা- মা-নি‘আ লিমা- আ‘অ্ত্বাইতা, ওয়ালা- মু‘অ্ত্বিয়া লিমা- মানা‘অ্তা, ওয়ালা- ইয়ানফা‘উ যাল জাদ্দি মিনকাল জাদ্দু।

অর্থ: “হে আল্লাহ, আমাদের প্রভু, আপনার জন্যই প্রশংসা, আকাশসমূহ পরিপূর্ণ করে, পৃথিবী পরিপূর্ণ করে, উভয়ের মধ্যে যা কিছু আছে সব পরিপূর্ণ করে এবং এরপর আপনি যা কিছু ইচ্ছা করেন তা পরিপূর্ণ করে প্রশংসা আপনার। সকল মর্যাদা ও প্রশংসার মালিক আপনিই। আপনি যা প্রদান করেন তা কেউ রোধ করতে পারে না। আর আপনি যা রোধ করেন তা কেউ প্রদান করতে পারে না। অধ্যবসায়ীর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমকারীর পরিশ্রম আপনার পরিবর্তে (আপনার ইচ্ছার বাইরে) তার কোনো উপকারে আসে না।”[2]


যিকর নং ৫৫ : দাঁড়ানো অবস্থার যিকর-৪

رَبَّنَا وَلَكَ الْحَمْدُ ، حَمْدًا كَثِيرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيهِ


উচ্চারণ: রাব্বানা- ওয়া লাকাল ‘হামদু, ‘হামদান কাসীরান ত্বাইয়িবান মুবা-রাকান ফীহি।

অর্থ: “হে আমাদের প্রভু, এবং আপনারই প্রশংসা, অশেষ প্রশংসা, পবিত্র ও বরকতময় প্রশংসা।”

রিফাআহ ইবনু রাফি (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে এই সময়ে এই বাক্যগুলি বলতে শুনে খুব প্রশংসা করে বলেন: আমি দেখলাম ত্রিশের অধিক ফিরিশতা বাক্যগুলি লিখে নেওয়ার জন্য পাল্লা দিচেছ।[3]

[1] সহীহ মুসলিম ১/৩৪৬, ৩৪৭, ৫৩৪-৫৩৫, নং ৪৭৬, ৪৭৭, ৪৭৮, ৭৭১।

[2] সহীহ মুসলিম ১/৩৪৩, নং ৪৭১।

[3] সহীহ ইবনু খুযাইমা ১/৩১১, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫/২৩৬, মুসতাদরাক হাকিম ১/৩৪৮।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩৮ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 পরের পাতা »